ভেজাল ও নকল ওষুধের দৌরাত্ম্য

অনিমেষ বিথীকা

স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। সুস্বাস্থ্য রক্ষার্থে একমাত্র প্রয়োজন স্বাস্থ্য সচেতনতা, ডাক্তার ও ওষুধ। ওষুধই অসুস্থতার একমাত্র নিয়ামক। বর্তমানে বাংলাদেশে ওষুধ শিল্প অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক ভালো সময় পার করছে। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প দেশের প্রয়োজনীয় সকল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন করতে সমর্থ। বাংলাদেশে বর্তমানে ২৫৭টি কারখানায় প্রায় ২৪,০০০ ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদন হচ্ছে। দেশীয় কোম্পানিগুলো বছরে প্রায় ২৫,০০০ কোটি টাকার ওষুধ ও কাঁচামাল তৈরি করছে। এতে করে ২ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি দেশের প্রায় ৯৮ শতাংশ ওষুধের চাহিদা পূরণ করছে দেশীয় কোম্পানিগুলো। তাছাড়াও দেশের অর্থনীতিতে রাখছে বিরাট ভূমিকা। বাংলাদেশের উৎপাদিত ওষুধ যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রায় ১৪৫টি দেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। বাংলাদেশের উৎপাদিত ওষুধের চাহিদা ও ব্যবহার বিশ্ববাজারে বেড়েই চলেছে।

এত সব সুখবরের মধ্যে খারাপ খবরটা কোথায়? বিশ্ববাজারে যখন বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধের চাহিদা বেড়ে চলেছে ঠিক তখনই এর বিপরীত চিত্র দেশের ওষুধের বাজারে। দেশীয় বাজারে উৎপাদিত হচ্ছে ভেজাল ও নকল ওষুধ। যার ফলশ্রুতিতে ক্রমশই অস্থির হয়ে উঠছে ওষুধ শিল্প ও চিকিৎসা ব্যবস্থা। ভেজাল ও নকল ওষুধ এই শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারে এক বিরাট অশনিসংকেত। পরিসংখ্যান মতে, দেশীয় বাজারে ভেজাল ও নকল ওষুধের বার্ষিক বিক্রি প্রায় ১.৫ হাজার কোটি টাকার উপর। বিরাট অংকের ভেজাল ওষুধের বিক্রি থেকে সহজে অনুমান করা যায় বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের উৎপাদিত ওষুধের সুনাম থাকলেও দেশীয় বাজারে চলছে চরম অনিয়ম ও দুর্নীতি। এসব ভেজাল ও নকল ওষুধ বাণিজ্যের ফলে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ছে। ভেজাল ওষুধের ফলে রোগীর স্বাস্থ্যঝুঁকি ও প্রাণহানির ঘটনাও ক্রমশ বেড়ে চলেছে। ভেজাল ওষুধের বিক্রয় মানেই ভোক্তার সাথে প্রতারণা। যার ফলে ভোক্তার আর্থিক ক্ষতি, মানসিক বিড়ম্বনা এবং সেবা পণ্যের বদলে কিনে নিচ্ছেন অনর্থক দুর্ভোগ। ভেজাল ও নকল ওষুধ ব্যবহারের ফলে নিজেদের অজান্তেই সুস্থতার বদলে উল্টো দীর্ঘায়িত করছে অসুস্থতা। ভেজাল ও নকল ওষুধকে অসুস্থ ব্যক্তির জন্য ‘মরণ ফাঁদ’ বললেও ভুল হবে না।

দেশের ওষুধ বাজারে ভেজাল এবং নকল ওষুধের বাণিজ্য কতটা শক্ত হাতে দমন করছে প্রশাসন? ভেজাল ওষুধের বাণিজ্য বন্ধে ততটা আগ্রহী এবং তৎপর নয় প্রশাসন। দেশের মোট চাহিদার আনুমানিক ২০% ভেজাল ওষুধ উৎপাদিত হচ্ছে। প্রশাসনের পর্যাপ্ত তদারকি থাকলে উক্ত ২০% ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত সম্ভব হতো না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওষুধ শিল্পের অনিয়ম বন্ধ করার মতো তেমন কোনো বড় পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। সম্প্রতি বাংলাদেশে অনিয়ম ও দুর্নীতির জন্য বহুজাতিক কোম্পানি সানোফি, গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লিন নিজেদের ওষুধ উৎপাদন ও ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় দেশের নিজস্ব ওষুধ বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। এতে করে স্থানীয় বাজারে দেশীয় কোম্পানিগুলোর মধ্যে শুরু হয়েছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। ফলে পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থা হয়ে পড়ছে অস্থিতিশীল।

ভেজাল ও নকল ওষুধ বন্ধের জন্য প্রশাসন মাঝে মাঝে কিছু অভিযান পরিচালনা করে যা তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি ভেজাল ওষুধ বাণিজ্যে। সম্প্রতি, মহামান্য সুপ্রিমকোর্ট মানহীন ওষুধ তৈরির দায়ে কিছু কোম্পানির ওষুধ উৎপাদন বন্ধ রেখেছিল। ভ্রাম্যমাণ আদালতের ভাষ্যমতে এসব নোংরা বাণিজ্যতে দেশের প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তিবর্গ যুক্ত রয়েছেন। এসব ভেজাল ও নকল ওষুধ বাণিজ্যের শুরু কখন থেকে তা বলা মুশকিল কিন্তু শেষটা বলা সম্ভব, যদি প্রশাসন শক্ত হাতে দমন করে অসুস্থ ওষুধ বাণিজ্যকে। ভেজাল ওষুধ বাণিজ্য মূলত সিন্ডিকেট দ্বারা পরিচালিত হয়। প্রশাসন এসব সিন্ডিকেটকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে পারলে ভেজাল ও নকল ওষুধের বিপণন ও বাণিজ্য অনেকটাই কমে আসবে। ওষুধ বাজারে নিয়মিত মনিটরিং চালানো সম্ভব হলে অসাধু ব্যবসায়ীরা খোলা বাজারে ভোক্তার কাছে ভেজাল ওষুধ বিক্রি করতে পারত না। এসবের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি দরকার উৎপাদিত ওষুধের কারখানায় নজর রাখা যেন ভেজাল ও নকল ওষুধ উৎপাদন না হয়। ফার্মেসিগুলোতে রেজিস্টার্ড ফার্মাসিস্ট নিয়োগের যে বিধান রয়েছে তা প্রশাসন থেকে নিশ্চিত করা একান্ত আবশ্যক। সময় এসেছে ভেজাল ও নকল ওষুধ বাণিজ্য বন্ধের। ভেজাল ও নকল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন বন্ধের দাবি সব জনমহলে। ভেজালবিরোধী গতানুগতিক অভিযান না চালিয়ে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং যুগোপযোগী নতুন আইন প্রণয়ন করা খুবই জরুরি। বর্তমানে ওষুধের হীন ও অসুস্থ ব্যবসা নীতি যদি সরকার কঠোর হাতে দমন করে তবে, দেশ আরো একধাপ এগিয়ে যাবে এবং বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আরো প্রশংসিত হবে।

[লেখক : শিক্ষার্থী আইন বিভাগ, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়]

hossainimam445@gmail.com

বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২০ , ২ মাঘ ১৪২৬, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

ভেজাল ও নকল ওষুধের দৌরাত্ম্য

অনিমেষ বিথীকা

স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। সুস্বাস্থ্য রক্ষার্থে একমাত্র প্রয়োজন স্বাস্থ্য সচেতনতা, ডাক্তার ও ওষুধ। ওষুধই অসুস্থতার একমাত্র নিয়ামক। বর্তমানে বাংলাদেশে ওষুধ শিল্প অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক ভালো সময় পার করছে। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প দেশের প্রয়োজনীয় সকল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন করতে সমর্থ। বাংলাদেশে বর্তমানে ২৫৭টি কারখানায় প্রায় ২৪,০০০ ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদন হচ্ছে। দেশীয় কোম্পানিগুলো বছরে প্রায় ২৫,০০০ কোটি টাকার ওষুধ ও কাঁচামাল তৈরি করছে। এতে করে ২ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি দেশের প্রায় ৯৮ শতাংশ ওষুধের চাহিদা পূরণ করছে দেশীয় কোম্পানিগুলো। তাছাড়াও দেশের অর্থনীতিতে রাখছে বিরাট ভূমিকা। বাংলাদেশের উৎপাদিত ওষুধ যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রায় ১৪৫টি দেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। বাংলাদেশের উৎপাদিত ওষুধের চাহিদা ও ব্যবহার বিশ্ববাজারে বেড়েই চলেছে।

এত সব সুখবরের মধ্যে খারাপ খবরটা কোথায়? বিশ্ববাজারে যখন বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধের চাহিদা বেড়ে চলেছে ঠিক তখনই এর বিপরীত চিত্র দেশের ওষুধের বাজারে। দেশীয় বাজারে উৎপাদিত হচ্ছে ভেজাল ও নকল ওষুধ। যার ফলশ্রুতিতে ক্রমশই অস্থির হয়ে উঠছে ওষুধ শিল্প ও চিকিৎসা ব্যবস্থা। ভেজাল ও নকল ওষুধ এই শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারে এক বিরাট অশনিসংকেত। পরিসংখ্যান মতে, দেশীয় বাজারে ভেজাল ও নকল ওষুধের বার্ষিক বিক্রি প্রায় ১.৫ হাজার কোটি টাকার উপর। বিরাট অংকের ভেজাল ওষুধের বিক্রি থেকে সহজে অনুমান করা যায় বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের উৎপাদিত ওষুধের সুনাম থাকলেও দেশীয় বাজারে চলছে চরম অনিয়ম ও দুর্নীতি। এসব ভেজাল ও নকল ওষুধ বাণিজ্যের ফলে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ছে। ভেজাল ওষুধের ফলে রোগীর স্বাস্থ্যঝুঁকি ও প্রাণহানির ঘটনাও ক্রমশ বেড়ে চলেছে। ভেজাল ওষুধের বিক্রয় মানেই ভোক্তার সাথে প্রতারণা। যার ফলে ভোক্তার আর্থিক ক্ষতি, মানসিক বিড়ম্বনা এবং সেবা পণ্যের বদলে কিনে নিচ্ছেন অনর্থক দুর্ভোগ। ভেজাল ও নকল ওষুধ ব্যবহারের ফলে নিজেদের অজান্তেই সুস্থতার বদলে উল্টো দীর্ঘায়িত করছে অসুস্থতা। ভেজাল ও নকল ওষুধকে অসুস্থ ব্যক্তির জন্য ‘মরণ ফাঁদ’ বললেও ভুল হবে না।

দেশের ওষুধ বাজারে ভেজাল এবং নকল ওষুধের বাণিজ্য কতটা শক্ত হাতে দমন করছে প্রশাসন? ভেজাল ওষুধের বাণিজ্য বন্ধে ততটা আগ্রহী এবং তৎপর নয় প্রশাসন। দেশের মোট চাহিদার আনুমানিক ২০% ভেজাল ওষুধ উৎপাদিত হচ্ছে। প্রশাসনের পর্যাপ্ত তদারকি থাকলে উক্ত ২০% ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত সম্ভব হতো না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওষুধ শিল্পের অনিয়ম বন্ধ করার মতো তেমন কোনো বড় পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। সম্প্রতি বাংলাদেশে অনিয়ম ও দুর্নীতির জন্য বহুজাতিক কোম্পানি সানোফি, গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লিন নিজেদের ওষুধ উৎপাদন ও ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় দেশের নিজস্ব ওষুধ বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। এতে করে স্থানীয় বাজারে দেশীয় কোম্পানিগুলোর মধ্যে শুরু হয়েছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। ফলে পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থা হয়ে পড়ছে অস্থিতিশীল।

ভেজাল ও নকল ওষুধ বন্ধের জন্য প্রশাসন মাঝে মাঝে কিছু অভিযান পরিচালনা করে যা তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি ভেজাল ওষুধ বাণিজ্যে। সম্প্রতি, মহামান্য সুপ্রিমকোর্ট মানহীন ওষুধ তৈরির দায়ে কিছু কোম্পানির ওষুধ উৎপাদন বন্ধ রেখেছিল। ভ্রাম্যমাণ আদালতের ভাষ্যমতে এসব নোংরা বাণিজ্যতে দেশের প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তিবর্গ যুক্ত রয়েছেন। এসব ভেজাল ও নকল ওষুধ বাণিজ্যের শুরু কখন থেকে তা বলা মুশকিল কিন্তু শেষটা বলা সম্ভব, যদি প্রশাসন শক্ত হাতে দমন করে অসুস্থ ওষুধ বাণিজ্যকে। ভেজাল ওষুধ বাণিজ্য মূলত সিন্ডিকেট দ্বারা পরিচালিত হয়। প্রশাসন এসব সিন্ডিকেটকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে পারলে ভেজাল ও নকল ওষুধের বিপণন ও বাণিজ্য অনেকটাই কমে আসবে। ওষুধ বাজারে নিয়মিত মনিটরিং চালানো সম্ভব হলে অসাধু ব্যবসায়ীরা খোলা বাজারে ভোক্তার কাছে ভেজাল ওষুধ বিক্রি করতে পারত না। এসবের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি দরকার উৎপাদিত ওষুধের কারখানায় নজর রাখা যেন ভেজাল ও নকল ওষুধ উৎপাদন না হয়। ফার্মেসিগুলোতে রেজিস্টার্ড ফার্মাসিস্ট নিয়োগের যে বিধান রয়েছে তা প্রশাসন থেকে নিশ্চিত করা একান্ত আবশ্যক। সময় এসেছে ভেজাল ও নকল ওষুধ বাণিজ্য বন্ধের। ভেজাল ও নকল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন বন্ধের দাবি সব জনমহলে। ভেজালবিরোধী গতানুগতিক অভিযান না চালিয়ে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং যুগোপযোগী নতুন আইন প্রণয়ন করা খুবই জরুরি। বর্তমানে ওষুধের হীন ও অসুস্থ ব্যবসা নীতি যদি সরকার কঠোর হাতে দমন করে তবে, দেশ আরো একধাপ এগিয়ে যাবে এবং বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আরো প্রশংসিত হবে।

[লেখক : শিক্ষার্থী আইন বিভাগ, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়]

hossainimam445@gmail.com