অনিরাপদ ঢাকা শহর

আবু আফজাল সালেহ

ক্রমেই আমাদের প্রিয় শহর ঢাকা অনিরাপদ হয়ে যাচ্ছে। ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নেই বললেই চলে। অবকাঠামোগত নিরাপত্তা বিশ্বপ্রেক্ষাপটে একেবারেই নিচের দিকে। চলাফেরায় স্বাধীনতা বলতে গেলে হাস্যকরই। খাদ্যে ভেজাল ও মাছ-সবজিতে কৃত্রিমতা বা কেমিক্যাল খাদ্য নিরাপত্তাকে শূন্যে নিয়ে গেছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা। এ কারণের চাপে অপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত গ্রহণও নিতে হচ্ছে। অপরিকল্পিত ঊর্ধ্ব সম্প্রসারণ ঘটছে এ শহরে। ছোটছোট ঘরে করুণ কাহিনীও দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। জলধারাগুলো ভরাট ও দূষিত হচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত বাড়ছে। মেয়াদোত্তীর্ণ গণপরিবহন। নারীরা নিগৃহীত। শিশু থেকে বৃদ্ধা ধর্ষণ বেড়েই চলেছে। এসব অনাচারের বিচার চাইতে আন্দোলন, মানববন্ধন করতে হয় এ শহরে! এর চেয়ে লজ্জাজনক বিষয় হতে পারে? এসবের ইঙ্গিতই বলে দেয় ঢাকা ভালো নেই। এখানে বাসিন্দা ও মেহমানদের জন্য বড়ই অনিরাপদ।

‘ইকোনমিস্ট ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ)’ ও ‘সেইফ সিটি ইনডেক্সের (এসসিআই)’ সর্বশেষ প্রতিবেদনে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ শহরের তালিকায় নিচের দিক থেকে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে ঢাকা। প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, অবকাঠামোগত নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সূচকে ঢাকা খুবই বাজে অবস্থানে রয়েছে।

এ শহরে চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নানা অনিয়ম বিরাজমান। চিকিৎসাক্ষেত্রে নানা অসঙ্গতি। ‘ব্যবসা ব্যবসা’ মনোভাবই বেশি। বেকারত্বের হারও বাড়ছে। গণমাধ্যমে জানা যায় যে, গতবছর বেড়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ। যানজট, চুরি, ছিনতাই বেড়েই চলেছে। সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। পরমতসহিষ্ণুতা নেই-ই। ফলে এ শহরের বেশিরভাগ বাসিন্দা হতাশাতে ভুগে থাকে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় দেখা যায় যে, ঢাকার প্রায় ৭১ শতাংশ বাসিন্দা বিভিন্ন কারণে বিষণœতায় ভুগছে এবং ৬৮ শতাংশ মানুষ শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত। এ শহরের ৩ শতাংশ (প্রায় সাড়ে সাত লাখ) বাসিন্দা তিন বেলা খেতে পায় না। এ সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।

গত বছরের জানুয়ারিতে ডেমরার নুসরাত জাহান (৪) ও ফারিয়া দোলো (৫) নামে দুই শিশুকে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে হত্যা করা হয়। বছর পেরিয়ে গেলেও বিচার সমাপ্ত হয়নি। সাংবাদিক দম্পতির সাগর-রুনির হত্যার কূলকিনারা আজও পাওয়া যায়নি। বারবার পিছিয়ে যায় বিচারের তারিখ। এসব বিষয়ে আরও একটু সতর্ক ও নিরপেক্ষ হতে হবে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আমাদের সহায়তা করতে হবে। কিন্তু উভয়পক্ষই ব্যর্থ হচ্ছি।

ধর্ষিতাদের একাংশের আত্মহননের ঘটনাও কম নয়। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এক্ষেত্রে বেশি দায়ী। ধর্ষণের ক্ষেত্রে নারীকেই অপরাধী হিসাবে দেখা হয়। সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয় এ দুঃস্মৃতি। অপমান সহ্য করতে না পেরে বা বিচার না পেয়ে ভুক্তভোগীর পাশাপাশি অনেক অবিভাবকও আত্মহত্যা করে থাকে এ দেশে, এ শহরে। বড়ই মর্মান্তিক এ দৃশ্য! বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অবিচার, ক্ষমতার অপব্যবহার চরমভাবে দায়ী। স্থান-কাল-পাত্রভেদে এ শহর বা দেশে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে হয়। ঢাবির সাথে সাধারণ কলেজের অবস্থানে পার্থক্য অনেক। আবার সাধারণ কলেজের চেয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহার হয় বেশি। সাধারণের ক্ষেত্রে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ গল্পের মতো- ‘ঈশ্বর থাকেন ভদ্র পল্লীতে...’ এর মতো অবস্থা। এ দেশে জাস্টিসও স্থান-কাল-পাত্র ভেদ আছে! শুধু সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়।

বাস থেকে নামার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েটিকে জোর করে ধর্ষণ করা হয়েছে। মেয়েটি সাংস্কৃতিক কর্মী এবং ঢাবির ছাত্রী বলেই প্রতিবাদটা হয়েছে তাৎক্ষণিক এবং বেশি। সারাদেশে এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। তারমধ্যে কিছু কিছু ভিআইপি ঘটনা(!) জেগে ওঠে। অন্যগুলো আড়ালে প্রায় থেকেই যায়। আরেকটা বিষয় হলো, ‘সিলেক্টিভ জাস্টিস’। ‘অমুক করলে শাস্তি হবে, অমুক করলে হবে না’- এমন ধারণা থেকেও সমাজে বাড়ে অপরাধ প্রবণতা। এ রকম বৈষম্য মানসিকতা দূর করতে বা বাসিন্দাদের মধ্যে আস্থা আনতে প্রথমে সরকারের সংস্থাগুলোকেই দায়িত্ব নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী তো এসব বিষয়ে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখিয়ে যাচ্ছেন। তাকে সহযোগিতা আমাদেরও করতে হবে। সব জায়গায় কিছু খারাপ মানুষ থাকবেই। এসব শনাক্ত করেই বা এড়িয়ে চলেই ভালো কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবেই। ঢাকা বা দেশবাসিকে আস্থা আনতে বিকল্প কিছু আছে বলে মনে হয় না।

অবিচার ও অনাচার রুখতে গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীদের চাপ বাড়াতে হবে। আমরা দেখেছি, টাঙ্গাইলের রূপা হত্যার পর মাত্র ১৪ কর্মদিবসে এবং ফেনীর নুসরাত রাফি হত্যার বিচার ৬১ কর্মদিবসের মধ্যে আসামিদের ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে। নুসরাত হত্যায় গণমাধ্যমের কঠোর অবস্থানের প্রশংসাও করেছিল আদালত। তবে অজানা কারণে তনু হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়নি। প্রবলচাপে কুর্মিটোলায় ঢাবি ছাত্রীর ধর্ষক ‘সিরিয়াল রেপিস্ট’ খুব অল্পসময়েই গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রায় একই সময়ে ঢাবিতে চা-বিক্রেতা মামার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়ের বিচার চেয়ে প্রায় একাই ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শিশুরাও ধর্ষিত হচ্ছে এ শহরে। ধর্ষণের পর হত্যাও করা হচ্ছে শিশু-নারীর। বেশিরভাগ আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। এগুলো নিয়েও গণমাধ্যমকে চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। নারীকে নিরাপদ পরিবেশ করে দেয়া আমাদেরই দায়িত্ব।

দেশে বা রাজধানীতে যৌন হয়রানি, ছিনতাইসহ নানাবিধ কর্মকা- বেড়েই চলছে। আছে ডেঙ্গুর মতো মারাত্মক ব্যাধির নানা রকম উপসর্গ। নানারকম অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতির বাণী শুনতে শুনতে নগরবাসী আজ বড়ই ক্লান্ত। ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা’ হুমকির মুখে। গুজব আর জিজিটালের অপব্যবহারে নগরবাসী নাকাল। অনেক সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নগরবাসিকে ভোগান্তিতে ফেলছে। অহেতুক কিছু গুজব ছড়িয়ে দেশবাসীকে বিভ্রান্তিতে ফেলা হয়। কিছু শিক্ষিত মানুষও এসব অনৈতিক কাজে জড়িত। প্রধানমন্ত্রী না জেনে কোনো কিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার না করতে আহ্বান জানিয়েছে। আমাদের এগিয়ে আসতে হবেই।

ঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। বর্ষাকালে একটু কম থাকলেও গ্রীষ্মকাল ও শীতকালে অনেক দূষিত থাকে বায়ু। দিনে বা রাতে সবসময়ই বাতাসে অনিরাপদ জিনিসে ভরপুর। ধুলোবালিতে ভরপুর। নিয়নবাতি কেড়ে নিয়েছে ঢাকার স্নেহ ভালোবাসা। বিজ্ঞাপনে ছারখার ঢাকা। কবি শঙ্খ ঘোষের মুখ ‘ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ কবিতার কথা বলতেই হচ্ছে- ‘একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি/তোমার জন্যে গলির কোণে/ভাবি আমার মুখ দেখাব/মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।/...বিকিয়ে গেছে চোখের চাওয়া/তোমার সাথে ওতপ্রোত/নিয়ন আলোয় পণ্য হলো/যা কিছু আজ ব্যক্তিগত।/মুখের কথা একলা হয়ে/রইল পড়ে গলির কোণে/ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু/ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে।’

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা ১ কোটি ৮০লাখ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সালে এটা দ্বিগুণ হয়ে৩ কোটি ৫০ লাখ হবে। জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৪ হাজার ৫০০ মানুষ বাস করে। ঘনবসতির দিক দিয়ে বিশ্বে শীর্ষে অবস্থানে করছে আমাদের ঢাকা। ঢাকা শহরের উন্নয়ন কর্মকা-ের ওপর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, নগরীতে গড়ে ওঠা অবকাঠামোর ৭৩ শতাংশই পুরোপুরি অপরিকল্পিত। এর জন্য সাধারণ বাসিন্দারাও কম দায়ী নয়।

আমরা আইন না মানার সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী হয়ে গেছি। নারী ও শিশু নির্যাতনে ঢাকা অনিরাপদ শহরের তালিকায় শীর্ষের দিকেই রয়েছে ঢাকা শহর। প্রতারণা ও ছলচাতুরী ঢাকা শহরে অনেক বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যার যার ক্ষমতার মোহ বা আর্থিক মোহে একে অপরকে ঠকিয়েই যাচ্ছি। ঢাকা শহরে গতবছরে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে প্রায় সাড়ে ছয় শতাংশ। ২০১৮ সালেও বেড়েছিল ছয় শতাংশ। ক্রমান্বয়ে এ শহরের বাসিন্দাদের ব্যয় বাড়ছে। অবিচার ও বৈষম্য অপরাধীর সংখ্যা বাড়াচ্ছে।

সরকার চায় জনগণের মঙ্গলকর কিছু। কিন্তু বিভিন্ন কারণে পারে না। এক্ষেত্রে আমরাও দায়ী। আমরাও সরকারকে ঠিকমতো সহযোগিতা করি না। সরকারের সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলোকে সহযোগিতা করি না। এ থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে আমাদের। ‘আইন না মানার’ প্রবণতাও আছে আমাদের। এক্ষেত্রেও অপরিকল্পিত নগরায়ণ দায়ী। আমরা শুধু নিজেরটাই বুঝে নিতে চাই বা বুঝতে চাই। তাই সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করা শুধু সরকারের পক্ষে করা কঠিন। এক্ষেত্রে আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। জনসচেতনতা তৈরিতে গণমাধ্যমকে আরও বেশি অবদান রাখতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে।

[লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট]

বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২০ , ২ মাঘ ১৪২৬, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

অনিরাপদ ঢাকা শহর

আবু আফজাল সালেহ

ক্রমেই আমাদের প্রিয় শহর ঢাকা অনিরাপদ হয়ে যাচ্ছে। ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নেই বললেই চলে। অবকাঠামোগত নিরাপত্তা বিশ্বপ্রেক্ষাপটে একেবারেই নিচের দিকে। চলাফেরায় স্বাধীনতা বলতে গেলে হাস্যকরই। খাদ্যে ভেজাল ও মাছ-সবজিতে কৃত্রিমতা বা কেমিক্যাল খাদ্য নিরাপত্তাকে শূন্যে নিয়ে গেছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা। এ কারণের চাপে অপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত গ্রহণও নিতে হচ্ছে। অপরিকল্পিত ঊর্ধ্ব সম্প্রসারণ ঘটছে এ শহরে। ছোটছোট ঘরে করুণ কাহিনীও দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। জলধারাগুলো ভরাট ও দূষিত হচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত বাড়ছে। মেয়াদোত্তীর্ণ গণপরিবহন। নারীরা নিগৃহীত। শিশু থেকে বৃদ্ধা ধর্ষণ বেড়েই চলেছে। এসব অনাচারের বিচার চাইতে আন্দোলন, মানববন্ধন করতে হয় এ শহরে! এর চেয়ে লজ্জাজনক বিষয় হতে পারে? এসবের ইঙ্গিতই বলে দেয় ঢাকা ভালো নেই। এখানে বাসিন্দা ও মেহমানদের জন্য বড়ই অনিরাপদ।

‘ইকোনমিস্ট ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ)’ ও ‘সেইফ সিটি ইনডেক্সের (এসসিআই)’ সর্বশেষ প্রতিবেদনে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ শহরের তালিকায় নিচের দিক থেকে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে ঢাকা। প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, অবকাঠামোগত নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সূচকে ঢাকা খুবই বাজে অবস্থানে রয়েছে।

এ শহরে চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নানা অনিয়ম বিরাজমান। চিকিৎসাক্ষেত্রে নানা অসঙ্গতি। ‘ব্যবসা ব্যবসা’ মনোভাবই বেশি। বেকারত্বের হারও বাড়ছে। গণমাধ্যমে জানা যায় যে, গতবছর বেড়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ। যানজট, চুরি, ছিনতাই বেড়েই চলেছে। সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। পরমতসহিষ্ণুতা নেই-ই। ফলে এ শহরের বেশিরভাগ বাসিন্দা হতাশাতে ভুগে থাকে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় দেখা যায় যে, ঢাকার প্রায় ৭১ শতাংশ বাসিন্দা বিভিন্ন কারণে বিষণœতায় ভুগছে এবং ৬৮ শতাংশ মানুষ শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত। এ শহরের ৩ শতাংশ (প্রায় সাড়ে সাত লাখ) বাসিন্দা তিন বেলা খেতে পায় না। এ সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।

গত বছরের জানুয়ারিতে ডেমরার নুসরাত জাহান (৪) ও ফারিয়া দোলো (৫) নামে দুই শিশুকে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে হত্যা করা হয়। বছর পেরিয়ে গেলেও বিচার সমাপ্ত হয়নি। সাংবাদিক দম্পতির সাগর-রুনির হত্যার কূলকিনারা আজও পাওয়া যায়নি। বারবার পিছিয়ে যায় বিচারের তারিখ। এসব বিষয়ে আরও একটু সতর্ক ও নিরপেক্ষ হতে হবে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আমাদের সহায়তা করতে হবে। কিন্তু উভয়পক্ষই ব্যর্থ হচ্ছি।

ধর্ষিতাদের একাংশের আত্মহননের ঘটনাও কম নয়। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এক্ষেত্রে বেশি দায়ী। ধর্ষণের ক্ষেত্রে নারীকেই অপরাধী হিসাবে দেখা হয়। সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয় এ দুঃস্মৃতি। অপমান সহ্য করতে না পেরে বা বিচার না পেয়ে ভুক্তভোগীর পাশাপাশি অনেক অবিভাবকও আত্মহত্যা করে থাকে এ দেশে, এ শহরে। বড়ই মর্মান্তিক এ দৃশ্য! বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অবিচার, ক্ষমতার অপব্যবহার চরমভাবে দায়ী। স্থান-কাল-পাত্রভেদে এ শহর বা দেশে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে হয়। ঢাবির সাথে সাধারণ কলেজের অবস্থানে পার্থক্য অনেক। আবার সাধারণ কলেজের চেয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহার হয় বেশি। সাধারণের ক্ষেত্রে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ গল্পের মতো- ‘ঈশ্বর থাকেন ভদ্র পল্লীতে...’ এর মতো অবস্থা। এ দেশে জাস্টিসও স্থান-কাল-পাত্র ভেদ আছে! শুধু সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়।

বাস থেকে নামার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েটিকে জোর করে ধর্ষণ করা হয়েছে। মেয়েটি সাংস্কৃতিক কর্মী এবং ঢাবির ছাত্রী বলেই প্রতিবাদটা হয়েছে তাৎক্ষণিক এবং বেশি। সারাদেশে এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। তারমধ্যে কিছু কিছু ভিআইপি ঘটনা(!) জেগে ওঠে। অন্যগুলো আড়ালে প্রায় থেকেই যায়। আরেকটা বিষয় হলো, ‘সিলেক্টিভ জাস্টিস’। ‘অমুক করলে শাস্তি হবে, অমুক করলে হবে না’- এমন ধারণা থেকেও সমাজে বাড়ে অপরাধ প্রবণতা। এ রকম বৈষম্য মানসিকতা দূর করতে বা বাসিন্দাদের মধ্যে আস্থা আনতে প্রথমে সরকারের সংস্থাগুলোকেই দায়িত্ব নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী তো এসব বিষয়ে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখিয়ে যাচ্ছেন। তাকে সহযোগিতা আমাদেরও করতে হবে। সব জায়গায় কিছু খারাপ মানুষ থাকবেই। এসব শনাক্ত করেই বা এড়িয়ে চলেই ভালো কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবেই। ঢাকা বা দেশবাসিকে আস্থা আনতে বিকল্প কিছু আছে বলে মনে হয় না।

অবিচার ও অনাচার রুখতে গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীদের চাপ বাড়াতে হবে। আমরা দেখেছি, টাঙ্গাইলের রূপা হত্যার পর মাত্র ১৪ কর্মদিবসে এবং ফেনীর নুসরাত রাফি হত্যার বিচার ৬১ কর্মদিবসের মধ্যে আসামিদের ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে। নুসরাত হত্যায় গণমাধ্যমের কঠোর অবস্থানের প্রশংসাও করেছিল আদালত। তবে অজানা কারণে তনু হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়নি। প্রবলচাপে কুর্মিটোলায় ঢাবি ছাত্রীর ধর্ষক ‘সিরিয়াল রেপিস্ট’ খুব অল্পসময়েই গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রায় একই সময়ে ঢাবিতে চা-বিক্রেতা মামার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়ের বিচার চেয়ে প্রায় একাই ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শিশুরাও ধর্ষিত হচ্ছে এ শহরে। ধর্ষণের পর হত্যাও করা হচ্ছে শিশু-নারীর। বেশিরভাগ আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। এগুলো নিয়েও গণমাধ্যমকে চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। নারীকে নিরাপদ পরিবেশ করে দেয়া আমাদেরই দায়িত্ব।

দেশে বা রাজধানীতে যৌন হয়রানি, ছিনতাইসহ নানাবিধ কর্মকা- বেড়েই চলছে। আছে ডেঙ্গুর মতো মারাত্মক ব্যাধির নানা রকম উপসর্গ। নানারকম অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতির বাণী শুনতে শুনতে নগরবাসী আজ বড়ই ক্লান্ত। ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা’ হুমকির মুখে। গুজব আর জিজিটালের অপব্যবহারে নগরবাসী নাকাল। অনেক সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নগরবাসিকে ভোগান্তিতে ফেলছে। অহেতুক কিছু গুজব ছড়িয়ে দেশবাসীকে বিভ্রান্তিতে ফেলা হয়। কিছু শিক্ষিত মানুষও এসব অনৈতিক কাজে জড়িত। প্রধানমন্ত্রী না জেনে কোনো কিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার না করতে আহ্বান জানিয়েছে। আমাদের এগিয়ে আসতে হবেই।

ঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। বর্ষাকালে একটু কম থাকলেও গ্রীষ্মকাল ও শীতকালে অনেক দূষিত থাকে বায়ু। দিনে বা রাতে সবসময়ই বাতাসে অনিরাপদ জিনিসে ভরপুর। ধুলোবালিতে ভরপুর। নিয়নবাতি কেড়ে নিয়েছে ঢাকার স্নেহ ভালোবাসা। বিজ্ঞাপনে ছারখার ঢাকা। কবি শঙ্খ ঘোষের মুখ ‘ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ কবিতার কথা বলতেই হচ্ছে- ‘একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি/তোমার জন্যে গলির কোণে/ভাবি আমার মুখ দেখাব/মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।/...বিকিয়ে গেছে চোখের চাওয়া/তোমার সাথে ওতপ্রোত/নিয়ন আলোয় পণ্য হলো/যা কিছু আজ ব্যক্তিগত।/মুখের কথা একলা হয়ে/রইল পড়ে গলির কোণে/ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু/ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে।’

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা ১ কোটি ৮০লাখ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সালে এটা দ্বিগুণ হয়ে৩ কোটি ৫০ লাখ হবে। জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৪ হাজার ৫০০ মানুষ বাস করে। ঘনবসতির দিক দিয়ে বিশ্বে শীর্ষে অবস্থানে করছে আমাদের ঢাকা। ঢাকা শহরের উন্নয়ন কর্মকা-ের ওপর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, নগরীতে গড়ে ওঠা অবকাঠামোর ৭৩ শতাংশই পুরোপুরি অপরিকল্পিত। এর জন্য সাধারণ বাসিন্দারাও কম দায়ী নয়।

আমরা আইন না মানার সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী হয়ে গেছি। নারী ও শিশু নির্যাতনে ঢাকা অনিরাপদ শহরের তালিকায় শীর্ষের দিকেই রয়েছে ঢাকা শহর। প্রতারণা ও ছলচাতুরী ঢাকা শহরে অনেক বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যার যার ক্ষমতার মোহ বা আর্থিক মোহে একে অপরকে ঠকিয়েই যাচ্ছি। ঢাকা শহরে গতবছরে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে প্রায় সাড়ে ছয় শতাংশ। ২০১৮ সালেও বেড়েছিল ছয় শতাংশ। ক্রমান্বয়ে এ শহরের বাসিন্দাদের ব্যয় বাড়ছে। অবিচার ও বৈষম্য অপরাধীর সংখ্যা বাড়াচ্ছে।

সরকার চায় জনগণের মঙ্গলকর কিছু। কিন্তু বিভিন্ন কারণে পারে না। এক্ষেত্রে আমরাও দায়ী। আমরাও সরকারকে ঠিকমতো সহযোগিতা করি না। সরকারের সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলোকে সহযোগিতা করি না। এ থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে আমাদের। ‘আইন না মানার’ প্রবণতাও আছে আমাদের। এক্ষেত্রেও অপরিকল্পিত নগরায়ণ দায়ী। আমরা শুধু নিজেরটাই বুঝে নিতে চাই বা বুঝতে চাই। তাই সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করা শুধু সরকারের পক্ষে করা কঠিন। এক্ষেত্রে আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। জনসচেতনতা তৈরিতে গণমাধ্যমকে আরও বেশি অবদান রাখতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে।

[লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট]