অর্থনীতি : আলোচনায় ছিল সুদহারে ৯-৬

বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণে রেকর্ড পতন খেলাপি ঋণ বেড়েছে

বছরজুড়েই টালমাটাল ছিল মুদ্রা বাজারের চালিকাশক্তি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধা নিয়েও সেই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সেসব সুবিধার বিপরীতে দেয়া প্রতিশ্রুতিও রাখতে পারেনি ব্যাংক মালিকরা। ঋণের সুদহার সিংগেল ডিজিটে নামানোর প্রতিশ্রুথি বাস্তবায়ন করতে পারেনি এক বছরেও। বিপরীতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে আরও। সেই খেলাপি ঋণের ফাঁদে পড়ে নিজেরা তারল্য সংকটে ভুগেছে। সঙ্গে ভুগিয়েছে উদ্যোক্তাদেরও। গত বছর বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ কমেছে রেকর্ড পরিমাণ। তিন-চার বছরের মধ্যে সর্বনি¤েœ নেমেছে ঋণ বিতরণ প্রবৃদ্ধি। ব্যাংক খাতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রভাব ছিল উল্লেখযোগ্য। এ সময় ডলার সংকটে দাম বেড়েছে কয়েক দফা। তারল্য আর ব্যবসায়িক সংকটে পড়ে পিপলস লিজিংয়ের নামের একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এরমধ্যে নতুন ব্যাংক এসেছে। আর ব্যাংক খাতের সুখকর বিষয় ছিল রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি। এক্ষেত্রে হুন্ডিতে কঠোরতা আর ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনা বিশেষ কাজ করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত বছরের ব্যাংক খাত নিয়ে বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মূল্যায়ন হলো- চলতি বছরে কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে যা ঋণখেলাপি হওয়াকে উসকে দিয়েছে। ব্যক্তিখাতে ঋণ প্রবাহ ১০ শতাংশের কাছাকাছি চলে এসেছে, এ ধরনের কম প্রবৃদ্ধি ইদানিং হয়নি। এর পেছনের মূল কারণ ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা। বিশেষ করে ঋণ দিলে আর ঋণ ফেরত পাওয়া যায় না। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফাকে মুজেরি মনে করেন, ব্যাংক খাতে শক্ত ভিত্তি নেই। ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।

রেকর্ড খেলাপি ঋণ : ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে তা আর না দেয়ার প্রবণতা বেড়েছে। অর্থাৎ ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে সঠিক মানুষ এবং প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে নানা দুর্বলতায় বাড়ছে খেলাপির হার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত নয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মোট ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৯ লাখ ৬৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে অবলোপন বাদে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় এক লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ।

ঋণখেলাপিদের ‘অভিনব’ সুবিধা : এই বছরেই ঋণখেলাপিদের অভিনব সুবিধা দেয় সরকার। গত ১৬ মে ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন ঋণ শোধসংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে খেলাপি ঋণের মাত্র ২ শতাংশ জমা দিয়ে ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিলের সুবিধা দেয়া হয়। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুদহার ঠিক করে দেয়া হয় ৯ শতাংশ। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এমন আহ্বানে ছোট ছোট ঋণখেলাপিই বেশি আবেদন করে। নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বড় বড় খেলাপিদের তেমন সাড়া মেলে না। বড় বড় খেলাপিদের আনতে এ পর্যন্ত সরকার চারবার সময় বাড়িয়েছে। প্রথমে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করতে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। খেলাপিদের দাবির মুখে সময় বাড়িয়ে দেয়া হয় সেপ্টেম্বর মাসের ৭ তারিখ পর্যন্ত। পরে আবারও সময় দেয়া হয় ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। তারপর এক মাস সময় বাড়িয়ে ২০ অক্টোবর করা হয়। আবেদনের সবশেষ ৯০ দিন সময় বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

‘নয়-ছয়’ নীতিতে হোঁচট : দীর্ঘদিন খেলাপি হয়ে থাকা ঋণের অর্থ তুলতে এই বছরই কৌশল হাতে নেয় সরকার। কথা ছিল ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যাংক সুদের হারে ‘নয়-ছয়’ নীতি কার্যকর হবে। অর্থাৎ ছয় শতাংশে ব্যাংক আমানত নেবে এবং নয় শতাংশে ঋণ দেবে। যাতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে ব্যবসা করতে পারে। সরকারের শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এ নীতি কার্যকর হয়নি।

সুবিধা দিয়েও মেলেনি সুফল : সহনীয় সুদহার কার্যকরে সরকারের কাছ থেকে কমপক্ষে চারটি সুবিধা আদায় করে নিয়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে রয়েছে নগদ জমা সংরক্ষণ (সিআরআর) কমানো, রেপো রেট হ্রাস ও মেয়াদ বৃদ্ধি, সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা এবং মুনাফার ওপর কর কমানো। এরমধ্যে কমপক্ষে দুটো সুষম অর্থনীতি গঠন ও সম্পদ মালিকানায় একচেটিয়াবাদ পরিহারে বড় বাধা হিসেবে বিবেচিত। আর পুরোটাই বাজার অর্থনীতির পরিপন্থী পদক্ষেপ। এত সুবিধা নিয়ে এক বছর পার হলেও নয়-ছয় নীতি কার্যকর করা হয়নি।

উৎপাদনমুখী খাতে এক অঙ্ক সুদহার : নয়-ছয় বাস্তবায়নে বাধার মুখে শুধু মাত্র উৎপাদনমুখী শিল্পে এক অঙ্কের সুদহার কার্যকরে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এসএম মনিরুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করে সরকার। সেই কমিটি সুদহার কমিয়ে আনার কৌশল সম্বলিত সুপারিশ অর্থমন্ত্রীর কাছে দেয়। সুপারিশের আলোকে ২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ড মিটিংয়ে শুধুমাত্র উৎপাদনশীল খাতে এক অঙ্কের সুদহার কার্যকরের সিদ্ধান্ত হয়। এ ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি করবে নিয়ন্ত্রক এই সংস্থা।

কমেছে বেসরকারি ঋণ : ধারাবাহিক কমেছে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি। চলতি অর্থবছরের অক্টোবরে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ১০ দশমিক ০৪ শতাংশ। আগের মাস সেপ্টেম্বরে যা ছিল ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ। অর্থবছরের ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এর মধ্যে চলতি ডিসেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্য ঠিক করা হয় ১৩ দশমিক ২ শতাংশ। যা গত অর্থবছরের জুন পর্যন্ত ছিল ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণ কমে যাওয়ার কারণে থমকে যাচ্ছে উৎপাদন।

সরকারের ঋণে রেকর্ড : ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়া বাড়িয়েছে সরকার। এ বছরের বাজেটে ঋণ নেয়ার যে লক্ষ্য ধরা হয়, পাঁচ মাসেই পূরণ হয়েছে সেই লক্ষ্যমাত্রা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৭ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নয় ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ পাঁচ মাস নয় দিনে ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪৭ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের বেশি ঋণ নেয়ায় তারল্য সংকট হতে পারে।

নতুন তিন ব্যাংক : অসম প্রতিযোগিতার কারণে সংকটে ব্যাংক খাত। একীভূত করার পরামর্শ যখন আসছে, ঠিক তখন আরও তিনটি ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরে অনুমোদন দেয়া ব্যাংক তিনটি হচ্ছে, বেঙ্গল কমার্শিয়াল, পিপলস ও সিটিজেন। তবে প্রাথমিকভাবে আগ্রহপত্র বা লেটার অব ইনটেন্ট (এলওআই) পাওয়ার পরও শর্ত অনুযায়ী পর্যাপ্ত মূলধন সংগ্রহসহ বিভিন্ন নির্দেশনা পরিপালনে ব্যর্থ হওয়ায় এখনও চূড়ান্ত লাইসেন্স পায়নি এসব ব্যাংক। তবে চলতি বছর কার্যক্রম চালু করেছে গত বছর অনুমোদন পাওয়া পুলিশের মালিকানাধীন কমিউনিটি ব্যাংক।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও দুর্দশা : অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর লুটপাটের অভিযোগে আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসকে (পিএলএফএসএল) এবছরই অবসায়নের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। গেল ১৪ জুলাই পিপলস লিজিং অবসায়নের জন্য আদালতে মামলা দায়ের করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অনিয়মের মাধ্যমে ৫৭০ কোটি টাকা বের করে নেয়ার অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির নয় পরিচালককে বহিষ্কার করা হয়। পিপলস লিজিং বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়েন প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীরা। ডিসেম্বরের মধ্যে টাকা ফেরত পেতে অর্থমন্ত্রী ও গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করেন তারা। কিন্তু এখনও কোন সুরাহা হয়নি।

রেমিট্যান্সে প্রণোদনার সুফল : অর্থনীতির অন্যান্য সূচক নেতিবাচক হলেও সুবাতাস বয়েছে প্রবাসী আয়ে। রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা প্রদান এবং টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য বৃদ্ধিতে বৈধ পথে বেড়েছে রেমিট্যান্সের প্রবাহ। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রেমিট্যান্স এসেছে ৭৭১ কোটি ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২২ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। গত বছর একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ৬২৯ কোটি ডলার।

আরও খবর
লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংকে বর্ষপণ্য ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীর
ভারতে বাংলাদেশের বেতার প্রচার শুরু এ মাসেই তথ্যমন্ত্রী
কুমিল্লা : প্রত্যাশা প্রাপ্তি ও বেদনার আলোচিত ঘটনা
নোয়াবের নতুন কার্যনির্বাহী কমিটি সভাপতি : একে আজাদ
সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না প্রমাণ করতেই বিএনপি নির্বাচনে যায় ফখরুল
ছাত্র রাজনীতি ভয়াবহ পর্যায়ে চলে এসেছে আনিসুজ্জামান
শওকত ওসমানের জন্মদিন আজ
দুই নাটক মৌ বনে কাক ও রাজার নতুন জামা মঞ্চস্থ
বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসব কাল শুরু
পল্লীকবি জসীম উদদীনের জন্মবার্ষিকী উদযাপন
নতুন বছরে ৫-৬ লাখ মামলা কমানো হবে আইনমন্ত্রী
বিচারপ্রার্থীকে ধর্ষণ মামলায় ইউপি চেয়ারম্যান কারাগারে
দুদকের দুর্নীতি পেলেও প্রকাশ করবেন
বছরের প্রথম দিন ৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত
যন্ত্রপাতি ক্রয়ে অর্থ আত্মসাৎ, শিক্ষক ডা. চন্দন কারাগারে
নারায়ণগঞ্জে ছাত্রছাত্রীদের হাতে নতুন বই তুলে দিলেন মুক্তিযোদ্ধারা

বৃহস্পতিবার, ০২ জানুয়ারী ২০২০ , ১৯ পৌষ ১৪২৬, ৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

অর্থনীতি : আলোচনায় ছিল সুদহারে ৯-৬

বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণে রেকর্ড পতন খেলাপি ঋণ বেড়েছে

রোকন মাহমুদ |

বছরজুড়েই টালমাটাল ছিল মুদ্রা বাজারের চালিকাশক্তি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধা নিয়েও সেই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সেসব সুবিধার বিপরীতে দেয়া প্রতিশ্রুতিও রাখতে পারেনি ব্যাংক মালিকরা। ঋণের সুদহার সিংগেল ডিজিটে নামানোর প্রতিশ্রুথি বাস্তবায়ন করতে পারেনি এক বছরেও। বিপরীতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে আরও। সেই খেলাপি ঋণের ফাঁদে পড়ে নিজেরা তারল্য সংকটে ভুগেছে। সঙ্গে ভুগিয়েছে উদ্যোক্তাদেরও। গত বছর বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ কমেছে রেকর্ড পরিমাণ। তিন-চার বছরের মধ্যে সর্বনি¤েœ নেমেছে ঋণ বিতরণ প্রবৃদ্ধি। ব্যাংক খাতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রভাব ছিল উল্লেখযোগ্য। এ সময় ডলার সংকটে দাম বেড়েছে কয়েক দফা। তারল্য আর ব্যবসায়িক সংকটে পড়ে পিপলস লিজিংয়ের নামের একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এরমধ্যে নতুন ব্যাংক এসেছে। আর ব্যাংক খাতের সুখকর বিষয় ছিল রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি। এক্ষেত্রে হুন্ডিতে কঠোরতা আর ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনা বিশেষ কাজ করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত বছরের ব্যাংক খাত নিয়ে বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মূল্যায়ন হলো- চলতি বছরে কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে যা ঋণখেলাপি হওয়াকে উসকে দিয়েছে। ব্যক্তিখাতে ঋণ প্রবাহ ১০ শতাংশের কাছাকাছি চলে এসেছে, এ ধরনের কম প্রবৃদ্ধি ইদানিং হয়নি। এর পেছনের মূল কারণ ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা। বিশেষ করে ঋণ দিলে আর ঋণ ফেরত পাওয়া যায় না। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফাকে মুজেরি মনে করেন, ব্যাংক খাতে শক্ত ভিত্তি নেই। ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।

রেকর্ড খেলাপি ঋণ : ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে তা আর না দেয়ার প্রবণতা বেড়েছে। অর্থাৎ ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে সঠিক মানুষ এবং প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে নানা দুর্বলতায় বাড়ছে খেলাপির হার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত নয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মোট ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৯ লাখ ৬৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে অবলোপন বাদে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় এক লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ।

ঋণখেলাপিদের ‘অভিনব’ সুবিধা : এই বছরেই ঋণখেলাপিদের অভিনব সুবিধা দেয় সরকার। গত ১৬ মে ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন ঋণ শোধসংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে খেলাপি ঋণের মাত্র ২ শতাংশ জমা দিয়ে ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিলের সুবিধা দেয়া হয়। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুদহার ঠিক করে দেয়া হয় ৯ শতাংশ। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এমন আহ্বানে ছোট ছোট ঋণখেলাপিই বেশি আবেদন করে। নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বড় বড় খেলাপিদের তেমন সাড়া মেলে না। বড় বড় খেলাপিদের আনতে এ পর্যন্ত সরকার চারবার সময় বাড়িয়েছে। প্রথমে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করতে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। খেলাপিদের দাবির মুখে সময় বাড়িয়ে দেয়া হয় সেপ্টেম্বর মাসের ৭ তারিখ পর্যন্ত। পরে আবারও সময় দেয়া হয় ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। তারপর এক মাস সময় বাড়িয়ে ২০ অক্টোবর করা হয়। আবেদনের সবশেষ ৯০ দিন সময় বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

‘নয়-ছয়’ নীতিতে হোঁচট : দীর্ঘদিন খেলাপি হয়ে থাকা ঋণের অর্থ তুলতে এই বছরই কৌশল হাতে নেয় সরকার। কথা ছিল ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যাংক সুদের হারে ‘নয়-ছয়’ নীতি কার্যকর হবে। অর্থাৎ ছয় শতাংশে ব্যাংক আমানত নেবে এবং নয় শতাংশে ঋণ দেবে। যাতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে ব্যবসা করতে পারে। সরকারের শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এ নীতি কার্যকর হয়নি।

সুবিধা দিয়েও মেলেনি সুফল : সহনীয় সুদহার কার্যকরে সরকারের কাছ থেকে কমপক্ষে চারটি সুবিধা আদায় করে নিয়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে রয়েছে নগদ জমা সংরক্ষণ (সিআরআর) কমানো, রেপো রেট হ্রাস ও মেয়াদ বৃদ্ধি, সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা এবং মুনাফার ওপর কর কমানো। এরমধ্যে কমপক্ষে দুটো সুষম অর্থনীতি গঠন ও সম্পদ মালিকানায় একচেটিয়াবাদ পরিহারে বড় বাধা হিসেবে বিবেচিত। আর পুরোটাই বাজার অর্থনীতির পরিপন্থী পদক্ষেপ। এত সুবিধা নিয়ে এক বছর পার হলেও নয়-ছয় নীতি কার্যকর করা হয়নি।

উৎপাদনমুখী খাতে এক অঙ্ক সুদহার : নয়-ছয় বাস্তবায়নে বাধার মুখে শুধু মাত্র উৎপাদনমুখী শিল্পে এক অঙ্কের সুদহার কার্যকরে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এসএম মনিরুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করে সরকার। সেই কমিটি সুদহার কমিয়ে আনার কৌশল সম্বলিত সুপারিশ অর্থমন্ত্রীর কাছে দেয়। সুপারিশের আলোকে ২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ড মিটিংয়ে শুধুমাত্র উৎপাদনশীল খাতে এক অঙ্কের সুদহার কার্যকরের সিদ্ধান্ত হয়। এ ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি করবে নিয়ন্ত্রক এই সংস্থা।

কমেছে বেসরকারি ঋণ : ধারাবাহিক কমেছে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি। চলতি অর্থবছরের অক্টোবরে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ১০ দশমিক ০৪ শতাংশ। আগের মাস সেপ্টেম্বরে যা ছিল ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ। অর্থবছরের ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এর মধ্যে চলতি ডিসেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্য ঠিক করা হয় ১৩ দশমিক ২ শতাংশ। যা গত অর্থবছরের জুন পর্যন্ত ছিল ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণ কমে যাওয়ার কারণে থমকে যাচ্ছে উৎপাদন।

সরকারের ঋণে রেকর্ড : ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়া বাড়িয়েছে সরকার। এ বছরের বাজেটে ঋণ নেয়ার যে লক্ষ্য ধরা হয়, পাঁচ মাসেই পূরণ হয়েছে সেই লক্ষ্যমাত্রা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৭ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নয় ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ পাঁচ মাস নয় দিনে ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪৭ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের বেশি ঋণ নেয়ায় তারল্য সংকট হতে পারে।

নতুন তিন ব্যাংক : অসম প্রতিযোগিতার কারণে সংকটে ব্যাংক খাত। একীভূত করার পরামর্শ যখন আসছে, ঠিক তখন আরও তিনটি ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরে অনুমোদন দেয়া ব্যাংক তিনটি হচ্ছে, বেঙ্গল কমার্শিয়াল, পিপলস ও সিটিজেন। তবে প্রাথমিকভাবে আগ্রহপত্র বা লেটার অব ইনটেন্ট (এলওআই) পাওয়ার পরও শর্ত অনুযায়ী পর্যাপ্ত মূলধন সংগ্রহসহ বিভিন্ন নির্দেশনা পরিপালনে ব্যর্থ হওয়ায় এখনও চূড়ান্ত লাইসেন্স পায়নি এসব ব্যাংক। তবে চলতি বছর কার্যক্রম চালু করেছে গত বছর অনুমোদন পাওয়া পুলিশের মালিকানাধীন কমিউনিটি ব্যাংক।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও দুর্দশা : অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর লুটপাটের অভিযোগে আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসকে (পিএলএফএসএল) এবছরই অবসায়নের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। গেল ১৪ জুলাই পিপলস লিজিং অবসায়নের জন্য আদালতে মামলা দায়ের করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অনিয়মের মাধ্যমে ৫৭০ কোটি টাকা বের করে নেয়ার অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির নয় পরিচালককে বহিষ্কার করা হয়। পিপলস লিজিং বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়েন প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীরা। ডিসেম্বরের মধ্যে টাকা ফেরত পেতে অর্থমন্ত্রী ও গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করেন তারা। কিন্তু এখনও কোন সুরাহা হয়নি।

রেমিট্যান্সে প্রণোদনার সুফল : অর্থনীতির অন্যান্য সূচক নেতিবাচক হলেও সুবাতাস বয়েছে প্রবাসী আয়ে। রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা প্রদান এবং টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য বৃদ্ধিতে বৈধ পথে বেড়েছে রেমিট্যান্সের প্রবাহ। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রেমিট্যান্স এসেছে ৭৭১ কোটি ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২২ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। গত বছর একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ৬২৯ কোটি ডলার।