শিক্ষা বিস্তারে সরকারিকরণ

অমিত রায় চৌধুরী

ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে শিক্ষার চরিত্র ও উদ্দেশ্যে এক ধরনের মিল দেখা যায়। কোন শাসকেরই লক্ষ্য সাধারণ মানুষ ছিল না। বাণিজ্যের স্বার্থে ব্রিটিশরাজের লক্ষ্য ছিল একটা ইংরেজি জানা অভিজাত শ্রেণী তৈরি করা। অন্যদিকে পাকিস্তানের শিক্ষা সংকোচন নীতি ছিল খুবই দৃষ্টিকটু। পশ্চিমা এলিট শ্রেণী ও এদেশীয় ধনিক শ্রেণীর বৃত্তে শিক্ষাকে আবদ্ধ রাখার কৌশল এদেশের ছাত্রজনতাকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন ছাত্র জনতার তীব্র অসন্তোষের ঐতিহাসিক দলিল। কার্যত ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে এই অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা আন্দোলন শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতিকে জাগ্রত করেছিল। বহু আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তা অর্জিত। সামন্তশ্রেণি মুষ্টিমেয় মানুষকে শিক্ষা দিতে চেয়েছে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তা পারে না। শিক্ষার অধিকার সর্বজনীন। এই অধিকার নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু বিখ্যাত শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষায় একটি গণমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নেন যার ভিত্তি ছিল বিজ্ঞান। প্রত্যাশা ছিল প্রকৃত শিক্ষায় মানুষ হবে একতাবদ্ধ। মনুষ্যত্বে উত্তীর্ণ। সৃষ্টি হবে সামাজিক দায়বদ্ধতা। মানুষ শিখবে শুধু নিজের স্বার্থে নয়, আমজনতার ঘামের পয়সায় লব্ধ শিক্ষার ফল ভোগ করবে রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। বঙ্গবন্ধু সেটাই চেয়েছিলেন।

এখন প্রশ্ন হলো শিক্ষার উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রের অংশগ্রহণ কতটা জরুরি। সাদা চোখে দেখা যায় প্রতিষ্ঠান সরকারি হলে শিক্ষার ব্যয় কমে, সুবিধা বাড়ে, ভালো শিক্ষকের সান্নিধ্যের সুযোগ সৃষ্টি হয়, শিক্ষার অবকাঠামো ও পরিবেশ উন্নীত হয়। জ্ঞানভাণ্ডারের ঐশ্বর্য থেকে কোন গোষ্ঠী বঞ্চিত হলে সমাজের সুষম বিকাশ সম্ভব হয় না। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বিনিয়োগ বহুগুণে সমাজ প্রগতির শর্ত তৈরি করে। তবে রাষ্ট্রের এই অংশীদারত্বকে অবশ্যই হতে হবে সুষম ও সুপরিকল্পিত। দেখা গেছে-অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে রাষ্ট্র। শিক্ষার্থীদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে নিয়ে আসার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু নানা স্তরে বিভাজিত ও বৈষম্যদীর্ণ শিক্ষাক্রম ও ব্যবস্থাগুলো সুস্থ সামাজিক বিকাশের পথে আগাগোড়াই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবে বর্তমান সরকার উপজেলাভিত্তিক একটি করে স্কুল ও কলেজ সরকারিকরণের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার মধ্য দিয়ে দেশে একটি বৈষম্যহীন ও অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্য সম্পূর্ণ পূরণ না হলেও অন্তত ন্যূনতম একটা কাঠামোভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনার ছাপ দেখা যায়। এত বড় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ অতীতে দেখা যায়নি। স্বাধীনতার আগে সরকারি কলেজ ছিল ৯৭টি। এখন তা ৬৫০-এর কাছাকাছি। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দেড় শতাধিক। মেডিকেল কলেজ ১১৫। সরকারি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ১৭টি। ইতোমধ্যেই ৬৫,০০০-এরও বেশি প্রাইমারি স্কুলকে সরকারি করা হয়েছে। ৬৩৪টি স্কুল-কলেজ সরকারিকরণের প্রক্রিয়া বর্তমানে চালু আছে। নতুন করে সরকারি স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে। শিক্ষা উপমন্ত্রী বলেছেন-পর্যায়ক্রমে সরকারিকরণের এই নীতি অব্যাহত থাকবে। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে পেশাগত বৈষম্য দ্রুত কমিয়ে আনা হবে।

জাতীয়করণের লক্ষ্যে পরিদর্শন শুরু হয়েছে ২০১৪ সাল হতে। স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর হয়েছে। কাগজপত্র যাচাই-বাছাই চলছে। চলার কথা। প্রথমত শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা অনেক এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের নিয়োগ ত্রুটিপূর্ণ। এই ত্রুটির দায় কোন বিশেষ প্রতিষ্ঠান বা পরিচালনা কমিটির নয়। স্রেফ এর দায় বিদ্যমান চর্চা, অনুশীলনের প্রেক্ষিত ও ব্যবস্থার। এ কথা হলফ করে খুব কম প্রতিষ্ঠান বলতে পারে যে, তার প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর প্রক্রিয়াগত কোন ত্রুটি নেই। তবে লাখ টাকার প্রশ্ন হলো-এর সঙ্গে যুক্ত কে বা কারা? উত্তর অত্যন্ত স্পর্শকাতর। যুগ যুগ ধরে একটা অসুস্থ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীরা নিযুক্ত হয়েছে। এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি এমনকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পর্যন্ত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে একটি অশুভ বৃত্তের দূষিত প্রক্রিয়ায় এদের নিয়োগ। অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয় চাইছে-এদের কাগজপত্র যাচাই করতে। করার কথা ন্যায্যত। এর থেকে বড় কথা তারা জানে-এসব কাগজপত্রের ত্রুটি কোথায়। কারণ তাদের বিভিন্ন শ্রেণীর সহকর্মীরা এসব প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয়-এরা চাইছে সব প্রতিষ্ঠান তার সব সংরক্ষিত ডকুমেন্ট এমনকি মূল রেজ্যুলিউশনসহ কার্যত গোটা অফিস হাজির করুক তাদের টেবিলে। কোন কাগজপত্রের সত্যায়নে তাদের বিশ্বাস নেই, আস্থা নেই। তারা খুব ভালো করেই চেনে, জানে-এসব সত্যায়নকারী কারা। তারা এর থেকে ভালো জানে-কীভাবে এসব প্রক্রিয়া চলে। তাই এদের এত অবিশ্বাস। এজন্য বছরের পর বছর ধরে চলে যাচাই। এতবড় দুর্ভাগ্য এর চেয়ে আর কি হতে পারে? তবে এটা ঠিক-এ পদ্ধতিতে কোন দুর্নীতির কথা অন্তত এবার শোনা যায়নি, এটাই এ উদ্যোগের বড় সাফল্য।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে-যেসব প্রতিষ্ঠানে পরিদর্শন হয়েছে ২০১৪ সালে, তারা সাত বছর পার করল। শিক্ষক-কর্মচারীর পদ সৃজনে দেরি হোক, নিখুঁতভাবে যাচাই হোক, কোনরকম ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে ব্যবস্থা নেয়া হোক। এসব ব্যাপারে আপত্তির কোন জায়গা নেই। মুশকিল হলো এমনিতেই এদেশে যে কথা প্রতিষ্ঠিত, তা হলো-কোন ভালো প্রতিষ্ঠান সরকারি হলে-সে প্রতিষ্ঠান সুনাম হারায়। এর কারণ বিভিন্ন। পুরোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থাও প্রায় এক। শিক্ষক ভালো থাকলেও লেখাপড়া ভালো হয়না, শিক্ষার্থীও তার ওপর নির্ভর করে না।

সদ্য সরকারিকরণের ফলে সৃষ্ট এই নড়বড়ে অবস্থার শিকার ছাত্র-ছাত্রীরা। বিশেষকরে অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা ভীষণ অপরিকল্পিত ও সারবত্তাহীন। যেখানে কার্যত কোন আইনানুগ কর্তৃপক্ষ নেই। প্রতিষ্ঠান প্রধান ও একজন সরকারি কর্মকর্তার যৌথ স্বাক্ষরে নৈমিত্তিক ব্যয় নির্বাহ করা হচ্ছে। এখানেই শেষ। অনেক শিক্ষক অবসরে যাচ্ছেন। শূন্যপদে নিয়োগের সুযোগ নেই। কোর সাবজেক্টে শিক্ষক না থাকলে দৃশ্যত শিক্ষার্থী দিশাহীন। বড় সমস্যা হলো প্রতিষ্ঠানের কোথাও দায়বদ্ধতা নেই। প্রতিষ্ঠান প্রধান নিজস্ব দায়, বিচার-বুদ্ধি ও কাণ্ডজ্ঞান প্রয়োগ করে প্রতিষ্ঠান চালিয়ে নিচ্ছেন। এখানে কোন পরিচালনা কমিটিও নেই। অন্যদিকে শিক্ষক-কর্মচারীর এসিআর বাস্তবায়নের সুযোগও সীমিত। প্রতিষ্ঠান প্রধানও কার্যত দায়মুক্ত।

যেহেতু সরকারিকরণের বিষয়টি একটি সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া, প্রথমেই দরকার ছিল অ্যাডহক কোন ব্যবস্থাপনা; যা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করবে। যেহেতু শিক্ষক-কর্মচারীর এখনও পদায়ন হয়নি, সেজন্য তারা চাকরিবিধির প্রচলিত শৃঙ্খলাচক্রে প্রবেশ করেননি। অন্যদিকে তারা কোন স্থানীয় ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছেও দায়বদ্ধ নয়। সুতরাং তারা স্বাধীন। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের দেশের বাস্তবতায় এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কতজন শিক্ষক আছেন যারা বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ। ন্যূনতম পুঁজির বিনিময়ে যখন সর্বোচ্চ মুনাফার মেকিয়াভেলিয়ান দর্শন সমাজে চালকের আসনে, সেখানে ভোগ, স্বার্থপরতা ও সুবিধাবাদের প্রাধান্যই বেশি। এখান থেকে ত্যাগ, দায়িত্বশীলতা ও দেশপ্রেম আশা করা খুব উচ্চাশা হবে না তো? যদি না হয়, তবে এত বিরাট সংখ্যক শিক্ষার্থী, যারা এসব প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত, তাদের প্রতি আমরা কি সুবিচার করছি-এ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

শিক্ষককে ভালো ছাত্র হতে হবে। পেশায় আগ্রহও থাকতে হবে। মর্যাদা থাকতে হবে। এর সঙ্গে প্রয়োজন পড়বে নজরদারি। প্রচলিত তদারকি ব্যবস্থার পরিপূরক হিসেবে সামাজিক তত্ত্বাবধান দরকার। নিষ্ঠাবান, দায়িত্বশীল জনপ্রতিনিধি, অভিভাবককে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের অংশগ্রহণে তদারকি প্রক্রিয়া ফলপ্রসূ হতে পারে। শিক্ষকদের প্রতি মাসে বিষয়ভিত্তিক মূল্যায়ন হতে হবে। একটি উন্নত দেশের উপযোগী প্রযুক্তিতে প্রবেশ করতে গেলে মেধাবী, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ও নিষ্ঠাশীল শ্রেষ্ঠ সন্তানদেরই এই মহৎ পেশায় আসতে হবে। শুধু শহরে না, বিস্তীর্ণ গ্রামেও তাদের ভীষণ প্রয়োজন। যারা চাকরিতে ইতোমধ্যে এসে পেেড়ছেন, তাদের উপযুক্ত জায়গায় স্থানান্তর করা যাবে; তবে কিছুতেই শিক্ষকতায় আপস করা যায় না। মর্যাদা ও বেতনও শিক্ষকদের জন্য মানানসই হতে হবে।

নতুন কারিকুলাম, নতুন চাহিদা, নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা-সব প্রেক্ষিতই বিবেচনায় নিতে হবে। কীভাবে নব্য ধনীর দুলালরা ঘামঝরানো পয়সায় পড়াশোনা করে বিদেশে পাড়ি জমায়-তা দেখতে হবে। অপচয় রুখতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতেই হবে। শিক্ষার মানোন্নয়নে মেধাবী, নিষ্ঠাবান, প্রশিক্ষিত শিক্ষকের জন্য উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। একমুখী শিক্ষা এই মুহূর্তে সম্ভব না হলেও পাঠ্যবস্তুকে তীক্ষè নজরদারিতে আনতে হবে। পাঠ্যসূচিতে ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্যকলার পাশাপাশি গণিতকেও গুরুত্ব দিতে হবে। প্রযুক্তির উৎকর্ষ না ঘটাতে পারলে নতুন বিশ্ব পরিস্থিতিতে আমরা পিছিয়েই পড়ব। তাই সবরকম বৈষম্য ও বিভক্তি দূর করে দেশের সার্বিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করতে হবে। একই যোগ্যতাসম্পন্ন নাগরিক যাতে রাষ্ট্রের কাছ থেকে সমান সুবিধা পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে অসাম্য ও বঞ্চনার বোধে কেউ আক্রান্ত হবে না। নয়া সুবিধাবাদ বিকাশের পথও রুদ্ধ হবে। একই সঙ্গে ঔপনিবেশিক ক্যাডার মানসিকতা ঝেড়ে ফেলে সরকারি শিক্ষকরা যাতে গবেষণা ও পেশায় নিবেদিত হন সেজন্য অবশ্যই শক্ত তদারকি থাকতে হবে। একজন শিক্ষক কতটা মেধাবী, কতটা যোগ্য তার প্রমাণ তার সৃষ্টিশীলতায়, নৈতিক পরিশীলতায়, মুক্তবুদ্ধির সুস্থতায়। আরোপিত কোন পদ-পদবি শিক্ষকের কৌলীন্যের পরিমাপ করে না।

[লেখক : অধ্যক্ষ, সরকারি ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়, ফকিরহাট, বাগেরহাট]

মঙ্গলবার, ৩০ নভেম্বর ২০২১ , ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪২৮ ২৪ রবিউস সানি ১৪৪৩

শিক্ষা বিস্তারে সরকারিকরণ

অমিত রায় চৌধুরী

ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে শিক্ষার চরিত্র ও উদ্দেশ্যে এক ধরনের মিল দেখা যায়। কোন শাসকেরই লক্ষ্য সাধারণ মানুষ ছিল না। বাণিজ্যের স্বার্থে ব্রিটিশরাজের লক্ষ্য ছিল একটা ইংরেজি জানা অভিজাত শ্রেণী তৈরি করা। অন্যদিকে পাকিস্তানের শিক্ষা সংকোচন নীতি ছিল খুবই দৃষ্টিকটু। পশ্চিমা এলিট শ্রেণী ও এদেশীয় ধনিক শ্রেণীর বৃত্তে শিক্ষাকে আবদ্ধ রাখার কৌশল এদেশের ছাত্রজনতাকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন ছাত্র জনতার তীব্র অসন্তোষের ঐতিহাসিক দলিল। কার্যত ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে এই অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা আন্দোলন শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতিকে জাগ্রত করেছিল। বহু আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তা অর্জিত। সামন্তশ্রেণি মুষ্টিমেয় মানুষকে শিক্ষা দিতে চেয়েছে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তা পারে না। শিক্ষার অধিকার সর্বজনীন। এই অধিকার নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু বিখ্যাত শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষায় একটি গণমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নেন যার ভিত্তি ছিল বিজ্ঞান। প্রত্যাশা ছিল প্রকৃত শিক্ষায় মানুষ হবে একতাবদ্ধ। মনুষ্যত্বে উত্তীর্ণ। সৃষ্টি হবে সামাজিক দায়বদ্ধতা। মানুষ শিখবে শুধু নিজের স্বার্থে নয়, আমজনতার ঘামের পয়সায় লব্ধ শিক্ষার ফল ভোগ করবে রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। বঙ্গবন্ধু সেটাই চেয়েছিলেন।

এখন প্রশ্ন হলো শিক্ষার উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রের অংশগ্রহণ কতটা জরুরি। সাদা চোখে দেখা যায় প্রতিষ্ঠান সরকারি হলে শিক্ষার ব্যয় কমে, সুবিধা বাড়ে, ভালো শিক্ষকের সান্নিধ্যের সুযোগ সৃষ্টি হয়, শিক্ষার অবকাঠামো ও পরিবেশ উন্নীত হয়। জ্ঞানভাণ্ডারের ঐশ্বর্য থেকে কোন গোষ্ঠী বঞ্চিত হলে সমাজের সুষম বিকাশ সম্ভব হয় না। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বিনিয়োগ বহুগুণে সমাজ প্রগতির শর্ত তৈরি করে। তবে রাষ্ট্রের এই অংশীদারত্বকে অবশ্যই হতে হবে সুষম ও সুপরিকল্পিত। দেখা গেছে-অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে রাষ্ট্র। শিক্ষার্থীদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে নিয়ে আসার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু নানা স্তরে বিভাজিত ও বৈষম্যদীর্ণ শিক্ষাক্রম ও ব্যবস্থাগুলো সুস্থ সামাজিক বিকাশের পথে আগাগোড়াই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবে বর্তমান সরকার উপজেলাভিত্তিক একটি করে স্কুল ও কলেজ সরকারিকরণের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার মধ্য দিয়ে দেশে একটি বৈষম্যহীন ও অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্য সম্পূর্ণ পূরণ না হলেও অন্তত ন্যূনতম একটা কাঠামোভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনার ছাপ দেখা যায়। এত বড় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ অতীতে দেখা যায়নি। স্বাধীনতার আগে সরকারি কলেজ ছিল ৯৭টি। এখন তা ৬৫০-এর কাছাকাছি। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দেড় শতাধিক। মেডিকেল কলেজ ১১৫। সরকারি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ১৭টি। ইতোমধ্যেই ৬৫,০০০-এরও বেশি প্রাইমারি স্কুলকে সরকারি করা হয়েছে। ৬৩৪টি স্কুল-কলেজ সরকারিকরণের প্রক্রিয়া বর্তমানে চালু আছে। নতুন করে সরকারি স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে। শিক্ষা উপমন্ত্রী বলেছেন-পর্যায়ক্রমে সরকারিকরণের এই নীতি অব্যাহত থাকবে। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে পেশাগত বৈষম্য দ্রুত কমিয়ে আনা হবে।

জাতীয়করণের লক্ষ্যে পরিদর্শন শুরু হয়েছে ২০১৪ সাল হতে। স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর হয়েছে। কাগজপত্র যাচাই-বাছাই চলছে। চলার কথা। প্রথমত শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা অনেক এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের নিয়োগ ত্রুটিপূর্ণ। এই ত্রুটির দায় কোন বিশেষ প্রতিষ্ঠান বা পরিচালনা কমিটির নয়। স্রেফ এর দায় বিদ্যমান চর্চা, অনুশীলনের প্রেক্ষিত ও ব্যবস্থার। এ কথা হলফ করে খুব কম প্রতিষ্ঠান বলতে পারে যে, তার প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর প্রক্রিয়াগত কোন ত্রুটি নেই। তবে লাখ টাকার প্রশ্ন হলো-এর সঙ্গে যুক্ত কে বা কারা? উত্তর অত্যন্ত স্পর্শকাতর। যুগ যুগ ধরে একটা অসুস্থ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীরা নিযুক্ত হয়েছে। এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি এমনকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পর্যন্ত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে একটি অশুভ বৃত্তের দূষিত প্রক্রিয়ায় এদের নিয়োগ। অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয় চাইছে-এদের কাগজপত্র যাচাই করতে। করার কথা ন্যায্যত। এর থেকে বড় কথা তারা জানে-এসব কাগজপত্রের ত্রুটি কোথায়। কারণ তাদের বিভিন্ন শ্রেণীর সহকর্মীরা এসব প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয়-এরা চাইছে সব প্রতিষ্ঠান তার সব সংরক্ষিত ডকুমেন্ট এমনকি মূল রেজ্যুলিউশনসহ কার্যত গোটা অফিস হাজির করুক তাদের টেবিলে। কোন কাগজপত্রের সত্যায়নে তাদের বিশ্বাস নেই, আস্থা নেই। তারা খুব ভালো করেই চেনে, জানে-এসব সত্যায়নকারী কারা। তারা এর থেকে ভালো জানে-কীভাবে এসব প্রক্রিয়া চলে। তাই এদের এত অবিশ্বাস। এজন্য বছরের পর বছর ধরে চলে যাচাই। এতবড় দুর্ভাগ্য এর চেয়ে আর কি হতে পারে? তবে এটা ঠিক-এ পদ্ধতিতে কোন দুর্নীতির কথা অন্তত এবার শোনা যায়নি, এটাই এ উদ্যোগের বড় সাফল্য।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে-যেসব প্রতিষ্ঠানে পরিদর্শন হয়েছে ২০১৪ সালে, তারা সাত বছর পার করল। শিক্ষক-কর্মচারীর পদ সৃজনে দেরি হোক, নিখুঁতভাবে যাচাই হোক, কোনরকম ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে ব্যবস্থা নেয়া হোক। এসব ব্যাপারে আপত্তির কোন জায়গা নেই। মুশকিল হলো এমনিতেই এদেশে যে কথা প্রতিষ্ঠিত, তা হলো-কোন ভালো প্রতিষ্ঠান সরকারি হলে-সে প্রতিষ্ঠান সুনাম হারায়। এর কারণ বিভিন্ন। পুরোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থাও প্রায় এক। শিক্ষক ভালো থাকলেও লেখাপড়া ভালো হয়না, শিক্ষার্থীও তার ওপর নির্ভর করে না।

সদ্য সরকারিকরণের ফলে সৃষ্ট এই নড়বড়ে অবস্থার শিকার ছাত্র-ছাত্রীরা। বিশেষকরে অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা ভীষণ অপরিকল্পিত ও সারবত্তাহীন। যেখানে কার্যত কোন আইনানুগ কর্তৃপক্ষ নেই। প্রতিষ্ঠান প্রধান ও একজন সরকারি কর্মকর্তার যৌথ স্বাক্ষরে নৈমিত্তিক ব্যয় নির্বাহ করা হচ্ছে। এখানেই শেষ। অনেক শিক্ষক অবসরে যাচ্ছেন। শূন্যপদে নিয়োগের সুযোগ নেই। কোর সাবজেক্টে শিক্ষক না থাকলে দৃশ্যত শিক্ষার্থী দিশাহীন। বড় সমস্যা হলো প্রতিষ্ঠানের কোথাও দায়বদ্ধতা নেই। প্রতিষ্ঠান প্রধান নিজস্ব দায়, বিচার-বুদ্ধি ও কাণ্ডজ্ঞান প্রয়োগ করে প্রতিষ্ঠান চালিয়ে নিচ্ছেন। এখানে কোন পরিচালনা কমিটিও নেই। অন্যদিকে শিক্ষক-কর্মচারীর এসিআর বাস্তবায়নের সুযোগও সীমিত। প্রতিষ্ঠান প্রধানও কার্যত দায়মুক্ত।

যেহেতু সরকারিকরণের বিষয়টি একটি সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া, প্রথমেই দরকার ছিল অ্যাডহক কোন ব্যবস্থাপনা; যা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করবে। যেহেতু শিক্ষক-কর্মচারীর এখনও পদায়ন হয়নি, সেজন্য তারা চাকরিবিধির প্রচলিত শৃঙ্খলাচক্রে প্রবেশ করেননি। অন্যদিকে তারা কোন স্থানীয় ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছেও দায়বদ্ধ নয়। সুতরাং তারা স্বাধীন। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের দেশের বাস্তবতায় এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কতজন শিক্ষক আছেন যারা বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ। ন্যূনতম পুঁজির বিনিময়ে যখন সর্বোচ্চ মুনাফার মেকিয়াভেলিয়ান দর্শন সমাজে চালকের আসনে, সেখানে ভোগ, স্বার্থপরতা ও সুবিধাবাদের প্রাধান্যই বেশি। এখান থেকে ত্যাগ, দায়িত্বশীলতা ও দেশপ্রেম আশা করা খুব উচ্চাশা হবে না তো? যদি না হয়, তবে এত বিরাট সংখ্যক শিক্ষার্থী, যারা এসব প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত, তাদের প্রতি আমরা কি সুবিচার করছি-এ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

শিক্ষককে ভালো ছাত্র হতে হবে। পেশায় আগ্রহও থাকতে হবে। মর্যাদা থাকতে হবে। এর সঙ্গে প্রয়োজন পড়বে নজরদারি। প্রচলিত তদারকি ব্যবস্থার পরিপূরক হিসেবে সামাজিক তত্ত্বাবধান দরকার। নিষ্ঠাবান, দায়িত্বশীল জনপ্রতিনিধি, অভিভাবককে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের অংশগ্রহণে তদারকি প্রক্রিয়া ফলপ্রসূ হতে পারে। শিক্ষকদের প্রতি মাসে বিষয়ভিত্তিক মূল্যায়ন হতে হবে। একটি উন্নত দেশের উপযোগী প্রযুক্তিতে প্রবেশ করতে গেলে মেধাবী, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ও নিষ্ঠাশীল শ্রেষ্ঠ সন্তানদেরই এই মহৎ পেশায় আসতে হবে। শুধু শহরে না, বিস্তীর্ণ গ্রামেও তাদের ভীষণ প্রয়োজন। যারা চাকরিতে ইতোমধ্যে এসে পেেড়ছেন, তাদের উপযুক্ত জায়গায় স্থানান্তর করা যাবে; তবে কিছুতেই শিক্ষকতায় আপস করা যায় না। মর্যাদা ও বেতনও শিক্ষকদের জন্য মানানসই হতে হবে।

নতুন কারিকুলাম, নতুন চাহিদা, নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা-সব প্রেক্ষিতই বিবেচনায় নিতে হবে। কীভাবে নব্য ধনীর দুলালরা ঘামঝরানো পয়সায় পড়াশোনা করে বিদেশে পাড়ি জমায়-তা দেখতে হবে। অপচয় রুখতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতেই হবে। শিক্ষার মানোন্নয়নে মেধাবী, নিষ্ঠাবান, প্রশিক্ষিত শিক্ষকের জন্য উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। একমুখী শিক্ষা এই মুহূর্তে সম্ভব না হলেও পাঠ্যবস্তুকে তীক্ষè নজরদারিতে আনতে হবে। পাঠ্যসূচিতে ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্যকলার পাশাপাশি গণিতকেও গুরুত্ব দিতে হবে। প্রযুক্তির উৎকর্ষ না ঘটাতে পারলে নতুন বিশ্ব পরিস্থিতিতে আমরা পিছিয়েই পড়ব। তাই সবরকম বৈষম্য ও বিভক্তি দূর করে দেশের সার্বিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করতে হবে। একই যোগ্যতাসম্পন্ন নাগরিক যাতে রাষ্ট্রের কাছ থেকে সমান সুবিধা পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে অসাম্য ও বঞ্চনার বোধে কেউ আক্রান্ত হবে না। নয়া সুবিধাবাদ বিকাশের পথও রুদ্ধ হবে। একই সঙ্গে ঔপনিবেশিক ক্যাডার মানসিকতা ঝেড়ে ফেলে সরকারি শিক্ষকরা যাতে গবেষণা ও পেশায় নিবেদিত হন সেজন্য অবশ্যই শক্ত তদারকি থাকতে হবে। একজন শিক্ষক কতটা মেধাবী, কতটা যোগ্য তার প্রমাণ তার সৃষ্টিশীলতায়, নৈতিক পরিশীলতায়, মুক্তবুদ্ধির সুস্থতায়। আরোপিত কোন পদ-পদবি শিক্ষকের কৌলীন্যের পরিমাপ করে না।

[লেখক : অধ্যক্ষ, সরকারি ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়, ফকিরহাট, বাগেরহাট]