১৯৭১ সালের মুক্তিসংগ্রাম : দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের অবদান

সাদেকুর রহমান

আজকের বাংলাদেশ, সেদিন ছিল পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে দুটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পৃথিবীর বুকে জন্ম নিল ভারত ও পাকিস্তান নাম নিয়ে। পশ্চিমবাংলা রয়ে গেল ভারতবর্ষে আর পূর্ববাংলা হলো পশ্চিম পাকিস্তানের একটি প্রদেশ, নাম হলো পূর্ব পাকিস্তান। অল্প সময়ের ব্যবধানেই পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ-বঞ্চনা, নিপীড়নের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে এ ভূখ-বাসী। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে তার স্ফূরণ ঘটে। আর স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার সংগঠিত আন্দোলন অনুষ্ঠিত ও সম্পন্ন হয় ১৯৭১ সালে। ওই বছরের মার্চ থেকেই দানা বাঁধে সহিংস আন্দোলন। সে আন্দোলন ছিল পাকিস্তানিদের অযাচিত শৃঙ্খল ছিন্ন করার, যা মূলত ছিল মুক্তির লড়াই। একটা পর্যায়ে যখন পশ্চিম পাকিস্তানি তথা পাকিস্তান সরকারের বোঝার বাকি রইলো না যে, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঠেকানো যাবে না তখন তারা মরণ কামড় দেয়। পঁচিশে মার্চের কালরাতেই গণহত্যা শুরু করে। অব্যাহত থাকে ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জেনারেল নিয়াজী গংয়ের অবনত মস্তকে আত্মসমর্পণ পর্যন্ত। ১৪ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে পূর্ব তালিকা অনুযায়ী দেশের বরেণ্য সকল শিক্ষাবিদ, গবেষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিকদের চোখ বেঁধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের এদেশীয় এজেন্টদের সহযোগিতায় নিজ নিজ বাসা থেকে তুলে নিয়ে পৈশাচিক নির্যাতনের পর হত্যা করে। বিভিন্ন বধ্যভূমিতে যাদের লাশ পাওয়া গেছে তাদের ঠিকমতো চেনা যাচ্ছিল না। পাকিস্তানি বাহিনীর এসব নির্মমতা উঠে আসে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে। বর্বর পাকিস্তানিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বিবেকশাসিত সাংবাদিকরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা তথা এদেশের নির্যাতিত, নিপীড়িত সর্বস্তরের মানুষের মুক্তিসংগ্রামকে অকুন্ঠ সমর্থন জুগিয়ে গেছেন। অবশ্য কিছু পত্রিকা নগ্নভাবে পাকিস্তান সরকারের বন্দনা আর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সংবাদ প্রকাশ করতো।

আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে গণমাধ্যমের অবদানকে মোটা দাগে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করতে পারি। এগুলো হলো-প্রথম পর্যায় : বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের দিন থেকে ২৪ মার্চ; দ্বিতীয় পর্যায় : ২৫ মার্চ থেকে ২ ডিসেম্বর এবং তৃতীয় পর্যায় : ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর। এছাড়া ১৭ ডিসেম্বর থেকে আরও একটি পর্যায়, বাংলাদেশ পুনর্গঠনপর্ব বিবেচনা করার সুযোগ রয়েছে। এ সময়ে গণমাধ্যমগুলোর খবরের প্রধান প্রতিপাদ্য ছিল তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রেক্ষাপট ও প্রতিক্রিয়া, বাংলাদেশের অন্যান্য স্বাধীনতাকামী নেতার ভূমিকা, পাকহানাদার বাহিনীর পঁচিশে মার্চের গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী নিধন ও ধর্ষণ, বাংলাদেশকে ভারতের সহযোগিতা এবং ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর নির্লজ্জ ও অসহায় আত্মসমর্পণ। দেশীয় গণমাধ্যমগুলোর সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা ছিল বাংলা ভাষায় প্রকাশ, প্রচার সংখ্যা ছিল সীমিত এবং এখনকার মতো অনলাইন ভার্সনের ব্যবস্থা ছিল না। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর ভাষা ছিল ইংরেজি, প্রচার সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্য এবং সেগুলোর অধিকাংশেরই মালিকানা ছিল পশ্চিমা দুনিয়া। এই ত্রিবিধ কারণে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গণমাধ্যমগুলোর খবরাখবর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে একটা সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। এসব গণমাধ্যমের ঐতিহাসিক অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয় লাভের মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে-পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান তার ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘আমাদের রেডিও ও সংবাদপত্র জানাচ্ছে, শত্রুর মোকাবিলা করে তাদের রুখে দেয়া হয়েছে। আর ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, ঢাকা শহরের চারদিকে ফাঁসের দড়ি আঁটসাঁট হয়ে আসছে। অর্থাৎ অবরুদ্ধ ঢাকার কেবল পতনের যেটুকু বাকি।’ তার এ কথা থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

বাংলাপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, মুক্তিযুদ্ধের সময় সারা দেশে ১ হাজার ১১১ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল। এর মধ্যে ১৩ জন ছিলেন সাংবাদিক। যাদের ১১ জন ঢাকায় এবং খুলনা ও রাজশাহীতে একজন করে স্বাধীনতাকামী সাংবাদিক শহীদ হন। তবে ধারণা করা হয় প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হবে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাংবাদিক’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে। গ্রন্থটিতে ১৩ জন শহীদ সাংবাদিকের জীবনী ও অন্তর্ধান-শহীদ হওয়ার বিবরণ বিবৃত হয়েছে। তারা হচ্ছেন-সিরাজুদ্দীন হোসেন, কার্যনিবাহী ও বার্তা সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক (১০ ডিসেম্বর); শহীদুল্লা কায়সার, সহ-সম্পাদক, দৈনিক সংবাদ (১৪ ডিসেম্বর); খোন্দকার আবু তালেব, সহ-সম্পাদক, দৈনিক পয়গাম (২৯ মার্চ); নিজামুদ্দীন আহমদ, জেনারেল ম্যানেজার, পিপিআই, সংবাদদাতা, বিবিসি, (১২ ডিসেম্বর); শেখ আবদুল মান্নান (লাডু ভাই), সাংবাদিক, দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার (১৪ ডিসেম্বর); আনম গোলাম মোস্তফা, সিনিয়র সম্পাদক, দৈনিক পূর্বদেশ, (১১ ডিসেম্বর), সৈয়দ নাজমুল হক, চিফ রিপোর্টার পিপিআই সংবাদদাতা, সিবিএস (১১ ডিসেম্বর), শহীদ সাবের, সহকারী সম্পাদক, দৈনিক সংবাদ (৩১ মার্চ), আবুল বাশার চৌধুরী, স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক মর্নিং নিউজ (অক্টোবরের শেষদিকে); শিবসাধন চক্রবর্তী, সহ-সম্পাদক, দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার (২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে); চিশ্তী শাহ হেলালুর রহমান, বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা, দৈনিক আজাদ (২৫ মার্চ), মুহম্মদ আখতার, কর্মাধ্যক্ষ, সাপ্তাহিক লালনা (১৪ ডিসেম্বর); সেলিনা পারভীন, সম্পাদিকা, শিলালিপি (১৪ ডিসেম্বর)। এই শহীদ সাংবাদিকদের নাম জাতীয় প্রেসক্লাবের নিচতলায় শ্বেতপাথরে লেখা রয়েছে। এছাড়া আরও দুজন শহীদ সাংবাদিকের কথা জানা যায়। তারা হলেনÑ আবু সাঈদ, রাজশাহী আঞ্চলিক প্রধান, দৈনিক আজাদ (২৮ জুন) ও শেখ হাবিবুর রহমান, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ঝিনাইদহ প্রেসক্লাব (১০ এপ্রিল)। তাদের একটাই ‘অপরাধ’ ছিল, তারা বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে কলম ধরেছিলেন, কেউ রণাঙ্গনে সোচ্চার ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধে কলম-সৈনিকের ভূমিকায় অগ্রগণ্য ছিলেন শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে ইত্তেফাকে সম্পাদকীয় ও উপ-সম্পাদকীয় ছাড়াও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতেন তিনি।

নিজামুদ্দীন আহমদ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিবিসির মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে মুক্তিযুদ্ধের কথা অবহিত করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধকালে সৈয়দ নাজমুল হক সিবিএসের (কলাম্বিয়ান ব্রডকাস্টিং সিস্টেম) করেসপন্ডেন্ট হিসেবে ওতপাতা পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দাদের এড়িয়ে ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে গিয়ে বিদেশি সাংবাদিকদের দিয়ে সারা পৃথিবীতে মুক্তিযোদ্ধাদের কৃতিত্বের খবর প্রচার করতেন। (চলবে)

রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯ , ১৪ পৌষ ১৪২৬, ১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

১৯৭১ সালের মুক্তিসংগ্রাম : দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের অবদান

সাদেকুর রহমান

আজকের বাংলাদেশ, সেদিন ছিল পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে দুটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পৃথিবীর বুকে জন্ম নিল ভারত ও পাকিস্তান নাম নিয়ে। পশ্চিমবাংলা রয়ে গেল ভারতবর্ষে আর পূর্ববাংলা হলো পশ্চিম পাকিস্তানের একটি প্রদেশ, নাম হলো পূর্ব পাকিস্তান। অল্প সময়ের ব্যবধানেই পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ-বঞ্চনা, নিপীড়নের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে এ ভূখ-বাসী। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে তার স্ফূরণ ঘটে। আর স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার সংগঠিত আন্দোলন অনুষ্ঠিত ও সম্পন্ন হয় ১৯৭১ সালে। ওই বছরের মার্চ থেকেই দানা বাঁধে সহিংস আন্দোলন। সে আন্দোলন ছিল পাকিস্তানিদের অযাচিত শৃঙ্খল ছিন্ন করার, যা মূলত ছিল মুক্তির লড়াই। একটা পর্যায়ে যখন পশ্চিম পাকিস্তানি তথা পাকিস্তান সরকারের বোঝার বাকি রইলো না যে, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঠেকানো যাবে না তখন তারা মরণ কামড় দেয়। পঁচিশে মার্চের কালরাতেই গণহত্যা শুরু করে। অব্যাহত থাকে ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জেনারেল নিয়াজী গংয়ের অবনত মস্তকে আত্মসমর্পণ পর্যন্ত। ১৪ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে পূর্ব তালিকা অনুযায়ী দেশের বরেণ্য সকল শিক্ষাবিদ, গবেষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিকদের চোখ বেঁধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের এদেশীয় এজেন্টদের সহযোগিতায় নিজ নিজ বাসা থেকে তুলে নিয়ে পৈশাচিক নির্যাতনের পর হত্যা করে। বিভিন্ন বধ্যভূমিতে যাদের লাশ পাওয়া গেছে তাদের ঠিকমতো চেনা যাচ্ছিল না। পাকিস্তানি বাহিনীর এসব নির্মমতা উঠে আসে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে। বর্বর পাকিস্তানিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বিবেকশাসিত সাংবাদিকরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা তথা এদেশের নির্যাতিত, নিপীড়িত সর্বস্তরের মানুষের মুক্তিসংগ্রামকে অকুন্ঠ সমর্থন জুগিয়ে গেছেন। অবশ্য কিছু পত্রিকা নগ্নভাবে পাকিস্তান সরকারের বন্দনা আর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সংবাদ প্রকাশ করতো।

আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে গণমাধ্যমের অবদানকে মোটা দাগে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করতে পারি। এগুলো হলো-প্রথম পর্যায় : বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের দিন থেকে ২৪ মার্চ; দ্বিতীয় পর্যায় : ২৫ মার্চ থেকে ২ ডিসেম্বর এবং তৃতীয় পর্যায় : ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর। এছাড়া ১৭ ডিসেম্বর থেকে আরও একটি পর্যায়, বাংলাদেশ পুনর্গঠনপর্ব বিবেচনা করার সুযোগ রয়েছে। এ সময়ে গণমাধ্যমগুলোর খবরের প্রধান প্রতিপাদ্য ছিল তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রেক্ষাপট ও প্রতিক্রিয়া, বাংলাদেশের অন্যান্য স্বাধীনতাকামী নেতার ভূমিকা, পাকহানাদার বাহিনীর পঁচিশে মার্চের গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী নিধন ও ধর্ষণ, বাংলাদেশকে ভারতের সহযোগিতা এবং ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর নির্লজ্জ ও অসহায় আত্মসমর্পণ। দেশীয় গণমাধ্যমগুলোর সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা ছিল বাংলা ভাষায় প্রকাশ, প্রচার সংখ্যা ছিল সীমিত এবং এখনকার মতো অনলাইন ভার্সনের ব্যবস্থা ছিল না। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর ভাষা ছিল ইংরেজি, প্রচার সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্য এবং সেগুলোর অধিকাংশেরই মালিকানা ছিল পশ্চিমা দুনিয়া। এই ত্রিবিধ কারণে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গণমাধ্যমগুলোর খবরাখবর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে একটা সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। এসব গণমাধ্যমের ঐতিহাসিক অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয় লাভের মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে-পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান তার ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘আমাদের রেডিও ও সংবাদপত্র জানাচ্ছে, শত্রুর মোকাবিলা করে তাদের রুখে দেয়া হয়েছে। আর ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, ঢাকা শহরের চারদিকে ফাঁসের দড়ি আঁটসাঁট হয়ে আসছে। অর্থাৎ অবরুদ্ধ ঢাকার কেবল পতনের যেটুকু বাকি।’ তার এ কথা থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

বাংলাপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, মুক্তিযুদ্ধের সময় সারা দেশে ১ হাজার ১১১ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল। এর মধ্যে ১৩ জন ছিলেন সাংবাদিক। যাদের ১১ জন ঢাকায় এবং খুলনা ও রাজশাহীতে একজন করে স্বাধীনতাকামী সাংবাদিক শহীদ হন। তবে ধারণা করা হয় প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হবে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাংবাদিক’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে। গ্রন্থটিতে ১৩ জন শহীদ সাংবাদিকের জীবনী ও অন্তর্ধান-শহীদ হওয়ার বিবরণ বিবৃত হয়েছে। তারা হচ্ছেন-সিরাজুদ্দীন হোসেন, কার্যনিবাহী ও বার্তা সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক (১০ ডিসেম্বর); শহীদুল্লা কায়সার, সহ-সম্পাদক, দৈনিক সংবাদ (১৪ ডিসেম্বর); খোন্দকার আবু তালেব, সহ-সম্পাদক, দৈনিক পয়গাম (২৯ মার্চ); নিজামুদ্দীন আহমদ, জেনারেল ম্যানেজার, পিপিআই, সংবাদদাতা, বিবিসি, (১২ ডিসেম্বর); শেখ আবদুল মান্নান (লাডু ভাই), সাংবাদিক, দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার (১৪ ডিসেম্বর); আনম গোলাম মোস্তফা, সিনিয়র সম্পাদক, দৈনিক পূর্বদেশ, (১১ ডিসেম্বর), সৈয়দ নাজমুল হক, চিফ রিপোর্টার পিপিআই সংবাদদাতা, সিবিএস (১১ ডিসেম্বর), শহীদ সাবের, সহকারী সম্পাদক, দৈনিক সংবাদ (৩১ মার্চ), আবুল বাশার চৌধুরী, স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক মর্নিং নিউজ (অক্টোবরের শেষদিকে); শিবসাধন চক্রবর্তী, সহ-সম্পাদক, দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার (২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে); চিশ্তী শাহ হেলালুর রহমান, বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা, দৈনিক আজাদ (২৫ মার্চ), মুহম্মদ আখতার, কর্মাধ্যক্ষ, সাপ্তাহিক লালনা (১৪ ডিসেম্বর); সেলিনা পারভীন, সম্পাদিকা, শিলালিপি (১৪ ডিসেম্বর)। এই শহীদ সাংবাদিকদের নাম জাতীয় প্রেসক্লাবের নিচতলায় শ্বেতপাথরে লেখা রয়েছে। এছাড়া আরও দুজন শহীদ সাংবাদিকের কথা জানা যায়। তারা হলেনÑ আবু সাঈদ, রাজশাহী আঞ্চলিক প্রধান, দৈনিক আজাদ (২৮ জুন) ও শেখ হাবিবুর রহমান, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ঝিনাইদহ প্রেসক্লাব (১০ এপ্রিল)। তাদের একটাই ‘অপরাধ’ ছিল, তারা বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে কলম ধরেছিলেন, কেউ রণাঙ্গনে সোচ্চার ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধে কলম-সৈনিকের ভূমিকায় অগ্রগণ্য ছিলেন শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে ইত্তেফাকে সম্পাদকীয় ও উপ-সম্পাদকীয় ছাড়াও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতেন তিনি।

নিজামুদ্দীন আহমদ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিবিসির মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে মুক্তিযুদ্ধের কথা অবহিত করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধকালে সৈয়দ নাজমুল হক সিবিএসের (কলাম্বিয়ান ব্রডকাস্টিং সিস্টেম) করেসপন্ডেন্ট হিসেবে ওতপাতা পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দাদের এড়িয়ে ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে গিয়ে বিদেশি সাংবাদিকদের দিয়ে সারা পৃথিবীতে মুক্তিযোদ্ধাদের কৃতিত্বের খবর প্রচার করতেন। (চলবে)