কমরেড মনিসিংহকে স্মরণ করি গভীর শ্রদ্ধায়

এ এন রাশেদা

কমরেড মনিসিংহ এ উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা এবং অন্যতম স্থপতি বলে সবাই মনে করেন। তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন এবং প্রথম সভাপতি। সততা, আত্মত্যাগ, আদর্শনিষ্ঠা, দায়িত্ববোধ, সময়ানুবর্তিতা প্রভৃতি গুণাবলী রাজনীতিতে তাকে এক অনন্য সম্মানের অধিকারী করেছে।

নিজের রচিত ‘জীবন সংগ্রাম’ গ্রন্থের ভূমিকায় কমরেড মনিসিংহ লিখছেন- ‘আমাদের দেশে কমিউনিস্ট এবং কৃষক, শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ দিনের। এই শতকের বিশের দশক থেকেই কমিউনিস্ট মতবাদে উদ্বুদ্ধ কর্মীরা শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে কাজ করে আসছেন। ত্রিশের দশকের শেষ ভাগে তা আরো জোরদার হয়ে উঠে।

আমি বিশের দশকের শেষ ভাগ থেকে এ আন্দোলনে সাধ্যমতো অংশগ্রহণ করেছি। প্রথমে শ্রমিক, পরে কৃষক আন্দোলন ও সংগঠনের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। ১৯৪৮ সালের মার্চে আমাদের পার্টি বর্তমান বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হওয়ার পর থেকে চেষ্টা করেছি পার্টির কাজ ও সংগঠনকে গুছিয়ে তুলতে। আজ আমি জীবন-সায়াহ্নে। মার্কসবাদ, লেলিনবাদ গ্রহণ করে এ দেশের বিপুল অংশ শ্রমিক-কৃষক-ক্ষেতমজুরের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য যৌবনের প্রথমে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু করেছিলাম- আজ তরুণরা অনেকেই এগিয়ে এসেছেন সেই সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব নিয়ে। আর এখানেই আমার মতো সূচনায় যারা এগিয়ে এসেছিলেন, তাদের জীবনের সার্থকতা।’ বলতে হয় এখানেই অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে কমিউনিস্টদের ভিন্নতা- তারা সবার অবদানকে স্বীকার করেন এবং বাস্তবতাও তাই।

১৯৮০ সালে অক্টোবর বিপ্লব বার্ষিকী উদযাপনকালে বাংলাদেশ সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির মুখপাত্র ‘মৈত্রী’র জন্য কমরেড মনিসিংহের সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে প্রশ্ন করেছিলাম- মানুষের বর্তমান ধারায় সমাজতন্ত্রের যে সুফল দেখছেন, সে সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?

উত্তরে তিনি জানালেন- ‘সমাজতান্ত্রিক দেশের মূল ব্যাপার হলো- সেখানে দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও বুভুক্ষার চিহ্নমাত্র নেই। লেখাপড়া করার জন্য কিংবা কর্মসংস্থানের জন্য কোনো দুশ্চিন্তায় পড়তে হয় না। সাবালক, সাবালিকা সবাই কাজ করতে পারেন। পড়াশোনার খরচও জোগাতে হয় না। কারণ প্রত্যেক শিক্ষার্থী সেখানে বৃত্তি পায়। কলেজ পর্যায়ে সোভিয়েত শিক্ষার্থীদের জন্য মাসে ৪৫ রুবল, বিদেশি শিক্ষার্থীরা ৯০ রুবল পায়। প্রত্যেক শিক্ষক শিক্ষয়ত্রী অত্যন্ত যত্নসহকারে তাদের পড়ান। কোনো শিক্ষার্থী কোনো বিষয়ে দুর্বল থাকলে তাকে আলাদাভাবে সে বিষয়টি পড়ানো হয়।

শুধু পড়াশোনা নয়, চিকিৎসা পেতেও সোভিয়েত দেশে অর্থ ব্যয় করতে হয় না। সোভিয়েত ইউনিয়নে বিরাট বিরাট পলিক্লিনিক সর্বত্র। কারো কোন অসুখ হলে ততক্ষণাৎ তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে খরচা ছাড়াই উন্নতমানের চিকিৎসা তারা পান। ওষুধপত্রের দামও সেখানে খুব কম। বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য আছে পৃথক হোম। প্রত্যেকের অবসর ভাতা আছেই। মানবিক জীবনে যা কিছু প্রয়োজন- পরিপূর্ণভাবে মেটাতে পারছে সমাজতান্ত্রিক সমাজ।

তিনি আরও বলেন, শিল্প-বাণিজ্য চর্চা ও উপভোগের প্রচুর ব্যবস্থা আছে সেখানে। এ সমস্ত সমাজতান্ত্রিক দেশে আমি জীবনের এক নবজাগরণ দেখেছি। শুধু তাই নয়, ওই সব ভাগ্যহত মানুষের জন্য তারা ভাবে- সাহায্য করে, যারা এখনও ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদী শোষণে নিষ্পেষিত। স্বাধীনতার সংগ্রামে অবতীর্ণ দেশ ও জাতির পাশে দাঁড়ায় সোভিয়েত জনগণ। সমগ্র পৃথিবীকে চিরদিনের জন্য শোষণমুক্ত করার লেনিনীয় আদর্শে তারা চায় সারাবিশ্বের মানুষ শোষণমুক্ত হয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে উন্নত জীবনের স্পর্শ লাভ করুক। তিনি আরও বলেন, মানুষের জন্য মানুষের দরদ বিদেশি অতিথিদের জন্য আন্তরিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার, কালো-ধলা বা নানাবিধি ব্যবস্থা থেকে মুক্ত মানসিকতা নিয়ে সকলকে মানুষ হিসেবে গণ্য করার সুগভীর উপলব্ধি ও বোধশক্তি সেখানে গড়ে উঠেছে।

এসব বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে কমরেড মনিসিংহ এবং তার পার্টির আদর্শের দিকটিই প্রতিভাত হয়েছে- সব মানুষের সমাজ, সাম্যের সমাজ এবং অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যই তারা রাজনীতি করেছেন। তাদের এই আকাক্সক্ষা আমাদের বাহাত্তরের সংবিধানে স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু আজও তা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, মানুষের জীবনে তার প্রতিফলনও নেই।

কমরেড মনিসিংহকে আমি প্রথম দেখেছিলাম স্বাধীনতার পর রংপুরে। রংপুর ডিস্ট্রিক বোর্ড কার্যালয়ে তৎকালীন ন্যাপের উদ্যোগে এক সুধী সমাবেশে। বক্তারা শুনে মুগ্ধ হয়েছেন- ‘শ্রমিক শ্রেণীর রাজ কায়েম হবে’ সেই বজ্রনিনাদ শুনে। তারপর বহুবার। জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর পার্টি আবার নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে কমরেড মনিসিংহকে আমাদের বাসায় রাখার সিদ্ধান্ত ছিল। বেশ কিছুদিন ছিলেন। তার নামে জারি হয়েছিল হুলিয়া।

একদিনের একটি মজার ঘটনা মনে পড়ছে। আমাদের বাসার পাশেই ছিলেন আমেরিকান কালচারাল সেন্টারের চিফ লাইব্রেরিয়ান। আমার মেজো ভাইয়ের বন্ধু হওয়ায় মাঝে-মধ্যে আসতেন। ছিলেন কট্টর মার্কিনপন্থী। একদিন এসে বললেন, ‘জানো, মনিসিংহ কোথায় আছে?’ তাৎক্ষণিক বুকে কাঁপুনি নিয়ে বললাম- না তো। হঠাৎ করেই তিনি টেলিফোন করার কথা বলে উঠতে লাগলেন। আমি প্রমাদ গুনলাম। কারণ মনিসিংহ যে ঘরে আছেন সে ঘরেই টেলিফোন। আমি তাড়াতাড়ি তাকে বসিয়ে দিয়ে বললাম- ভাই, আপনাকে কষ্ট করতে হবে না, আমি এনে দিচ্ছি। আর, হ্যাঁ তিনি কোথায় আছেন? তিনি অনেক রং চড়িয়ে বর্ণনা করলেন- ‘মনি সিংহ সোভিয়েত অ্যাম্বেসির আন্ডারগ্রাউন্ডে আছেন।’ তারপর চা-চক্র শেষে বিদায় দিলাম।

আর যেদিন পার্টির ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠানো হলো- তার দুই দিন আগে উত্তরবঙ্গের তে-ভাগা আন্দোলনের কিংবদন্তিতুল্য কমরেড মনি কৃষ্ণ সেন কলকাতা থেকে ঢাকায় আমাদের বাসায় উঠেছেন। আর রাতে খবর প্রচারিত হলো- পার্টির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে। অমনি বড় ভাই (কমরেড মনিসিংহ) যাওয়ার জন্য তাগাদা দিলেন। আমার স্বামী গোলাম মহিউদ্দিন (বর্তমানে প্রয়াত) ঢাকায় না থাকায় আমি একটু বিপদগ্রস্ত বোধ করলাম। আমি ফোন করলাম ডাকসুর সাবেক ভিপি শফি আহমেদ ভাইকে। তিনি সকালে এসে দু’জনকে নিয়ে বের হলেন। দোতলা থেকে নেমে কমরেড মনিসিংহ গটগট করে গিয়ে গাড়িতে বসলেন। কমরেড মনি কৃষ্ণ সেন তাকে অনুসরণ করলেন। তাদের পরনে ধবধবে সাদা পায়জামা আর শার্ট। তা-দেখে কৌতুহলী বাড়ির মালিক তৎক্ষণাৎ উপরে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন- ‘আপা, উনারা কারা, এত সুন্দর চেহারা, এমন স্মার্ট- ব্যারিস্টার বলে মনে হলো। আমি তাৎক্ষণিক জবাব দিলাম- হ্যাঁ, উনারা কলকাতা থেকে এসেছিলেন, যে মনিসিংহকে এতদিন ধরে খোঁজা হচ্ছিল, যার নামে হুলিয়া ছিল। তাকে আমি তার বাসায় জায়গা দিয়েছি শুনে বাড়ির মালিকের কী রিঅ্যাকশন হয়- তা ভেবেই ওই উত্তর ছিল।

এভাবেই কমিউনিস্ট পার্টির কমরেডরা বছরের পর বছর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন একটি শোষণমুক্ত মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।

[লেখক : সাবেক অধ্যাপিকা, নটর ডেম কলেজ; সম্পাদক, মাসিক শিক্ষাবার্তা ও সাপ্তাহিক একতা]

মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ , ১৬ পৌষ ১৪২৬, ৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

কমরেড মনিসিংহকে স্মরণ করি গভীর শ্রদ্ধায়

এ এন রাশেদা

কমরেড মনিসিংহ এ উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা এবং অন্যতম স্থপতি বলে সবাই মনে করেন। তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন এবং প্রথম সভাপতি। সততা, আত্মত্যাগ, আদর্শনিষ্ঠা, দায়িত্ববোধ, সময়ানুবর্তিতা প্রভৃতি গুণাবলী রাজনীতিতে তাকে এক অনন্য সম্মানের অধিকারী করেছে।

নিজের রচিত ‘জীবন সংগ্রাম’ গ্রন্থের ভূমিকায় কমরেড মনিসিংহ লিখছেন- ‘আমাদের দেশে কমিউনিস্ট এবং কৃষক, শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ দিনের। এই শতকের বিশের দশক থেকেই কমিউনিস্ট মতবাদে উদ্বুদ্ধ কর্মীরা শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে কাজ করে আসছেন। ত্রিশের দশকের শেষ ভাগে তা আরো জোরদার হয়ে উঠে।

আমি বিশের দশকের শেষ ভাগ থেকে এ আন্দোলনে সাধ্যমতো অংশগ্রহণ করেছি। প্রথমে শ্রমিক, পরে কৃষক আন্দোলন ও সংগঠনের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। ১৯৪৮ সালের মার্চে আমাদের পার্টি বর্তমান বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হওয়ার পর থেকে চেষ্টা করেছি পার্টির কাজ ও সংগঠনকে গুছিয়ে তুলতে। আজ আমি জীবন-সায়াহ্নে। মার্কসবাদ, লেলিনবাদ গ্রহণ করে এ দেশের বিপুল অংশ শ্রমিক-কৃষক-ক্ষেতমজুরের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য যৌবনের প্রথমে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু করেছিলাম- আজ তরুণরা অনেকেই এগিয়ে এসেছেন সেই সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব নিয়ে। আর এখানেই আমার মতো সূচনায় যারা এগিয়ে এসেছিলেন, তাদের জীবনের সার্থকতা।’ বলতে হয় এখানেই অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে কমিউনিস্টদের ভিন্নতা- তারা সবার অবদানকে স্বীকার করেন এবং বাস্তবতাও তাই।

১৯৮০ সালে অক্টোবর বিপ্লব বার্ষিকী উদযাপনকালে বাংলাদেশ সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির মুখপাত্র ‘মৈত্রী’র জন্য কমরেড মনিসিংহের সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে প্রশ্ন করেছিলাম- মানুষের বর্তমান ধারায় সমাজতন্ত্রের যে সুফল দেখছেন, সে সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?

উত্তরে তিনি জানালেন- ‘সমাজতান্ত্রিক দেশের মূল ব্যাপার হলো- সেখানে দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও বুভুক্ষার চিহ্নমাত্র নেই। লেখাপড়া করার জন্য কিংবা কর্মসংস্থানের জন্য কোনো দুশ্চিন্তায় পড়তে হয় না। সাবালক, সাবালিকা সবাই কাজ করতে পারেন। পড়াশোনার খরচও জোগাতে হয় না। কারণ প্রত্যেক শিক্ষার্থী সেখানে বৃত্তি পায়। কলেজ পর্যায়ে সোভিয়েত শিক্ষার্থীদের জন্য মাসে ৪৫ রুবল, বিদেশি শিক্ষার্থীরা ৯০ রুবল পায়। প্রত্যেক শিক্ষক শিক্ষয়ত্রী অত্যন্ত যত্নসহকারে তাদের পড়ান। কোনো শিক্ষার্থী কোনো বিষয়ে দুর্বল থাকলে তাকে আলাদাভাবে সে বিষয়টি পড়ানো হয়।

শুধু পড়াশোনা নয়, চিকিৎসা পেতেও সোভিয়েত দেশে অর্থ ব্যয় করতে হয় না। সোভিয়েত ইউনিয়নে বিরাট বিরাট পলিক্লিনিক সর্বত্র। কারো কোন অসুখ হলে ততক্ষণাৎ তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে খরচা ছাড়াই উন্নতমানের চিকিৎসা তারা পান। ওষুধপত্রের দামও সেখানে খুব কম। বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য আছে পৃথক হোম। প্রত্যেকের অবসর ভাতা আছেই। মানবিক জীবনে যা কিছু প্রয়োজন- পরিপূর্ণভাবে মেটাতে পারছে সমাজতান্ত্রিক সমাজ।

তিনি আরও বলেন, শিল্প-বাণিজ্য চর্চা ও উপভোগের প্রচুর ব্যবস্থা আছে সেখানে। এ সমস্ত সমাজতান্ত্রিক দেশে আমি জীবনের এক নবজাগরণ দেখেছি। শুধু তাই নয়, ওই সব ভাগ্যহত মানুষের জন্য তারা ভাবে- সাহায্য করে, যারা এখনও ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদী শোষণে নিষ্পেষিত। স্বাধীনতার সংগ্রামে অবতীর্ণ দেশ ও জাতির পাশে দাঁড়ায় সোভিয়েত জনগণ। সমগ্র পৃথিবীকে চিরদিনের জন্য শোষণমুক্ত করার লেনিনীয় আদর্শে তারা চায় সারাবিশ্বের মানুষ শোষণমুক্ত হয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে উন্নত জীবনের স্পর্শ লাভ করুক। তিনি আরও বলেন, মানুষের জন্য মানুষের দরদ বিদেশি অতিথিদের জন্য আন্তরিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার, কালো-ধলা বা নানাবিধি ব্যবস্থা থেকে মুক্ত মানসিকতা নিয়ে সকলকে মানুষ হিসেবে গণ্য করার সুগভীর উপলব্ধি ও বোধশক্তি সেখানে গড়ে উঠেছে।

এসব বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে কমরেড মনিসিংহ এবং তার পার্টির আদর্শের দিকটিই প্রতিভাত হয়েছে- সব মানুষের সমাজ, সাম্যের সমাজ এবং অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যই তারা রাজনীতি করেছেন। তাদের এই আকাক্সক্ষা আমাদের বাহাত্তরের সংবিধানে স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু আজও তা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, মানুষের জীবনে তার প্রতিফলনও নেই।

কমরেড মনিসিংহকে আমি প্রথম দেখেছিলাম স্বাধীনতার পর রংপুরে। রংপুর ডিস্ট্রিক বোর্ড কার্যালয়ে তৎকালীন ন্যাপের উদ্যোগে এক সুধী সমাবেশে। বক্তারা শুনে মুগ্ধ হয়েছেন- ‘শ্রমিক শ্রেণীর রাজ কায়েম হবে’ সেই বজ্রনিনাদ শুনে। তারপর বহুবার। জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর পার্টি আবার নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে কমরেড মনিসিংহকে আমাদের বাসায় রাখার সিদ্ধান্ত ছিল। বেশ কিছুদিন ছিলেন। তার নামে জারি হয়েছিল হুলিয়া।

একদিনের একটি মজার ঘটনা মনে পড়ছে। আমাদের বাসার পাশেই ছিলেন আমেরিকান কালচারাল সেন্টারের চিফ লাইব্রেরিয়ান। আমার মেজো ভাইয়ের বন্ধু হওয়ায় মাঝে-মধ্যে আসতেন। ছিলেন কট্টর মার্কিনপন্থী। একদিন এসে বললেন, ‘জানো, মনিসিংহ কোথায় আছে?’ তাৎক্ষণিক বুকে কাঁপুনি নিয়ে বললাম- না তো। হঠাৎ করেই তিনি টেলিফোন করার কথা বলে উঠতে লাগলেন। আমি প্রমাদ গুনলাম। কারণ মনিসিংহ যে ঘরে আছেন সে ঘরেই টেলিফোন। আমি তাড়াতাড়ি তাকে বসিয়ে দিয়ে বললাম- ভাই, আপনাকে কষ্ট করতে হবে না, আমি এনে দিচ্ছি। আর, হ্যাঁ তিনি কোথায় আছেন? তিনি অনেক রং চড়িয়ে বর্ণনা করলেন- ‘মনি সিংহ সোভিয়েত অ্যাম্বেসির আন্ডারগ্রাউন্ডে আছেন।’ তারপর চা-চক্র শেষে বিদায় দিলাম।

আর যেদিন পার্টির ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠানো হলো- তার দুই দিন আগে উত্তরবঙ্গের তে-ভাগা আন্দোলনের কিংবদন্তিতুল্য কমরেড মনি কৃষ্ণ সেন কলকাতা থেকে ঢাকায় আমাদের বাসায় উঠেছেন। আর রাতে খবর প্রচারিত হলো- পার্টির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে। অমনি বড় ভাই (কমরেড মনিসিংহ) যাওয়ার জন্য তাগাদা দিলেন। আমার স্বামী গোলাম মহিউদ্দিন (বর্তমানে প্রয়াত) ঢাকায় না থাকায় আমি একটু বিপদগ্রস্ত বোধ করলাম। আমি ফোন করলাম ডাকসুর সাবেক ভিপি শফি আহমেদ ভাইকে। তিনি সকালে এসে দু’জনকে নিয়ে বের হলেন। দোতলা থেকে নেমে কমরেড মনিসিংহ গটগট করে গিয়ে গাড়িতে বসলেন। কমরেড মনি কৃষ্ণ সেন তাকে অনুসরণ করলেন। তাদের পরনে ধবধবে সাদা পায়জামা আর শার্ট। তা-দেখে কৌতুহলী বাড়ির মালিক তৎক্ষণাৎ উপরে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন- ‘আপা, উনারা কারা, এত সুন্দর চেহারা, এমন স্মার্ট- ব্যারিস্টার বলে মনে হলো। আমি তাৎক্ষণিক জবাব দিলাম- হ্যাঁ, উনারা কলকাতা থেকে এসেছিলেন, যে মনিসিংহকে এতদিন ধরে খোঁজা হচ্ছিল, যার নামে হুলিয়া ছিল। তাকে আমি তার বাসায় জায়গা দিয়েছি শুনে বাড়ির মালিকের কী রিঅ্যাকশন হয়- তা ভেবেই ওই উত্তর ছিল।

এভাবেই কমিউনিস্ট পার্টির কমরেডরা বছরের পর বছর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন একটি শোষণমুক্ত মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।

[লেখক : সাবেক অধ্যাপিকা, নটর ডেম কলেজ; সম্পাদক, মাসিক শিক্ষাবার্তা ও সাপ্তাহিক একতা]