বিশেষ সুবিধায় ১৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল

নতুন করে দেয়া ঋণ পুনঃতফসিলের বিশেষ সুবিধায় ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ব্যাংকগুলো। সাড়ে ছয় হাজার আবেদনের বিপরীতে এসব ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়। উৎপাদনশীল খাতসহ অন্যান্য খাতে স্বাভাবিক ঋণপ্রবাহ বজায় রাখতে ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট সংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা জারি করা হয়েছে। এর অধীনে আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আবেদন বিবেচনা করতে পারবে ব্যাংকগুলো।

জানা যায়, ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো ১৩ হাজার ৩৬৮টি আবেদন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠিয়েছে। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৬ হাজার ৬৩২টি। নিষ্পত্তিকৃত আবেদনের মাধ্যমে মোট ১৪ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা ঋণ পুনঃতফসিল বা নিয়মিত করা হয়েছে। ঋণ নিয়মিত করে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যাংকগুলো ডাউন পেমেন্ট হিসেবে পেয়েছে ৪৪০ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোতে করা খেলাপিদের আবেদনের মধ্যে ঋণ পুনঃতফসিলে জন্য আবেদন করেছে ৮ হাজার ৫৪৬ জন আর এককালীন জমা দিয়ে ঋণ নিষ্পত্তি করতে আবেদন করেছে ৪ হাজার ৮২২ জন খেলাপি গ্রাহক। এসব আবেদনের মধ্যে ৩ হাজার ৮৮১ জনকে ঋণ পুনতফসিলের অনুমতি দেয়া হয়েছে। আর ২ হাজার ৭৫১ জনকে এককালীন জমা দিয়ে ঋণ নিষ্পত্তির (এককালীন এক্সিট) সুযোগ দিতে অনুমতি দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। অনুমোদন পাওয়া আবেদনের মাধ্যমে ১৩ হাজার ২১৫ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ নিয়মিত করা হয়েছে। যার বিপরীতে ডাউন পেমেন্ট পাওয়া গেছে ৩৯৭ কোটি টাকা। আর ৯২৯ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ এককালীন এক্সিটের সুযোগ গ্রহণ করেছে। যার বিপরীতে ৪৩ কোটি টাকা ডাউন পেমেন্ট পেয়েছে ব্যাংকগুলো। এসব আবেদনের মধ্যে সরকারি ব্যাংকগুলো করেছে ৪ হাজার ৯২টি। মোট আবেদনের যা প্রায় ৬২ শতাংশ। আর বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলো নিষ্পত্তি করেছে ২ হাজার ৫৪০টি। ঋণ নিয়মিত বা এককালীন এক্সিটের সুযোগ দিয়ে ব্যাংকগুলো ২ হাজার ৭ কোটি টাকা সুদ মওকুফ বা স্থগিত করেছে। আর অনারোপিত সুদ রয়েছে ৫ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা।

ব্যাংকের ঋণ মন্দ হয়ে পড়লে কীভাবে পুনঃতফসিল করা যাবে, এ নিয়ে ২০১২ সালে হালনাগাদ পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রণয়ন করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নীতিমালা মেনে ব্যাংকগুলো নিজেরাই ঋণ নিয়মিত করতে পারে। কিন্তু ওই নীতিমালার বাইরে বিশেষ বিবেচনায় ঋণ নিয়মিত করার অনুমোদন দেয়া শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেই বিশেষ বিবেচনার সিদ্ধান্ত এখন হিতে বিপরীত হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গত বছরের ১৬ মে ঋণ খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বলা হয়, ঋণখেলাপিরা মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়েই ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারবেন। পুনঃতফসিল হওয়া ঋণ পরিশোধে তারা সময় পাবেন টানা ১০ বছর। এক্ষেত্রে প্রথম এক বছর কোন কিস্তি দিতে হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই প্রজ্ঞাপনের কার্যকারিতা স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে সম্পূরক আবেদন করেন রিটকারী। গত ২১ মে হাইকোর্ট ওই প্রজ্ঞাপনের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করে। এই স্থিতাবস্থার আদেশ স্থগিত চেয়ে আবেদন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ৮ জুলাই আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশ দুই মাসের জন্য স্থগিত করে রুল শুনানির জন্য পক্ষদের নির্দেশ দেয়। পরে আদালতে আরেক শুনানি শেষে স্থগিতাদেশ তুলে নিয়ে বিশেষ সুবিধা বহাল রাখে। একই সঙ্গে আবেদনের সময় বাড়ানোর নির্দেশ দেয়। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে বিআরপিডি সার্কুলার নং-০৫/২০১৯ এর আওতায় ঋণগ্রহিতা কর্তৃক আবেদনের সময়সীমা ১৭ নভেম্বর থেকে ৯০ (নব্বই) দিন বৃদ্ধি করে।

জানা যায়, প্রতিদিন ব্যাংকগুলো ঋণ পুনঃতফসিলের শতাধিক ফাইল কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা নিজে গিয়ে তদবির করছেন, আবার ওপর মহল থেকেও তদবির করাচ্ছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩১ হাজার ১৭৫ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে। বছর শেষে তা ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। অথচ ২০১৮ সালের পুরো বছরে ২৩ হাজার ২১০ কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত হয়েছিল, ২০১৭ সালে যা ছিল ১৯ হাজার ১২০ কোটি টাকা। গত বছর সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা।

রবিবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২০ , ৫ মাঘ ১৪২৬, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

বিশেষ সুবিধায় ১৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল

রোকন মাহমুদ |

নতুন করে দেয়া ঋণ পুনঃতফসিলের বিশেষ সুবিধায় ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ব্যাংকগুলো। সাড়ে ছয় হাজার আবেদনের বিপরীতে এসব ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়। উৎপাদনশীল খাতসহ অন্যান্য খাতে স্বাভাবিক ঋণপ্রবাহ বজায় রাখতে ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট সংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা জারি করা হয়েছে। এর অধীনে আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আবেদন বিবেচনা করতে পারবে ব্যাংকগুলো।

জানা যায়, ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো ১৩ হাজার ৩৬৮টি আবেদন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠিয়েছে। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৬ হাজার ৬৩২টি। নিষ্পত্তিকৃত আবেদনের মাধ্যমে মোট ১৪ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা ঋণ পুনঃতফসিল বা নিয়মিত করা হয়েছে। ঋণ নিয়মিত করে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যাংকগুলো ডাউন পেমেন্ট হিসেবে পেয়েছে ৪৪০ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোতে করা খেলাপিদের আবেদনের মধ্যে ঋণ পুনঃতফসিলে জন্য আবেদন করেছে ৮ হাজার ৫৪৬ জন আর এককালীন জমা দিয়ে ঋণ নিষ্পত্তি করতে আবেদন করেছে ৪ হাজার ৮২২ জন খেলাপি গ্রাহক। এসব আবেদনের মধ্যে ৩ হাজার ৮৮১ জনকে ঋণ পুনতফসিলের অনুমতি দেয়া হয়েছে। আর ২ হাজার ৭৫১ জনকে এককালীন জমা দিয়ে ঋণ নিষ্পত্তির (এককালীন এক্সিট) সুযোগ দিতে অনুমতি দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। অনুমোদন পাওয়া আবেদনের মাধ্যমে ১৩ হাজার ২১৫ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ নিয়মিত করা হয়েছে। যার বিপরীতে ডাউন পেমেন্ট পাওয়া গেছে ৩৯৭ কোটি টাকা। আর ৯২৯ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ এককালীন এক্সিটের সুযোগ গ্রহণ করেছে। যার বিপরীতে ৪৩ কোটি টাকা ডাউন পেমেন্ট পেয়েছে ব্যাংকগুলো। এসব আবেদনের মধ্যে সরকারি ব্যাংকগুলো করেছে ৪ হাজার ৯২টি। মোট আবেদনের যা প্রায় ৬২ শতাংশ। আর বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলো নিষ্পত্তি করেছে ২ হাজার ৫৪০টি। ঋণ নিয়মিত বা এককালীন এক্সিটের সুযোগ দিয়ে ব্যাংকগুলো ২ হাজার ৭ কোটি টাকা সুদ মওকুফ বা স্থগিত করেছে। আর অনারোপিত সুদ রয়েছে ৫ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা।

ব্যাংকের ঋণ মন্দ হয়ে পড়লে কীভাবে পুনঃতফসিল করা যাবে, এ নিয়ে ২০১২ সালে হালনাগাদ পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রণয়ন করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নীতিমালা মেনে ব্যাংকগুলো নিজেরাই ঋণ নিয়মিত করতে পারে। কিন্তু ওই নীতিমালার বাইরে বিশেষ বিবেচনায় ঋণ নিয়মিত করার অনুমোদন দেয়া শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেই বিশেষ বিবেচনার সিদ্ধান্ত এখন হিতে বিপরীত হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গত বছরের ১৬ মে ঋণ খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বলা হয়, ঋণখেলাপিরা মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়েই ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারবেন। পুনঃতফসিল হওয়া ঋণ পরিশোধে তারা সময় পাবেন টানা ১০ বছর। এক্ষেত্রে প্রথম এক বছর কোন কিস্তি দিতে হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই প্রজ্ঞাপনের কার্যকারিতা স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে সম্পূরক আবেদন করেন রিটকারী। গত ২১ মে হাইকোর্ট ওই প্রজ্ঞাপনের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করে। এই স্থিতাবস্থার আদেশ স্থগিত চেয়ে আবেদন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ৮ জুলাই আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশ দুই মাসের জন্য স্থগিত করে রুল শুনানির জন্য পক্ষদের নির্দেশ দেয়। পরে আদালতে আরেক শুনানি শেষে স্থগিতাদেশ তুলে নিয়ে বিশেষ সুবিধা বহাল রাখে। একই সঙ্গে আবেদনের সময় বাড়ানোর নির্দেশ দেয়। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে বিআরপিডি সার্কুলার নং-০৫/২০১৯ এর আওতায় ঋণগ্রহিতা কর্তৃক আবেদনের সময়সীমা ১৭ নভেম্বর থেকে ৯০ (নব্বই) দিন বৃদ্ধি করে।

জানা যায়, প্রতিদিন ব্যাংকগুলো ঋণ পুনঃতফসিলের শতাধিক ফাইল কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা নিজে গিয়ে তদবির করছেন, আবার ওপর মহল থেকেও তদবির করাচ্ছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩১ হাজার ১৭৫ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে। বছর শেষে তা ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। অথচ ২০১৮ সালের পুরো বছরে ২৩ হাজার ২১০ কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত হয়েছিল, ২০১৭ সালে যা ছিল ১৯ হাজার ১২০ কোটি টাকা। গত বছর সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা।