বঙ্গবন্ধুর মশাল

মুনীরুজ্জামান

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ‘মুজিববর্ষের ক্ষণগণনার উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর মশাল নিয়েই চলতে চাই’। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং ধর্মনিরপেক্ষ মৌলবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক, বাঙালি জাতীয়তাভিত্তিক বাংলাদেশ এবং সমাজতন্ত্রের বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এ দুটি লক্ষ্যে শুধু অবিচল থাকেনি, ধ্রুবতারার মতো অবিচল থেকেছে। লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত তিনি খান্ত হননি। তার রাজনৈতিক জীবন ও বিশ্বাসের এ লক্ষ্যই বঙ্গবন্ধুর মশাল।

এ প্রসঙ্গে খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস লিখেছেন- ‘সময়টা ১৯৬৪ সাল। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা প্রবীণ নেতাদের অন্যতম অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম খানের পল্টনের বাসবভনে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে একটি ঘরোয়া বৈঠকের আয়োজন করা হয়। আলোচ্য বিষয় ছিল- আওয়ামী লীগের সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সমস্যা ও তার পথনির্দেশ। শেখ মুজিব যাদেরকে আলোচনার জন্য নিমন্ত্রণ জানান, তাদের মধ্যে সেদিন উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান, ডক্টর আলীম আল রাজী, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতা অ্যাডভোকেট ফজলুল করিম এবং গৃহস্বামী আব্দুস সালম খান। রংপুরের আওয়ামী লীগ নেতা ও শিল্পপতি মতিউর রহমানও ছিলেন আলোচনা সভায়। আলোচনার একপর্যায়ে বলা হলো যে, দেশে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি আওয়ামী লীগ দলের চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণের কথা ভাবছে। এ ব্যাপারে তারা আলোচকদের কাছে সহযোগিতা চান।’ (প্রসঙ্গ শেখ মুজিব : খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। প্রকাশক অরিত্র প্রকাশনী। পৃষ্ঠা : ৫৮)।

এরপরই তিনি লিখেছেন- ‘সমাজতন্ত্রের প্রশ্নে শেখ মুজিবের সঙ্গে কতিপয় বৈঠক হয় আমার। ...পরের এক বৈঠকে শেখ মুজিব আমাকে একটু অবাক করেছিলেন। তিনি বললেন : তোমরা বামপন্থীরা দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে সংগ্রাম শুরু করেছো, সে সংগ্রাম সম্পাদন করতে হবে আমাকেই। তার মুখে আত্মপ্রত্যয়ের হাসি।

আমিও হেসে তাকে প্রশ্ন করেছিলাম : কীভাবে?

শেখ মুজিব বললেন : শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রতীক্ষায় তোমরা দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে চাও, করো। কিন্তু আমি সে পথেই যাবো না। যে দেশে শ্রমিকের সংখ্যা অতি নগণ্য এবং কৃষকের সংগঠন ও চেতনার স্তর নিম্নপর্যায়ে রয়েছে, সেদেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রত্যাশায় কালক্ষেপণ করতে আমি রাজি নই। আমার পথ ভিন্ন হবে।

এক. প্রথমে পাকিস্তান থেকে সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করবো। শোষক পশ্চিমাদের এটা ততটা সমস্যা নয়, যতটা বাঙালিদের। ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ব্যবস্থায় তারা রাজি না হলে আমরাও তখন ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে জাতীয়তাবাদের সেøাগান তোলা সম্পর্কে চিন্তা করে দেখবো।

দুই. এ দেশে আগে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবো। যদি আমাদের গণতন্ত্র শোষক খানদের [পাকিস্তানিদের] পছন্দ না হয়, তারা মিলিটারি ‘ডিক্টেটরশিপ’ নিয়ে শান্তিতে বাস করুক। সংখ্যাগরিষ্ঠতার গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী আমরা পাকিস্তান থেকে তাদের বহিষ্কার করে দেব। কারণ লাহোর প্রস্তাবে সামরিক শাসনের কথা লেখা নেই, বলা হয়েছে গণতন্ত্রের কথা।

মুজিব বললেন : সংখ্যাগুরু কখনো আলাদা হয় না। ওরা সংখ্যালঘু, ওরাই আলাদা হওয়ার দাবি উত্থাপন করুক। আমরা তখন ওদের দাবি বিবেচনা করে দেখবো।

তিন. সভ্য জগতে কোন রাষ্ট্রই ধর্মের উপর ভিত্তি করে চলতে পারে না। রাষ্ট্রকে হতে হবে ধর্ম নিরপেক্ষ। ধর্ম যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান- যার ধর্ম তার অন্তরে, তার তার গৃহে। রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মের ধোঁকা দিয়ে বিশ্বব্যাপী যে প্রকট শোষণ অব্যাহত রয়েছে, বাংলাদেশ থেকে সমূলে তার উৎপাটন করবো, সাফ কথা। আমার ছোট্ট দেশ মানুষ বেশি। এখানে খাদ্যও কম, রুজি রোজগারও তেমনি নগণ্য।

চার. এমন কতকগুলো অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া উত্থাপন করতে যাচ্ছি- যাতে শ্রমিক, কৃষক, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ও মেহনতি মানুষ সকল সম্পদের মালিক হয়; রাষ্ট্র ও সমাজের নেতৃত্বে সেই মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ...সমাজতন্ত্রের প্রশ্নে আমরা একা নই, ধনী খানদের বিরুদ্ধে দেশের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল মহলেরও সমর্থন পাওয়া যাবে বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস।

শেখ মুজিবকে প্রশ্ন করেছিলাম : উপরোক্ত চারটি দফা যদি আদায়ই হয়, তবে সে তো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হবে না, হবে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব ধরনের একটা কিছু। কিন্তু মেহনতী মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে পরিষ্কার বক্তব্য ও কর্মসূচি দিতে হবে। উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানা কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্রে শ্রমিক, কৃষক ও নিপীড়িত জনগণের অবস্থান কীরূপ দাঁড়াবে সে প্রশ্নেরও সুস্পষ্ট জবাব থাকতে হবে সমাজতন্ত্রের কর্মসূচিতে।

জবাবে মুজিব বললেন : ধীরে ধীরে যেতে হবে, ধাপে ধাপে যেতে হবে। শ্রমিক, কৃষক ও শোষিত মানুষের জন্যই তো আমাদের তো সংগ্রাম। জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পাদন এবং তার কর্মসূচি বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত এদেশে সমাজতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হতে পারা যাবে না, সে সম্পর্কে আমি সজাগ, আমি নিশ্চিত।’

শেখ মুজিব এবার আওয়ামী লীগের শক্তি সঞ্চয়ে গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করেন। নেতৃত্বের ক্ষেত্রে তিনি দেশপ্রেমিক প্রবীণ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি এবং বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ তরুণদের সমাবেশ ঘটালেন। (প্রসঙ্গ শেখ মুজিব, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। অরিত্র প্রকাশনী। পৃষ্ঠা : ৫৮-৬১)

উদ্ধৃতিটা অনেক দীর্ঘ হয়ে গেলো। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তা এবং চিন্তার প্রতি তার গভীর কমিটমেন্ট বোঝার জন্য এর প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ এবং শ্রেণী সংগ্রামে যারা বিশ্বাস করেন, তারা সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর কনসেপ্ট সম্পর্কে নিশ্চয়ই দ্বিমত পোষণ করবেন। কিন্তু একজন প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী নেতা তার মতো করে সমাজতন্ত্রের একটি কনসেপ্ট তৈরি করেছেন এবং তার প্রতি কমিটেড থেকে তার রাজনৈতিক লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন, দলকে তৈরি করেছেন এবং সবশেষে জীবনবাজি রেখে তার মতো করেই কমিটমেন্ট সম্পন্ন করবার চেষ্টা করেছেন, এই দৃষ্টান্তও আধুনিক বিশ্বে এক বিরল ঘটনা।

আমরা খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের গ্রন্থ থেকেই জানতে পারছি বঙ্গবন্ধু শুধু তার স্বপ্নের কথা বলে বা গণতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতা-সমাজতন্ত্রের বুলি কপচিয়েই বসে থাকেননি অথবা দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করেননি। তিনি ‘আওয়ামী লীগের শক্তি সঞ্চয়ে গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করেন। নেতৃত্বের ক্ষেত্রে তিনি দেশপ্রেমিক প্রবীণ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি এবং বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ তরুণদের সমাবেশ ঘটালেন।’ অর্থাৎ তার রাজনৈতিক চিন্তার লাইনে দলকে সাগঠনিক-রাজনৈতিকভাবে তৈরি করতে শুরু করলেন।

তার গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ-সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র চিন্তার সূচনা পদক্ষেপ হিসেবে রাজনৈতিক কর্মসূচি দিলেন ৬ দফা। খন্দকার মোহাম্মদের লেখায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনায় বেশ পরিষ্কার বোঝা যায় তিনি যে রাজনীতির কথা বলছেন তাতে পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে থাকবে না, অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথাই তিনি বুঝিয়েছেন। এটাও জানতেন যে, তার রাজনৈতিক কর্মসূচি পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কিছুতেই মেনে নেবে না। যার অনিবার্য পরিণতি বাঙালির পরিণতি।

এ লক্ষ্যে জনগণ ও দলকে তৈরি করেছেন। ৬ দফা দিয়ে জনগণকে তৈরি করেছেন। ৭ মার্চের ভাষণ দিয়ে জনগণকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের জন্য তৈরি করেছেন। এভাবে নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন।

কিন্তু নিজের কমিটমেন্টের কথা বিস্মৃত হননি। বাংলাদেশের সংবিধানে গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্রকে জাতীয় চার নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধর্ম নিয়ে কাউকে রাজনীতি করতে দেবেন না বলেছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে তিনি ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা এবং ধর্মভিত্তিক দল গঠন করা নিষিদ্ধ করেছিলেন।

যে রাজনীতি বঙ্গবন্ধু আজীবন লালন করেছেন সেটাই তিনি বাস্তবায়ন করার জন্য কাজ করেছেন আমৃত্যু। এই যে গণতন্ত্র-বাঙালি জাতীয়তাবাদ-ধর্মনিরপেক্ষতা-সমাজতন্ত্রের রাজনীতি এটাই বঙ্গবন্ধুর মশাল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর মশাল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে তার দল কি এর জন্য প্রস্তুত। দলের বর্তমান যে অবস্থা তাতে আমরা কীভাবে আশা করবো বঙ্গবন্ধুর মশাল নিয়ে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। ক্যাসিনো কাণ্ডের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে এবং দলের ভেতরের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে ঘোষণা দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দলের যে চিত্র দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেছেন সেই দলকে নিয়ে তিনি কীভাবে বঙ্গবন্ধুর মশাল ধরে এগোবেন?

তারচেয়ে বড় কথা, বঙ্গবন্ধুর যে রাজনীতি যে রাজনীতির জন্য আজীবন লড়েছেন, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন, তারপর জীবন উৎসর্গ করেছেন। আজকের দলের ক’জন সে রাজনীতির খবর রাখে। ধর্মনিরপেক্ষতায় দলের কজন বিশ্বাস করেন। তৃণমূল পর্যায়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর লুটপাট, হুমকি দিয়ে দেশত্যাগের ঘটনা যেভাবে ঘটছে এবং এসব ঘটনার সঙ্গে দলের লোকজন জড়িত থাকবার অভিযোগ যেমন নিরন্তর; এর ফলে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের যে চিত্র আমরা পাচ্ছি, সেই দলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের কথা বলবার মতো অবস্থা কি রয়েছে?

মৌলিক এ বিষয়গুলোর রাজনৈতিক সুরাহা না করে এই দেশ, এই সমাজ, এই দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর মশাল কীভাবে ধরবে? ধরলেও ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ কি আমরা পাবো?

সোমবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২০ , ২৯ পৌষ ১৪২৬, ১৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

বঙ্গবন্ধুর মশাল

মুনীরুজ্জামান

image

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ‘মুজিববর্ষের ক্ষণগণনার উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর মশাল নিয়েই চলতে চাই’। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং ধর্মনিরপেক্ষ মৌলবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক, বাঙালি জাতীয়তাভিত্তিক বাংলাদেশ এবং সমাজতন্ত্রের বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এ দুটি লক্ষ্যে শুধু অবিচল থাকেনি, ধ্রুবতারার মতো অবিচল থেকেছে। লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত তিনি খান্ত হননি। তার রাজনৈতিক জীবন ও বিশ্বাসের এ লক্ষ্যই বঙ্গবন্ধুর মশাল।

এ প্রসঙ্গে খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস লিখেছেন- ‘সময়টা ১৯৬৪ সাল। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা প্রবীণ নেতাদের অন্যতম অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম খানের পল্টনের বাসবভনে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে একটি ঘরোয়া বৈঠকের আয়োজন করা হয়। আলোচ্য বিষয় ছিল- আওয়ামী লীগের সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সমস্যা ও তার পথনির্দেশ। শেখ মুজিব যাদেরকে আলোচনার জন্য নিমন্ত্রণ জানান, তাদের মধ্যে সেদিন উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান, ডক্টর আলীম আল রাজী, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতা অ্যাডভোকেট ফজলুল করিম এবং গৃহস্বামী আব্দুস সালম খান। রংপুরের আওয়ামী লীগ নেতা ও শিল্পপতি মতিউর রহমানও ছিলেন আলোচনা সভায়। আলোচনার একপর্যায়ে বলা হলো যে, দেশে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি আওয়ামী লীগ দলের চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণের কথা ভাবছে। এ ব্যাপারে তারা আলোচকদের কাছে সহযোগিতা চান।’ (প্রসঙ্গ শেখ মুজিব : খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। প্রকাশক অরিত্র প্রকাশনী। পৃষ্ঠা : ৫৮)।

এরপরই তিনি লিখেছেন- ‘সমাজতন্ত্রের প্রশ্নে শেখ মুজিবের সঙ্গে কতিপয় বৈঠক হয় আমার। ...পরের এক বৈঠকে শেখ মুজিব আমাকে একটু অবাক করেছিলেন। তিনি বললেন : তোমরা বামপন্থীরা দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে সংগ্রাম শুরু করেছো, সে সংগ্রাম সম্পাদন করতে হবে আমাকেই। তার মুখে আত্মপ্রত্যয়ের হাসি।

আমিও হেসে তাকে প্রশ্ন করেছিলাম : কীভাবে?

শেখ মুজিব বললেন : শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রতীক্ষায় তোমরা দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে চাও, করো। কিন্তু আমি সে পথেই যাবো না। যে দেশে শ্রমিকের সংখ্যা অতি নগণ্য এবং কৃষকের সংগঠন ও চেতনার স্তর নিম্নপর্যায়ে রয়েছে, সেদেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রত্যাশায় কালক্ষেপণ করতে আমি রাজি নই। আমার পথ ভিন্ন হবে।

এক. প্রথমে পাকিস্তান থেকে সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করবো। শোষক পশ্চিমাদের এটা ততটা সমস্যা নয়, যতটা বাঙালিদের। ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ব্যবস্থায় তারা রাজি না হলে আমরাও তখন ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে জাতীয়তাবাদের সেøাগান তোলা সম্পর্কে চিন্তা করে দেখবো।

দুই. এ দেশে আগে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবো। যদি আমাদের গণতন্ত্র শোষক খানদের [পাকিস্তানিদের] পছন্দ না হয়, তারা মিলিটারি ‘ডিক্টেটরশিপ’ নিয়ে শান্তিতে বাস করুক। সংখ্যাগরিষ্ঠতার গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী আমরা পাকিস্তান থেকে তাদের বহিষ্কার করে দেব। কারণ লাহোর প্রস্তাবে সামরিক শাসনের কথা লেখা নেই, বলা হয়েছে গণতন্ত্রের কথা।

মুজিব বললেন : সংখ্যাগুরু কখনো আলাদা হয় না। ওরা সংখ্যালঘু, ওরাই আলাদা হওয়ার দাবি উত্থাপন করুক। আমরা তখন ওদের দাবি বিবেচনা করে দেখবো।

তিন. সভ্য জগতে কোন রাষ্ট্রই ধর্মের উপর ভিত্তি করে চলতে পারে না। রাষ্ট্রকে হতে হবে ধর্ম নিরপেক্ষ। ধর্ম যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান- যার ধর্ম তার অন্তরে, তার তার গৃহে। রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মের ধোঁকা দিয়ে বিশ্বব্যাপী যে প্রকট শোষণ অব্যাহত রয়েছে, বাংলাদেশ থেকে সমূলে তার উৎপাটন করবো, সাফ কথা। আমার ছোট্ট দেশ মানুষ বেশি। এখানে খাদ্যও কম, রুজি রোজগারও তেমনি নগণ্য।

চার. এমন কতকগুলো অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া উত্থাপন করতে যাচ্ছি- যাতে শ্রমিক, কৃষক, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ও মেহনতি মানুষ সকল সম্পদের মালিক হয়; রাষ্ট্র ও সমাজের নেতৃত্বে সেই মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ...সমাজতন্ত্রের প্রশ্নে আমরা একা নই, ধনী খানদের বিরুদ্ধে দেশের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল মহলেরও সমর্থন পাওয়া যাবে বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস।

শেখ মুজিবকে প্রশ্ন করেছিলাম : উপরোক্ত চারটি দফা যদি আদায়ই হয়, তবে সে তো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হবে না, হবে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব ধরনের একটা কিছু। কিন্তু মেহনতী মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে পরিষ্কার বক্তব্য ও কর্মসূচি দিতে হবে। উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানা কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্রে শ্রমিক, কৃষক ও নিপীড়িত জনগণের অবস্থান কীরূপ দাঁড়াবে সে প্রশ্নেরও সুস্পষ্ট জবাব থাকতে হবে সমাজতন্ত্রের কর্মসূচিতে।

জবাবে মুজিব বললেন : ধীরে ধীরে যেতে হবে, ধাপে ধাপে যেতে হবে। শ্রমিক, কৃষক ও শোষিত মানুষের জন্যই তো আমাদের তো সংগ্রাম। জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পাদন এবং তার কর্মসূচি বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত এদেশে সমাজতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হতে পারা যাবে না, সে সম্পর্কে আমি সজাগ, আমি নিশ্চিত।’

শেখ মুজিব এবার আওয়ামী লীগের শক্তি সঞ্চয়ে গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করেন। নেতৃত্বের ক্ষেত্রে তিনি দেশপ্রেমিক প্রবীণ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি এবং বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ তরুণদের সমাবেশ ঘটালেন। (প্রসঙ্গ শেখ মুজিব, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। অরিত্র প্রকাশনী। পৃষ্ঠা : ৫৮-৬১)

উদ্ধৃতিটা অনেক দীর্ঘ হয়ে গেলো। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তা এবং চিন্তার প্রতি তার গভীর কমিটমেন্ট বোঝার জন্য এর প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ এবং শ্রেণী সংগ্রামে যারা বিশ্বাস করেন, তারা সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর কনসেপ্ট সম্পর্কে নিশ্চয়ই দ্বিমত পোষণ করবেন। কিন্তু একজন প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী নেতা তার মতো করে সমাজতন্ত্রের একটি কনসেপ্ট তৈরি করেছেন এবং তার প্রতি কমিটেড থেকে তার রাজনৈতিক লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন, দলকে তৈরি করেছেন এবং সবশেষে জীবনবাজি রেখে তার মতো করেই কমিটমেন্ট সম্পন্ন করবার চেষ্টা করেছেন, এই দৃষ্টান্তও আধুনিক বিশ্বে এক বিরল ঘটনা।

আমরা খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের গ্রন্থ থেকেই জানতে পারছি বঙ্গবন্ধু শুধু তার স্বপ্নের কথা বলে বা গণতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতা-সমাজতন্ত্রের বুলি কপচিয়েই বসে থাকেননি অথবা দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করেননি। তিনি ‘আওয়ামী লীগের শক্তি সঞ্চয়ে গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করেন। নেতৃত্বের ক্ষেত্রে তিনি দেশপ্রেমিক প্রবীণ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি এবং বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ তরুণদের সমাবেশ ঘটালেন।’ অর্থাৎ তার রাজনৈতিক চিন্তার লাইনে দলকে সাগঠনিক-রাজনৈতিকভাবে তৈরি করতে শুরু করলেন।

তার গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ-সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র চিন্তার সূচনা পদক্ষেপ হিসেবে রাজনৈতিক কর্মসূচি দিলেন ৬ দফা। খন্দকার মোহাম্মদের লেখায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনায় বেশ পরিষ্কার বোঝা যায় তিনি যে রাজনীতির কথা বলছেন তাতে পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে থাকবে না, অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথাই তিনি বুঝিয়েছেন। এটাও জানতেন যে, তার রাজনৈতিক কর্মসূচি পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কিছুতেই মেনে নেবে না। যার অনিবার্য পরিণতি বাঙালির পরিণতি।

এ লক্ষ্যে জনগণ ও দলকে তৈরি করেছেন। ৬ দফা দিয়ে জনগণকে তৈরি করেছেন। ৭ মার্চের ভাষণ দিয়ে জনগণকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের জন্য তৈরি করেছেন। এভাবে নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন।

কিন্তু নিজের কমিটমেন্টের কথা বিস্মৃত হননি। বাংলাদেশের সংবিধানে গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্রকে জাতীয় চার নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধর্ম নিয়ে কাউকে রাজনীতি করতে দেবেন না বলেছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে তিনি ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা এবং ধর্মভিত্তিক দল গঠন করা নিষিদ্ধ করেছিলেন।

যে রাজনীতি বঙ্গবন্ধু আজীবন লালন করেছেন সেটাই তিনি বাস্তবায়ন করার জন্য কাজ করেছেন আমৃত্যু। এই যে গণতন্ত্র-বাঙালি জাতীয়তাবাদ-ধর্মনিরপেক্ষতা-সমাজতন্ত্রের রাজনীতি এটাই বঙ্গবন্ধুর মশাল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর মশাল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে তার দল কি এর জন্য প্রস্তুত। দলের বর্তমান যে অবস্থা তাতে আমরা কীভাবে আশা করবো বঙ্গবন্ধুর মশাল নিয়ে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। ক্যাসিনো কাণ্ডের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে এবং দলের ভেতরের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে ঘোষণা দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দলের যে চিত্র দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেছেন সেই দলকে নিয়ে তিনি কীভাবে বঙ্গবন্ধুর মশাল ধরে এগোবেন?

তারচেয়ে বড় কথা, বঙ্গবন্ধুর যে রাজনীতি যে রাজনীতির জন্য আজীবন লড়েছেন, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন, তারপর জীবন উৎসর্গ করেছেন। আজকের দলের ক’জন সে রাজনীতির খবর রাখে। ধর্মনিরপেক্ষতায় দলের কজন বিশ্বাস করেন। তৃণমূল পর্যায়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর লুটপাট, হুমকি দিয়ে দেশত্যাগের ঘটনা যেভাবে ঘটছে এবং এসব ঘটনার সঙ্গে দলের লোকজন জড়িত থাকবার অভিযোগ যেমন নিরন্তর; এর ফলে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের যে চিত্র আমরা পাচ্ছি, সেই দলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের কথা বলবার মতো অবস্থা কি রয়েছে?

মৌলিক এ বিষয়গুলোর রাজনৈতিক সুরাহা না করে এই দেশ, এই সমাজ, এই দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর মশাল কীভাবে ধরবে? ধরলেও ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ কি আমরা পাবো?