লিটন চক্রবর্তী মিঠুন
দিন কয়েক আগে যখন নোবেল পুরস্কার কমিটি সাহিত্য ক্যাটাগরিতে ২০১৯ সালের বিজয়ী হিসেবে অস্ট্রীয় ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্র পরিচালক পিটার হান্ডকের নাম ঘোষণা করে, অমনি সারা দুনিয়ার সাহিত্য মহলে ঢিঢিক্কার পড়ে যায় আর ‘মিডিয়া ভেসে যায় বুড়িগঙ্গা জলে’। এর আগে এ মহাত্মনের নাম শুনিনি। তাই গুগল সাহেবের সাহারা নিতেই চোখের সামনে উঠে আসে এনার একের পর এক কেলোর কীর্তি। ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানের সৌজন্যে জানতে পারি, ১৯৯৯ সালে এনাকে খ্যাতনামা লেখক সালমান রুশদী “ইন্টারন্যাশনাল মরোন অব দ্য ইয়ার” বা ‘বছরের সেরা আন্তর্জাতিক হাবলা’ ক্যাটাগরির রানার-আপ হিসেবে ঘোষণা দেন। কারণটা পড়ে আমার মেজাজ একদম খিঁচড়ে যায়। বলকানের অন্যতম কসাইখ্যাত স্লবোদান মিলোসেবিচের গণহত্যাকারী সরকারের সপক্ষে ধারাবাহিকভাবে তীব্র আবেগাকীর্ণ লিখিত সাফাই গাওয়াই ছিল সে কারণ। যার নেতৃত্বে হাজারো বসনীয় মুসলমানের রক্তে ভেসে যায় সেব্রেনিকা তথা বসনিয়া-হার্জেগোবিনার পথ-প্রান্তর তার সমর্থনে নিজের কলম যিনি ধরতে পারেন এবং গণহত্যার হোতা হিসেবে স্বয়ং আক্রান্ত জনগোষ্ঠীকেই যিনি দায়ী করতে পারেন, তিনি যদি সাহিত্যিক হন তো “জানোয়ার কিস কো কেহতে হ্যায়?” বিষয়টা ঠিক এখানেই চুকে যায়নি। আন্তর্জাতিক আদালতে মিলোসেবিচের বিচার কার্যক্রমে এবং পরবর্তীতে ২০০৬ সালে তার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে, সর্বত্র সানাইয়ের পোঁ হিসেবে হাজির ছিলেন এ ঘাগু কলম-কলঙ্কী।
তবে হান্ডকেকে নিয়ে সবচেয়ে সরস মন্তব্যটি করেছেন স্লোভেনীয় দার্শনিক স্লাভোজ জিজেক। গার্ডিয়ানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন যে, ২০১৪ সালে হান্ডকে নোবেল পুরস্কারকে বিলুপ্ত করে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সাহিত্যের মেকী ক্যাননাইজেশান বা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের অভিযোগে। এবার সে পুরস্কারটি পেয়ে নিজের অভিযোগটাকেই খোদ নিজেই পাক্কা করে দিল। অন্যদিকে, লেখক হারি কুঞ্জরু হান্ডকের অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টির খানিকটা তারিফ করলেও তার বীভৎস নৈতিক অন্ধত্বের ব্যাপারটাকেও স্বীকার করে নেন। তিনি তার নোবেল প্রাপ্তিকে সুইডিশ কমিটির জন্য “ট্রাবলিং চয়েস” বা ঝামেলাপূর্ণ বাছাই হিসেবে উল্লেখ করেন। আরেক স্লোভেনীয় লেখক মিহা মাজ্জিনি তার রাগ উগরে দেন এই বলে, “কোনও কোনও শিল্পী নিজেদের মানবাত্মা বিকিয়ে দেন আদর্শের খাতিরে (যেমন: হামসুন ও নাৎসিবাদ), কেউ কেউ ঘৃণার কাছে (যেমন: সেলিন ও তার তীব্র সেমিটীয়-বিরোধিতা), কেউ কেউ আবার অর্থ ও ক্ষমতার মোহে পড়ে (যেমন: কুস্তুরিকা); কিন্তু আমাকে সবচেয়ে বেশি মর্মাহত করেছে হান্ডকে, মিলোসেবিচ সরকারের সপক্ষে তার বাচ্চাসুলভ ভ্যাবলামির কারণে।” হান্ডকের এত এত প্রশংসা পড়ে নিশ্চয়ই আপনারাও তার ব্যাপারে এতক্ষণে মনস্থির করে ফেলেছেন। দাঁড়ান। কাহানি আভি বাকি হ্যায়।
এবারই অন্যান্য সাহিত্য পুরস্কারের ব্যাপারে নীরব থাকার নিজস্ব প্রটোকল ভেঙ্গে সাহিত্য ও মানবতাবাদী সংগঠন পেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, ঔপন্যাসিক জেনিফার এগান একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রদান করেছেন: “আমরা হতভম্ব হয়েছি এমন একজন লেখককে নির্বাচন করায় যিনি কিনা নিজের পাবলিক ভয়েস ব্যবহার করে থাকেন ঐতিহাসিক সত্যকে কেটেছেঁটে ফেলতে এবং সাবেক সার্বীয় প্রেসিডেন্ট স্লবোদান মিলোসেবিচ ও বসনীয় সার্ব নেতা রাদোভান কারাজিচের মতো গণহত্যার হোতাদের আনুষ্ঠানিক প্রণোদনা ও উৎসাহ দেবার কাজে।” তিনি আরও বলেন, “আমরা এমন সিদ্ধান্তকে নাকচ করি যা একজন লেখককে তার ‘ভাষার চাতুর্যপূর্ণ উদ্ভাবনশীলতার’ জন্যে উদ্যাপন করে থাকে অথচ যিনি সুলিপিবদ্ধ যুদ্ধাপরাধের দলিলসমূহকে লাগাতার প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদ, স্বৈরাচারী নেতৃত্ব এবং বিশ্বজুড়ে চলতে থাকা ব্যাপক তথ্যবিকৃতির এ কুক্ষণে সাহিত্যসমাজ এরচেয়ে ভাল কিছুর যোগ্য দাবি রাখে। আমরা নোবেল কমিটি অন লিটারেচারের এ নির্বাচনে তীব্র দুঃখপ্রকাশ করছি।”
হান্ডকে যে কেবল তার সমালোচকদের হাতে দাঁতানি-ধাবড়ানি খেয়েছেন তা নয়, তার অনেক বন্ধু-শুভাকাক্সক্ষীও তাকে বিভিন্ন সময়ে বাটাম দিয়েছেন তার উৎপটাং রাজনৈতিক ও আদর্শিক অবস্থানের জন্য। ২০০৮ সালে ঔপন্যাসিক জোনাথন লেটেল বলেন, “সে হয়তো একজন চমৎকার শিল্পী হতে পারে, কিন্তু মানুষ হিসেবে সে আমার দুশমন... ও একটা গান্ডু!” অ্যালেন ফিনকিয়েল্করাউত হান্ডকেকে “একজন আদর্শিক দৈত্য” হিসেবে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছেন। শুধু কি তাই! বহুদিনের বন্ধু সুসান সন্তাগ বলেছেন যে, হান্ডকের বিতিকিচ্ছিরি মন্তব্য তাকে তার নিউ ইয়র্কস্থ বন্ধুমহলে “ফিনিশ” করে দিয়েছে।
এতসব প্রশংসা শুনে পাঠকদের নিশ্চয়ই এনার সাহিত্য নিয়ে আগ্রহ মরে-হেজে শেষ হয়ে যাবার কথা। ব্যতিক্রমী কেউ কেউ হয়তো উল্টে হান্ডকের ব্যাপারে কৌতূহলী হয়ে উঠবেন। ওনার বইয়ের অনলাইন অর্ডার দেবেন। কোনও কোনও প্রকাশক আসছে বইমেলাকে সামনে রেখে এনার বই অনুবাদের কাজে হাত লাগাবেন হয়তোবা। পত্রিকার সাহিত্যপাতাগুলো বেশ কিছু দিন এনার কাজকম্মো নিয়ে শোরগোল করতে থাকবে। তারপর “একদিন ঝড় থেমে যাবে। পৃথিবী আবার শান্ত হবে।” আমার বিরক্তিটা ঠিক এখানেই। নোবেল কমিটি তারকাটা নাকি কানকাটা?
প্রত্যেক বছর যখন নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণার সময়ক্ষণ ঘনিয়ে আসে, সাহিত্যমহলে জল্পনা-কল্পনার ডানা মেলতে থাকে। বিশ্বের তাবড় তাবড় মহান সাহিত্যিকদের কারও না কারও কপালে নোবেলের তকমা জুটুক, এ পুষ্পিত কামনা অনেকের মনে জেগে ওঠে। অন্তত, ইউরোপ-আমেরিকার বাইরের বিশাল বিশ্বের কেউ যাদের চিন্তার দানে ভরে উঠেছে আমাদের মননরাজ্য, ভাবনার জগৎ। তাঁদের কেউ কেউ জীবনের প্রান্তসীমার আশেপাশে, অথচ মরণোত্তর নোবেল বলে কিছু হয় না। নোবেল না পাওয়া হয়তো এদের জন্যে বড় কোনও ব্যাপার নয়, কিন্তু স্বীকৃতিরও নিশ্চয়ই একটা মূল্য আছে। আবার, স্বীকৃতির নামে যে সার্কাস চালাচ্ছে নোবেল কমিটি তারও একটা যবনিকা দরকার। মাঝেমাঝে দুয়েকজন যোগ্য সাহিত্যিককে পুরস্কার দিয়ে তারা হয়তো প্রমাণ করতে চান, ‘নোবেল এখনও মরে নাই।’
গত বছর যখন নোবেল কমিটির এক নারী সদস্যের স্বামীর বিরুদ্ধে যৌন কেলেঙ্কারি এবং পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকের নাম অগ্রিম ফাঁস করার ঘটনা চাউর হয়ে যায় মিডিয়া, পুরো সাহিত্যবিশ্ব ‘হায় নোবেল! হায় নোবেল’ বলে মাতম ওঠে। শেষমেশ সে বছরের মত পুরস্কার স্থগিত হয়। বলা হয়, ২০১৮ সালের পুরস্কার ২০১৯ সালের পুরস্কারের সাথে একসাথে মিলিয়ে দেয়া হবে। আমরা মেনে নিলাম। (না নিয়ে উপায়ও নেই।) ভাবলাম দু’ফোঁটা গঙ্গাজল গায়ে ছিটিয়ে নোবেল কমিটি শুদ্ধ হবে। ইউরোকেন্দ্রিকতা, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য, পুরুষতান্ত্রিকতার বারমুডা ট্রায়াঙ্গল থেকে তেনারা বেরিয়ে আসবেন। তারপর, বুম...। ঠাটার বদলে পিটার হান্ডকে পড়ল মাথায়। মাঝখান থেকে সান্ত¡না হিসেবে পোলিশ লেখক ওলগা তুকারজুককে ২০১৮ সালের লরিয়েট ঘোষণা করা হল। ভদ্রমহিলা যোগ্য লেখক অবশ্যই, কিন্তু যোগত্যর লেখক আরও আছেন সেটাও আপনি মানবেন নিশ্চয়ই। ব্যাপারটা যে লাউ সে কদুই, তবে আরও একটু পানসে। ইউরোকেন্দ্রিকতার ভুলভুলাইয়া থেকে নোবেল কমিটি আজ ২০১৯ সালেও মুক্ত হতে পারেনি। এবং ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’
প্রিয় পাঠক, আপনারা যৌক্তিকভাবেই প্রশ্ন করতে পারেন যে লেখক নিয়ে এত কথা তার একটা সাহিত্যকর্মের নামও আমি উল্লেখ করিনি কেন তা নিয়ে। সে আপনারা চাইলেই গুগলে কিংবা পত্রিকান্তরে জানতে পারবেন। তথ্যের জন্যে আপনারা আটকে থাকবেন না। কিন্তু, হান্ডকেকে এতটা দয়া দেখাতে আমার না একদমই ইচ্ছে করছে না। অন্তত, আজকের দিনে তো নয়ই। কেউ যদি এ যুক্তিটা পাড়েন যে, একজন লেখককে তাঁর আদর্শ বা চরিত্র নয়, বরং কাজ দিয়েই মূল্যায়ন করা উচিত; খানিকটা একমত হব বৈকি। কিন্তু, আপনি নিশ্চয়ই জেনেবুঝে আপনার সন্তানকে কোনও দুশ্চরিত্র প-িতের কাছে বিদ্যার্জনের জন্যে পাঠাতে চাইবেন না। আবার এও তো সত্য, লেখকের লেখায় তার চিন্তাবিশ্বের ছাপ পড়বেই, কম কিংবা বেশি। সেক্ষেত্রে পিটার হান্ডকের মতো চিন্তাসন্ত্রাসীর জন্য আমার পক্ষে এ লেখাটির বাইরে আর বিশেষ কিছু পাত্তা দেবার খায়েশ নেই। আপনারাও দেবেন না আশা করি। মানবতাবিরোধী বদমাইশটিকে বরং দুটো খিস্তি দিয়ে চুপচাপ কেটে পড়ুন। পরিশেষে, নোবেল সাহিত্য কমিটিকে একটা কথাই বলব, “আবার তোরা মানুষ হ।”
বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর ২০১৯ , ১ কার্তিক ১৪২৬, ১৭ সফর ১৪৪১
লিটন চক্রবর্তী মিঠুন
দিন কয়েক আগে যখন নোবেল পুরস্কার কমিটি সাহিত্য ক্যাটাগরিতে ২০১৯ সালের বিজয়ী হিসেবে অস্ট্রীয় ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্র পরিচালক পিটার হান্ডকের নাম ঘোষণা করে, অমনি সারা দুনিয়ার সাহিত্য মহলে ঢিঢিক্কার পড়ে যায় আর ‘মিডিয়া ভেসে যায় বুড়িগঙ্গা জলে’। এর আগে এ মহাত্মনের নাম শুনিনি। তাই গুগল সাহেবের সাহারা নিতেই চোখের সামনে উঠে আসে এনার একের পর এক কেলোর কীর্তি। ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানের সৌজন্যে জানতে পারি, ১৯৯৯ সালে এনাকে খ্যাতনামা লেখক সালমান রুশদী “ইন্টারন্যাশনাল মরোন অব দ্য ইয়ার” বা ‘বছরের সেরা আন্তর্জাতিক হাবলা’ ক্যাটাগরির রানার-আপ হিসেবে ঘোষণা দেন। কারণটা পড়ে আমার মেজাজ একদম খিঁচড়ে যায়। বলকানের অন্যতম কসাইখ্যাত স্লবোদান মিলোসেবিচের গণহত্যাকারী সরকারের সপক্ষে ধারাবাহিকভাবে তীব্র আবেগাকীর্ণ লিখিত সাফাই গাওয়াই ছিল সে কারণ। যার নেতৃত্বে হাজারো বসনীয় মুসলমানের রক্তে ভেসে যায় সেব্রেনিকা তথা বসনিয়া-হার্জেগোবিনার পথ-প্রান্তর তার সমর্থনে নিজের কলম যিনি ধরতে পারেন এবং গণহত্যার হোতা হিসেবে স্বয়ং আক্রান্ত জনগোষ্ঠীকেই যিনি দায়ী করতে পারেন, তিনি যদি সাহিত্যিক হন তো “জানোয়ার কিস কো কেহতে হ্যায়?” বিষয়টা ঠিক এখানেই চুকে যায়নি। আন্তর্জাতিক আদালতে মিলোসেবিচের বিচার কার্যক্রমে এবং পরবর্তীতে ২০০৬ সালে তার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে, সর্বত্র সানাইয়ের পোঁ হিসেবে হাজির ছিলেন এ ঘাগু কলম-কলঙ্কী।
তবে হান্ডকেকে নিয়ে সবচেয়ে সরস মন্তব্যটি করেছেন স্লোভেনীয় দার্শনিক স্লাভোজ জিজেক। গার্ডিয়ানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন যে, ২০১৪ সালে হান্ডকে নোবেল পুরস্কারকে বিলুপ্ত করে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সাহিত্যের মেকী ক্যাননাইজেশান বা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের অভিযোগে। এবার সে পুরস্কারটি পেয়ে নিজের অভিযোগটাকেই খোদ নিজেই পাক্কা করে দিল। অন্যদিকে, লেখক হারি কুঞ্জরু হান্ডকের অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টির খানিকটা তারিফ করলেও তার বীভৎস নৈতিক অন্ধত্বের ব্যাপারটাকেও স্বীকার করে নেন। তিনি তার নোবেল প্রাপ্তিকে সুইডিশ কমিটির জন্য “ট্রাবলিং চয়েস” বা ঝামেলাপূর্ণ বাছাই হিসেবে উল্লেখ করেন। আরেক স্লোভেনীয় লেখক মিহা মাজ্জিনি তার রাগ উগরে দেন এই বলে, “কোনও কোনও শিল্পী নিজেদের মানবাত্মা বিকিয়ে দেন আদর্শের খাতিরে (যেমন: হামসুন ও নাৎসিবাদ), কেউ কেউ ঘৃণার কাছে (যেমন: সেলিন ও তার তীব্র সেমিটীয়-বিরোধিতা), কেউ কেউ আবার অর্থ ও ক্ষমতার মোহে পড়ে (যেমন: কুস্তুরিকা); কিন্তু আমাকে সবচেয়ে বেশি মর্মাহত করেছে হান্ডকে, মিলোসেবিচ সরকারের সপক্ষে তার বাচ্চাসুলভ ভ্যাবলামির কারণে।” হান্ডকের এত এত প্রশংসা পড়ে নিশ্চয়ই আপনারাও তার ব্যাপারে এতক্ষণে মনস্থির করে ফেলেছেন। দাঁড়ান। কাহানি আভি বাকি হ্যায়।
এবারই অন্যান্য সাহিত্য পুরস্কারের ব্যাপারে নীরব থাকার নিজস্ব প্রটোকল ভেঙ্গে সাহিত্য ও মানবতাবাদী সংগঠন পেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, ঔপন্যাসিক জেনিফার এগান একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রদান করেছেন: “আমরা হতভম্ব হয়েছি এমন একজন লেখককে নির্বাচন করায় যিনি কিনা নিজের পাবলিক ভয়েস ব্যবহার করে থাকেন ঐতিহাসিক সত্যকে কেটেছেঁটে ফেলতে এবং সাবেক সার্বীয় প্রেসিডেন্ট স্লবোদান মিলোসেবিচ ও বসনীয় সার্ব নেতা রাদোভান কারাজিচের মতো গণহত্যার হোতাদের আনুষ্ঠানিক প্রণোদনা ও উৎসাহ দেবার কাজে।” তিনি আরও বলেন, “আমরা এমন সিদ্ধান্তকে নাকচ করি যা একজন লেখককে তার ‘ভাষার চাতুর্যপূর্ণ উদ্ভাবনশীলতার’ জন্যে উদ্যাপন করে থাকে অথচ যিনি সুলিপিবদ্ধ যুদ্ধাপরাধের দলিলসমূহকে লাগাতার প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদ, স্বৈরাচারী নেতৃত্ব এবং বিশ্বজুড়ে চলতে থাকা ব্যাপক তথ্যবিকৃতির এ কুক্ষণে সাহিত্যসমাজ এরচেয়ে ভাল কিছুর যোগ্য দাবি রাখে। আমরা নোবেল কমিটি অন লিটারেচারের এ নির্বাচনে তীব্র দুঃখপ্রকাশ করছি।”
হান্ডকে যে কেবল তার সমালোচকদের হাতে দাঁতানি-ধাবড়ানি খেয়েছেন তা নয়, তার অনেক বন্ধু-শুভাকাক্সক্ষীও তাকে বিভিন্ন সময়ে বাটাম দিয়েছেন তার উৎপটাং রাজনৈতিক ও আদর্শিক অবস্থানের জন্য। ২০০৮ সালে ঔপন্যাসিক জোনাথন লেটেল বলেন, “সে হয়তো একজন চমৎকার শিল্পী হতে পারে, কিন্তু মানুষ হিসেবে সে আমার দুশমন... ও একটা গান্ডু!” অ্যালেন ফিনকিয়েল্করাউত হান্ডকেকে “একজন আদর্শিক দৈত্য” হিসেবে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছেন। শুধু কি তাই! বহুদিনের বন্ধু সুসান সন্তাগ বলেছেন যে, হান্ডকের বিতিকিচ্ছিরি মন্তব্য তাকে তার নিউ ইয়র্কস্থ বন্ধুমহলে “ফিনিশ” করে দিয়েছে।
এতসব প্রশংসা শুনে পাঠকদের নিশ্চয়ই এনার সাহিত্য নিয়ে আগ্রহ মরে-হেজে শেষ হয়ে যাবার কথা। ব্যতিক্রমী কেউ কেউ হয়তো উল্টে হান্ডকের ব্যাপারে কৌতূহলী হয়ে উঠবেন। ওনার বইয়ের অনলাইন অর্ডার দেবেন। কোনও কোনও প্রকাশক আসছে বইমেলাকে সামনে রেখে এনার বই অনুবাদের কাজে হাত লাগাবেন হয়তোবা। পত্রিকার সাহিত্যপাতাগুলো বেশ কিছু দিন এনার কাজকম্মো নিয়ে শোরগোল করতে থাকবে। তারপর “একদিন ঝড় থেমে যাবে। পৃথিবী আবার শান্ত হবে।” আমার বিরক্তিটা ঠিক এখানেই। নোবেল কমিটি তারকাটা নাকি কানকাটা?
প্রত্যেক বছর যখন নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণার সময়ক্ষণ ঘনিয়ে আসে, সাহিত্যমহলে জল্পনা-কল্পনার ডানা মেলতে থাকে। বিশ্বের তাবড় তাবড় মহান সাহিত্যিকদের কারও না কারও কপালে নোবেলের তকমা জুটুক, এ পুষ্পিত কামনা অনেকের মনে জেগে ওঠে। অন্তত, ইউরোপ-আমেরিকার বাইরের বিশাল বিশ্বের কেউ যাদের চিন্তার দানে ভরে উঠেছে আমাদের মননরাজ্য, ভাবনার জগৎ। তাঁদের কেউ কেউ জীবনের প্রান্তসীমার আশেপাশে, অথচ মরণোত্তর নোবেল বলে কিছু হয় না। নোবেল না পাওয়া হয়তো এদের জন্যে বড় কোনও ব্যাপার নয়, কিন্তু স্বীকৃতিরও নিশ্চয়ই একটা মূল্য আছে। আবার, স্বীকৃতির নামে যে সার্কাস চালাচ্ছে নোবেল কমিটি তারও একটা যবনিকা দরকার। মাঝেমাঝে দুয়েকজন যোগ্য সাহিত্যিককে পুরস্কার দিয়ে তারা হয়তো প্রমাণ করতে চান, ‘নোবেল এখনও মরে নাই।’
গত বছর যখন নোবেল কমিটির এক নারী সদস্যের স্বামীর বিরুদ্ধে যৌন কেলেঙ্কারি এবং পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকের নাম অগ্রিম ফাঁস করার ঘটনা চাউর হয়ে যায় মিডিয়া, পুরো সাহিত্যবিশ্ব ‘হায় নোবেল! হায় নোবেল’ বলে মাতম ওঠে। শেষমেশ সে বছরের মত পুরস্কার স্থগিত হয়। বলা হয়, ২০১৮ সালের পুরস্কার ২০১৯ সালের পুরস্কারের সাথে একসাথে মিলিয়ে দেয়া হবে। আমরা মেনে নিলাম। (না নিয়ে উপায়ও নেই।) ভাবলাম দু’ফোঁটা গঙ্গাজল গায়ে ছিটিয়ে নোবেল কমিটি শুদ্ধ হবে। ইউরোকেন্দ্রিকতা, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য, পুরুষতান্ত্রিকতার বারমুডা ট্রায়াঙ্গল থেকে তেনারা বেরিয়ে আসবেন। তারপর, বুম...। ঠাটার বদলে পিটার হান্ডকে পড়ল মাথায়। মাঝখান থেকে সান্ত¡না হিসেবে পোলিশ লেখক ওলগা তুকারজুককে ২০১৮ সালের লরিয়েট ঘোষণা করা হল। ভদ্রমহিলা যোগ্য লেখক অবশ্যই, কিন্তু যোগত্যর লেখক আরও আছেন সেটাও আপনি মানবেন নিশ্চয়ই। ব্যাপারটা যে লাউ সে কদুই, তবে আরও একটু পানসে। ইউরোকেন্দ্রিকতার ভুলভুলাইয়া থেকে নোবেল কমিটি আজ ২০১৯ সালেও মুক্ত হতে পারেনি। এবং ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’
প্রিয় পাঠক, আপনারা যৌক্তিকভাবেই প্রশ্ন করতে পারেন যে লেখক নিয়ে এত কথা তার একটা সাহিত্যকর্মের নামও আমি উল্লেখ করিনি কেন তা নিয়ে। সে আপনারা চাইলেই গুগলে কিংবা পত্রিকান্তরে জানতে পারবেন। তথ্যের জন্যে আপনারা আটকে থাকবেন না। কিন্তু, হান্ডকেকে এতটা দয়া দেখাতে আমার না একদমই ইচ্ছে করছে না। অন্তত, আজকের দিনে তো নয়ই। কেউ যদি এ যুক্তিটা পাড়েন যে, একজন লেখককে তাঁর আদর্শ বা চরিত্র নয়, বরং কাজ দিয়েই মূল্যায়ন করা উচিত; খানিকটা একমত হব বৈকি। কিন্তু, আপনি নিশ্চয়ই জেনেবুঝে আপনার সন্তানকে কোনও দুশ্চরিত্র প-িতের কাছে বিদ্যার্জনের জন্যে পাঠাতে চাইবেন না। আবার এও তো সত্য, লেখকের লেখায় তার চিন্তাবিশ্বের ছাপ পড়বেই, কম কিংবা বেশি। সেক্ষেত্রে পিটার হান্ডকের মতো চিন্তাসন্ত্রাসীর জন্য আমার পক্ষে এ লেখাটির বাইরে আর বিশেষ কিছু পাত্তা দেবার খায়েশ নেই। আপনারাও দেবেন না আশা করি। মানবতাবিরোধী বদমাইশটিকে বরং দুটো খিস্তি দিয়ে চুপচাপ কেটে পড়ুন। পরিশেষে, নোবেল সাহিত্য কমিটিকে একটা কথাই বলব, “আবার তোরা মানুষ হ।”