১৯৭১ সালের মুক্তিসংগ্রাম দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের অবদান

সাদেকুর রহমান

(গতকালের পর)

২৫ মার্চের গণহত্যা নিয়ে বিশ্ব তোলপাড় করা খবরটি আসে অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের কলম থেকে। গণহত্যা নিয়ে সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে তাকে পাকিস্তান ছাড়তে হয়। এপ্রিল মাসে পাকিস্তান থেকে আটজন সাংবাদিককে বাংলাদেশে আনা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল তারা যেন পাকিস্তানের পক্ষে সংবাদ তৈরি করে। এ দলে ছিলেন পাকিস্তানের মর্নিং নিউজ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ও ব্রিটেনের সানডে টাইমস পত্রিকার পাকিস্তান সংবাদদাতা মাসকারেনহাস। পাকিস্তানে ফিরে তিনি অপ্রত্যাশিতভাবে ১৮ মে লন্ডনে সানডে টাইমসের দফতরে হাজির হয়ে জানান যে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে তিনি একটি প্রতিবেদন লিখতে চান।

কিন্তু এ প্রতিবেদন লিখলে তার পক্ষে পাকিস্তানে থাকা সম্ভব হবেনা বলে তিনি আশংকা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে তার স্ত্রী এবং সন্তানদের বের করে না আনা পর্যন্ত এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা যাবেনা।

১৩ জুন ‘সান ডে টাইমস’র প্রথম পাতায় প্রকাশিত মাসকারেনহাসের প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘জেনোসাইড’। এটাই ছিল পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রথম কোন বিবরণমূলক প্রতিবেদন, যেখানে তিনি তুলে ধরেন সেই সময়ের গণহত্যার অনেক চিত্র। প্রতিবেদনের শুরুতে তিনি লেখেন, “মার্চ মাসের শেষ দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানের হাজার হাজার নিরীহ মানুষ মারছে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনারা।” এই প্রতিবেদন বিশ্ববাসীর নজরে আসে এবং পাকিস্তানের চালানো দমন-পীড়ন আর গণহত্যা সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা পায় কূটনৈতিক বিশ্ব।

ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সানডে টাইমসের সম্পাদক হ্যারল্ড ইভান্সকে বলেছিলেন, “লেখাটি তাকে এত গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল যে এটি তাকে ইউরোপীয় রাজধানীগুলো আর মস্কোয় ব্যক্তিগতভাবে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে উৎসাহ দেয়, যাতে ভারত এক্ষেত্রে সশস্ত্র হস্তক্ষেপ করতে পারে।”

তবে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস এসব উদ্দেশ্য নিয়ে রিপোর্ট করেননি। যেমনটা তার সম্পাদক হ্যারল্ড ইভান্স লিখেছেন, “তিনি খুব ভালো একজন প্রতিবেদক, যিনি তার কাজটা সৎভাবে করছেন।” গণহত্যার স্বরূপ সম্পর্কে লুই হেরেস ২ এপ্রিল লন্ডনের ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকায় লিখেন, “পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে এক নৃশংস হত্যাকাণ্ডে নেমেছে। এর লক্ষ্য হচ্ছে ওই দেশের রাজনৈতিক শক্তি ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে সমূলে হত্যা করা।”

‘দ্য টাইমস’র প্রতিবেদনের শুরুতে লেখা হয়, “দু’দিন, দু’রাত ধরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোলাবর্ষণে শুধু ঢাকা শহরেই মারা গেছে ৭ হাজারের বেশি মানুষ। আমেরিকার সরবরাহ করা এম-২৪ ট্যাংক, আর্টিলারি ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কোনো পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই বৃহস্পতিবার (২৫ মার্চ) রাতে হামলা চালায়, শহরের বিশাল অংশ ধ্বংস করে দেয়।”

১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল সিঙ্গাপুরের ‘দ্য নিউ নেশন’ পত্রিকায় গণহত্যা নিয়ে একটি সম্পাদকীয় ছাপা হয়। এর শিরোনাম ছিল, ‘পূর্ব পাকিস্তানে চলমান এই হত্যাকাণ্ড অবশ্যই বন্ধ করতে হবে’।

৫ এপ্রিল নিউজউইক-এ প্রকাশিত হয় দীর্ঘ প্রতিবেদন, ‘পাকিস্তান প্লাঞ্জেস ইনটু সিভিল ওয়ার’, ১২ এপ্রিল টাইম ম্যাগাজিন পূর্ব পাকিস্তানে হত্যাকাণ্ড ও গণকবরের বিবরণ প্রকাশ করে। ১৯ এপ্রিল নিকোলাস টোমালিন ডেইলি টেলিগ্রাফ-এ লিখেন, ‘ফার ফ্রম দ্য হলোকস্ট’।

এছাড়া দ্য নিউইয়র্ক টাইমস এর সিডনি শ্যানবাগ, ইটালির সাংবাদিক ওরিয়ানা ফেলাচি, ফরাসি সাংবাদিক বার্নার্ড হেনরি লেভিসহ আরও অনেক বিদেশি সাংবাদিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সরাসরি প্রত্যক্ষ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেন।

৪৮ বছর আগে পাকিস্তানের চালানো সেই গণহত্যার খবর ঐতিহাসিক দলিল হয়ে থেকে গেছে আন্তর্জাতিক গণমাধমে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো মুক্তিযুদ্ধের ওপর গুরুত্বারোপ করে বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করলেও দেশটির গণমাধ্যম বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের সংগ্রামের সমর্থনে বিভিন্ন প্রতিবেদন লেখে। ভারতের গণমাধ্যম একাট্টাভাবে বাংলাদেশের পক্ষে ছিল।

২৫ এবং ২৬ মার্চে ঢাকায় বেশ কয়েকটি পত্রিকা আক্রান্ত হবার পর অনেক সাংবাদিক আত্নগোপনে ছিলেন। ঢাকা থেকে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি বড় পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। হত্যাকাণ্ডের খবর ছাপানোর কোন উপায় নেই। তিনমাস বন্ধ থাকার পর অক্টোবর মাসে স্বল্প পরিসরে বেরিয়েছিল দৈনিক ইত্তেফাক।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ও গ্রেফতারের খবর :

একাত্তরের ২৬ মার্চ বিশ্বমঞ্চে অভ্যুদয় ঘটে ‘বাংলাদেশ’ নামের নতুন একটি মানচিত্রের, যার পতাকার রং লাল-সবুজ। দীর্ঘ নয় মাস বীরযোদ্ধারা আপসহীন ও সহিংস লড়াই করে ছিনিয়ে আনে বিজয় নিশান। ২৫ মার্চের গণহত্যার খবর নানা কারনে গণমাধ্যমে বিলম্বে আসে। কিন্তু ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা করা হয়, এই তথ্য ১৯৭১ সালের ২৬ ও ২৭ মার্চই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত হয়।

বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতের ঢাকার পরিস্থিতি ও শেখ মুজিবকে আটকের ঘটনা ২৭শে মার্চেই বিশ্বের অন্তত ২৫টি দেশের পত্রিকা বা সংবাদ সংস্থার খবরে প্রকাশিত হয়।

২৬ মার্চ বিশ্বের সর্বাধিক প্রভাবশালী গণমাধ্যম বিবিসি লন্ডনের সান্ধ্যকালীন ইংরেজি সংবাদে বলা হয়, “পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেতার ভাষণে কঠোর ভাষায় তার যা করণীয়, সে সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়েছেন; শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন; যে আওয়ামী লীগ কার্যত পূর্ব পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। প্রেসিডেন্ট সারা দেশে রাজনৈতিক কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন এবং পত্রপত্রিকার ওপর সেন্সর আরওপ করেছেন।”

একই খবরে বিবিসি লন্ডন আরও বলেছে, “পূর্বাঞ্চলীয় রাজধানী ঢাকায় অবস্থানরত মার্কিন কনসাল জেনারেল জানিয়েছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় ট্যাংক ব্যবহার করা হচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের একটি গোপনীয় বেতারের সংবাদ উদ্ধৃত করে জানানো হয়েছে যে বিভিন্ন স্থানে সহিংস লড়াই শুরু হয়ে গেছে। পূর্ববাংলার সেনাসদস্যরা পুলিশ ও সশস্ত্র নাগরিকদের সঙ্গে যোগ দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে।”

বিবিসি পরদিন (২৭ মার্চ) প্রচার করে, “পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের হুলিয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থকরা এখনো যশোর, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা নিয়ন্ত্রণ করছে।”

ব্রিটেনের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ ১৯৭১-এর ২৭ মার্চ ‘সিভিল ওয়ার ফ্লেয়ারস ইন ইস্ট পাকিস্তান : শেখ এ ট্রেইটর, সেইস প্রেসিডেন্ট’ শিরোনামে প্রতিবেদন ছাপে। ভারতের নয়াদিল্লি থেকে টেলিগ্রাফের প্রতিবেদক ডেভিড লোসাক তার প্রতিবেদনে লিখেন, “পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। ভয়ানক রকমের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। মুসলিম এই রাষ্ট্রের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে এই যুদ্ধ শুরু হয়। শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীন ঘোষণা দিয়েছেন। আর ইয়াহিয়া খান তার বেতার ভাষণে শেখ মুজিবকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে অভিহিত করেছেন।”

প্রতিবেদনে ডেভিড লোসাক আরও লিখেন, “গত রাতে বিশ্বের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অনেক দূরে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তান নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্যোন্নয়নের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান। বিদ্রোহী এই নেতা ও বাঙালি জনগোষ্ঠীকে দমনের জন্য পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানে ভারী অস্ত্রসহ ৭০ হাজার সেনা মোতায়েন করেছে। ঢাকার সূত্রগুলো জানাচ্ছে, শেখ মুজিবসহ তার পাঁচ ঘনিষ্ঠ সহচরকে রাতের আঁধারে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকাসহ অন্য শহরগুলোতে কারফিউ জারি হয়েছে, সরকারি সেনারা ঢাকার রেডিও অফিস দখল করেছে। একাধিক সূত্র জানাচ্ছে, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে বেসমারিক অনেক লোককে হত্যা করা হয়েছে। চারদিকে লুটপাঁ, অগ্নিসংযোগসহ পশ্চিম পাকিস্তানের সেনারা তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে।”

ওই একই দিন ব্রিটেনের দৈনিক টেলিগ্রাফ ‘পাকিস্তান’স সিভিল ওয়ার’ শীর্ষক একটি সম্পাদকীয় ছাপে। সম্পাদকীয়তে বলা হয়, “মুসলমান বিশ্বের বড় একটি রাষ্ট্র দু’ভাগ হবে, তা অনেক আগেই অনুমেয় ছিল। এখন পূর্ব পাকিস্তানে নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করে সেই অনুমানকে বাস্তবে রূপ দিচ্ছে। রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানীতে ব্যাপক গণ্ডগোল শুরু হয়েছে। গতকাল সেখানে বড় আকারের যুদ্ধ শুরু হয়েছে, যেখানে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক সমর্থকরা লড়াই করছে। এই যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক সমর্থকদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ মুজিব। পশ্চিমের সঙ্গে পূর্বের বিচ্ছিন্ন হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।” (চলবে)

বৃহস্পতিবার, ০২ জানুয়ারী ২০২০ , ১৯ পৌষ ১৪২৬, ৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

১৯৭১ সালের মুক্তিসংগ্রাম দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের অবদান

সাদেকুর রহমান

(গতকালের পর)

২৫ মার্চের গণহত্যা নিয়ে বিশ্ব তোলপাড় করা খবরটি আসে অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের কলম থেকে। গণহত্যা নিয়ে সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে তাকে পাকিস্তান ছাড়তে হয়। এপ্রিল মাসে পাকিস্তান থেকে আটজন সাংবাদিককে বাংলাদেশে আনা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল তারা যেন পাকিস্তানের পক্ষে সংবাদ তৈরি করে। এ দলে ছিলেন পাকিস্তানের মর্নিং নিউজ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ও ব্রিটেনের সানডে টাইমস পত্রিকার পাকিস্তান সংবাদদাতা মাসকারেনহাস। পাকিস্তানে ফিরে তিনি অপ্রত্যাশিতভাবে ১৮ মে লন্ডনে সানডে টাইমসের দফতরে হাজির হয়ে জানান যে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে তিনি একটি প্রতিবেদন লিখতে চান।

কিন্তু এ প্রতিবেদন লিখলে তার পক্ষে পাকিস্তানে থাকা সম্ভব হবেনা বলে তিনি আশংকা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে তার স্ত্রী এবং সন্তানদের বের করে না আনা পর্যন্ত এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা যাবেনা।

১৩ জুন ‘সান ডে টাইমস’র প্রথম পাতায় প্রকাশিত মাসকারেনহাসের প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘জেনোসাইড’। এটাই ছিল পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রথম কোন বিবরণমূলক প্রতিবেদন, যেখানে তিনি তুলে ধরেন সেই সময়ের গণহত্যার অনেক চিত্র। প্রতিবেদনের শুরুতে তিনি লেখেন, “মার্চ মাসের শেষ দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানের হাজার হাজার নিরীহ মানুষ মারছে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনারা।” এই প্রতিবেদন বিশ্ববাসীর নজরে আসে এবং পাকিস্তানের চালানো দমন-পীড়ন আর গণহত্যা সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা পায় কূটনৈতিক বিশ্ব।

ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সানডে টাইমসের সম্পাদক হ্যারল্ড ইভান্সকে বলেছিলেন, “লেখাটি তাকে এত গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল যে এটি তাকে ইউরোপীয় রাজধানীগুলো আর মস্কোয় ব্যক্তিগতভাবে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে উৎসাহ দেয়, যাতে ভারত এক্ষেত্রে সশস্ত্র হস্তক্ষেপ করতে পারে।”

তবে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস এসব উদ্দেশ্য নিয়ে রিপোর্ট করেননি। যেমনটা তার সম্পাদক হ্যারল্ড ইভান্স লিখেছেন, “তিনি খুব ভালো একজন প্রতিবেদক, যিনি তার কাজটা সৎভাবে করছেন।” গণহত্যার স্বরূপ সম্পর্কে লুই হেরেস ২ এপ্রিল লন্ডনের ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকায় লিখেন, “পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে এক নৃশংস হত্যাকাণ্ডে নেমেছে। এর লক্ষ্য হচ্ছে ওই দেশের রাজনৈতিক শক্তি ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে সমূলে হত্যা করা।”

‘দ্য টাইমস’র প্রতিবেদনের শুরুতে লেখা হয়, “দু’দিন, দু’রাত ধরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোলাবর্ষণে শুধু ঢাকা শহরেই মারা গেছে ৭ হাজারের বেশি মানুষ। আমেরিকার সরবরাহ করা এম-২৪ ট্যাংক, আর্টিলারি ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কোনো পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই বৃহস্পতিবার (২৫ মার্চ) রাতে হামলা চালায়, শহরের বিশাল অংশ ধ্বংস করে দেয়।”

১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল সিঙ্গাপুরের ‘দ্য নিউ নেশন’ পত্রিকায় গণহত্যা নিয়ে একটি সম্পাদকীয় ছাপা হয়। এর শিরোনাম ছিল, ‘পূর্ব পাকিস্তানে চলমান এই হত্যাকাণ্ড অবশ্যই বন্ধ করতে হবে’।

৫ এপ্রিল নিউজউইক-এ প্রকাশিত হয় দীর্ঘ প্রতিবেদন, ‘পাকিস্তান প্লাঞ্জেস ইনটু সিভিল ওয়ার’, ১২ এপ্রিল টাইম ম্যাগাজিন পূর্ব পাকিস্তানে হত্যাকাণ্ড ও গণকবরের বিবরণ প্রকাশ করে। ১৯ এপ্রিল নিকোলাস টোমালিন ডেইলি টেলিগ্রাফ-এ লিখেন, ‘ফার ফ্রম দ্য হলোকস্ট’।

এছাড়া দ্য নিউইয়র্ক টাইমস এর সিডনি শ্যানবাগ, ইটালির সাংবাদিক ওরিয়ানা ফেলাচি, ফরাসি সাংবাদিক বার্নার্ড হেনরি লেভিসহ আরও অনেক বিদেশি সাংবাদিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সরাসরি প্রত্যক্ষ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেন।

৪৮ বছর আগে পাকিস্তানের চালানো সেই গণহত্যার খবর ঐতিহাসিক দলিল হয়ে থেকে গেছে আন্তর্জাতিক গণমাধমে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো মুক্তিযুদ্ধের ওপর গুরুত্বারোপ করে বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করলেও দেশটির গণমাধ্যম বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের সংগ্রামের সমর্থনে বিভিন্ন প্রতিবেদন লেখে। ভারতের গণমাধ্যম একাট্টাভাবে বাংলাদেশের পক্ষে ছিল।

২৫ এবং ২৬ মার্চে ঢাকায় বেশ কয়েকটি পত্রিকা আক্রান্ত হবার পর অনেক সাংবাদিক আত্নগোপনে ছিলেন। ঢাকা থেকে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি বড় পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। হত্যাকাণ্ডের খবর ছাপানোর কোন উপায় নেই। তিনমাস বন্ধ থাকার পর অক্টোবর মাসে স্বল্প পরিসরে বেরিয়েছিল দৈনিক ইত্তেফাক।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ও গ্রেফতারের খবর :

একাত্তরের ২৬ মার্চ বিশ্বমঞ্চে অভ্যুদয় ঘটে ‘বাংলাদেশ’ নামের নতুন একটি মানচিত্রের, যার পতাকার রং লাল-সবুজ। দীর্ঘ নয় মাস বীরযোদ্ধারা আপসহীন ও সহিংস লড়াই করে ছিনিয়ে আনে বিজয় নিশান। ২৫ মার্চের গণহত্যার খবর নানা কারনে গণমাধ্যমে বিলম্বে আসে। কিন্তু ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা করা হয়, এই তথ্য ১৯৭১ সালের ২৬ ও ২৭ মার্চই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত হয়।

বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতের ঢাকার পরিস্থিতি ও শেখ মুজিবকে আটকের ঘটনা ২৭শে মার্চেই বিশ্বের অন্তত ২৫টি দেশের পত্রিকা বা সংবাদ সংস্থার খবরে প্রকাশিত হয়।

২৬ মার্চ বিশ্বের সর্বাধিক প্রভাবশালী গণমাধ্যম বিবিসি লন্ডনের সান্ধ্যকালীন ইংরেজি সংবাদে বলা হয়, “পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেতার ভাষণে কঠোর ভাষায় তার যা করণীয়, সে সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়েছেন; শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন; যে আওয়ামী লীগ কার্যত পূর্ব পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। প্রেসিডেন্ট সারা দেশে রাজনৈতিক কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন এবং পত্রপত্রিকার ওপর সেন্সর আরওপ করেছেন।”

একই খবরে বিবিসি লন্ডন আরও বলেছে, “পূর্বাঞ্চলীয় রাজধানী ঢাকায় অবস্থানরত মার্কিন কনসাল জেনারেল জানিয়েছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় ট্যাংক ব্যবহার করা হচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের একটি গোপনীয় বেতারের সংবাদ উদ্ধৃত করে জানানো হয়েছে যে বিভিন্ন স্থানে সহিংস লড়াই শুরু হয়ে গেছে। পূর্ববাংলার সেনাসদস্যরা পুলিশ ও সশস্ত্র নাগরিকদের সঙ্গে যোগ দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে।”

বিবিসি পরদিন (২৭ মার্চ) প্রচার করে, “পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের হুলিয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থকরা এখনো যশোর, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা নিয়ন্ত্রণ করছে।”

ব্রিটেনের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ ১৯৭১-এর ২৭ মার্চ ‘সিভিল ওয়ার ফ্লেয়ারস ইন ইস্ট পাকিস্তান : শেখ এ ট্রেইটর, সেইস প্রেসিডেন্ট’ শিরোনামে প্রতিবেদন ছাপে। ভারতের নয়াদিল্লি থেকে টেলিগ্রাফের প্রতিবেদক ডেভিড লোসাক তার প্রতিবেদনে লিখেন, “পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। ভয়ানক রকমের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। মুসলিম এই রাষ্ট্রের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে এই যুদ্ধ শুরু হয়। শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীন ঘোষণা দিয়েছেন। আর ইয়াহিয়া খান তার বেতার ভাষণে শেখ মুজিবকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে অভিহিত করেছেন।”

প্রতিবেদনে ডেভিড লোসাক আরও লিখেন, “গত রাতে বিশ্বের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অনেক দূরে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তান নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্যোন্নয়নের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান। বিদ্রোহী এই নেতা ও বাঙালি জনগোষ্ঠীকে দমনের জন্য পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানে ভারী অস্ত্রসহ ৭০ হাজার সেনা মোতায়েন করেছে। ঢাকার সূত্রগুলো জানাচ্ছে, শেখ মুজিবসহ তার পাঁচ ঘনিষ্ঠ সহচরকে রাতের আঁধারে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকাসহ অন্য শহরগুলোতে কারফিউ জারি হয়েছে, সরকারি সেনারা ঢাকার রেডিও অফিস দখল করেছে। একাধিক সূত্র জানাচ্ছে, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে বেসমারিক অনেক লোককে হত্যা করা হয়েছে। চারদিকে লুটপাঁ, অগ্নিসংযোগসহ পশ্চিম পাকিস্তানের সেনারা তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে।”

ওই একই দিন ব্রিটেনের দৈনিক টেলিগ্রাফ ‘পাকিস্তান’স সিভিল ওয়ার’ শীর্ষক একটি সম্পাদকীয় ছাপে। সম্পাদকীয়তে বলা হয়, “মুসলমান বিশ্বের বড় একটি রাষ্ট্র দু’ভাগ হবে, তা অনেক আগেই অনুমেয় ছিল। এখন পূর্ব পাকিস্তানে নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করে সেই অনুমানকে বাস্তবে রূপ দিচ্ছে। রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানীতে ব্যাপক গণ্ডগোল শুরু হয়েছে। গতকাল সেখানে বড় আকারের যুদ্ধ শুরু হয়েছে, যেখানে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক সমর্থকরা লড়াই করছে। এই যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক সমর্থকদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ মুজিব। পশ্চিমের সঙ্গে পূর্বের বিচ্ছিন্ন হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।” (চলবে)