জয় বাংলা মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক

নিতাই চন্দ্র রায়

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পর্যন্ত বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য মিছিলে, মিটিং-এ উচ্চারিত হয় অনেক স্লোগান। এসব স্লোগান আন্দোলনে অণুঘটক হিসেবে কাজ করে। সংগ্রামী জনতাকে উদ্দীপ্ত করে। উৎসাহ জোগায়। এগুলো আমাদের ইতিহাসের অংশ। চেতনার অগ্নিশিখা। স্লোগানগুলো মানুষকে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শক্তি জোগায়। উদ্বুদ্ধ করে হাসি মুখে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গের। ভাষা আন্দোলনে বাঙালির প্রাণের দাবির স্বপক্ষে স্লোগান ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের স্লোগান ছিল জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনব। ‘৭০-এর নির্বাচনে স্লোগান ছিল-আমার তোমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা যমুনা। আর মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের স্লোগান ছিল- জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

১৬ ডিসেম্বর-২০১৯ থেকে সর্বস্তরে ‘জয় বাংলা’ কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করা উচিত বলে অভিমত দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি এএম কামরুল কাদের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ১০ ডিসেম্বর, এক রুলের শুনানিতে এই অভিমত প্রদান করেন। জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা চেয়ে দুই বছর আগে হাইকোর্টে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী বশির আহমেদ। রিট আবেদনকারী আইনজীবী বশির আহমেদের কথা-জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জয় বাংলা বলে ৭ মার্চের ভাষণ শেষ করেন। তাই জয় বাংলাকে রাষ্ট্রীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা করার আবেদন করা হয়। প্রজাতন্ত্রের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বক্তব্যে ও শপথের শেষে জয় বাংলা উচ্চারণ করার নির্দেশনা চাওয়া হয় রিট আবেদনে। এ স্লোগান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা এবং জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। জয় বাংলাকে কেন জাতীয় স্লোগান ও মূলমন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হবে না-তা জানতে চাওয়া হয় রুলে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব, আইন সচিব এবং শিক্ষা সচিবকে ওই রুলের জবার দিতে বলা হয়। হাইকোর্ট রুল জারির পর বসির আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, জয় বাংলা কোনো দলের স্লোগান নয়, এটা হচ্ছে জাতীয় ঐক্য ও প্রেরণার প্রতীক। পৃথিবীর ৬০টি দেশে জাতীয় স্লোগান আছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ দুর্ভাগা যে তারা তাদের চেতনার সেই জয় বাংলাকে স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর্যন্ত জাতীয় স্লোগান হিসেবে পাননি।

হাইকোর্টের এ ঐতিহাসিক অভিমতকে আমরা অভিনন্দন জানাই। জয় বাংলা বাঙালির সব আন্দোলন, সংগ্রাম, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মুক্তিযোদ্ধারা এ অগ্নিস্লোগান উচ্চারণ করেই যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। যুদ্ধ শুরুর আগে এবং যুদ্ধ জয়ের পরও জয় বাংলা স্লোগান উচ্চারণের মাধ্যমে বাংলার আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলতেন। এ স্লোগান যুদ্ধের ময়দানে মুক্তিযোদ্ধাদের জোগাতো সীমাহীন সাহস ও অসীম প্রেরণা। জয় বাংলা স্লোগানকে মুক্তিপাগল বাঙালি জীবনের চেয়েও বেশি ভালো বাসতো, তার প্রমাণ একটি ঘটনার মাধ্যমে পরিষ্কার করা যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ময়মনসিংহ ক্যাম্পের পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তিনজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ধরা পড়েন। সারা রাত তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। তাদের বলা হয় যদি তোমরা পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলো, তবে তোমাদের ছেড়ে দেয়া হবে। কিন্তু অকুতভয় মুক্তিযোদ্ধারা কিছুতেই হানাদার পাকিস্তানি সেনাদের প্রস্তাবে রাজি হননি। ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তারপর তাদের হাতমোড়া করে বেঁধে বহ্মপুত্র নদের তীরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রাইফেল তাক করে একজন পাকিস্তানি সেনা আবার বলে, ‘আমি এক, দুই তিন বলার সঙ্গে সঙ্গে তোমরা যদি পাকিস্তান জিন্দাবাদ না বলো, তাহলে তোমাদের গুলি করে হত্যা করা হবে।’ পাকিস্তানি সেনাটি জোরে উচ্চারণ করে ‘বাতাও- পাকিস্তান জিন্দাবাদ, এক, দু, তিন’। তারপরও মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলেননি। তারা সজোরে উচ্চারণ করেন ‘জয় বাংলা’। জয় বাংলা স্লোগান উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাটি চাইনিজ রাইফেল দিয়ে গুলি করে ওই তিনজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এতেই বোঝা যায় জয় বাংলা স্লোগানটি মুক্তিযোদ্ধাদের কত প্রিয় ছিল। কত গভীর প্রেরণার উৎস ছিল। এই স্লোগানকে কণ্ঠে ধারণ করেই বঙ্গবন্ধুর ডাকে নয় মাস যুদ্ধ করে বাংলার সূর্য সন্তানেরা স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনে। এই স্লোগান ৩০ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অংকিত বাঙালির শত বছরের জীবন সংগ্রামের ফসল।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ভীষণ ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন তার তার কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ। বঙ্গবন্ধু ৬ দফা আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য বাংলার পথে-প্রান্তরে ঘুরেছেন। কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। অসংখ্য জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন। তিনি তার ভাষণে প্রায়ই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কবিতার পঙ্ক্তি উচ্চারণ করতেন। মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার ভাষণ শুনতেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘ভাঙ্গার গান’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ কবিতার শেষের দিকে আছে ‘বাংলা বাঙালির হোক, বাংলার জয় হোক, জয় বাংলা।’ এ কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই আওয়ামী লীগের জনসভার শেষে বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিতে শুরু করেন জয় বাংলা, জয় বাংলা ভাষা, জয় হোক বাংলার মানুষের।

উইকিপিডিয়ার সূত্রে প্রাপ্ত আ স ম আবদুর রবের একটি সাক্ষাৎ থেকে জানা যায়, ১৯৭০ সালে ৭ জুন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের বিশাল এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীপ্ত কণ্ঠে প্রথমবারের মতো ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি উচ্চারণ করেন। এর পর ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ভাষণও তিনি সমাপ্ত করেন জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে। মুনতাসির মামুন সম্পাদিত ‘কিশোর মুক্তিযুদ্ধ কোষ’ গ্রন্থে বলা হয়েছে জয় বাংলা স্লোগান ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন বাঙালির প্রেরণার উৎস। সফল অপারেশন শেষে বা যুদ্ধ জয়ের পর মুক্তিযোদ্ধারা চিৎকার করে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে জয় উদ্যাপন করতেন।

এ ব্যাপারে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, জয় বাংলা ছিল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূলমন্ত্র। যে স্লোগান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন, জীবন দিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন, সেটাকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করা উচিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতীয় স্লোগান রয়েছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জাতীয় স্লোগান হলো-জয় হিন্দ। আমরাও জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান করতে আদালতে মত দিয়েছি। শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম বলেন, জয় বাংলা স্লোগান ইতিহাসের অংশ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে জয় বাংলা স্লোগান দেয়া হয়। এ জয় বাংলা স্লোগান মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। এটা শুধু একটা স্লোগান নয়, চেতনার নামও। এই স্লোগান ধারণ করেই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যার পর এ স্লোগান নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ওই সময় ক্ষমতাসীন সরকার ও তাদের দোসর স্বাধীনতা যুদ্ধের পরাজিত শক্তি জয় বাংলার পরিবর্তে পাকিস্তানের অনুকরণে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে উচ্চারণ করে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, এই জয় বাংলা স্লোগান সম্পর্কে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানানো উচিত। এই স্লোগান আমাদের জন্য একটা শক্তি। সাবেক আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু এমপি বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে সবার হৃদয় উৎসারিত স্লোগান ছিল জয় বাংলা। আমরা আশা করি রিট আবেদনকারীর পক্ষে জয় বাংলার পক্ষে আদালত রায় দেবেন।

সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি এম আমিন উদ্দিন বলেন, আমাদের বর্তমান সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটিকে সংবিধানের অংশ করে নেয়া হয়েছে। সেই ভাষণের শেষ অংশ হচ্ছে জয় বাংলা। সুতরাং সংবিধান অনুযায়ী, জয় বাংলা আমাদের সংবিধানের অংশ। তাই জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান করা উচিত। আমরা মনে করি এটা অবশ্যই আইনে পরিণত হবে।

জয় বাংলা এমন একটি স্লোগান যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জনগণকে তাদের মুক্তি সংগ্রামে প্রবলভাবে প্রেরণা জুগিয়েছিল। এর আগে বাঙালি কখনও এত তীব্র, সংহত ও তাৎপর্যপূর্ণ স্লোগান দেয়নি।, যাতে একটি পদেই প্রকাশ পেয়েছে রাজনীতি, সংস্কৃতি, দেশ, ভাষার সৌন্দর্য ও জাতীয় আবেগ। জয় বাংলা স্লোগান ছিল মুক্তি যুদ্ধকালীন বাঙালির প্রেরণার উৎস।

কখন কীভাবে এ স্লোগানটি উৎপত্তি হয়েছিল তা সুনিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। এক সূত্রে বলা হয়েছে যে, ১৯৬৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে শিক্ষা দিবস যৌথভাব পালনের জন্য কর্মসূচি প্রণয়নের সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহুত সভায় তৎকালীন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আফতাব আহমেদ ও চিশতী হেলালুর রহমান ‘জয় বাংলা’ স্লোগান সর্ব প্রথম উচ্চারণ করেন। তবে ১৯৭০ সালের ১৯ জানুয়ারি, ঢাকা শহরের পল্টনে এক জনসভায় ছাত্র নেতা সিরাজুল আলম খান তার ভাষণে সর্বপ্রথম ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি উচ্চারণ করেন। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান অস্থায়ী কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে যে স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠ করেছিলেন তার শেষেও তিনি জয় বাংলা উচ্চারণ করেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল, প্রচারিত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের প্রথম বেতার ভাষণটি শেষ হয়েছিল জয় বাংলা, জয় স্বাধীন বাংলাদেশ স্লোগানের মাধ্যমে।

জয় বাংলা স্লোগানকে কেন্দ্র করে ১৯৭০ সালে গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার রচনা করেন একটি বিখ্যাত গণসংগীত। সংগীতের শুরুটা হলো-জয় বাংলা, বাংলার জয়,/হবে হবে হবে হবে নিশ্চয়/কোটি প্রাণ এক সঙ্গে জেগেছে অন্ধরাতে/নতুন সুর্য ওঠার এখনই সময়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে এই গানটিকে আরাধ্য করেই মুক্তির পথে এগিয়ে যায় সমগ্র জাতি। বিবিসির জরিপে ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গান’ হিসেবে ২০টি গানের মধ্যে এ গানটি ১৩তম স্থান পায়। এ গানটি ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সূচনা সংগীত, যার উৎস ছিল বাঙালির হৃদয় নিংড়ানো জয় বাংলা স্লোগান।

[লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লি.

গোপালপুর, নাটোর]

netairoy18@yahoo.com

শুক্রবার, ০৩ জানুয়ারী ২০২০ , ২০ পৌষ ১৪২৬, ৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

জয় বাংলা মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক

নিতাই চন্দ্র রায়

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পর্যন্ত বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য মিছিলে, মিটিং-এ উচ্চারিত হয় অনেক স্লোগান। এসব স্লোগান আন্দোলনে অণুঘটক হিসেবে কাজ করে। সংগ্রামী জনতাকে উদ্দীপ্ত করে। উৎসাহ জোগায়। এগুলো আমাদের ইতিহাসের অংশ। চেতনার অগ্নিশিখা। স্লোগানগুলো মানুষকে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শক্তি জোগায়। উদ্বুদ্ধ করে হাসি মুখে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গের। ভাষা আন্দোলনে বাঙালির প্রাণের দাবির স্বপক্ষে স্লোগান ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের স্লোগান ছিল জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনব। ‘৭০-এর নির্বাচনে স্লোগান ছিল-আমার তোমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা যমুনা। আর মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের স্লোগান ছিল- জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

১৬ ডিসেম্বর-২০১৯ থেকে সর্বস্তরে ‘জয় বাংলা’ কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করা উচিত বলে অভিমত দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি এএম কামরুল কাদের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ১০ ডিসেম্বর, এক রুলের শুনানিতে এই অভিমত প্রদান করেন। জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা চেয়ে দুই বছর আগে হাইকোর্টে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী বশির আহমেদ। রিট আবেদনকারী আইনজীবী বশির আহমেদের কথা-জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জয় বাংলা বলে ৭ মার্চের ভাষণ শেষ করেন। তাই জয় বাংলাকে রাষ্ট্রীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা করার আবেদন করা হয়। প্রজাতন্ত্রের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বক্তব্যে ও শপথের শেষে জয় বাংলা উচ্চারণ করার নির্দেশনা চাওয়া হয় রিট আবেদনে। এ স্লোগান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা এবং জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। জয় বাংলাকে কেন জাতীয় স্লোগান ও মূলমন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হবে না-তা জানতে চাওয়া হয় রুলে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব, আইন সচিব এবং শিক্ষা সচিবকে ওই রুলের জবার দিতে বলা হয়। হাইকোর্ট রুল জারির পর বসির আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, জয় বাংলা কোনো দলের স্লোগান নয়, এটা হচ্ছে জাতীয় ঐক্য ও প্রেরণার প্রতীক। পৃথিবীর ৬০টি দেশে জাতীয় স্লোগান আছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ দুর্ভাগা যে তারা তাদের চেতনার সেই জয় বাংলাকে স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর্যন্ত জাতীয় স্লোগান হিসেবে পাননি।

হাইকোর্টের এ ঐতিহাসিক অভিমতকে আমরা অভিনন্দন জানাই। জয় বাংলা বাঙালির সব আন্দোলন, সংগ্রাম, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মুক্তিযোদ্ধারা এ অগ্নিস্লোগান উচ্চারণ করেই যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। যুদ্ধ শুরুর আগে এবং যুদ্ধ জয়ের পরও জয় বাংলা স্লোগান উচ্চারণের মাধ্যমে বাংলার আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলতেন। এ স্লোগান যুদ্ধের ময়দানে মুক্তিযোদ্ধাদের জোগাতো সীমাহীন সাহস ও অসীম প্রেরণা। জয় বাংলা স্লোগানকে মুক্তিপাগল বাঙালি জীবনের চেয়েও বেশি ভালো বাসতো, তার প্রমাণ একটি ঘটনার মাধ্যমে পরিষ্কার করা যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ময়মনসিংহ ক্যাম্পের পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তিনজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ধরা পড়েন। সারা রাত তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। তাদের বলা হয় যদি তোমরা পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলো, তবে তোমাদের ছেড়ে দেয়া হবে। কিন্তু অকুতভয় মুক্তিযোদ্ধারা কিছুতেই হানাদার পাকিস্তানি সেনাদের প্রস্তাবে রাজি হননি। ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তারপর তাদের হাতমোড়া করে বেঁধে বহ্মপুত্র নদের তীরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রাইফেল তাক করে একজন পাকিস্তানি সেনা আবার বলে, ‘আমি এক, দুই তিন বলার সঙ্গে সঙ্গে তোমরা যদি পাকিস্তান জিন্দাবাদ না বলো, তাহলে তোমাদের গুলি করে হত্যা করা হবে।’ পাকিস্তানি সেনাটি জোরে উচ্চারণ করে ‘বাতাও- পাকিস্তান জিন্দাবাদ, এক, দু, তিন’। তারপরও মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলেননি। তারা সজোরে উচ্চারণ করেন ‘জয় বাংলা’। জয় বাংলা স্লোগান উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাটি চাইনিজ রাইফেল দিয়ে গুলি করে ওই তিনজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এতেই বোঝা যায় জয় বাংলা স্লোগানটি মুক্তিযোদ্ধাদের কত প্রিয় ছিল। কত গভীর প্রেরণার উৎস ছিল। এই স্লোগানকে কণ্ঠে ধারণ করেই বঙ্গবন্ধুর ডাকে নয় মাস যুদ্ধ করে বাংলার সূর্য সন্তানেরা স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনে। এই স্লোগান ৩০ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অংকিত বাঙালির শত বছরের জীবন সংগ্রামের ফসল।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ভীষণ ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন তার তার কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ। বঙ্গবন্ধু ৬ দফা আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য বাংলার পথে-প্রান্তরে ঘুরেছেন। কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। অসংখ্য জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন। তিনি তার ভাষণে প্রায়ই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কবিতার পঙ্ক্তি উচ্চারণ করতেন। মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার ভাষণ শুনতেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘ভাঙ্গার গান’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ কবিতার শেষের দিকে আছে ‘বাংলা বাঙালির হোক, বাংলার জয় হোক, জয় বাংলা।’ এ কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই আওয়ামী লীগের জনসভার শেষে বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিতে শুরু করেন জয় বাংলা, জয় বাংলা ভাষা, জয় হোক বাংলার মানুষের।

উইকিপিডিয়ার সূত্রে প্রাপ্ত আ স ম আবদুর রবের একটি সাক্ষাৎ থেকে জানা যায়, ১৯৭০ সালে ৭ জুন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের বিশাল এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীপ্ত কণ্ঠে প্রথমবারের মতো ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি উচ্চারণ করেন। এর পর ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ভাষণও তিনি সমাপ্ত করেন জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে। মুনতাসির মামুন সম্পাদিত ‘কিশোর মুক্তিযুদ্ধ কোষ’ গ্রন্থে বলা হয়েছে জয় বাংলা স্লোগান ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন বাঙালির প্রেরণার উৎস। সফল অপারেশন শেষে বা যুদ্ধ জয়ের পর মুক্তিযোদ্ধারা চিৎকার করে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে জয় উদ্যাপন করতেন।

এ ব্যাপারে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, জয় বাংলা ছিল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূলমন্ত্র। যে স্লোগান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন, জীবন দিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন, সেটাকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করা উচিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতীয় স্লোগান রয়েছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জাতীয় স্লোগান হলো-জয় হিন্দ। আমরাও জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান করতে আদালতে মত দিয়েছি। শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম বলেন, জয় বাংলা স্লোগান ইতিহাসের অংশ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে জয় বাংলা স্লোগান দেয়া হয়। এ জয় বাংলা স্লোগান মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। এটা শুধু একটা স্লোগান নয়, চেতনার নামও। এই স্লোগান ধারণ করেই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যার পর এ স্লোগান নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ওই সময় ক্ষমতাসীন সরকার ও তাদের দোসর স্বাধীনতা যুদ্ধের পরাজিত শক্তি জয় বাংলার পরিবর্তে পাকিস্তানের অনুকরণে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে উচ্চারণ করে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, এই জয় বাংলা স্লোগান সম্পর্কে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানানো উচিত। এই স্লোগান আমাদের জন্য একটা শক্তি। সাবেক আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু এমপি বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে সবার হৃদয় উৎসারিত স্লোগান ছিল জয় বাংলা। আমরা আশা করি রিট আবেদনকারীর পক্ষে জয় বাংলার পক্ষে আদালত রায় দেবেন।

সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি এম আমিন উদ্দিন বলেন, আমাদের বর্তমান সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটিকে সংবিধানের অংশ করে নেয়া হয়েছে। সেই ভাষণের শেষ অংশ হচ্ছে জয় বাংলা। সুতরাং সংবিধান অনুযায়ী, জয় বাংলা আমাদের সংবিধানের অংশ। তাই জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান করা উচিত। আমরা মনে করি এটা অবশ্যই আইনে পরিণত হবে।

জয় বাংলা এমন একটি স্লোগান যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জনগণকে তাদের মুক্তি সংগ্রামে প্রবলভাবে প্রেরণা জুগিয়েছিল। এর আগে বাঙালি কখনও এত তীব্র, সংহত ও তাৎপর্যপূর্ণ স্লোগান দেয়নি।, যাতে একটি পদেই প্রকাশ পেয়েছে রাজনীতি, সংস্কৃতি, দেশ, ভাষার সৌন্দর্য ও জাতীয় আবেগ। জয় বাংলা স্লোগান ছিল মুক্তি যুদ্ধকালীন বাঙালির প্রেরণার উৎস।

কখন কীভাবে এ স্লোগানটি উৎপত্তি হয়েছিল তা সুনিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। এক সূত্রে বলা হয়েছে যে, ১৯৬৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে শিক্ষা দিবস যৌথভাব পালনের জন্য কর্মসূচি প্রণয়নের সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহুত সভায় তৎকালীন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আফতাব আহমেদ ও চিশতী হেলালুর রহমান ‘জয় বাংলা’ স্লোগান সর্ব প্রথম উচ্চারণ করেন। তবে ১৯৭০ সালের ১৯ জানুয়ারি, ঢাকা শহরের পল্টনে এক জনসভায় ছাত্র নেতা সিরাজুল আলম খান তার ভাষণে সর্বপ্রথম ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি উচ্চারণ করেন। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান অস্থায়ী কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে যে স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠ করেছিলেন তার শেষেও তিনি জয় বাংলা উচ্চারণ করেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল, প্রচারিত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের প্রথম বেতার ভাষণটি শেষ হয়েছিল জয় বাংলা, জয় স্বাধীন বাংলাদেশ স্লোগানের মাধ্যমে।

জয় বাংলা স্লোগানকে কেন্দ্র করে ১৯৭০ সালে গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার রচনা করেন একটি বিখ্যাত গণসংগীত। সংগীতের শুরুটা হলো-জয় বাংলা, বাংলার জয়,/হবে হবে হবে হবে নিশ্চয়/কোটি প্রাণ এক সঙ্গে জেগেছে অন্ধরাতে/নতুন সুর্য ওঠার এখনই সময়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে এই গানটিকে আরাধ্য করেই মুক্তির পথে এগিয়ে যায় সমগ্র জাতি। বিবিসির জরিপে ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গান’ হিসেবে ২০টি গানের মধ্যে এ গানটি ১৩তম স্থান পায়। এ গানটি ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সূচনা সংগীত, যার উৎস ছিল বাঙালির হৃদয় নিংড়ানো জয় বাংলা স্লোগান।

[লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লি.

গোপালপুর, নাটোর]

netairoy18@yahoo.com