আবার কেজরিওয়াল!

মো. মাহবুবুল হক

‘অবিশ্যাস্য কেজরিওয়াল’ শিরোনামে একটি লেখা এ কাগজে আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগে ১২ জুলাই ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। তার খানিকটা হুবহু তুলে দিচ্ছি যা এ লেখাটির সঙ্গে মেলবন্ধন হিসেবে কাজ করতে পারে।

‘অরবিন্দ কেজরিওয়াল একজন গান্ধীবাদী, বয়স ৪৬। কলেজপড়ুয়া যুবকের মতোই দেখায় তাকে। তার দলের বিধায়কদের গড় বয়স ৩৫। ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠনে দিল্লি থেকে যে ২ লাখের মতো খুদে বার্তা এসেছিল তাদের অধিকাংশ বয়সে তরুণ। দুর্নীতি আন্দোলনে অগ্রজ, আন্না হাজারের হাত ধরে তার যাত্রা। লাজুক প্রকৃতির, মুখচোরা, মুখে একচিলতে হাসি লেগে থাকা একজন মানুষ। মাথায় গান্ধী টুপি, পরনে হাফ সোয়েটার। পেশায় প্রকৌশলী, বেসরকারি-সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। এক যুগ ধরে দুর্নীতির শিকার হয়ে মানুষের হয়রানি-জুলুম দেখেছেন। সরকারের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন। এক সময়ে জনস্বার্থে কাজ করে যাবেন বলে মনস্থির করেন। ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে ঝাঁটা প্রতীক নিয়ে ‘আম আদমি পার্টি’ (আপ) গঠন করেন। তিনি বলেছেন, রাজনীতিতে এসে অনেকে ক্যারিয়ার গড়ে। আমি ক্যারিয়ার ছেড়ে রাজনীতিতে এসেছি।’

কেজরিওয়াল সরকার তো তার বিধি-বদ্ধ সেবা দিয়েছে, মালামাল সরবরাহ করেনি। দিল্লি সরকারের চরিত্র তো কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের মতো রাজনৈতিক প্রকারের নয়। এটি স্থানীয় সরকার চরিত্রের। দুটি দুই রকম। কার্য-পরিধি, বিধানাদি, আয়-ব্যয় পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন। অতএব, কেজরিওয়াল সরকার যত খুশি সেবা দিয়ে যাক দিতে পারে। কারও আপত্তি থাকার কথা নয়

‘আগেই বলেছি আপ-এর প্রতীক ঝাঁটা। ঝাড়– দিয়ে যেমন ঘরদোর আবর্জনামুক্ত রাখা হয় তেমন সমাজ থেকে আবর্জনা ঝেড়ে ফেলার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে এটি। মোক্ষম প্রতিক বটে। আপ ২০১৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনে দিল্লির ৭০টি আসনের মধ্যে ২৮ পেয়ে কংগ্রেসের সমর্থনে সরকার গঠন করেছিল। যে দলের বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম সেটির সমর্থন কাজে লাগানো কতটুকু সমীচীন ছিল সময়ই বলে দিয়েছে। এবার তিনি এমনভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে যে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। ৬৭টি আসন গিয়েছে তার দলে, ৩টি বিজেপিতে আর কংগ্রেস শূন্য। উল্লেখ্য, তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় বিরোধী পক্ষের প্রতি কটাক্ষ করেননি। ফেব্রুয়ারি ১০ তারিখ ফলাফল যখন ঘোষণা হচ্ছিল, তখন হচকচিয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি ভয় পাচ্ছি’। এই ভেবে যে তার ওপর এত আস্থা, ওয়াদা পূরণ করতে পারবেন তো? দলের সমর্থকদের বলেছেন অহংকার না করতে। তার কথা-বার্তায় মনে হয় তার অবস্থান সাধারণ মানুষের কাতারে। দিল্লিবাসীর যা ছিল সব তাকে উজাড় করে দিয়েছে তা কবিগুরুর ভাষায় বলা যায়, ‘এত দিন তো বসেছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুনে/দেখা পেলেম ফাল্গুনে /বালক বীরের বেশে তুমি করলে বিশ্বজয় / একি যে বিস্ময় / অবাক আমি তরুণ গলার গান শুনে...’। দিল্লিওয়ালারা তারই আশায় হয়তো বসেছিলেন এত দিন।’

‘দিল্লিবাসীদের প্রতি তার দেয়া কয়েকটি প্রতিশ্রুতি এমন : (ক) দিল্লির পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা অর্জন। বাস্তবায়িত হলে শহরটি পূর্ণ প্রশাসনিক কর্তৃত্ব এ বিধানসভা সরকারের অধীনে ন্যস্ত হবে (খ) শহরে একাধিক বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সুবিধা। এমন হলে প্রতিযোগিতা তৈরি হবে বিলও কমবে, দুর্নীতি থাকলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা দুষ্করও হয়ে দাঁড়াতে পারে (গ) প্রতি পরিবারের জন্য ২০ হাজার লিটার পানি (২০ ঘন মিটার পানি) বিনা মূল্যে সরবরাহ করা। এ পরিমাণের মধ্যে মাস গুজরানো সম্ভব হলে সংসার খরচ অনেক বেঁচে যাবে ও (ঘ) দিল্লি ওয়াই-ফাই করা। তাহলে শহরবাসী অনেক কাজ ছুটাছুটি না করে ঘরে বসে বসে করতে পারবে।’

‘আপ দল ৪৯ দিন মেয়াদি সরকার আমলে আশার যে ঝিলিক দেখিয়েছিল তা দিল্লিবাসী ভোলেনি। দল প্রধানের সাদাসিধে, নিরহংকার, সৎ, সাহসী ও কর্তব্যপরায়ণতায় তারা মুগ্ধ হয়েছে। তক্কে তক্কে ছিল সুযোগ পেলে মতামতটা জানিয়ে দেবে। আর দেরি করেনি ২০১৫ সালে। দলটির ওপর দিল্লিবাসীর এমন অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন বড় দুটি দলের অন্তরাত্মা কিছুটা হলেও হেলিয়ে দিয়েছে বলে মনে হয়। তা না হলে বিধানসভা নির্বাচনের আগেই এ সরকার থেকে কিছু কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা কেড়ে নেবে কেন কেন্দ্র? আপ-এর দেনদরবার হেলাফেলার নয়, এ কথা কেন্দ্রকে মনে রাখতে হবে। এ দাবিতে দিল্লিবাসী একাট্টা। ফেলে দেয়া সহজ হবে বলে মনে হয় না।’

এ তো গেল প্রেক্ষাপট ও প্রতিশ্রুতির পালা। দিল্লি শহরবাসীদের কাছে মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালের গত ৫ বছরের হিসেব দেয়ার পালা। তাই ভারতের টিভি চ্যানেল ‘এনডিটিভি’ দিল্লির কন্নটপ্লেস ময়দানে আম জনতার সম্মুখে কেজরিওয়ালের সঙ্গে কথা আয়োজন করেছিল। বিষয়টির নাম ‘চিফ মিনিস্টার রিপোর্ট কার্ড’। স্কুলে পড়াকালীন সময়ে ষাণ্মাসিক বা বার্ষিক পরীক্ষান্তে শ্রেণী শিক্ষক একটি ‘প্রগ্রেস রিপোর্ট’ ধরিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘বাবাকে দেখিয়ে তার দস্তখতসহ জমা দেবে, কেমন?’ অনেকটা তেমনই লাগছে। গত ৫ বছরে দিল্লিতে যে কাজ হয়েছে তা নিয়ে কী নগরবাসী তুষ্ট না কী অসন্তুষ্ট। এই জানার প্রয়াস। মঞ্চে চ্যানেলের দুজন সাংবাদিক আর মুখ্যমন্ত্রী মুখোমুখি বসে আছেন। আর অগণিত মানুষ সামনে। তিল ধরার ঠাঁই নেই। কখনো সাংবাদিকদের কখনো উপবিষ্টদের থেকে ছোড়া প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তার দেয়া ফিরিস্তিগুলো তুলে ধরলাম।

দিল্লি শহর জুড়ে ২০ হাজার শ্রেণীকক্ষ গড়েছে কেজরিওয়াল সরকার। এমনভাবে যে নামিদামি প্রাইভেট স্কুল থেকে শিক্ষার্থীরা তার সরকারের করা স্কুলের দিকে ঝুঁকছে। আর যেসব স্কুল বেআইনিভাবে অতিরিক্ত ফি আদায় করেছে তাদের থেকে অতিরিক্ত অংশটুকু ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। বাচ্চারা খুশি তো বাবা-মায়েরা খুশি। ৪৫০টি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত স্বয়ংসম্পূর্ণ ‘মহল্লা ক্লিনিক’ করেছে। যেখানে ওষুধসহ সব ধরনের চিকিৎসাসেবা বিনা মূল্যে করা হয়ে থাকে। দিল্লিতেও ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিয়েছিল। উৎরে গিয়েছিল তাদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তির কারণে। প্রযুক্তির নাম ‘দাস হাফতা, দাস বাজে, দাস মিনিট’ (মর্ম জানা নেই)। আর বাসাবাড়িতে বিদ্যুৎ? ২০০ ইউনিট পর্যন্ত মুফতে। তারপর মিটার। পানি? প্রতিশ্রুত ২০ ঘন মিটার পানি সরবরাহ চলছে। সামান্য কিছু এলাকা ছাড়া বাকী সব এলাকাতে ‘সরাসরি ট্যাপ থেকে পানযোগ্য’ পানি। কম কথা নয় কিন্তু। সরকারি বাসে নারীদের ভাড়া লাগে না। আরেকটি যুগান্তকারী সুযোগ সৃষ্টি করেছে এ সরকার- ৭০টির মতো পরিসেবা মানুষ যাতে ঘরে বসে বিনা ঘুষে পেতে পারে। ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ বিভিন্ন ধরনের লাইসেন্স ও নানা সরকারি সার্টিফিকেট পেতে আর দালালদের খপ্পরে পড়তে হয় না। দিল্লিতে দুই লাখ সড়ক বাতি আর সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর কাজ চলছে। ফলে সন্ধ্যা নামার পর দিল্লি আলো ঝলমল করে। মদ্যপরা আর মাতলামির সুযোগ পায় না, দুষ্টু ছেলেরা মেয়েদের উত্ত্যক্ত করতে ভয় পায় আর মানুষ রাতে চলতে নিরাপদ বোধ করে। উপবিষ্টদের থেকে একজন জানতে চেয়েছেন যে, এতসব সেবা দিযে যাচ্ছেন, তার অর্থ জোগান কোথা থেকে হয়। উত্তরে যা বলেছেন তার মর্ম হচ্ছে কেন্দ্রের অনুদান ও দিল্লি সরকারের আয় থেকে মেটানো হয়। কাজ-কর্ম দুর্নীতিমুক্ত করাতে অর্থের সাশ্রয় হচ্ছে। আর মানুষ ট্যাক্স সেচ্ছায় বৃদ্ধি করেছে এই বলে যে তাদের সেবার জন্য যে সরকার খরচ করছে অর্থ দিলে আখেরে তাদেরই লাভ হবে। সাহসী আর সৎ পদক্ষেপের কারণে দিল্লির মানুষ কেজরিওয়াল ছাড়া আর কাউকে বোঝে না।

এসব ক্ষমতাসীন বিজেপির ভালো লাগে না। তারা বলে থাকেন, বিনা মূল্যে যেসব সেবা দেয়া হচ্ছে তা সংবিধানের লঙ্ঘন। কথাটা ঠিক। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রজোয্য নয়। দক্ষিণের একটি রাজ্যে ক্ষমতাসীন দল ঘোষণা দিল, রাজ্যে যাদের ঘরে বৈদ্যুতিক চুলা হিটার মিক্সার গ্রাইন্ডার ফ্রিজ ডিপ ফ্রিজ নেই সেগুলো বিনা মূল্যে সরকার সরবরাহ করবে। নির্বাচনে জিতেছে। বিরোধী পক্ষ মামলা করেছিল তবে রায় সরকারের পক্ষে গিয়েছে। দল নেতা ‘বালাজি’ বসে থাকেনি। ছুটেছে দিল্লিতে। সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছে। রায় তার পক্ষে গিয়েছে। তবে ৬ বছর চলে গিয়েছে। আদালত বলেছে, সরকারি অর্থ ব্যয়ে ভোটারদের প্রভাবান্বিত করা আইনের লঙ্ঘন। কেজরিওয়াল সরকার তো তার বিধি-বদ্ধ সেবা দিয়েছে, মালামাল সরবরাহ করেনি। দিল্লি সরকারের চরিত্র তো কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের মতো রাজনৈতিক প্রকারের নয়। এটি স্থানীয় সরকার চরিত্রের। দুটি দুই রকম। কার্য-পরিধি, বিধানাদি, আয়-ব্যয় পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন। অতএব, কেজরিওয়াল সরকার যত খুশি সেবা দিয়ে যাক দিতে পারে। কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। সাক্ষাৎকারে কেজরিওয়াল বলেছেন, তিনি বিভিন্ন মহল্লায় সময়ে সময়ে পরিদর্শনে গেলে মা-বোন-দাদি-নানী পর্যায়ের নাগরিক তাকে জিজ্ঞেস করত যে নির্বাচনের পর কী ফ্রি বাস থাকবে। তার উত্তর, তাকে ভোট দিলে থাকবে, বিজেপিকে দিলে থাকবে না। এ ফিরিস্তি শেষ হবার নয়।

প্রথম লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর একজন স্বনামধন্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বলেছিলেন, ‘আর টপিক খুঁজে পেলেন না লেখার?’ বলেছিলাম, ‘নগরপিতাদের ধারণা সমৃদ্ধ হলে আমাদের লাভ।’ ৫ বছর পেরিয়েছে। দিল্লি ঢাকায় নির্বাচন আসন্ন। ভোটের মাঠ গরম। ‘মুখ্যমন্ত্রী রিপোর্ট কার্ড’ পাওয়া গেছে। ‘মেয়র রিপোর্ট কার্ড’ কী পাওয়া যাবে?

[লেখক : পরিচালক, প্রকৌশল (সাবেক)

বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন]

শনিবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২০ , ৪ মাঘ ১৪২৬, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

আবার কেজরিওয়াল!

মো. মাহবুবুল হক

‘অবিশ্যাস্য কেজরিওয়াল’ শিরোনামে একটি লেখা এ কাগজে আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগে ১২ জুলাই ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। তার খানিকটা হুবহু তুলে দিচ্ছি যা এ লেখাটির সঙ্গে মেলবন্ধন হিসেবে কাজ করতে পারে।

‘অরবিন্দ কেজরিওয়াল একজন গান্ধীবাদী, বয়স ৪৬। কলেজপড়ুয়া যুবকের মতোই দেখায় তাকে। তার দলের বিধায়কদের গড় বয়স ৩৫। ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠনে দিল্লি থেকে যে ২ লাখের মতো খুদে বার্তা এসেছিল তাদের অধিকাংশ বয়সে তরুণ। দুর্নীতি আন্দোলনে অগ্রজ, আন্না হাজারের হাত ধরে তার যাত্রা। লাজুক প্রকৃতির, মুখচোরা, মুখে একচিলতে হাসি লেগে থাকা একজন মানুষ। মাথায় গান্ধী টুপি, পরনে হাফ সোয়েটার। পেশায় প্রকৌশলী, বেসরকারি-সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। এক যুগ ধরে দুর্নীতির শিকার হয়ে মানুষের হয়রানি-জুলুম দেখেছেন। সরকারের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন। এক সময়ে জনস্বার্থে কাজ করে যাবেন বলে মনস্থির করেন। ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে ঝাঁটা প্রতীক নিয়ে ‘আম আদমি পার্টি’ (আপ) গঠন করেন। তিনি বলেছেন, রাজনীতিতে এসে অনেকে ক্যারিয়ার গড়ে। আমি ক্যারিয়ার ছেড়ে রাজনীতিতে এসেছি।’

কেজরিওয়াল সরকার তো তার বিধি-বদ্ধ সেবা দিয়েছে, মালামাল সরবরাহ করেনি। দিল্লি সরকারের চরিত্র তো কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের মতো রাজনৈতিক প্রকারের নয়। এটি স্থানীয় সরকার চরিত্রের। দুটি দুই রকম। কার্য-পরিধি, বিধানাদি, আয়-ব্যয় পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন। অতএব, কেজরিওয়াল সরকার যত খুশি সেবা দিয়ে যাক দিতে পারে। কারও আপত্তি থাকার কথা নয়

‘আগেই বলেছি আপ-এর প্রতীক ঝাঁটা। ঝাড়– দিয়ে যেমন ঘরদোর আবর্জনামুক্ত রাখা হয় তেমন সমাজ থেকে আবর্জনা ঝেড়ে ফেলার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে এটি। মোক্ষম প্রতিক বটে। আপ ২০১৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনে দিল্লির ৭০টি আসনের মধ্যে ২৮ পেয়ে কংগ্রেসের সমর্থনে সরকার গঠন করেছিল। যে দলের বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম সেটির সমর্থন কাজে লাগানো কতটুকু সমীচীন ছিল সময়ই বলে দিয়েছে। এবার তিনি এমনভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে যে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। ৬৭টি আসন গিয়েছে তার দলে, ৩টি বিজেপিতে আর কংগ্রেস শূন্য। উল্লেখ্য, তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় বিরোধী পক্ষের প্রতি কটাক্ষ করেননি। ফেব্রুয়ারি ১০ তারিখ ফলাফল যখন ঘোষণা হচ্ছিল, তখন হচকচিয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি ভয় পাচ্ছি’। এই ভেবে যে তার ওপর এত আস্থা, ওয়াদা পূরণ করতে পারবেন তো? দলের সমর্থকদের বলেছেন অহংকার না করতে। তার কথা-বার্তায় মনে হয় তার অবস্থান সাধারণ মানুষের কাতারে। দিল্লিবাসীর যা ছিল সব তাকে উজাড় করে দিয়েছে তা কবিগুরুর ভাষায় বলা যায়, ‘এত দিন তো বসেছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুনে/দেখা পেলেম ফাল্গুনে /বালক বীরের বেশে তুমি করলে বিশ্বজয় / একি যে বিস্ময় / অবাক আমি তরুণ গলার গান শুনে...’। দিল্লিওয়ালারা তারই আশায় হয়তো বসেছিলেন এত দিন।’

‘দিল্লিবাসীদের প্রতি তার দেয়া কয়েকটি প্রতিশ্রুতি এমন : (ক) দিল্লির পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা অর্জন। বাস্তবায়িত হলে শহরটি পূর্ণ প্রশাসনিক কর্তৃত্ব এ বিধানসভা সরকারের অধীনে ন্যস্ত হবে (খ) শহরে একাধিক বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সুবিধা। এমন হলে প্রতিযোগিতা তৈরি হবে বিলও কমবে, দুর্নীতি থাকলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা দুষ্করও হয়ে দাঁড়াতে পারে (গ) প্রতি পরিবারের জন্য ২০ হাজার লিটার পানি (২০ ঘন মিটার পানি) বিনা মূল্যে সরবরাহ করা। এ পরিমাণের মধ্যে মাস গুজরানো সম্ভব হলে সংসার খরচ অনেক বেঁচে যাবে ও (ঘ) দিল্লি ওয়াই-ফাই করা। তাহলে শহরবাসী অনেক কাজ ছুটাছুটি না করে ঘরে বসে বসে করতে পারবে।’

‘আপ দল ৪৯ দিন মেয়াদি সরকার আমলে আশার যে ঝিলিক দেখিয়েছিল তা দিল্লিবাসী ভোলেনি। দল প্রধানের সাদাসিধে, নিরহংকার, সৎ, সাহসী ও কর্তব্যপরায়ণতায় তারা মুগ্ধ হয়েছে। তক্কে তক্কে ছিল সুযোগ পেলে মতামতটা জানিয়ে দেবে। আর দেরি করেনি ২০১৫ সালে। দলটির ওপর দিল্লিবাসীর এমন অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন বড় দুটি দলের অন্তরাত্মা কিছুটা হলেও হেলিয়ে দিয়েছে বলে মনে হয়। তা না হলে বিধানসভা নির্বাচনের আগেই এ সরকার থেকে কিছু কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা কেড়ে নেবে কেন কেন্দ্র? আপ-এর দেনদরবার হেলাফেলার নয়, এ কথা কেন্দ্রকে মনে রাখতে হবে। এ দাবিতে দিল্লিবাসী একাট্টা। ফেলে দেয়া সহজ হবে বলে মনে হয় না।’

এ তো গেল প্রেক্ষাপট ও প্রতিশ্রুতির পালা। দিল্লি শহরবাসীদের কাছে মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালের গত ৫ বছরের হিসেব দেয়ার পালা। তাই ভারতের টিভি চ্যানেল ‘এনডিটিভি’ দিল্লির কন্নটপ্লেস ময়দানে আম জনতার সম্মুখে কেজরিওয়ালের সঙ্গে কথা আয়োজন করেছিল। বিষয়টির নাম ‘চিফ মিনিস্টার রিপোর্ট কার্ড’। স্কুলে পড়াকালীন সময়ে ষাণ্মাসিক বা বার্ষিক পরীক্ষান্তে শ্রেণী শিক্ষক একটি ‘প্রগ্রেস রিপোর্ট’ ধরিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘বাবাকে দেখিয়ে তার দস্তখতসহ জমা দেবে, কেমন?’ অনেকটা তেমনই লাগছে। গত ৫ বছরে দিল্লিতে যে কাজ হয়েছে তা নিয়ে কী নগরবাসী তুষ্ট না কী অসন্তুষ্ট। এই জানার প্রয়াস। মঞ্চে চ্যানেলের দুজন সাংবাদিক আর মুখ্যমন্ত্রী মুখোমুখি বসে আছেন। আর অগণিত মানুষ সামনে। তিল ধরার ঠাঁই নেই। কখনো সাংবাদিকদের কখনো উপবিষ্টদের থেকে ছোড়া প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তার দেয়া ফিরিস্তিগুলো তুলে ধরলাম।

দিল্লি শহর জুড়ে ২০ হাজার শ্রেণীকক্ষ গড়েছে কেজরিওয়াল সরকার। এমনভাবে যে নামিদামি প্রাইভেট স্কুল থেকে শিক্ষার্থীরা তার সরকারের করা স্কুলের দিকে ঝুঁকছে। আর যেসব স্কুল বেআইনিভাবে অতিরিক্ত ফি আদায় করেছে তাদের থেকে অতিরিক্ত অংশটুকু ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। বাচ্চারা খুশি তো বাবা-মায়েরা খুশি। ৪৫০টি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত স্বয়ংসম্পূর্ণ ‘মহল্লা ক্লিনিক’ করেছে। যেখানে ওষুধসহ সব ধরনের চিকিৎসাসেবা বিনা মূল্যে করা হয়ে থাকে। দিল্লিতেও ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিয়েছিল। উৎরে গিয়েছিল তাদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তির কারণে। প্রযুক্তির নাম ‘দাস হাফতা, দাস বাজে, দাস মিনিট’ (মর্ম জানা নেই)। আর বাসাবাড়িতে বিদ্যুৎ? ২০০ ইউনিট পর্যন্ত মুফতে। তারপর মিটার। পানি? প্রতিশ্রুত ২০ ঘন মিটার পানি সরবরাহ চলছে। সামান্য কিছু এলাকা ছাড়া বাকী সব এলাকাতে ‘সরাসরি ট্যাপ থেকে পানযোগ্য’ পানি। কম কথা নয় কিন্তু। সরকারি বাসে নারীদের ভাড়া লাগে না। আরেকটি যুগান্তকারী সুযোগ সৃষ্টি করেছে এ সরকার- ৭০টির মতো পরিসেবা মানুষ যাতে ঘরে বসে বিনা ঘুষে পেতে পারে। ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ বিভিন্ন ধরনের লাইসেন্স ও নানা সরকারি সার্টিফিকেট পেতে আর দালালদের খপ্পরে পড়তে হয় না। দিল্লিতে দুই লাখ সড়ক বাতি আর সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর কাজ চলছে। ফলে সন্ধ্যা নামার পর দিল্লি আলো ঝলমল করে। মদ্যপরা আর মাতলামির সুযোগ পায় না, দুষ্টু ছেলেরা মেয়েদের উত্ত্যক্ত করতে ভয় পায় আর মানুষ রাতে চলতে নিরাপদ বোধ করে। উপবিষ্টদের থেকে একজন জানতে চেয়েছেন যে, এতসব সেবা দিযে যাচ্ছেন, তার অর্থ জোগান কোথা থেকে হয়। উত্তরে যা বলেছেন তার মর্ম হচ্ছে কেন্দ্রের অনুদান ও দিল্লি সরকারের আয় থেকে মেটানো হয়। কাজ-কর্ম দুর্নীতিমুক্ত করাতে অর্থের সাশ্রয় হচ্ছে। আর মানুষ ট্যাক্স সেচ্ছায় বৃদ্ধি করেছে এই বলে যে তাদের সেবার জন্য যে সরকার খরচ করছে অর্থ দিলে আখেরে তাদেরই লাভ হবে। সাহসী আর সৎ পদক্ষেপের কারণে দিল্লির মানুষ কেজরিওয়াল ছাড়া আর কাউকে বোঝে না।

এসব ক্ষমতাসীন বিজেপির ভালো লাগে না। তারা বলে থাকেন, বিনা মূল্যে যেসব সেবা দেয়া হচ্ছে তা সংবিধানের লঙ্ঘন। কথাটা ঠিক। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রজোয্য নয়। দক্ষিণের একটি রাজ্যে ক্ষমতাসীন দল ঘোষণা দিল, রাজ্যে যাদের ঘরে বৈদ্যুতিক চুলা হিটার মিক্সার গ্রাইন্ডার ফ্রিজ ডিপ ফ্রিজ নেই সেগুলো বিনা মূল্যে সরকার সরবরাহ করবে। নির্বাচনে জিতেছে। বিরোধী পক্ষ মামলা করেছিল তবে রায় সরকারের পক্ষে গিয়েছে। দল নেতা ‘বালাজি’ বসে থাকেনি। ছুটেছে দিল্লিতে। সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছে। রায় তার পক্ষে গিয়েছে। তবে ৬ বছর চলে গিয়েছে। আদালত বলেছে, সরকারি অর্থ ব্যয়ে ভোটারদের প্রভাবান্বিত করা আইনের লঙ্ঘন। কেজরিওয়াল সরকার তো তার বিধি-বদ্ধ সেবা দিয়েছে, মালামাল সরবরাহ করেনি। দিল্লি সরকারের চরিত্র তো কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের মতো রাজনৈতিক প্রকারের নয়। এটি স্থানীয় সরকার চরিত্রের। দুটি দুই রকম। কার্য-পরিধি, বিধানাদি, আয়-ব্যয় পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন। অতএব, কেজরিওয়াল সরকার যত খুশি সেবা দিয়ে যাক দিতে পারে। কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। সাক্ষাৎকারে কেজরিওয়াল বলেছেন, তিনি বিভিন্ন মহল্লায় সময়ে সময়ে পরিদর্শনে গেলে মা-বোন-দাদি-নানী পর্যায়ের নাগরিক তাকে জিজ্ঞেস করত যে নির্বাচনের পর কী ফ্রি বাস থাকবে। তার উত্তর, তাকে ভোট দিলে থাকবে, বিজেপিকে দিলে থাকবে না। এ ফিরিস্তি শেষ হবার নয়।

প্রথম লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর একজন স্বনামধন্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বলেছিলেন, ‘আর টপিক খুঁজে পেলেন না লেখার?’ বলেছিলাম, ‘নগরপিতাদের ধারণা সমৃদ্ধ হলে আমাদের লাভ।’ ৫ বছর পেরিয়েছে। দিল্লি ঢাকায় নির্বাচন আসন্ন। ভোটের মাঠ গরম। ‘মুখ্যমন্ত্রী রিপোর্ট কার্ড’ পাওয়া গেছে। ‘মেয়র রিপোর্ট কার্ড’ কী পাওয়া যাবে?

[লেখক : পরিচালক, প্রকৌশল (সাবেক)

বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন]