ওয়ান-ইলেভেনের ষড়যন্ত্র এবং আরও কিছু কথা

মোহাম্মদ শাহজাহান

গত সাত দশকের ইতিহাসে- পাকিস্তান আমলে এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশেও নির্বাচনের মাধ্যমে যখনই আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় যাওয়ার সময় হয়েছে, তখনই বারবার ষড়যন্ত্র হয়েছে। বছর ঘুরে আবার

ও এগারো জানুয়ারি আসছে। ২০০৭ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় ছিল শতভাগ নিশ্চিত। কিন্তু দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা সেই নির্বাচন হতে দেয়নি। মাত্র এক যুগ আগের কথা। বাঙালি বীরের জাতি। ৯ মাসের সম্মুখ সমরে দুর্ধর্ষ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে একাত্তরে দেশ স্বাধীন করেছিল। মাত্র ১৩ বছর আগের ওয়ান-ইলেভেনের ষড়যন্ত্রের কথা কি আমরা ভুলে গেছি?

বিএনপি স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবিরকে নিয়ে ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে ৫ বছরের দুঃশাসনে একেবারে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ২০০৭-এর ২২ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে বিএনপি আবারও ক্ষমতা দখলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। আর বিশাল জনসমর্থনের কারণে আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচন প্রতিহত করতে আরও বেশি মরিয়া হয়ে ওঠে। বিএনপি চাচ্ছিল হয় নিজেরা ক্ষমতায় যাবে নতুবা তৃতীয় শক্তি ক্ষমতায় আসুক। আর আওয়ামী লীগ চাচ্ছিল জনবিচ্ছিন্ন বিএনপিকে কোনভাবেই পুনরায় অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দেয়া যাবে না। নিশ্চিত গৃহযুদ্ধের পথেই এগোচ্ছিল দেশ। ওই মুহূর্তে ত্রাণকর্তারূপেই ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনরা ক্ষমতা দখল করে। কয়েক মাস ভালোই চলছিল। এরপরে ক্ষমতা দখলের নেশায় পড়ে ওরা তালগোল পাকিয়ে ফেলে। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ওরা একরকম পালিয়ে বাঁচে।

কি পরিস্থিতিতে ‘ওয়ান-ইলেভেন’ এসেছিল তা জানতে হলে আমাদের পেছনে ফিরে যেতে হবে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিতর্কিত ও কৌশলগত কারচুপির নির্বাচনে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতকে নিয়ে দুই শতাধিক আসনে জয়ী হয়ে বিএনপি পুনরায় ক্ষমতায় আসে। নির্বাচনে বিজয়ী হয়েই বিএনপির গু-া-পা-ারা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর দমন-পীড়ন-নির্যাতন শুরু করে। ওদের অত্যাচার, অবিচার, উৎপীড়ন একাত্তরের ইয়াহিয়া-টিক্কা-নিজামিদের বর্বরতাকেও ছাড়িয়ে যায়। জোটের ৫ বছরে আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ সহযোগী সংগঠনগুলোর হাজার হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা, গুম, গ্রেফতার ও হয়রানি করা হয়। ওদের ক্যাডার বাহিনী বিরোধী দলের বহু নেতাকর্মী বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের গৃহবধূ যুবতী কিশোরীদের পালাক্রমে ধর্ষণ করে। এখনো যে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- চলছে এর শুরু তো করে গেছেন খালেদা জিয়া। নব্বইয়ের দশকে প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর তার শাসনামলে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটলে সারা দেশে যৌথ বাহিনী নামিয়ে বিনা বিচারে হত্যার মহোৎসব শুরু হয়। মানবাধিকার সংস্থাসহ বিভিন্ন মহল থেকে ওই বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ শুরু হলে যৌথ বাহিনী প্রত্যাহার করে সরকার। এরপর র‌্যাব গঠন করে আগের নিয়মেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- চলতে থাকে, যা আজও অব্যাহত রয়েছে।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে সময় বিনা বিচারে এসব নির্মম হত্যাকা-ের প্রতিবাদ করলেও এখনও তা চলছে। বিনা বিচারে এ বর্বর হত্যাকা- অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিত। আজ হোক, কাল হোক এই বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তি এবং তাদের লাইসেন্সদাতা সরকারকে জবাবদিহি করতেই হবে। খালেদা জিয়ার ৫ বছরে (২০০১-০৬) বাংলাদেশ পরপর চারবার দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমানের লুটপাট ও দুর্নীতি দেশ-বিদেশের পত্রিকার শিরোনাম হয়। খালেদা জিয়ার দুই পুত্র এবং লালু-ফালু-মামুন-হারিছগং দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। ওই সময় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সারা দেশে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার অসৎ উদ্দেশে ২০০৪-এর ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়। নেত্রী বেঁচে গেলেও বেগম আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত এবং বহু নেতাকর্মী এখনও পঙ্গু জীবনযাপন করছে।

ওই সময় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হত্যার ষড়যন্ত্র ছাড়াও আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া এমপি ও গাজীপুরের জনপ্রিয় সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টারসহ দলের জেলা পর্যায়ের আরও অনেক নেতাকে খালেদা জিয়ার জোট আমলে হত্যা করা হয়। ওই আমলে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক করে পুলিশ। এই বেআইনি অস্ত্র কে, কোথা থেকে কিভাবে আনল তা ধামাচাপা দেয় খালেদা-নিজামী সরকার। স্মরণকালের চরম দুঃশাসনের কারণে খালেদা-নিজামী সরকারের জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। আর এসব কারণেই বিএনপি জোট ৫ বছর মেয়াদ শেষে ২০০৬ সালে ছলেবলেকলে কৌশলে আবারও রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। অথচ বারবার দলবদলকারী মওদুদ আহমদ এক সময়ের বিএনপি নেতা বিচারপতি হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বানানোর অসৎ উদ্দেশে বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়ে দিয়েছিল। এ বহুরূপী মানুষটি কি জবাব দেবেন, রাষ্ট্রের আর কোন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বয়স না বাড়িয়ে তখন বিচারপতিদের বয়স কেন ৬৭ বছর করা হয়েছিল? এ মানুষটি এ দেশের রাজনীতি সবচেয়ে বেশি কলুষিত করেছেন। তিনি এক সময় বঙ্গবন্ধুর গাড়ি চালিয়ে আনন্দ পেলেও পরে স্বৈরশাসকদের পদলেহন করে উপদেষ্টা, মন্ত্রী, উপপ্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ও উপরাষ্ট্রপতির আসন পর্যন্ত অপবিত্র করেছেন।

মওদুদ- খালেদা জিয়ারা ২০০৬ সালে নির্ধারিত মেয়াদ শেষে সংবিধানসম্মতভাবে সব দলের কাছে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করে তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে দেশে কোনভাবেই ১১ জানুয়ারির সৃষ্টি হতো না। কিভাবে খালেদা জিয়াদের প্ররোচনায় বিএনপি দলীয় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন প্রধান উপদেষ্টার গদি অন্যায়ভাবে দখল করেছিলেন, সে কাহিনী এখন ইতিহাস। এরপর দলীয় রাষ্ট্রপতি, আজ্ঞাবহ ইয়াজউদ্দিন ও দালাল নির্বাচন কমিশনার আবদুল আজিজ ২২ জানুয়ারির ষড়যন্ত্রের নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি জোটকে আবারও ক্ষমতায় বসাতে তৎপর হয়। সে কাহিনীও কারও অজানা নয়। মেরুদ-হীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে সুপথে আনতে ব্যর্থ হয়ে সরকারের দেশপ্রেমিক চার উপদেষ্টা ১১ ডিসেম্বর ২০০৬ একযোগে পদত্যাগ করেন। কিন্তু এতেও লজ্জিত হননি নির্লজ্জ সম্রাট প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন। নতুন উপদেষ্টা নিয়োগ করে তিনি একদলীয় একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানে অগ্রসর হন। এহেন পরিস্থিেিত ঘোষিত ২২ জানুয়ারির নির্বাচনের ১১ দিন আগে ১০ জানুযারি ২০০৭ সালে মহাজোট নেত্রী শেখ হাসিনা পল্টনের বিশাল মহাসমাবেশে নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দেন। একই দিন নির্বাচনের জন্য সারা দেশে মোতায়েন সেনাবাহিনীকে নির্বাচনী কাজে সম্পৃক্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করেন রাষ্ট্রপতি। সরকারের প্রজ্ঞাপনে নির্বাচনী কাজে বাধা সৃষ্টিকারীদের কোন পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার করার ক্ষমতা দেয়া হয় সেনাবাহিনীকে।

বিএনপি দলীয় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন খালেদা জিয়া-মওদুদ-মান্নান ভূঁইয়াদের প্ররোচনায় সেনাবাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলেন। ১১ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের ব্যাপারে সরাসরি হুমকি আসে জাতিসংঘ থেকে। তৎকালীন সেনা প্রধান লে. জে. মঈন ইউ আহমেদ তার গ্রন্থে লিখেছেন- ‘১১ জানুয়ারি সকালে জাতিসংঘ সদর দফতর থেকে আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল মি. গুইহিনো কোন রকম ভনিতা না করেই জানালেন, সব দলের অংশগ্রহণ ব্যতীত নির্বাচন তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এ রকম নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ভূমিকা রাখলে জাতিসংঘ শান্তি মিশন থেকে বাংলাদেশকে প্রত্যাহার করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে।’ এভাবে ইয়াজউদ্দিন সাহেব দেশকে গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়ে সেনাবাহিনীকে হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দেয়। বিএনপিও চাচ্ছিল সেনা হস্তক্ষেপ। কারণ সব দলের নির্বাচন হলে নিশ্চিতভাবেই তাদের ভরাডুবি ঘটত। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসত। এ অবস্থায় আর্মি ক্ষমতা নিলে খালেদা জিয়ার পোয়াবারো হতো। একদিকে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হলো, অন্যদিকে নিজেদের লোকেরাই ক্ষমতা পেলো। আবার সুবিধা মতো সময়ে ক্ষমতা বিএনপির হাতেই চলে আসবে।

খালেদা জিয়াদের দুর্ভাগ্য, যে কোন কারণেই হোক সেনাবাহিনী সে সময় সরাসরি ক্ষমতা নিতে এগিয়ে আসেনি। বিএনপি-জামায়াতের প্ররোচনায় দলবাজ ইয়াজউদ্দিন যখন দেশকে সংঘাতের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেলেন, তখনই সেনাপ্রধান অন্য দু’বাহিনী প্রধান এবং পদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ে ১১ জানুয়ারি ২০০৭ বৃহস্পতিবার বিকেলে বঙ্গভবনে যান। সেনা নেতাদের চাপে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ সংক্রান্ত কাগজে স্বাক্ষর দেন রাষ্ট্রপতি অর্থাৎ অন্যায়ভাবে দখল করা পদ থেকে পদচ্যুত করা হলো। এরপর রাষ্ট্রপতি দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন। রাত ১১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত ঢাকাসহ সব বিভাগীয় ও জেলা শহরে কারফিউ জারি করা হয়। রাত সাড়ে ১১টায় ভাষণে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন বিগত মাসগুলোতে তার নেয়া ভুল পদক্ষেপ ও দুষ্কর্মের কথা স্বীকার করে নেন। পরে শোনা যায়, রাষ্ট্রপতির তথ্য উপদেষ্টা এক সাংবাদিককে নাকি ওই দিন চর-থাপ্পড়ও মারা হয়েছিল। ১২ জানুয়ারি শুক্রবার নয়া প্রধান উপদেষ্টা হন ফখরুদ্দীন আহমেদ। কোন কোন বিদেশি পত্রিকায় সরকার পরিবর্তনের এই পদক্ষেপকে এক ধরনের ক্যু হিসেবে উল্লেখ করা হয়। উল্লেখ্য, ১১ জানুয়ারি বিকেলে ঢাকার কানাডীয় রাষ্ট্রদূতের বাসায় কূটনীতিকদের সঙ্গে প্রথমে আওয়ামী লীগ ও পরে বিএনপি নেতৃবৃন্দের বৈঠক হয়। আর সেনা নেতাদের সঙ্গে কূটনীতিকদের যোগাযোগতো সব সময়ই ছিল।

অবশেষে ফখরুদ্দীন মইনউদ্দিনরা নির্বাচন দিয়ে এক প্রকার পালিয়ে বাঁচে। তবে ২৯ ডিসেম্বরের (২০০৮) ওই নির্বাচন ছিল স্মরণকালের অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ।

অবাধ ও সুষ্ঠু ওই নির্বাচনে শেখ হাসিনার মহাজোট জিতবে আর বিএনপি জোট হারবে এটা ছিল প্রত্যাশিত। তবে শেখ হাসিনার জোট ৩০০ আসনের মধ্যে ২৬২টি পাবে, এটা হয়তো মহাজোট নেত্রী নিজেও চিন্তা করেননি। ফখরুদ্দীন সরকার যদি মাইনাস-টুসহ বিতর্কিত পদক্ষেপগুলো না নিয়ে ৯ মাস থেকে এক বছরের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে বিদায় নিতো, তাহলে ওই অনির্বাচিত ও অসাংবিধানিক সরকারের কথা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকত। তবে সরকারের ভুলত্রুটি, দুর্নীতি, অনিয়ম সত্ত্বেও ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচন দেশের শতকরা ৯০ ভাগ লোকের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। নির্বাচনে চরমভাবে পরাজিত খালেদা জিয়া ও বিএনপি কয়েক বছর জে. মঈন ও ফখরুদ্দীনের বিচার দাবি করেছে। তাদের পক্ষে এটা করাই স্বাভাবিক। ফখরুদ্দীন সরকারের আমলে বিএনপির দুঃশাসন, কুশাসন-অপশাসন এবং ওই দলের নেতাকর্মীদের সীমাহীন দুঃশাসনের কথা দেশ বিদেশের মানুষ জানতে পারে।

শুরুতে ২/৩ বছর বিএনপি ১১ জানুয়ারিকে কালো দিবস, গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে পালন করেছে। তবে এটা তো ঠিক, বিএনপির প্ররোচতায় বিএনপি দলীয় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন ওয়ান-ইলেভেন অনিবার্য করে তুলেছিলেন। জোট সরকারের অঘোষিত আইন উপদেষ্টা দেশের খ্যাতিমান আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ২০১০ সালের ২৪ জুলাই যুগান্তর আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে যথার্থভাবেই বলেন, ‘ওয়ান-ইলেভেনের জন্য বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী (সাকাচৌ) সবচেয়ে বেশি দায়ী।’

দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে খালেদা জিয়া দু’বছরের বেশি সময় ধরে কারাগারে রয়েছেন। গত বছর ১০ অক্টোবর গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের যাবজ্জীবন কারাদ- এবং বিএনপির আরও কয়েকজন নেতার ফাঁসি ও যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। গত বছর ৩০ ডিসেম্বর বৃহৎ জোট করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি মাত্র ৬/৭টি আসন পেয়েছে। বিএনপি ও জোটের পক্ষ থেকে ওই নির্বাচনে বিশাল কারচুপির অভিযোগ করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার মুক্তির লক্ষ্যে বিএনপি নেতারা আন্দোলন করার হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। বাস্তবে কিছুই হচ্ছে না, তেমন কিছু হওয়ার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। বিদেশে ১১ বছর অবস্থানকারী দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভুল রাজনীতির কারণে বিএনপি নামের দলটি ক্রমেই ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে।

গণতান্ত্রিক দেশে কার্যকর বিরোধী দল না থাকলে সে দেশে গণতন্ত্র থাকে না। ওই পরিস্থিতিতে সরকারি দল আপনা-আপনি দৈত্যে পরিণত হয়। আওয়ামী লীগ ১১ বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, বিগত ৭ দশকের ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের যখন ক্ষমতায় যাওয়ার সময় এসেছে তখনই দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা ষড়যন্ত্র করেছে। চক্রান্তকারীরা আজও থেমে নেই। বর্তমান সময়ে নির্বাচনের মাধ্যমে বিরোধী দলের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ বললেই চলে। এই অবস্থায় ওয়ান-ইলেভেনের মতো কোন দৈত্য যেন জাতির ঘাড়ে আবারও সওয়ার হতে না পারে সে জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

২৯ ডিসেম্বর ২০১৯

[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষক; সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা ]

bandhu.ch77@yahoo.com

মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ , ১৬ পৌষ ১৪২৬, ৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

ওয়ান-ইলেভেনের ষড়যন্ত্র এবং আরও কিছু কথা

মোহাম্মদ শাহজাহান

গত সাত দশকের ইতিহাসে- পাকিস্তান আমলে এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশেও নির্বাচনের মাধ্যমে যখনই আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় যাওয়ার সময় হয়েছে, তখনই বারবার ষড়যন্ত্র হয়েছে। বছর ঘুরে আবার

ও এগারো জানুয়ারি আসছে। ২০০৭ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় ছিল শতভাগ নিশ্চিত। কিন্তু দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা সেই নির্বাচন হতে দেয়নি। মাত্র এক যুগ আগের কথা। বাঙালি বীরের জাতি। ৯ মাসের সম্মুখ সমরে দুর্ধর্ষ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে একাত্তরে দেশ স্বাধীন করেছিল। মাত্র ১৩ বছর আগের ওয়ান-ইলেভেনের ষড়যন্ত্রের কথা কি আমরা ভুলে গেছি?

বিএনপি স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবিরকে নিয়ে ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে ৫ বছরের দুঃশাসনে একেবারে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ২০০৭-এর ২২ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে বিএনপি আবারও ক্ষমতা দখলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। আর বিশাল জনসমর্থনের কারণে আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচন প্রতিহত করতে আরও বেশি মরিয়া হয়ে ওঠে। বিএনপি চাচ্ছিল হয় নিজেরা ক্ষমতায় যাবে নতুবা তৃতীয় শক্তি ক্ষমতায় আসুক। আর আওয়ামী লীগ চাচ্ছিল জনবিচ্ছিন্ন বিএনপিকে কোনভাবেই পুনরায় অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দেয়া যাবে না। নিশ্চিত গৃহযুদ্ধের পথেই এগোচ্ছিল দেশ। ওই মুহূর্তে ত্রাণকর্তারূপেই ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনরা ক্ষমতা দখল করে। কয়েক মাস ভালোই চলছিল। এরপরে ক্ষমতা দখলের নেশায় পড়ে ওরা তালগোল পাকিয়ে ফেলে। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ওরা একরকম পালিয়ে বাঁচে।

কি পরিস্থিতিতে ‘ওয়ান-ইলেভেন’ এসেছিল তা জানতে হলে আমাদের পেছনে ফিরে যেতে হবে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিতর্কিত ও কৌশলগত কারচুপির নির্বাচনে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতকে নিয়ে দুই শতাধিক আসনে জয়ী হয়ে বিএনপি পুনরায় ক্ষমতায় আসে। নির্বাচনে বিজয়ী হয়েই বিএনপির গু-া-পা-ারা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর দমন-পীড়ন-নির্যাতন শুরু করে। ওদের অত্যাচার, অবিচার, উৎপীড়ন একাত্তরের ইয়াহিয়া-টিক্কা-নিজামিদের বর্বরতাকেও ছাড়িয়ে যায়। জোটের ৫ বছরে আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ সহযোগী সংগঠনগুলোর হাজার হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা, গুম, গ্রেফতার ও হয়রানি করা হয়। ওদের ক্যাডার বাহিনী বিরোধী দলের বহু নেতাকর্মী বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের গৃহবধূ যুবতী কিশোরীদের পালাক্রমে ধর্ষণ করে। এখনো যে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- চলছে এর শুরু তো করে গেছেন খালেদা জিয়া। নব্বইয়ের দশকে প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর তার শাসনামলে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটলে সারা দেশে যৌথ বাহিনী নামিয়ে বিনা বিচারে হত্যার মহোৎসব শুরু হয়। মানবাধিকার সংস্থাসহ বিভিন্ন মহল থেকে ওই বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ শুরু হলে যৌথ বাহিনী প্রত্যাহার করে সরকার। এরপর র‌্যাব গঠন করে আগের নিয়মেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- চলতে থাকে, যা আজও অব্যাহত রয়েছে।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে সময় বিনা বিচারে এসব নির্মম হত্যাকা-ের প্রতিবাদ করলেও এখনও তা চলছে। বিনা বিচারে এ বর্বর হত্যাকা- অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিত। আজ হোক, কাল হোক এই বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তি এবং তাদের লাইসেন্সদাতা সরকারকে জবাবদিহি করতেই হবে। খালেদা জিয়ার ৫ বছরে (২০০১-০৬) বাংলাদেশ পরপর চারবার দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমানের লুটপাট ও দুর্নীতি দেশ-বিদেশের পত্রিকার শিরোনাম হয়। খালেদা জিয়ার দুই পুত্র এবং লালু-ফালু-মামুন-হারিছগং দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। ওই সময় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সারা দেশে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার অসৎ উদ্দেশে ২০০৪-এর ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়। নেত্রী বেঁচে গেলেও বেগম আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত এবং বহু নেতাকর্মী এখনও পঙ্গু জীবনযাপন করছে।

ওই সময় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হত্যার ষড়যন্ত্র ছাড়াও আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া এমপি ও গাজীপুরের জনপ্রিয় সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টারসহ দলের জেলা পর্যায়ের আরও অনেক নেতাকে খালেদা জিয়ার জোট আমলে হত্যা করা হয়। ওই আমলে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক করে পুলিশ। এই বেআইনি অস্ত্র কে, কোথা থেকে কিভাবে আনল তা ধামাচাপা দেয় খালেদা-নিজামী সরকার। স্মরণকালের চরম দুঃশাসনের কারণে খালেদা-নিজামী সরকারের জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। আর এসব কারণেই বিএনপি জোট ৫ বছর মেয়াদ শেষে ২০০৬ সালে ছলেবলেকলে কৌশলে আবারও রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। অথচ বারবার দলবদলকারী মওদুদ আহমদ এক সময়ের বিএনপি নেতা বিচারপতি হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বানানোর অসৎ উদ্দেশে বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়ে দিয়েছিল। এ বহুরূপী মানুষটি কি জবাব দেবেন, রাষ্ট্রের আর কোন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বয়স না বাড়িয়ে তখন বিচারপতিদের বয়স কেন ৬৭ বছর করা হয়েছিল? এ মানুষটি এ দেশের রাজনীতি সবচেয়ে বেশি কলুষিত করেছেন। তিনি এক সময় বঙ্গবন্ধুর গাড়ি চালিয়ে আনন্দ পেলেও পরে স্বৈরশাসকদের পদলেহন করে উপদেষ্টা, মন্ত্রী, উপপ্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ও উপরাষ্ট্রপতির আসন পর্যন্ত অপবিত্র করেছেন।

মওদুদ- খালেদা জিয়ারা ২০০৬ সালে নির্ধারিত মেয়াদ শেষে সংবিধানসম্মতভাবে সব দলের কাছে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করে তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে দেশে কোনভাবেই ১১ জানুয়ারির সৃষ্টি হতো না। কিভাবে খালেদা জিয়াদের প্ররোচনায় বিএনপি দলীয় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন প্রধান উপদেষ্টার গদি অন্যায়ভাবে দখল করেছিলেন, সে কাহিনী এখন ইতিহাস। এরপর দলীয় রাষ্ট্রপতি, আজ্ঞাবহ ইয়াজউদ্দিন ও দালাল নির্বাচন কমিশনার আবদুল আজিজ ২২ জানুয়ারির ষড়যন্ত্রের নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি জোটকে আবারও ক্ষমতায় বসাতে তৎপর হয়। সে কাহিনীও কারও অজানা নয়। মেরুদ-হীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে সুপথে আনতে ব্যর্থ হয়ে সরকারের দেশপ্রেমিক চার উপদেষ্টা ১১ ডিসেম্বর ২০০৬ একযোগে পদত্যাগ করেন। কিন্তু এতেও লজ্জিত হননি নির্লজ্জ সম্রাট প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন। নতুন উপদেষ্টা নিয়োগ করে তিনি একদলীয় একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানে অগ্রসর হন। এহেন পরিস্থিেিত ঘোষিত ২২ জানুয়ারির নির্বাচনের ১১ দিন আগে ১০ জানুযারি ২০০৭ সালে মহাজোট নেত্রী শেখ হাসিনা পল্টনের বিশাল মহাসমাবেশে নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দেন। একই দিন নির্বাচনের জন্য সারা দেশে মোতায়েন সেনাবাহিনীকে নির্বাচনী কাজে সম্পৃক্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করেন রাষ্ট্রপতি। সরকারের প্রজ্ঞাপনে নির্বাচনী কাজে বাধা সৃষ্টিকারীদের কোন পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার করার ক্ষমতা দেয়া হয় সেনাবাহিনীকে।

বিএনপি দলীয় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন খালেদা জিয়া-মওদুদ-মান্নান ভূঁইয়াদের প্ররোচনায় সেনাবাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলেন। ১১ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের ব্যাপারে সরাসরি হুমকি আসে জাতিসংঘ থেকে। তৎকালীন সেনা প্রধান লে. জে. মঈন ইউ আহমেদ তার গ্রন্থে লিখেছেন- ‘১১ জানুয়ারি সকালে জাতিসংঘ সদর দফতর থেকে আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল মি. গুইহিনো কোন রকম ভনিতা না করেই জানালেন, সব দলের অংশগ্রহণ ব্যতীত নির্বাচন তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এ রকম নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ভূমিকা রাখলে জাতিসংঘ শান্তি মিশন থেকে বাংলাদেশকে প্রত্যাহার করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে।’ এভাবে ইয়াজউদ্দিন সাহেব দেশকে গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়ে সেনাবাহিনীকে হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দেয়। বিএনপিও চাচ্ছিল সেনা হস্তক্ষেপ। কারণ সব দলের নির্বাচন হলে নিশ্চিতভাবেই তাদের ভরাডুবি ঘটত। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসত। এ অবস্থায় আর্মি ক্ষমতা নিলে খালেদা জিয়ার পোয়াবারো হতো। একদিকে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হলো, অন্যদিকে নিজেদের লোকেরাই ক্ষমতা পেলো। আবার সুবিধা মতো সময়ে ক্ষমতা বিএনপির হাতেই চলে আসবে।

খালেদা জিয়াদের দুর্ভাগ্য, যে কোন কারণেই হোক সেনাবাহিনী সে সময় সরাসরি ক্ষমতা নিতে এগিয়ে আসেনি। বিএনপি-জামায়াতের প্ররোচনায় দলবাজ ইয়াজউদ্দিন যখন দেশকে সংঘাতের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেলেন, তখনই সেনাপ্রধান অন্য দু’বাহিনী প্রধান এবং পদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ে ১১ জানুয়ারি ২০০৭ বৃহস্পতিবার বিকেলে বঙ্গভবনে যান। সেনা নেতাদের চাপে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ সংক্রান্ত কাগজে স্বাক্ষর দেন রাষ্ট্রপতি অর্থাৎ অন্যায়ভাবে দখল করা পদ থেকে পদচ্যুত করা হলো। এরপর রাষ্ট্রপতি দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন। রাত ১১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত ঢাকাসহ সব বিভাগীয় ও জেলা শহরে কারফিউ জারি করা হয়। রাত সাড়ে ১১টায় ভাষণে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন বিগত মাসগুলোতে তার নেয়া ভুল পদক্ষেপ ও দুষ্কর্মের কথা স্বীকার করে নেন। পরে শোনা যায়, রাষ্ট্রপতির তথ্য উপদেষ্টা এক সাংবাদিককে নাকি ওই দিন চর-থাপ্পড়ও মারা হয়েছিল। ১২ জানুয়ারি শুক্রবার নয়া প্রধান উপদেষ্টা হন ফখরুদ্দীন আহমেদ। কোন কোন বিদেশি পত্রিকায় সরকার পরিবর্তনের এই পদক্ষেপকে এক ধরনের ক্যু হিসেবে উল্লেখ করা হয়। উল্লেখ্য, ১১ জানুয়ারি বিকেলে ঢাকার কানাডীয় রাষ্ট্রদূতের বাসায় কূটনীতিকদের সঙ্গে প্রথমে আওয়ামী লীগ ও পরে বিএনপি নেতৃবৃন্দের বৈঠক হয়। আর সেনা নেতাদের সঙ্গে কূটনীতিকদের যোগাযোগতো সব সময়ই ছিল।

অবশেষে ফখরুদ্দীন মইনউদ্দিনরা নির্বাচন দিয়ে এক প্রকার পালিয়ে বাঁচে। তবে ২৯ ডিসেম্বরের (২০০৮) ওই নির্বাচন ছিল স্মরণকালের অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ।

অবাধ ও সুষ্ঠু ওই নির্বাচনে শেখ হাসিনার মহাজোট জিতবে আর বিএনপি জোট হারবে এটা ছিল প্রত্যাশিত। তবে শেখ হাসিনার জোট ৩০০ আসনের মধ্যে ২৬২টি পাবে, এটা হয়তো মহাজোট নেত্রী নিজেও চিন্তা করেননি। ফখরুদ্দীন সরকার যদি মাইনাস-টুসহ বিতর্কিত পদক্ষেপগুলো না নিয়ে ৯ মাস থেকে এক বছরের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে বিদায় নিতো, তাহলে ওই অনির্বাচিত ও অসাংবিধানিক সরকারের কথা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকত। তবে সরকারের ভুলত্রুটি, দুর্নীতি, অনিয়ম সত্ত্বেও ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচন দেশের শতকরা ৯০ ভাগ লোকের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। নির্বাচনে চরমভাবে পরাজিত খালেদা জিয়া ও বিএনপি কয়েক বছর জে. মঈন ও ফখরুদ্দীনের বিচার দাবি করেছে। তাদের পক্ষে এটা করাই স্বাভাবিক। ফখরুদ্দীন সরকারের আমলে বিএনপির দুঃশাসন, কুশাসন-অপশাসন এবং ওই দলের নেতাকর্মীদের সীমাহীন দুঃশাসনের কথা দেশ বিদেশের মানুষ জানতে পারে।

শুরুতে ২/৩ বছর বিএনপি ১১ জানুয়ারিকে কালো দিবস, গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে পালন করেছে। তবে এটা তো ঠিক, বিএনপির প্ররোচতায় বিএনপি দলীয় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন ওয়ান-ইলেভেন অনিবার্য করে তুলেছিলেন। জোট সরকারের অঘোষিত আইন উপদেষ্টা দেশের খ্যাতিমান আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ২০১০ সালের ২৪ জুলাই যুগান্তর আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে যথার্থভাবেই বলেন, ‘ওয়ান-ইলেভেনের জন্য বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী (সাকাচৌ) সবচেয়ে বেশি দায়ী।’

দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে খালেদা জিয়া দু’বছরের বেশি সময় ধরে কারাগারে রয়েছেন। গত বছর ১০ অক্টোবর গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের যাবজ্জীবন কারাদ- এবং বিএনপির আরও কয়েকজন নেতার ফাঁসি ও যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। গত বছর ৩০ ডিসেম্বর বৃহৎ জোট করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি মাত্র ৬/৭টি আসন পেয়েছে। বিএনপি ও জোটের পক্ষ থেকে ওই নির্বাচনে বিশাল কারচুপির অভিযোগ করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার মুক্তির লক্ষ্যে বিএনপি নেতারা আন্দোলন করার হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। বাস্তবে কিছুই হচ্ছে না, তেমন কিছু হওয়ার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। বিদেশে ১১ বছর অবস্থানকারী দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভুল রাজনীতির কারণে বিএনপি নামের দলটি ক্রমেই ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে।

গণতান্ত্রিক দেশে কার্যকর বিরোধী দল না থাকলে সে দেশে গণতন্ত্র থাকে না। ওই পরিস্থিতিতে সরকারি দল আপনা-আপনি দৈত্যে পরিণত হয়। আওয়ামী লীগ ১১ বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, বিগত ৭ দশকের ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের যখন ক্ষমতায় যাওয়ার সময় এসেছে তখনই দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা ষড়যন্ত্র করেছে। চক্রান্তকারীরা আজও থেমে নেই। বর্তমান সময়ে নির্বাচনের মাধ্যমে বিরোধী দলের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ বললেই চলে। এই অবস্থায় ওয়ান-ইলেভেনের মতো কোন দৈত্য যেন জাতির ঘাড়ে আবারও সওয়ার হতে না পারে সে জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

২৯ ডিসেম্বর ২০১৯

[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষক; সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা ]

bandhu.ch77@yahoo.com