অনন্ত মাহফুজ
বিভিন্ন কারণে ক্রমাগত বিতর্কিত হয়ে পড়া নোবেল পুরস্কার নিয়ে মানুষের আগ্রহ কিছুটা কমে আসলেও ২০১৯ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার নিয়ে সারা বিশে^র পাঠকের মধ্যে বেশ আগ্রহ ছিল; কারণ এবারই প্রথমবারের মতো সাহিত্যে একসাথে দুটি পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। এই বিতর্ক আরও জোরদার হয়েছে ২০১৯ সালে পিটার হ্যান্ডকে নামক বিশ^ব্যাপী বিতর্কিত ও নিন্দিত সাহিত্যিককে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার মাধ্যমে। ইতিমধ্যে প্রায় সকলে অবহিত যে, পুরস্কার প্রদানের জন্য প্রার্থী নির্বাচনকারী সংস্থা সুইডিস একাডেমি সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের যৌন ও অর্থ কেলেঙ্কারির কারণে ২০১৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদান করেনি। এইসব কেলেঙ্কারির কেন্দ্রে আছেন সুইডিস একাডেমির অন্যতম সদস্য কবি ক্যাটরিনা ফ্রস্টেনসন এবং তার স্বামী জ্যঁ-ক্লদে আরনল্ট।
নানা জল্পনাকল্পনা হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান এবং অনেকে ব্যক্তিগতভাবে সম্ভাব্য সাহিত্যিকদের তালিকাও তৈরি করেন। অবাক করার মতো বিষয় হলো খুব কম ক্ষেত্রে এ-সকল তালিকার মধ্য থেকে কেউ নোবেল পান। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কল্পনার বাইরে কম পরিচিত কাউকে নোবেল প্রদান করে সাহিত্যপ্রেমীদের অবাক করে দেওয়া হয়। এবারও দুটি নোবেল পুরস্কারের ক্ষেত্রে সেই ঘটনাই ঘটেছে। প্রতি বছর আলোচনার শীর্ষে থাকা ব্যক্তিদের কেউ নোবেল পাননি। এমন দুই ব্যক্তিকে পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে যারা সাহিত্যবোদ্ধাদের কাছেও খুব একটা পরিচিত নন। ২০১৯ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন অস্ট্রিয়ার লেখক পিটার হ্যান্ডকে এবং ২০১৮ সালের নোবেল পুরস্কার প্রাপকের নাম পোল্যান্ডের সাহিত্যিক ওলগা তোকারচুক। দুজনেই আলোচনার একেবারে তলানিতে ছিলেন। গণহত্যার সমর্থন ও ফ্যাসিবাদী আচরণের কারণে পিটার হান্ডকের নোবেল পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারে শূন্য বলেই মনে করা হয়েছিল।
নানাবিধ কেলেঙ্কারীর জন্য স্থগিত হওয়া ২০১৮ সালের জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলো ওলগা তোকারচুককে। তাকে পোল্যান্ডের সফলতম লেখকদের অন্যতম বলে মনে করা হয়। ওলগা তোকারচুকের জন্ম ২৯ জানুয়ারি ১৯৬২ সালে, পোল্যান্ডের জিলোনা গারার নিকটে সুলেচুতে। সাহিত্যজীবন শুরু করার আগে ১৯৮০ সাল থেকে তিনি ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি একজন ঔপন্যাসিক, কবি ও মনোবিজ্ঞানী যাকে তার প্রজন্মের অন্যতম সমালোচিত, প্রশংসিত ও বাণিজ্যিকভাবে সফল লেখক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পড়াশোনার সময় তিনি আচরণগত সমস্যাযুক্ত কিশোর-কিশোরীদের একটি প্রতিষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৫ সালে ¯œাতক শেষ হওয়ার পরে তিনি প্রথমে রোককা এবং পরে ওয়ালব্রিজিকে চলে যান এবং সেখানে তিনি থেরাপিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। তোকারচুক নিজেকে বিংশ শতকের প্রভাববিস্তারকারী সুইস মনোবিজ্ঞানী ও মনোবিশ্লেষক কার্ল জাংয়ের শিষ্য হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন এবং জাংয়ের মনস্তত্ত্বকে তার সাহিত্যকর্মের অনুপ্রেরণা হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। ১৯৯৯ সাল থেকে তোকারচুক নোয়া রুদার কাছে একটি ছোট্ট গ্রাম ক্রাজানউতে বাস করতে থাকেন এবং সেখান থেকে তিনি তার ব্যক্তিগত প্রকাশনা সংস্থা রুটা পরিচালনা করেন। তিনি একজন বামপন্থী, নিরামিষভোজী এবং নারীবাদী।
ওলগা তোকারচুক নিজ দেশেই ব্যাপক সমাদৃত আবার সমালোচিতও। খুব বেশিদিন হয়নি তিনি ইংরেজি পাঠকদের নজরে এসেছেন। ২০১৮ সালে Flights উপন্যাসের জন্য ম্যান বুকার পুরস্কার জিতেছেন। এই বইটি ২০০৭ সালের ইরবমঁহর উপন্যাসের অনুবাদ এবং ওই বছরেই বইটি পোল্যান্ডে প্রকাশিত হয়। ফ্লাইটস এক জটিল উপন্যাস। বলা হয়ে থাকে, উপন্যাসটি পড়বার জন্য নয়, বোধগম্যতার জন্য। এক শ ষোলোটি পারস্পরিক শিথিল সম্পর্কযুক্ত চিত্র বা ভ্রমণ-বর্ণনার মাধ্যমে উপন্যাসটি সামনের দিকে এগিয়ে যায়। উপন্যাসের ছোটো এবং বড় দৃশ্যকল্পের বর্ণনাকারী একজন নামহীন নারী। কোনো অধ্যায় না থাকলেও এক শ ষোলোটি ভ্রমণ বর্ণনার অনুচ্ছেদগুলোর প্রতিটির একটি শিরোনাম আছে। যেমন, ‘আমার বাড়ি আমার হোটেল’, ‘তিন শত কিলোমিটার’, ‘বিমানবন্দর’, ‘গাইড বই’, ‘নতুন এথেন্স’, ‘উইকিপিডিয়া’, ‘বোর্ডিং’ ইত্যাদি। এসব অনুচ্ছেদ কোনোটি মাত্র এক লাইনের, আবার কোনোটি একত্রিশ পৃষ্ঠার। তোকারচুকের নিজের ভাষায় ফ্লাইটস “constellation novel” বা “গুচ্ছ উপন্যাস”। ‘ফ্লাইট’ মূলত চলমানতার প্রতীক। থেমে থাকা যেন জীবনবিরুদ্ধ। প্রথাগত কোনো সাধারণ উপন্যাসের কাঠামোতে ফেলে এ উপন্যাসটিকে বিচার সম্ভব নয়। উপন্যাসের পোলিশ শিরোনাম Bieguni প্রাচীন রাশিয়ার একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে বোঝায় যারা কখনো কারও দ্বারা শাসিত হতে চায়নি, না রাষ্ট্র না চার্চ। শাসন বা নিয়ন্ত্রণের পরিস্থিতির উদ্ভব হলে তারা সেই স্থান ত্যাগ করেছে। ক্রমাগত ভ্রমণের মধ্যেই কেটে যেত তাদের জীবন। উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন জেনিফার ক্রফট। ফ্লাইটস ২০০৮ সালে পোল্যান্ডের শীর্ষস্থানীয় সাহিত্যের পুরস্কার নাইক অ্যাওয়ার্ড জিতেছিল।
নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করতে গিয়ে তার বিষয়ে সুইডিশ একাডেমি বলেছে ওলগা তোকারচুককে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হলো “for a narrative imagination that with encyclopedic passion represents the crossing of boundaries as a form of life”। তাঁর অধিকাংশ সাহিত্যকর্মই ঐতিহাসিক বা মিথিক্যাল প্রেক্ষপটে, বাস্তববাদী অনুপুঙ্খসহ এবং তার থিম হলো সাংস্কৃতিক বৈপরীত্যের টেনশন, কখনো তা যুক্তি বনাম উন্মাদনা, কখনো নারী বনাম পুরুষ, আবার কখনো গৃহ বনাম বিচ্ছিন্নতা। উপন্যাসের জন্য বুকার পাওয়া সাতান্ন বছর বয়সী লেখিকা তোকারচুক সাহিত্যের জগতে পা রাখেন কবিতার হাত ধরে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ সিটিজ অফ মিররস। ১৯৯৩ সালে তোকচুকের প্রথম উপন্যাস দ্য জার্নি অব দ্য বুক-পিপল প্রকাশিত হয়। সতেরো শতকের প্রেক্ষাপটে লেখা এই উপন্যাসের আখ্যান এক প্রেমিক দম্পতির একটি হারিয়ে যাওয়া বই অন্বেষণ নিয়ে গড়ে ওঠে। এ বছর সুইডিশ নোবেল কমিটি ২০১৮ সালের নোবেল প্রাপক হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা করে বলে, তোকারচুক এমন একজন আখ্যানকার যিনি আবেগময় বর্ণনাত্মক কল্পনা দিয়ে দেশ-কালের সীমা ভেঙে দেন।
তাঁর সাড়া জাগানো এবং তৃতীয় উপন্যাস Prawiek i inne czasy প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ সালে। ২০১০ সালে এই উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ Primeval and Other Times প্রকাশিত হয়। এ উপন্যাসের প্রেক্ষিতও এক মিথিক্যাল বা পৌরাণিক স্থান কিন্তু তা আবার বাস্তবতাপূর্ণও। এটি পোল্যান্ডের একেবারে কেন্দ্রস্থল প্রভিয়েক (প্রাইভাল) নামক কল্পিত গ্রামকে কেন্দ্র করে যে লোকালয়টি কিছু বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক চরিত্র দ্বারা পূর্ণ। উপন্যাসে দেখা যায়, এই গ্রাম চারটি শ্রেষ্ঠ শ্রেণির দেবদূত দ্বারা রক্ষিত। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রভিয়েকের বাসিন্দাদের জীবন আট দশক ধরে চলমান থাকে- যা ১৯১৪ সালে শুরু হয়েছিল। অ্যাকাডেমি বলেছে, তোকারজুকের এই ন্যারেটিভ হলো অতীতের ভাবমূর্তির সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত বোঝাপড়ার চেষ্টা- যা ১৯৮৯ পরবর্তী সময়ে নতুন পোলিশ সাহিত্যের এক চমৎকার উদাহরণ, যেখানে নীতিবিচারকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা হয়েছে এবং জাতির বিবেকের প্রতিনিধিত্ব করতে অনিচ্ছাও বিবৃত হয়েছে। ওলগার বারোতম, সর্বশেষ ও সর্ববৃহৎ কাজ হলো Ksiegi Jakubowe, ২০১৪ সালে প্রকাশিত এ উপন্যাসের ইংরেজি নাম The Books of Jacob। নয় শ পৃষ্ঠার এই উপন্যাস অষ্টাদশ শতাব্দির ইহুদি সম্প্রদায়ের এক নেতা জ্যাকব ফ্যাঙ্ককে নিয়ে, যার নাম খুব কম লোকেই জানে। ইহুদি ধর্মানুসারী জ্যাকব অত্যন্ত বিতর্কিত ঐতিহাসিক চরিত্র। তিনি ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিম সম্প্রদায়কে একত্রিত করার প্রয়াসের মাধ্যমে গোঁড়াদের চক্ষুশূল হয়েছিলেন। ২০১৪ সালে প্রকাশের পর প্রায় এক বছর উপন্যাসটি বেস্ট সেলার ছিল। কবিতা, গল্প ও নীরিক্ষাধর্মী উপন্যাস লিখলেও পরবর্তীতে তোকারচুকের সাহিত্যকর্ম উপন্যাসের ধারা থেকে ছোটো গদ্য এবং প্রবন্ধের দিকে যেতে শুরু করে। তার পরবর্তী বই জাজাফা বা দ্য ওয়ার্ড্রোব প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে যা তিনটি নভেলার গল্পের সংকলন। ২০০৪ সালে প্রকাশিত দ্য লাস্ট স্টোরিজ তিনটি প্রজন্মের দৃষ্টিকোণ থেকে মৃত্যুর অনুসন্ধান। ওলগার লেখার বিষয় ও ভাব ক্রিস্টালের মতো স্বচ্ছ, তিনি যা বলতে চান তা অনুবাদ এবং প্রবাহিত করাও সহজ বলেই মনে করা হয়।
তোকারচুক দেশে এবং দেশের বাইরে অসংখ্য সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেছেন। ম্যান বুকার ছাড়াও তিনি ২০১৩ সালে ভিলেনিকা পুরস্কার অর্জন করেন। ২০১৪ সালে প্রকাশিত মহাকাব্যিক উপন্যাস The Books of Jacob-এর জন্য আরও একবার নাইক অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন। এর ঐতিহাসিক পটভূমি আঠারো শতকের পোল্যান্ড এবং পূর্ব-মধ্য ইউরোপ এবং এটি ইহুদি ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বের সাথে স¤পর্কিত। বইটি সমালোচক এবং পাঠকদের কাছে সমাদৃত হয়েছিল, তবে পোলিশ জাতীয়তাবাদীরা উপন্যাসটিকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। এ উপন্যাসের জন্য ঘৃণা ও হয়রানির শিকার হয়েছিলেন তোকারচুক। ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয় ডিটেকটিভ ঘরানার উপন্যাস ড্রাইভ ইউর প্লাউ ওভার দ্য বোনস অব দ্য ডেড। এ উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ২০১৫ সালে ‘নোকা রুডা দেশপ্রেমিক সংস্থা’ তোকারচুকের সমালোচনা করে বলে, নগরীর কাউন্সিল যেন এই লেখকের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রত্যাহার করে নেয়। সমিতির দাবি অনুসারে, তিনি পোলিশ জাতির নাম কলঙ্কিত করেছিলেন। তোকারচুকও এই সমালোচনার কড়া জবাব দিয়েছিলেন। তোকারচুকের নোবেল পাওয়া নিয়ে দ্য গার্ডিয়ান মন্তব্য করেছে, সাম্প্রতিক সময়ে সুইডিশ একাডেমি অনেক ভুল করেছে। তবে পোলিশ লেখক তোকারচুককে পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করে তারা মোটেও ভুল করেনি। বছরখানেক আগে ওলগা তোকারচুক মন্তব্য করেছিলেন, “আমি মাঝে মাঝে ভাবি, আমার বই যদি ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হতো তাহলে কেমন হতো। ইংরেজি একটি আন্তর্জাতিক ভাষা। ইংরেজিতে বই প্রকাশিত হওয়া মানে তা আন্তর্জাতিক হয়ে যাওয়া।”
ওলগা তোকারচুকের নোবেল পাওয়া নিয়ে তেমন আলোচনা না হলেও ২০১৯ সালের নোবেলজয়ী লেখক পিটার হ্যান্ডকের নোবেল ইতিমধ্যে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এই লেখকের জন্ম সোভিয়েত অধিকৃত বার্লিনে, ১৯৪২ সালের ৬ ডিসেম্বর। সুইডিশ একাডেমি বলেছে, দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর সবচেয়ে প্রভাবশালী লেখকদের মধ্যে অন্যতম তিনি। তাকে নোবেল প্রদান করা হয়েছে “for an influential work that with linguistic ingenuity has explored the periphery and the specificity of human experience”। পিটার হ্যান্ডকে গ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ার সময়ে ১৯৬৫ সালে মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দেন, যোগ দেন আভা গার্দ আন্দোলনে। তিনি বেশকিছু সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন। ৭৬ বছর বয়সী হ্যান্ডকের প্রথম উপন্যাস উরব Die Hornissen বা দ্য হরনেটস প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালে। পঞ্চাশ বছরের লেখালেখি জীবনে তার সাহিত্যকর্ম উল্লেখ করার মতো সমৃদ্ধ।
১৯৭৮ সালে তাঁর পরিচালনায় তৈরি ছবি দ্য লেফট হ্যান্ডেড ওম্যান সে বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন পাম পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয় এবং ১৯৮০ সালে জার্মান আর্টহাউস সিনেমা স্বর্ণপদক জিতে নেয়। তার চিত্রনাট্যে নির্মিত দ্য রং মুভ সিনেমাটি ১৯৭৫ সালে জার্মান স্বর্ণপদক লাভ করে। ১৯৬৯ সালে নতুন ধারার বাণিজ্যিক ধারণা নিয়ে কয়েকজন লেখকের সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ভারলাগ ডার অটোরেন। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হ্যান্ডকের ভ্রমণালেখ্য অ্যা জার্নি টু দ্য রিভারস: জাস্টিস ফর সার্বিয়া বিতর্কের সৃষ্টি করে, কারণ হ্যান্ডকে সার্বিয়াকে যুগোস্লাভ যুদ্ধের শিকার হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। একই প্রবন্ধে হ্যান্ডকে পশ্চিমা গণমাধ্যমকে আক্রমণ করেছিলেন। তিনি অভিযোগ করেন, পশ্চিমা গণমাধ্যম যুদ্ধের কারণ ও পরিণতি ভুলভাবে উপস্থাপন করে আসছে।
শৈশব থেকেই স্বাভাবিক জীবনযাপন হয়ে ওঠেনি হ্যান্ডকের। অস্ট্রিয়ায় এক সংখ্যালঘু মহিলা ছিলেন হ্যান্ডকের মা। তার বাবা ছিলেন এক জার্মান ক্লার্ক ও সৈনিক। পিটারের জন্মের আগেই তার মা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন ব্রোনো হ্যান্ডকে নামের মদ্যপ বাসকন্টাক্টরকে। পিটার এক অসহনীয় জীবন যাপন করেছেন সৎপিতার সঙ্গে। তার জন্মদাতা পিতার সঙ্গে পিটারের যখন প্রথম দেখা হয় তখন তিনি প্রাপ্তবয়স্ক। বারো বছর বয়সে পিটার হ্যান্ডকে ক্যাথলিক বয়েজ স্কুলে যান। এখানেই তার লেখালেখির শুরু, স্কুল ম্যাগাজিনে। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন এবং অ্যাভা গার্দ সাহিত্য আন্দোলনের মুখপত্র ম্যানুস্ক্রিপ্টের জন্য লিখেছেন। তিনি প্রথাবিরোধী নাট্যকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তার আলোচিত নাটক অফেন্ডিং দ্য অডিয়েন্স-এর মাধ্যমে। এ নাটকের চার চরিত্র প্রায় এক ঘণ্টা ধরে নাটক নিয়ে পর্যালোচনা করে, অডিয়েন্স বা দর্শকদের সমালোচনা করে এবং সর্বোপরি নিজেদের অভিনয়ের প্রশংসা করে। তার প্রথম নাটক দর্শক-পাঠক মহলে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি করে। হ্যান্ডকের অন্য নাটকগুলোতেও প্রথাগত প্লট, চরিত্র বা সংলাপ নেই। তার সবচেয়ে আলোচিত ও উল্লেখযোগ্য পূর্ণাঙ্গ নাটক কাসপার প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। এর আগে ১৯৬৫ সালে জার্মান প্রকাশনা সংস্থা সুহরক্যাম্প ভারলাগ তার প্রথম উপন্যাস দ্য হরনেটস প্রকাশে রাজি হলে তিনি বিশ^বিদ্যালয়ের পাঠে ইতি টানেন।
হ্যান্ডকের জন্ম অস্ট্রিয়ার করিনথিয়া প্রদেশের গ্রিফিন অঞ্চলে। জন্মের পর হ্যান্ডেকের শৈশবে ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত সময় কাটে বার্লিনের সোভিয়েত অধিকৃত প্যানকো জেলায়। এখানে ১৯৪৭ সালে তার সৎবোনের জন্ম হয়। তারপর পুরো পরিবার পুনরায় মায়ের শহর গ্রিফিনে চলে যায়। ১৯৭১ সালে হ্যান্ডকের মা আত্মহত্যা করেন। মায়ের জন্য শোক, কষ্ট এবং তার সংগ্রাম প্রতিফলিত হয়েছে তার অনেক লেখায়। মা আত্মহত্যা করার পর হ্যান্ডকে লিখেন আ সরো বিয়ন্ড ড্রিমস উপন্যাস। উপন্যাসটি ফিকশন আকারে লিখিত জীবনী ও আত্মজীবনীর মিশেল। অনেকটা নীরিক্ষাধর্মী এই উপন্যাসে পিটার হ্যান্ডকে গল্পের মধ্যে জীবনী, আত্মজীবনী, কল্পনা, চরিত্র, সংলাপ, সত্য ঘটনা- এক কথায় বর্তমান ঐতিহাসিক ফিকশন বা ডকুড্রামার বৈশিষ্ট্য ঢুকিয়ে ফেলেছেন। উপন্যাসে তার মায়ের জীবন শুরু হয় অস্ট্রিয়ার এক ছোটো গ্রামে। অবাক করার মতো বিষয় হলো, উপন্যাসে তিনি মায়ের নাম উল্লেখ করেননি। মায়েদের নৈমিত্তিক জীবন, দারিদ্র্য ও বঞ্চনার মধ্যে সত্যিকার অর্থেই কোনো মাকে আলাদা করা যায় না। আর এ কারণেই হয়তো উপন্যাসে মায়ের কোনো নাম দেননি হ্যান্ডকে। ভালোবাসাহীন বিয়ে, সাংসারিক ও সামাজিক গঞ্জনা, ফিকে হয়ে আসা স্বপ্ন, সমাজ কর্তৃক ব্যক্তিত্ব ও সম্ভাবনাকে অস্বীকার ইত্যাদি থেকে মুক্তি পেতে মা জার্মান থেকে পালিয়ে অস্ট্রিয়ায় এসে সাহিত্য ও রাজনীতিতে প্রবেশের পর পুনরায় উপলব্ধি হয় “I’m not human anymore.” তারপর জীবনের এইসব অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে, হয়তো যে অবসাদ বংশগতভাবে প্রাপ্ত, মা একদিন শান্ত ও ইচ্ছাকৃতভাবে আত্মহত্যা করে। হ্যান্ডকের নিজস্ব বর্ণনারীতি উপন্যাসটিকে বিশেষ বৈশিষ্ট্য দিয়েছে।
হ্যান্ডকে ছোটোগল্প, প্রবন্ধ, রেডিও নাটক এবং আত্মজীবনীমূলক রচনাও লিখেছেন। তাঁর রচনার প্রধান বিষয় হলো সাধারণ ভাষা, দৈনন্দিন বাস্তবতা এবং তাদের সাথে যুক্তিযুক্ত সংযোগ মানুষের উপর যে সীমাবদ্ধ কিন্তু মারাত্মক প্রভাব ফেলে যা আবার অযৌক্তিকতা, বিভ্রান্তি এমনকি পাগলামির দ্বারাও আচ্ছন্ন থাকে। হ্যান্ডকের যাবতীয় অর্জন, তার সাহিত্য-সাধনা ম্লান হয়ে যায় যখন দেখা যায় সাহিত্যে নোবেল অর্জনকারী এই সাহিত্যিক সার্বিয়ার গণহত্যা সমর্থন করেন, পাশ্চাত্যের কসাই বলে পরিচিত স্লোবোদান মিলোসেভিচকে সমর্থন করে তার পাশে দাঁড়ান। যুগোশ্লাভিয়া যুদ্ধের সমালোচনা করে লেখা অ্যা জার্নি টু দ্য রিভারস: জাস্টিস ফর সার্বিয়া সারা বিশে^ সমালোচনার ঝড় তোলে। পরবর্তীতে তার কর্মকাণ্ডের কারণে বিতর্ক তার চিরসঙ্গী হয়ে থেকেছে।
আমরা অবগত যে, ১৯৮০ সালে প্রাক্তন যুগোশ্লাভিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান মার্শাল জোসেফ টিটোর মৃত্যুর পর বহু জাতির এ রাষ্ট্রটি আর টিকতে পারেনি। মার্শাল টিটোর মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন স্লোবোদান মিলোসেভিচ। তিনি জাতিতে ছিলেন সার্বিয়ান। জাতিগতভাবে সার্বিয়ানরা ছিল অর্থোডক্স খ্রিস্টান। অনেক আগে থেকেই সার্বিয়ানদের সাথে জাতিগত দ্বন্দ্ব ছিল ক্যাথলিক খ্রিস্টান ক্রোট এবং মুসলিম বসনয়িদের সাথে। ১৯৯১ সালে স্লোভেনিয়া এবং ক্রোয়েশিয়া যুগোস্লাভিয়া থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং অতি দ্রুত স্বাধীনতা অর্জন করে। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ সালের এপ্রিল মাসে বসনিয়াও স্বাধীনতা ঘোষণা করে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বসনিয়াকে স্বীকৃতি দেয়। যুগোস্লাভিয়ার তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান স্লোবোদান মিলোসেভিচ এই স্বাধীনতা ঠেকাতে বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভো আক্রমণ করেন। বসনিয়ার মোট জনসংখ্যার ৪৪% বসনীয়, ১৭% সার্ব এবং ৩১% ক্রোট। অথচ সার্বিয়ান বাহিনী এই অজুহাত দাঁড় করায় যে তারা বসনিয়ার নির্যাতিত সার্বদের রক্ষার জন্যই বসনিয়া আক্রমণ করেছে। মূলত তাঁরা Ethnic Cleansing বা জাতিগত নিধনের লক্ষ্য নিয়ে আক্রমণ করে। সেই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সার্ব বাহিনী সার্বিয়ায় গণহত্যা চালায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার পরে এত বড় হত্যাকা- আর হয়নি। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত সার্ব আগ্রাসনে প্রায় দুই লক্ষ বসনিয়ান মুসলমান মারা যায়। বসনিয়ার যুদ্ধে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে বিশ লক্ষ মানুষ। সার্বদের হাতে ধর্ষণের স্বীকার হয় পঞ্চাশ হাজার বসনিয় মুসলিম নারী। ১৯৯৫ সালে ন্যাটোর হস্তক্ষেপে বসনিয়া স্বাধীনতা লাভ করে এবং এর মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে ইতিহাসের এক বর্বর গণহত্যার। পরবর্তীতে International Criminal Tribunal গঠন করে স্লোবোদান মিলোসেভিস, জেনারেল রাকতোসহ একশ’ ষাট জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে বিচার কাজ শুরু করা হয়। ২০০৪ সালে যুদ্ধ-অপরাধ আদালতের রিপোর্টে বলা হয়, ২৫ থেকে ত্রিশ হাজার বসনীয় মুসলিম নারী ও শিশুকে জোর করে অন্য অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং স্থানান্তরের সময় তাদের এক বিপুল অংশ ধর্ষণ ও গণহত্যার শিকার হয়। নানা সাক্ষ্য-প্রমাণে দেখা গেছে, এইসব হত্যাকা- ছিল সুপরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধ অভিযানের ফসল। বসনিয়ার যুদ্ধ চলাকালে সার্ব সেনা ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা কখনো কখনো একটি অঞ্চলে হামলা চালানোর পর সেখানকার সমস্ত পুরুষকে হত্যা করত অথবা অপহরণ করত এবং সেখানকার নারীদের ধর্ষণের পর তাদের হত্যা করত। এই ভয়াবহ হত্যা ও নির্যাতনের পক্ষে কোনো বিবেকসম্পন্ন মানুষ কথা বলতে পারেন, হত্যাকা- পরিচালনাকারী রাষ্ট্রপ্রধানের কার্যক্রমকে সমর্থন করতে পারেন এটা স্বাভাবিক বোধসম্পন্ন মানুষের পক্ষে ভাবা সম্ভব নয়।
২০১৪ সালে পিটার হ্যান্ডকে যখন আন্তর্জাতিক ইবসেন পুরস্কারে ভূষিত হন তখনও ব্যাপক সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। নরওয়েজিয়ান মিডিয়াসহ অনেকে জুরি বোর্ডের পদত্যাগ দাবি করেন। তারা যুক্তি দেখান, হ্যান্ডকে একজন ফ্যাসিস্ট এবং তিনি যুদ্ধাপরাধীর দোসর। হান্ডকে এখন থাকেন ফ্রান্সে। কিন্তু সার্বিয়ার অতি দক্ষিণপন্থীদের প্রতি তিনি সহানুভূতিশীল বলেই মনে করেন অনেকে। ২০০৬ সালে প্রাক্তন সার্বিয়ান প্রেসিডেন্ট স্লোবোদান মিলোসেভিচের শেষকৃত্যে যোগদান করেছিলেন তিনি এবং শংসাপত্র পাঠ করেছিলেন। ১৯৯০ সালে যুগোস্লাভদের সঙ্গে যুদ্ধে সার্বদের প্রতি সহানুভূতিও ব্যক্ত করেছেন-এসব নিয়ে তিনি বিস্তর লেখালেখি করেছেন। হ্যান্ডকের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে সুইডিস একাডেমি বলেছে, হ্যান্ডকে কোনো কোনো সময়ে বিতর্কের কারণ হয়েছেন, কিন্তু তিনি কোনোমতেই জ্যঁ পল সার্ত্রের মতো পক্ষাবলম্বী লেখক নন এবং তিনি আমাদের সামনে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি উপস্থাপন করেন না। নোবেল কর্তৃপক্ষের এই যুক্তি কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়েও সমালোচনা শুরু হয়েছে। হ্যান্ডকে তার অ্যা জার্নি টু দ্য রিভারস: জাস্টিস ফর সার্বিয়া গ্রন্থে প্রকাশ্যে সার্বদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে শক্তভাবে তাদের পক্ষ নিয়েছেন। সার্বদের স্বার্থ রক্ষার্থে বসনিয়ায় মিলোসেভিচ যে হত্যাজ্ঞ চালিয়েছেন হ্যান্ডকে সেই হত্যাজজ্ঞের সমর্থন করে গেছেন। গণহত্যা নিয়ে বিশ^ব্যাপী সমালোচনা হলে তিনি তার জবাব দিয়েছেন। পশ্চিমাগণমাধ্যম, যুদ্ধের বিরোধিতাকারী ও গণহত্যার বিরুদ্ধে অবস্থানকারীদের কড়া সমালোচনাও তিনি করেছিলেন। অনেকে তাকে অর্থোডক্স খ্রিস্টান মৌলবাদী হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন। কারণ তিনি এখনো সার্বিয়ান অর্থোডক্স গির্জার একজন সক্রিয় সদস্য। সার্বদের প্রতি তার মমত্ববোধ এতটাই প্রবল যে ২০১২ সাল থেকে তিনি সার্বিয়ান একাডেমি অব সায়েন্স এন্ড আর্টস-এর সদস্য।
সার্বিক দিক বিবেচনায় নোবেল কর্তৃপক্ষের কর্মকা- ক্রমাগত প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। পিটার হ্যান্ডকের তুলনায় সাহিত্যে অবদান বেশি এ-রকম অনেক সাহিত্যিক দীর্ঘদিন ধরে সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় থেকেও নোবেল পাননি। জাপানের হারুকি মুরাকামি, কেনিয়ার নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো, কানাডার মার্গারেট এটউড ও অ্যানি কারসন, সিরিয়ার কবি এডোনিস কিংবা আলবেনিয়ার ইসমাইল কাদেরির নাম বহুদিন থেকে নোবেলপ্রাপ্তির সম্ভাব্যতার তালিকায় আছে। অথচ পিটার হ্যান্ডকে, যিনি সার্বিয়দের গণহত্যাকে সমর্থন করেছেন, মুসলমানরা নিজেরা খুনখারাপি করে সার্বদের ওপর দায় চাপায় বলে গণহত্যার শিকার মুসলমানদেরকেই দোষারোপ করেছেন তাকেই নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। হ্যান্ডকের পুরস্কারপ্রাপ্তির মাধ্যমে এ পুরস্কারের উদ্যেশ্য নিয়ে সন্দেহ আরও জোরদার হতে শুরু করেছে।
জানা যায়, এই হ্যান্ডকেই একদা নোবেল পুরস্কারের সমালোচনা করে তা বন্ধ করে দেওয়ার দাবি তুলেছিলেন। ইতোমধ্যে এবারের সাহিত্যে নোবেল নিয়ে বিশে^ সমালোচনার ঝড় শুরু হয়েছে। হ্যান্ডকের নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন বিশ্বের অনেক নেতা ও মানবতাবাদী সংগঠন। সুইডিশ একাডেমি পিটার হ্যান্ডকের মতো একজন ফ্যাসিস্ট ও মৌলবাদীকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করে প্রকারান্তরে ফ্যাসিবাদকেই সমর্থন করেছে।
অনন্ত মাহফুজ
অনন্ত মাহফুজ
অনন্ত মাহফুজ
অনন্ত মাহফুজ
অনন্ত মাহফুজ
বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর ২০১৯ , ১ কার্তিক ১৪২৬, ১৭ সফর ১৪৪১
অনন্ত মাহফুজ
বিভিন্ন কারণে ক্রমাগত বিতর্কিত হয়ে পড়া নোবেল পুরস্কার নিয়ে মানুষের আগ্রহ কিছুটা কমে আসলেও ২০১৯ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার নিয়ে সারা বিশে^র পাঠকের মধ্যে বেশ আগ্রহ ছিল; কারণ এবারই প্রথমবারের মতো সাহিত্যে একসাথে দুটি পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। এই বিতর্ক আরও জোরদার হয়েছে ২০১৯ সালে পিটার হ্যান্ডকে নামক বিশ^ব্যাপী বিতর্কিত ও নিন্দিত সাহিত্যিককে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার মাধ্যমে। ইতিমধ্যে প্রায় সকলে অবহিত যে, পুরস্কার প্রদানের জন্য প্রার্থী নির্বাচনকারী সংস্থা সুইডিস একাডেমি সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের যৌন ও অর্থ কেলেঙ্কারির কারণে ২০১৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদান করেনি। এইসব কেলেঙ্কারির কেন্দ্রে আছেন সুইডিস একাডেমির অন্যতম সদস্য কবি ক্যাটরিনা ফ্রস্টেনসন এবং তার স্বামী জ্যঁ-ক্লদে আরনল্ট।
নানা জল্পনাকল্পনা হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান এবং অনেকে ব্যক্তিগতভাবে সম্ভাব্য সাহিত্যিকদের তালিকাও তৈরি করেন। অবাক করার মতো বিষয় হলো খুব কম ক্ষেত্রে এ-সকল তালিকার মধ্য থেকে কেউ নোবেল পান। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কল্পনার বাইরে কম পরিচিত কাউকে নোবেল প্রদান করে সাহিত্যপ্রেমীদের অবাক করে দেওয়া হয়। এবারও দুটি নোবেল পুরস্কারের ক্ষেত্রে সেই ঘটনাই ঘটেছে। প্রতি বছর আলোচনার শীর্ষে থাকা ব্যক্তিদের কেউ নোবেল পাননি। এমন দুই ব্যক্তিকে পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে যারা সাহিত্যবোদ্ধাদের কাছেও খুব একটা পরিচিত নন। ২০১৯ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন অস্ট্রিয়ার লেখক পিটার হ্যান্ডকে এবং ২০১৮ সালের নোবেল পুরস্কার প্রাপকের নাম পোল্যান্ডের সাহিত্যিক ওলগা তোকারচুক। দুজনেই আলোচনার একেবারে তলানিতে ছিলেন। গণহত্যার সমর্থন ও ফ্যাসিবাদী আচরণের কারণে পিটার হান্ডকের নোবেল পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারে শূন্য বলেই মনে করা হয়েছিল।
নানাবিধ কেলেঙ্কারীর জন্য স্থগিত হওয়া ২০১৮ সালের জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলো ওলগা তোকারচুককে। তাকে পোল্যান্ডের সফলতম লেখকদের অন্যতম বলে মনে করা হয়। ওলগা তোকারচুকের জন্ম ২৯ জানুয়ারি ১৯৬২ সালে, পোল্যান্ডের জিলোনা গারার নিকটে সুলেচুতে। সাহিত্যজীবন শুরু করার আগে ১৯৮০ সাল থেকে তিনি ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি একজন ঔপন্যাসিক, কবি ও মনোবিজ্ঞানী যাকে তার প্রজন্মের অন্যতম সমালোচিত, প্রশংসিত ও বাণিজ্যিকভাবে সফল লেখক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পড়াশোনার সময় তিনি আচরণগত সমস্যাযুক্ত কিশোর-কিশোরীদের একটি প্রতিষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৫ সালে ¯œাতক শেষ হওয়ার পরে তিনি প্রথমে রোককা এবং পরে ওয়ালব্রিজিকে চলে যান এবং সেখানে তিনি থেরাপিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। তোকারচুক নিজেকে বিংশ শতকের প্রভাববিস্তারকারী সুইস মনোবিজ্ঞানী ও মনোবিশ্লেষক কার্ল জাংয়ের শিষ্য হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন এবং জাংয়ের মনস্তত্ত্বকে তার সাহিত্যকর্মের অনুপ্রেরণা হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। ১৯৯৯ সাল থেকে তোকারচুক নোয়া রুদার কাছে একটি ছোট্ট গ্রাম ক্রাজানউতে বাস করতে থাকেন এবং সেখান থেকে তিনি তার ব্যক্তিগত প্রকাশনা সংস্থা রুটা পরিচালনা করেন। তিনি একজন বামপন্থী, নিরামিষভোজী এবং নারীবাদী।
ওলগা তোকারচুক নিজ দেশেই ব্যাপক সমাদৃত আবার সমালোচিতও। খুব বেশিদিন হয়নি তিনি ইংরেজি পাঠকদের নজরে এসেছেন। ২০১৮ সালে Flights উপন্যাসের জন্য ম্যান বুকার পুরস্কার জিতেছেন। এই বইটি ২০০৭ সালের ইরবমঁহর উপন্যাসের অনুবাদ এবং ওই বছরেই বইটি পোল্যান্ডে প্রকাশিত হয়। ফ্লাইটস এক জটিল উপন্যাস। বলা হয়ে থাকে, উপন্যাসটি পড়বার জন্য নয়, বোধগম্যতার জন্য। এক শ ষোলোটি পারস্পরিক শিথিল সম্পর্কযুক্ত চিত্র বা ভ্রমণ-বর্ণনার মাধ্যমে উপন্যাসটি সামনের দিকে এগিয়ে যায়। উপন্যাসের ছোটো এবং বড় দৃশ্যকল্পের বর্ণনাকারী একজন নামহীন নারী। কোনো অধ্যায় না থাকলেও এক শ ষোলোটি ভ্রমণ বর্ণনার অনুচ্ছেদগুলোর প্রতিটির একটি শিরোনাম আছে। যেমন, ‘আমার বাড়ি আমার হোটেল’, ‘তিন শত কিলোমিটার’, ‘বিমানবন্দর’, ‘গাইড বই’, ‘নতুন এথেন্স’, ‘উইকিপিডিয়া’, ‘বোর্ডিং’ ইত্যাদি। এসব অনুচ্ছেদ কোনোটি মাত্র এক লাইনের, আবার কোনোটি একত্রিশ পৃষ্ঠার। তোকারচুকের নিজের ভাষায় ফ্লাইটস “constellation novel” বা “গুচ্ছ উপন্যাস”। ‘ফ্লাইট’ মূলত চলমানতার প্রতীক। থেমে থাকা যেন জীবনবিরুদ্ধ। প্রথাগত কোনো সাধারণ উপন্যাসের কাঠামোতে ফেলে এ উপন্যাসটিকে বিচার সম্ভব নয়। উপন্যাসের পোলিশ শিরোনাম Bieguni প্রাচীন রাশিয়ার একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে বোঝায় যারা কখনো কারও দ্বারা শাসিত হতে চায়নি, না রাষ্ট্র না চার্চ। শাসন বা নিয়ন্ত্রণের পরিস্থিতির উদ্ভব হলে তারা সেই স্থান ত্যাগ করেছে। ক্রমাগত ভ্রমণের মধ্যেই কেটে যেত তাদের জীবন। উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন জেনিফার ক্রফট। ফ্লাইটস ২০০৮ সালে পোল্যান্ডের শীর্ষস্থানীয় সাহিত্যের পুরস্কার নাইক অ্যাওয়ার্ড জিতেছিল।
নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করতে গিয়ে তার বিষয়ে সুইডিশ একাডেমি বলেছে ওলগা তোকারচুককে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হলো “for a narrative imagination that with encyclopedic passion represents the crossing of boundaries as a form of life”। তাঁর অধিকাংশ সাহিত্যকর্মই ঐতিহাসিক বা মিথিক্যাল প্রেক্ষপটে, বাস্তববাদী অনুপুঙ্খসহ এবং তার থিম হলো সাংস্কৃতিক বৈপরীত্যের টেনশন, কখনো তা যুক্তি বনাম উন্মাদনা, কখনো নারী বনাম পুরুষ, আবার কখনো গৃহ বনাম বিচ্ছিন্নতা। উপন্যাসের জন্য বুকার পাওয়া সাতান্ন বছর বয়সী লেখিকা তোকারচুক সাহিত্যের জগতে পা রাখেন কবিতার হাত ধরে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ সিটিজ অফ মিররস। ১৯৯৩ সালে তোকচুকের প্রথম উপন্যাস দ্য জার্নি অব দ্য বুক-পিপল প্রকাশিত হয়। সতেরো শতকের প্রেক্ষাপটে লেখা এই উপন্যাসের আখ্যান এক প্রেমিক দম্পতির একটি হারিয়ে যাওয়া বই অন্বেষণ নিয়ে গড়ে ওঠে। এ বছর সুইডিশ নোবেল কমিটি ২০১৮ সালের নোবেল প্রাপক হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা করে বলে, তোকারচুক এমন একজন আখ্যানকার যিনি আবেগময় বর্ণনাত্মক কল্পনা দিয়ে দেশ-কালের সীমা ভেঙে দেন।
তাঁর সাড়া জাগানো এবং তৃতীয় উপন্যাস Prawiek i inne czasy প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ সালে। ২০১০ সালে এই উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ Primeval and Other Times প্রকাশিত হয়। এ উপন্যাসের প্রেক্ষিতও এক মিথিক্যাল বা পৌরাণিক স্থান কিন্তু তা আবার বাস্তবতাপূর্ণও। এটি পোল্যান্ডের একেবারে কেন্দ্রস্থল প্রভিয়েক (প্রাইভাল) নামক কল্পিত গ্রামকে কেন্দ্র করে যে লোকালয়টি কিছু বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক চরিত্র দ্বারা পূর্ণ। উপন্যাসে দেখা যায়, এই গ্রাম চারটি শ্রেষ্ঠ শ্রেণির দেবদূত দ্বারা রক্ষিত। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রভিয়েকের বাসিন্দাদের জীবন আট দশক ধরে চলমান থাকে- যা ১৯১৪ সালে শুরু হয়েছিল। অ্যাকাডেমি বলেছে, তোকারজুকের এই ন্যারেটিভ হলো অতীতের ভাবমূর্তির সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত বোঝাপড়ার চেষ্টা- যা ১৯৮৯ পরবর্তী সময়ে নতুন পোলিশ সাহিত্যের এক চমৎকার উদাহরণ, যেখানে নীতিবিচারকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা হয়েছে এবং জাতির বিবেকের প্রতিনিধিত্ব করতে অনিচ্ছাও বিবৃত হয়েছে। ওলগার বারোতম, সর্বশেষ ও সর্ববৃহৎ কাজ হলো Ksiegi Jakubowe, ২০১৪ সালে প্রকাশিত এ উপন্যাসের ইংরেজি নাম The Books of Jacob। নয় শ পৃষ্ঠার এই উপন্যাস অষ্টাদশ শতাব্দির ইহুদি সম্প্রদায়ের এক নেতা জ্যাকব ফ্যাঙ্ককে নিয়ে, যার নাম খুব কম লোকেই জানে। ইহুদি ধর্মানুসারী জ্যাকব অত্যন্ত বিতর্কিত ঐতিহাসিক চরিত্র। তিনি ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিম সম্প্রদায়কে একত্রিত করার প্রয়াসের মাধ্যমে গোঁড়াদের চক্ষুশূল হয়েছিলেন। ২০১৪ সালে প্রকাশের পর প্রায় এক বছর উপন্যাসটি বেস্ট সেলার ছিল। কবিতা, গল্প ও নীরিক্ষাধর্মী উপন্যাস লিখলেও পরবর্তীতে তোকারচুকের সাহিত্যকর্ম উপন্যাসের ধারা থেকে ছোটো গদ্য এবং প্রবন্ধের দিকে যেতে শুরু করে। তার পরবর্তী বই জাজাফা বা দ্য ওয়ার্ড্রোব প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে যা তিনটি নভেলার গল্পের সংকলন। ২০০৪ সালে প্রকাশিত দ্য লাস্ট স্টোরিজ তিনটি প্রজন্মের দৃষ্টিকোণ থেকে মৃত্যুর অনুসন্ধান। ওলগার লেখার বিষয় ও ভাব ক্রিস্টালের মতো স্বচ্ছ, তিনি যা বলতে চান তা অনুবাদ এবং প্রবাহিত করাও সহজ বলেই মনে করা হয়।
তোকারচুক দেশে এবং দেশের বাইরে অসংখ্য সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেছেন। ম্যান বুকার ছাড়াও তিনি ২০১৩ সালে ভিলেনিকা পুরস্কার অর্জন করেন। ২০১৪ সালে প্রকাশিত মহাকাব্যিক উপন্যাস The Books of Jacob-এর জন্য আরও একবার নাইক অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন। এর ঐতিহাসিক পটভূমি আঠারো শতকের পোল্যান্ড এবং পূর্ব-মধ্য ইউরোপ এবং এটি ইহুদি ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বের সাথে স¤পর্কিত। বইটি সমালোচক এবং পাঠকদের কাছে সমাদৃত হয়েছিল, তবে পোলিশ জাতীয়তাবাদীরা উপন্যাসটিকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। এ উপন্যাসের জন্য ঘৃণা ও হয়রানির শিকার হয়েছিলেন তোকারচুক। ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয় ডিটেকটিভ ঘরানার উপন্যাস ড্রাইভ ইউর প্লাউ ওভার দ্য বোনস অব দ্য ডেড। এ উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ২০১৫ সালে ‘নোকা রুডা দেশপ্রেমিক সংস্থা’ তোকারচুকের সমালোচনা করে বলে, নগরীর কাউন্সিল যেন এই লেখকের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রত্যাহার করে নেয়। সমিতির দাবি অনুসারে, তিনি পোলিশ জাতির নাম কলঙ্কিত করেছিলেন। তোকারচুকও এই সমালোচনার কড়া জবাব দিয়েছিলেন। তোকারচুকের নোবেল পাওয়া নিয়ে দ্য গার্ডিয়ান মন্তব্য করেছে, সাম্প্রতিক সময়ে সুইডিশ একাডেমি অনেক ভুল করেছে। তবে পোলিশ লেখক তোকারচুককে পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করে তারা মোটেও ভুল করেনি। বছরখানেক আগে ওলগা তোকারচুক মন্তব্য করেছিলেন, “আমি মাঝে মাঝে ভাবি, আমার বই যদি ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হতো তাহলে কেমন হতো। ইংরেজি একটি আন্তর্জাতিক ভাষা। ইংরেজিতে বই প্রকাশিত হওয়া মানে তা আন্তর্জাতিক হয়ে যাওয়া।”
ওলগা তোকারচুকের নোবেল পাওয়া নিয়ে তেমন আলোচনা না হলেও ২০১৯ সালের নোবেলজয়ী লেখক পিটার হ্যান্ডকের নোবেল ইতিমধ্যে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এই লেখকের জন্ম সোভিয়েত অধিকৃত বার্লিনে, ১৯৪২ সালের ৬ ডিসেম্বর। সুইডিশ একাডেমি বলেছে, দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর সবচেয়ে প্রভাবশালী লেখকদের মধ্যে অন্যতম তিনি। তাকে নোবেল প্রদান করা হয়েছে “for an influential work that with linguistic ingenuity has explored the periphery and the specificity of human experience”। পিটার হ্যান্ডকে গ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ার সময়ে ১৯৬৫ সালে মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দেন, যোগ দেন আভা গার্দ আন্দোলনে। তিনি বেশকিছু সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন। ৭৬ বছর বয়সী হ্যান্ডকের প্রথম উপন্যাস উরব Die Hornissen বা দ্য হরনেটস প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালে। পঞ্চাশ বছরের লেখালেখি জীবনে তার সাহিত্যকর্ম উল্লেখ করার মতো সমৃদ্ধ।
১৯৭৮ সালে তাঁর পরিচালনায় তৈরি ছবি দ্য লেফট হ্যান্ডেড ওম্যান সে বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন পাম পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয় এবং ১৯৮০ সালে জার্মান আর্টহাউস সিনেমা স্বর্ণপদক জিতে নেয়। তার চিত্রনাট্যে নির্মিত দ্য রং মুভ সিনেমাটি ১৯৭৫ সালে জার্মান স্বর্ণপদক লাভ করে। ১৯৬৯ সালে নতুন ধারার বাণিজ্যিক ধারণা নিয়ে কয়েকজন লেখকের সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ভারলাগ ডার অটোরেন। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হ্যান্ডকের ভ্রমণালেখ্য অ্যা জার্নি টু দ্য রিভারস: জাস্টিস ফর সার্বিয়া বিতর্কের সৃষ্টি করে, কারণ হ্যান্ডকে সার্বিয়াকে যুগোস্লাভ যুদ্ধের শিকার হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। একই প্রবন্ধে হ্যান্ডকে পশ্চিমা গণমাধ্যমকে আক্রমণ করেছিলেন। তিনি অভিযোগ করেন, পশ্চিমা গণমাধ্যম যুদ্ধের কারণ ও পরিণতি ভুলভাবে উপস্থাপন করে আসছে।
শৈশব থেকেই স্বাভাবিক জীবনযাপন হয়ে ওঠেনি হ্যান্ডকের। অস্ট্রিয়ায় এক সংখ্যালঘু মহিলা ছিলেন হ্যান্ডকের মা। তার বাবা ছিলেন এক জার্মান ক্লার্ক ও সৈনিক। পিটারের জন্মের আগেই তার মা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন ব্রোনো হ্যান্ডকে নামের মদ্যপ বাসকন্টাক্টরকে। পিটার এক অসহনীয় জীবন যাপন করেছেন সৎপিতার সঙ্গে। তার জন্মদাতা পিতার সঙ্গে পিটারের যখন প্রথম দেখা হয় তখন তিনি প্রাপ্তবয়স্ক। বারো বছর বয়সে পিটার হ্যান্ডকে ক্যাথলিক বয়েজ স্কুলে যান। এখানেই তার লেখালেখির শুরু, স্কুল ম্যাগাজিনে। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন এবং অ্যাভা গার্দ সাহিত্য আন্দোলনের মুখপত্র ম্যানুস্ক্রিপ্টের জন্য লিখেছেন। তিনি প্রথাবিরোধী নাট্যকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তার আলোচিত নাটক অফেন্ডিং দ্য অডিয়েন্স-এর মাধ্যমে। এ নাটকের চার চরিত্র প্রায় এক ঘণ্টা ধরে নাটক নিয়ে পর্যালোচনা করে, অডিয়েন্স বা দর্শকদের সমালোচনা করে এবং সর্বোপরি নিজেদের অভিনয়ের প্রশংসা করে। তার প্রথম নাটক দর্শক-পাঠক মহলে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি করে। হ্যান্ডকের অন্য নাটকগুলোতেও প্রথাগত প্লট, চরিত্র বা সংলাপ নেই। তার সবচেয়ে আলোচিত ও উল্লেখযোগ্য পূর্ণাঙ্গ নাটক কাসপার প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। এর আগে ১৯৬৫ সালে জার্মান প্রকাশনা সংস্থা সুহরক্যাম্প ভারলাগ তার প্রথম উপন্যাস দ্য হরনেটস প্রকাশে রাজি হলে তিনি বিশ^বিদ্যালয়ের পাঠে ইতি টানেন।
হ্যান্ডকের জন্ম অস্ট্রিয়ার করিনথিয়া প্রদেশের গ্রিফিন অঞ্চলে। জন্মের পর হ্যান্ডেকের শৈশবে ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত সময় কাটে বার্লিনের সোভিয়েত অধিকৃত প্যানকো জেলায়। এখানে ১৯৪৭ সালে তার সৎবোনের জন্ম হয়। তারপর পুরো পরিবার পুনরায় মায়ের শহর গ্রিফিনে চলে যায়। ১৯৭১ সালে হ্যান্ডকের মা আত্মহত্যা করেন। মায়ের জন্য শোক, কষ্ট এবং তার সংগ্রাম প্রতিফলিত হয়েছে তার অনেক লেখায়। মা আত্মহত্যা করার পর হ্যান্ডকে লিখেন আ সরো বিয়ন্ড ড্রিমস উপন্যাস। উপন্যাসটি ফিকশন আকারে লিখিত জীবনী ও আত্মজীবনীর মিশেল। অনেকটা নীরিক্ষাধর্মী এই উপন্যাসে পিটার হ্যান্ডকে গল্পের মধ্যে জীবনী, আত্মজীবনী, কল্পনা, চরিত্র, সংলাপ, সত্য ঘটনা- এক কথায় বর্তমান ঐতিহাসিক ফিকশন বা ডকুড্রামার বৈশিষ্ট্য ঢুকিয়ে ফেলেছেন। উপন্যাসে তার মায়ের জীবন শুরু হয় অস্ট্রিয়ার এক ছোটো গ্রামে। অবাক করার মতো বিষয় হলো, উপন্যাসে তিনি মায়ের নাম উল্লেখ করেননি। মায়েদের নৈমিত্তিক জীবন, দারিদ্র্য ও বঞ্চনার মধ্যে সত্যিকার অর্থেই কোনো মাকে আলাদা করা যায় না। আর এ কারণেই হয়তো উপন্যাসে মায়ের কোনো নাম দেননি হ্যান্ডকে। ভালোবাসাহীন বিয়ে, সাংসারিক ও সামাজিক গঞ্জনা, ফিকে হয়ে আসা স্বপ্ন, সমাজ কর্তৃক ব্যক্তিত্ব ও সম্ভাবনাকে অস্বীকার ইত্যাদি থেকে মুক্তি পেতে মা জার্মান থেকে পালিয়ে অস্ট্রিয়ায় এসে সাহিত্য ও রাজনীতিতে প্রবেশের পর পুনরায় উপলব্ধি হয় “I’m not human anymore.” তারপর জীবনের এইসব অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে, হয়তো যে অবসাদ বংশগতভাবে প্রাপ্ত, মা একদিন শান্ত ও ইচ্ছাকৃতভাবে আত্মহত্যা করে। হ্যান্ডকের নিজস্ব বর্ণনারীতি উপন্যাসটিকে বিশেষ বৈশিষ্ট্য দিয়েছে।
হ্যান্ডকে ছোটোগল্প, প্রবন্ধ, রেডিও নাটক এবং আত্মজীবনীমূলক রচনাও লিখেছেন। তাঁর রচনার প্রধান বিষয় হলো সাধারণ ভাষা, দৈনন্দিন বাস্তবতা এবং তাদের সাথে যুক্তিযুক্ত সংযোগ মানুষের উপর যে সীমাবদ্ধ কিন্তু মারাত্মক প্রভাব ফেলে যা আবার অযৌক্তিকতা, বিভ্রান্তি এমনকি পাগলামির দ্বারাও আচ্ছন্ন থাকে। হ্যান্ডকের যাবতীয় অর্জন, তার সাহিত্য-সাধনা ম্লান হয়ে যায় যখন দেখা যায় সাহিত্যে নোবেল অর্জনকারী এই সাহিত্যিক সার্বিয়ার গণহত্যা সমর্থন করেন, পাশ্চাত্যের কসাই বলে পরিচিত স্লোবোদান মিলোসেভিচকে সমর্থন করে তার পাশে দাঁড়ান। যুগোশ্লাভিয়া যুদ্ধের সমালোচনা করে লেখা অ্যা জার্নি টু দ্য রিভারস: জাস্টিস ফর সার্বিয়া সারা বিশে^ সমালোচনার ঝড় তোলে। পরবর্তীতে তার কর্মকাণ্ডের কারণে বিতর্ক তার চিরসঙ্গী হয়ে থেকেছে।
আমরা অবগত যে, ১৯৮০ সালে প্রাক্তন যুগোশ্লাভিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান মার্শাল জোসেফ টিটোর মৃত্যুর পর বহু জাতির এ রাষ্ট্রটি আর টিকতে পারেনি। মার্শাল টিটোর মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন স্লোবোদান মিলোসেভিচ। তিনি জাতিতে ছিলেন সার্বিয়ান। জাতিগতভাবে সার্বিয়ানরা ছিল অর্থোডক্স খ্রিস্টান। অনেক আগে থেকেই সার্বিয়ানদের সাথে জাতিগত দ্বন্দ্ব ছিল ক্যাথলিক খ্রিস্টান ক্রোট এবং মুসলিম বসনয়িদের সাথে। ১৯৯১ সালে স্লোভেনিয়া এবং ক্রোয়েশিয়া যুগোস্লাভিয়া থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং অতি দ্রুত স্বাধীনতা অর্জন করে। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ সালের এপ্রিল মাসে বসনিয়াও স্বাধীনতা ঘোষণা করে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বসনিয়াকে স্বীকৃতি দেয়। যুগোস্লাভিয়ার তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান স্লোবোদান মিলোসেভিচ এই স্বাধীনতা ঠেকাতে বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভো আক্রমণ করেন। বসনিয়ার মোট জনসংখ্যার ৪৪% বসনীয়, ১৭% সার্ব এবং ৩১% ক্রোট। অথচ সার্বিয়ান বাহিনী এই অজুহাত দাঁড় করায় যে তারা বসনিয়ার নির্যাতিত সার্বদের রক্ষার জন্যই বসনিয়া আক্রমণ করেছে। মূলত তাঁরা Ethnic Cleansing বা জাতিগত নিধনের লক্ষ্য নিয়ে আক্রমণ করে। সেই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সার্ব বাহিনী সার্বিয়ায় গণহত্যা চালায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার পরে এত বড় হত্যাকা- আর হয়নি। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত সার্ব আগ্রাসনে প্রায় দুই লক্ষ বসনিয়ান মুসলমান মারা যায়। বসনিয়ার যুদ্ধে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে বিশ লক্ষ মানুষ। সার্বদের হাতে ধর্ষণের স্বীকার হয় পঞ্চাশ হাজার বসনিয় মুসলিম নারী। ১৯৯৫ সালে ন্যাটোর হস্তক্ষেপে বসনিয়া স্বাধীনতা লাভ করে এবং এর মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে ইতিহাসের এক বর্বর গণহত্যার। পরবর্তীতে International Criminal Tribunal গঠন করে স্লোবোদান মিলোসেভিস, জেনারেল রাকতোসহ একশ’ ষাট জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে বিচার কাজ শুরু করা হয়। ২০০৪ সালে যুদ্ধ-অপরাধ আদালতের রিপোর্টে বলা হয়, ২৫ থেকে ত্রিশ হাজার বসনীয় মুসলিম নারী ও শিশুকে জোর করে অন্য অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং স্থানান্তরের সময় তাদের এক বিপুল অংশ ধর্ষণ ও গণহত্যার শিকার হয়। নানা সাক্ষ্য-প্রমাণে দেখা গেছে, এইসব হত্যাকা- ছিল সুপরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধ অভিযানের ফসল। বসনিয়ার যুদ্ধ চলাকালে সার্ব সেনা ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা কখনো কখনো একটি অঞ্চলে হামলা চালানোর পর সেখানকার সমস্ত পুরুষকে হত্যা করত অথবা অপহরণ করত এবং সেখানকার নারীদের ধর্ষণের পর তাদের হত্যা করত। এই ভয়াবহ হত্যা ও নির্যাতনের পক্ষে কোনো বিবেকসম্পন্ন মানুষ কথা বলতে পারেন, হত্যাকা- পরিচালনাকারী রাষ্ট্রপ্রধানের কার্যক্রমকে সমর্থন করতে পারেন এটা স্বাভাবিক বোধসম্পন্ন মানুষের পক্ষে ভাবা সম্ভব নয়।
২০১৪ সালে পিটার হ্যান্ডকে যখন আন্তর্জাতিক ইবসেন পুরস্কারে ভূষিত হন তখনও ব্যাপক সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। নরওয়েজিয়ান মিডিয়াসহ অনেকে জুরি বোর্ডের পদত্যাগ দাবি করেন। তারা যুক্তি দেখান, হ্যান্ডকে একজন ফ্যাসিস্ট এবং তিনি যুদ্ধাপরাধীর দোসর। হান্ডকে এখন থাকেন ফ্রান্সে। কিন্তু সার্বিয়ার অতি দক্ষিণপন্থীদের প্রতি তিনি সহানুভূতিশীল বলেই মনে করেন অনেকে। ২০০৬ সালে প্রাক্তন সার্বিয়ান প্রেসিডেন্ট স্লোবোদান মিলোসেভিচের শেষকৃত্যে যোগদান করেছিলেন তিনি এবং শংসাপত্র পাঠ করেছিলেন। ১৯৯০ সালে যুগোস্লাভদের সঙ্গে যুদ্ধে সার্বদের প্রতি সহানুভূতিও ব্যক্ত করেছেন-এসব নিয়ে তিনি বিস্তর লেখালেখি করেছেন। হ্যান্ডকের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে সুইডিস একাডেমি বলেছে, হ্যান্ডকে কোনো কোনো সময়ে বিতর্কের কারণ হয়েছেন, কিন্তু তিনি কোনোমতেই জ্যঁ পল সার্ত্রের মতো পক্ষাবলম্বী লেখক নন এবং তিনি আমাদের সামনে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি উপস্থাপন করেন না। নোবেল কর্তৃপক্ষের এই যুক্তি কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়েও সমালোচনা শুরু হয়েছে। হ্যান্ডকে তার অ্যা জার্নি টু দ্য রিভারস: জাস্টিস ফর সার্বিয়া গ্রন্থে প্রকাশ্যে সার্বদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে শক্তভাবে তাদের পক্ষ নিয়েছেন। সার্বদের স্বার্থ রক্ষার্থে বসনিয়ায় মিলোসেভিচ যে হত্যাজ্ঞ চালিয়েছেন হ্যান্ডকে সেই হত্যাজজ্ঞের সমর্থন করে গেছেন। গণহত্যা নিয়ে বিশ^ব্যাপী সমালোচনা হলে তিনি তার জবাব দিয়েছেন। পশ্চিমাগণমাধ্যম, যুদ্ধের বিরোধিতাকারী ও গণহত্যার বিরুদ্ধে অবস্থানকারীদের কড়া সমালোচনাও তিনি করেছিলেন। অনেকে তাকে অর্থোডক্স খ্রিস্টান মৌলবাদী হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন। কারণ তিনি এখনো সার্বিয়ান অর্থোডক্স গির্জার একজন সক্রিয় সদস্য। সার্বদের প্রতি তার মমত্ববোধ এতটাই প্রবল যে ২০১২ সাল থেকে তিনি সার্বিয়ান একাডেমি অব সায়েন্স এন্ড আর্টস-এর সদস্য।
সার্বিক দিক বিবেচনায় নোবেল কর্তৃপক্ষের কর্মকা- ক্রমাগত প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। পিটার হ্যান্ডকের তুলনায় সাহিত্যে অবদান বেশি এ-রকম অনেক সাহিত্যিক দীর্ঘদিন ধরে সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় থেকেও নোবেল পাননি। জাপানের হারুকি মুরাকামি, কেনিয়ার নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো, কানাডার মার্গারেট এটউড ও অ্যানি কারসন, সিরিয়ার কবি এডোনিস কিংবা আলবেনিয়ার ইসমাইল কাদেরির নাম বহুদিন থেকে নোবেলপ্রাপ্তির সম্ভাব্যতার তালিকায় আছে। অথচ পিটার হ্যান্ডকে, যিনি সার্বিয়দের গণহত্যাকে সমর্থন করেছেন, মুসলমানরা নিজেরা খুনখারাপি করে সার্বদের ওপর দায় চাপায় বলে গণহত্যার শিকার মুসলমানদেরকেই দোষারোপ করেছেন তাকেই নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। হ্যান্ডকের পুরস্কারপ্রাপ্তির মাধ্যমে এ পুরস্কারের উদ্যেশ্য নিয়ে সন্দেহ আরও জোরদার হতে শুরু করেছে।
জানা যায়, এই হ্যান্ডকেই একদা নোবেল পুরস্কারের সমালোচনা করে তা বন্ধ করে দেওয়ার দাবি তুলেছিলেন। ইতোমধ্যে এবারের সাহিত্যে নোবেল নিয়ে বিশে^ সমালোচনার ঝড় শুরু হয়েছে। হ্যান্ডকের নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন বিশ্বের অনেক নেতা ও মানবতাবাদী সংগঠন। সুইডিশ একাডেমি পিটার হ্যান্ডকের মতো একজন ফ্যাসিস্ট ও মৌলবাদীকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করে প্রকারান্তরে ফ্যাসিবাদকেই সমর্থন করেছে।