বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাঁত কারখানা, দিশেহারা তাঁতিরা

পাবনার জালালপুর তাঁতিপাড়ার বুলবুল হোসেন তার তাঁত কারখানার ৪০টি তাঁতের প্রায় সবগুলো বিক্রি করে বিশাল তাঁতের ঘর ফাঁকা করছেন। কারণ তাকে ব্যবসা পরিবর্তন করতে হবে। একই কারণে সাঁথিয়ার আফতাব নগরের আবদুল মজিদ ইতোমধ্যে তার ৫৬টি তাঁত বন্ধ করে দিয়ে সেখানে গবাদি পশুর খামার করেছেন।

বুলবুল জানান, কারখানা চালালে তাকে দুইভাবে লোকসান গুনতে হবে। চড়া দামে সুতা রং কিনে কাপড় তৈরি করে লোকসান দিয়ে বাজারে বিক্রি করতে হবে, পাশাপাশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। সে কারণে কারখানা বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করার পাশাপাশি নতুন ব্যবসার চেষ্টা করতে হচ্ছে তাকে।

একই এলাকার তাঁত ব্যবসায়ী আজিজুল হাকিম জানান, তার কারখানার ২৪টি তাঁতের মধ্যে ইতোমধ্যে ১২টি তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। ১২টি তাঁত চালাতে হচ্ছে লোকসান দিয়ে। তাঁত কারখানার পাশে একটি মুদি দোকান দিয়ে জীবিকার জন্য প্রাণান্তর চেষ্টা করছেন তিনি।

আজিজুল জানান, করোনায় প্রায় এক বছরের বেশি সময় লোকসান দিয়ে কারখানা চালু রেখেছিলেন। করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ার পর নতুন আশায় বুক বেঁধে ব্যবসা শুরু করে সীমাহীন লোকসান হয়েছে। এখন বাপ-দাদার ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন তিনি।

জালালপুর তাঁতিপাড়া এলাকার সর্বত্রই এখন একই অবস্থা। ক্রমাগত লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে তাঁত কারখানাগুলো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁতিরা। পাবনার অন্যতম বৃহত্তম তাঁত সমৃদ্ধ এলাকা জালালপুরের ৫ হাজার তাঁতের মধ্যে এখন মাত্র দেড় থেকে দুই হাজার তাঁত চলছে। সাঁথিয়ার প্রায় ৭ হাজার তাঁতের মধ্যে চালু আছে প্রায় ২ হাজার।

অধিকাংশ প্রান্তিক তাঁতি ইতোমধ্যে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে, বড় ব্যবসায়ীরা অর্ধেকের বেশি তাঁত বন্ধ রেখে কোনরকম তাদের কারখানা চালু রেখেছে, যে কোন সময় বন্ধ হতে পারে পুরো তাঁত।

তাঁত শ্রমিক আজিজ ও আবদুর রউফ জানান, তিনি যে কারখানায় কাজ করেন সেখানে ৩৪টি তাঁতের বেশিরভাগই বন্ধ হয়ে গেছে, বেকার হয়ে পড়েছে অনেক শ্রমিক। মাত্র কয়েকজন শ্রমিক এখন ১৩টি তাঁত চালাচ্ছে, তবে মালিক বলেছে, আগামী মাস থেকে এগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে। তাঁতগুলো বন্ধ হয়ে গেলে বেকার হতে হবে। এর পর কিভাবে সংসার চলবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে দরিদ্র তাঁত শ্রমিকরা।

তাঁতিরা জানান, গত তিন/চার মাসে লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে সুতার দাম। সুতার দাম ইতোমধ্যে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, সে সঙ্গে বাড়ছে রং, কেমিক্যালসহ তাঁত কারখানার সব কাঁচামালের দাম। তবে দাম বাড়েনি তাঁত কাপড়ের। এ অবস্থায় লোকসান দিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারছেন না তাঁতিরা।

তাঁতিরা জানান, বর্তমানে প্রতি পাউন্ড ৮০ কাউন্ট সুতা বিক্রি হচ্ছে ৩৪০ থেকে ৩৬০ টাকা, অথচ কয়েক মাস আগেও এই সুতার দাম ছিল মাত্র ১৮০ থেকে ২০০ টাকা পাউন্ড। একইভাবে ৬০ কাউন্ট সুতা বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৩০ টাকা পাউন্ড, যা কয়েক মাস আগেও ছিল ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকা পাউন্ড। এছাড়া ৪০ কাউন্ট সুতা বিক্রি হচ্ছে ১৯০ থেকে ২০০ টাকা পাউন্ড, যা কয়েক মাস আগেও ছিল ১২০ থেকে ১৩০ টাকা পাউন্ড।

পাশাপাশি রং-এর দাম বেড়ে হয়েছে প্রায় দিগুণ। ৫ হাজার টাকার চায়না রং এখন ৯ হাজার টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

তাঁতিরা জানান, বর্তমানে ৮০ কাউন্ট সুতার এক থান তাঁতের কাপড় (চারটি লুঙ্গি) তৈরি করতে খরচ হচ্ছে প্রায় ৫ হাজার টাকা, অথচ বাজারে বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ২৪০০ টাকা। সুতার দাম ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও কাপড়ের দাম বেড়েছে থান প্রতি মাত্র ১০০ থেকে ২০০ টাকা।

কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাঁত কারখানাগুলো। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের অন্যতম বৃহত্তম ক্ষুদ্র শিল্প ধ্বংসের মুখে পড়তে পারে এমনটাই আশঙ্কা করছে তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা।

বাংলাদেশ হ্যান্ডলুম অ্যান্ড পাওয়ারলুম মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি মো. হায়দায় আলী বলেন, দেশের অন্যতম বৃহত্তম তাঁতসমৃদ্ধ এলাকা পাবনা ও সিরাজগঞ্জের ৬ লাখ তাঁতের মধ্যে এখন প্রায় ৪ লাখই বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাকি তাঁতগুলো যে কোন সময় বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সুতার দাম হুহু করে বাড়ছে। সুতার বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে মাত্র কয়েকজন আমদানিকারক। ফলে প্রান্তিক তাঁতিদের স্বার্থ সংরক্ষণ হচ্ছে না বলে জানান তিনি। দেশের বৃহত্তম ক্ষুদ্র শিল্প (তাঁত শিল্প) রক্ষার জন্য সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি।

image

পাবনা : জামালপুর তাঁতিপাড়ার একটি তাঁত কারখানায় কর্মরত একজন শ্রমিক -সংবাদ

আরও খবর
২০৪১ সাল নাগাদ বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রয়োজন হবে ৫ হাজার কোটি টাকা
কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ১২৭৫ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে এডিবি
খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য বিদেশ থেকে ডাক্তার আনা যাবে : কাদের
চট্টগ্রাম কারাগারের সাবেক তত্ত্বাবধায়কের বিরুদ্ধে মামলা
প্রতিবাদের মুখে পদ ছাড়লেন শেরপুর আ’লীগের সা. সম্পাদক
১৮ বছরের ধৈর্যের দৃষ্টান্ত জালাল উদ্দীন
সড়কে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ
রাজারবাগের পীরসহ ৪ জনকে বিবাদী করার আবেদন
প্রার্থী তালিকায় প্রাধান্য পেয়েছে মহিলা-তরুণ ও সংখ্যালঘু
আরও দুই আসামি জিসান ও অন্তু গ্রেপ্তার
ইউপি নির্বাচনে চর দখলের মতো কেন্দ্র দখল হচ্ছে জিএম কাদের

মঙ্গলবার, ৩০ নভেম্বর ২০২১ , ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪২৮ ২৪ রবিউস সানি ১৪৪৩

বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাঁত কারখানা, দিশেহারা তাঁতিরা

হাবিবুর রহমান স্বপন, পাবনা

image

পাবনা : জামালপুর তাঁতিপাড়ার একটি তাঁত কারখানায় কর্মরত একজন শ্রমিক -সংবাদ

পাবনার জালালপুর তাঁতিপাড়ার বুলবুল হোসেন তার তাঁত কারখানার ৪০টি তাঁতের প্রায় সবগুলো বিক্রি করে বিশাল তাঁতের ঘর ফাঁকা করছেন। কারণ তাকে ব্যবসা পরিবর্তন করতে হবে। একই কারণে সাঁথিয়ার আফতাব নগরের আবদুল মজিদ ইতোমধ্যে তার ৫৬টি তাঁত বন্ধ করে দিয়ে সেখানে গবাদি পশুর খামার করেছেন।

বুলবুল জানান, কারখানা চালালে তাকে দুইভাবে লোকসান গুনতে হবে। চড়া দামে সুতা রং কিনে কাপড় তৈরি করে লোকসান দিয়ে বাজারে বিক্রি করতে হবে, পাশাপাশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। সে কারণে কারখানা বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করার পাশাপাশি নতুন ব্যবসার চেষ্টা করতে হচ্ছে তাকে।

একই এলাকার তাঁত ব্যবসায়ী আজিজুল হাকিম জানান, তার কারখানার ২৪টি তাঁতের মধ্যে ইতোমধ্যে ১২টি তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। ১২টি তাঁত চালাতে হচ্ছে লোকসান দিয়ে। তাঁত কারখানার পাশে একটি মুদি দোকান দিয়ে জীবিকার জন্য প্রাণান্তর চেষ্টা করছেন তিনি।

আজিজুল জানান, করোনায় প্রায় এক বছরের বেশি সময় লোকসান দিয়ে কারখানা চালু রেখেছিলেন। করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ার পর নতুন আশায় বুক বেঁধে ব্যবসা শুরু করে সীমাহীন লোকসান হয়েছে। এখন বাপ-দাদার ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন তিনি।

জালালপুর তাঁতিপাড়া এলাকার সর্বত্রই এখন একই অবস্থা। ক্রমাগত লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে তাঁত কারখানাগুলো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁতিরা। পাবনার অন্যতম বৃহত্তম তাঁত সমৃদ্ধ এলাকা জালালপুরের ৫ হাজার তাঁতের মধ্যে এখন মাত্র দেড় থেকে দুই হাজার তাঁত চলছে। সাঁথিয়ার প্রায় ৭ হাজার তাঁতের মধ্যে চালু আছে প্রায় ২ হাজার।

অধিকাংশ প্রান্তিক তাঁতি ইতোমধ্যে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে, বড় ব্যবসায়ীরা অর্ধেকের বেশি তাঁত বন্ধ রেখে কোনরকম তাদের কারখানা চালু রেখেছে, যে কোন সময় বন্ধ হতে পারে পুরো তাঁত।

তাঁত শ্রমিক আজিজ ও আবদুর রউফ জানান, তিনি যে কারখানায় কাজ করেন সেখানে ৩৪টি তাঁতের বেশিরভাগই বন্ধ হয়ে গেছে, বেকার হয়ে পড়েছে অনেক শ্রমিক। মাত্র কয়েকজন শ্রমিক এখন ১৩টি তাঁত চালাচ্ছে, তবে মালিক বলেছে, আগামী মাস থেকে এগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে। তাঁতগুলো বন্ধ হয়ে গেলে বেকার হতে হবে। এর পর কিভাবে সংসার চলবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে দরিদ্র তাঁত শ্রমিকরা।

তাঁতিরা জানান, গত তিন/চার মাসে লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে সুতার দাম। সুতার দাম ইতোমধ্যে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, সে সঙ্গে বাড়ছে রং, কেমিক্যালসহ তাঁত কারখানার সব কাঁচামালের দাম। তবে দাম বাড়েনি তাঁত কাপড়ের। এ অবস্থায় লোকসান দিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারছেন না তাঁতিরা।

তাঁতিরা জানান, বর্তমানে প্রতি পাউন্ড ৮০ কাউন্ট সুতা বিক্রি হচ্ছে ৩৪০ থেকে ৩৬০ টাকা, অথচ কয়েক মাস আগেও এই সুতার দাম ছিল মাত্র ১৮০ থেকে ২০০ টাকা পাউন্ড। একইভাবে ৬০ কাউন্ট সুতা বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৩০ টাকা পাউন্ড, যা কয়েক মাস আগেও ছিল ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকা পাউন্ড। এছাড়া ৪০ কাউন্ট সুতা বিক্রি হচ্ছে ১৯০ থেকে ২০০ টাকা পাউন্ড, যা কয়েক মাস আগেও ছিল ১২০ থেকে ১৩০ টাকা পাউন্ড।

পাশাপাশি রং-এর দাম বেড়ে হয়েছে প্রায় দিগুণ। ৫ হাজার টাকার চায়না রং এখন ৯ হাজার টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

তাঁতিরা জানান, বর্তমানে ৮০ কাউন্ট সুতার এক থান তাঁতের কাপড় (চারটি লুঙ্গি) তৈরি করতে খরচ হচ্ছে প্রায় ৫ হাজার টাকা, অথচ বাজারে বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ২৪০০ টাকা। সুতার দাম ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও কাপড়ের দাম বেড়েছে থান প্রতি মাত্র ১০০ থেকে ২০০ টাকা।

কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাঁত কারখানাগুলো। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের অন্যতম বৃহত্তম ক্ষুদ্র শিল্প ধ্বংসের মুখে পড়তে পারে এমনটাই আশঙ্কা করছে তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা।

বাংলাদেশ হ্যান্ডলুম অ্যান্ড পাওয়ারলুম মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি মো. হায়দায় আলী বলেন, দেশের অন্যতম বৃহত্তম তাঁতসমৃদ্ধ এলাকা পাবনা ও সিরাজগঞ্জের ৬ লাখ তাঁতের মধ্যে এখন প্রায় ৪ লাখই বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাকি তাঁতগুলো যে কোন সময় বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সুতার দাম হুহু করে বাড়ছে। সুতার বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে মাত্র কয়েকজন আমদানিকারক। ফলে প্রান্তিক তাঁতিদের স্বার্থ সংরক্ষণ হচ্ছে না বলে জানান তিনি। দেশের বৃহত্তম ক্ষুদ্র শিল্প (তাঁত শিল্প) রক্ষার জন্য সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি।