কানাডীয় সাহিত্য বিচ্ছিন্ন ভাবনা

ভিনদেশি সাহিত্যের চক্রব্যুহ ভেদের কথা

বরুণ কুমার বিশ্বাস

প্রাবন্ধিক ও গবেষক সুব্রত কুমার দাস ২০১৩ সালে কানাডা প্রবাসী হয়েছেন স্বপরিবারে। বাংলাদেশে থাকাকালীন নজরুল ও রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও জীবনী নিয়ে বিস্তর কাজ করেছেন। প্রবাস জীবনের রূঢ় বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে আর যাই হোক কেউ সেই দেশের সাহিত্যের রস আস্বাদন করবে সেটা ভাবা যায় না কিংবা এটাও ভাবা যায় না সেই সাহিত্য নিয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখার প্রাসঙ্গিকতা নিয়েও। ‘টরন্টো পাবলিক লাইব্রেরি’-তে নিয়মিত যাতায়াতের মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকেই প্রণোদিত করতে থাকেন। বিস্ময়ের বিষয়, দুয়েকজন ছাড়া কানাডার অধিকাংশ লেখকদের নামও তেমনটা তিনি জানতেন না। তবে অপরিচিত হলেও পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের বই তার আগ্রহের বিষয় হয়ে ওঠে। অপেক্ষাকৃত বিশ্বপরিচিত লেখক যেমন এলিস মানরো, মাইকেল ওনডাডজি বা ইয়ান মার্টেল প্রমুখের বই তার পড়ার তালিকায় স্থান পায়নি। কারণ এদের বই তার পড়া। তালিকায় যুক্ত করতে থাকেন গভর্নর জেনারেল পুরস্কারপ্রাপ্ত, গিলার পুরস্কারপ্রাপ্ত ইত্যাদি পুরস্কার প্রাপ্ত বই। সেই তালিকার লেখকদের মধ্যে ছিলেন মার্গারেট লরেন্স, আন-মেরি ম্যাকডোনাল্ডস, রবীন্দ্রনাথ মহারাজ, টমাস কিং, ডেভিড এডামস রিচার্ডস, জোসেফ বয়ডন, ক্যাথারিন গোভিয়ার, লরেন্স হিলসহ আরো অনেকের বই। দেশটির সাহিত্য যে অভিবাসী লেখক নির্ভর সে বিষয়ে প্রশ্ন থাকার কোনো কারণ নেই। সুব্রত কুমার দাস ধীরে ধীরে কানাডীয় সাহিত্যের চক্রব্যূহ ভেদ করতে থাকেন। একসময় যেই প্রস্তর-পাহাড় তার সামনে মূর্ত আতঙ্ক হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলো, তা ধীরে ধীরে শক্তিতে রূপান্তরিত হতে থাকে। বিভিন্ন লেখকের বই পড়া এবং সেই বই নিয়ে লেখার একটা চাক্রিক কর্মে তিনি বুঁদ হয়ে থাকতে থাকতে পরিকল্পনা করেন এই অভিযাত্রার অর্জনগুলোকে নিয়ে একটা বই আকারে প্রকাশ করবেন। সেই স্বপ্নের বাস্তবরূপ “কানাডীয় সাহিত্য : বিচ্ছিন্ন ভাবনা”। কানাডীয় সাহিত্য মূলত বিশ্বসাহিত্যের জানালা। দেশটির সাহিত্য নিয়ে আগ্রহী যে কেউই নির্দ্বিধায় পেতে পারেন বিশ্বসাহিত্যের স্বাদ। তবে এটিও সত্যি বিশ্বসাহিত্যের উপকরণগুলোকে দেশটির সকল প্রকার সাহিত্যবোদ্ধারা সানন্দে গ্রহণ করেছেন এবং করছেন বলেই এটি ভিন্নমাত্রা পাচ্ছে, দিনকেদিন। অন্যান্য দেশের সাহিত্যিকদের মতো বাংলাদেশি বেশ কয়েকজন লেখক কানাডীয় সাহিত্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। তাদের মধ্যে দয়ালী ইসলাম তার কাব্যসংকলন “ইউসুফ এন্ড দ্য লোটাস ফ্লাওয়ার”, আরিফ আনোয়ার তার “দ্য স্টর্ম” বইয়ের জন্য বেশ আলোচিত হয়েছেন। তবে কলকাতার আয়েশা ব্যানার্জি তার “বটলস এন্ড বোনস”, “দ্য ক্লারিটি অব ডিসট্যান্স” বইয়ের জন্য বেশ আলোচিত হয়েছেন। কানাডীয় সাহিত্যকে ওখানকার মানুষরা ভালোবেসে ‘ক্যানলিট’ নামে অভিহিত করে। পুরো বই জুড়ে যে সকল লেখকদের সাহিত্যকর্ম বা অবদান নিয়ে আলোচনা করেছেন তাদের মধ্যে সুজানা মোদি, স্টিফেন লেকক, এমিলি কার, রবার্ট সার্ভিস, লুসি মড মন্টগোমারি, মাজো ডি লা রচ, হিউ ম্যাকলেনান, গাব্রিয়েল রয়, ডরোথি লিভসে, আরভিং লেইটন, পিকে পেইজ, লরিয়েট আল পারডি, মিল্টন আকর্ন, ফিলিপ ওয়েব, লিওনার্দ কোহেন, ক্যারোল শিল্ডস, প্যাট লোথার, জর্জ বাওয়ারিং, শিলা ফিশম্যান, বিল বিসেট, ডেভিড জনস্টেন, গুয়েনডলিন ম্যাকইওয়ান, হ্যারল্ড সনি লাডো, শার্টল গ্রে, ক্যাথি অসলার প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। সুজানা মোদি প্রসঙ্গে সুব্রত কুমার দাস গ্রন্থটিতে বলেছেন, “কানাডীয় সাহিত্যের অতীত পড়তে গেলে অবশ্যম্ভাবী একটি পাঠ হলো সুজানা মোদি। সুজানা বর্তমান লেখককে বেশি আকর্ষণ করেন যখন দেখি কানাডার গভর্নর জেনারেল সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্ত একজন লেখক মার্গারেট এটাউড সুজানার জীবন-সংগ্রাম ও জীবন অভিজ্ঞতা নিয়ে আলাদা কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন। যে পাঠকরা ‘Journals of Susanna Moodie’ পড়েছেন তাদের খেয়াল থাকতে পারে সেই সময়ের কথা যখন সুজানা প্রথম কানাডায় এসেছেন। অপরিচিত ভূখন্ডে সুজানার বিপন্নতা এমন ‘I am a word /in a foreign language’ । বিপন্ন সে সময়ে সুজানার মনে হয়, ‘It was our own/ignorance we entered’। আর ঠিক তখনই সুজানা শুনতে পান ‘Go back where you came from’- অভিবাসী জীবনে কঠিন এক চপেটাঘাত।” (কানাডীয় সাহিত্য/ পৃষ্ঠা-৪৮)। কানাডায় বহু ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষের সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ ও একাগ্রতার বিষয়ই বারবার ফুটে উঠেছে বইটির পাতায় পাতায়। বইটিকে যেভাবে তিনি পরতে পরতে সাজিয়েছেন সেটিকে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন ভাবনা বলা যায় না। বরং সেটি একজন অনুসন্ধিৎসু গবেষকের সুনিদিষ্ট ও সুপরিকল্পিত পাঠ-অভিজ্ঞতার সুষমামন্ডিত উপস্থাপন।

বৃহস্পতিবার, ২০ জুন ২০১৯ , ৫ আষাঢ় ১৪২৫, ১৫ শাওয়াল ১৪৪০

কানাডীয় সাহিত্য বিচ্ছিন্ন ভাবনা

ভিনদেশি সাহিত্যের চক্রব্যুহ ভেদের কথা

বরুণ কুমার বিশ্বাস

image

প্রাবন্ধিক ও গবেষক সুব্রত কুমার দাস ২০১৩ সালে কানাডা প্রবাসী হয়েছেন স্বপরিবারে। বাংলাদেশে থাকাকালীন নজরুল ও রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও জীবনী নিয়ে বিস্তর কাজ করেছেন। প্রবাস জীবনের রূঢ় বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে আর যাই হোক কেউ সেই দেশের সাহিত্যের রস আস্বাদন করবে সেটা ভাবা যায় না কিংবা এটাও ভাবা যায় না সেই সাহিত্য নিয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখার প্রাসঙ্গিকতা নিয়েও। ‘টরন্টো পাবলিক লাইব্রেরি’-তে নিয়মিত যাতায়াতের মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকেই প্রণোদিত করতে থাকেন। বিস্ময়ের বিষয়, দুয়েকজন ছাড়া কানাডার অধিকাংশ লেখকদের নামও তেমনটা তিনি জানতেন না। তবে অপরিচিত হলেও পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের বই তার আগ্রহের বিষয় হয়ে ওঠে। অপেক্ষাকৃত বিশ্বপরিচিত লেখক যেমন এলিস মানরো, মাইকেল ওনডাডজি বা ইয়ান মার্টেল প্রমুখের বই তার পড়ার তালিকায় স্থান পায়নি। কারণ এদের বই তার পড়া। তালিকায় যুক্ত করতে থাকেন গভর্নর জেনারেল পুরস্কারপ্রাপ্ত, গিলার পুরস্কারপ্রাপ্ত ইত্যাদি পুরস্কার প্রাপ্ত বই। সেই তালিকার লেখকদের মধ্যে ছিলেন মার্গারেট লরেন্স, আন-মেরি ম্যাকডোনাল্ডস, রবীন্দ্রনাথ মহারাজ, টমাস কিং, ডেভিড এডামস রিচার্ডস, জোসেফ বয়ডন, ক্যাথারিন গোভিয়ার, লরেন্স হিলসহ আরো অনেকের বই। দেশটির সাহিত্য যে অভিবাসী লেখক নির্ভর সে বিষয়ে প্রশ্ন থাকার কোনো কারণ নেই। সুব্রত কুমার দাস ধীরে ধীরে কানাডীয় সাহিত্যের চক্রব্যূহ ভেদ করতে থাকেন। একসময় যেই প্রস্তর-পাহাড় তার সামনে মূর্ত আতঙ্ক হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলো, তা ধীরে ধীরে শক্তিতে রূপান্তরিত হতে থাকে। বিভিন্ন লেখকের বই পড়া এবং সেই বই নিয়ে লেখার একটা চাক্রিক কর্মে তিনি বুঁদ হয়ে থাকতে থাকতে পরিকল্পনা করেন এই অভিযাত্রার অর্জনগুলোকে নিয়ে একটা বই আকারে প্রকাশ করবেন। সেই স্বপ্নের বাস্তবরূপ “কানাডীয় সাহিত্য : বিচ্ছিন্ন ভাবনা”। কানাডীয় সাহিত্য মূলত বিশ্বসাহিত্যের জানালা। দেশটির সাহিত্য নিয়ে আগ্রহী যে কেউই নির্দ্বিধায় পেতে পারেন বিশ্বসাহিত্যের স্বাদ। তবে এটিও সত্যি বিশ্বসাহিত্যের উপকরণগুলোকে দেশটির সকল প্রকার সাহিত্যবোদ্ধারা সানন্দে গ্রহণ করেছেন এবং করছেন বলেই এটি ভিন্নমাত্রা পাচ্ছে, দিনকেদিন। অন্যান্য দেশের সাহিত্যিকদের মতো বাংলাদেশি বেশ কয়েকজন লেখক কানাডীয় সাহিত্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। তাদের মধ্যে দয়ালী ইসলাম তার কাব্যসংকলন “ইউসুফ এন্ড দ্য লোটাস ফ্লাওয়ার”, আরিফ আনোয়ার তার “দ্য স্টর্ম” বইয়ের জন্য বেশ আলোচিত হয়েছেন। তবে কলকাতার আয়েশা ব্যানার্জি তার “বটলস এন্ড বোনস”, “দ্য ক্লারিটি অব ডিসট্যান্স” বইয়ের জন্য বেশ আলোচিত হয়েছেন। কানাডীয় সাহিত্যকে ওখানকার মানুষরা ভালোবেসে ‘ক্যানলিট’ নামে অভিহিত করে। পুরো বই জুড়ে যে সকল লেখকদের সাহিত্যকর্ম বা অবদান নিয়ে আলোচনা করেছেন তাদের মধ্যে সুজানা মোদি, স্টিফেন লেকক, এমিলি কার, রবার্ট সার্ভিস, লুসি মড মন্টগোমারি, মাজো ডি লা রচ, হিউ ম্যাকলেনান, গাব্রিয়েল রয়, ডরোথি লিভসে, আরভিং লেইটন, পিকে পেইজ, লরিয়েট আল পারডি, মিল্টন আকর্ন, ফিলিপ ওয়েব, লিওনার্দ কোহেন, ক্যারোল শিল্ডস, প্যাট লোথার, জর্জ বাওয়ারিং, শিলা ফিশম্যান, বিল বিসেট, ডেভিড জনস্টেন, গুয়েনডলিন ম্যাকইওয়ান, হ্যারল্ড সনি লাডো, শার্টল গ্রে, ক্যাথি অসলার প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। সুজানা মোদি প্রসঙ্গে সুব্রত কুমার দাস গ্রন্থটিতে বলেছেন, “কানাডীয় সাহিত্যের অতীত পড়তে গেলে অবশ্যম্ভাবী একটি পাঠ হলো সুজানা মোদি। সুজানা বর্তমান লেখককে বেশি আকর্ষণ করেন যখন দেখি কানাডার গভর্নর জেনারেল সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্ত একজন লেখক মার্গারেট এটাউড সুজানার জীবন-সংগ্রাম ও জীবন অভিজ্ঞতা নিয়ে আলাদা কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন। যে পাঠকরা ‘Journals of Susanna Moodie’ পড়েছেন তাদের খেয়াল থাকতে পারে সেই সময়ের কথা যখন সুজানা প্রথম কানাডায় এসেছেন। অপরিচিত ভূখন্ডে সুজানার বিপন্নতা এমন ‘I am a word /in a foreign language’ । বিপন্ন সে সময়ে সুজানার মনে হয়, ‘It was our own/ignorance we entered’। আর ঠিক তখনই সুজানা শুনতে পান ‘Go back where you came from’- অভিবাসী জীবনে কঠিন এক চপেটাঘাত।” (কানাডীয় সাহিত্য/ পৃষ্ঠা-৪৮)। কানাডায় বহু ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষের সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ ও একাগ্রতার বিষয়ই বারবার ফুটে উঠেছে বইটির পাতায় পাতায়। বইটিকে যেভাবে তিনি পরতে পরতে সাজিয়েছেন সেটিকে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন ভাবনা বলা যায় না। বরং সেটি একজন অনুসন্ধিৎসু গবেষকের সুনিদিষ্ট ও সুপরিকল্পিত পাঠ-অভিজ্ঞতার সুষমামন্ডিত উপস্থাপন।