এক নজরে ২০১৯

সংবাদ ডেস্ক |

http://print.thesangbad.net/images/2019/December/31Dec19/news/International%20%281%29.jpg

২০১৯ সাল পুরোটা জুড়েই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সৃষ্ট নানা অস্থিরতা। ধর্মীয় ও জাতিবিদ্বেষ, অভিবাসীদের প্রতি ঘৃণা আর ক্ষমতাকেন্দ্রিক বিভাজনের জেরে বিশ্বজুড়ে বিক্ষোভ-সহিংসতা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। অর্থনীতিতে সংরক্ষণবাদের প্রসারে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বাণিজ্য যুদ্ধ সারা বছরজুড়ে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়। ব্রেক্সিট নিয়ে বছরজুড়েই অস্থির ছিল যুক্তরাজ্যের রাজনীতি। বছরের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের। অভিশংসিত হওয়া মনযোগ কেড়েছে বিশ্ববাসীর। ইউরোপ, এশিয়া, লাতিন আমেরিকায় এ বছর দেখা গেছে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ডানপন্থার উত্থানে পুরো পশ্চিমা বিশ্বের উদার গণতন্ত্র এখন হুমকির মুখে। এরইমধ্যে কোরিয় উপদ্বীপে উত্তেজনা ও মধ্যপ্রাচ্যেও রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি থামেনি অস্ত্রের ঝনঝনানি। এদিকে বছরের মাঝামাঝি ভারতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে জয় পেয়ে আবারও ক্ষমতায় আসা বিজেপি সরকার আসামে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি ও দেশজুড়ে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিয়ে বেকায়দায় পড়েছে। অপর দিকে বিজ্ঞানীদের সতর্কতা অনুযায়ী, আশঙ্কাজন গলছে আইসল্যান্ডের হীমবাহ। জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও কার্বন নিঃসরণ নিয়ে চলতি বছর বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তাকে গুরুত্ব দিয়ে তরুণদের পরিবেশবাদী ও জলবায়ু আন্দোলনকর্মীদেরও লড়াই নতুন আশার পথ দেখিয়েছে।

জলবায়ু আন্দোলনের নেতা গ্রেটা থুনবার্গ

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ্বজুড়ে জলবায়ু আন্দোলনকে যিনি একাই বারুদের আকারে ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি সুইডেনের স্কুল শিক্ষার্থী গ্রেটা থুনব্যার্গ। গত বছরও বিশ্ববাসীর কাছে প্রায় অপরিচিত থাকা এ পরিবেশ আন্দোলনকর্মী জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিতে ইউরোপ থেকে নিউইয়র্কে পালতোলা নৌকায় যাত্রা করেন। সেখানে পৌঁছে বিশ্বজুড়ে লাখো বিক্ষোভকারীর পক্ষে বিশ্বনেতাদের প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘কী সাহস আপনাদের!’ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে বিশ্ববাসীকে মনোযোগী করে তোলায় ১৬ বছর বয়সী এই স্কুল শিক্ষার্থী জলবায়ু আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন।

২০১৮ সালের আগস্টের প্রতি শুক্রবার সুইডিশ পার্লামেন্টের সামনে একটি প্লাকার্ড নিয়ে অবস্থান নিয়ে জলবায়ু আন্দোলন শুরু করেন। ওই প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল ‘জলবায়ুর জন্য স্কুলে ধর্মঘট’। তার ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’ অহিংস কর্মসূচির ডাকে সাড়া দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন শহরের শিক্ষার্থীসহ কয়েক লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে এসে আন্দোলন-বিক্ষোভ -ধর্মঘট করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়ে প্রথম ধর্মঘটটি নিউ ক্যালেডোনিয়ার ফ্রেঞ্চ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শুরু হয়। সমুদ্রের স্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপাকে পড়েছে দ্বীপ দেশগুলো। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে শত শত দ্বীপ নিয়ে গঠিত সলোমন দ্বীপপুঞ্জের শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে না গিয়ে জলবায়ু বিপর্যয় কীভাবে তাদের দেশকে হুমকির মুখে ফেলেছে তা তুলে ধরেন। অস্ট্রেলিয়ায় বিক্ষোভকারীদের দাবি ছিল, তারা চান সরকার ও ব্যবসায়ীরা যেন ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায়া নামিয়ে আনার ঘোষণা দেন। তারা বিশ্ব নেতাদের জাতিসংঘের ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিটে এনিয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার আহ্বানও জানান। থাইল্যান্ডের শিক্ষার্থীরা ব্যাংককের প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বাইরে এই আন্দোলনে অংশ নেন। পরিবেশ আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রাখায় আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন বিশ্বজুড়ে সাড়াজাগানো এ তরুণ জলবায়ুকর্মী। পাশাপাশি ২০১৯ সালের নোবেল পুরস্কারের জন্যও মনোনয়নও পেয়েছেন তিনি।

ব্রেক্সিট ইস্যুতে জনসনের বাজিমাত

ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে যুক্তরাজ্যের আনুষ্ঠানিকভাবে বেরিয়ে যাবার প্রক্রিয়া ব্রেক্সিট প্রশ্নে গত তিন বছর থেকে ব্রিটিশ রাজনীতি যেন থমকে আছে। ২০১৬ সালে ২৩ জুন এক ঐতিহাসিক গণভোটে ব্রেক্সিটের পক্ষে ব্রিটিশরা রায় দেয়ার পর থেকে গত বছরজুড়ে এ রাজনৈতিক অচলাবস্থা টানাপোড়েনে রূপ নেয়। তবে বছরের প্রথম ভাগে প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে পার্লামেন্টে তিনবার চেষ্টা করেও নিজের খসড়া ব্রেক্সিট চুক্তির প্রতি সাংসদদের সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হন। ৭ জুনে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ছাড়লে নতুন নেতা নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২৪ জুলাই দেশটির ৭৭তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশটির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও লন্ডনের মেয়র বরিস জনসন ডাউনিং স্ট্রিটে মে’র স্থলাভিষিক্ত হন।

এদিকে ব্রেক্সিট নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সুবিধা করতে না পেরে সেপ্টেম্বরে অধিবেশন মুলতবি করার ব্যবস্থা নেন নতুন প্রধানমন্ত্রী জনসন। দেশটির বিরোধী দলের নেতারা এ নিয়ে আদালতে গেলে সুপ্রিমকোর্ট সরকারের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে নতুন করে অধিবেশন শুরুর নির্দেশ দেন। দ্রুত ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন করতে চাওয়ায় পার্লামেন্টের চাপে পড়ে মেয়াদ বাড়াতে ইউরোপের কাছে চিঠিও লিখতে হয় এ টোরি নেতাকে। এরই ধারবাহিকতায় অক্টোবরে লন্ডনে পিপলস ভোট নামের একটি সংগঠনের উদ্যোগে ব্রেক্সিট নিয়ে দ্বিতীয় গণভোট চেয়ে বিরাট বিক্ষোভ হয় রাজধানী লন্ডনে। অবস্থা বেগতিক দেখে ওই মাসের শুরুতেই আগাম নির্বাচনের ডাক দেন জনসন। ব্রেক্সিট কার্যকরে জনগণের শক্তিশালী ম্যান্ডেট চেয়ে নির্বাচনে বাজিমাত করে কনজারভেটিভ পার্টিকে এনে দেন তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ফল। অন্যদিকে, কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফল করে দলের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দেন বিরোধীদল লেবার নেতা জেরেমি করবিন।

ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে টোরি সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্লামেন্ট ৩১ জানুয়ারির মধ্যে ব্রেক্সিট কার্যকরের বিলে অনুমোদন দেয়। এর মধ্য দিয়ে ব্রেক্সিট সংকটের অবসান ঘটে।

অভিশংসনের মুখে ট্রাম্প

সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অন্যতম প্রধান ইস্যু হলো বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাবান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ইমপিচ (অভিশংসন)। ৪৫তম এ মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই অনাস্থা জানিয়ে তাকে অভিশংসিত করার পক্ষে মত দিয়েছে বিরোধী ডেমোক্র্যাট নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভস (প্রতিনিধি পরিষদ)। দেশটির সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও তার ছেলে হান্টার বাইডেনের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে ইউক্রেনকে আহ্বান জানানোর অভিযোগে তার বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু করে বিরোধীরা।

দেশটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইয়ের গোপন নথিফাঁসকারী এক সদস্যের ফাঁস করা এক নথী অনুযায়ী, চলতি বছরের ২৫ জুলাই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলোনস্কির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন ট্রাম্প। ওই সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট আগামী ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ও ডেমোক্র্যাট নেতা জো বাইডেনের ও তার ছেলে হান্টার বাইডেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি সংক্রান্ত তদন্ত পরিচালনার জন্য অনুরোধ করেন। ওই সময় ট্রাম্প ইউক্রেনের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন যেন তারা বাইডেন পরিবারের ‘দুর্নীতি’ নিয়ে তদন্ত করে।

এ অনৈতিক চাপের অভিযোগে চলতি বছরের ৩১ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসন তদন্তের জন্য আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাস করে প্রতিনিধি পরিষদ। এরই ধারাবহিকতায় ১৩ নভেম্বর ক্যাপিটল হিলে প্রকাশ্যে অভিশংসন শুনানী শুরু হয়। দীর্ঘ শুনানী শেষে ১০ ডিসেম্বর প্রতিনিধি পরিষদে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ক্ষমতা থেকে অপসারনের জন্য আনুষ্ঠানিক অভিশংসন প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। এতে প্রেসিডেন্টর বিরুদ্ধে দুটি শক্ত অভিযোগ তুলে ধরা হয়। একটি, ক্ষমতার অপব্যবহার। অপরটি কংগ্রেসের কাজে বাধা দেয়া। অভিশংসন প্রস্তাবটি ডেমোক্র্যাট নিয়ন্ত্রিত নিন্মকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে পাস হওয়ার পর উচ্চকক্ষ সিনেটে গেছে। ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রীত সিনেটে শুনানী ২০২০ সালের জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে শুরু হওয়ার কথা।

জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্য মর্যাদা বাতিল

চলতি বছরের ৫ আগস্ট ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা তুলে নেয় দেশটির কক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকার। কেন্দ্রীয় সরকারের স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দেশটির সংসদের নিন্মকক্ষ রাজ্যসভায় এ সংক্রান্ত রাষ্ট্রপতির নির্দেশনা পড়ে শোনান। এতে প্রায় ৭০ বছর আগে ভারতীয় সংবিধানে কাশ্মীরকে দেয়া বিশেষ মর্যাদা ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের নির্দেশনা দেয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে অবধারিতভাবে বিলুপ্তি ঘটে সংবিধানের ৩৫(ক) ধারার। জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করে পৃথক রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নেয়া হয়। এ লক্ষ্যে ৫ আগস্ট ২০১৯ ভারতীয় সংসদেও নিন্মকক্ষ লোকসভা ও পরদিন ৬ আগস্ট উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় পাস করা হয় জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য পুনর্গঠন আইন ২০১৯। রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ ৯ আগস্ট ২০১৯ এ আইনে সই করেন। এরই ধারবাহিকতায় ৩১ অক্টোবর ২০১৯ থেকে নতুন এ আইন কার্যকর হয়।

নতুন এ আইন অনুযায়ী, জম্মু ও কাশ্মির থেকে কারগিল ও লাদাখকে আলাদা করে তৈরি করা হয় ‘লাদাখ’ নামের নতুন এক কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল (টহরড়হ ঞবৎৎরঃড়ৎু), যেখানে কোন বিধানসভা থাকবে না। অন্যদিকে জম্মু ও কাশ্মীর উপত্যকার বাকি অংশ গণ্য হবে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে। তবে এখানে বিধানসভা থাকবে। এ দুই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলই পারচালনা করবেন দুইজন লেফটেন্যান্ট গর্ভনর। ৩১ অক্টোবর ২০১৯ ভারত নিয়ন্ত্রিত ‘জম্মু ও কাশ্মীর’ আনুষ্ঠানিকভাবে দুই ভাগে ভাগ হয়।

দাবানলে পুড়ল পৃথিবীর ফুসফুস আমাজন

ভৌগোলিকভাবে বিশ্বের বৃহত্তম অরণ্য আমাজনের বনাঞ্চল। পৃথিবীর ২০ শতাংশ অক্সিজেন সরবরাহ করে এ বন। তাই দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা এই গভীর রেইন ফরেস্টকে পৃথিবীর ফুসফুসও বলা হয়। কিন্তু ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে নিঃশব্দে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে এই ফুসফুস।

ব্রাজিলে আমাজনের উষ্ণমণ্ডলীয় বনাঞ্চলে ২০১৯ সালে ব্রাজিলিয়ান স্পেস এজেন্সির তথ্য অনুযায়ী রেকর্ডসংখ্যক দাবানলের ঘটনা ঘটেছে। দ্য ন্যাশানাল ইন্সটিটিউট ফর স্পেস রিসার্চ (আইএনপিই) বলছে তাদের উপগ্রহ থেকে সংগৃহীত তথ্যে দেখা যাচ্ছে ২০১৮-র একই সময়ের তুলনায় ২০১৯ সালে আগুন লাগার ঘটনা ৮৫ শতাংশ বেড়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনে নাকাল বিশ্ব

২০১৯ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্ববাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে। এর জেওে পৃথিবীর একপ্রান্তে খরা, দাবদাহ, দাবানালের ছোবল তো আপরপ্রান্তে কাঁপিয়ে দিয়েছে ভয়াবহ তুষারঝড় ও শীত। এছাড়াও বন্যায় পানি ও সমুদ্রপিষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জেরে পানির নিচে তলিয়ে গেছে বহু এলাকা। এদিকে দিন যত গড়াচ্ছে, বিশ্বজুড়ে বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমাণও। গত মার্চে উত্তর আমেরিকার দেশগুলোকে কাঁপিয়ে দিয়েছে ভয়াবহ তুষারঝড়। এতে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। একই মাসে মোজাম্বিকে আছড়ে পড়া ঘূর্ণিঝড় কেড়ে নেয় হাজারেরও বেশি মানুষের জীবন। জুনে ইন্দোনেশিয়ার মাউন্ট সিনাবাংয়ে বিকট বিস্ফোরণ ও উদগিরণে ছাইয়ের কলাম ৭ হাজার মিটার ছোঁয়। অগাস্টে চীনের ঝেঝিয়াংয়ে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় লেকিমায় ৩২ জন প্রাণ হারান। একই মাসের ১০ তারিখ থেকে শুরু হওয়া ক্যানারি আইল্যান্ডের দাবানল দ্বীপটির বনাঞ্চলের বেশিরভাগ অংশকেই নিঃশেষ করে ফেলে। একই সময়ে ভারতের কেরালা, কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রে ভয়াবহ বন্যায় প্রায় দেড়শ’ জনের মৃত্যু হয়। অস্ট্রেলিয়ায় ভয়াবহ দাবানলেও এবছর পুরো একটি শহর পুড়ে ছাই হওয়াসহ ৯ জনের মৃত্যু হয়। বড় ধরনের দাবানলের কবলে পড়ে চিলির একটি শহরও। সেপ্টেম্বরের শুরুর দিনই ঘণ্টায় ১৮৫ মাইল গতির বাতাস নিয়ে বাহামা দ্বীপপুঞ্জে আঘাত হানে সামুদ্রিক ঝড় ডোরিয়ান। দেশটির ইতিহাসে আঘাত হানা সবচেয়ে শক্তিশালী এ ঝড় ৫২ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়।অক্টোবরের মাঝামাঝি জাপানে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় হাগিবিস। ওই মাসের শেষদিকে কয়েক দফা ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে ফিলিপাইন। নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলে ভারত ও বাংলাদেশের বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর খবর মেলে। ভেনিসে রেকর্ড বন্যায় জরুরি অবস্থা জারি করে ইতালি। মাসের শেষ সপ্তাহে আলবেনিয়ায় ভূমিকম্প ৫১ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়। ডিসেম্বরে বুরুন্ডিতে ভূমিধসে নিহত হন ২৬ জন।

খাশোগি হত্যাকাণ্ড

২০১৯ সালে অন্যতম আলোচিত বিষয় ছিল সৌদ সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ড। এ হত্যাকাণ্ডে সৌদি প্রভাবশালী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। তবে আন্তজাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর দাবি, এ হামলার নির্দেশদাতা যুবরাজ সালমানই। গত ডিসেম্বরে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকায় ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড দিলেও বিন সালমানের ঘনিষ্ঠ দুইজনকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। এ রায়কে ঘিরে নতুন করে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে রিয়াদ কর্র্তৃপক্ষ। ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে দ্বিতীয় বিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছায় নির্বাসিত ও ওয়াশিংটন পোস্টের কলাম লেখক খাশোগি।

নটরডাম ক্যাথিড্রালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড

গত বছরের ১৫ এপ্রিল প্যারিসের নটরডাম ক্যাথিড্রালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ৮৫০ বছরের পুরনো গির্জাটিতে এমন আগুন লাগা বিশ্ববাসীকে চরমভাবে হতাশ করেছে। ওই অগ্নিকাণ্ডে ক্যাথিড্রালটির মূল কাঠামো ও বাইরের অংশ প্রায় অক্ষত থাকলেও সব মিলিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ছাদের অংশটুকু প্রায় পুরোটাই ধ্বংস হয়ে যায়। বেশ কিছু ঐতিহাসিক সামগ্রী ও তৈলচিত্র নষ্ট হয়ে যায়। গির্জার প্রধান অরগ্যানেরও বেশ ক্ষতি হয়। ক্যাথিড্রালটি পুননির্মাণ করতে কয়েক বছর সময় লাগবে।

ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ রাম মন্দির মামলার রায়

২০১৯ সালের নভেম্বর মাসের ৯ তারিখে ভারতের ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ-রাম মন্দির বিরোধ মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। উত্তর প্রদেশের অযোধ্যার বিতর্কিত ২ দশমিক ৭৭ একর জমিতে রাম মন্দির নির্মাণের অনুমতি এবং মসজিদ নির্মাণের জন্য অন্য কোনো স্থানে ৫ একর জমি দিতে বলা হয়। রায়কে স্বাগত জানায় ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার এবং বিরোধী দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। অন্যদিকে রায়ে অসুন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে ভারতের সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড এবং অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ‘ল’ বোর্ড। এ রায়ের মধ্য দিয়ে পাঁচ শ’ পুরোনো ঐতিহাসিক স্থাপনাটি নিয়ে চলমান বিরোধের মিমাংসা হয়।

৯ নভেম্বর দেশটির সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ ভারতের বহুল আলোচিত এ মামলার রায় পড়েন। রায়ে বলা হয়, মসজিদটি ফাঁকা যায়গায় নির্মাণ করা হয়নি। এর নিচে অন্য কাঠামো ছিল। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার খননের ফলে যেসব জিনিস পাওয়া গেছে তা ইসলামী নয়। অযোধ্যার বিকল্প স্থানে মসজিদ নির্মাণের জন্য ৫ একর জমি সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। মন্দিরের জন্য সরকারকে ট্রাস্ট গঠনের কথা বলা হয়।

পাশাপাশি বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার মধ্য দিয়ে আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে বলেও রায়ে উল্লেখ করা হয় ।১৯৯২ সালে গুঁড়িয়ে দেয় দেশটির উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা। এতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় তিন হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়।

সিএএ ও এনআরসি ইস্যুতে উত্তাল ভারত

বছরের শেষ দিকে এসে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ও জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) নিয়ে পুরো ভারতজুড়ে বিক্ষোভের আগুন জ্ব¡লছে। বহুত্ববাদী গণতন্ত্রের দেশটিতে ধর্মীয় বৈষম্যপূর্ণ আইন সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট-এর বিরুদ্ধে সব ধর্মের নাগরিক একত্রিত হয়ে আন্দোলন করছেন। এক সপ্তাতেই ঝরেছে কমপক্ষে ২৩ প্রাণ। এ দুই ইস্যুতে উত্তর ও উত্তরপূর্ব ভারতে চলতি বছর বড় বড় আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়েছে। জাতীয় নাগরিকপঞ্জি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে পুরো দেশ যখন বিক্ষোভে উত্তাল, তখন নতুন করে জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জি (ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টারে) ছাড়পত্র দিল সরকার। এজন্য বিপুল অঙ্কের অর্থ বরাদ্দে অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে ইতোমধ্যেই নাগরিকপঞ্জিকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর সব রাজ্যে এনআরসি করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে বিজেপি সরকার। পাস হয়েছে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। এ দুইয়ের জেরেই কার্যত আগুন জ্বলছে দেশটিতে। বিভিন্ন রাজ্যে বিক্ষোভ প্রতিবাদ চললেও সহিংস বিক্ষোভের জেরে উত্তরপ্রদেশে মৃত্যু হয়েছে ১৭ জনের। সাম্প্রতিক বিক্ষোভ, আন্দোলনের জেরে আগেই এনপিআর তৈরির কাজ বন্ধ করে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, কেরেলার রাজ্য সরকার।

হংকং উত্তেজনা

২০১৯ সালের জুনে বিতর্কিত প্রত্যর্পণ বিলকে কেন্দ্র করে অশান্ত হয়ে ওঠে চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হংকং। এ বিল বাতিলের দাবিতে গণতন্ত্রপন্থিদের আন্দোলনে মাসজুড়েই উত্তাল থাকে অঞ্চলটি। বিতর্কিত ওই বিলে বিচারের জন্য হংকংয়ের বাসিন্দাদের তাইওয়ান, ম্যাকাউ ও চীনের মূল ভূখণ্ডে পাঠানোর সুযোগ রাখা হয়েছিল। আন্দোলনকারীদের দাবি, এ বিলটি আইনে পরিণত হলে তা গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলনকারীদের দমনে বেইজিংয়ের হাতিয়ারে পরিণত হবে। বিলটির প্রতিবাদে ৯ জুন ১০ লাখেরও বেশি মানুষ হংকংয়ের রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করে। ১৯৯৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে হংকং চীনের হাতে আসার পর সেখানে এত বড় বিক্ষোভ আর দেখা যায়নি। টানা বিক্ষোভের ধারাবাহিকতায় ১৫ জুন হংকং সরকার বিলটি প্রথমে মৃত ঘোষণা এবং পরে তা প্রত্যাহার করলেও বিক্ষোভকারীদের দমানো যায়নি। তারা প্রধান নির্বাহী ক্যারি লামের পদত্যাগ এবং আরো আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ের দাবিতে বিক্ষোভ চালিয়ে গেছে। সেপ্টেম্বরের শুরুতে লাম বিতর্কিত ওই বন্দি প্রত্যর্পণ বিলটি আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে নেন এবং চীনের এ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসমতা নিয়ে তদন্তে স্বতন্ত্র গবেষণার ঘোষণা দেন। অক্টোবরের প্রথম দিনে বিক্ষোভকারীদের একজন বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন।

বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন

বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের হত্যার হার তুলনামূলক কমলেও বেড়েছে গ্রেফতার, হয়রানির পরিমাণ। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের প্রকাশ করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে এ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে কাজ করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন ৪৯ সাংবাদিক। গত ১৬ বছরে এই সংখ্যা সর্বনিম্ন। সংবাদকর্মীদের নিয়ে কাজ করা প্যারিসভিত্তিক এ সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, গত দুই দশকে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৮০ জন সাংবাদিক পেশাগত কাজে নিহত হয়েছেন। ২০১৮ সালেও বিশ্বজুড়ে ৮৭ সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছিলেন। ২০১৯ সালে এসে এই সংখ্যা ৪৪ শতাংশ কমেছে। নিহত সাংবাদিকদের মধ্যে ৪৬ জন পুরুষ ও ৩ জন নারী। এ বছর মেক্সিকো, সিরিয়া, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে সবচেয়ে বেশি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। সংস্থাটি এই দেশগুলোকেই সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বর্তমানে সবচেয়ে আশঙ্কাজনক জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সংস্থাটি বলছে, মৃত্যুর হার কমলেও দেশে দেশে সাংবাদিকদের ওপর অত্যাচার কমেনি। গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর সবচেয়ে বেশি সাংবাদিককে বিভিন্ন কারণে আটক করা হয়েছে। এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই সংখ্যা ৩৮৯। এক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে চীন। দেশটিতে এখন পর্যন্ত আটক সাংবাদিকের সংখ্যা ১২০।

বুধবার, ০১ জানুয়ারী ২০২০ , ১৮ পৌষ ১৪২৬, ৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

এক নজরে ২০১৯

সংবাদ ডেস্ক |

http://print.thesangbad.net/images/2019/December/31Dec19/news/International%20%281%29.jpg

২০১৯ সাল পুরোটা জুড়েই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সৃষ্ট নানা অস্থিরতা। ধর্মীয় ও জাতিবিদ্বেষ, অভিবাসীদের প্রতি ঘৃণা আর ক্ষমতাকেন্দ্রিক বিভাজনের জেরে বিশ্বজুড়ে বিক্ষোভ-সহিংসতা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। অর্থনীতিতে সংরক্ষণবাদের প্রসারে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বাণিজ্য যুদ্ধ সারা বছরজুড়ে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়। ব্রেক্সিট নিয়ে বছরজুড়েই অস্থির ছিল যুক্তরাজ্যের রাজনীতি। বছরের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের। অভিশংসিত হওয়া মনযোগ কেড়েছে বিশ্ববাসীর। ইউরোপ, এশিয়া, লাতিন আমেরিকায় এ বছর দেখা গেছে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ডানপন্থার উত্থানে পুরো পশ্চিমা বিশ্বের উদার গণতন্ত্র এখন হুমকির মুখে। এরইমধ্যে কোরিয় উপদ্বীপে উত্তেজনা ও মধ্যপ্রাচ্যেও রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি থামেনি অস্ত্রের ঝনঝনানি। এদিকে বছরের মাঝামাঝি ভারতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে জয় পেয়ে আবারও ক্ষমতায় আসা বিজেপি সরকার আসামে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি ও দেশজুড়ে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিয়ে বেকায়দায় পড়েছে। অপর দিকে বিজ্ঞানীদের সতর্কতা অনুযায়ী, আশঙ্কাজন গলছে আইসল্যান্ডের হীমবাহ। জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও কার্বন নিঃসরণ নিয়ে চলতি বছর বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তাকে গুরুত্ব দিয়ে তরুণদের পরিবেশবাদী ও জলবায়ু আন্দোলনকর্মীদেরও লড়াই নতুন আশার পথ দেখিয়েছে।

জলবায়ু আন্দোলনের নেতা গ্রেটা থুনবার্গ

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ্বজুড়ে জলবায়ু আন্দোলনকে যিনি একাই বারুদের আকারে ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি সুইডেনের স্কুল শিক্ষার্থী গ্রেটা থুনব্যার্গ। গত বছরও বিশ্ববাসীর কাছে প্রায় অপরিচিত থাকা এ পরিবেশ আন্দোলনকর্মী জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিতে ইউরোপ থেকে নিউইয়র্কে পালতোলা নৌকায় যাত্রা করেন। সেখানে পৌঁছে বিশ্বজুড়ে লাখো বিক্ষোভকারীর পক্ষে বিশ্বনেতাদের প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘কী সাহস আপনাদের!’ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে বিশ্ববাসীকে মনোযোগী করে তোলায় ১৬ বছর বয়সী এই স্কুল শিক্ষার্থী জলবায়ু আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন।

২০১৮ সালের আগস্টের প্রতি শুক্রবার সুইডিশ পার্লামেন্টের সামনে একটি প্লাকার্ড নিয়ে অবস্থান নিয়ে জলবায়ু আন্দোলন শুরু করেন। ওই প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল ‘জলবায়ুর জন্য স্কুলে ধর্মঘট’। তার ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’ অহিংস কর্মসূচির ডাকে সাড়া দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন শহরের শিক্ষার্থীসহ কয়েক লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে এসে আন্দোলন-বিক্ষোভ -ধর্মঘট করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়ে প্রথম ধর্মঘটটি নিউ ক্যালেডোনিয়ার ফ্রেঞ্চ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শুরু হয়। সমুদ্রের স্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপাকে পড়েছে দ্বীপ দেশগুলো। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে শত শত দ্বীপ নিয়ে গঠিত সলোমন দ্বীপপুঞ্জের শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে না গিয়ে জলবায়ু বিপর্যয় কীভাবে তাদের দেশকে হুমকির মুখে ফেলেছে তা তুলে ধরেন। অস্ট্রেলিয়ায় বিক্ষোভকারীদের দাবি ছিল, তারা চান সরকার ও ব্যবসায়ীরা যেন ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায়া নামিয়ে আনার ঘোষণা দেন। তারা বিশ্ব নেতাদের জাতিসংঘের ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিটে এনিয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার আহ্বানও জানান। থাইল্যান্ডের শিক্ষার্থীরা ব্যাংককের প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বাইরে এই আন্দোলনে অংশ নেন। পরিবেশ আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রাখায় আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন বিশ্বজুড়ে সাড়াজাগানো এ তরুণ জলবায়ুকর্মী। পাশাপাশি ২০১৯ সালের নোবেল পুরস্কারের জন্যও মনোনয়নও পেয়েছেন তিনি।

ব্রেক্সিট ইস্যুতে জনসনের বাজিমাত

ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে যুক্তরাজ্যের আনুষ্ঠানিকভাবে বেরিয়ে যাবার প্রক্রিয়া ব্রেক্সিট প্রশ্নে গত তিন বছর থেকে ব্রিটিশ রাজনীতি যেন থমকে আছে। ২০১৬ সালে ২৩ জুন এক ঐতিহাসিক গণভোটে ব্রেক্সিটের পক্ষে ব্রিটিশরা রায় দেয়ার পর থেকে গত বছরজুড়ে এ রাজনৈতিক অচলাবস্থা টানাপোড়েনে রূপ নেয়। তবে বছরের প্রথম ভাগে প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে পার্লামেন্টে তিনবার চেষ্টা করেও নিজের খসড়া ব্রেক্সিট চুক্তির প্রতি সাংসদদের সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হন। ৭ জুনে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ছাড়লে নতুন নেতা নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২৪ জুলাই দেশটির ৭৭তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশটির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও লন্ডনের মেয়র বরিস জনসন ডাউনিং স্ট্রিটে মে’র স্থলাভিষিক্ত হন।

এদিকে ব্রেক্সিট নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সুবিধা করতে না পেরে সেপ্টেম্বরে অধিবেশন মুলতবি করার ব্যবস্থা নেন নতুন প্রধানমন্ত্রী জনসন। দেশটির বিরোধী দলের নেতারা এ নিয়ে আদালতে গেলে সুপ্রিমকোর্ট সরকারের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে নতুন করে অধিবেশন শুরুর নির্দেশ দেন। দ্রুত ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন করতে চাওয়ায় পার্লামেন্টের চাপে পড়ে মেয়াদ বাড়াতে ইউরোপের কাছে চিঠিও লিখতে হয় এ টোরি নেতাকে। এরই ধারবাহিকতায় অক্টোবরে লন্ডনে পিপলস ভোট নামের একটি সংগঠনের উদ্যোগে ব্রেক্সিট নিয়ে দ্বিতীয় গণভোট চেয়ে বিরাট বিক্ষোভ হয় রাজধানী লন্ডনে। অবস্থা বেগতিক দেখে ওই মাসের শুরুতেই আগাম নির্বাচনের ডাক দেন জনসন। ব্রেক্সিট কার্যকরে জনগণের শক্তিশালী ম্যান্ডেট চেয়ে নির্বাচনে বাজিমাত করে কনজারভেটিভ পার্টিকে এনে দেন তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ফল। অন্যদিকে, কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফল করে দলের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দেন বিরোধীদল লেবার নেতা জেরেমি করবিন।

ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে টোরি সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্লামেন্ট ৩১ জানুয়ারির মধ্যে ব্রেক্সিট কার্যকরের বিলে অনুমোদন দেয়। এর মধ্য দিয়ে ব্রেক্সিট সংকটের অবসান ঘটে।

অভিশংসনের মুখে ট্রাম্প

সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অন্যতম প্রধান ইস্যু হলো বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাবান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ইমপিচ (অভিশংসন)। ৪৫তম এ মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই অনাস্থা জানিয়ে তাকে অভিশংসিত করার পক্ষে মত দিয়েছে বিরোধী ডেমোক্র্যাট নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভস (প্রতিনিধি পরিষদ)। দেশটির সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও তার ছেলে হান্টার বাইডেনের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে ইউক্রেনকে আহ্বান জানানোর অভিযোগে তার বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু করে বিরোধীরা।

দেশটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইয়ের গোপন নথিফাঁসকারী এক সদস্যের ফাঁস করা এক নথী অনুযায়ী, চলতি বছরের ২৫ জুলাই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলোনস্কির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন ট্রাম্প। ওই সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট আগামী ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ও ডেমোক্র্যাট নেতা জো বাইডেনের ও তার ছেলে হান্টার বাইডেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি সংক্রান্ত তদন্ত পরিচালনার জন্য অনুরোধ করেন। ওই সময় ট্রাম্প ইউক্রেনের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন যেন তারা বাইডেন পরিবারের ‘দুর্নীতি’ নিয়ে তদন্ত করে।

এ অনৈতিক চাপের অভিযোগে চলতি বছরের ৩১ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসন তদন্তের জন্য আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাস করে প্রতিনিধি পরিষদ। এরই ধারাবহিকতায় ১৩ নভেম্বর ক্যাপিটল হিলে প্রকাশ্যে অভিশংসন শুনানী শুরু হয়। দীর্ঘ শুনানী শেষে ১০ ডিসেম্বর প্রতিনিধি পরিষদে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ক্ষমতা থেকে অপসারনের জন্য আনুষ্ঠানিক অভিশংসন প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। এতে প্রেসিডেন্টর বিরুদ্ধে দুটি শক্ত অভিযোগ তুলে ধরা হয়। একটি, ক্ষমতার অপব্যবহার। অপরটি কংগ্রেসের কাজে বাধা দেয়া। অভিশংসন প্রস্তাবটি ডেমোক্র্যাট নিয়ন্ত্রিত নিন্মকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে পাস হওয়ার পর উচ্চকক্ষ সিনেটে গেছে। ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রীত সিনেটে শুনানী ২০২০ সালের জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে শুরু হওয়ার কথা।

জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্য মর্যাদা বাতিল

চলতি বছরের ৫ আগস্ট ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা তুলে নেয় দেশটির কক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকার। কেন্দ্রীয় সরকারের স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দেশটির সংসদের নিন্মকক্ষ রাজ্যসভায় এ সংক্রান্ত রাষ্ট্রপতির নির্দেশনা পড়ে শোনান। এতে প্রায় ৭০ বছর আগে ভারতীয় সংবিধানে কাশ্মীরকে দেয়া বিশেষ মর্যাদা ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের নির্দেশনা দেয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে অবধারিতভাবে বিলুপ্তি ঘটে সংবিধানের ৩৫(ক) ধারার। জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করে পৃথক রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নেয়া হয়। এ লক্ষ্যে ৫ আগস্ট ২০১৯ ভারতীয় সংসদেও নিন্মকক্ষ লোকসভা ও পরদিন ৬ আগস্ট উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় পাস করা হয় জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য পুনর্গঠন আইন ২০১৯। রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ ৯ আগস্ট ২০১৯ এ আইনে সই করেন। এরই ধারবাহিকতায় ৩১ অক্টোবর ২০১৯ থেকে নতুন এ আইন কার্যকর হয়।

নতুন এ আইন অনুযায়ী, জম্মু ও কাশ্মির থেকে কারগিল ও লাদাখকে আলাদা করে তৈরি করা হয় ‘লাদাখ’ নামের নতুন এক কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল (টহরড়হ ঞবৎৎরঃড়ৎু), যেখানে কোন বিধানসভা থাকবে না। অন্যদিকে জম্মু ও কাশ্মীর উপত্যকার বাকি অংশ গণ্য হবে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে। তবে এখানে বিধানসভা থাকবে। এ দুই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলই পারচালনা করবেন দুইজন লেফটেন্যান্ট গর্ভনর। ৩১ অক্টোবর ২০১৯ ভারত নিয়ন্ত্রিত ‘জম্মু ও কাশ্মীর’ আনুষ্ঠানিকভাবে দুই ভাগে ভাগ হয়।

দাবানলে পুড়ল পৃথিবীর ফুসফুস আমাজন

ভৌগোলিকভাবে বিশ্বের বৃহত্তম অরণ্য আমাজনের বনাঞ্চল। পৃথিবীর ২০ শতাংশ অক্সিজেন সরবরাহ করে এ বন। তাই দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা এই গভীর রেইন ফরেস্টকে পৃথিবীর ফুসফুসও বলা হয়। কিন্তু ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে নিঃশব্দে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে এই ফুসফুস।

ব্রাজিলে আমাজনের উষ্ণমণ্ডলীয় বনাঞ্চলে ২০১৯ সালে ব্রাজিলিয়ান স্পেস এজেন্সির তথ্য অনুযায়ী রেকর্ডসংখ্যক দাবানলের ঘটনা ঘটেছে। দ্য ন্যাশানাল ইন্সটিটিউট ফর স্পেস রিসার্চ (আইএনপিই) বলছে তাদের উপগ্রহ থেকে সংগৃহীত তথ্যে দেখা যাচ্ছে ২০১৮-র একই সময়ের তুলনায় ২০১৯ সালে আগুন লাগার ঘটনা ৮৫ শতাংশ বেড়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনে নাকাল বিশ্ব

২০১৯ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্ববাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে। এর জেওে পৃথিবীর একপ্রান্তে খরা, দাবদাহ, দাবানালের ছোবল তো আপরপ্রান্তে কাঁপিয়ে দিয়েছে ভয়াবহ তুষারঝড় ও শীত। এছাড়াও বন্যায় পানি ও সমুদ্রপিষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জেরে পানির নিচে তলিয়ে গেছে বহু এলাকা। এদিকে দিন যত গড়াচ্ছে, বিশ্বজুড়ে বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমাণও। গত মার্চে উত্তর আমেরিকার দেশগুলোকে কাঁপিয়ে দিয়েছে ভয়াবহ তুষারঝড়। এতে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। একই মাসে মোজাম্বিকে আছড়ে পড়া ঘূর্ণিঝড় কেড়ে নেয় হাজারেরও বেশি মানুষের জীবন। জুনে ইন্দোনেশিয়ার মাউন্ট সিনাবাংয়ে বিকট বিস্ফোরণ ও উদগিরণে ছাইয়ের কলাম ৭ হাজার মিটার ছোঁয়। অগাস্টে চীনের ঝেঝিয়াংয়ে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় লেকিমায় ৩২ জন প্রাণ হারান। একই মাসের ১০ তারিখ থেকে শুরু হওয়া ক্যানারি আইল্যান্ডের দাবানল দ্বীপটির বনাঞ্চলের বেশিরভাগ অংশকেই নিঃশেষ করে ফেলে। একই সময়ে ভারতের কেরালা, কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রে ভয়াবহ বন্যায় প্রায় দেড়শ’ জনের মৃত্যু হয়। অস্ট্রেলিয়ায় ভয়াবহ দাবানলেও এবছর পুরো একটি শহর পুড়ে ছাই হওয়াসহ ৯ জনের মৃত্যু হয়। বড় ধরনের দাবানলের কবলে পড়ে চিলির একটি শহরও। সেপ্টেম্বরের শুরুর দিনই ঘণ্টায় ১৮৫ মাইল গতির বাতাস নিয়ে বাহামা দ্বীপপুঞ্জে আঘাত হানে সামুদ্রিক ঝড় ডোরিয়ান। দেশটির ইতিহাসে আঘাত হানা সবচেয়ে শক্তিশালী এ ঝড় ৫২ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়।অক্টোবরের মাঝামাঝি জাপানে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় হাগিবিস। ওই মাসের শেষদিকে কয়েক দফা ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে ফিলিপাইন। নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলে ভারত ও বাংলাদেশের বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর খবর মেলে। ভেনিসে রেকর্ড বন্যায় জরুরি অবস্থা জারি করে ইতালি। মাসের শেষ সপ্তাহে আলবেনিয়ায় ভূমিকম্প ৫১ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়। ডিসেম্বরে বুরুন্ডিতে ভূমিধসে নিহত হন ২৬ জন।

খাশোগি হত্যাকাণ্ড

২০১৯ সালে অন্যতম আলোচিত বিষয় ছিল সৌদ সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ড। এ হত্যাকাণ্ডে সৌদি প্রভাবশালী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। তবে আন্তজাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর দাবি, এ হামলার নির্দেশদাতা যুবরাজ সালমানই। গত ডিসেম্বরে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকায় ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড দিলেও বিন সালমানের ঘনিষ্ঠ দুইজনকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। এ রায়কে ঘিরে নতুন করে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে রিয়াদ কর্র্তৃপক্ষ। ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে দ্বিতীয় বিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছায় নির্বাসিত ও ওয়াশিংটন পোস্টের কলাম লেখক খাশোগি।

নটরডাম ক্যাথিড্রালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড

গত বছরের ১৫ এপ্রিল প্যারিসের নটরডাম ক্যাথিড্রালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ৮৫০ বছরের পুরনো গির্জাটিতে এমন আগুন লাগা বিশ্ববাসীকে চরমভাবে হতাশ করেছে। ওই অগ্নিকাণ্ডে ক্যাথিড্রালটির মূল কাঠামো ও বাইরের অংশ প্রায় অক্ষত থাকলেও সব মিলিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ছাদের অংশটুকু প্রায় পুরোটাই ধ্বংস হয়ে যায়। বেশ কিছু ঐতিহাসিক সামগ্রী ও তৈলচিত্র নষ্ট হয়ে যায়। গির্জার প্রধান অরগ্যানেরও বেশ ক্ষতি হয়। ক্যাথিড্রালটি পুননির্মাণ করতে কয়েক বছর সময় লাগবে।

ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ রাম মন্দির মামলার রায়

২০১৯ সালের নভেম্বর মাসের ৯ তারিখে ভারতের ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ-রাম মন্দির বিরোধ মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। উত্তর প্রদেশের অযোধ্যার বিতর্কিত ২ দশমিক ৭৭ একর জমিতে রাম মন্দির নির্মাণের অনুমতি এবং মসজিদ নির্মাণের জন্য অন্য কোনো স্থানে ৫ একর জমি দিতে বলা হয়। রায়কে স্বাগত জানায় ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার এবং বিরোধী দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। অন্যদিকে রায়ে অসুন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে ভারতের সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড এবং অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ‘ল’ বোর্ড। এ রায়ের মধ্য দিয়ে পাঁচ শ’ পুরোনো ঐতিহাসিক স্থাপনাটি নিয়ে চলমান বিরোধের মিমাংসা হয়।

৯ নভেম্বর দেশটির সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ ভারতের বহুল আলোচিত এ মামলার রায় পড়েন। রায়ে বলা হয়, মসজিদটি ফাঁকা যায়গায় নির্মাণ করা হয়নি। এর নিচে অন্য কাঠামো ছিল। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার খননের ফলে যেসব জিনিস পাওয়া গেছে তা ইসলামী নয়। অযোধ্যার বিকল্প স্থানে মসজিদ নির্মাণের জন্য ৫ একর জমি সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। মন্দিরের জন্য সরকারকে ট্রাস্ট গঠনের কথা বলা হয়।

পাশাপাশি বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার মধ্য দিয়ে আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে বলেও রায়ে উল্লেখ করা হয় ।১৯৯২ সালে গুঁড়িয়ে দেয় দেশটির উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা। এতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় তিন হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়।

সিএএ ও এনআরসি ইস্যুতে উত্তাল ভারত

বছরের শেষ দিকে এসে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ও জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) নিয়ে পুরো ভারতজুড়ে বিক্ষোভের আগুন জ্ব¡লছে। বহুত্ববাদী গণতন্ত্রের দেশটিতে ধর্মীয় বৈষম্যপূর্ণ আইন সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট-এর বিরুদ্ধে সব ধর্মের নাগরিক একত্রিত হয়ে আন্দোলন করছেন। এক সপ্তাতেই ঝরেছে কমপক্ষে ২৩ প্রাণ। এ দুই ইস্যুতে উত্তর ও উত্তরপূর্ব ভারতে চলতি বছর বড় বড় আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়েছে। জাতীয় নাগরিকপঞ্জি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে পুরো দেশ যখন বিক্ষোভে উত্তাল, তখন নতুন করে জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জি (ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টারে) ছাড়পত্র দিল সরকার। এজন্য বিপুল অঙ্কের অর্থ বরাদ্দে অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে ইতোমধ্যেই নাগরিকপঞ্জিকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর সব রাজ্যে এনআরসি করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে বিজেপি সরকার। পাস হয়েছে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। এ দুইয়ের জেরেই কার্যত আগুন জ্বলছে দেশটিতে। বিভিন্ন রাজ্যে বিক্ষোভ প্রতিবাদ চললেও সহিংস বিক্ষোভের জেরে উত্তরপ্রদেশে মৃত্যু হয়েছে ১৭ জনের। সাম্প্রতিক বিক্ষোভ, আন্দোলনের জেরে আগেই এনপিআর তৈরির কাজ বন্ধ করে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, কেরেলার রাজ্য সরকার।

হংকং উত্তেজনা

২০১৯ সালের জুনে বিতর্কিত প্রত্যর্পণ বিলকে কেন্দ্র করে অশান্ত হয়ে ওঠে চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হংকং। এ বিল বাতিলের দাবিতে গণতন্ত্রপন্থিদের আন্দোলনে মাসজুড়েই উত্তাল থাকে অঞ্চলটি। বিতর্কিত ওই বিলে বিচারের জন্য হংকংয়ের বাসিন্দাদের তাইওয়ান, ম্যাকাউ ও চীনের মূল ভূখণ্ডে পাঠানোর সুযোগ রাখা হয়েছিল। আন্দোলনকারীদের দাবি, এ বিলটি আইনে পরিণত হলে তা গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলনকারীদের দমনে বেইজিংয়ের হাতিয়ারে পরিণত হবে। বিলটির প্রতিবাদে ৯ জুন ১০ লাখেরও বেশি মানুষ হংকংয়ের রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করে। ১৯৯৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে হংকং চীনের হাতে আসার পর সেখানে এত বড় বিক্ষোভ আর দেখা যায়নি। টানা বিক্ষোভের ধারাবাহিকতায় ১৫ জুন হংকং সরকার বিলটি প্রথমে মৃত ঘোষণা এবং পরে তা প্রত্যাহার করলেও বিক্ষোভকারীদের দমানো যায়নি। তারা প্রধান নির্বাহী ক্যারি লামের পদত্যাগ এবং আরো আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ের দাবিতে বিক্ষোভ চালিয়ে গেছে। সেপ্টেম্বরের শুরুতে লাম বিতর্কিত ওই বন্দি প্রত্যর্পণ বিলটি আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে নেন এবং চীনের এ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসমতা নিয়ে তদন্তে স্বতন্ত্র গবেষণার ঘোষণা দেন। অক্টোবরের প্রথম দিনে বিক্ষোভকারীদের একজন বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন।

বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন

বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের হত্যার হার তুলনামূলক কমলেও বেড়েছে গ্রেফতার, হয়রানির পরিমাণ। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের প্রকাশ করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে এ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে কাজ করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন ৪৯ সাংবাদিক। গত ১৬ বছরে এই সংখ্যা সর্বনিম্ন। সংবাদকর্মীদের নিয়ে কাজ করা প্যারিসভিত্তিক এ সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, গত দুই দশকে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৮০ জন সাংবাদিক পেশাগত কাজে নিহত হয়েছেন। ২০১৮ সালেও বিশ্বজুড়ে ৮৭ সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছিলেন। ২০১৯ সালে এসে এই সংখ্যা ৪৪ শতাংশ কমেছে। নিহত সাংবাদিকদের মধ্যে ৪৬ জন পুরুষ ও ৩ জন নারী। এ বছর মেক্সিকো, সিরিয়া, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে সবচেয়ে বেশি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। সংস্থাটি এই দেশগুলোকেই সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বর্তমানে সবচেয়ে আশঙ্কাজনক জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সংস্থাটি বলছে, মৃত্যুর হার কমলেও দেশে দেশে সাংবাদিকদের ওপর অত্যাচার কমেনি। গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর সবচেয়ে বেশি সাংবাদিককে বিভিন্ন কারণে আটক করা হয়েছে। এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই সংখ্যা ৩৮৯। এক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে চীন। দেশটিতে এখন পর্যন্ত আটক সাংবাদিকের সংখ্যা ১২০।