কৌতুক অভিনেতা আনিস ভাই

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা আনিসুর রহমান আনিস ২৮ এপ্রিল, ২০১৯ তারিখ রোববার রাত ১১টায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অভয়দাস লেনস্থ তার নিজ বাসায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। তার কিডনির ক্রিয়েটিনাইন সামান্য বেশি ছিল, এছাড়া আর কোন মারাত্মক রোগ তার ছিল না। ২০১৩ সনে তার স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি একাই বাসায় থাকতেন। তার দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে ফারহা দীবা থাকে আমেরিকায়, ছোট মেয়ে ফাতেমা রহমান রিমি থাকে কুমিল্লায়। অভয়দাস লেনের টিকাটুলী জামে মসজিদে তার প্রথম জানাজায় শরিক হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। তাকে তার গ্রামের বাড়ি ফেনীর ছাগলনাইয়া থানার বল্লভপুরে মায়ের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়। তার বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ির দূরত্ব চার মাইলের বেশি হবে না। তার ছোট মেয়ে রিমির সঙ্গে আমার ভাতিজা শিমুলের বিয়ে হওয়ার পর আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠে।

বাবার ব্যবসার কারণে আনিস ভাইয়ের জন্ম ১৯৪০ সনে জলপাইগুড়িতে। তবে তার স্কুল জীবনের লেখাপড়া শুরু গ্রামের স্কুলে ফেনীর বল্লভপুরে। আনিস ভাই আড়াই শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন। ১৯৬০ সনে তার অভিনীত ‘বিষকন্যা’ ছবিটি মুক্তি পায়নি; তাই ১৯৬৩ সনে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘এই তো জীবন’ই তার প্রথম ছবি। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এ চ্যানেলে অভিনয় করেছেন। নবাব সিরাজদ্দৌলা নাটকে গোলাম হোসেন চরিত্রে অভিনয় করে তিনি ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। বাংলা সিনেমায় খ্যাতিমান কৌতুক অভিনেতাদের মধ্যে এখন আর কেউ বেঁচে নেই। কয়েক দিন পূর্বে বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা আবদুস সামাদ বা টেলি সামাদও মারা গেছেন। বাংলা চলচ্চিত্রে প্রায় একই সময়ে রবিউল ইসলাম, খান জয়নুল, আশীষ কুমার লৌহ, আনিসুর রহমান আনিস, এটিএম শামসুজ্জামান, সুজা খন্দকার, সাইফুদ্দিন আহমেদ, নাজমুল হুদা বাচ্চু, ব্লাক আনোয়ার, দিলদার, হাসমতের মতো কৌতুক অভিনেতাদের আবির্ভাব হয়েছিল। এটিএম শামছুজ্জমান ব্যতীত এখন আর কেউ বেঁচে নেই, খবরে দেখলাম তার অবস্থাও সংকটাপন্ন।

মানুষের একটি জীবনে হাসির তুলনায় কান্না একটু বেশি। সুস্থভাবে জীবনযাপনের জন্য হাস্যরসের প্রয়োজন অপরিহার্য; তাই আজকাল বিভিন্ন পার্কে জোটবদ্ধ হয়ে অনেক বন্ধুকে একত্রে হাসির ব্যায়াম করতে দেখা যায়। সুস্থ জীবন নিয়ে বেশি দিন বেঁচে থাকার এই প্রয়াস হাসির গুরুত্বকে অপরিহার্য করে তোলে। কিন্তু অনেকে মনে করেন, জনসম্মুখে হাসি-কান্নার শব্দ একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব নষ্ট করে থাকে। এজন্য প্রিয়জনের মৃত্যুতেও অনেকে কাঁদেন না; প্রিয়জনের মৃত্যুতে ‘গান্ধী’ সিনেমায় গান্ধীর কান্নার চিত্রটি খেয়াল করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ব্যক্তিত্বের কৃত্রিম আবরণে ঢাকা এ মানুষগুলো হাসির বেগ দমন করেন অনুশীলন করে। অ্যাটিকেট অ্যান্ড ম্যানারের দাপটে কোথাও কোথাও জোরে হাসা কঠিন অপরাধ। তবে ব্যক্তি ও স্থান ভেদে কখনও কখনও অট্টহাসিও গ্রহণযোগ্য হয়। কাজী নজরুল ইসলামের অট্টহাসিতে ছাদ ফেটে গেলেও কেউ সৌজন্যবিরোধী ভাবতো না। কমেডি সাহিত্য মানেই হাস্যরসের ছড়াছড়ি। তবে শিল্পসম্মত কমেডি না হলে ঔচিত্যবোধের ব্যাঘাত ঘটে। কমেডির পরিবেশনে বাংলা সিনেমায় কৌতুক অভিনেতাদের সবাই সমান দক্ষ ছিলেন তা বলা যাবে না। আমার জীবনে প্রথম দেখা সিনেমা ‘বাহার’; এই সিনেমায় শেরেগুল এলেই সিনেমা হলে সবাইকে হাসতে দেখেছি। চলচ্চিত্র বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয় বিধায় কমেডি চলচ্চিত্রের অপরিহার্য উপাদান। নির্বাক চলচ্চিত্রে কৌতুক অভিনেতাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, চলাফেরা, চাল-চলন, অঙ্গ-ভঙ্গি দ্বারা হাসির ফোয়ারার সৃষ্টি হয়। চার্লি চ্যাপলিনকে দেখলেই দর্শক হাসি মুখে সতেজ হতে উঠে; তাকে সংলাপ উচ্চারণ করতে হয় না। তবে উপযোগী সংলাপ পরিবেশনায় বাচনভঙ্গি হাস্যরস সৃষ্টিতে প্রধান অনুষঙ্গ। অনেকে কাতুকুতু দিয়ে হাসানোর কসরত করে থাকেন। ভাঁড় আর কৌতুক অভিনেতা এক নয়; ভাঁড়ামিতে অতি নাটকীয়তা থাকে। সংলাপ, ভাষা, উচ্চারণ আর অভিনেতার অঙ্গভঙ্গি দ্বারা কৌতুক এবং ভাঁড়ামির পার্থক্য দর্শক বুঝতে পারে। তবে দর্শক ভেদে কৌতুক আর ভাঁড়ামির পার্থক্যও ভিন্নতর হয়ে থাকে।

পূর্বোক্ত কৌতুক অভিনেতাগণ তাদের অভিনয় দ্বারা দর্শক মহলে শুধু নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করেননি, অভিনয় নৈপুণ্য দিয়ে আমাদের চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধও করেছেন। কিন্তু ইদানীংকালে চলচ্চিত্রে কৌতুক অভিনেতার আর দেখা যায় না। কৌতুক অভিনেতার অভিব্যক্তি সবার রসাস্বাদনে ভূমিকা রাখলেও নিজে কিন্তু হাসেন না। নিজে না হেসে অন্যকে হাসানোর এ গুণটিই একজন কৌতুক অভিনেতার বড় বৈশিষ্ট্য। সিনেমা বা নাটকে সিরিয়াস বিষয়গুলোর অনবচ্ছিন্ন অবতারণায় সৃষ্ট একঘেয়েমিতে একটু রিলিফ দেয়ার জন্য কৌতুক রসের পরিবেশ করার রীতি এখনও অবলম্বিত হয়। তবে কাহিনীর প্রয়োজন ছাড়া কৌতুকের অবতারণা করা হলে তা খাপছাড়া অশ্লীল ভাঁড়ামিতে পর্যবসিত হয়। সঙ্গতিহীন সংলাপ, সাজসজ্জায় ঔচিত্যবোধের অভাব, দৃষ্টিকটু অঙ্গভঙ্গিও অশ্লীল। যৌন উদ্দীপক সংলাপ বা নায়ক, নায়িকার অন্তরঙ্গ দৃশ্যও অশ্লীল নয় যদি তা কাহিনীর প্রয়োজনে অপরিহার্য বিবেচিত হয়। তাই কাহিনী রচনা ও দৃশ্য পরিকল্পনায় কৌতুকের সন্নিবেশে সস্তা সুড়সুড়ি দেয়ার অপকৌশল পরিহার করা বাঞ্ছনীয়। গল্পে কৌতুকের সমন্বয় ঘটানোর ক্ষেত্রে গল্প রচয়িতার ঔচিত্যবোধ থাকতে হবে, নির্দেশক বা পরিচালকের থাকতে হবে মাত্রাজ্ঞান। মানসম্পন্ন কমেডির দর্শকপ্রিয়তা আগেও ছিল, এখন আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।

চার্লি চ্যাপলিন বা মিস্টার বিন সারা পৃথিবীব্যাপী জনপ্রিয়। আনিস ভাইসহ যাদের নামোল্লেখ করেছি তাদের সবার প্রতিভা ছিল অসামান্য; কিন্তু কাহিনী রচনা ও তার শৈল্পিক উপস্থাপনায় রচয়িতা ও পরিচালকের ব্যর্থতায় আমাদের কোন কৌতুক অভিনেতা বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করতে পারেননি। আনিস ভাইকে শেষের দিকে বেকার বসে থাকতে দেখেছি, সম্ভবত অভিনয় করার কোন ডাকও ছিল না। কমেডি-নির্ভর শিল্পসম্মত কাহিনীও বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি দেখা যায় না। হুমায়ূন আহমেদের কাহিনী বিন্যাস, সংলাপ রচনা ও আবহ সৃষ্টির ঔচিত্যবোধ তুলনাহীন; তার গল্প, উপন্যাস, নাটকে চরিত্র সৃষ্টিতে এবং সংলাপ রচনায় শিল্পসম্মত কৌতুক পাঠক ও দর্শকদের তৃপ্ত করে।

ভারতের নির্বাচনে সিনেমার অভিনেতা, অভিনেত্রীদের দোর্দ- প্রতাপ রয়েছে; দেব, দেবীর চরিত্রে যারা অভিনয় করেন বাস্তব জীবনেও তাদের দেব-দেবী সমজ্ঞানে সম্মান করা হয়। ঈর্ষান্বিত জনপ্রিয়তা নিয়ে জয়ললিতা বহু বছর তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। গোটা দক্ষিণ ভারতেই তিনি ‘আম্মা’ নামে সবার কাছে পরিচিত। তামিলনাড়ুতে তাকে দেবী তুল্য ভক্তি-শ্রদ্ধা করা হতো বলে তার মৃত্যু সহ্য করতে না পেরে অনেকে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গেও অনেক অভিনেতা, অভিনেত্রী সংসদ সদস্য। বাংলাদেশেও দুয়েকজন অভিনেতা, অভিনেত্রী সংসদ সদস্য হয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতে কোন কৌতুক অভিনেতাকে সংসদ নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দল মনোনয়ও দেয়নি। চলচ্চিত্র জগতেও আমাদের দেশে কৌতুক অভিনেতাকে অভিনেতা জ্ঞানে সন্মান ও সম্মানি দেয়া হয় না। সম্প্রতি দুটি দেশে দুজন কৌতুক অভিনেতাকে সরকার ও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে সেই দেশের জনগণ। কৌতুকাভিনেতা ভøাদিমির জেলেনস্কি প্রদত্ত ভোটের ৭০ শতাংশ পেয়ে সম্প্রতি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। লোক হাসানোর পেশা নিয়ে আরেকজন কৌতুক অভিনেতা জিম্মি মোরালস প্রেসিডেন্ট হয়েছেন গুয়াতেমালায়। ব্রিটিশ কমেডিয়ান ইয়ান কগনিটো অভিনয় করার সময় মারা যান; মঞ্চে তার সত্যিকার মৃত্যুকালীন দৃশ্য দেখে দর্শকেরা ভেবেছে তিনি স্ট্রোকের নিখুঁত অভিনয় করছেন; তাই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার পর তার নিখুঁত অভিনয়ে সবাই হাতে তালিও দিয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর দর্শক বুঝতে পারল- ইয়ান সত্যি সত্যি মারা গেছেন। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কৌতুক অভিনেতা ঢাকার ‘পোলা’ পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র ভানু (সৌম্য) বন্দ্যোপাধ্যায় ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, কৃষক-শ্রমিক সবাইর কাছে সমান জনপ্রিয়। সিনেমা, নাটক ছাড়াও ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় দর্শক, শ্রোতাদের জন্য কৌতুক পরিবেশন করে কৌতুককে শিল্পরূপ দিতে সমর্থ হয়েছেন।

হাস্যকৌতুকের মাধ্যমে দর্শক, শ্রোতাদের নির্মল আনন্দ দেয়া সহজ মনে হলেও তা সবচেয়ে কঠিন কাজ। এই কঠিন কাজটি আনিস ভাই অবলীলায় করতে পারতেন। কৌতুক পরিবেশনের কারণে তাকে হাল্কা ধরনের অভিনেতা মনে হলেও তিনি ছিলেন একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন গুরুগম্ভীর লোক। হাসির ফোয়ারা সৃষ্টি করে তিনি আমাদের পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলোকেও প্রাণবন্ত করে তুলতেন। টাঁকশালে আমার মেজ ভাই মহিউদ্দিন আহম্মদ কর্তৃক আয়োজিত প্রতিটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে আনিস ভাই ছিলেন সবার কাক্সিক্ষত ব্যক্তিত্ব; অনুষ্ঠানে তাকে দেখামাত্রই সবাই হাসতে শুরু করে দিতেন। স্বজনের বিপদে-আপদে তিনি ছুটে আসতেন। হাসপাতালে আনিস ভাইকে দেখলে ডাক্তার, নার্সেরা আমাদের আত্মীয়-স্বজন রোগীদের অতিরিক্ত যতœ নিত। বেয়াই বলে আনিস ভাইয়ের সঙ্গে আমার হাসি ঠাট্টার সম্পর্ক ছিল। আনিস ভাইয়ের মৃত্যুতে আমরা আত্মীয়রা একজন দরদি, পরোপকারী ও রসিক লোককে হারালাম, দেশ হারালো একজন জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতাকে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

eauddinahmed@gmail.com

রবিবার, ১৯ মে ২০১৯ , ৫ জৈষ্ঠ্য ১৪২৫, ১৩ রমজান ১৪৪০

কৌতুক অভিনেতা আনিস ভাই

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা আনিসুর রহমান আনিস ২৮ এপ্রিল, ২০১৯ তারিখ রোববার রাত ১১টায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অভয়দাস লেনস্থ তার নিজ বাসায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। তার কিডনির ক্রিয়েটিনাইন সামান্য বেশি ছিল, এছাড়া আর কোন মারাত্মক রোগ তার ছিল না। ২০১৩ সনে তার স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি একাই বাসায় থাকতেন। তার দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে ফারহা দীবা থাকে আমেরিকায়, ছোট মেয়ে ফাতেমা রহমান রিমি থাকে কুমিল্লায়। অভয়দাস লেনের টিকাটুলী জামে মসজিদে তার প্রথম জানাজায় শরিক হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। তাকে তার গ্রামের বাড়ি ফেনীর ছাগলনাইয়া থানার বল্লভপুরে মায়ের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়। তার বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ির দূরত্ব চার মাইলের বেশি হবে না। তার ছোট মেয়ে রিমির সঙ্গে আমার ভাতিজা শিমুলের বিয়ে হওয়ার পর আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠে।

বাবার ব্যবসার কারণে আনিস ভাইয়ের জন্ম ১৯৪০ সনে জলপাইগুড়িতে। তবে তার স্কুল জীবনের লেখাপড়া শুরু গ্রামের স্কুলে ফেনীর বল্লভপুরে। আনিস ভাই আড়াই শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন। ১৯৬০ সনে তার অভিনীত ‘বিষকন্যা’ ছবিটি মুক্তি পায়নি; তাই ১৯৬৩ সনে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘এই তো জীবন’ই তার প্রথম ছবি। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এ চ্যানেলে অভিনয় করেছেন। নবাব সিরাজদ্দৌলা নাটকে গোলাম হোসেন চরিত্রে অভিনয় করে তিনি ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। বাংলা সিনেমায় খ্যাতিমান কৌতুক অভিনেতাদের মধ্যে এখন আর কেউ বেঁচে নেই। কয়েক দিন পূর্বে বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা আবদুস সামাদ বা টেলি সামাদও মারা গেছেন। বাংলা চলচ্চিত্রে প্রায় একই সময়ে রবিউল ইসলাম, খান জয়নুল, আশীষ কুমার লৌহ, আনিসুর রহমান আনিস, এটিএম শামসুজ্জামান, সুজা খন্দকার, সাইফুদ্দিন আহমেদ, নাজমুল হুদা বাচ্চু, ব্লাক আনোয়ার, দিলদার, হাসমতের মতো কৌতুক অভিনেতাদের আবির্ভাব হয়েছিল। এটিএম শামছুজ্জমান ব্যতীত এখন আর কেউ বেঁচে নেই, খবরে দেখলাম তার অবস্থাও সংকটাপন্ন।

মানুষের একটি জীবনে হাসির তুলনায় কান্না একটু বেশি। সুস্থভাবে জীবনযাপনের জন্য হাস্যরসের প্রয়োজন অপরিহার্য; তাই আজকাল বিভিন্ন পার্কে জোটবদ্ধ হয়ে অনেক বন্ধুকে একত্রে হাসির ব্যায়াম করতে দেখা যায়। সুস্থ জীবন নিয়ে বেশি দিন বেঁচে থাকার এই প্রয়াস হাসির গুরুত্বকে অপরিহার্য করে তোলে। কিন্তু অনেকে মনে করেন, জনসম্মুখে হাসি-কান্নার শব্দ একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব নষ্ট করে থাকে। এজন্য প্রিয়জনের মৃত্যুতেও অনেকে কাঁদেন না; প্রিয়জনের মৃত্যুতে ‘গান্ধী’ সিনেমায় গান্ধীর কান্নার চিত্রটি খেয়াল করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ব্যক্তিত্বের কৃত্রিম আবরণে ঢাকা এ মানুষগুলো হাসির বেগ দমন করেন অনুশীলন করে। অ্যাটিকেট অ্যান্ড ম্যানারের দাপটে কোথাও কোথাও জোরে হাসা কঠিন অপরাধ। তবে ব্যক্তি ও স্থান ভেদে কখনও কখনও অট্টহাসিও গ্রহণযোগ্য হয়। কাজী নজরুল ইসলামের অট্টহাসিতে ছাদ ফেটে গেলেও কেউ সৌজন্যবিরোধী ভাবতো না। কমেডি সাহিত্য মানেই হাস্যরসের ছড়াছড়ি। তবে শিল্পসম্মত কমেডি না হলে ঔচিত্যবোধের ব্যাঘাত ঘটে। কমেডির পরিবেশনে বাংলা সিনেমায় কৌতুক অভিনেতাদের সবাই সমান দক্ষ ছিলেন তা বলা যাবে না। আমার জীবনে প্রথম দেখা সিনেমা ‘বাহার’; এই সিনেমায় শেরেগুল এলেই সিনেমা হলে সবাইকে হাসতে দেখেছি। চলচ্চিত্র বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয় বিধায় কমেডি চলচ্চিত্রের অপরিহার্য উপাদান। নির্বাক চলচ্চিত্রে কৌতুক অভিনেতাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, চলাফেরা, চাল-চলন, অঙ্গ-ভঙ্গি দ্বারা হাসির ফোয়ারার সৃষ্টি হয়। চার্লি চ্যাপলিনকে দেখলেই দর্শক হাসি মুখে সতেজ হতে উঠে; তাকে সংলাপ উচ্চারণ করতে হয় না। তবে উপযোগী সংলাপ পরিবেশনায় বাচনভঙ্গি হাস্যরস সৃষ্টিতে প্রধান অনুষঙ্গ। অনেকে কাতুকুতু দিয়ে হাসানোর কসরত করে থাকেন। ভাঁড় আর কৌতুক অভিনেতা এক নয়; ভাঁড়ামিতে অতি নাটকীয়তা থাকে। সংলাপ, ভাষা, উচ্চারণ আর অভিনেতার অঙ্গভঙ্গি দ্বারা কৌতুক এবং ভাঁড়ামির পার্থক্য দর্শক বুঝতে পারে। তবে দর্শক ভেদে কৌতুক আর ভাঁড়ামির পার্থক্যও ভিন্নতর হয়ে থাকে।

পূর্বোক্ত কৌতুক অভিনেতাগণ তাদের অভিনয় দ্বারা দর্শক মহলে শুধু নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করেননি, অভিনয় নৈপুণ্য দিয়ে আমাদের চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধও করেছেন। কিন্তু ইদানীংকালে চলচ্চিত্রে কৌতুক অভিনেতার আর দেখা যায় না। কৌতুক অভিনেতার অভিব্যক্তি সবার রসাস্বাদনে ভূমিকা রাখলেও নিজে কিন্তু হাসেন না। নিজে না হেসে অন্যকে হাসানোর এ গুণটিই একজন কৌতুক অভিনেতার বড় বৈশিষ্ট্য। সিনেমা বা নাটকে সিরিয়াস বিষয়গুলোর অনবচ্ছিন্ন অবতারণায় সৃষ্ট একঘেয়েমিতে একটু রিলিফ দেয়ার জন্য কৌতুক রসের পরিবেশ করার রীতি এখনও অবলম্বিত হয়। তবে কাহিনীর প্রয়োজন ছাড়া কৌতুকের অবতারণা করা হলে তা খাপছাড়া অশ্লীল ভাঁড়ামিতে পর্যবসিত হয়। সঙ্গতিহীন সংলাপ, সাজসজ্জায় ঔচিত্যবোধের অভাব, দৃষ্টিকটু অঙ্গভঙ্গিও অশ্লীল। যৌন উদ্দীপক সংলাপ বা নায়ক, নায়িকার অন্তরঙ্গ দৃশ্যও অশ্লীল নয় যদি তা কাহিনীর প্রয়োজনে অপরিহার্য বিবেচিত হয়। তাই কাহিনী রচনা ও দৃশ্য পরিকল্পনায় কৌতুকের সন্নিবেশে সস্তা সুড়সুড়ি দেয়ার অপকৌশল পরিহার করা বাঞ্ছনীয়। গল্পে কৌতুকের সমন্বয় ঘটানোর ক্ষেত্রে গল্প রচয়িতার ঔচিত্যবোধ থাকতে হবে, নির্দেশক বা পরিচালকের থাকতে হবে মাত্রাজ্ঞান। মানসম্পন্ন কমেডির দর্শকপ্রিয়তা আগেও ছিল, এখন আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।

চার্লি চ্যাপলিন বা মিস্টার বিন সারা পৃথিবীব্যাপী জনপ্রিয়। আনিস ভাইসহ যাদের নামোল্লেখ করেছি তাদের সবার প্রতিভা ছিল অসামান্য; কিন্তু কাহিনী রচনা ও তার শৈল্পিক উপস্থাপনায় রচয়িতা ও পরিচালকের ব্যর্থতায় আমাদের কোন কৌতুক অভিনেতা বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করতে পারেননি। আনিস ভাইকে শেষের দিকে বেকার বসে থাকতে দেখেছি, সম্ভবত অভিনয় করার কোন ডাকও ছিল না। কমেডি-নির্ভর শিল্পসম্মত কাহিনীও বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি দেখা যায় না। হুমায়ূন আহমেদের কাহিনী বিন্যাস, সংলাপ রচনা ও আবহ সৃষ্টির ঔচিত্যবোধ তুলনাহীন; তার গল্প, উপন্যাস, নাটকে চরিত্র সৃষ্টিতে এবং সংলাপ রচনায় শিল্পসম্মত কৌতুক পাঠক ও দর্শকদের তৃপ্ত করে।

ভারতের নির্বাচনে সিনেমার অভিনেতা, অভিনেত্রীদের দোর্দ- প্রতাপ রয়েছে; দেব, দেবীর চরিত্রে যারা অভিনয় করেন বাস্তব জীবনেও তাদের দেব-দেবী সমজ্ঞানে সম্মান করা হয়। ঈর্ষান্বিত জনপ্রিয়তা নিয়ে জয়ললিতা বহু বছর তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। গোটা দক্ষিণ ভারতেই তিনি ‘আম্মা’ নামে সবার কাছে পরিচিত। তামিলনাড়ুতে তাকে দেবী তুল্য ভক্তি-শ্রদ্ধা করা হতো বলে তার মৃত্যু সহ্য করতে না পেরে অনেকে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গেও অনেক অভিনেতা, অভিনেত্রী সংসদ সদস্য। বাংলাদেশেও দুয়েকজন অভিনেতা, অভিনেত্রী সংসদ সদস্য হয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতে কোন কৌতুক অভিনেতাকে সংসদ নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দল মনোনয়ও দেয়নি। চলচ্চিত্র জগতেও আমাদের দেশে কৌতুক অভিনেতাকে অভিনেতা জ্ঞানে সন্মান ও সম্মানি দেয়া হয় না। সম্প্রতি দুটি দেশে দুজন কৌতুক অভিনেতাকে সরকার ও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে সেই দেশের জনগণ। কৌতুকাভিনেতা ভøাদিমির জেলেনস্কি প্রদত্ত ভোটের ৭০ শতাংশ পেয়ে সম্প্রতি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। লোক হাসানোর পেশা নিয়ে আরেকজন কৌতুক অভিনেতা জিম্মি মোরালস প্রেসিডেন্ট হয়েছেন গুয়াতেমালায়। ব্রিটিশ কমেডিয়ান ইয়ান কগনিটো অভিনয় করার সময় মারা যান; মঞ্চে তার সত্যিকার মৃত্যুকালীন দৃশ্য দেখে দর্শকেরা ভেবেছে তিনি স্ট্রোকের নিখুঁত অভিনয় করছেন; তাই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার পর তার নিখুঁত অভিনয়ে সবাই হাতে তালিও দিয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর দর্শক বুঝতে পারল- ইয়ান সত্যি সত্যি মারা গেছেন। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কৌতুক অভিনেতা ঢাকার ‘পোলা’ পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র ভানু (সৌম্য) বন্দ্যোপাধ্যায় ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, কৃষক-শ্রমিক সবাইর কাছে সমান জনপ্রিয়। সিনেমা, নাটক ছাড়াও ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় দর্শক, শ্রোতাদের জন্য কৌতুক পরিবেশন করে কৌতুককে শিল্পরূপ দিতে সমর্থ হয়েছেন।

হাস্যকৌতুকের মাধ্যমে দর্শক, শ্রোতাদের নির্মল আনন্দ দেয়া সহজ মনে হলেও তা সবচেয়ে কঠিন কাজ। এই কঠিন কাজটি আনিস ভাই অবলীলায় করতে পারতেন। কৌতুক পরিবেশনের কারণে তাকে হাল্কা ধরনের অভিনেতা মনে হলেও তিনি ছিলেন একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন গুরুগম্ভীর লোক। হাসির ফোয়ারা সৃষ্টি করে তিনি আমাদের পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলোকেও প্রাণবন্ত করে তুলতেন। টাঁকশালে আমার মেজ ভাই মহিউদ্দিন আহম্মদ কর্তৃক আয়োজিত প্রতিটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে আনিস ভাই ছিলেন সবার কাক্সিক্ষত ব্যক্তিত্ব; অনুষ্ঠানে তাকে দেখামাত্রই সবাই হাসতে শুরু করে দিতেন। স্বজনের বিপদে-আপদে তিনি ছুটে আসতেন। হাসপাতালে আনিস ভাইকে দেখলে ডাক্তার, নার্সেরা আমাদের আত্মীয়-স্বজন রোগীদের অতিরিক্ত যতœ নিত। বেয়াই বলে আনিস ভাইয়ের সঙ্গে আমার হাসি ঠাট্টার সম্পর্ক ছিল। আনিস ভাইয়ের মৃত্যুতে আমরা আত্মীয়রা একজন দরদি, পরোপকারী ও রসিক লোককে হারালাম, দেশ হারালো একজন জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতাকে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

eauddinahmed@gmail.com