বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে কি?

বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট জেলা মেহেরপুরেরে সমান একটি দেশের নাম সিংগাপুর। সম্প্রতি এশিয়ার সবচেয়ে উদ্ভাবন ক্ষমতাসম্পন্ন দেশ হিসেবে নাম করেছে এই দেশটি। সিংগাপুরের নাম্বার ওয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম “ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিংগাপুর”। এই একটি বিশ্ববিদ্যালয় সিংগাপুরকে দিন দিন শ্রেষ্ঠ করে তুলছে। ওয়ার্ল্ড র্যান্কে প্রথম কুড়িটির মধ্যে স্থান পাওয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন এশিয়ার স্ট্যানফোর্ড! সিংগাপুর তাদের জিডিপির ২.২ শতাংশ ব্যয় করে গবেষণায়; যা আমাদের জাতীয় বাজেটের প্রায় এক পঞ্চমাংশ। ষাটের দশকে স্বাধীন হওয়া সিংগাপুরের এই বিস্ময়কর এগিয়ে যাওয়ার জাদুর কাঠির নাম হলো “এডুকেশন এ- রিসার্চ”। তাদের দেশে প্রায় ৪০ হাজার গবেষক অর্থাৎ - অর্ধকোটি মানুষের দেশে অর্ধলাখ গবেষক! দুনিয়ার বুকে উদ্ভাবনে অনন্য হওয়ার লক্ষ্যেই সর্বাধুনিক গবেষণায় দিনদিন খেটে যাচ্ছে তাদের গবেষকরা।

মানব সভ্যতার ইতিহাসে স্বল্প সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হওয়া দেশটির নাম হচ্ছে জাপান। হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহর ধ্বংস করা ছিলো ইতিহাসে ন্যক্কারজনক ঘটনা। এত বড় ক্ষতির শিকার হওয়ার পরেও জাপান ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলো। শত্রু-শত্রু খেলা বন্ধ করলো। যে দেশটি তাদের ২টি শহর ধ্বংস করেছিলো, সেই দেশটি থেকে আরও বেশি জ্ঞান-বিজ্ঞান নিতে শুরু করলো। জাপান প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী কে আমেরিকা পাঠায়। তারা উচ্চশিক্ষায় বিলেত গমন বলতে আমেরিকাকেই বোঝে।

এর ফলাফলে গত চার দশকে ওরা বিজ্ঞানেই নোবেল নিয়েছে প্রায় কুড়িটি। শুধু তাই নয়, মৌলিক আবিষ্কার ও উদ্ভাবনে একটি ক্ষুদ্র জাতি কতদূর চলে যেতে পারে, সেটার অদ্বিতীয় উদাহরণ জাপান। সুনামি ও ভূমিকম্পনপ্রবণ এই দেশটি প্রকৃতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যেভাবে বিশ্ব দরবারে নিজেদের প্রমাণ করেছে তাই সত্যিই ভাববার বিষয়।

কিন্তু নির্মম সত্য হলো যে, প্রায় অর্ধশত বয়সে পদার্পণ করা আমাদের বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও উচ্চশিক্ষার স্থান নামক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর দেশ ও জাতির প্রকৃত স্বার্থে এদের অগ্রগামীতা এখন প্রশ্নবিদ্ধ! মেধাবীদের মিলনমেলার এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার উদ্দেশ্য পূরণে কতটা এগিয়ে কিংবা পিছিয়ে তা ভাববার বিষয়!

উচ্চ শিক্ষার এই প্রতিষ্ঠান গুলো প্রতিনিয়ত তাদের বিতর্কিত কার্যালপের জন্য মিডিও ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার্থীরা যতটা শিক্ষার পিছনে ছুটছে, তার চেয়ে বেশি কুশিক্ষায় লিপ্ত হচ্ছে; ফলে খুন, ছিনতাই, মাদক, সন্ত্রাসীর অভয়ারণ্যে পরিণত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে শুধু গত ১০ বছরেই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৪ জন খুন হয়েছেন।

আর শিক্ষক নামক মহান পেশায় অধিষ্ঠিত শিক্ষকগণের অনেকেই লেজুড়বৃত্তি রাজনীতি আর রঙিন রঙিন দলের দলীয় কর্মব্যস্ততায় ভুলেই যান তাদের নৈতিক দায়িত্ব। অনেক শিক্ষক আছেন যারা অতি স্বার্থবুদ্ধিসম্পন্ন; যার দরুন শিক্ষকতার পাশাপাশি বিভিন্ন কাজে যুক্ত থেকে শিক্ষকতা পেশাকেউ অবহেলা করেন। কেউ কেউ শিক্ষাছুটিতে দেশের বাইরে গেলেও দেশে ফেরার কথা ভুলে যান। ইউজিসির তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে সরকারের অর্থে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৪৫টি। এর মধ্যে ৩৭টিতে ২ হাজার ৯৪০ শিক্ষক অন্তত ৫ ধরনের ছুটিতে আছেন। এসব শিক্ষকের মধ্যে ২ হাজার ১০১ জন আছেন শিক্ষাছুটিতে।

প্রেষণ বা লিয়েন নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন ৮৪ জন, বিনা বেতনে ছুটিতে আছেন ৫৮ জন, ছুটি শেষ হওয়ার পরও অননুমোদিতভাবে বিদেশে অবস্থান করছেন ১৭ জন এবং খ-কালীন বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন ৬৮০ জন।

এছাড়া বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে এনজিও ব্যবসা, বিদেশি সংস্থায় পরামর্শকসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খ-কালীন কাজ করছেন আরও ৫ শতাধিক। সব মিলিয়ে ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ হাজারের বেশি শিক্ষক বিচ্ছিন্ন আছেন পাঠদান কার্যক্রম থেকে।

যে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের গবেষণা মুখি করে তুলবেন এবং দেশকে এগিয়ে নিতে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করবেন ; তারা আজ ভিন্ন কাজে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। ফলে গবেষণায় নেই অগ্রগতি। সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে জানা যায় যে, ২০১৮ সালে ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬টি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের গবেষণা খাতে কোন ব্যয় করেনি। আর সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়। এমনকি ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন প্রকাশনায় নেই।

স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক- শিক্ষার্থীদের ভূমিকার ইতিহাস অনেক সমুজ্জ্বল হলেও বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোন পথে হাটছে তা প্রতিনিয়ত ভাবায়। প্রতিযোগিতাপূর্ণ এ বিশ্বের অন্য দেশগুলো যখন তাদের গবেষণার ওপর ভর করে তরতর করে উন্নতির শীর্ষে পৌঁছাচ্ছে তখন আমাদের মনে এই প্রশ্ন জেগে বসেছে যে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জাতির প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করতে পারছে?

ফয়সাল মাহমুদ আল-মারজান

শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

আরও খবর

রবিবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২০ , ৫ মাঘ ১৪২৬, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে কি?

বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট জেলা মেহেরপুরেরে সমান একটি দেশের নাম সিংগাপুর। সম্প্রতি এশিয়ার সবচেয়ে উদ্ভাবন ক্ষমতাসম্পন্ন দেশ হিসেবে নাম করেছে এই দেশটি। সিংগাপুরের নাম্বার ওয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম “ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিংগাপুর”। এই একটি বিশ্ববিদ্যালয় সিংগাপুরকে দিন দিন শ্রেষ্ঠ করে তুলছে। ওয়ার্ল্ড র্যান্কে প্রথম কুড়িটির মধ্যে স্থান পাওয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন এশিয়ার স্ট্যানফোর্ড! সিংগাপুর তাদের জিডিপির ২.২ শতাংশ ব্যয় করে গবেষণায়; যা আমাদের জাতীয় বাজেটের প্রায় এক পঞ্চমাংশ। ষাটের দশকে স্বাধীন হওয়া সিংগাপুরের এই বিস্ময়কর এগিয়ে যাওয়ার জাদুর কাঠির নাম হলো “এডুকেশন এ- রিসার্চ”। তাদের দেশে প্রায় ৪০ হাজার গবেষক অর্থাৎ - অর্ধকোটি মানুষের দেশে অর্ধলাখ গবেষক! দুনিয়ার বুকে উদ্ভাবনে অনন্য হওয়ার লক্ষ্যেই সর্বাধুনিক গবেষণায় দিনদিন খেটে যাচ্ছে তাদের গবেষকরা।

মানব সভ্যতার ইতিহাসে স্বল্প সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হওয়া দেশটির নাম হচ্ছে জাপান। হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহর ধ্বংস করা ছিলো ইতিহাসে ন্যক্কারজনক ঘটনা। এত বড় ক্ষতির শিকার হওয়ার পরেও জাপান ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলো। শত্রু-শত্রু খেলা বন্ধ করলো। যে দেশটি তাদের ২টি শহর ধ্বংস করেছিলো, সেই দেশটি থেকে আরও বেশি জ্ঞান-বিজ্ঞান নিতে শুরু করলো। জাপান প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী কে আমেরিকা পাঠায়। তারা উচ্চশিক্ষায় বিলেত গমন বলতে আমেরিকাকেই বোঝে।

এর ফলাফলে গত চার দশকে ওরা বিজ্ঞানেই নোবেল নিয়েছে প্রায় কুড়িটি। শুধু তাই নয়, মৌলিক আবিষ্কার ও উদ্ভাবনে একটি ক্ষুদ্র জাতি কতদূর চলে যেতে পারে, সেটার অদ্বিতীয় উদাহরণ জাপান। সুনামি ও ভূমিকম্পনপ্রবণ এই দেশটি প্রকৃতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যেভাবে বিশ্ব দরবারে নিজেদের প্রমাণ করেছে তাই সত্যিই ভাববার বিষয়।

কিন্তু নির্মম সত্য হলো যে, প্রায় অর্ধশত বয়সে পদার্পণ করা আমাদের বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও উচ্চশিক্ষার স্থান নামক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর দেশ ও জাতির প্রকৃত স্বার্থে এদের অগ্রগামীতা এখন প্রশ্নবিদ্ধ! মেধাবীদের মিলনমেলার এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার উদ্দেশ্য পূরণে কতটা এগিয়ে কিংবা পিছিয়ে তা ভাববার বিষয়!

উচ্চ শিক্ষার এই প্রতিষ্ঠান গুলো প্রতিনিয়ত তাদের বিতর্কিত কার্যালপের জন্য মিডিও ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার্থীরা যতটা শিক্ষার পিছনে ছুটছে, তার চেয়ে বেশি কুশিক্ষায় লিপ্ত হচ্ছে; ফলে খুন, ছিনতাই, মাদক, সন্ত্রাসীর অভয়ারণ্যে পরিণত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে শুধু গত ১০ বছরেই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৪ জন খুন হয়েছেন।

আর শিক্ষক নামক মহান পেশায় অধিষ্ঠিত শিক্ষকগণের অনেকেই লেজুড়বৃত্তি রাজনীতি আর রঙিন রঙিন দলের দলীয় কর্মব্যস্ততায় ভুলেই যান তাদের নৈতিক দায়িত্ব। অনেক শিক্ষক আছেন যারা অতি স্বার্থবুদ্ধিসম্পন্ন; যার দরুন শিক্ষকতার পাশাপাশি বিভিন্ন কাজে যুক্ত থেকে শিক্ষকতা পেশাকেউ অবহেলা করেন। কেউ কেউ শিক্ষাছুটিতে দেশের বাইরে গেলেও দেশে ফেরার কথা ভুলে যান। ইউজিসির তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে সরকারের অর্থে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৪৫টি। এর মধ্যে ৩৭টিতে ২ হাজার ৯৪০ শিক্ষক অন্তত ৫ ধরনের ছুটিতে আছেন। এসব শিক্ষকের মধ্যে ২ হাজার ১০১ জন আছেন শিক্ষাছুটিতে।

প্রেষণ বা লিয়েন নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন ৮৪ জন, বিনা বেতনে ছুটিতে আছেন ৫৮ জন, ছুটি শেষ হওয়ার পরও অননুমোদিতভাবে বিদেশে অবস্থান করছেন ১৭ জন এবং খ-কালীন বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন ৬৮০ জন।

এছাড়া বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে এনজিও ব্যবসা, বিদেশি সংস্থায় পরামর্শকসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খ-কালীন কাজ করছেন আরও ৫ শতাধিক। সব মিলিয়ে ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ হাজারের বেশি শিক্ষক বিচ্ছিন্ন আছেন পাঠদান কার্যক্রম থেকে।

যে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের গবেষণা মুখি করে তুলবেন এবং দেশকে এগিয়ে নিতে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করবেন ; তারা আজ ভিন্ন কাজে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। ফলে গবেষণায় নেই অগ্রগতি। সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে জানা যায় যে, ২০১৮ সালে ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬টি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের গবেষণা খাতে কোন ব্যয় করেনি। আর সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়। এমনকি ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন প্রকাশনায় নেই।

স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক- শিক্ষার্থীদের ভূমিকার ইতিহাস অনেক সমুজ্জ্বল হলেও বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোন পথে হাটছে তা প্রতিনিয়ত ভাবায়। প্রতিযোগিতাপূর্ণ এ বিশ্বের অন্য দেশগুলো যখন তাদের গবেষণার ওপর ভর করে তরতর করে উন্নতির শীর্ষে পৌঁছাচ্ছে তখন আমাদের মনে এই প্রশ্ন জেগে বসেছে যে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জাতির প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করতে পারছে?

ফয়সাল মাহমুদ আল-মারজান

শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়