গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি এবং দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব সিন্দবাদ

সাকিব আনোয়ার

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সংবাদ সম্মেলন দেখতে দেখতে হঠাৎ অনেক বছর আগে দেখা দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব সিন্দবাদের একটা পর্বের কথা মনে পড়ে গেল। ওই পর্বে দেখেছিলাম সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে সিন্দবাদ, মিভ, ডুবার আর ফিরোজ একটা রাজ্যে গিয়ে পৌঁছায়। ওই রাজ্যের রাজা আর তার উজির নাজিররা কোন কাজ করেন না। উপরন্তু প্রমোদতরী নিয়ে বছরের অর্ধেকটা সময় এদেশ ওদেশ ঘুরে বেড়ান। সেখানে দু’হাত ভরে খরচ করে আনন্দ করেন আর এই খরচের জোগান দেন রাজার মদদপুষ্ট রাজ্যের তহসিলদার আর ব্যবসায়ীরা। যারা তাদের প্রয়োজনমতো নিয়ম করে প্রজাদের কাছ থেকে নিয়মিত খাজনার বাইরেও খাজনা আদায় করেন বা জনগণের প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন।

গত ১৩ জুন বাজেট প্রস্তাবনার পরে আগামী অর্থবছর কে ঘিরে সরকারের যে দর্শন ফুটে উঠেছিল, ৩০ জুন বাজেট পাস হওয়ার মাধ্যমে সেই দর্শনই স্পষ্ট হয়েছে। মেগা প্রকল্পের নামে বড় বড় প্রজেক্টের অর্থ ব্যয় এবং দ্বিগুণ-তিনগুণ খরচে সম্পন্ন বিভিন্ন প্রকল্পের খরচ মেটাতে সরকার জনগণের উপর পরোক্ষ করের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে। এবারের বাজেটে প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩২ শতাংশ; যা আগের বছরগুলোতে ৩৫ শতাংশের কম বেশি ছিল। আমাদের মতো দেশে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ করের হার সমান হওয়া উচিত। পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীলতা সব শ্রেণীর মানুষের উপর চাপ তৈরি করে যার সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী মধ্যবিত্ত থেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষটিও।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) কার্যালয়ে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলা হয় এলএনজি আমদানিতে ঘাটতি মেটাতে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থ বছরের পরিকল্পনা অনুযায়ী এলএনজি আমদানিতে ঘাটতি ১৮ হাজার ২৭০ কোটি টাকার মধ্যে সরকার ভর্তুকি দিবে ৭ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা। গ্যাসের দাম বাড়িয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে পাওয়া যাবে ৮ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। বাকি ২ হাজার ৪২০ কোটি টাকা জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল থেকে আসবে। গ্রাহকের বিল থেকেই একটি অংশ জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল ও গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে জমা হয়। এই জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিলের টাকাও সরকার এলএনজি আমদানিতে ব্যয় করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তার মানে এলএনজি আমদানিতে ঘাটতির ১০ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা গ্রাহকের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে। এলএনজি আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং ২ শতাংশ উৎস কর রয়েছে; যা প্রত্যাহার বা কমানো হয়নি। তার মানে সরকার এই এলএনজি আমদানিতেও পরোক্ষ করের মাধ্যমে জনগণের টাকা দিয়ে ঘাটতি মেটাতে চাচ্ছে।

বর্ধিত দাম অনুযায়ী এক চুলার জন্য গ্রাহকদের ৭৫০ টাকার স্থলে ৯২৫ টাকা এবং দুই চুলার গ্রাহকদের ৮০০ টাকার স্থলে ৯৭৫ টাকা দিতে হবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে দাম বাড়ানো হয়েছে ২২ শতাংশ। এছাড়া আবাসিকের প্রিপেইড মিটারে গ্যাসের দাম ৯ টাকা ১০ পয়সা থেকে ১২ টাকা ৬০ পয়সা করা হয়েছে অর্থাৎ দাম বাড়ানো হয়েছে ৩৮ শতাংশ। সিএনজির দাম ৪০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৩ টাকা করা হয়েছে।

প্রতি ঘনমিটার বিদ্যুতের জন্য গ্যাসের দাম ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি করে ৩ টাকা ৬১ পয়সা থেকে ৪ টাকা ৪৫ পয়সা করা হয়েছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রতি ঘনমিটার ৯ টাকা ৬২ পয়সা থেকে ৪৪ শতাংশ বাড়িয়ে ১৩ টাকা ৮৫ পয়সা করা হয়েছে। সার কারখানায় ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রতি ঘনমিটারে ২ টাকা ৭১ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ৪৫ পয়সা করা হয়েছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে দাম বেড়েছে ৬৫ শতাংশ। এছাড়াও শিল্পে ব্যবহারের জন্য প্রতি ঘনমিটার ৩৮ শতাংশ বাড়িয়ে ৭ টাকা ৭৬ পয়সা থেকে ১০ টাকা ৭০ পয়সা করা হয়েছে। এছাড়া চা বাগান এবং হোটেল-রেস্তোরাঁয় বাড়ানো হয়েছে যথাক্রমে ৪৪ এবং ৩৫ শতাংশ।

পেট্রোবাংলা এবং তিতাসের দুর্নীতি, অযৌক্তিক সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যয়, ক্রয়মূল্যের অসঙ্গতি রোধ করা গেলে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন হয় না। তারপরও সব হিসেবকে সঠিক ধরে নিলেও সরকার দেশের জনগণের কথা ভেবে-ভিন্ন পন্থায়ও এ খরচের জোগান দিতে পারে। আমাদের দেশে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশের দুই লাখের মতো বেতনভুক্ত কর্মী প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা আয় করে নিয়ে যায়। তাদের করের আওতায় আনার কোন প্রক্রিয়া বা প্রস্তাব সরকার কখনো গ্রহণ করেনি। উচ্চ আয় করা এসব কর্মীদের বেতনের ওপর গড়ে ১৫% আয়কর ধরে হিসাব করলেও প্রাপ্ত করের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা; যা গ্যাসের দাম বাড়িয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে বাড়তি আদায় করা অর্থের চেয়েও প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা বেশি। বাজেটে এ বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

অথচ এই বাজেটেই ১০% কর প্রদানের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। তার মানে আপনি যদি নিয়মিত কর প্রদান করেন তবে আপনাকে ৩০% পর্যন্ত কর দিতে হতে পারে। আর যদি আপনি কর প্রদান না করে কালো টাকার পাহাড় জমান তবে আপনার ওপর করের হার এক-তৃতীয়াংশ। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র কর প্রদানের ক্ষেত্রে অসৎ হতে উৎসাহিত করবে। তার মানে সরকার বিশেষ একটি শ্রেণীকে সুবিধা প্রদান করার ব্যবস্থা করছে। ঠিক একই সময় চিনির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যার ভোক্তা রাষ্ট্রের শীর্ষ ধনী থেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা মানুষটিও, তার উপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছে। আমদানি শুল্ক, ভ্যাট, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কসহ সবকিছু হিসাব করলে প্রতি কেজি চিনির ওপর শুল্কের পরিমাণ ২১ টাকার বেশি। একজন ভিক্ষুক কিংবা ব্যাংক লুট করে হাজার হাজার কোটি টাকা বানানো মানুষ যখন চিনি কেনে, তখন উভয়কেই এই একই পরিমাণ শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। গ্যাসের ক্ষেত্রেও বিষয়টি ঠিক একই রকম। সরকার ওই সকল পণ্য বা সেবার ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ বা মূল্যবৃদ্ধি করেছে যেগুলো সমাজের সকল শ্রেণীর অবশ্য ব্যবহৃত।

গ্যাসের দাম বাড়ার ফলে শিল্প ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের পোশাক শিল্পসহ রফতানি খাতের শিল্পগুলো প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। ব্যবসায়ীরা সব পণ্যের দাম বাড়াতে বাধ্য হবেন। বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দেবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। পরিবহন ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দেবেন গাড়িভাড়া। তেল, চিনি, লবণ, আটা, ময়দা, সুজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্য এবং মাছ ও মুরগির খাবার তৈরিতে প্রচুর গ্যাস-বিদ্যুতের দরকার হয়। গ্যাসের দাম বাড়ায় তার প্রভাব পড়বে এসব পণ্য উৎপাদনে। এছাড়া গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে জ্বালানি কাঠ ও কয়লার ব্যবহার বাড়বে। এতে হুমকির মুখে পড়বে দেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।

তিতাস, পেট্রোবাংলাসহ গ্যাস খাতে সংশ্লিষ্ট সব মহলের দুর্নীতির মহোৎসবের কথা আমরা সবাই জানি। কিছুদিন আগে হাইকোর্টও এ বিষয়ে দৃষ্টিপাত করেছে। তাছাড়া সরকারি প্ররোচনায় সাধারণ মানুষ এখন সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহারের দিকে ঝুঁকবে যার ব্যবসা সরকারের মদদপুষ্ট গুটিকয়েক মানুষের কাছে। উপরন্তু এই সিলিন্ডার গ্যাসের দাম আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের প্রায় দেড়গুণ যা কমানোর বা নিয়ন্ত্রণের কোন উদ্যোগ সরকারের নেই। বোঝাই যাচ্ছে সরকার চাচ্ছে এই গুটিকয়েক মানুষের হাতে দেশের সাধারণ ভোক্তাদের জিম্মি করতে। জেমস এ রবিনসন এবং ড্যারেন এসেমগ্লু রচিত ‘হোয়াই নেশন্স ফেইল’ বইতে লেখকদ্বয় ইনক্লুসিভ এবং এক্সট্র্যাক্টিভ ডেভেলপমেন্ট দেখাতে গিয়ে বিশ্বের দুজন শীর্ষ ধনীর উদাহরণ দিয়েছেন। একজন হচ্ছেন আমেরিকার বিল গেটস আর একজন মেক্সিকোর কার্লোস সিøম। বিল গেটস ধনী হয়েছেন পরিশ্রম, উদ্ভাবনী শক্তি এবং প্রতিনিয়ত তার বিকাশের কারণে। এতে সে বা তার প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি তার দেশ রাজস্ব এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে; যা দেশের জন্য ইনক্লুসিভ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক ডেভেলপমেন্ট। অন্যদিকে কার্লোস সিøম ধনী হয়েছেন তার দেশের ক্ষমতাসীনদের যোগসাজশে মনোপলি টেলিকম ব্যবসার মাধ্যমে। এতে দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীর অর্থ রাষ্ট্র ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতায় একজনের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। এটি একজন ব্যক্তির স্বার্থে রাষ্ট্রের এক্সট্রাকটিভ ডেভেলপমেন্ট।

চার কোটি দরিদ্র (যার মধ্যে দুই কোটি হতদরিদ্র) মানুষের দেশ, বাংলাদেশে অতি ধনী (কমপক্ষে ২৫০ কোটি টাকার মালিক) বৃদ্ধির হার পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। কমপক্ষে ৮ কোটি টাকার মালিক, ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ তৃতীয়। ২০১৬ সালের হিসেব অনুযায়ী দেশের দরিদ্রতম জনসংখ্যার ৫ ভাগের অবদান জাতীয় আয়ে ০.২৩ শতাংশ আর মোট আয়ে সবচেয়ে ধনী পাঁচ শতাংশের অবদান ২৭.৮৯ শতাংশ। তার মানে এটা পরিষ্কার যে এদেশে কার্লোস সিøম হওয়া সম্ভব হলেও বিল গেটস হওয়ার আশা করা অবান্তর।

দি নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব সিন্দবাদের মতো আমাদের রাজ্যের রাজারাও (উজির-নাজিরসহ) সকল ক্ষমতা এবং সুযোগ-সুবিধা তাদের মদদপুষ্ট গোষ্ঠীর হাতে তুলে দিয়েছেন এবং তাদের বিশেষ সুবিধা দেয়ার জন্যই প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করছেন। দুর্নীতির মহাসাগরে পতিত দেশের অর্থনীতি আর নিজেদের প্রমোদতরী ভাসিয়ে রাখতে জনগণের ওপর অযাচিত কর আরোপ এবং মূল্যবৃদ্ধি করা হচ্ছে। সিন্দবাদ তার দলবল নিয়ে কয়েক দিনেই সেই রাজ্যের রাজা আর তাদের মদদপুষ্টদের হাত থেকে প্রজাদের রক্ষা করেছিলেন। এদেশে সিন্দবাদ কবে আসবেন- সেটাই দেখার অপেক্ষা।

Email: mnsaqeeb@gmail.com

বুধবার, ০৩ জুলাই ২০১৯ , ১৯ আষাঢ় ১৪২৫, ২৯ শাওয়াল ১৪৪০

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি এবং দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব সিন্দবাদ

সাকিব আনোয়ার

image

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সংবাদ সম্মেলন দেখতে দেখতে হঠাৎ অনেক বছর আগে দেখা দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব সিন্দবাদের একটা পর্বের কথা মনে পড়ে গেল। ওই পর্বে দেখেছিলাম সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে সিন্দবাদ, মিভ, ডুবার আর ফিরোজ একটা রাজ্যে গিয়ে পৌঁছায়। ওই রাজ্যের রাজা আর তার উজির নাজিররা কোন কাজ করেন না। উপরন্তু প্রমোদতরী নিয়ে বছরের অর্ধেকটা সময় এদেশ ওদেশ ঘুরে বেড়ান। সেখানে দু’হাত ভরে খরচ করে আনন্দ করেন আর এই খরচের জোগান দেন রাজার মদদপুষ্ট রাজ্যের তহসিলদার আর ব্যবসায়ীরা। যারা তাদের প্রয়োজনমতো নিয়ম করে প্রজাদের কাছ থেকে নিয়মিত খাজনার বাইরেও খাজনা আদায় করেন বা জনগণের প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন।

গত ১৩ জুন বাজেট প্রস্তাবনার পরে আগামী অর্থবছর কে ঘিরে সরকারের যে দর্শন ফুটে উঠেছিল, ৩০ জুন বাজেট পাস হওয়ার মাধ্যমে সেই দর্শনই স্পষ্ট হয়েছে। মেগা প্রকল্পের নামে বড় বড় প্রজেক্টের অর্থ ব্যয় এবং দ্বিগুণ-তিনগুণ খরচে সম্পন্ন বিভিন্ন প্রকল্পের খরচ মেটাতে সরকার জনগণের উপর পরোক্ষ করের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে। এবারের বাজেটে প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩২ শতাংশ; যা আগের বছরগুলোতে ৩৫ শতাংশের কম বেশি ছিল। আমাদের মতো দেশে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ করের হার সমান হওয়া উচিত। পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীলতা সব শ্রেণীর মানুষের উপর চাপ তৈরি করে যার সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী মধ্যবিত্ত থেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষটিও।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) কার্যালয়ে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলা হয় এলএনজি আমদানিতে ঘাটতি মেটাতে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থ বছরের পরিকল্পনা অনুযায়ী এলএনজি আমদানিতে ঘাটতি ১৮ হাজার ২৭০ কোটি টাকার মধ্যে সরকার ভর্তুকি দিবে ৭ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা। গ্যাসের দাম বাড়িয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে পাওয়া যাবে ৮ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। বাকি ২ হাজার ৪২০ কোটি টাকা জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল থেকে আসবে। গ্রাহকের বিল থেকেই একটি অংশ জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল ও গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে জমা হয়। এই জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিলের টাকাও সরকার এলএনজি আমদানিতে ব্যয় করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তার মানে এলএনজি আমদানিতে ঘাটতির ১০ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা গ্রাহকের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে। এলএনজি আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং ২ শতাংশ উৎস কর রয়েছে; যা প্রত্যাহার বা কমানো হয়নি। তার মানে সরকার এই এলএনজি আমদানিতেও পরোক্ষ করের মাধ্যমে জনগণের টাকা দিয়ে ঘাটতি মেটাতে চাচ্ছে।

বর্ধিত দাম অনুযায়ী এক চুলার জন্য গ্রাহকদের ৭৫০ টাকার স্থলে ৯২৫ টাকা এবং দুই চুলার গ্রাহকদের ৮০০ টাকার স্থলে ৯৭৫ টাকা দিতে হবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে দাম বাড়ানো হয়েছে ২২ শতাংশ। এছাড়া আবাসিকের প্রিপেইড মিটারে গ্যাসের দাম ৯ টাকা ১০ পয়সা থেকে ১২ টাকা ৬০ পয়সা করা হয়েছে অর্থাৎ দাম বাড়ানো হয়েছে ৩৮ শতাংশ। সিএনজির দাম ৪০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৩ টাকা করা হয়েছে।

প্রতি ঘনমিটার বিদ্যুতের জন্য গ্যাসের দাম ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি করে ৩ টাকা ৬১ পয়সা থেকে ৪ টাকা ৪৫ পয়সা করা হয়েছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রতি ঘনমিটার ৯ টাকা ৬২ পয়সা থেকে ৪৪ শতাংশ বাড়িয়ে ১৩ টাকা ৮৫ পয়সা করা হয়েছে। সার কারখানায় ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রতি ঘনমিটারে ২ টাকা ৭১ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ৪৫ পয়সা করা হয়েছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে দাম বেড়েছে ৬৫ শতাংশ। এছাড়াও শিল্পে ব্যবহারের জন্য প্রতি ঘনমিটার ৩৮ শতাংশ বাড়িয়ে ৭ টাকা ৭৬ পয়সা থেকে ১০ টাকা ৭০ পয়সা করা হয়েছে। এছাড়া চা বাগান এবং হোটেল-রেস্তোরাঁয় বাড়ানো হয়েছে যথাক্রমে ৪৪ এবং ৩৫ শতাংশ।

পেট্রোবাংলা এবং তিতাসের দুর্নীতি, অযৌক্তিক সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যয়, ক্রয়মূল্যের অসঙ্গতি রোধ করা গেলে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন হয় না। তারপরও সব হিসেবকে সঠিক ধরে নিলেও সরকার দেশের জনগণের কথা ভেবে-ভিন্ন পন্থায়ও এ খরচের জোগান দিতে পারে। আমাদের দেশে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশের দুই লাখের মতো বেতনভুক্ত কর্মী প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা আয় করে নিয়ে যায়। তাদের করের আওতায় আনার কোন প্রক্রিয়া বা প্রস্তাব সরকার কখনো গ্রহণ করেনি। উচ্চ আয় করা এসব কর্মীদের বেতনের ওপর গড়ে ১৫% আয়কর ধরে হিসাব করলেও প্রাপ্ত করের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা; যা গ্যাসের দাম বাড়িয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে বাড়তি আদায় করা অর্থের চেয়েও প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা বেশি। বাজেটে এ বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

অথচ এই বাজেটেই ১০% কর প্রদানের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। তার মানে আপনি যদি নিয়মিত কর প্রদান করেন তবে আপনাকে ৩০% পর্যন্ত কর দিতে হতে পারে। আর যদি আপনি কর প্রদান না করে কালো টাকার পাহাড় জমান তবে আপনার ওপর করের হার এক-তৃতীয়াংশ। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র কর প্রদানের ক্ষেত্রে অসৎ হতে উৎসাহিত করবে। তার মানে সরকার বিশেষ একটি শ্রেণীকে সুবিধা প্রদান করার ব্যবস্থা করছে। ঠিক একই সময় চিনির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যার ভোক্তা রাষ্ট্রের শীর্ষ ধনী থেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা মানুষটিও, তার উপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছে। আমদানি শুল্ক, ভ্যাট, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কসহ সবকিছু হিসাব করলে প্রতি কেজি চিনির ওপর শুল্কের পরিমাণ ২১ টাকার বেশি। একজন ভিক্ষুক কিংবা ব্যাংক লুট করে হাজার হাজার কোটি টাকা বানানো মানুষ যখন চিনি কেনে, তখন উভয়কেই এই একই পরিমাণ শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। গ্যাসের ক্ষেত্রেও বিষয়টি ঠিক একই রকম। সরকার ওই সকল পণ্য বা সেবার ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ বা মূল্যবৃদ্ধি করেছে যেগুলো সমাজের সকল শ্রেণীর অবশ্য ব্যবহৃত।

গ্যাসের দাম বাড়ার ফলে শিল্প ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের পোশাক শিল্পসহ রফতানি খাতের শিল্পগুলো প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। ব্যবসায়ীরা সব পণ্যের দাম বাড়াতে বাধ্য হবেন। বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দেবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। পরিবহন ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দেবেন গাড়িভাড়া। তেল, চিনি, লবণ, আটা, ময়দা, সুজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্য এবং মাছ ও মুরগির খাবার তৈরিতে প্রচুর গ্যাস-বিদ্যুতের দরকার হয়। গ্যাসের দাম বাড়ায় তার প্রভাব পড়বে এসব পণ্য উৎপাদনে। এছাড়া গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে জ্বালানি কাঠ ও কয়লার ব্যবহার বাড়বে। এতে হুমকির মুখে পড়বে দেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।

তিতাস, পেট্রোবাংলাসহ গ্যাস খাতে সংশ্লিষ্ট সব মহলের দুর্নীতির মহোৎসবের কথা আমরা সবাই জানি। কিছুদিন আগে হাইকোর্টও এ বিষয়ে দৃষ্টিপাত করেছে। তাছাড়া সরকারি প্ররোচনায় সাধারণ মানুষ এখন সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহারের দিকে ঝুঁকবে যার ব্যবসা সরকারের মদদপুষ্ট গুটিকয়েক মানুষের কাছে। উপরন্তু এই সিলিন্ডার গ্যাসের দাম আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের প্রায় দেড়গুণ যা কমানোর বা নিয়ন্ত্রণের কোন উদ্যোগ সরকারের নেই। বোঝাই যাচ্ছে সরকার চাচ্ছে এই গুটিকয়েক মানুষের হাতে দেশের সাধারণ ভোক্তাদের জিম্মি করতে। জেমস এ রবিনসন এবং ড্যারেন এসেমগ্লু রচিত ‘হোয়াই নেশন্স ফেইল’ বইতে লেখকদ্বয় ইনক্লুসিভ এবং এক্সট্র্যাক্টিভ ডেভেলপমেন্ট দেখাতে গিয়ে বিশ্বের দুজন শীর্ষ ধনীর উদাহরণ দিয়েছেন। একজন হচ্ছেন আমেরিকার বিল গেটস আর একজন মেক্সিকোর কার্লোস সিøম। বিল গেটস ধনী হয়েছেন পরিশ্রম, উদ্ভাবনী শক্তি এবং প্রতিনিয়ত তার বিকাশের কারণে। এতে সে বা তার প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি তার দেশ রাজস্ব এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে; যা দেশের জন্য ইনক্লুসিভ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক ডেভেলপমেন্ট। অন্যদিকে কার্লোস সিøম ধনী হয়েছেন তার দেশের ক্ষমতাসীনদের যোগসাজশে মনোপলি টেলিকম ব্যবসার মাধ্যমে। এতে দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীর অর্থ রাষ্ট্র ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতায় একজনের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। এটি একজন ব্যক্তির স্বার্থে রাষ্ট্রের এক্সট্রাকটিভ ডেভেলপমেন্ট।

চার কোটি দরিদ্র (যার মধ্যে দুই কোটি হতদরিদ্র) মানুষের দেশ, বাংলাদেশে অতি ধনী (কমপক্ষে ২৫০ কোটি টাকার মালিক) বৃদ্ধির হার পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। কমপক্ষে ৮ কোটি টাকার মালিক, ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ তৃতীয়। ২০১৬ সালের হিসেব অনুযায়ী দেশের দরিদ্রতম জনসংখ্যার ৫ ভাগের অবদান জাতীয় আয়ে ০.২৩ শতাংশ আর মোট আয়ে সবচেয়ে ধনী পাঁচ শতাংশের অবদান ২৭.৮৯ শতাংশ। তার মানে এটা পরিষ্কার যে এদেশে কার্লোস সিøম হওয়া সম্ভব হলেও বিল গেটস হওয়ার আশা করা অবান্তর।

দি নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব সিন্দবাদের মতো আমাদের রাজ্যের রাজারাও (উজির-নাজিরসহ) সকল ক্ষমতা এবং সুযোগ-সুবিধা তাদের মদদপুষ্ট গোষ্ঠীর হাতে তুলে দিয়েছেন এবং তাদের বিশেষ সুবিধা দেয়ার জন্যই প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করছেন। দুর্নীতির মহাসাগরে পতিত দেশের অর্থনীতি আর নিজেদের প্রমোদতরী ভাসিয়ে রাখতে জনগণের ওপর অযাচিত কর আরোপ এবং মূল্যবৃদ্ধি করা হচ্ছে। সিন্দবাদ তার দলবল নিয়ে কয়েক দিনেই সেই রাজ্যের রাজা আর তাদের মদদপুষ্টদের হাত থেকে প্রজাদের রক্ষা করেছিলেন। এদেশে সিন্দবাদ কবে আসবেন- সেটাই দেখার অপেক্ষা।

Email: mnsaqeeb@gmail.com