১৯৭১ সালের মুক্তিসংগ্রাম : দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের অবদান

সাদেকুর রহমান

(গতকালের পর)

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর মর্টারের গোলায় তিনটি দৈনিক পত্রিকার প্রেস ও অফিস ধ্বংস হয়ে যায়। এগুলো হলো দৈনিক ‘ইত্তেফাক’, ‘সংবাদ’ ও ‘দ্য পিপল’। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বাংলার নিরস্ত্র জনতার ওপর যখন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সে সময়ে ‘অবরুদ্ধ বাংলাদেশ : কণ্ঠরুদ্ধ সংবাদপত্র’ এই ব্যানার শিরোনাম প্রস্তুত করেছিল ‘দ্য পিপল’। কিন্তু সে রাতেই পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আক্রান্ত হয় পরীবাগে দ্য পিপল অফিস। মারা যায় ছ’জন সাংবাদিক। ২৬ মার্চ বিকেল ৪টার দিকে ইত্তেফাক অফিসে দুটি ট্যাংক থেকে গোলা ছুড়ে সেই অফিসটি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। ৩১ মার্চ খুব সকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বংশালে অবস্থিত তৎকালীন দৈনিক সংবাদ অফিসে আগুন লাগিয়ে দেয়। তাতে শহীদ হন ওই পত্রিকার এক সময়কার সহকারী সম্পাদক একেএম শহীদুল্লাহ, যিনি শহীদ সাবের নামে সমধিক পরিচিত। তিনি সংবাদ অফিসেই রাত কাটাতেন। অগ্নিদগ্ধ হয়ে তিনি মারা যান।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যুদ্ধপূর্ব পাকিস্তান শাসনামলে দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ, পূর্বদেশ, জনপদ, অবজারভার বাঙালির চেতনাকে যেভাবে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনকে উদ্বুদ্ধ ও ঐকমত্য তৈরিতে ভূমিকা পালন করেছিল তা ইতিহাস হয়ে আছে। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, জহুর আহমেদ চৌধুরী, আহমেদুল কবির, আব্দুস সালাম, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, চরমপত্রখ্যাত এম. আর আখতার মুকুল, রণেশ দাশগুপ্ত, কামাল লোহানী, সন্তোষ গুপ্ত, এবিএম মূসা প্রমুখ নির্ভীক সাংবাদিকদের ভূমিকা আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে আজও মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত।

এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাংবাদিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন দৈনিক পূর্বদেশ ও জয়বাংলা পত্রিকার সাংবাদিক আবুল মনজুর, চট্টগ্রামের মাসিক বান্ধবী পত্রিকার সাংবাদিক ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কথিকা পাঠিকা বেগম মুশতারী শফি, দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার সাংবাদিক ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কথক আবু তোয়াব খান, সাংবাদিক ওয়াহিদুল হক, দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার সাংবাদিক ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কথক মোহাম্মদ সলিমুল্লাহ, দৈনিক পূর্বদেশ ও জয়বাংলা পত্রিকার সাংবাদিক ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কথক রণজিত পাল চৌধুরী, দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার আল মাহমুদ, দ্য পিপলের নির্মলেন্দু গুণ ও আবিদুর রহমান, দৈনিক ইত্তেফাক ও জয়বাংলা পত্রিকার মোহাম্মদুল্লাহ চৌধুরী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইংরেজি বিভাগের সংগঠক আলমগীর কবির, খুলনার সাংবাদিক ও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের তথ্য কর্মকর্তা আলী তারেক, দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার মহাদেব সাহা, দৈনিক অবজারভার ও জয়বাংলা পত্রিকার এবিএম মূসা, সাপ্তাহিক হলিডে’র সাদেক খান, বাংলার বাণীর শফিকুল আজিজ মুকুল ও আমির হোসেন, দৈনিক আজাদ ও জয়বাংলা পত্রিকার আমিনুল হক বাদশা, দৈনিক অবজারভার পত্রিকার মৃণাল কুমার রায় ও জালাল উদ্দিন, দৈনিক বার্তা পত্রিকার আব্দুর রাজ্জাক চৌধুরী, দৈনিক অবজারভার পত্রিকার ফয়েজ আহমদ, দৈনিক আজাদী পত্রিকার সাধন কুমার ধরসহ আরও অনেকে। এসব সাংবাদিকদের প্রায় সবাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথে কোন না কোনভাবে যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বিশ্বব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সমর্থন আদায়ে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে সংবাদসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করে।

মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ৬৪টি পত্রিকা প্রকাশের তথ্য পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি দৈনিক এবং বেশির ভাগ সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, সাময়িকী, বুলেটিন, ম্যাগাজিন, নিউজলেটার ইত্যাদি। পাকিস্তানি বাহিনী যেহেতু একবারে সব জেলায় আক্রমণ করতে পারেনি, তাই ঢাকার বাইরের অনেক জেলা একাত্তরের মার্চের পরেও কয়েক মাস মুক্ত ছিল। এসব মুক্ত জেলা এবং মুজিবনগর থেকে সে সময় বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের উদ্যোগে প্রচুর পত্র-পত্রিকা বেরিয়েছে। দেশের ভেতরে ও বাইরে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছে যে দুটি মাধ্যম তার মধ্যে একটি এসব পত্রপত্রিকা এবং অন্যটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। যুদ্ধে অংশগ্রহণের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধারা এসব পত্রপত্রিকার তথ্য সংগ্রহে সহায়তা করত।

মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে নয় মাসে আত্মপ্রকাশকৃত উল্লেখযোগ্য পত্রিকাগুলো হলো- ঢাকার ‘জয়ধ্বনি’, ‘দেশবাংলা’, ‘অভিযান’, ‘স্বদেশ’, ‘বাংলাদেশ’; সিলেটের ‘সিলেট বার্তা’, ‘মুক্তবাংলা’, ‘বাংলা’, ‘দুর্জয় বাংলা’; খুলনার ‘স্বদেশ’, ‘ডাক দিয়ে যাই’; রাজশাহীর ‘বাংলার কথা’, ‘স্বাধীন বাংলা’; রংপুরের ‘রণাঙ্গন’, ‘অগ্রদূত’, ‘সংগ্রামী বাংলা’; বরিশালের ‘বাংলাদেশ’, ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’, ‘আমার বাংলা’, ‘সোনার বাংলা’; নওগাঁর ‘জয় বাংলা’, ‘বঙ্গবাণী’; মুজিবনগরের ‘জন্মভূমি’, ‘বাংলার বাণী’, ‘স্বাধীন বাংলা’, ‘জাতীয় বাংলাদেশ’, ‘জয় বাংলা’, ‘নতুন বাংলা’, ‘মুক্তি’, ‘দাবানল’, ‘বাংলাদেশ’, ‘অমর বাংলা’, ‘মায়ের ডাক’, ‘বাংলার মুখ’, ‘স্বাধীন বাংলা’, ‘Bangladesh‘, The Nation, The People’’, ময়মনসিংহের ‘মুক্ত বাংলা’, ‘জাগ্রত বাংলা’, ‘সংগ্রামী বাংলা’; চট্টগ্রামের ‘ইসলামাবাদ’, ‘বাংলাদেশ’, ‘স্বাধীন বাংলা’; সাতক্ষীরার ‘কাফেলা’; মুক্তাঞ্চলের ‘অগ্নিবাণ’, ‘বাংলাদেশ’, ‘আমার দেশ’; টাঙ্গাইলের ‘রণাঙ্গন’; যশোরের ‘স্ফুলিঙ্গ’; নোয়াখালীর ‘বাংলাদেশ’, ‘মুজিববার্তা’, ‘স্বাধীন বাংলা’; সুনামগঞ্জের ‘বিন্দু বিন্দু রক্তে’; ঠাকুরগাঁওয়ের ‘সংগ্রামী বাংলা’; আওয়ামী লীগের ‘জয় বাংলা’; কমিউনিস্ট পার্টির ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘স্বাধীন বাংলা’, ‘বাংলাদেশ’। এছাড়া রয়েছে ‘প্রতিনিধি’, ‘মুক্তি’ (যুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যপত্র),‘নতুন বাংলা’ (ন্যাপ), ‘বাংলার ডাক’, ‘আমোদ’ (কুমিল্লা), ‘উত্তাল পদ্মা’, ‘ইশতেহার’, ‘ওরা দুর্জয় ওরা দুর্বার’, ‘গণমুক্তি’, ‘গ্রেনেড’, ‘ধূমকেতু’, ‘বাংলার কথা’, ‘বাংলার মুখ’, ‘মায়ের ডাক’, ‘লড়াই’, ‘স্বাধীনতা’ প্রভৃতি। উল্লেখ্য, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রকাশিত হয়েছে বলে ভিন্ন সম্পাদনায় একই নামের একাধিক পত্রিকাও পরিলক্ষিত হয়। এ সংখ্যা দশেরও অধিক। সংখ্যাধিক্যে ‘বাংলাদেশ’ নামে আট স্থান থেকে আটটি এবং ‘স্বাধীন বাংলা’ নামে ছয় অঞ্চল থেকে ছয়টি পত্রিকা প্রকাশ করা হয়। কোনো কোনো পত্রিকা হাতে লিখে যাত্রা শুরু করে, পরে সাইক্লোস্টাইলরূপে প্রকাশ করা হয়েছে। কারফিউ উঠানোর পর অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে সাইক্লোস্টাইলকৃত পত্রিকার কপি বিদেশি দূতাবাস ও সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছে দেয়া হতো। হাতেগোনা বাদে এসব পত্রিকা ডিসেম্বরের পর আর প্রকাশিত হয়নি।

উল্লেখিত পত্রিকা ছাড়াও প্রবাসী বাংলাদেশিদের উদ্যোগে লন্ডন থেকে ‘বাংলাদেশ সংবাদ পরিক্রমা’, ‘বাংলাদেশ নিউজ লেটার’, পাক্ষিক ‘বাংলাদেশ টুডে’, ও সাপ্তাহিক ‘জনমত’; আমেরিকা থেকে ‘বাংলাদেশ পত্র’, ‘বাংলাদেশ শিখা’, ‘স্ফুলিঙ্গ’, ‘বাংলাদেশ নিউজ লেটার’, ‘বাংলাদেশ ওয়েস্ট কাস্ট নিউজ বুলেটিন’ ও কানাডা থেকে ‘বাংলাদেশ’ প্রকাশিত হতো। প্রবাসীরা এসব পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনে সহায়তা করেছেন। (চলবে)

সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯ , ১৫ পৌষ ১৪২৬, ২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

১৯৭১ সালের মুক্তিসংগ্রাম : দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের অবদান

সাদেকুর রহমান

(গতকালের পর)

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর মর্টারের গোলায় তিনটি দৈনিক পত্রিকার প্রেস ও অফিস ধ্বংস হয়ে যায়। এগুলো হলো দৈনিক ‘ইত্তেফাক’, ‘সংবাদ’ ও ‘দ্য পিপল’। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বাংলার নিরস্ত্র জনতার ওপর যখন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সে সময়ে ‘অবরুদ্ধ বাংলাদেশ : কণ্ঠরুদ্ধ সংবাদপত্র’ এই ব্যানার শিরোনাম প্রস্তুত করেছিল ‘দ্য পিপল’। কিন্তু সে রাতেই পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আক্রান্ত হয় পরীবাগে দ্য পিপল অফিস। মারা যায় ছ’জন সাংবাদিক। ২৬ মার্চ বিকেল ৪টার দিকে ইত্তেফাক অফিসে দুটি ট্যাংক থেকে গোলা ছুড়ে সেই অফিসটি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। ৩১ মার্চ খুব সকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বংশালে অবস্থিত তৎকালীন দৈনিক সংবাদ অফিসে আগুন লাগিয়ে দেয়। তাতে শহীদ হন ওই পত্রিকার এক সময়কার সহকারী সম্পাদক একেএম শহীদুল্লাহ, যিনি শহীদ সাবের নামে সমধিক পরিচিত। তিনি সংবাদ অফিসেই রাত কাটাতেন। অগ্নিদগ্ধ হয়ে তিনি মারা যান।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যুদ্ধপূর্ব পাকিস্তান শাসনামলে দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ, পূর্বদেশ, জনপদ, অবজারভার বাঙালির চেতনাকে যেভাবে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনকে উদ্বুদ্ধ ও ঐকমত্য তৈরিতে ভূমিকা পালন করেছিল তা ইতিহাস হয়ে আছে। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, জহুর আহমেদ চৌধুরী, আহমেদুল কবির, আব্দুস সালাম, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, চরমপত্রখ্যাত এম. আর আখতার মুকুল, রণেশ দাশগুপ্ত, কামাল লোহানী, সন্তোষ গুপ্ত, এবিএম মূসা প্রমুখ নির্ভীক সাংবাদিকদের ভূমিকা আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে আজও মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত।

এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাংবাদিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন দৈনিক পূর্বদেশ ও জয়বাংলা পত্রিকার সাংবাদিক আবুল মনজুর, চট্টগ্রামের মাসিক বান্ধবী পত্রিকার সাংবাদিক ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কথিকা পাঠিকা বেগম মুশতারী শফি, দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার সাংবাদিক ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কথক আবু তোয়াব খান, সাংবাদিক ওয়াহিদুল হক, দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার সাংবাদিক ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কথক মোহাম্মদ সলিমুল্লাহ, দৈনিক পূর্বদেশ ও জয়বাংলা পত্রিকার সাংবাদিক ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কথক রণজিত পাল চৌধুরী, দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার আল মাহমুদ, দ্য পিপলের নির্মলেন্দু গুণ ও আবিদুর রহমান, দৈনিক ইত্তেফাক ও জয়বাংলা পত্রিকার মোহাম্মদুল্লাহ চৌধুরী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইংরেজি বিভাগের সংগঠক আলমগীর কবির, খুলনার সাংবাদিক ও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের তথ্য কর্মকর্তা আলী তারেক, দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার মহাদেব সাহা, দৈনিক অবজারভার ও জয়বাংলা পত্রিকার এবিএম মূসা, সাপ্তাহিক হলিডে’র সাদেক খান, বাংলার বাণীর শফিকুল আজিজ মুকুল ও আমির হোসেন, দৈনিক আজাদ ও জয়বাংলা পত্রিকার আমিনুল হক বাদশা, দৈনিক অবজারভার পত্রিকার মৃণাল কুমার রায় ও জালাল উদ্দিন, দৈনিক বার্তা পত্রিকার আব্দুর রাজ্জাক চৌধুরী, দৈনিক অবজারভার পত্রিকার ফয়েজ আহমদ, দৈনিক আজাদী পত্রিকার সাধন কুমার ধরসহ আরও অনেকে। এসব সাংবাদিকদের প্রায় সবাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথে কোন না কোনভাবে যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বিশ্বব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সমর্থন আদায়ে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে সংবাদসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করে।

মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ৬৪টি পত্রিকা প্রকাশের তথ্য পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি দৈনিক এবং বেশির ভাগ সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, সাময়িকী, বুলেটিন, ম্যাগাজিন, নিউজলেটার ইত্যাদি। পাকিস্তানি বাহিনী যেহেতু একবারে সব জেলায় আক্রমণ করতে পারেনি, তাই ঢাকার বাইরের অনেক জেলা একাত্তরের মার্চের পরেও কয়েক মাস মুক্ত ছিল। এসব মুক্ত জেলা এবং মুজিবনগর থেকে সে সময় বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের উদ্যোগে প্রচুর পত্র-পত্রিকা বেরিয়েছে। দেশের ভেতরে ও বাইরে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছে যে দুটি মাধ্যম তার মধ্যে একটি এসব পত্রপত্রিকা এবং অন্যটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। যুদ্ধে অংশগ্রহণের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধারা এসব পত্রপত্রিকার তথ্য সংগ্রহে সহায়তা করত।

মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে নয় মাসে আত্মপ্রকাশকৃত উল্লেখযোগ্য পত্রিকাগুলো হলো- ঢাকার ‘জয়ধ্বনি’, ‘দেশবাংলা’, ‘অভিযান’, ‘স্বদেশ’, ‘বাংলাদেশ’; সিলেটের ‘সিলেট বার্তা’, ‘মুক্তবাংলা’, ‘বাংলা’, ‘দুর্জয় বাংলা’; খুলনার ‘স্বদেশ’, ‘ডাক দিয়ে যাই’; রাজশাহীর ‘বাংলার কথা’, ‘স্বাধীন বাংলা’; রংপুরের ‘রণাঙ্গন’, ‘অগ্রদূত’, ‘সংগ্রামী বাংলা’; বরিশালের ‘বাংলাদেশ’, ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’, ‘আমার বাংলা’, ‘সোনার বাংলা’; নওগাঁর ‘জয় বাংলা’, ‘বঙ্গবাণী’; মুজিবনগরের ‘জন্মভূমি’, ‘বাংলার বাণী’, ‘স্বাধীন বাংলা’, ‘জাতীয় বাংলাদেশ’, ‘জয় বাংলা’, ‘নতুন বাংলা’, ‘মুক্তি’, ‘দাবানল’, ‘বাংলাদেশ’, ‘অমর বাংলা’, ‘মায়ের ডাক’, ‘বাংলার মুখ’, ‘স্বাধীন বাংলা’, ‘Bangladesh‘, The Nation, The People’’, ময়মনসিংহের ‘মুক্ত বাংলা’, ‘জাগ্রত বাংলা’, ‘সংগ্রামী বাংলা’; চট্টগ্রামের ‘ইসলামাবাদ’, ‘বাংলাদেশ’, ‘স্বাধীন বাংলা’; সাতক্ষীরার ‘কাফেলা’; মুক্তাঞ্চলের ‘অগ্নিবাণ’, ‘বাংলাদেশ’, ‘আমার দেশ’; টাঙ্গাইলের ‘রণাঙ্গন’; যশোরের ‘স্ফুলিঙ্গ’; নোয়াখালীর ‘বাংলাদেশ’, ‘মুজিববার্তা’, ‘স্বাধীন বাংলা’; সুনামগঞ্জের ‘বিন্দু বিন্দু রক্তে’; ঠাকুরগাঁওয়ের ‘সংগ্রামী বাংলা’; আওয়ামী লীগের ‘জয় বাংলা’; কমিউনিস্ট পার্টির ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘স্বাধীন বাংলা’, ‘বাংলাদেশ’। এছাড়া রয়েছে ‘প্রতিনিধি’, ‘মুক্তি’ (যুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যপত্র),‘নতুন বাংলা’ (ন্যাপ), ‘বাংলার ডাক’, ‘আমোদ’ (কুমিল্লা), ‘উত্তাল পদ্মা’, ‘ইশতেহার’, ‘ওরা দুর্জয় ওরা দুর্বার’, ‘গণমুক্তি’, ‘গ্রেনেড’, ‘ধূমকেতু’, ‘বাংলার কথা’, ‘বাংলার মুখ’, ‘মায়ের ডাক’, ‘লড়াই’, ‘স্বাধীনতা’ প্রভৃতি। উল্লেখ্য, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রকাশিত হয়েছে বলে ভিন্ন সম্পাদনায় একই নামের একাধিক পত্রিকাও পরিলক্ষিত হয়। এ সংখ্যা দশেরও অধিক। সংখ্যাধিক্যে ‘বাংলাদেশ’ নামে আট স্থান থেকে আটটি এবং ‘স্বাধীন বাংলা’ নামে ছয় অঞ্চল থেকে ছয়টি পত্রিকা প্রকাশ করা হয়। কোনো কোনো পত্রিকা হাতে লিখে যাত্রা শুরু করে, পরে সাইক্লোস্টাইলরূপে প্রকাশ করা হয়েছে। কারফিউ উঠানোর পর অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে সাইক্লোস্টাইলকৃত পত্রিকার কপি বিদেশি দূতাবাস ও সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছে দেয়া হতো। হাতেগোনা বাদে এসব পত্রিকা ডিসেম্বরের পর আর প্রকাশিত হয়নি।

উল্লেখিত পত্রিকা ছাড়াও প্রবাসী বাংলাদেশিদের উদ্যোগে লন্ডন থেকে ‘বাংলাদেশ সংবাদ পরিক্রমা’, ‘বাংলাদেশ নিউজ লেটার’, পাক্ষিক ‘বাংলাদেশ টুডে’, ও সাপ্তাহিক ‘জনমত’; আমেরিকা থেকে ‘বাংলাদেশ পত্র’, ‘বাংলাদেশ শিখা’, ‘স্ফুলিঙ্গ’, ‘বাংলাদেশ নিউজ লেটার’, ‘বাংলাদেশ ওয়েস্ট কাস্ট নিউজ বুলেটিন’ ও কানাডা থেকে ‘বাংলাদেশ’ প্রকাশিত হতো। প্রবাসীরা এসব পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনে সহায়তা করেছেন। (চলবে)