সোনামসজিদ পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দরের মর্যাদা কবে পাবে

সামসুল ইসলাম টুকু

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থলবন্দর হিসেবে খ্যাত সোনামসজিদ স্থলবন্দরটি দীর্ঘ ২৯ বছরেও পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দরের মর্যাদা পায়নি। এখনও এটি সরকার কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে না। পরিচালিত হচ্ছে একটি বেসরকারি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পানামা পোর্ট লিংক লি. এর মাধ্যমে BOT পদ্ধতিতে অর্থাৎ Built, Operate, Transfer। তৈরি কর ব্যবহার কর এবং হস্তান্তর কর। বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ ২৫ বছরের চুক্তিতে ওই বেসরকারি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বন্দোবস্ত দিয়েছে ২০০৬ সালে। প্রতিষ্ঠানটি এ সময়ে স্থলবন্দরের প্রয়োজনীয় সব অবকাঠামো ও সুযোগ সুবিধা তৈরি করে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দরের রূপ দেবে এবং ওই সময়ে আমদানি ও রপ্তানিকৃত মালামালের রক্ষণাবেক্ষণ পরিবহনের পার্কিংসহ যে মাশুল আদায় করবে তার ৫১ শতাংশ সরকারকে দেবে এবং ৪৯ শতাংশ ওই বন্দোবস্ত গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান পাবে। কিন্তু ১৩ বছরের শুধু স্থলবন্দরের জন্য অধিগ্রহণকৃত জমির ওপর সীমানা প্রাচীর ও ছোটখাট ওয়্যারহাউস ছাড়া কিছু করতে পারেনি। এখনও বহু উন্নয়নের কাজ পড়ে রয়েছে। তারা এখনও ডাম্পিং প্লেস, ইয়ার্ড, ট্রাকস্ট্যান্ডসহ আরও কিছু অবকাঠামো তৈরি করতে পারেনি। এ কারণে তারা সরকারের নির্ধারিত মাশুলও আদায় করতে পারছে না। ফলে এ কয় বছরে সরকার কয়েকশ’ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

১৯৯০ সালে স্থল শুল্কস্টেশন হিসেবে এ স্থলবন্দরের যাত্রা শুরু হয় এবং তখন থেকে পাথর আমদানি শুরু হয়। জেলার উন্নয়ন ও আমদানি রপ্তানিকারকদের সুবিধার্থে বারবার দাবি উঠে এ এল.সি স্টেশনটি স্থলবন্দরে রূপান্তর করার। এরই প্রেক্ষিতে দীর্ঘ ১৬ বছর পর ২০০৬ সালে স্থলবন্দরের পূর্ণাঙ্গ রূপ দেবার জন্য পানামা পোর্ট লিংক লি.-কে বন্দোবস্ত দেয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘ এ ২৯ বছরে বিশেষত পাথর আমদানিকারকরা নিজেদের প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে নিজেদের অর্থে এ এলাকায় ডাম্পিং প্লেস, ইয়ার্ডসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে নিয়েছে। ফলে ২০০৬ সাল থেকে স্থলবন্দরের কাজ শুরু হলেও পানামা পোর্ট লিংক লি. ট্রাক প্রতি ন্যায্য মাশুল চালু করতে পারেনি। জানা যায় ট্রাক প্রতি মাত্র ২৩০/- টাকা মাশুল দিয়ে তাদের যাত্রা শুরু হয় এবং ক্রমশ: বৃদ্ধি করে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৭৮৩/- টাকা মাশুল ধার্য ছিল এবং শর্ত ছিল পোর্ট যতদিন কমার্শিয়াল অপারেশনে পূর্ণাঙ্গভাবে চালু না হবে ততদিন উল্লেখিত মাশুল বহাল থাকবে। অন্যদিকে পোর্টলিংক লি. এর শর্ত ছিল ট্রাক প্রতি পাথরের পরিমাণ থাকবে সর্বোচ্চ ৩৫ মে. টন। কিন্তু আমদানিকারকরা ৫০ টন পর্যন্ত পাথর এনেছে ট্রাকে। গত ১৪/১১/১৯ তারিখে বাংলাদেশ স্থলবন্দরের (ট্রাফিক) যুগ্ম সচিবের উপস্থিতিতে পানামার এক সভায় ৭৮৩/- টাকার স্থলে মাশুল ধার্য করা হয়। ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। অর্থাৎ হঠাৎ করে ১০ গুণ। ফলে আমদানি ও রপ্তানিকারকরা বিব্রত ও বেকায়দায় পড়েন এবং ১৭/১১/১৯ তারিখ থেকে পাথর আমদানি বন্দ করে দেয়। দাবি উত্থাপন করে যে, পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর চালু না হওয়া পর্যন্ত তারা ওই নতুন নির্ধারিত মাশুল দিতে পারবে না। অথবা তারা যে ডাম্পিং প্লেস ও ইয়ার্ডসহ অবকাঠামো তৈরি করেছে তা স্থলবন্দর কিনে নিক।

দীর্ঘ ১ মাস এমন অচল অবস্থার প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসকের মধ্যস্থতায় এক সভায় উভয়পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়। এতে টনপ্রতি পাথরের মাশুল ধার্য করা হয় ৯৩ টাকা। এই দর বলবৎ থাকলে আগামী বছর শুধু পাথর থেকেই চারগুণ অতিরিক্ত মাশুল পাবে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ ও পানামা। অবশ্য এর প্রভাব পড়তে পারে পাথরের দামেও। তবে গত ১ মাসে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ও স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ বড় অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েগেছে। প্রতিদিন আগত ট্রাকের গড় সংখ্যা ও শুল্কের হিসাব করলে দেখা যায় শুধু পাথর থেকে কাস্টমস হারিয়েছে ২৫ কোটি টাকা, স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ হারিয়েছে ৩০ লাখ টাকা ও পানামা হারিয়েছে প্রায় ২৭ লাখ টাকা। তবে এর চেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে বন্দরে কর্মরত ৪ হাজার শ্রমিক বেকার থাকায়। এছাড়া সরকারের মেগা প্রকল্প বিশেষ করে পাথর নির্ভর ব্রিজ রেল লাইনের জন্য পাথরের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।

পানামা পোর্ট লিংক লি. এর সঙ্গে আমদানি-রফতানিকারকদের রফা হলেও বেঁকে বসেছে ভারতীয় পাথর রফতানিকারকরা। তারা ও ট্রাক শ্রমিকরা যৌথ সিন্ডিকেট করে আমদানিকারকদের নিকট থেকে পাথরের বেশি দাম ও ট্রাকের ভাড়া বেশি আদায় করার জন্য ভারতীয় ট্রাক সোনামসসিদে আসতে দিচ্ছে না। তারা সোনামসজিদের অদূরে (১০ কিমি দূরে) ভারতীয় এলাকায় সুস্তানি নামক স্থানে নিজেরা পাথর কিনে সেখানে ডাম্পিং করেছে ও বেশি মূল্য দাবিসহ ট্রাক ঢুকতে দিচ্ছে না। বাধ্য হয়ে আমদানিকারকরা ভারতীয় রফতানিকারকদের সঙ্গে আলোচনায় বসে ৫/৮ সাইজের পাথর প্রতি সিএফটি ৬৫ টাকা এবং ১/২ সাইজের পাথরপ্রতি সিএফটি ৪৫ টাকা দরে কিনতে সম্মত হয়েছে। শুধু তাই নয় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার ট্রাক পাথর (যা ধুলাবালি ও আবর্জনাপূর্ণ) কেনা শেষ না করা পর্যন্ত সরাসরি কোন পাথর আমদানি করতে পারবে না। এ পরিমাণ পাথর নিতেও প্রায় ১ মাস লাগবে। তারপরে নিজেদের ইচ্ছেমত ভারতের ৩ পাহাড় ও পাকুড় থেকে আমদানি করতে পারবে। তবে সেটাও নির্ভর করে ভারতীয় রফতানিকারকদের মর্জির ওপর। এই অবস্থায় আমদানিকারকরা একদিকে বেশি দাম দিয়ে পাথর কিনছে এবং অন্যদিকে পানামাকে বেশি মাশুল দিতে হচ্ছে। সুতরাং দেশের বাজারে পাথরের দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা আছে। উল্লেখ করা যেতে পারে সোনামসজিদ স্থলবন্দর থেকে মাত্র ৮০ কিমি দূরে ভারতীয় পাথরের উৎপত্তি স্থল। সেটা হচ্ছে তিন পাহাড় ও পাকুড়। যা বাংলাদেশের অন্য কোন স্থলবন্দরই এত কাছে নয়। এমনকি হিলি বন্দরও প্রায় ২০০ কিমি দূরে অবস্থিত। যে কারণে প্রথম থেকেই সোনামসজিদ এল.সি স্টেশনের মাধ্যমেই পাথর আমদানি শুরু করা হয়। এবং আজও অব্যাহত আছে। প্রতিদিন গড়ে ২০০ ট্রাকের বেশি পাথর আসে এ বন্দর দিয়ে।

জানা যায়, আমদানিকারকরা পাথরের দাম প্রতি টনে ১৩ ডলার দিলেই ভারতীয় রফতানিকারকরা সোনামসজিদে পৌঁছে দেয়। আমদানিকারকরা কাস্টমস ট্যাক্স বাবদ প্রতি টন পাথরে ৭৯০/- টাকা শুল্ক, পানামা পোর্ট লিংকে ট্রাক প্রতি ৭৮৩/- মাশুল দেয়ার পরে স্থানীয়ভাবে ট্রাক ভাড়া করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেয় এবং দাম নেয় ১১৫ থেকে ১২২ টাকা সিএফটি। আর এই ব্যবসা চলছে ২৯ বছর ধরে। এ পাথর ব্যবসাকে কেন্দ্র করে সোনামসজিদ এলাকার জমির দামও বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। একদিকে স্থলবন্দর অন্যদিকে পর্যটন নগরী গৌড় একই সঙ্গে ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট নিয়ে একটি কর্মব্যস্ত এলাকা গড়ে উঠেছে এ সোনামসজিদ। স্থলবন্দরের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে শ্রমিক সংগঠন ও মধ্যস্বত্বভোগী সিএন্ডএফ এজেন্ট সমিতি। ফলে ওই দুই শক্তিকে নিয়ে রাজনীতি হয়। যে দল যখন ক্ষমতায় আসে তারা তাদের ইচ্ছেমত এই দুই সংগঠনের কমিটি তৈরি করে। অথচ সংগঠন দুটি অধিকাংশ সদস্যই চান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কমিটি গঠিত হোক। কারণ একটাই এ স্থলবন্দর দিয়ে যেমন বৈধভাবে ব্যবসা হয় তেমনি কোটি কোটি টাকা অবৈধ ব্যবসায়ও হয়। যার একটা অংশ স্থানীয় রাজনীতিবিদরা আদায় করে। আর এ ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ বন্দরে একাধিক হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। কিছু সচেতন মানুষ এ স্থলবন্দরকে রাজনীতিমুক্ত করার দাবি জানিয়ে আসছে যেন দুর্নীতি কম হয়। কিন্তু রাজনীতিবিদরা তা চাই না। এ বন্দরে যে কোটি কোটি টাকার অবৈধ ব্যবসার কথা বলা হয়েছে তা হলো বন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা কাস্টমসের সহযোগিতায় মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেয়া। যার ভাগ পায় রাজনীতিবিদরা। এ রাজস্ব ফাঁকির ব্যাপারটা মাঝে মাঝে ধরা পড়ে, কোটি কোটি টাকা ভাগাভাগি হওয়ার সময়েও হাতেনাতে ধরা পড়ার ঘটনা আছে, পত্র-পত্রিকায় ফলাও করে নিউজ এসেছে। কিন্তু এজন্য কোন কাস্টমস কর্মকর্তা বা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের শাস্তি হয়েছে বলে জানা যায় না। এ স্থলবন্দরের অবৈধ ব্যবসা করে কত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এবং কত কাস্টমস কোটিপতি হয়েছে তা হিসাব করে বলা যাবে না। এ স্থলবন্দরের মাধ্যমে পাথর ছাড়াও ফলমূল, কসমেটিকস, মসলা, ছাই, চাল-ডাল, কেমিক্যালসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি হয়। মাঝে মাঝে কিছু পণ্য আমদানিতে বিধি নিষেধ আরোপ করা হয় যা স্থলবন্দর আয়ের জন্য মোটেও সঠিক নয়। যেখান থেকে শুধু কাস্টমস কর্তৃপক্ষ শুল্ক আদায় করে প্রতি বছরে ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা। এ বছরেও এ স্থলবন্দরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৫০ কোটি টাকা। সুতরাং অর্থ আহরণকারী ও সম্ভাবনাময় এ স্থলবন্দরের দিকে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের তথা সরকারের বিশেষ দৃষ্টি দেয়া আবশ্যক।

[লেখক : সাংবাদিক]

শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯ , ১৩ পৌষ ১৪২৬, ৩০ রবিউস সানি ১৪৪১

সোনামসজিদ পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দরের মর্যাদা কবে পাবে

সামসুল ইসলাম টুকু

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থলবন্দর হিসেবে খ্যাত সোনামসজিদ স্থলবন্দরটি দীর্ঘ ২৯ বছরেও পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দরের মর্যাদা পায়নি। এখনও এটি সরকার কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে না। পরিচালিত হচ্ছে একটি বেসরকারি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পানামা পোর্ট লিংক লি. এর মাধ্যমে BOT পদ্ধতিতে অর্থাৎ Built, Operate, Transfer। তৈরি কর ব্যবহার কর এবং হস্তান্তর কর। বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ ২৫ বছরের চুক্তিতে ওই বেসরকারি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বন্দোবস্ত দিয়েছে ২০০৬ সালে। প্রতিষ্ঠানটি এ সময়ে স্থলবন্দরের প্রয়োজনীয় সব অবকাঠামো ও সুযোগ সুবিধা তৈরি করে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দরের রূপ দেবে এবং ওই সময়ে আমদানি ও রপ্তানিকৃত মালামালের রক্ষণাবেক্ষণ পরিবহনের পার্কিংসহ যে মাশুল আদায় করবে তার ৫১ শতাংশ সরকারকে দেবে এবং ৪৯ শতাংশ ওই বন্দোবস্ত গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান পাবে। কিন্তু ১৩ বছরের শুধু স্থলবন্দরের জন্য অধিগ্রহণকৃত জমির ওপর সীমানা প্রাচীর ও ছোটখাট ওয়্যারহাউস ছাড়া কিছু করতে পারেনি। এখনও বহু উন্নয়নের কাজ পড়ে রয়েছে। তারা এখনও ডাম্পিং প্লেস, ইয়ার্ড, ট্রাকস্ট্যান্ডসহ আরও কিছু অবকাঠামো তৈরি করতে পারেনি। এ কারণে তারা সরকারের নির্ধারিত মাশুলও আদায় করতে পারছে না। ফলে এ কয় বছরে সরকার কয়েকশ’ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

১৯৯০ সালে স্থল শুল্কস্টেশন হিসেবে এ স্থলবন্দরের যাত্রা শুরু হয় এবং তখন থেকে পাথর আমদানি শুরু হয়। জেলার উন্নয়ন ও আমদানি রপ্তানিকারকদের সুবিধার্থে বারবার দাবি উঠে এ এল.সি স্টেশনটি স্থলবন্দরে রূপান্তর করার। এরই প্রেক্ষিতে দীর্ঘ ১৬ বছর পর ২০০৬ সালে স্থলবন্দরের পূর্ণাঙ্গ রূপ দেবার জন্য পানামা পোর্ট লিংক লি.-কে বন্দোবস্ত দেয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘ এ ২৯ বছরে বিশেষত পাথর আমদানিকারকরা নিজেদের প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে নিজেদের অর্থে এ এলাকায় ডাম্পিং প্লেস, ইয়ার্ডসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে নিয়েছে। ফলে ২০০৬ সাল থেকে স্থলবন্দরের কাজ শুরু হলেও পানামা পোর্ট লিংক লি. ট্রাক প্রতি ন্যায্য মাশুল চালু করতে পারেনি। জানা যায় ট্রাক প্রতি মাত্র ২৩০/- টাকা মাশুল দিয়ে তাদের যাত্রা শুরু হয় এবং ক্রমশ: বৃদ্ধি করে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৭৮৩/- টাকা মাশুল ধার্য ছিল এবং শর্ত ছিল পোর্ট যতদিন কমার্শিয়াল অপারেশনে পূর্ণাঙ্গভাবে চালু না হবে ততদিন উল্লেখিত মাশুল বহাল থাকবে। অন্যদিকে পোর্টলিংক লি. এর শর্ত ছিল ট্রাক প্রতি পাথরের পরিমাণ থাকবে সর্বোচ্চ ৩৫ মে. টন। কিন্তু আমদানিকারকরা ৫০ টন পর্যন্ত পাথর এনেছে ট্রাকে। গত ১৪/১১/১৯ তারিখে বাংলাদেশ স্থলবন্দরের (ট্রাফিক) যুগ্ম সচিবের উপস্থিতিতে পানামার এক সভায় ৭৮৩/- টাকার স্থলে মাশুল ধার্য করা হয়। ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। অর্থাৎ হঠাৎ করে ১০ গুণ। ফলে আমদানি ও রপ্তানিকারকরা বিব্রত ও বেকায়দায় পড়েন এবং ১৭/১১/১৯ তারিখ থেকে পাথর আমদানি বন্দ করে দেয়। দাবি উত্থাপন করে যে, পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর চালু না হওয়া পর্যন্ত তারা ওই নতুন নির্ধারিত মাশুল দিতে পারবে না। অথবা তারা যে ডাম্পিং প্লেস ও ইয়ার্ডসহ অবকাঠামো তৈরি করেছে তা স্থলবন্দর কিনে নিক।

দীর্ঘ ১ মাস এমন অচল অবস্থার প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসকের মধ্যস্থতায় এক সভায় উভয়পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়। এতে টনপ্রতি পাথরের মাশুল ধার্য করা হয় ৯৩ টাকা। এই দর বলবৎ থাকলে আগামী বছর শুধু পাথর থেকেই চারগুণ অতিরিক্ত মাশুল পাবে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ ও পানামা। অবশ্য এর প্রভাব পড়তে পারে পাথরের দামেও। তবে গত ১ মাসে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ও স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ বড় অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েগেছে। প্রতিদিন আগত ট্রাকের গড় সংখ্যা ও শুল্কের হিসাব করলে দেখা যায় শুধু পাথর থেকে কাস্টমস হারিয়েছে ২৫ কোটি টাকা, স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ হারিয়েছে ৩০ লাখ টাকা ও পানামা হারিয়েছে প্রায় ২৭ লাখ টাকা। তবে এর চেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে বন্দরে কর্মরত ৪ হাজার শ্রমিক বেকার থাকায়। এছাড়া সরকারের মেগা প্রকল্প বিশেষ করে পাথর নির্ভর ব্রিজ রেল লাইনের জন্য পাথরের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।

পানামা পোর্ট লিংক লি. এর সঙ্গে আমদানি-রফতানিকারকদের রফা হলেও বেঁকে বসেছে ভারতীয় পাথর রফতানিকারকরা। তারা ও ট্রাক শ্রমিকরা যৌথ সিন্ডিকেট করে আমদানিকারকদের নিকট থেকে পাথরের বেশি দাম ও ট্রাকের ভাড়া বেশি আদায় করার জন্য ভারতীয় ট্রাক সোনামসসিদে আসতে দিচ্ছে না। তারা সোনামসজিদের অদূরে (১০ কিমি দূরে) ভারতীয় এলাকায় সুস্তানি নামক স্থানে নিজেরা পাথর কিনে সেখানে ডাম্পিং করেছে ও বেশি মূল্য দাবিসহ ট্রাক ঢুকতে দিচ্ছে না। বাধ্য হয়ে আমদানিকারকরা ভারতীয় রফতানিকারকদের সঙ্গে আলোচনায় বসে ৫/৮ সাইজের পাথর প্রতি সিএফটি ৬৫ টাকা এবং ১/২ সাইজের পাথরপ্রতি সিএফটি ৪৫ টাকা দরে কিনতে সম্মত হয়েছে। শুধু তাই নয় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার ট্রাক পাথর (যা ধুলাবালি ও আবর্জনাপূর্ণ) কেনা শেষ না করা পর্যন্ত সরাসরি কোন পাথর আমদানি করতে পারবে না। এ পরিমাণ পাথর নিতেও প্রায় ১ মাস লাগবে। তারপরে নিজেদের ইচ্ছেমত ভারতের ৩ পাহাড় ও পাকুড় থেকে আমদানি করতে পারবে। তবে সেটাও নির্ভর করে ভারতীয় রফতানিকারকদের মর্জির ওপর। এই অবস্থায় আমদানিকারকরা একদিকে বেশি দাম দিয়ে পাথর কিনছে এবং অন্যদিকে পানামাকে বেশি মাশুল দিতে হচ্ছে। সুতরাং দেশের বাজারে পাথরের দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা আছে। উল্লেখ করা যেতে পারে সোনামসজিদ স্থলবন্দর থেকে মাত্র ৮০ কিমি দূরে ভারতীয় পাথরের উৎপত্তি স্থল। সেটা হচ্ছে তিন পাহাড় ও পাকুড়। যা বাংলাদেশের অন্য কোন স্থলবন্দরই এত কাছে নয়। এমনকি হিলি বন্দরও প্রায় ২০০ কিমি দূরে অবস্থিত। যে কারণে প্রথম থেকেই সোনামসজিদ এল.সি স্টেশনের মাধ্যমেই পাথর আমদানি শুরু করা হয়। এবং আজও অব্যাহত আছে। প্রতিদিন গড়ে ২০০ ট্রাকের বেশি পাথর আসে এ বন্দর দিয়ে।

জানা যায়, আমদানিকারকরা পাথরের দাম প্রতি টনে ১৩ ডলার দিলেই ভারতীয় রফতানিকারকরা সোনামসজিদে পৌঁছে দেয়। আমদানিকারকরা কাস্টমস ট্যাক্স বাবদ প্রতি টন পাথরে ৭৯০/- টাকা শুল্ক, পানামা পোর্ট লিংকে ট্রাক প্রতি ৭৮৩/- মাশুল দেয়ার পরে স্থানীয়ভাবে ট্রাক ভাড়া করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেয় এবং দাম নেয় ১১৫ থেকে ১২২ টাকা সিএফটি। আর এই ব্যবসা চলছে ২৯ বছর ধরে। এ পাথর ব্যবসাকে কেন্দ্র করে সোনামসজিদ এলাকার জমির দামও বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। একদিকে স্থলবন্দর অন্যদিকে পর্যটন নগরী গৌড় একই সঙ্গে ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট নিয়ে একটি কর্মব্যস্ত এলাকা গড়ে উঠেছে এ সোনামসজিদ। স্থলবন্দরের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে শ্রমিক সংগঠন ও মধ্যস্বত্বভোগী সিএন্ডএফ এজেন্ট সমিতি। ফলে ওই দুই শক্তিকে নিয়ে রাজনীতি হয়। যে দল যখন ক্ষমতায় আসে তারা তাদের ইচ্ছেমত এই দুই সংগঠনের কমিটি তৈরি করে। অথচ সংগঠন দুটি অধিকাংশ সদস্যই চান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কমিটি গঠিত হোক। কারণ একটাই এ স্থলবন্দর দিয়ে যেমন বৈধভাবে ব্যবসা হয় তেমনি কোটি কোটি টাকা অবৈধ ব্যবসায়ও হয়। যার একটা অংশ স্থানীয় রাজনীতিবিদরা আদায় করে। আর এ ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ বন্দরে একাধিক হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। কিছু সচেতন মানুষ এ স্থলবন্দরকে রাজনীতিমুক্ত করার দাবি জানিয়ে আসছে যেন দুর্নীতি কম হয়। কিন্তু রাজনীতিবিদরা তা চাই না। এ বন্দরে যে কোটি কোটি টাকার অবৈধ ব্যবসার কথা বলা হয়েছে তা হলো বন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা কাস্টমসের সহযোগিতায় মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেয়া। যার ভাগ পায় রাজনীতিবিদরা। এ রাজস্ব ফাঁকির ব্যাপারটা মাঝে মাঝে ধরা পড়ে, কোটি কোটি টাকা ভাগাভাগি হওয়ার সময়েও হাতেনাতে ধরা পড়ার ঘটনা আছে, পত্র-পত্রিকায় ফলাও করে নিউজ এসেছে। কিন্তু এজন্য কোন কাস্টমস কর্মকর্তা বা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের শাস্তি হয়েছে বলে জানা যায় না। এ স্থলবন্দরের অবৈধ ব্যবসা করে কত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এবং কত কাস্টমস কোটিপতি হয়েছে তা হিসাব করে বলা যাবে না। এ স্থলবন্দরের মাধ্যমে পাথর ছাড়াও ফলমূল, কসমেটিকস, মসলা, ছাই, চাল-ডাল, কেমিক্যালসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি হয়। মাঝে মাঝে কিছু পণ্য আমদানিতে বিধি নিষেধ আরোপ করা হয় যা স্থলবন্দর আয়ের জন্য মোটেও সঠিক নয়। যেখান থেকে শুধু কাস্টমস কর্তৃপক্ষ শুল্ক আদায় করে প্রতি বছরে ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা। এ বছরেও এ স্থলবন্দরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৫০ কোটি টাকা। সুতরাং অর্থ আহরণকারী ও সম্ভাবনাময় এ স্থলবন্দরের দিকে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের তথা সরকারের বিশেষ দৃষ্টি দেয়া আবশ্যক।

[লেখক : সাংবাদিক]