আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস এবং রিলায়েন্স ফাইন্যান্স কোম্পানির শীর্ষ পদে থেকে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লুটে দিয়ে এখন বিদেশে হাওয়া খেয়ে বেড়াচ্ছে এরআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার। অর্থলুটের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধানকালে প্রশাস্ত কুমার হালদারের বিদেশ যাত্রায় দুদক থেকে নিষেধাজ্ঞা থাকলে কৌশলে দেশ ছেড়ে এখন বিদেশে অবস্থান করতেন তিনি। গত নভেম্বর মাসে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস এবং রিলায়েন্স ফাইন্যান্স কোম্পানির টাকা আত্মসাতের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করেন দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান। প্রশাস্ত কুমার হালদারের বিরুদ্ধে ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ বাদী হয়ে একটি মামলাও করেছেন।
দুদক সূত্র জানায়, প্রশান্ত কুমার হালদার যে শুধু পিপলস লিজিং এবং রিলায়েন্সের অর্থ লুট করেছে তা নয়, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) এবং এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের শীর্ষ পদে থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন। এসব সব প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন ও নতুন আরও কিছু কাগুজে প্রতিষ্ঠান তৈরির মাধ্যমে প্রায় তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা আত্মসাত করে তা বিদেশে পাচার করেছেন প্রশান্ত কুমার হালদার। দুদকের অনুসন্ধান চলাকালে কৌশলে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। ক্যাসিনো অভিযানের মধ্যে দুদক কর্তৃক দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের পর্যায়ে প্রশান্ত কুমার হালদারের বিরুদ্ধে ২৭৫ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেন দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ। ওই মামলার আগেই তিনি দেশ ছেড়ে লাপাত্তা হন। দুদক চেষ্টা করছে প্রশাস্ত কুমার হালদারকে কিভাবে বিদেশ থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা যায়।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস এবং রিলায়েন্স ফাইন্যান্স কোম্পানির আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে অনুসন্ধানে দুদকের উপপরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধানকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হলে পিপলস লিজিং কোম্পানি ও রিলায়েন্স ফ্যাইন্স্যান্সের গত ৪ বছরে (২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত) দায়িত্বে থাকা বোর্ড অব ডিরেক্টটরদের নামসহ যাবতীয় নথিপত্র তলব করে চিঠি পাঠানো হয়েছে। গত বছরের ১৩ নভেম্বরের মধ্যে ওই দুই প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় নথিপত্র দুদকে পৌঁছানোর জন্য বলা হয়েছে। তথ্য চেয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পিপলস লিজিং এবং রিলায়েন্স ফাইনেন্সের কাছে পত্র দেয়া হয়েছে। এছাড়া জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদারকে দুদকে তলব করে গত বছরের ১৪ নভেম্বর হাজির থাকতে বলা হয়েছে। ওই চিঠিতে তার সব ব্যাংক অ্যাকাউন্টেরও তথ্য চাওয়া হয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়. রিলায়েন্স ফাইনান্সের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদার প্রতিষ্ঠানের এমডি থাকা অবস্থায় তার আত্মীয়স্বজনকে দিয়ে আরও বেশ কয়েকটি লিজিং কোম্পানির ইনডিপেন্ডেন পরিচালক বানান। একক কর্তৃত্বে অদৃশ্য শক্তির মাধ্যমে পিপলস লিজিংসহ বেশ কয়েকটি লিজিং কোম্পানির টাকা বিভিন্ন কৌশলে বের করে আত্মসাত করেন। পিপলস লিজিং এ আমানতকারীদের ৩ হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন কৌশলে আত্মসাত করার অভিযোগ রিলায়েন্সের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদারের বিরুদ্ধে। মূলত পিপলস লিজিং কোম্পানি দেওলিয়া ঘোষণা করে বন্ধ হওয়ার নেপথ্যে বড় ভূমিকা ছিল প্রশান্ত কুমার হালদারের বিরুদ্ধে। এ সব কোম্পানির স্থাবর সম্পদ বিক্রি করে দিয়ে আমানতকারীদের শেয়ার পোর্টফোলিও থেকে শেয়ার বিক্রি করে সব অর্থ আত্মসাত করেন প্রশাস্ত কুমার হালদার।
দুদক সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে পিপলস লিজিং কোম্পানি দেওলিয়া ঘোষণা করে কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। কোম্পানিটির কাছে বিভিন্ন বিনিয়োগকারী গ্রাহকরা ১৫শ’ কোটি টাকার মতো পাওয়া ছিল। কোম্পানির মাধ্যমে শেয়ার ক্রয়কারী গ্রাহকরা ওই অবস্থায় চরম বিপাকে পড়েন। লভ্যাংশ ঘোষণা করেও শেয়ার হোল্ডারদের লভ্যাংশ না দেয়ার অভিযোগ পিপলস লিজিং কোম্পানির বিরুদ্ধে। গ্রাহকদের অর্থ ফিরিয়ে দেয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রচেষ্টা চালানো হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে পিপলস লিজিং কোম্পানিতে যে সব গ্রাহকরা অর্থ পাবেন তাদের অর্থ ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। এর আগে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের সাবেক নয় পরিচালক ও দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। সূত্র জানায়, পিপলসের বোড অব ডিরেক্টরিতে প্রশাস্ত কুমার হালদার তার নিজস্ব আত্মীয়স্বজনদের বসান। তারা বোর্ড অব ডিরেক্টর হিসেবে থাকলেও একক ক্ষমতা ছিল প্রশাস্ত কুমার হালদারের। ২০০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পিপলসের বোড অব ডিকেক্টর হিসেবে প্রশাস্ত কুমার হালদারের বেশ কয়েকজন নিকট আত্মীয় ছিলেন। তাদের মাধ্যমে এ প্রতিষ্ঠানের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন প্রশান্ত কুমার হালদার।
দুদক সূত্র জানায় প্রশাস্তের বিরুদ্ধে ২২৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অভিযোগে করা মামলায় বলা হয়েছে, প্রশান্ত কুমার হালদার ও তার স্বার্থ–সংশ্লিষ্টদের ব্যাংক হিসাবে সন্দেহজনক ১ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকার লেনদেনের বিষয়ে তথ্য ছিল। কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা থাকা অবস্থায় ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, কর ফাঁকির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থের মালিক হয়েছেন প্রশাস্ত কুমার হালদার। পরে অর্থ লুট ও আত্মসাতের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গিয়ে দুদক বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) তদন্ত করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করার জন্য অনুরোধ করে। দুদকের অনুরোধে প্রশাস্ত কুমার হালদারের অর্থ লেনদেন নিয়ে এক বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করে বিএফআইইউ। তদন্তে ভয়াবহ জালিয়াতি এবং অর্থ লুটের কাহিনী বের হয়ে আসে। ওই প্রতিবেদন চেয়েছে বর্তমান অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান। গত ১২ জানুয়ারি পাঠানো চিঠিতে পিপলস লিজিংয়ের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে কয়েকশত কোটি টাকার লেনদেনের নথিপত্র, এর সঙ্গে যত অ্যাকাউন্ট হোল্ডার রয়েছে তাদের নাম-পরিচয়, কোন কোন প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে তা দিতে বলা হয়েছে। প্রশান্ত কুমারের যেসব আত্মীয়স্বজন এ অর্থ লুটের সঙ্গে জড়িত বা সহয়তা করেছে তাদের নাম-পরিচয়সহ বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে। চিঠিতে গতকালের মধ্যে নথিপত্র দুদকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠানোর কথা ছিল। দুদক সূত্র জানায়, ক্যাসিনোবিরোধী সাম্প্রতিক শুদ্ধি অভিযানের পরপরই প্রশাস্ত কুমার হালদারের নাম ওঠে আসে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গত বছরের ১৪ নভেম্বর হাজির হতে নোটিশ দিয়েছিল দুদক অনুসন্ধান কর্মকর্তা গুলশান আনোয়ার প্রধান। এর আগে গত বছরের ৩ অক্টোবর তার বিদেশযাত্রায়ও নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে সূত্র জানায়, প্রশাস্ত কুমার হালদার ও তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে জমা হয় প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা, প্রশান্ত কুমার হালদারের ব্যক্তিগত হিসাবে ২৪০ কোটি টাকা এবং তার মা লীলাবতী হালদারের হিসাবে জমা হয় ১৬০ কোটি টাকা। এসব অর্থের মধ্যে এসব হিসাবে এখন জমা আছে মাত্র ১০ কোটি টাকার কম। প্রশান্ত কুমার হালদার এক ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকেই ২ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ বের করে নিয়েছেন। এসব টাকা দিয়েই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানা কেনা হয়। তবে ঋণ নেয়া পুরো টাকার হদিস মিলছে না। ২০১৪ সালে কমপক্ষে চারটি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) মালিকানায় অস্বাভাবিক পরিবর্তন আসে। সেই চার প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা এখন চরম খারাপ। একটি বিলুপ্তের পথে, বাকি তিনটিও গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। নানা কৌশল করে এসব প্রতিষ্ঠান দখল করার জন্য নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলেছেন, শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনেছেন, দখল করা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের নামে টাকাও সরিয়েছেন। এমনকি দেশের বাইরেও কোম্পানি খুলেছেন। এসব কাজ করেছেন প্রশান্ত কুমার হালদার একাই। আর এসব কাজে তাকে সব ধরনের সমর্থন ও সহায়তা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা।
রবিবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২০ , ৫ মাঘ ১৪২৬, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১
সাইফ বাবলু
আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস এবং রিলায়েন্স ফাইন্যান্স কোম্পানির শীর্ষ পদে থেকে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লুটে দিয়ে এখন বিদেশে হাওয়া খেয়ে বেড়াচ্ছে এরআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার। অর্থলুটের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধানকালে প্রশাস্ত কুমার হালদারের বিদেশ যাত্রায় দুদক থেকে নিষেধাজ্ঞা থাকলে কৌশলে দেশ ছেড়ে এখন বিদেশে অবস্থান করতেন তিনি। গত নভেম্বর মাসে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস এবং রিলায়েন্স ফাইন্যান্স কোম্পানির টাকা আত্মসাতের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করেন দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান। প্রশাস্ত কুমার হালদারের বিরুদ্ধে ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ বাদী হয়ে একটি মামলাও করেছেন।
দুদক সূত্র জানায়, প্রশান্ত কুমার হালদার যে শুধু পিপলস লিজিং এবং রিলায়েন্সের অর্থ লুট করেছে তা নয়, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) এবং এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের শীর্ষ পদে থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন। এসব সব প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন ও নতুন আরও কিছু কাগুজে প্রতিষ্ঠান তৈরির মাধ্যমে প্রায় তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা আত্মসাত করে তা বিদেশে পাচার করেছেন প্রশান্ত কুমার হালদার। দুদকের অনুসন্ধান চলাকালে কৌশলে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। ক্যাসিনো অভিযানের মধ্যে দুদক কর্তৃক দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের পর্যায়ে প্রশান্ত কুমার হালদারের বিরুদ্ধে ২৭৫ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেন দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ। ওই মামলার আগেই তিনি দেশ ছেড়ে লাপাত্তা হন। দুদক চেষ্টা করছে প্রশাস্ত কুমার হালদারকে কিভাবে বিদেশ থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা যায়।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস এবং রিলায়েন্স ফাইন্যান্স কোম্পানির আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে অনুসন্ধানে দুদকের উপপরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধানকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হলে পিপলস লিজিং কোম্পানি ও রিলায়েন্স ফ্যাইন্স্যান্সের গত ৪ বছরে (২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত) দায়িত্বে থাকা বোর্ড অব ডিরেক্টটরদের নামসহ যাবতীয় নথিপত্র তলব করে চিঠি পাঠানো হয়েছে। গত বছরের ১৩ নভেম্বরের মধ্যে ওই দুই প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় নথিপত্র দুদকে পৌঁছানোর জন্য বলা হয়েছে। তথ্য চেয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পিপলস লিজিং এবং রিলায়েন্স ফাইনেন্সের কাছে পত্র দেয়া হয়েছে। এছাড়া জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদারকে দুদকে তলব করে গত বছরের ১৪ নভেম্বর হাজির থাকতে বলা হয়েছে। ওই চিঠিতে তার সব ব্যাংক অ্যাকাউন্টেরও তথ্য চাওয়া হয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়. রিলায়েন্স ফাইনান্সের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদার প্রতিষ্ঠানের এমডি থাকা অবস্থায় তার আত্মীয়স্বজনকে দিয়ে আরও বেশ কয়েকটি লিজিং কোম্পানির ইনডিপেন্ডেন পরিচালক বানান। একক কর্তৃত্বে অদৃশ্য শক্তির মাধ্যমে পিপলস লিজিংসহ বেশ কয়েকটি লিজিং কোম্পানির টাকা বিভিন্ন কৌশলে বের করে আত্মসাত করেন। পিপলস লিজিং এ আমানতকারীদের ৩ হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন কৌশলে আত্মসাত করার অভিযোগ রিলায়েন্সের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদারের বিরুদ্ধে। মূলত পিপলস লিজিং কোম্পানি দেওলিয়া ঘোষণা করে বন্ধ হওয়ার নেপথ্যে বড় ভূমিকা ছিল প্রশান্ত কুমার হালদারের বিরুদ্ধে। এ সব কোম্পানির স্থাবর সম্পদ বিক্রি করে দিয়ে আমানতকারীদের শেয়ার পোর্টফোলিও থেকে শেয়ার বিক্রি করে সব অর্থ আত্মসাত করেন প্রশাস্ত কুমার হালদার।
দুদক সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে পিপলস লিজিং কোম্পানি দেওলিয়া ঘোষণা করে কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। কোম্পানিটির কাছে বিভিন্ন বিনিয়োগকারী গ্রাহকরা ১৫শ’ কোটি টাকার মতো পাওয়া ছিল। কোম্পানির মাধ্যমে শেয়ার ক্রয়কারী গ্রাহকরা ওই অবস্থায় চরম বিপাকে পড়েন। লভ্যাংশ ঘোষণা করেও শেয়ার হোল্ডারদের লভ্যাংশ না দেয়ার অভিযোগ পিপলস লিজিং কোম্পানির বিরুদ্ধে। গ্রাহকদের অর্থ ফিরিয়ে দেয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রচেষ্টা চালানো হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে পিপলস লিজিং কোম্পানিতে যে সব গ্রাহকরা অর্থ পাবেন তাদের অর্থ ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। এর আগে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের সাবেক নয় পরিচালক ও দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। সূত্র জানায়, পিপলসের বোড অব ডিরেক্টরিতে প্রশাস্ত কুমার হালদার তার নিজস্ব আত্মীয়স্বজনদের বসান। তারা বোর্ড অব ডিরেক্টর হিসেবে থাকলেও একক ক্ষমতা ছিল প্রশাস্ত কুমার হালদারের। ২০০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পিপলসের বোড অব ডিকেক্টর হিসেবে প্রশাস্ত কুমার হালদারের বেশ কয়েকজন নিকট আত্মীয় ছিলেন। তাদের মাধ্যমে এ প্রতিষ্ঠানের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন প্রশান্ত কুমার হালদার।
দুদক সূত্র জানায় প্রশাস্তের বিরুদ্ধে ২২৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অভিযোগে করা মামলায় বলা হয়েছে, প্রশান্ত কুমার হালদার ও তার স্বার্থ–সংশ্লিষ্টদের ব্যাংক হিসাবে সন্দেহজনক ১ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকার লেনদেনের বিষয়ে তথ্য ছিল। কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা থাকা অবস্থায় ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, কর ফাঁকির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থের মালিক হয়েছেন প্রশাস্ত কুমার হালদার। পরে অর্থ লুট ও আত্মসাতের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গিয়ে দুদক বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) তদন্ত করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করার জন্য অনুরোধ করে। দুদকের অনুরোধে প্রশাস্ত কুমার হালদারের অর্থ লেনদেন নিয়ে এক বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করে বিএফআইইউ। তদন্তে ভয়াবহ জালিয়াতি এবং অর্থ লুটের কাহিনী বের হয়ে আসে। ওই প্রতিবেদন চেয়েছে বর্তমান অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান। গত ১২ জানুয়ারি পাঠানো চিঠিতে পিপলস লিজিংয়ের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে কয়েকশত কোটি টাকার লেনদেনের নথিপত্র, এর সঙ্গে যত অ্যাকাউন্ট হোল্ডার রয়েছে তাদের নাম-পরিচয়, কোন কোন প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে তা দিতে বলা হয়েছে। প্রশান্ত কুমারের যেসব আত্মীয়স্বজন এ অর্থ লুটের সঙ্গে জড়িত বা সহয়তা করেছে তাদের নাম-পরিচয়সহ বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে। চিঠিতে গতকালের মধ্যে নথিপত্র দুদকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠানোর কথা ছিল। দুদক সূত্র জানায়, ক্যাসিনোবিরোধী সাম্প্রতিক শুদ্ধি অভিযানের পরপরই প্রশাস্ত কুমার হালদারের নাম ওঠে আসে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গত বছরের ১৪ নভেম্বর হাজির হতে নোটিশ দিয়েছিল দুদক অনুসন্ধান কর্মকর্তা গুলশান আনোয়ার প্রধান। এর আগে গত বছরের ৩ অক্টোবর তার বিদেশযাত্রায়ও নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে সূত্র জানায়, প্রশাস্ত কুমার হালদার ও তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে জমা হয় প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা, প্রশান্ত কুমার হালদারের ব্যক্তিগত হিসাবে ২৪০ কোটি টাকা এবং তার মা লীলাবতী হালদারের হিসাবে জমা হয় ১৬০ কোটি টাকা। এসব অর্থের মধ্যে এসব হিসাবে এখন জমা আছে মাত্র ১০ কোটি টাকার কম। প্রশান্ত কুমার হালদার এক ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকেই ২ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ বের করে নিয়েছেন। এসব টাকা দিয়েই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানা কেনা হয়। তবে ঋণ নেয়া পুরো টাকার হদিস মিলছে না। ২০১৪ সালে কমপক্ষে চারটি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) মালিকানায় অস্বাভাবিক পরিবর্তন আসে। সেই চার প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা এখন চরম খারাপ। একটি বিলুপ্তের পথে, বাকি তিনটিও গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। নানা কৌশল করে এসব প্রতিষ্ঠান দখল করার জন্য নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলেছেন, শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনেছেন, দখল করা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের নামে টাকাও সরিয়েছেন। এমনকি দেশের বাইরেও কোম্পানি খুলেছেন। এসব কাজ করেছেন প্রশান্ত কুমার হালদার একাই। আর এসব কাজে তাকে সব ধরনের সমর্থন ও সহায়তা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা।