একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে ডিসিদের কাজ করতে হবে

সাহাদাৎ রানা

একটি জেলার প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা ডিসি বা ডেপুটি কমিশনার। মাঠপর্যায়ে সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারী প্রধান কর্মকর্তা ডিসি। জেলার উন্নয়ন কর্মকা- অনেকটাই পরিচালিত হয় ডিসিদের কেন্দ্র করে। জেলা প্রশাসন সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ধাপ। সরকার তার কর্মসূচি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করেন সংশ্লিষ্ট ডিসিদের মাধ্যমে। তাই জেলার উন্নতি ও জেলাবাসীর জীবনমানের উন্নয়নই তাদের কর্মপদ্ধতির মূল লক্ষ্য। এটা ঠিক, নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে গিয়ে অনেক সময় ডিসিরা পদ্ধতিগত নানা সমস্যায় পড়েন। সেই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের কাছে বিভিন্ন সময় দাবি-দাওয়াও তুলে ধরেন তারা। আর সেই দাবি-দাওয়া তুলে ধরার প্রধানতম জায়গা হলো ডিসি সম্মেলন। যা প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়। এবারও ডিসি সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল তাই। অবশ্য এবারই প্রথমবারের মতো ডিসি সম্মেলন ছিল পাঁচ দিনব্যাপী। পাঁচ দিনের এই সম্মেলনে আরও নতুন কিছু যুক্ত হয় প্রথমবারের মতো। এবারই প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি প্রধান বিচারপতি, স্পিকার এবং তিন বাহিনী প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেন ডিসিরা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে এই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। সুশাসন ও দেশের যথাযথ উন্নয়ন নিশ্চিতে ডিসিদের ৩১ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসব নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে- সরকারি সেবা গ্রহণে সাধারণ মানুষ যাতে কোনভাবেই হয়রানি বা বঞ্চনার শিকার না হন সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা। এছাড়া জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা দূর, মাদকবিরোধী অভিযান, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, সম্ভাবনাময় স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচনে ব্রতী হওয়ার পাশাপাশি তৃণমূল পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করার কথা বলা হয়। এরপর ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে ডিসিদের বৈঠক হয় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে। ১৬ জুলাই বিকেলে সুপ্রিমকোর্ট জাজেস লাউঞ্জে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ডিসিরা। ১৭ জুলাই সচিবালয়ের মন্ত্রিপরিষদ কক্ষে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সশস্ত্রবাহিনী বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কার্য-অধিবেধন হয়। ১৮ জুলাই সচিবালয়ের মন্ত্রিপরিষদ কক্ষে স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন এবং মন্ত্রিপরিষদবিষয়ক অধিবেশন শেষে দুপুরে হয় ডিসিদের সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশন।

সাধারণত ডিসি সম্মেলনে ডিসিরা তাদের কর্মক্ষেত্রে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হন, সেসব থেকে উত্তরণের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়ে থাকেন। বরাবরের মতো এবারও তেমন কিছু প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সংখ্যার হিসাবে যা ৩৩৩টি। ডিসিরা এবার যেসব দাবি জানিয়েছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ ডিসিদের অধীনে সার্বক্ষণিক একটি বিশেষায়িত পুলিশ ফোর্স গঠন করার প্রস্তাব দিয়েছেন। এছাড়া জেলায় কর্মরত এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটদের ম্যাজেস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়ার এখতিয়ার তাদের ওপর ন্যস্ত করার প্রস্তাব এসেছে। দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে মাদকের ব্যবহার। তা নিয়ন্ত্রণে মাদকদ্রব্য আইন ও ২০১৮ সালের মোবাইল কোর্ট আইনের তফসিলভুক্তকরণ সংক্রান্ত বিষয়টি উঠে এসেছে এবারের ডিসি সম্মেলনে। এছাড়া আরও কিছু দাবির মধ্যে রয়েছে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সন্তানদের স্কুলে ভর্তির ব্যাপারে কোটা সংরক্ষণ ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের (পিআইও) এসিআর ইউএনওদের হাতে দেয়া। তবে এবার নতুন দুটি প্রস্তাব সবার দৃষ্টি কেড়েছে। ডিসিরা প্রশাসন ক্যাডারের জন্য আলাদা ব্যাংক ও বিশ্ববিদ্যালয় চেয়েছেন। তবে ডিসিদের জন্য আলাদা ব্যাংক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন আছে কিনা তা ভাবনার বিষয়। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো যেসব দাবি করা হয়েছে তার বেশকিছু দাবি বাস্তবায়ন হলে ডিসিদের গোষ্ঠীস্বার্থকেই রক্ষা করবে, প্রকৃত অর্থে জনগণের স্বার্থকে নয়। সরকারের উচিত হবে যেসব দাবি যৌক্তিক সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে বাস্তবায়ন করা। অবশ্য সম্মেলনে কিছু কিছু বিষয় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দিয়ে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে ডিসিদের। এটা বরাবরই হয়, এবারও হয়েছে।

এছাড়াও বরাবরের মতো দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে নির্দেশনা পেয়েছেন ডিসিরা। তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে সঠিকভাবে ভূমি ব্যবস্থাপনা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে বিশেষভাবে দৃষ্টিপাত। সবার মধ্যে যেন স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয় সে বিষয়ে আরও বেশি মনোযোগ দেয়ার ওপর জোর দেয়া হয়। এছাড়া সম্মেলনে গুরুত্ব পাওয়া উল্লেখ্যযোগ্য বিষয়গুলো হলোÑ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যক্রম জোরদার করা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, ত্রাণ পুনর্বাসন কার্যক্রম, স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসৃজন ও দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি বাস্তবায়ন। পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি বাস্তবায়ন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার এবং ই-গভর্নেন্স, শিক্ষার মান উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ, পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণরোধ, ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং উন্নয়ন কার্যক্রমের বাস্তবায়ন করার প্রতিও বিশেষ দৃষ্টি দিতে বলা হয় সম্মেলনে। এছাড়া পরিবীক্ষণ ও সমন্বয় নিয়েও জেলা প্রশাসক সম্মেলনে আলোচনা হয়েছে এবং এসব বিষয়ে আরও মনোনিবেশন করার তাগিদ দেয়া হয়।

তবে ডিসিদের কাজে অনেক সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায় স্থানীয় রাজনীতি বা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। এবারও এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে দায় এড়ানোর মতো। কিন্তু বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে সবসময় সরকারদলীয় লোকজনের ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায় জেলা প্রশাসনে। এ কারণে অনেক সময় ডিসিরা কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে বাধাগ্রস্ত হন। রাজনৈতিক চাপের মধ্যে থাকতে হয় তাদের। এ থেকে উত্তরণ জরুরি। বিশেষ করে সরকারের কর্মকা- সঠিকভাবে পরিচালনার স্বার্থে। আর সরকারের পক্ষ থেকে ডিসিদের আশ্বস্ত করতে হবে, তারা যেন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারেন। বলতে হবে স্থানীয় রাজনৈতিক কোন চাপের কাছে যেন তারা মাথানত না করেন। এক্ষেত্রে সরকার তাদের পাশে থাকবে। ডিসিদের কাজের ক্ষেত্রে আরও কয়েকটি বাধা রয়েছে। ডিসিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন বা সংগঠনের নেতৃত্ব বিভিন্ন সময় তোষামোদিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অনেক সময় কোন কোন ডিসি সেই তোষামোদিতে গা ভাসান। সেই ডিসির কাছে নির্দিষ্ট কিছু তোষামোদকারীকে বারবার দেখা যায়। এতে সরকারের কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তোষামোদির একটাই কারণ, এর মাধ্যমে তোষামোদকারীরা নিজেদের কাজটা আদায় করে নেয়া। এটা জেলা প্রশাসনের স্বাভাবিক কাজে প্রতিনিয়ত বিঘœ সৃষ্টি করে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাষ্ট্র ও সাধারণ মানুষের স্বার্থ। এতে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন বাধাগ্রস্ত হয়। ডিসিদের উচিত এসব তোষামোদি পরিহার করে নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা। নির্দিষ্ট কোন শ্রেণীপেশার বা স্বার্থান্বেষী মানুষের জন্য নয়, তার সেবার দ্বার খোলা থাকবে সবার জন্য। সব মানুষ সমান সুযোগ পাবে। এখানে অবশ্য শুধু ডিসি বা জেলা প্রশাসনের একার দায় নয়, দায় পেশাজীবী সংগঠনগুলোরও। তাই এ থেকে অবশ্যই আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

এবার ডিসি সম্মেলনে যেসব বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন তার সঠিক বাস্তবায়ন একটি জেলাকে দক্ষ, কর্মক্ষম এবং জনস্বার্থ করতে পারে। ডিসিদের এখন লক্ষ্য হতে হবে একবিংশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের মধ্যদিয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়ার পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করা।

[লেখক : সাংবাদিক]

শুক্রবার, ২৬ জুলাই ২০১৯ , ১১ শ্রাবন ১৪২৫, ২২ জিলকদ ১৪৪০

একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে ডিসিদের কাজ করতে হবে

সাহাদাৎ রানা

একটি জেলার প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা ডিসি বা ডেপুটি কমিশনার। মাঠপর্যায়ে সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারী প্রধান কর্মকর্তা ডিসি। জেলার উন্নয়ন কর্মকা- অনেকটাই পরিচালিত হয় ডিসিদের কেন্দ্র করে। জেলা প্রশাসন সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ধাপ। সরকার তার কর্মসূচি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করেন সংশ্লিষ্ট ডিসিদের মাধ্যমে। তাই জেলার উন্নতি ও জেলাবাসীর জীবনমানের উন্নয়নই তাদের কর্মপদ্ধতির মূল লক্ষ্য। এটা ঠিক, নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে গিয়ে অনেক সময় ডিসিরা পদ্ধতিগত নানা সমস্যায় পড়েন। সেই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের কাছে বিভিন্ন সময় দাবি-দাওয়াও তুলে ধরেন তারা। আর সেই দাবি-দাওয়া তুলে ধরার প্রধানতম জায়গা হলো ডিসি সম্মেলন। যা প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়। এবারও ডিসি সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল তাই। অবশ্য এবারই প্রথমবারের মতো ডিসি সম্মেলন ছিল পাঁচ দিনব্যাপী। পাঁচ দিনের এই সম্মেলনে আরও নতুন কিছু যুক্ত হয় প্রথমবারের মতো। এবারই প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি প্রধান বিচারপতি, স্পিকার এবং তিন বাহিনী প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেন ডিসিরা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে এই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। সুশাসন ও দেশের যথাযথ উন্নয়ন নিশ্চিতে ডিসিদের ৩১ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসব নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে- সরকারি সেবা গ্রহণে সাধারণ মানুষ যাতে কোনভাবেই হয়রানি বা বঞ্চনার শিকার না হন সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা। এছাড়া জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা দূর, মাদকবিরোধী অভিযান, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, সম্ভাবনাময় স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচনে ব্রতী হওয়ার পাশাপাশি তৃণমূল পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করার কথা বলা হয়। এরপর ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে ডিসিদের বৈঠক হয় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে। ১৬ জুলাই বিকেলে সুপ্রিমকোর্ট জাজেস লাউঞ্জে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ডিসিরা। ১৭ জুলাই সচিবালয়ের মন্ত্রিপরিষদ কক্ষে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সশস্ত্রবাহিনী বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কার্য-অধিবেধন হয়। ১৮ জুলাই সচিবালয়ের মন্ত্রিপরিষদ কক্ষে স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন এবং মন্ত্রিপরিষদবিষয়ক অধিবেশন শেষে দুপুরে হয় ডিসিদের সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশন।

সাধারণত ডিসি সম্মেলনে ডিসিরা তাদের কর্মক্ষেত্রে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হন, সেসব থেকে উত্তরণের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়ে থাকেন। বরাবরের মতো এবারও তেমন কিছু প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সংখ্যার হিসাবে যা ৩৩৩টি। ডিসিরা এবার যেসব দাবি জানিয়েছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ ডিসিদের অধীনে সার্বক্ষণিক একটি বিশেষায়িত পুলিশ ফোর্স গঠন করার প্রস্তাব দিয়েছেন। এছাড়া জেলায় কর্মরত এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটদের ম্যাজেস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়ার এখতিয়ার তাদের ওপর ন্যস্ত করার প্রস্তাব এসেছে। দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে মাদকের ব্যবহার। তা নিয়ন্ত্রণে মাদকদ্রব্য আইন ও ২০১৮ সালের মোবাইল কোর্ট আইনের তফসিলভুক্তকরণ সংক্রান্ত বিষয়টি উঠে এসেছে এবারের ডিসি সম্মেলনে। এছাড়া আরও কিছু দাবির মধ্যে রয়েছে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সন্তানদের স্কুলে ভর্তির ব্যাপারে কোটা সংরক্ষণ ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের (পিআইও) এসিআর ইউএনওদের হাতে দেয়া। তবে এবার নতুন দুটি প্রস্তাব সবার দৃষ্টি কেড়েছে। ডিসিরা প্রশাসন ক্যাডারের জন্য আলাদা ব্যাংক ও বিশ্ববিদ্যালয় চেয়েছেন। তবে ডিসিদের জন্য আলাদা ব্যাংক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন আছে কিনা তা ভাবনার বিষয়। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো যেসব দাবি করা হয়েছে তার বেশকিছু দাবি বাস্তবায়ন হলে ডিসিদের গোষ্ঠীস্বার্থকেই রক্ষা করবে, প্রকৃত অর্থে জনগণের স্বার্থকে নয়। সরকারের উচিত হবে যেসব দাবি যৌক্তিক সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে বাস্তবায়ন করা। অবশ্য সম্মেলনে কিছু কিছু বিষয় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দিয়ে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে ডিসিদের। এটা বরাবরই হয়, এবারও হয়েছে।

এছাড়াও বরাবরের মতো দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে নির্দেশনা পেয়েছেন ডিসিরা। তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে সঠিকভাবে ভূমি ব্যবস্থাপনা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে বিশেষভাবে দৃষ্টিপাত। সবার মধ্যে যেন স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয় সে বিষয়ে আরও বেশি মনোযোগ দেয়ার ওপর জোর দেয়া হয়। এছাড়া সম্মেলনে গুরুত্ব পাওয়া উল্লেখ্যযোগ্য বিষয়গুলো হলোÑ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যক্রম জোরদার করা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, ত্রাণ পুনর্বাসন কার্যক্রম, স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসৃজন ও দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি বাস্তবায়ন। পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি বাস্তবায়ন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার এবং ই-গভর্নেন্স, শিক্ষার মান উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ, পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণরোধ, ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং উন্নয়ন কার্যক্রমের বাস্তবায়ন করার প্রতিও বিশেষ দৃষ্টি দিতে বলা হয় সম্মেলনে। এছাড়া পরিবীক্ষণ ও সমন্বয় নিয়েও জেলা প্রশাসক সম্মেলনে আলোচনা হয়েছে এবং এসব বিষয়ে আরও মনোনিবেশন করার তাগিদ দেয়া হয়।

তবে ডিসিদের কাজে অনেক সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায় স্থানীয় রাজনীতি বা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। এবারও এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে দায় এড়ানোর মতো। কিন্তু বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে সবসময় সরকারদলীয় লোকজনের ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায় জেলা প্রশাসনে। এ কারণে অনেক সময় ডিসিরা কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে বাধাগ্রস্ত হন। রাজনৈতিক চাপের মধ্যে থাকতে হয় তাদের। এ থেকে উত্তরণ জরুরি। বিশেষ করে সরকারের কর্মকা- সঠিকভাবে পরিচালনার স্বার্থে। আর সরকারের পক্ষ থেকে ডিসিদের আশ্বস্ত করতে হবে, তারা যেন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারেন। বলতে হবে স্থানীয় রাজনৈতিক কোন চাপের কাছে যেন তারা মাথানত না করেন। এক্ষেত্রে সরকার তাদের পাশে থাকবে। ডিসিদের কাজের ক্ষেত্রে আরও কয়েকটি বাধা রয়েছে। ডিসিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন বা সংগঠনের নেতৃত্ব বিভিন্ন সময় তোষামোদিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অনেক সময় কোন কোন ডিসি সেই তোষামোদিতে গা ভাসান। সেই ডিসির কাছে নির্দিষ্ট কিছু তোষামোদকারীকে বারবার দেখা যায়। এতে সরকারের কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তোষামোদির একটাই কারণ, এর মাধ্যমে তোষামোদকারীরা নিজেদের কাজটা আদায় করে নেয়া। এটা জেলা প্রশাসনের স্বাভাবিক কাজে প্রতিনিয়ত বিঘœ সৃষ্টি করে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাষ্ট্র ও সাধারণ মানুষের স্বার্থ। এতে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন বাধাগ্রস্ত হয়। ডিসিদের উচিত এসব তোষামোদি পরিহার করে নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা। নির্দিষ্ট কোন শ্রেণীপেশার বা স্বার্থান্বেষী মানুষের জন্য নয়, তার সেবার দ্বার খোলা থাকবে সবার জন্য। সব মানুষ সমান সুযোগ পাবে। এখানে অবশ্য শুধু ডিসি বা জেলা প্রশাসনের একার দায় নয়, দায় পেশাজীবী সংগঠনগুলোরও। তাই এ থেকে অবশ্যই আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

এবার ডিসি সম্মেলনে যেসব বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন তার সঠিক বাস্তবায়ন একটি জেলাকে দক্ষ, কর্মক্ষম এবং জনস্বার্থ করতে পারে। ডিসিদের এখন লক্ষ্য হতে হবে একবিংশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের মধ্যদিয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়ার পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করা।

[লেখক : সাংবাদিক]