ইরান সংকট

আফসানা রিজোয়ানা সুলতানা

ইরান মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র এবং সব থেকে জনবহুল দেশ। পারস্য উপসাগরের তীরে অবস্থিত হওয়ায় ভৌগোলিক দিক থেকে ইরানের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর দক্ষিণে রয়েছে পারস্য উপসাগর এবং উত্তরে পৃথিবীর সব থেকে বড় হ্রদ কাস্পিয়ান হ্রদ। পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রণালী হরমুজ প্রণালীও ইরানের সীমানায় রয়েছে। ইরান প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকেও বেশ সমৃদ্ধশালী। বিশ্বের সব থেকে বেশি গ্যাসের মজুদ রয়েছে ইরানে (১৫%) এবং তেল মজুদের দিক থেকে ইরান বিশ্বে চতুর্থ (১০%)।

মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরানের অনেক শত্রু ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল এবং সৌদি আরব সে তালিকায় শীর্ষে। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ইরানের ইসলামিক বিপ্লবের সময় থেকে।

১৯৫৩ সালে ইরানের ক্ষমতায় আসেন মোসাদ্দেক। তিনি ছিলেন ইরানের সর্বপ্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। তিনি যখন ক্ষমতায় আসেন তখন ইরানের তেল ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম নামে একটি বৃহদকার কোম্পানি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। মোসাদ্দেক ক্ষমতায় বসেই তেলের নিয়ন্ত্রণ ইরান সরকারের হাতে নিয়ে নেন। এতে করে ব্রিটিশরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে। তখন যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্য মিলে মোসাদ্দেকে ক্ষমতা থেকে সরানোর পরিকল্পনা করে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং ব্রিটিশ এমআইসিক্স অপারেশন এজাক্সের পরিকল্পনা করে। সে অনুযায়ী অভ্যুত্থান ঘটিয়ে মোসাদ্দেককে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ক্ষমতায় বসানো হয় মো. রেজা শাহ পাহলাভিকে। রেজা শাহ ক্ষমতায় বসে আবার যুক্তরাষ্ট্রে তেল রফতানি শুরু করেন। রেজা শাহের শাসন সে দেশের জনগণ বেশিদিন মেনে নেয়নি। ১৯৭৮ সালে ইরানের জনগণ তার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে। ৮ সেপ্টেম্বর জনগণের মিছিলে শাহের বাহিনী গুলি চালালে ইরানি জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং ইতিহাসে দিনটি ব্ল্যাক ফ্রাইডে হিসেবে পরিচিতি পায়। অবশেষে ১৬ জানুয়ারি ১৯৭৯ গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শাহের পতন ঘটে। ইরানে একটি ইসলামিক সরকার ক্ষমতায় বসে। ইরানের নুতন নাম করা হয় দ্য ইসলামিক রিপাবলিক অফ ইরান। পশ্চিমাদের সংস্কৃতি ত্যাগ করে ইসলামিক সংস্কৃতি গ্রহণ করা হয়েছিল বলে একে ইসলামী বিপ্লব বলা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এ বিপ্লবের মর্যাদাও অনেক। ফরাসি এবং বলশেভিক বিপ্লবের পরই ইরানের ইসলামী বিপ্লবের অবস্থান। তখন থেকেই ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সাপে নেউলে সম্পর্ক। এই সম্পর্কের আরও অবনতি হয় যখন যুক্তরাষ্ট্রের মদদে ইরাক ইরানে হামলা চালায়। ইরান যখন দেশ পুনর্গঠনে মনোযোগ দিবে ঠিক তখনই ইরানিদের মোকাবিলা করতে হয় ইরাকি হামলা। ৮ বছর ধরে চলে সেই যুদ্ধ।

ইরানে শাহ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের পরমাণু স্থাপনা তৈরি করার বিষয়ে চুক্তি হয়েছিল। সেখান থেকে ইসলামী বিপ্লবের পর যুক্তরাষ্ট্র সরে আসে। কিন্তু ইরান নিজেদের পারমানবিক কর্মসূচি চালু রাখে। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করছে কিন্তু ইরান বরাবরই দাবি করে আসছে যে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি পারমাণবিক বোমা তৈরির উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে না। কিন্তু তারপরও যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর অবরোধ আরোপ করে রেখেছে যার ফলে ইরানের অর্থনীতি আজ বিপর্যস্ত। বহু বছর পর ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শীতল সম্পর্কের অবসান ঘটান বারাক ওবামা। ইরানের সঙ্গে চুক্তি করে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করা এবং তার উপর নজরদারি করার মাধ্যমে ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ায় ইরানের অর্থনীতিও প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে সে চুক্তি বাতিল করায় ইরান আর যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আবার তলানিতে এসে ঠেকে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ছায়া যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের থেকে ইরানের সফলতার হার বেশি। আর সফলতার পিছনে যার ভূমিকা সব থেকে বেশি তিনি হলেন কাসেম সোলেইমানি। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরানের যে প্রভাব এটা সম্ভব হয়েছে কাসেম সোলেইমানির কারণে।

কাসেম সোলেইমানি ১৯৫৭ সালে ইরানের কারমান প্রদেশের একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার সামরিক প্রশিক্ষণের মেয়াদ মাত্র ৬ সপ্তাহ হলেও তার চিন্তাশক্তি আর সামরিক কৌশলের দিক থেকে তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ। সোলেইমানি ছিলেন ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের একজন কমান্ডার। রেভল্যুশনারি গার্ডের ‘কুদস ফোর্স’ সোলেইমানির নেতৃত্বেই পরিচালিত হতো। আর এই ‘কুদস ফোর্স’ এর সঙ্গে জড়িত ছিল লেবাননের হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের হামাস ও ইয়েমেনের হুতিরা। যার প্রত্যেকটিই যুক্তরাষ্ট্রের এবং ইসরায়েলের স্বার্থের প্রতি হুমকি স্বরূপ ছিল। এই সংগঠন গুলোর মাধ্যমে ইরান ধীরে ধীরে মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব বাড়াতে শুরু করে। ইয়েমেনে, সিরিয়া, লেবাননে তারা সফলও হয়। তাই যুক্তরাষ্ট্রের এবং ইসরায়েলের নিশানায় সোলেইমানি অনেক আগে থেকেই ছিলেন। ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ ২০১৮ সালের নভেম্বরে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে যেখানে বলা হয়েছে সাংবাদিক খাসোগিকে হত্যার অন্তত এক বছর আগে সোলেইমানিকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। বিশ্বের সব থেকে দক্ষ গোয়েন্দা সংস্থা যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ এবং ইসরাইলের মোসাদের হিট লিস্টের ১ নম্বরে ছিলেন সোলেইমানি। অবশেষে ৩ জানুয়ারি ট্রাম্পের নির্দেশে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে ড্রোন হামলার মাধ্যমে সোলেইমানিকে হত্যা করা হয়।

সোলেইমানিকে হত্যা করে ট্রাম্প বিশ্বব্যাপী সমালোচনার শিকার হয়েছেন। বিরোধীদল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতারা বলেছেন ট্রাম্প আমেরিকাকে আরও একটি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। কিন্তু ট্রাম্প এই ভুল কাজটি করবেন বলে মনে হয় না। কারণ তিনি ভালো করেই জানেন যে বেশির ভাগ মার্কিন জনগোষ্ঠীই চান না যে যুক্তরাষ্ট্র নুতন করে কোন যুদ্ধে জড়াক। সোলেইমানিকে হত্যা করে ট্রাম্প শুধু চেয়েছেন ইসরাইলি লবিকে খুশি করতে এবং তার বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে যে অভিশংসন চলছে সেদিক দিয়ে সবার মনোযোগ সরাতে। সেই সঙ্গে নভেম্বরের নির্বাচনের আগে একটি প্রচারণা চালানোর মতো রসদ জুগিয়ে রাখলেন ট্রাম্প। দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের আগে ওবামাও লাদেনকে হত্যা করেছিলেন। তখন লাদেন ছিল বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী। অবশ্য লাদেন এবং সোলেইমানি কোন দিক থেকেই এক নয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই সোলেইমানিকে সন্ত্রাসী হিসেবে প্রচার করে আসছে।

স্বাভাবিকভাবেই ইরান সোলেইমানি হত্যার কঠিন জবাব দেয়া হবে বলে হুশিয়ারি দেয় যুক্তরাষ্ট্রকে। ৮ জানুয়ারি ইরাকে অবস্থিত দুটি মার্কিন বিমান ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। ইরানের এক ক্ষেপণাস্ত্রের হামলায় ইউক্রেনের যাত্রীবাহী একটি বিমান বিধস্ত হয়। বিমানের ১৭৬ জন যাত্রীর সবাই নিহত হন। ইরান প্রথমে বিষয়টিকে অস্বীকার করলেও পরে যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার চাপে স্বীকার করে নেয়। নিহতদের প্রতি সমবেদনা জানানোর পাশাপাশি দেশটির শাসক দলের পদত্যাগের দাবি জানায় বিক্ষুব্ধ মানুষ। তাদের প্রতি সমর্থন জানান ট্রাম্প। রোববার থেকে শুরু হয় এই বিক্ষোভ। ইরানের শাসক দলকে এখন দেশের এই অভ্যন্তরীণ বিক্ষোভ মোকাবেলা করতে হবে। তাই বলা যায় সব মিলিয়ে দেশের ভিতরে আর বাইরে ইরানের শাসক দল একটি কঠিন সময় পার করছে। ইরান এ সংকট কিভাবে মোকাবিলা করে সেটি দেখতে হলে আমাদের আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।

তবে এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, ইরান সামরিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের থেকে পিছিয়ে থাকলেও তার সামরিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন সুযোগ নেই। উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরাকের পিছনে যুক্তরাষ্ট্র থাকলেও ইরান একাই সব মোকাবিলা করেছে। ৪০ বছর ধরে অবরোধ জারি করে ইরানের অর্থনীতিকে কিছুটা দুর্বল করে দিলেও ইরানের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। বরং পারমাণবিক দিক থেকে ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে ইরান। আর ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে আগ্রহ দেখাচ্ছে বিশ্ব পরাশক্তি রাশিয়া, চীন এবং আঞ্চলিক পরাশক্তি তুরস্ক।

শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী ২০২০ , ৩ মাঘ ১৪২৬, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

ইরান সংকট

আফসানা রিজোয়ানা সুলতানা

image

ইরান মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র এবং সব থেকে জনবহুল দেশ। পারস্য উপসাগরের তীরে অবস্থিত হওয়ায় ভৌগোলিক দিক থেকে ইরানের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর দক্ষিণে রয়েছে পারস্য উপসাগর এবং উত্তরে পৃথিবীর সব থেকে বড় হ্রদ কাস্পিয়ান হ্রদ। পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রণালী হরমুজ প্রণালীও ইরানের সীমানায় রয়েছে। ইরান প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকেও বেশ সমৃদ্ধশালী। বিশ্বের সব থেকে বেশি গ্যাসের মজুদ রয়েছে ইরানে (১৫%) এবং তেল মজুদের দিক থেকে ইরান বিশ্বে চতুর্থ (১০%)।

মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরানের অনেক শত্রু ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল এবং সৌদি আরব সে তালিকায় শীর্ষে। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ইরানের ইসলামিক বিপ্লবের সময় থেকে।

১৯৫৩ সালে ইরানের ক্ষমতায় আসেন মোসাদ্দেক। তিনি ছিলেন ইরানের সর্বপ্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। তিনি যখন ক্ষমতায় আসেন তখন ইরানের তেল ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম নামে একটি বৃহদকার কোম্পানি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। মোসাদ্দেক ক্ষমতায় বসেই তেলের নিয়ন্ত্রণ ইরান সরকারের হাতে নিয়ে নেন। এতে করে ব্রিটিশরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে। তখন যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্য মিলে মোসাদ্দেকে ক্ষমতা থেকে সরানোর পরিকল্পনা করে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং ব্রিটিশ এমআইসিক্স অপারেশন এজাক্সের পরিকল্পনা করে। সে অনুযায়ী অভ্যুত্থান ঘটিয়ে মোসাদ্দেককে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ক্ষমতায় বসানো হয় মো. রেজা শাহ পাহলাভিকে। রেজা শাহ ক্ষমতায় বসে আবার যুক্তরাষ্ট্রে তেল রফতানি শুরু করেন। রেজা শাহের শাসন সে দেশের জনগণ বেশিদিন মেনে নেয়নি। ১৯৭৮ সালে ইরানের জনগণ তার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে। ৮ সেপ্টেম্বর জনগণের মিছিলে শাহের বাহিনী গুলি চালালে ইরানি জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং ইতিহাসে দিনটি ব্ল্যাক ফ্রাইডে হিসেবে পরিচিতি পায়। অবশেষে ১৬ জানুয়ারি ১৯৭৯ গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শাহের পতন ঘটে। ইরানে একটি ইসলামিক সরকার ক্ষমতায় বসে। ইরানের নুতন নাম করা হয় দ্য ইসলামিক রিপাবলিক অফ ইরান। পশ্চিমাদের সংস্কৃতি ত্যাগ করে ইসলামিক সংস্কৃতি গ্রহণ করা হয়েছিল বলে একে ইসলামী বিপ্লব বলা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এ বিপ্লবের মর্যাদাও অনেক। ফরাসি এবং বলশেভিক বিপ্লবের পরই ইরানের ইসলামী বিপ্লবের অবস্থান। তখন থেকেই ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সাপে নেউলে সম্পর্ক। এই সম্পর্কের আরও অবনতি হয় যখন যুক্তরাষ্ট্রের মদদে ইরাক ইরানে হামলা চালায়। ইরান যখন দেশ পুনর্গঠনে মনোযোগ দিবে ঠিক তখনই ইরানিদের মোকাবিলা করতে হয় ইরাকি হামলা। ৮ বছর ধরে চলে সেই যুদ্ধ।

ইরানে শাহ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের পরমাণু স্থাপনা তৈরি করার বিষয়ে চুক্তি হয়েছিল। সেখান থেকে ইসলামী বিপ্লবের পর যুক্তরাষ্ট্র সরে আসে। কিন্তু ইরান নিজেদের পারমানবিক কর্মসূচি চালু রাখে। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করছে কিন্তু ইরান বরাবরই দাবি করে আসছে যে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি পারমাণবিক বোমা তৈরির উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে না। কিন্তু তারপরও যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর অবরোধ আরোপ করে রেখেছে যার ফলে ইরানের অর্থনীতি আজ বিপর্যস্ত। বহু বছর পর ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শীতল সম্পর্কের অবসান ঘটান বারাক ওবামা। ইরানের সঙ্গে চুক্তি করে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করা এবং তার উপর নজরদারি করার মাধ্যমে ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ায় ইরানের অর্থনীতিও প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে সে চুক্তি বাতিল করায় ইরান আর যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আবার তলানিতে এসে ঠেকে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ছায়া যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের থেকে ইরানের সফলতার হার বেশি। আর সফলতার পিছনে যার ভূমিকা সব থেকে বেশি তিনি হলেন কাসেম সোলেইমানি। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরানের যে প্রভাব এটা সম্ভব হয়েছে কাসেম সোলেইমানির কারণে।

কাসেম সোলেইমানি ১৯৫৭ সালে ইরানের কারমান প্রদেশের একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার সামরিক প্রশিক্ষণের মেয়াদ মাত্র ৬ সপ্তাহ হলেও তার চিন্তাশক্তি আর সামরিক কৌশলের দিক থেকে তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ। সোলেইমানি ছিলেন ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের একজন কমান্ডার। রেভল্যুশনারি গার্ডের ‘কুদস ফোর্স’ সোলেইমানির নেতৃত্বেই পরিচালিত হতো। আর এই ‘কুদস ফোর্স’ এর সঙ্গে জড়িত ছিল লেবাননের হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের হামাস ও ইয়েমেনের হুতিরা। যার প্রত্যেকটিই যুক্তরাষ্ট্রের এবং ইসরায়েলের স্বার্থের প্রতি হুমকি স্বরূপ ছিল। এই সংগঠন গুলোর মাধ্যমে ইরান ধীরে ধীরে মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব বাড়াতে শুরু করে। ইয়েমেনে, সিরিয়া, লেবাননে তারা সফলও হয়। তাই যুক্তরাষ্ট্রের এবং ইসরায়েলের নিশানায় সোলেইমানি অনেক আগে থেকেই ছিলেন। ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ ২০১৮ সালের নভেম্বরে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে যেখানে বলা হয়েছে সাংবাদিক খাসোগিকে হত্যার অন্তত এক বছর আগে সোলেইমানিকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। বিশ্বের সব থেকে দক্ষ গোয়েন্দা সংস্থা যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ এবং ইসরাইলের মোসাদের হিট লিস্টের ১ নম্বরে ছিলেন সোলেইমানি। অবশেষে ৩ জানুয়ারি ট্রাম্পের নির্দেশে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে ড্রোন হামলার মাধ্যমে সোলেইমানিকে হত্যা করা হয়।

সোলেইমানিকে হত্যা করে ট্রাম্প বিশ্বব্যাপী সমালোচনার শিকার হয়েছেন। বিরোধীদল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতারা বলেছেন ট্রাম্প আমেরিকাকে আরও একটি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। কিন্তু ট্রাম্প এই ভুল কাজটি করবেন বলে মনে হয় না। কারণ তিনি ভালো করেই জানেন যে বেশির ভাগ মার্কিন জনগোষ্ঠীই চান না যে যুক্তরাষ্ট্র নুতন করে কোন যুদ্ধে জড়াক। সোলেইমানিকে হত্যা করে ট্রাম্প শুধু চেয়েছেন ইসরাইলি লবিকে খুশি করতে এবং তার বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে যে অভিশংসন চলছে সেদিক দিয়ে সবার মনোযোগ সরাতে। সেই সঙ্গে নভেম্বরের নির্বাচনের আগে একটি প্রচারণা চালানোর মতো রসদ জুগিয়ে রাখলেন ট্রাম্প। দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের আগে ওবামাও লাদেনকে হত্যা করেছিলেন। তখন লাদেন ছিল বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী। অবশ্য লাদেন এবং সোলেইমানি কোন দিক থেকেই এক নয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই সোলেইমানিকে সন্ত্রাসী হিসেবে প্রচার করে আসছে।

স্বাভাবিকভাবেই ইরান সোলেইমানি হত্যার কঠিন জবাব দেয়া হবে বলে হুশিয়ারি দেয় যুক্তরাষ্ট্রকে। ৮ জানুয়ারি ইরাকে অবস্থিত দুটি মার্কিন বিমান ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। ইরানের এক ক্ষেপণাস্ত্রের হামলায় ইউক্রেনের যাত্রীবাহী একটি বিমান বিধস্ত হয়। বিমানের ১৭৬ জন যাত্রীর সবাই নিহত হন। ইরান প্রথমে বিষয়টিকে অস্বীকার করলেও পরে যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার চাপে স্বীকার করে নেয়। নিহতদের প্রতি সমবেদনা জানানোর পাশাপাশি দেশটির শাসক দলের পদত্যাগের দাবি জানায় বিক্ষুব্ধ মানুষ। তাদের প্রতি সমর্থন জানান ট্রাম্প। রোববার থেকে শুরু হয় এই বিক্ষোভ। ইরানের শাসক দলকে এখন দেশের এই অভ্যন্তরীণ বিক্ষোভ মোকাবেলা করতে হবে। তাই বলা যায় সব মিলিয়ে দেশের ভিতরে আর বাইরে ইরানের শাসক দল একটি কঠিন সময় পার করছে। ইরান এ সংকট কিভাবে মোকাবিলা করে সেটি দেখতে হলে আমাদের আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।

তবে এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, ইরান সামরিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের থেকে পিছিয়ে থাকলেও তার সামরিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন সুযোগ নেই। উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরাকের পিছনে যুক্তরাষ্ট্র থাকলেও ইরান একাই সব মোকাবিলা করেছে। ৪০ বছর ধরে অবরোধ জারি করে ইরানের অর্থনীতিকে কিছুটা দুর্বল করে দিলেও ইরানের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। বরং পারমাণবিক দিক থেকে ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে ইরান। আর ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে আগ্রহ দেখাচ্ছে বিশ্ব পরাশক্তি রাশিয়া, চীন এবং আঞ্চলিক পরাশক্তি তুরস্ক।