চলমান ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনে সহিংসতা থামছেই না। তৃতীয় ধাপের ভোট শেষ হলেও থামছে না সংঘাত। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে মাঠ প্রশাসনের বৈঠকে আর সহিংসতা হবে না আশ্বস্ত করার পরও সংঘাত, হামলা, ভাঙচুর ও প্রাণহানি কমেনি। গত রোববার তৃতীয় ধাপে নির্বাচনী সংঘাত, সহিংসতায় বিজিবি সদস্যসহ ১১ জন নিহত হয়েছেন।
প্রথম ধাপ থেকে শুরু করে একের পর এক নির্বাচনী সহিংসতায় মৃত্যুর মিছিল যেন ভারি ও বড় হচ্ছে। এই নির্বাচন নিয়ে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ চলছেই। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন অনেকে।
প্রথম ধাপের নির্বাচনে পাঁচজন নিহত ও অনেকে আহত হওয়ার খবরের পর দ্বিতীয় ধাপে এসে মনে করা হয়েছিল এবার পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ না হলেও অন্তত অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব হবে। তবে প্রথম ধাপের ইউপি নির্বাচনে সহিংসতার চেয়ে দ্বিতীয় ধাপে নির্বাচনী সহিংসতা বেড়েছে অনেক বেশি। দ্বিতীয় ধাপের ভোটের দিন মারা গেছেন সাতজন। আহত হয়েছিলেন শতাধিক নেতাকর্মী, সমর্থকসহ সাধারণ মানুষ। দ্বিতীয় ধাপের সহিংসতার রেশ না কাটতেই তৃতীয় ধাপে এসে নির্বাচনী সংঘাত, সহিংসতায় বিজিবি সদস্যসহ নিহত হয়েছেন ১১ জন। তিন ধাপের ভোটের আগে-পরে মিলে মোট প্রাণহানি ঘটেছে ৬৫ জনের। প্রথম দ্বিতীয় এবং সব শেষ তৃতীয় ধাপে এসেও নির্বাচন সহিংসতা এড়াতে পারেনি প্রশাসন।
প্রতিটি ধাপেই গুলিবর্ষণ ও বোমাবাজির মতো ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষ থামাতে পুলিশকেও গুলি ছুড়তে হয়েছে। মারামারি, সংঘর্ষ, গোলাগুলি, ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ছিনতাই জালভোটের মধ্য দিয়ে প্রথম দ্বীতিয় ধাপের মতো শেষ হলো তৃতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচন।
জাল ভোট ব্যালট ছিনতাই ও বর্জনের মধ্য দিয়ে গত রোববার শেষ হয়েছে তৃতীয় ধাপে ৯৮৬টি ইউনিয়ন পরিষদ ও অষ্টম ধাপের ৯টি পৌরসভায় নির্বাচন। কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ছিনতাই ও প্রকাশ্যে সিল মারার ঘটনা ঘটেছে নীলফামারী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, নেত্রকোনা, সাতক্ষীরা, ফেনীসহ অনেক এলাকায়। ভোটকেন্দ্র দখলসহ নানা অনিয়মের কারণে ২১টি কেন্দ্রে ভোট স্থগিত করা হয়েছে। নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে বিজিবি সদস্য, লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে এক ছাত্রলীগ নেতা, নরসিংদীতে তিনজন, মুন্সীগঞ্জে দুইজন, ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে দুইজন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া ভোটের আগের রাতে সহিংসতায় আহত দুজনের মৃত্যু হয়েছে।
প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য থেকে জানা যায়Ñ চরফ্যাসনে তৃতীয়ধাপে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পরবর্তী পৃথক ১০টি সহিংসতার ঘটনায় ৭৫ জন আহত হয়েছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বসতঘর এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ও নির্বাচনী অফিসে নির্বিচারে হামলা ভাঙচুর এবং লুটের ঘটনা ঘটেছে। গত রোববার সন্ধ্যায় ভোটের ফল ঘোষণার পর থেকে গতকাল দুপুর ২টা পর্যন্ত এসব হামলার ঘটনায় আহত ৭৫ জনকে চরফ্যাসনের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে নারী ও শিশুরাও আছেন। চর মানিকার ৭নং ওয়ার্ডের লোকমান বাড়ি এবং রসূলপুরের ৫নং ওয়ার্ডের মাজেদের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করেছে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ। সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে।
জানা গেছে, রসূলপুর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের সাধারণ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা সমান হওয়ার খবরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় টিউবওয়েল প্রতীকের প্রার্থী কামাল খানের কর্মী-সমর্থকরা প্রতিপক্ষ তালা প্রতীকের প্রার্থী শাহ আলম বেপারীর বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করে। এই হামলায় শাহ আলম বেপারীর জামাতা আবদুল আলী, ছোট ভাই হেলাল, নাতি রাহাদ, ভাগনি রীমা, পুত্রবধূ সুমা ও রাবেয়া, কর্মী আরিফ আহত হন। ভাঙচুর করা হয় শাহ আলম বেপারীর নির্বাচনী অফিসও। এ ছাড় আবদুল্লাহপুর ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের বিজয়ী প্রার্থী ইউসুফের সমর্থকদের ওপর পরাজিত প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা হামলা করেছে।
একই ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের পরাজিত প্রার্থী আবুল কালাম সর্দারের কর্মীদের ওপর হামলা করে বিজয়ী প্রার্থী খালেক সিদারের কর্মীরা। ফলাফল প্রকাশের পরপর এই হামলার ঘটনা ঘটে। ওই ইউনিয়নের বিজয়ী প্রার্থী মাকসুদ বকসীর কর্মীকে কুপিয়েছে পরাজিত প্রার্থী কবির ফরাজির কর্মীরা। চর মানিকার ৯নং ওয়ার্ডের বিজয়ী প্রার্থী কামাল চৌধুরীর কর্মীরা পরাজিত প্রার্থী ইব্রাহীম কাজীর কর্মীদের ওপর হামলা করেছে। পরাজিত মেম্বার প্রার্থীর এজেন্ট মনিরকে পিটিয়ে জখম করেছে বিজয়ী প্রার্থী গিয়াস উদ্দিনের কর্মীরা। রসূলপুর ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের পরাজিত মেম্বার প্রার্থী হেলাল খানের ভাই সালাউদ্দিনকে মারধর করেছে বিজয়ী প্রার্থী কাশেম মোল্লার কর্মীরা।
মুন্সীগঞ্জে নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর সহিংসতার ঘটনায় দুইজন নিহত হয়েছেন। নিহতরা হলেনÑ চরাঞ্চলের বাংলাবাজারে শাকিল (১৭) ও পঞ্চসারে রিয়াজুল শেখ (৬০)। সংঘর্ষে কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছে। নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর এ ঘটনা ঘটে।
বাংলাবাজরের নিহত শাকিল কাচিকাটা গ্রামের হারুন মোল্লার ছেলে ও রিয়াজুল শেখ পঞ্চসারের গোসাইবাগ এলাকার মৃত আলতাফ উদ্দিন শেখের ছেলে। এ সময় কমপক্ষে আরও ১০ জন আহত হয়েছে।
অন্যদিকে একই সময় শহরের উপকণ্ঠ পঞ্চসারের গোসাইবাগ এলাকায় জয়ী হওয়া আনারস প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলম মোস্তফার কর্মী-সমর্থকদের হামলায় অন্য স্বতন্ত্র বিএনপির প্রার্থী টেলিফোন প্রতীকের সমর্থক রিয়াজুল শেখ নামের একজন নিহত হয়েছেন। এ সময় এখানেও ১০ জনের মতো আহত হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মুন্সীগঞ্জ সদর থানার ওসি মো. আবু বক্কর সিদ্দিক এসব হত্যাকা-ের দ্রুত তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন।
পঞ্চসার ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড সহ-সভাপতি ও নৌকার সমর্থকের বাড়িতে গুলি ও ককটেল নিক্ষেপ করা হয়েছে। অন্যদিকে মিরেশ^রাই কবির হোসেন ও সালাউদ্দিনের বাড়িসহ ২০-৩০টি বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছে। গতকাল মোক্তারপুরে খাজা বাহাউদ্দিনের নিজ বাড়িতে এই গুলি ও ককটেলে নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।
বাড়ির মালিক খাজা বাহাউদ্দিন জানান, ৪-৫ জনের একটি দল তার কক্ষ লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এদের মধ্যে একজনকে চিনতে পেরেছেন বলে জানিয়ে বলেন, গুলি ও ককটেল নিক্ষেপ করতে আসা একজন হলো মৃত সবুজের ছেলে মুসা (৪০)। সাংবাদিকদের জানালে আরও বড় ধরনের ক্ষতি করারও হুমকি প্রদান করেন সন্ত্রাসীরা। এখন নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে এই পরিবারটি।
শহরের উপকণ্ঠ পঞ্চসারের গোসাইবাগ এলাকায় নির্বাচন শেষে জয়ী হওয়া আনারস প্রতীকের স্বতন্ত প্রার্থী গোলম মোস্তফার কর্মী সর্মথকদের হামলায় অন্য স্বতন্ত্র বিএনপির প্রার্থী টেলিফোন প্রতীকের সমর্থক রিয়াজুল শেখ নামের একজন নিহত হয়েছেন। এ সময় এখানেও ১০ জনের মতো আহত হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পঞ্চসার ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের বিজয়ী প্রার্থী ইমরান মেম্বারের ছোট ভাই মাদক সম্রাট ও সন্ত্রাসী সম্রাট (২৮) পরাজিত প্রার্থীর সমর্থক স্বপনকে (৩৮) পিটিয়ে হাত পা ভেঙে দেয়ার অভিযোগ করেছেন সুমন। সন্ত্রাসী ও অস্ত্রবাজ সম্রাট দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্র বহন করে এবং মাদক ব্যবসা করে আসছে বলে এলাকায় চাউর রয়েছে। এ ঘটনায় তিনজন আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া নজির হালদারের ছেলে বিপ্লব হালদারসহ দুইজনকে খাসকান্দি গ্রামের একটি মসজিদ থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমণ দেব বলেন, ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে। ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়েছে। অভিযোগ পেলে আইনগত্য ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলেন তিনি। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। এ ঘটনায় নজির হালদারের ছেলে বিপ্লবসহ দুজনকে মসজিদের ইমামের কক্ষ থেকে আটক করে। তবে এ ব্যাপারে কোন পক্ষই অভিযোগ করেনি।
যশোরের শার্শা উপজেলার বাগআঁচড়া ইউনিয়নে নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতায় শতাধিক বাড়িঘর ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। গত রোববার রাতে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিজয় মিছিল থেকে এ হামলা চালানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী ইলিয়াস কবির বকুলকে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্র্থী আনারস প্রতীকের আবদুল খালেক। ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি, নৌকায় ভোট দেয়ায় তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্র্থী আনারস প্রতীকের আবদুল খালেকের কর্মী-সমর্থকরা।
যশোরের শার্শা উপজেলার বাগআঁচড়া ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড ২নং কলোনির তাসলিমা বেগমের স্বামী জামাল হোসেনকে না পেয়ে তাসলিমার ঘর ভাঙচুর করে কোলের দেড় মাসের বাচ্চাকে আছার দিয়ে মেরা ফেলার হুমকি দিয়ে হামলাকারীরা বলে, ‘নৌকায় ভোট দিস! বাচ্চা দে, আছাড় মেরে দিই, তাইলে তোর স্বামীর খোঁজ পাওয়া যাবে!’ হাত পা ধরে নিজের ও সন্তানের প্রাণ বাঁচিয়েছেন বলে জানান তাসলিমা।
ট্রলিচালক মিঠুন হোসেনের স্ত্রী জেসমিন খাতুন বললেন, তাদের বাড়ি ও দোকান ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। তার ছেলেকে জবাই করার দেয়ার হুমকি দিয়ে গেছে। ভয়ে স্বামী বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, ভোটগণনা শেষে রোববার রাতে ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড ২নং কলোনিতে আনারস প্রতীকের বিজয় মিছিল বের হয়। মিছিল শেষে ফেরার পথে নৌকার সমর্থকদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এই পাড়াতেই অন্তত দশটি বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। ভাঙচুর করা হয়েছে দোকানপাট, মিনিবাস, ইজিবাইক, মোটরসাইকেল। আহত হয়েছে অন্তত দশজন। এলাকার পুরুষরা ভয়ে পালিয়ে গেছে। ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় ওই বাড়িগুলোতে নারী ও শিশুরা অবস্থান করছেন।
ওই এলাকার বৃদ্ধ গনি পাঠান জানান, তার ছেলে সুখচান নৌকায় ভোট দেয়ায় তার বাড়ির সামনে বোমা মেরেছে। কুপিয়ে পিটিয়ে ভাঙচুর করেছে টিনের ঘর। ধারদেনা করে ঘরটি তৈরি করেছেন, এখনও দেনাও শোধ হয়নি। নাসির উদ্দিনের স্ত্রী নুরনাহার অভিযোগ করেন, আবদুল খালেকের লোকজন সন্ত্রাসীদের ভাড়া করে নিয়ে এসে হামলা চালিয়েছে। হামলাকারীদের সাথে দু’জন পুলিশও ছিল। কিন্তু তারা কোন ভূমিকা রাখেনি বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
মঙ্গলবার, ৩০ নভেম্বর ২০২১ , ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪২৮ ২৪ রবিউস সানি ১৪৪৩
নিজস্ব বার্তা পরিবেশক
চলমান ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনে সহিংসতা থামছেই না। তৃতীয় ধাপের ভোট শেষ হলেও থামছে না সংঘাত। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে মাঠ প্রশাসনের বৈঠকে আর সহিংসতা হবে না আশ্বস্ত করার পরও সংঘাত, হামলা, ভাঙচুর ও প্রাণহানি কমেনি। গত রোববার তৃতীয় ধাপে নির্বাচনী সংঘাত, সহিংসতায় বিজিবি সদস্যসহ ১১ জন নিহত হয়েছেন।
প্রথম ধাপ থেকে শুরু করে একের পর এক নির্বাচনী সহিংসতায় মৃত্যুর মিছিল যেন ভারি ও বড় হচ্ছে। এই নির্বাচন নিয়ে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ চলছেই। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন অনেকে।
প্রথম ধাপের নির্বাচনে পাঁচজন নিহত ও অনেকে আহত হওয়ার খবরের পর দ্বিতীয় ধাপে এসে মনে করা হয়েছিল এবার পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ না হলেও অন্তত অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব হবে। তবে প্রথম ধাপের ইউপি নির্বাচনে সহিংসতার চেয়ে দ্বিতীয় ধাপে নির্বাচনী সহিংসতা বেড়েছে অনেক বেশি। দ্বিতীয় ধাপের ভোটের দিন মারা গেছেন সাতজন। আহত হয়েছিলেন শতাধিক নেতাকর্মী, সমর্থকসহ সাধারণ মানুষ। দ্বিতীয় ধাপের সহিংসতার রেশ না কাটতেই তৃতীয় ধাপে এসে নির্বাচনী সংঘাত, সহিংসতায় বিজিবি সদস্যসহ নিহত হয়েছেন ১১ জন। তিন ধাপের ভোটের আগে-পরে মিলে মোট প্রাণহানি ঘটেছে ৬৫ জনের। প্রথম দ্বিতীয় এবং সব শেষ তৃতীয় ধাপে এসেও নির্বাচন সহিংসতা এড়াতে পারেনি প্রশাসন।
প্রতিটি ধাপেই গুলিবর্ষণ ও বোমাবাজির মতো ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষ থামাতে পুলিশকেও গুলি ছুড়তে হয়েছে। মারামারি, সংঘর্ষ, গোলাগুলি, ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ছিনতাই জালভোটের মধ্য দিয়ে প্রথম দ্বীতিয় ধাপের মতো শেষ হলো তৃতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচন।
জাল ভোট ব্যালট ছিনতাই ও বর্জনের মধ্য দিয়ে গত রোববার শেষ হয়েছে তৃতীয় ধাপে ৯৮৬টি ইউনিয়ন পরিষদ ও অষ্টম ধাপের ৯টি পৌরসভায় নির্বাচন। কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ছিনতাই ও প্রকাশ্যে সিল মারার ঘটনা ঘটেছে নীলফামারী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, নেত্রকোনা, সাতক্ষীরা, ফেনীসহ অনেক এলাকায়। ভোটকেন্দ্র দখলসহ নানা অনিয়মের কারণে ২১টি কেন্দ্রে ভোট স্থগিত করা হয়েছে। নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে বিজিবি সদস্য, লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে এক ছাত্রলীগ নেতা, নরসিংদীতে তিনজন, মুন্সীগঞ্জে দুইজন, ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে দুইজন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া ভোটের আগের রাতে সহিংসতায় আহত দুজনের মৃত্যু হয়েছে।
প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য থেকে জানা যায়Ñ চরফ্যাসনে তৃতীয়ধাপে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পরবর্তী পৃথক ১০টি সহিংসতার ঘটনায় ৭৫ জন আহত হয়েছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বসতঘর এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ও নির্বাচনী অফিসে নির্বিচারে হামলা ভাঙচুর এবং লুটের ঘটনা ঘটেছে। গত রোববার সন্ধ্যায় ভোটের ফল ঘোষণার পর থেকে গতকাল দুপুর ২টা পর্যন্ত এসব হামলার ঘটনায় আহত ৭৫ জনকে চরফ্যাসনের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে নারী ও শিশুরাও আছেন। চর মানিকার ৭নং ওয়ার্ডের লোকমান বাড়ি এবং রসূলপুরের ৫নং ওয়ার্ডের মাজেদের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করেছে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ। সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে।
জানা গেছে, রসূলপুর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের সাধারণ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা সমান হওয়ার খবরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় টিউবওয়েল প্রতীকের প্রার্থী কামাল খানের কর্মী-সমর্থকরা প্রতিপক্ষ তালা প্রতীকের প্রার্থী শাহ আলম বেপারীর বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করে। এই হামলায় শাহ আলম বেপারীর জামাতা আবদুল আলী, ছোট ভাই হেলাল, নাতি রাহাদ, ভাগনি রীমা, পুত্রবধূ সুমা ও রাবেয়া, কর্মী আরিফ আহত হন। ভাঙচুর করা হয় শাহ আলম বেপারীর নির্বাচনী অফিসও। এ ছাড় আবদুল্লাহপুর ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের বিজয়ী প্রার্থী ইউসুফের সমর্থকদের ওপর পরাজিত প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা হামলা করেছে।
একই ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের পরাজিত প্রার্থী আবুল কালাম সর্দারের কর্মীদের ওপর হামলা করে বিজয়ী প্রার্থী খালেক সিদারের কর্মীরা। ফলাফল প্রকাশের পরপর এই হামলার ঘটনা ঘটে। ওই ইউনিয়নের বিজয়ী প্রার্থী মাকসুদ বকসীর কর্মীকে কুপিয়েছে পরাজিত প্রার্থী কবির ফরাজির কর্মীরা। চর মানিকার ৯নং ওয়ার্ডের বিজয়ী প্রার্থী কামাল চৌধুরীর কর্মীরা পরাজিত প্রার্থী ইব্রাহীম কাজীর কর্মীদের ওপর হামলা করেছে। পরাজিত মেম্বার প্রার্থীর এজেন্ট মনিরকে পিটিয়ে জখম করেছে বিজয়ী প্রার্থী গিয়াস উদ্দিনের কর্মীরা। রসূলপুর ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের পরাজিত মেম্বার প্রার্থী হেলাল খানের ভাই সালাউদ্দিনকে মারধর করেছে বিজয়ী প্রার্থী কাশেম মোল্লার কর্মীরা।
মুন্সীগঞ্জে নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর সহিংসতার ঘটনায় দুইজন নিহত হয়েছেন। নিহতরা হলেনÑ চরাঞ্চলের বাংলাবাজারে শাকিল (১৭) ও পঞ্চসারে রিয়াজুল শেখ (৬০)। সংঘর্ষে কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছে। নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর এ ঘটনা ঘটে।
বাংলাবাজরের নিহত শাকিল কাচিকাটা গ্রামের হারুন মোল্লার ছেলে ও রিয়াজুল শেখ পঞ্চসারের গোসাইবাগ এলাকার মৃত আলতাফ উদ্দিন শেখের ছেলে। এ সময় কমপক্ষে আরও ১০ জন আহত হয়েছে।
অন্যদিকে একই সময় শহরের উপকণ্ঠ পঞ্চসারের গোসাইবাগ এলাকায় জয়ী হওয়া আনারস প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলম মোস্তফার কর্মী-সমর্থকদের হামলায় অন্য স্বতন্ত্র বিএনপির প্রার্থী টেলিফোন প্রতীকের সমর্থক রিয়াজুল শেখ নামের একজন নিহত হয়েছেন। এ সময় এখানেও ১০ জনের মতো আহত হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মুন্সীগঞ্জ সদর থানার ওসি মো. আবু বক্কর সিদ্দিক এসব হত্যাকা-ের দ্রুত তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন।
পঞ্চসার ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড সহ-সভাপতি ও নৌকার সমর্থকের বাড়িতে গুলি ও ককটেল নিক্ষেপ করা হয়েছে। অন্যদিকে মিরেশ^রাই কবির হোসেন ও সালাউদ্দিনের বাড়িসহ ২০-৩০টি বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছে। গতকাল মোক্তারপুরে খাজা বাহাউদ্দিনের নিজ বাড়িতে এই গুলি ও ককটেলে নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।
বাড়ির মালিক খাজা বাহাউদ্দিন জানান, ৪-৫ জনের একটি দল তার কক্ষ লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এদের মধ্যে একজনকে চিনতে পেরেছেন বলে জানিয়ে বলেন, গুলি ও ককটেল নিক্ষেপ করতে আসা একজন হলো মৃত সবুজের ছেলে মুসা (৪০)। সাংবাদিকদের জানালে আরও বড় ধরনের ক্ষতি করারও হুমকি প্রদান করেন সন্ত্রাসীরা। এখন নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে এই পরিবারটি।
শহরের উপকণ্ঠ পঞ্চসারের গোসাইবাগ এলাকায় নির্বাচন শেষে জয়ী হওয়া আনারস প্রতীকের স্বতন্ত প্রার্থী গোলম মোস্তফার কর্মী সর্মথকদের হামলায় অন্য স্বতন্ত্র বিএনপির প্রার্থী টেলিফোন প্রতীকের সমর্থক রিয়াজুল শেখ নামের একজন নিহত হয়েছেন। এ সময় এখানেও ১০ জনের মতো আহত হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পঞ্চসার ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের বিজয়ী প্রার্থী ইমরান মেম্বারের ছোট ভাই মাদক সম্রাট ও সন্ত্রাসী সম্রাট (২৮) পরাজিত প্রার্থীর সমর্থক স্বপনকে (৩৮) পিটিয়ে হাত পা ভেঙে দেয়ার অভিযোগ করেছেন সুমন। সন্ত্রাসী ও অস্ত্রবাজ সম্রাট দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্র বহন করে এবং মাদক ব্যবসা করে আসছে বলে এলাকায় চাউর রয়েছে। এ ঘটনায় তিনজন আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া নজির হালদারের ছেলে বিপ্লব হালদারসহ দুইজনকে খাসকান্দি গ্রামের একটি মসজিদ থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমণ দেব বলেন, ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে। ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়েছে। অভিযোগ পেলে আইনগত্য ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলেন তিনি। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। এ ঘটনায় নজির হালদারের ছেলে বিপ্লবসহ দুজনকে মসজিদের ইমামের কক্ষ থেকে আটক করে। তবে এ ব্যাপারে কোন পক্ষই অভিযোগ করেনি।
যশোরের শার্শা উপজেলার বাগআঁচড়া ইউনিয়নে নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতায় শতাধিক বাড়িঘর ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। গত রোববার রাতে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিজয় মিছিল থেকে এ হামলা চালানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী ইলিয়াস কবির বকুলকে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্র্থী আনারস প্রতীকের আবদুল খালেক। ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি, নৌকায় ভোট দেয়ায় তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্র্থী আনারস প্রতীকের আবদুল খালেকের কর্মী-সমর্থকরা।
যশোরের শার্শা উপজেলার বাগআঁচড়া ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড ২নং কলোনির তাসলিমা বেগমের স্বামী জামাল হোসেনকে না পেয়ে তাসলিমার ঘর ভাঙচুর করে কোলের দেড় মাসের বাচ্চাকে আছার দিয়ে মেরা ফেলার হুমকি দিয়ে হামলাকারীরা বলে, ‘নৌকায় ভোট দিস! বাচ্চা দে, আছাড় মেরে দিই, তাইলে তোর স্বামীর খোঁজ পাওয়া যাবে!’ হাত পা ধরে নিজের ও সন্তানের প্রাণ বাঁচিয়েছেন বলে জানান তাসলিমা।
ট্রলিচালক মিঠুন হোসেনের স্ত্রী জেসমিন খাতুন বললেন, তাদের বাড়ি ও দোকান ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। তার ছেলেকে জবাই করার দেয়ার হুমকি দিয়ে গেছে। ভয়ে স্বামী বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, ভোটগণনা শেষে রোববার রাতে ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড ২নং কলোনিতে আনারস প্রতীকের বিজয় মিছিল বের হয়। মিছিল শেষে ফেরার পথে নৌকার সমর্থকদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এই পাড়াতেই অন্তত দশটি বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। ভাঙচুর করা হয়েছে দোকানপাট, মিনিবাস, ইজিবাইক, মোটরসাইকেল। আহত হয়েছে অন্তত দশজন। এলাকার পুরুষরা ভয়ে পালিয়ে গেছে। ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় ওই বাড়িগুলোতে নারী ও শিশুরা অবস্থান করছেন।
ওই এলাকার বৃদ্ধ গনি পাঠান জানান, তার ছেলে সুখচান নৌকায় ভোট দেয়ায় তার বাড়ির সামনে বোমা মেরেছে। কুপিয়ে পিটিয়ে ভাঙচুর করেছে টিনের ঘর। ধারদেনা করে ঘরটি তৈরি করেছেন, এখনও দেনাও শোধ হয়নি। নাসির উদ্দিনের স্ত্রী নুরনাহার অভিযোগ করেন, আবদুল খালেকের লোকজন সন্ত্রাসীদের ভাড়া করে নিয়ে এসে হামলা চালিয়েছে। হামলাকারীদের সাথে দু’জন পুলিশও ছিল। কিন্তু তারা কোন ভূমিকা রাখেনি বলেও তিনি অভিযোগ করেন।