পরিবহন আইন বড়ই অসহায়

রণেশ মৈত্র

আসলে পরিবহন আইনটি বড় অসহায়। অসহায় সরকারও। পরিবহন সেক্টরের মালিক-শ্রমিকদের দৌরাত্ম্যের কারণে কিছুতেই বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না পরিবহন আইন। বাংলাদেশের পরিবহন মালিক শ্রমিকরা জানেন যে, এ দেশে তারা একচেটিয়া ব্যবসায়ের সুযোগ পেয়ে থাকেন; যা পৃথিবীর খুব কম দেশে বিদ্যমান। তারা জানেন, বাংলাদেশে রেলপথ, রেলপথে যাত্রী সেবা-বিশেষত উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে নিদারুণভাবে আজও সীমিত। নদীপথ-নৌযানগুলিকেও কবেই না সমাধিস্থ করেছি আমরা এবং নানাবিধ কারণেই ব্যবসাটা একচেটিয়া।

ব্যক্তি মালিকানা যদি একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ পায়, বিপদ-বিপর্যয়ের আশঙ্কার অস্তিত্ব, এমনকি ক্রমবৃদ্ধির আশঙ্কা সেখানে তীব্র। বাস্তবে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ এই ব্যক্তি মালিকানায় পরিবহন সেক্টেরের ব্যবসার অসহায় শিকারে পরিণত আজ নয়- বহুকাল যাবত।

গত বছরের ১৯ নভেম্বর উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের ১২টি জেলায় সেদিন থেকেই পরিবহন ধর্মঘট শুরু। নির্দিষ্ট কোন সময়ের জন্য তারা এই ধর্মঘটের ডাক দেয়নি তারা বলেছে তাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ ধর্মঘট চলবে অনির্দিষ্টকালের জন্য।

দাবিটি কি? পরিবহন আইনের সংশোধিত বিধানগুলো প্রত্যাহারের দাবিতে- দাবি তাদের এই একটাই।

সংস্কারকৃত এই আইনের বিধানগুলো কার স্বার্থে প্রণীত? যাত্রী সাধারণ, চালক-মালিক-সবার স্বার্থেই। কিন্তু তারা বাতিল বা প্রত্যাহার চান ততটুকুই যতটুকু যাত্রীদের স্বার্থে প্রণীত। যেমন, অতিদ্রুত চালালে শাস্তি, লাইসেন্স-বিহীন চালক চালালে শাস্তি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন চালালে শাস্তি, মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে গাড়ি চালালে শাস্তি, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালালে শাস্তি প্রভৃতি। কিন্তু এগুলো কি আমাদের দেশেই শুধুমাত্র নিষিদ্ধ? না, পৃথিবীর সর্বত্র তা নিষিদ্ধ। অথচ পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের দাবি মানলে ওই শাস্তির বিধানগুলোকে প্রত্যাহার করে নিতে হবে।

প্রত্যাহারের পরিণতি? পথে পথে দুর্ঘটনার আশঙ্কা, অহেতুক নিরীহ যাত্রীদের মৃত্যুর আশঙ্কা বৃদ্ধি। ধর্মঘটে নিয়োজিতরা তা জানেন না-তা নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এমন সর্বনাশা ধর্মঘট।

এই ধর্মঘট কি আইনসম্মত? আমরা জানি দেশে শ্রম আইন বিদ্যমান। সে আইনে আমাদের শ্রমিক সমাজের স্বার্থ পুরোপুরি রক্ষিত হয় নি- এ অভিযোগ শুধু নানা সেক্টরে বাংলাদেশে কর্মরত শ্রমিকদের বা দেশবাসীর তা নয়। এ অভিযোগটি খোদ আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থারও (আইএলও) বটে। সেই শ্রম আইনের বিধান অনুযায়ী ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন কোন কারণে প্রয়োজনে ধর্মঘট ডাকতে পারবে তবে তার আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে লিখিত দিয়ে বলতে হবে যে এই এই দাবী এত তারিখের মধ্যে মানতে হবে এবং না মানলে তারা ধর্মঘটে যেতে বাধ্য হবেন। যদি কর্তৃপক্ষ না মানেন তবেই একটি ধর্মঘটকে বৈধভাবে আশুত বলে বিবেচনা করা হয়।

চলমান ধর্মঘট শ্রম আইনের সেই নিয়ম মেনে করা হয়নি। এটি অকস্মাৎ আহ্বান করার ফলে এই ধর্মঘট অবৈধ।

আরও এক কারণে ধর্মঘটটি অবৈধ ছিল। কোন ট্রেড ইউনিয়ন যদি ধর্মঘট কোন কারণে ডাকতে চান তবে ওই ট্রেড ইউনিয়নের নির্দিষ্ট পরিমাণ বৈধ সদস্য থাকতে হবে এবং সেই সদস্যদের অধিকাংশ ভোটে যদি ধর্মঘট আহ্বানির প্রস্তাব অনুমোদিত হয়- তবেই কর্তৃপক্ষের নিকট সংশ্লিষ্ট ট্রেড ইউনিয়ন দাবি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে না মানলে ধর্মঘট করা হবে উল্লেখ করে নোটিশ পাঠাতে পারেন। দৃশ্যতই এক্ষেত্রে তেমন কোন কিছুই করা হয়নি। তাই শ্রম আইনের বিধান অনুযায়ীও এ ধর্মঘটে সম্পূর্ণ বেআইনি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ট্রেড ইউনিয়নগুলো (বিশেষ করে পরিবহন শিল্পে) কোন দিনই আইন মেনে ধর্মঘট ডাকে না। তাই তার কি শ্রম আইন, কি পরিবহন আইন- কোনটাই মানতে চান না, মানেনও না।

না মানার সাহসটি তারা পান, কারণ তাদের কোন ধর্মঘটকেই বেআইনি ঘোষণা করা হয় না এবং বেআইনি ধর্মঘটিদের বা তার উসকানিদাতাদের বিরুদ্ধে কোন শাস্তির ব্যবস্থাও করেন না। ফলে এ শিল্পের মালিক, শ্রমিকেরা দুঃসাহসী বেপরোয়া।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী এবং সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, পরিবহন আইন অবশ্যই কার্যকর করা হবে এবং কোন চাপেই আইনটির বাস্তবায়ন বন্ধ বা স্থগিত হবে না। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন কবে থেকে শুরু হবে তার স্পষ্ট ঘোষণা না থাকায় এইভাবে ধর্মঘট ডেকে যে সরকারের উপর অবৈধ চাপ অহরহ করা হচ্ছে- সে ব্যাপারে সরকার নেহায়েতই উদাসীন। সমস্যাটা সেখানেই।

এখন ট্রেড ইউনিয়ন বলতে প্রধানত শ্রমিক লীগকে বোঝায়। পরিবহন সেক্টরের শ্রমিকদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে পরিবহন শ্রমিক লীগ যা একটি সরকার সমর্থিত সংগঠন। তাহলে এটাও তো স্পষ্ট সরকার সমর্থিত, সরকারি লোকদের দ্বারা পরিচালিত পরিবহন শ্রমিক লীগই সরকারের বিরুদ্ধে ধর্মঘটে নেমেছে- নামছে বারংবার। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন তোলাই যায়, সরকার কি তাদের প্রণীত এই আইনটির দ্রুত এবং পরিপূর্ণ বাস্তবায়নে সত্যই আন্তরিক কিনা, সে প্রশ্নটিও তোলাই যায় চলমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে।

আরও গুরুত্বপূর্ণ কথা বেশ কয়েকটি উত্থাপন করছি এই সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে। সমস্যাটির কোন টোটকা সমাধান নেই বলে আমার ধারণা। তাই বিষয়টির স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে যা যা করা প্রয়োজন তা হলোÑ

এক. বিআরটিসি সরকারি সড়ক পরিবহন পরিষেবার কথা আমরা প্রায় ভুলেই গিয়েছি। জনগণের দাবিতে পাকিস্তান সরকারও বিআরটিসি নামে সংস্থাটি চালু করে প্রদেশের নানা স্থানে বিআরটিসি বাসের চাহিদা থাকায় তখনও আরও বৃদ্ধি করার দাবি উঠেছিল। পাবনা, বগুড়া, রাজশাহী, কুষ্টিয়াসহ দেশের প্রতিটি জেলাতেই ডিপো স্থাপন করে বেশ ভালোসংখ্যক বাস ডিপোগুলোতে দেয়া হয়েছিল। তাদের ভাড়াও ছিল কম এবং যাত্রীসেবাও ছিল উন্নততর। কিন্তু সামরিক শাসক স্বৈরাচারী এরশাদ ক্ষমতায় এসে এক কলমের খোঁচায় ঢাকা ছাড়া অন্যান্য ডিপোগুলো থেকে বিআরটিসির বাস ক্রমান্বয়ে প্রত্যাহার করে নেন। তার প্রতিবাদ ওঠে দেশজুড়ে। পরে ক্ষমতা বদলের পর ডিপোগুলোতে নামমাত্র সংখ্যক বাস সরবরাহ করে সেগুলো চালু করা হয়েছিল। কিন্তু বেসরকারি বাসগুলোর মালিক শ্রমিকদের ধ্বংসাত্মক বিরোধিতার কারণে বা যে সুযোগে ডিপোগুলো থেকে বাসগুলো প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। যে কয়টি করে দোতলা বাস ছিল সেগুলোকে বেসরকারি বাস মালিক-শ্রমিকরা ঢিলিয়ে ভেঙে-চুরে দিতে থাকলে দোতলা বাসগুলো পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নিয়ে বেসরকারি পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকলাপের শাস্তি না দিয়ে সরকারই নতিস্বীকার করে অপরাধীদের আরও বেশি বেশি দুঃসাহসী দুর্বিনীত করে তোলেন।

যা হোক, ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তার কারণে সরকার অবিলম্বে প্রত্যেক জেলার বিআরটিসি ডিপোতে ১০০ করে ভালো (নতুন হলে সর্বোত্তম) বাস ও অন্তত ৫০টি করে ট্রাক সরবরাহ করে সেগুলো ঢাকাসহ সকল আঞ্চলিক রুটগুলোতে চালু করে এই দীর্ঘস্থায়ী সংকটের যতটা সম্ভব সমাধানে এগিয়ে আসুন;

দুই. অতিদ্রুত পশ্চিমাঞ্চলের রেলপথগুলো আধুনিকায়ন, ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ, বগি, নতুন নতুন ইঞ্জিনসহ সার্ভিস চালু করুন। ট্রেনের সংখ্যা ওই অঞ্চলগুলোতে দ্বিগুণ বৃদ্ধি করা হোক;

তিন. এবারে বলছি সর্বাংশে নিহত ও সমাধিস্থ নদ-নদীগুলোকে দখলমুক্ত করে, সিএস খতিয়ান মোতাবেক সেগুলোর দৈর্ঘ্যে প্রস্থে উদ্ধার ও সেগুলো খননের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় গভীরতা নিশ্চিত করে সেগুলোকে সারা বছরের বহমান করে তোলার মাধ্যমে কার্যকর নৌপরিবহন সার্ভিস চালু করা হোক। জনমত শতভাগ এ দাবিগুলোর পেছনে রয়েছে, রয়েছে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ ও নির্দেশনা।

যে কোন সূত্র থেকেই এ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করে অবিলম্বে তা বিভিন্ন জেলার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের করছে পৌঁছানো এবং চলমান শুকনা মৌসুমটি সে কাজের উপযুক্ত হয়ায় তার পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা হোক।

আমাদের স্মরণে রাখা দরকার যে, নদী পুনরুদ্ধার শুধুমাত্র নৌপরিবহন চালু করার জন্যই প্রয়োজনীয় নয়। তা ছাড়াও দেশব্যাপী পরিবেশের উন্নয়ন, কৃষিতে স্বল্প ব্যয়ে সেচ সম্প্রসারণ, বনায়ন ও মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্যও অপরিহার্য।

মূল আলোচ্য বিষয়টি হলো পরিবহন ব্যবসায় উন্নয়ন এবং তা নিয়েই নিবন্ধটির অবতারণা। সেক্ষেত্রে নতুন সড়ক আইনের পরিপূর্ণ প্রয়োগ এবং বাধাদানকারীদের ও অমান্যকারীদের কঠোর শাস্তি বিধান ব্যতীত এই মুহূর্তে পরিস্থিতির উন্নয়ন অসম্ভব। তাই চলমান ধর্মঘটকে বেআইনি ঘোষণা করে অবিলম্বে সকল সার্ভিস চালু করে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো এবং তা না করলে কঠোরতম শাস্তি প্রদানও শুরু করা হোক।

এবারের কৌশলটা নতুন। মালিকরা বলেছেন তারা জানেন না এ ধর্মঘটের ব্যাপারে। ট্রেড ইউনিয়ন নেতারাও বলেছেন তাদের কোনো সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু ১৪টি জেলায় ধর্মঘট, তাহলে ধর্মঘট করল কাদের নির্দেশে- এটা কী করে সম্ভব? ধর্মঘট হচ্ছে অথচ কেউ জানে না, ধর্মঘট ভেঙেছিল কিন্তু সরকারও খুঁজে বের করার কোন চেষ্টাই করেনি কারা ডাক দিয়েছিল সেই ধর্মঘটের। বস্তুত এই নৈরাজ্য চলছে দীর্ঘদিন ধরে। একদল মাফিয়া জিম্মি করে রেখেছে পরিবহন সেক্টরকে। সরকারি দলের নেতারাই রয়েছেন সেখানে। নৈরাজ্য থামবে কিভাবে।

[লেখক : সভাপতিম-লীর সদস্য, ঐক্যন্যাপ; সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত]

E-mail:raneshmaitra@gmail.com

বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২০ , ১ মাঘ ১৪২৬, ১৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

পরিবহন আইন বড়ই অসহায়

রণেশ মৈত্র

আসলে পরিবহন আইনটি বড় অসহায়। অসহায় সরকারও। পরিবহন সেক্টরের মালিক-শ্রমিকদের দৌরাত্ম্যের কারণে কিছুতেই বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না পরিবহন আইন। বাংলাদেশের পরিবহন মালিক শ্রমিকরা জানেন যে, এ দেশে তারা একচেটিয়া ব্যবসায়ের সুযোগ পেয়ে থাকেন; যা পৃথিবীর খুব কম দেশে বিদ্যমান। তারা জানেন, বাংলাদেশে রেলপথ, রেলপথে যাত্রী সেবা-বিশেষত উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে নিদারুণভাবে আজও সীমিত। নদীপথ-নৌযানগুলিকেও কবেই না সমাধিস্থ করেছি আমরা এবং নানাবিধ কারণেই ব্যবসাটা একচেটিয়া।

ব্যক্তি মালিকানা যদি একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ পায়, বিপদ-বিপর্যয়ের আশঙ্কার অস্তিত্ব, এমনকি ক্রমবৃদ্ধির আশঙ্কা সেখানে তীব্র। বাস্তবে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ এই ব্যক্তি মালিকানায় পরিবহন সেক্টেরের ব্যবসার অসহায় শিকারে পরিণত আজ নয়- বহুকাল যাবত।

গত বছরের ১৯ নভেম্বর উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের ১২টি জেলায় সেদিন থেকেই পরিবহন ধর্মঘট শুরু। নির্দিষ্ট কোন সময়ের জন্য তারা এই ধর্মঘটের ডাক দেয়নি তারা বলেছে তাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ ধর্মঘট চলবে অনির্দিষ্টকালের জন্য।

দাবিটি কি? পরিবহন আইনের সংশোধিত বিধানগুলো প্রত্যাহারের দাবিতে- দাবি তাদের এই একটাই।

সংস্কারকৃত এই আইনের বিধানগুলো কার স্বার্থে প্রণীত? যাত্রী সাধারণ, চালক-মালিক-সবার স্বার্থেই। কিন্তু তারা বাতিল বা প্রত্যাহার চান ততটুকুই যতটুকু যাত্রীদের স্বার্থে প্রণীত। যেমন, অতিদ্রুত চালালে শাস্তি, লাইসেন্স-বিহীন চালক চালালে শাস্তি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন চালালে শাস্তি, মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে গাড়ি চালালে শাস্তি, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালালে শাস্তি প্রভৃতি। কিন্তু এগুলো কি আমাদের দেশেই শুধুমাত্র নিষিদ্ধ? না, পৃথিবীর সর্বত্র তা নিষিদ্ধ। অথচ পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের দাবি মানলে ওই শাস্তির বিধানগুলোকে প্রত্যাহার করে নিতে হবে।

প্রত্যাহারের পরিণতি? পথে পথে দুর্ঘটনার আশঙ্কা, অহেতুক নিরীহ যাত্রীদের মৃত্যুর আশঙ্কা বৃদ্ধি। ধর্মঘটে নিয়োজিতরা তা জানেন না-তা নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এমন সর্বনাশা ধর্মঘট।

এই ধর্মঘট কি আইনসম্মত? আমরা জানি দেশে শ্রম আইন বিদ্যমান। সে আইনে আমাদের শ্রমিক সমাজের স্বার্থ পুরোপুরি রক্ষিত হয় নি- এ অভিযোগ শুধু নানা সেক্টরে বাংলাদেশে কর্মরত শ্রমিকদের বা দেশবাসীর তা নয়। এ অভিযোগটি খোদ আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থারও (আইএলও) বটে। সেই শ্রম আইনের বিধান অনুযায়ী ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন কোন কারণে প্রয়োজনে ধর্মঘট ডাকতে পারবে তবে তার আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে লিখিত দিয়ে বলতে হবে যে এই এই দাবী এত তারিখের মধ্যে মানতে হবে এবং না মানলে তারা ধর্মঘটে যেতে বাধ্য হবেন। যদি কর্তৃপক্ষ না মানেন তবেই একটি ধর্মঘটকে বৈধভাবে আশুত বলে বিবেচনা করা হয়।

চলমান ধর্মঘট শ্রম আইনের সেই নিয়ম মেনে করা হয়নি। এটি অকস্মাৎ আহ্বান করার ফলে এই ধর্মঘট অবৈধ।

আরও এক কারণে ধর্মঘটটি অবৈধ ছিল। কোন ট্রেড ইউনিয়ন যদি ধর্মঘট কোন কারণে ডাকতে চান তবে ওই ট্রেড ইউনিয়নের নির্দিষ্ট পরিমাণ বৈধ সদস্য থাকতে হবে এবং সেই সদস্যদের অধিকাংশ ভোটে যদি ধর্মঘট আহ্বানির প্রস্তাব অনুমোদিত হয়- তবেই কর্তৃপক্ষের নিকট সংশ্লিষ্ট ট্রেড ইউনিয়ন দাবি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে না মানলে ধর্মঘট করা হবে উল্লেখ করে নোটিশ পাঠাতে পারেন। দৃশ্যতই এক্ষেত্রে তেমন কোন কিছুই করা হয়নি। তাই শ্রম আইনের বিধান অনুযায়ীও এ ধর্মঘটে সম্পূর্ণ বেআইনি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ট্রেড ইউনিয়নগুলো (বিশেষ করে পরিবহন শিল্পে) কোন দিনই আইন মেনে ধর্মঘট ডাকে না। তাই তার কি শ্রম আইন, কি পরিবহন আইন- কোনটাই মানতে চান না, মানেনও না।

না মানার সাহসটি তারা পান, কারণ তাদের কোন ধর্মঘটকেই বেআইনি ঘোষণা করা হয় না এবং বেআইনি ধর্মঘটিদের বা তার উসকানিদাতাদের বিরুদ্ধে কোন শাস্তির ব্যবস্থাও করেন না। ফলে এ শিল্পের মালিক, শ্রমিকেরা দুঃসাহসী বেপরোয়া।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী এবং সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, পরিবহন আইন অবশ্যই কার্যকর করা হবে এবং কোন চাপেই আইনটির বাস্তবায়ন বন্ধ বা স্থগিত হবে না। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন কবে থেকে শুরু হবে তার স্পষ্ট ঘোষণা না থাকায় এইভাবে ধর্মঘট ডেকে যে সরকারের উপর অবৈধ চাপ অহরহ করা হচ্ছে- সে ব্যাপারে সরকার নেহায়েতই উদাসীন। সমস্যাটা সেখানেই।

এখন ট্রেড ইউনিয়ন বলতে প্রধানত শ্রমিক লীগকে বোঝায়। পরিবহন সেক্টরের শ্রমিকদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে পরিবহন শ্রমিক লীগ যা একটি সরকার সমর্থিত সংগঠন। তাহলে এটাও তো স্পষ্ট সরকার সমর্থিত, সরকারি লোকদের দ্বারা পরিচালিত পরিবহন শ্রমিক লীগই সরকারের বিরুদ্ধে ধর্মঘটে নেমেছে- নামছে বারংবার। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন তোলাই যায়, সরকার কি তাদের প্রণীত এই আইনটির দ্রুত এবং পরিপূর্ণ বাস্তবায়নে সত্যই আন্তরিক কিনা, সে প্রশ্নটিও তোলাই যায় চলমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে।

আরও গুরুত্বপূর্ণ কথা বেশ কয়েকটি উত্থাপন করছি এই সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে। সমস্যাটির কোন টোটকা সমাধান নেই বলে আমার ধারণা। তাই বিষয়টির স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে যা যা করা প্রয়োজন তা হলোÑ

এক. বিআরটিসি সরকারি সড়ক পরিবহন পরিষেবার কথা আমরা প্রায় ভুলেই গিয়েছি। জনগণের দাবিতে পাকিস্তান সরকারও বিআরটিসি নামে সংস্থাটি চালু করে প্রদেশের নানা স্থানে বিআরটিসি বাসের চাহিদা থাকায় তখনও আরও বৃদ্ধি করার দাবি উঠেছিল। পাবনা, বগুড়া, রাজশাহী, কুষ্টিয়াসহ দেশের প্রতিটি জেলাতেই ডিপো স্থাপন করে বেশ ভালোসংখ্যক বাস ডিপোগুলোতে দেয়া হয়েছিল। তাদের ভাড়াও ছিল কম এবং যাত্রীসেবাও ছিল উন্নততর। কিন্তু সামরিক শাসক স্বৈরাচারী এরশাদ ক্ষমতায় এসে এক কলমের খোঁচায় ঢাকা ছাড়া অন্যান্য ডিপোগুলো থেকে বিআরটিসির বাস ক্রমান্বয়ে প্রত্যাহার করে নেন। তার প্রতিবাদ ওঠে দেশজুড়ে। পরে ক্ষমতা বদলের পর ডিপোগুলোতে নামমাত্র সংখ্যক বাস সরবরাহ করে সেগুলো চালু করা হয়েছিল। কিন্তু বেসরকারি বাসগুলোর মালিক শ্রমিকদের ধ্বংসাত্মক বিরোধিতার কারণে বা যে সুযোগে ডিপোগুলো থেকে বাসগুলো প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। যে কয়টি করে দোতলা বাস ছিল সেগুলোকে বেসরকারি বাস মালিক-শ্রমিকরা ঢিলিয়ে ভেঙে-চুরে দিতে থাকলে দোতলা বাসগুলো পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নিয়ে বেসরকারি পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকলাপের শাস্তি না দিয়ে সরকারই নতিস্বীকার করে অপরাধীদের আরও বেশি বেশি দুঃসাহসী দুর্বিনীত করে তোলেন।

যা হোক, ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তার কারণে সরকার অবিলম্বে প্রত্যেক জেলার বিআরটিসি ডিপোতে ১০০ করে ভালো (নতুন হলে সর্বোত্তম) বাস ও অন্তত ৫০টি করে ট্রাক সরবরাহ করে সেগুলো ঢাকাসহ সকল আঞ্চলিক রুটগুলোতে চালু করে এই দীর্ঘস্থায়ী সংকটের যতটা সম্ভব সমাধানে এগিয়ে আসুন;

দুই. অতিদ্রুত পশ্চিমাঞ্চলের রেলপথগুলো আধুনিকায়ন, ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ, বগি, নতুন নতুন ইঞ্জিনসহ সার্ভিস চালু করুন। ট্রেনের সংখ্যা ওই অঞ্চলগুলোতে দ্বিগুণ বৃদ্ধি করা হোক;

তিন. এবারে বলছি সর্বাংশে নিহত ও সমাধিস্থ নদ-নদীগুলোকে দখলমুক্ত করে, সিএস খতিয়ান মোতাবেক সেগুলোর দৈর্ঘ্যে প্রস্থে উদ্ধার ও সেগুলো খননের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় গভীরতা নিশ্চিত করে সেগুলোকে সারা বছরের বহমান করে তোলার মাধ্যমে কার্যকর নৌপরিবহন সার্ভিস চালু করা হোক। জনমত শতভাগ এ দাবিগুলোর পেছনে রয়েছে, রয়েছে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ ও নির্দেশনা।

যে কোন সূত্র থেকেই এ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করে অবিলম্বে তা বিভিন্ন জেলার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের করছে পৌঁছানো এবং চলমান শুকনা মৌসুমটি সে কাজের উপযুক্ত হয়ায় তার পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা হোক।

আমাদের স্মরণে রাখা দরকার যে, নদী পুনরুদ্ধার শুধুমাত্র নৌপরিবহন চালু করার জন্যই প্রয়োজনীয় নয়। তা ছাড়াও দেশব্যাপী পরিবেশের উন্নয়ন, কৃষিতে স্বল্প ব্যয়ে সেচ সম্প্রসারণ, বনায়ন ও মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্যও অপরিহার্য।

মূল আলোচ্য বিষয়টি হলো পরিবহন ব্যবসায় উন্নয়ন এবং তা নিয়েই নিবন্ধটির অবতারণা। সেক্ষেত্রে নতুন সড়ক আইনের পরিপূর্ণ প্রয়োগ এবং বাধাদানকারীদের ও অমান্যকারীদের কঠোর শাস্তি বিধান ব্যতীত এই মুহূর্তে পরিস্থিতির উন্নয়ন অসম্ভব। তাই চলমান ধর্মঘটকে বেআইনি ঘোষণা করে অবিলম্বে সকল সার্ভিস চালু করে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো এবং তা না করলে কঠোরতম শাস্তি প্রদানও শুরু করা হোক।

এবারের কৌশলটা নতুন। মালিকরা বলেছেন তারা জানেন না এ ধর্মঘটের ব্যাপারে। ট্রেড ইউনিয়ন নেতারাও বলেছেন তাদের কোনো সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু ১৪টি জেলায় ধর্মঘট, তাহলে ধর্মঘট করল কাদের নির্দেশে- এটা কী করে সম্ভব? ধর্মঘট হচ্ছে অথচ কেউ জানে না, ধর্মঘট ভেঙেছিল কিন্তু সরকারও খুঁজে বের করার কোন চেষ্টাই করেনি কারা ডাক দিয়েছিল সেই ধর্মঘটের। বস্তুত এই নৈরাজ্য চলছে দীর্ঘদিন ধরে। একদল মাফিয়া জিম্মি করে রেখেছে পরিবহন সেক্টরকে। সরকারি দলের নেতারাই রয়েছেন সেখানে। নৈরাজ্য থামবে কিভাবে।

[লেখক : সভাপতিম-লীর সদস্য, ঐক্যন্যাপ; সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত]

E-mail:raneshmaitra@gmail.com