‘জজ মিয়া’ মানে ‘সাজানো-নাটক’

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রীর ধর্ষক নিয়ে জজ মিয়া নাটক সাজানোর অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি ধর্ষিতা ওই ছাত্রী ঢাকার কুর্মিটোলা বাসস্ট্যান্ড থেকে নেমে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে আর্মি গলফ ক্লাব পর্যন্ত যাওয়ার পর পেছন দিক থেকে একজন লোক তার গলা টিপে ধরে মাটিতে ফেলে দেয়; মাটিতে পড়ে মেয়েটি চিৎকার শুরু করলে লোকটি তাকে কিল-ঘুষি মারতে থাকে, এক সময় মেয়েটি জ্ঞান হারালে লোকটি তাকে ধর্ষণ করে। ধর্ষিত মেয়েটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বলে এ ধর্ষণের বিরুদ্ধে মিছিল-মিটিং চলতে থাকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী আন্দোলনে নামে। রাজপথ ও বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রতিবাদ জোরালো হওয়ায় ঘটনার দুদিনের মধ্যেই র্যাব ধর্ষক মজনুকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। এখন এ মজনু সত্যিকারের ধর্ষক কী না সে ব্যাপারে বিভিন্ন তরফ থেকে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ষিতা মেয়েটি জীবিত এবং সে নিজেই ধর্ষকের ছবি শনাক্ত করেছে- তবুও মজনু নামে কথিত ধর্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই মেয়েটির ধর্ষক কী না সে প্রশ্ন বিখ্যাত বিখ্যাত ব্যক্তিদের মুখ থেকে উত্থিত হচ্ছে। এমন প্রশ্ন উত্থিত হওয়ার কারণও আছে; বাংলাদেশে পুলিশ ও দুদকের হাতে সাজানো নাটক যে হয়নি তা কিন্তু নয়। যারা আজ জজ মিয়া নাটকের কথা বলছেন তারা সবাই বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধেছেন, জজ মিয়ার সৃষ্টি হয়েছে বিএনপির আমলেই। মান্না সাহেবেরা তাই যতবার জজ মিয়ার কথা বলছেন তত বার বিএনপির কুকীর্তি জনমনে ভেসে উঠছে। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার লক্ষ্যে ২১ আগস্টে তার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে নেয়ার উদ্দেশ্যে প্রথমে গ্রেপ্তার করা হয় নিরপরাধী শৈবাল সাহা পার্থ নামের এক তরুণকে। এলিফ্যান্ট রোডের হার্ডনেট সাইবার ক্যাফে থেকে শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দিয়ে একটি দৈনিক পত্রিকায় ইমেইল পাঠানোর ঘটনার নাটক সাজানো হয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে। দীর্ঘ আঠার দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করা ছাড়াও তাকে বিনা অপরাধে সাত মাস কারাভোগ করতে হয়েছে।

তাকে ফাঁসাতে না পেরে নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে জজ মিয়া নামের এক যুবককে ধরে এনে ১৭ দিন রিমান্ডে রেখে, ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে তার কাছ থেকে এই মর্মে স্বীকারোক্তি আদায় করে নেয়া হয় যে, তিনিই গ্রেনেড হামলা করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় না এলে এ সাজানো নাটক আদৌ উন্মোচিত হতো কী না সন্দেহ। বিভিন্ন নাটক সাজাতে ক্রসফায়ার মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে, সবাই জানে ক্রসফায়ার প্রায়ই ঘটে এবং এর জন্য কোন জবাবদিহি নেই। তাই তাৎক্ষণিক মরার চেয়ে জেল খাটার অপরাধ স্বীকার করা বুদ্ধিমানের কাজ। একজনের বদলে আরেকজনের জেল খাটার কাহিনী প্রায়ই মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। মানুষ কত অভাবী হলে কিছু টাকার বিনিময়ে বিনা অপরাধে জেলে থাকার এমন জঘন্য কাজটি করতে পারে তা আইন দিয়ে বিচার করা যাবে না। দুদকের মামলায় আবু সালেকের পরিবর্তে জাহালমকে জেল খাটতে হয়েছে তিন বছর। দুদক কর্মকর্তা ও নিম্ন আদালতে জাহালম বারবার উচ্চকণ্ঠে বলেছে, ‘আমি আবু সালেক নই, আমি জাহালম’। কেউ তার কথা শোনেননি, তার কথা বিশ্বাস করেননি। কান এবং চোখ সচল থাকা সত্ত্বেও এত অন্ধ ও বধির লোক পৃথিবীতে থাকলে নাটক সাজানো এবং সাজানো নাটকের মঞ্চায়ন করা সহজ, এসব নাটকের দর্শকও প্রচুর। কোন লোককে ফাঁসানোর জন্য পকেটে অস্ত্র বা মাদক ঢুকিয়ে দেয়ার কাহিনী অহরহ শুনছি। এমন কাহিনীও মিডিয়ায় এসেছে যে, অপহরণ ও হত্যা মামলার আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থাকা সত্ত্বেও পরবর্তীতে দেখা গেল অপহরণও হয়নি, হত্যাও হয়নি। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিশ্চয়ই পুলিশের ‘প্যাদানির’ কারণে সম্ভব হয়েছে। জজ মিয়াও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন; পরবর্তীতে দেখা গেল, জজ মিয়া গ্রেনেড কী জিনিস তা জানে না, পুলিশ তার পরিবারের সদস্যদের জন্য প্রতি মাসে টাকা পাঠাতো। বিএনপি আমলে সৃষ্ট জজ মিয়া এখন আর কোন ব্যক্তির নাম নয়, মিরজাফরের মতো অর্থবহ শব্দ।

জজ মিয়াসহ অন্যান্য সাজানো নাটক অবলোকন করেই অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মজনুকে গ্রেফতারের ঘটনাকে ‘রেশমা নাটক’ বলে মন্তব্য করেছেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী সাভারের রানা প্লাজা ভেঙে পড়ার ১৭ দিন পর ধ্বংস স্তূপের ভেতর থেকে পোশাককর্মী রেশমা বেগমকে উদ্ধারের সাজানো নাটক করা হয়েছিল হেফাজতের সমাবেশের হামলাকে আড়াল করার জন্য। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী মজনু মিয়া জজ মিয়ার কাহিনীর মতো সাজানো বলে উল্লেখ করেছেন। ডাকসু’র ভিপি নুরুল হক নুরুও এই মজনু আসল ধর্ষক কী না সে ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। একজন রোগা মাদকাসক্ত দুর্বল যুবক কী করে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে কাবু করে ফেললো তা মাহমুদুর রহমান মান্না সাহেবের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, কেবল একজন যুবকের পক্ষে একটি মেয়ের অসম্মতিতে জোরপূর্বক ধর্ষণ করা অসম্ভব। মেয়েটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কী না সে ব্যাপারেও বোধ হয় মান্না সাহেব সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ফেসবুকেও মজনুকে নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে অসংখ্য পোস্ট দেয়া হয়েছে, অনেকের ধারণা এ ধরনের ঘটনা আদৌ ঘটেনি।

মজনুকে যারা ধর্ষক বলছেন না তারা সবাই উচ্চ শিক্ষিত, রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তি, এদের অধিকাংশ আওয়ামী লীগ বিরোধী। তাদের সন্দেহ সঠিক বলে মেনে নিলে সরকার বা র্যাবের সাজানো নাটকের উদ্দেশ্য জানা প্রয়োজন। মান্না সাহেব ব্যতীত উল্লেখিত ব্যক্তিদের আর কেউই সরকার বা র্যাবের উদ্দেশ্য নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য রাখেননি। মান্না সাহেব বলেছেন, এ ঘটনা সাজানোর অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কলঙ্কিত করা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ধ্বংস করা, ভিপি নুরুল হক ও অন্যান্য ছাত্রদের ওপর নির্যাতনকে ধামাচাপা দেয়া। মান্না সাহেবের উল্লেখিত কারণগুলো আমার কাছে খুব সবল বলে মনে হয়নি। সরকারের জন্য বিব্রতকর কোন আলোচিত ঘটনাকে আড়াল করার জন্য সাধারণত আরেকটি ঘটনার অবতারণা করা হয়ে থাকে। বর্তমানে মেয়র নির্বাচনের ইস্যু ব্যতীত অন্য কোন ইস্যু দেখা যাচ্ছে না যা ঢাকার জন্য বা অন্য কোন বেনিফিট পাওয়ার জন্য সরকার এমন একটি নাটক সাজাতে প্রলুব্ধ হয়েছে। ছাত্রীটির ধর্ষণের সঙ্গে ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের কারো নাম উচ্চারিত হলে বিশ্বাস করার কারণ ছিল যে, মান্না সাহেবেরা সঠিক কথা বলছেন। মজনু নিজেই স্বীকার করেছে যে, সে একাই ধর্ষণ করেছে। অবশ্য র্যাব বা পুলিশের প্যাদানি শক্ত হলে ধর্ষকের স্বীকারোক্তি আদায় করা খুব কঠিন বিষয় নয়। তাই মজনুর স্বীকারোক্তি আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়। অন্যদিকে অনেকের বিশ্বাস মতো র্যাব সরকারের নির্দেশানুযায়ী নাটক সাজাতেই পারে; কিন্তু মেয়েটি কেন মিথ্যে বলবে? মেয়েটিও কি সরকারের বড় কোন প্রলোভনে পড়েছে? সেই প্রলোভনটির কথা কেউ বলছেন না। কিন্তু পৃথিবীতে এমন কোন প্রলোভন নেই যার বিনিময়ে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নাটক সাজিয়ে একজন মাদকাসক্ত ভবঘুরকে তার ধর্ষক বানাবে।

আসামির স্বীকারোক্তি অনুসারে ওই ছাত্রীর ব্যাগ, মোবাইল এবং আসামির ব্যবহৃত একটি জিন্সের প্যান্ট ও একটি জ্যাকেট উদ্ধার করা হয়। মজনু সেই মোবাইলটি শেওড়া এলাকার অরুনা নামে একজনের কাছে দেয়, অরুনা সেই মোবাইলটি খায়রুল নামে একজনের কাছে বিক্রি করে। সেই মোবাইলের সূত্র ধরেই মজনুকে গ্রেফতার করে র্যাব। উদ্ধার করা মোবাইল ও পোশাক-পরিচ্ছদ ধর্ষিতা মেয়েটি তার বলে শনাক্ত করেছে। ধর্ষককে শনাক্ত করার ব্যাপারে মেয়েটি স্পষ্ট করে বলেছে যে, পৃথিবীর সব চেহারা ভুলে গেলেও সে ওই ধর্ষকের চেহারা ভুলবে না। থানায় মামলা দায়েরের সময় ধর্ষকের যে আকার-আকৃতি বর্ণনা করা হয়েছে তাতে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, ধর্ষকের সামনের দুটি দাঁত নেই। মামলার এজাহারের বর্ণনার সঙ্গে মজনুর আকার-আকৃতির মিল রয়েছে, মজনুরও সামনে দুটি দাঁত ভাঙা। রেলগাড়ি থেকে পড়ে গেলে তার দাঁত দুটি ভেঙে যায় বলে মজনু র্যাবকে জানিয়েছে। র্যাব মেয়েটিকে পরীক্ষা করার জন্য অন্য একজন লোকের ছবি দেখিয়ে জানতে চায়, ছবির যুবক ধর্ষক কী না। মেয়েটির স্পষ্ট উত্তর ছিল, ‘না’। পরে র্যাব মজনুর ছবি দেখালে মেয়েটি বলে, ‘হ্যাঁ’। কোথায় মজনুকে ধরা হয়েছে, কীভাবে ধরা হয়েছে সবিস্তারে তা বর্ণনা করেছে র্যাব। মজনুও নাকি র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে মেয়েটিকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছে। র‌্যাবের বক্তব্য অনুযায়ী মজনু একজন সিরিয়াল রেপিস্ট। এই মজনু দীর্ঘদিন ধরে রাস্তা-ঘাটে পাগল, প্রতিবন্ধী ভিক্ষুকদের সুযোগমত ধর্ষণ করে আসছে- বহু ধর্ষণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা সত্ত্বেও সে কখনও ধরা পড়েনি। সে চুরি, ছিনতাই করে খাবার ও মাদক জোগাড় করত। তার স্ত্রী মারা গেছে। এ মজনুর আরেকটি ভিডিও ক্লিপ দেখলাম যেখানে সে একজন প্রতিবন্ধীকে আরেকজন ধর্ষকের হাত থেকে রক্ষা করার গল্প শোনাচ্ছে। তার পাশে বসা প্রতিবন্ধীকে নাকি অন্য একজন লোক ধর্ষণের জন্য হাত ধরে নেয়ার পথে মজনু তাকে রক্ষা করে। দেখলাম, মজনুর কথা শুনে মেয়েটি শুধু হাসছে। যারা ভিডিও করেছে তাদের দেখা না গেলেও কথা শোনা গেছে, তাদের প্রশ্নের উত্তরে মজনুর বক্তব্য হচ্ছে, পাশে বসা মেয়েটি চলে গেলেও তার কোন অসুবিধা হবে না, এমন মেয়ে তার প্রচুর আছে। মাদক সেবনের কারণে সম্ভবত তার মুখের কথা স্পষ্ট হচ্ছিল না।

মিডিয়ার খবর অনুযায়ী, ধর্ষিতা মেয়েটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। এ তথ্যের সত্যতা অতি সহজেই নিরূপণ করা সম্ভব। ধর্ষণের পর ওই এলাকায় পুলিশের তদন্ত চলাকালীন মজনুকে ঘোরাফেরা করতে টিভি চ্যানেল একাত্তরের ক্যামেরায় দেখা গেছে। একাত্তরের ভিডিও ক্লিপটিও সাজানো কী না তা আমার জানা নেই। মজনুর বক্তব্য অনুযায়ী ছাত্রীটি তাকে বারবার বাধা দিয়েছে। মেয়েটি জানে, মজনু তাকে মেরে ফেলার হুমকি এমনি এমনি দেয়নি, ধর্ষণে কোন সাক্ষী না রাখার মানসে বহু ধর্ষিতাকে ইতিপূর্বে হত্যা করা হয়েছে। মাদকাসক্ত ব্যক্তির এমনিতেই হুঁশ থাকে না- এই অবস্থায় মেয়েটির মৃত্যুর ভয় ছিল। শুধু বেঁচে থাকার জন্য ভয়ঙ্কর মাদকাসক্ত মজনুর কাছে মেয়েটি পরাজিত হতে বাধ্য হয়েছে বলে মনে হয়। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে মজনু সত্যি সত্যি ধর্ষক কী না- তা যাচাই করতে ডিএনএ টেস্টও করা হচ্ছে। ডিএনএ টেস্টে মজনুকে ধর্ষক হিসেবে শনাক্ত করা হলেও সন্দেহ দূর করা যাবে বলে মনে হয় না; কারণ এই সন্দেহের উৎস হচ্ছে রাজনীতি। আমার মনে হচ্ছে, মান্না সাহেবদের বক্তব্যগুলো বেশি আগামবার্তা হয়ে গেছে, তাদের আরেকটু ধৈর্য ধরার দরকার ছিল। কারণ এ ধর্ষণের সঙ্গে সাধারণ মানুষ এখনও কোন রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা খুঁজে পাচ্ছে না। তাই তাদের নানাবিধ সন্দেহ ফ্লপ করবে বলে মনে হয়। এভাবে ফ্লপ করলে ভবিষ্যতে তাদের মুখ দিয়ে নিসৃত সত্য কথাও মানুষ আর বিশ্বাস করবে না।

যুদ্ধেও নাটক সাজানো হয়; যুদ্ধে সাজানো নাটক নিয়ে মানুষ মাথা ঘামায় না। ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ৮০ জন আমেরিকান সৈন্য মারা গেছে বা ইউক্রেনের যাত্রীবাহী বিমান ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ভূপাতিত হয়নি- ইরানের এমন বক্তব্য বিশ্বাস করার প্রচুর লোক বাংলাদেশে আছে। আমেরিকান সেনা মারা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না- ইরানের এমন বক্তব্যের পরও অনেক বাংলাদেশির ধারণা, নিহত সেনাদের গোপনে কবর দেয়া হয়েছে এবং আহত সেনারা ইসরাইলে চিকিৎসা নিচ্ছে। ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে বিমান ধ্বংসের আমেরিকান বার্তা অধিকাংশ মুসলমান বিশ্বাস করেননি; ইরান বলেছিল যান্ত্রিক ত্রুটির কারণেই বিমানটি ধ্বংস হয়েছে এবং অধিকাংশ মুসলমান বাঙালি ইরানের বক্তব্যকেই সহি বলে বিশ্বাস করেছিল। পরবর্তীতে ইরানের স্বীকারোক্তির পর ওই মুসলমানেরাই বলছেন, ইরানের স্বীকার করা ঠিক হয়নি। বিমানে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতও সাজানো নাটক হতে পারে, যিনি বা যারা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছেন তিনি আমেরিকান পেইড লোকও হতে পারে। বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমেরিকা বলে দিয়েছিল, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রে বিমান ধ্বংস হয়েছে, তখন ইরানও জানে না যে কীভাবে যাত্রীবাহী বিমানটি ধ্বংস হলো। বাংলাদেশেও সংঘটিত নানাবিধ ঘটনার পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলার লোকের অভাব নেই- পক্ষ বা বিপক্ষের এই লোকগুলো যুক্তিসঙ্গত কার্য-কারণ অনুসন্ধানে মোটেই উৎসাহী নয়, নাটক সাজাতে এবং সাজানো নাটক দিয়ে বিপক্ষকে ঘায়েল করতে মানসিকভাবে ওই লোকগুলো সর্বদা প্রস্তুত থাকে। এরা যুক্তি নয়, অন্ধ বিশ্বাসে তাড়িত।

ক্যান্টনমেন্ট থানার আওতায় রাজধানীর ব্যস্ততম একটি এলাকায় এভাবে চুরি, ছিনতাই ও ধর্ষণ কর্মকা- হয়ে আসছে তা শুনলেই গা শিহরিত হয়ে উঠে। এ মজনু নাকি একই জায়গায় বহুবার প্রতিবন্ধী ভিক্ষুকদের ধর্ষণ করেছে। কথিত এলাকায় স্বল্প আলোর ভেতর ঝোপঝাড়ের আড়ালে মাদকাসক্ত ও ভবঘুরদের নিয়মিত আড্ডা কারো চোখে এতদিন ধরে কেন পড়লো না তা বিস্ময়কর। এমনতর ঘটনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ কোন লোকের নজরে না আসা জাতির জন্য লজ্জার। সারা দেশে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে ধর্ষণ, ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যা। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু নয়, মাদরাসা ও মক্তবের পাঁচ-ছয় বছরের শিশু ছাত্রীরাও ধর্মীয় মূল্যবোধে উজ্জীবিত নিয়মিত ওয়াজকারী আলেমদের ধর্ষণ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ধর্ষণ অতীতেও হয়েছে, কিন্তু প্রকাশ পেয়েছে খুবই কম। এখন ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশে মেয়েরা অনেকটা সাহসী হয়ে উঠেছে। ধর্ষণের কাহিনী প্রকাশের সাহসিকতা নিয়ে আমরা অনেকে বাহবা দিলেও পরিবার ও সমাজে একজন ধর্ষিতার দুর্বিষহ অবস্থা দূরীভূত করার কোন হাতিয়ার জানা নেই- কোন ধর্ষিতা মেয়ের আত্মহত্যা ঠেকানোর স্বার্থে ওই পরিবারকে বাধ্য হয়ে নিজের এলাকা ত্যাগ করে অপরিচিত জায়গায় গিয়ে বসতি গড়ে তুলতে হয়। আমরা কুমারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন না করেই বিধবা বিয়ে করি, পরকীয়ায় বিবাহিতা রমনীর সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হই, কিন্ত ধর্ষিতা মেয়েদের বিয়ে করাকে ঘৃণা করি- এমন দ্বিচারী মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

zeauddinahmed@gmail.com

রবিবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২০ , ৫ মাঘ ১৪২৬, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

‘জজ মিয়া’ মানে ‘সাজানো-নাটক’

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রীর ধর্ষক নিয়ে জজ মিয়া নাটক সাজানোর অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি ধর্ষিতা ওই ছাত্রী ঢাকার কুর্মিটোলা বাসস্ট্যান্ড থেকে নেমে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে আর্মি গলফ ক্লাব পর্যন্ত যাওয়ার পর পেছন দিক থেকে একজন লোক তার গলা টিপে ধরে মাটিতে ফেলে দেয়; মাটিতে পড়ে মেয়েটি চিৎকার শুরু করলে লোকটি তাকে কিল-ঘুষি মারতে থাকে, এক সময় মেয়েটি জ্ঞান হারালে লোকটি তাকে ধর্ষণ করে। ধর্ষিত মেয়েটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বলে এ ধর্ষণের বিরুদ্ধে মিছিল-মিটিং চলতে থাকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী আন্দোলনে নামে। রাজপথ ও বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রতিবাদ জোরালো হওয়ায় ঘটনার দুদিনের মধ্যেই র্যাব ধর্ষক মজনুকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। এখন এ মজনু সত্যিকারের ধর্ষক কী না সে ব্যাপারে বিভিন্ন তরফ থেকে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ষিতা মেয়েটি জীবিত এবং সে নিজেই ধর্ষকের ছবি শনাক্ত করেছে- তবুও মজনু নামে কথিত ধর্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই মেয়েটির ধর্ষক কী না সে প্রশ্ন বিখ্যাত বিখ্যাত ব্যক্তিদের মুখ থেকে উত্থিত হচ্ছে। এমন প্রশ্ন উত্থিত হওয়ার কারণও আছে; বাংলাদেশে পুলিশ ও দুদকের হাতে সাজানো নাটক যে হয়নি তা কিন্তু নয়। যারা আজ জজ মিয়া নাটকের কথা বলছেন তারা সবাই বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধেছেন, জজ মিয়ার সৃষ্টি হয়েছে বিএনপির আমলেই। মান্না সাহেবেরা তাই যতবার জজ মিয়ার কথা বলছেন তত বার বিএনপির কুকীর্তি জনমনে ভেসে উঠছে। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার লক্ষ্যে ২১ আগস্টে তার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে নেয়ার উদ্দেশ্যে প্রথমে গ্রেপ্তার করা হয় নিরপরাধী শৈবাল সাহা পার্থ নামের এক তরুণকে। এলিফ্যান্ট রোডের হার্ডনেট সাইবার ক্যাফে থেকে শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দিয়ে একটি দৈনিক পত্রিকায় ইমেইল পাঠানোর ঘটনার নাটক সাজানো হয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে। দীর্ঘ আঠার দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করা ছাড়াও তাকে বিনা অপরাধে সাত মাস কারাভোগ করতে হয়েছে।

তাকে ফাঁসাতে না পেরে নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে জজ মিয়া নামের এক যুবককে ধরে এনে ১৭ দিন রিমান্ডে রেখে, ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে তার কাছ থেকে এই মর্মে স্বীকারোক্তি আদায় করে নেয়া হয় যে, তিনিই গ্রেনেড হামলা করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় না এলে এ সাজানো নাটক আদৌ উন্মোচিত হতো কী না সন্দেহ। বিভিন্ন নাটক সাজাতে ক্রসফায়ার মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে, সবাই জানে ক্রসফায়ার প্রায়ই ঘটে এবং এর জন্য কোন জবাবদিহি নেই। তাই তাৎক্ষণিক মরার চেয়ে জেল খাটার অপরাধ স্বীকার করা বুদ্ধিমানের কাজ। একজনের বদলে আরেকজনের জেল খাটার কাহিনী প্রায়ই মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। মানুষ কত অভাবী হলে কিছু টাকার বিনিময়ে বিনা অপরাধে জেলে থাকার এমন জঘন্য কাজটি করতে পারে তা আইন দিয়ে বিচার করা যাবে না। দুদকের মামলায় আবু সালেকের পরিবর্তে জাহালমকে জেল খাটতে হয়েছে তিন বছর। দুদক কর্মকর্তা ও নিম্ন আদালতে জাহালম বারবার উচ্চকণ্ঠে বলেছে, ‘আমি আবু সালেক নই, আমি জাহালম’। কেউ তার কথা শোনেননি, তার কথা বিশ্বাস করেননি। কান এবং চোখ সচল থাকা সত্ত্বেও এত অন্ধ ও বধির লোক পৃথিবীতে থাকলে নাটক সাজানো এবং সাজানো নাটকের মঞ্চায়ন করা সহজ, এসব নাটকের দর্শকও প্রচুর। কোন লোককে ফাঁসানোর জন্য পকেটে অস্ত্র বা মাদক ঢুকিয়ে দেয়ার কাহিনী অহরহ শুনছি। এমন কাহিনীও মিডিয়ায় এসেছে যে, অপহরণ ও হত্যা মামলার আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থাকা সত্ত্বেও পরবর্তীতে দেখা গেল অপহরণও হয়নি, হত্যাও হয়নি। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিশ্চয়ই পুলিশের ‘প্যাদানির’ কারণে সম্ভব হয়েছে। জজ মিয়াও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন; পরবর্তীতে দেখা গেল, জজ মিয়া গ্রেনেড কী জিনিস তা জানে না, পুলিশ তার পরিবারের সদস্যদের জন্য প্রতি মাসে টাকা পাঠাতো। বিএনপি আমলে সৃষ্ট জজ মিয়া এখন আর কোন ব্যক্তির নাম নয়, মিরজাফরের মতো অর্থবহ শব্দ।

জজ মিয়াসহ অন্যান্য সাজানো নাটক অবলোকন করেই অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মজনুকে গ্রেফতারের ঘটনাকে ‘রেশমা নাটক’ বলে মন্তব্য করেছেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী সাভারের রানা প্লাজা ভেঙে পড়ার ১৭ দিন পর ধ্বংস স্তূপের ভেতর থেকে পোশাককর্মী রেশমা বেগমকে উদ্ধারের সাজানো নাটক করা হয়েছিল হেফাজতের সমাবেশের হামলাকে আড়াল করার জন্য। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী মজনু মিয়া জজ মিয়ার কাহিনীর মতো সাজানো বলে উল্লেখ করেছেন। ডাকসু’র ভিপি নুরুল হক নুরুও এই মজনু আসল ধর্ষক কী না সে ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। একজন রোগা মাদকাসক্ত দুর্বল যুবক কী করে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে কাবু করে ফেললো তা মাহমুদুর রহমান মান্না সাহেবের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, কেবল একজন যুবকের পক্ষে একটি মেয়ের অসম্মতিতে জোরপূর্বক ধর্ষণ করা অসম্ভব। মেয়েটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কী না সে ব্যাপারেও বোধ হয় মান্না সাহেব সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ফেসবুকেও মজনুকে নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে অসংখ্য পোস্ট দেয়া হয়েছে, অনেকের ধারণা এ ধরনের ঘটনা আদৌ ঘটেনি।

মজনুকে যারা ধর্ষক বলছেন না তারা সবাই উচ্চ শিক্ষিত, রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তি, এদের অধিকাংশ আওয়ামী লীগ বিরোধী। তাদের সন্দেহ সঠিক বলে মেনে নিলে সরকার বা র্যাবের সাজানো নাটকের উদ্দেশ্য জানা প্রয়োজন। মান্না সাহেব ব্যতীত উল্লেখিত ব্যক্তিদের আর কেউই সরকার বা র্যাবের উদ্দেশ্য নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য রাখেননি। মান্না সাহেব বলেছেন, এ ঘটনা সাজানোর অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কলঙ্কিত করা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ধ্বংস করা, ভিপি নুরুল হক ও অন্যান্য ছাত্রদের ওপর নির্যাতনকে ধামাচাপা দেয়া। মান্না সাহেবের উল্লেখিত কারণগুলো আমার কাছে খুব সবল বলে মনে হয়নি। সরকারের জন্য বিব্রতকর কোন আলোচিত ঘটনাকে আড়াল করার জন্য সাধারণত আরেকটি ঘটনার অবতারণা করা হয়ে থাকে। বর্তমানে মেয়র নির্বাচনের ইস্যু ব্যতীত অন্য কোন ইস্যু দেখা যাচ্ছে না যা ঢাকার জন্য বা অন্য কোন বেনিফিট পাওয়ার জন্য সরকার এমন একটি নাটক সাজাতে প্রলুব্ধ হয়েছে। ছাত্রীটির ধর্ষণের সঙ্গে ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের কারো নাম উচ্চারিত হলে বিশ্বাস করার কারণ ছিল যে, মান্না সাহেবেরা সঠিক কথা বলছেন। মজনু নিজেই স্বীকার করেছে যে, সে একাই ধর্ষণ করেছে। অবশ্য র্যাব বা পুলিশের প্যাদানি শক্ত হলে ধর্ষকের স্বীকারোক্তি আদায় করা খুব কঠিন বিষয় নয়। তাই মজনুর স্বীকারোক্তি আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়। অন্যদিকে অনেকের বিশ্বাস মতো র্যাব সরকারের নির্দেশানুযায়ী নাটক সাজাতেই পারে; কিন্তু মেয়েটি কেন মিথ্যে বলবে? মেয়েটিও কি সরকারের বড় কোন প্রলোভনে পড়েছে? সেই প্রলোভনটির কথা কেউ বলছেন না। কিন্তু পৃথিবীতে এমন কোন প্রলোভন নেই যার বিনিময়ে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নাটক সাজিয়ে একজন মাদকাসক্ত ভবঘুরকে তার ধর্ষক বানাবে।

আসামির স্বীকারোক্তি অনুসারে ওই ছাত্রীর ব্যাগ, মোবাইল এবং আসামির ব্যবহৃত একটি জিন্সের প্যান্ট ও একটি জ্যাকেট উদ্ধার করা হয়। মজনু সেই মোবাইলটি শেওড়া এলাকার অরুনা নামে একজনের কাছে দেয়, অরুনা সেই মোবাইলটি খায়রুল নামে একজনের কাছে বিক্রি করে। সেই মোবাইলের সূত্র ধরেই মজনুকে গ্রেফতার করে র্যাব। উদ্ধার করা মোবাইল ও পোশাক-পরিচ্ছদ ধর্ষিতা মেয়েটি তার বলে শনাক্ত করেছে। ধর্ষককে শনাক্ত করার ব্যাপারে মেয়েটি স্পষ্ট করে বলেছে যে, পৃথিবীর সব চেহারা ভুলে গেলেও সে ওই ধর্ষকের চেহারা ভুলবে না। থানায় মামলা দায়েরের সময় ধর্ষকের যে আকার-আকৃতি বর্ণনা করা হয়েছে তাতে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, ধর্ষকের সামনের দুটি দাঁত নেই। মামলার এজাহারের বর্ণনার সঙ্গে মজনুর আকার-আকৃতির মিল রয়েছে, মজনুরও সামনে দুটি দাঁত ভাঙা। রেলগাড়ি থেকে পড়ে গেলে তার দাঁত দুটি ভেঙে যায় বলে মজনু র্যাবকে জানিয়েছে। র্যাব মেয়েটিকে পরীক্ষা করার জন্য অন্য একজন লোকের ছবি দেখিয়ে জানতে চায়, ছবির যুবক ধর্ষক কী না। মেয়েটির স্পষ্ট উত্তর ছিল, ‘না’। পরে র্যাব মজনুর ছবি দেখালে মেয়েটি বলে, ‘হ্যাঁ’। কোথায় মজনুকে ধরা হয়েছে, কীভাবে ধরা হয়েছে সবিস্তারে তা বর্ণনা করেছে র্যাব। মজনুও নাকি র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে মেয়েটিকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছে। র‌্যাবের বক্তব্য অনুযায়ী মজনু একজন সিরিয়াল রেপিস্ট। এই মজনু দীর্ঘদিন ধরে রাস্তা-ঘাটে পাগল, প্রতিবন্ধী ভিক্ষুকদের সুযোগমত ধর্ষণ করে আসছে- বহু ধর্ষণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা সত্ত্বেও সে কখনও ধরা পড়েনি। সে চুরি, ছিনতাই করে খাবার ও মাদক জোগাড় করত। তার স্ত্রী মারা গেছে। এ মজনুর আরেকটি ভিডিও ক্লিপ দেখলাম যেখানে সে একজন প্রতিবন্ধীকে আরেকজন ধর্ষকের হাত থেকে রক্ষা করার গল্প শোনাচ্ছে। তার পাশে বসা প্রতিবন্ধীকে নাকি অন্য একজন লোক ধর্ষণের জন্য হাত ধরে নেয়ার পথে মজনু তাকে রক্ষা করে। দেখলাম, মজনুর কথা শুনে মেয়েটি শুধু হাসছে। যারা ভিডিও করেছে তাদের দেখা না গেলেও কথা শোনা গেছে, তাদের প্রশ্নের উত্তরে মজনুর বক্তব্য হচ্ছে, পাশে বসা মেয়েটি চলে গেলেও তার কোন অসুবিধা হবে না, এমন মেয়ে তার প্রচুর আছে। মাদক সেবনের কারণে সম্ভবত তার মুখের কথা স্পষ্ট হচ্ছিল না।

মিডিয়ার খবর অনুযায়ী, ধর্ষিতা মেয়েটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। এ তথ্যের সত্যতা অতি সহজেই নিরূপণ করা সম্ভব। ধর্ষণের পর ওই এলাকায় পুলিশের তদন্ত চলাকালীন মজনুকে ঘোরাফেরা করতে টিভি চ্যানেল একাত্তরের ক্যামেরায় দেখা গেছে। একাত্তরের ভিডিও ক্লিপটিও সাজানো কী না তা আমার জানা নেই। মজনুর বক্তব্য অনুযায়ী ছাত্রীটি তাকে বারবার বাধা দিয়েছে। মেয়েটি জানে, মজনু তাকে মেরে ফেলার হুমকি এমনি এমনি দেয়নি, ধর্ষণে কোন সাক্ষী না রাখার মানসে বহু ধর্ষিতাকে ইতিপূর্বে হত্যা করা হয়েছে। মাদকাসক্ত ব্যক্তির এমনিতেই হুঁশ থাকে না- এই অবস্থায় মেয়েটির মৃত্যুর ভয় ছিল। শুধু বেঁচে থাকার জন্য ভয়ঙ্কর মাদকাসক্ত মজনুর কাছে মেয়েটি পরাজিত হতে বাধ্য হয়েছে বলে মনে হয়। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে মজনু সত্যি সত্যি ধর্ষক কী না- তা যাচাই করতে ডিএনএ টেস্টও করা হচ্ছে। ডিএনএ টেস্টে মজনুকে ধর্ষক হিসেবে শনাক্ত করা হলেও সন্দেহ দূর করা যাবে বলে মনে হয় না; কারণ এই সন্দেহের উৎস হচ্ছে রাজনীতি। আমার মনে হচ্ছে, মান্না সাহেবদের বক্তব্যগুলো বেশি আগামবার্তা হয়ে গেছে, তাদের আরেকটু ধৈর্য ধরার দরকার ছিল। কারণ এ ধর্ষণের সঙ্গে সাধারণ মানুষ এখনও কোন রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা খুঁজে পাচ্ছে না। তাই তাদের নানাবিধ সন্দেহ ফ্লপ করবে বলে মনে হয়। এভাবে ফ্লপ করলে ভবিষ্যতে তাদের মুখ দিয়ে নিসৃত সত্য কথাও মানুষ আর বিশ্বাস করবে না।

যুদ্ধেও নাটক সাজানো হয়; যুদ্ধে সাজানো নাটক নিয়ে মানুষ মাথা ঘামায় না। ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ৮০ জন আমেরিকান সৈন্য মারা গেছে বা ইউক্রেনের যাত্রীবাহী বিমান ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ভূপাতিত হয়নি- ইরানের এমন বক্তব্য বিশ্বাস করার প্রচুর লোক বাংলাদেশে আছে। আমেরিকান সেনা মারা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না- ইরানের এমন বক্তব্যের পরও অনেক বাংলাদেশির ধারণা, নিহত সেনাদের গোপনে কবর দেয়া হয়েছে এবং আহত সেনারা ইসরাইলে চিকিৎসা নিচ্ছে। ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে বিমান ধ্বংসের আমেরিকান বার্তা অধিকাংশ মুসলমান বিশ্বাস করেননি; ইরান বলেছিল যান্ত্রিক ত্রুটির কারণেই বিমানটি ধ্বংস হয়েছে এবং অধিকাংশ মুসলমান বাঙালি ইরানের বক্তব্যকেই সহি বলে বিশ্বাস করেছিল। পরবর্তীতে ইরানের স্বীকারোক্তির পর ওই মুসলমানেরাই বলছেন, ইরানের স্বীকার করা ঠিক হয়নি। বিমানে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতও সাজানো নাটক হতে পারে, যিনি বা যারা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছেন তিনি আমেরিকান পেইড লোকও হতে পারে। বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমেরিকা বলে দিয়েছিল, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রে বিমান ধ্বংস হয়েছে, তখন ইরানও জানে না যে কীভাবে যাত্রীবাহী বিমানটি ধ্বংস হলো। বাংলাদেশেও সংঘটিত নানাবিধ ঘটনার পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলার লোকের অভাব নেই- পক্ষ বা বিপক্ষের এই লোকগুলো যুক্তিসঙ্গত কার্য-কারণ অনুসন্ধানে মোটেই উৎসাহী নয়, নাটক সাজাতে এবং সাজানো নাটক দিয়ে বিপক্ষকে ঘায়েল করতে মানসিকভাবে ওই লোকগুলো সর্বদা প্রস্তুত থাকে। এরা যুক্তি নয়, অন্ধ বিশ্বাসে তাড়িত।

ক্যান্টনমেন্ট থানার আওতায় রাজধানীর ব্যস্ততম একটি এলাকায় এভাবে চুরি, ছিনতাই ও ধর্ষণ কর্মকা- হয়ে আসছে তা শুনলেই গা শিহরিত হয়ে উঠে। এ মজনু নাকি একই জায়গায় বহুবার প্রতিবন্ধী ভিক্ষুকদের ধর্ষণ করেছে। কথিত এলাকায় স্বল্প আলোর ভেতর ঝোপঝাড়ের আড়ালে মাদকাসক্ত ও ভবঘুরদের নিয়মিত আড্ডা কারো চোখে এতদিন ধরে কেন পড়লো না তা বিস্ময়কর। এমনতর ঘটনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ কোন লোকের নজরে না আসা জাতির জন্য লজ্জার। সারা দেশে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে ধর্ষণ, ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যা। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু নয়, মাদরাসা ও মক্তবের পাঁচ-ছয় বছরের শিশু ছাত্রীরাও ধর্মীয় মূল্যবোধে উজ্জীবিত নিয়মিত ওয়াজকারী আলেমদের ধর্ষণ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ধর্ষণ অতীতেও হয়েছে, কিন্তু প্রকাশ পেয়েছে খুবই কম। এখন ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশে মেয়েরা অনেকটা সাহসী হয়ে উঠেছে। ধর্ষণের কাহিনী প্রকাশের সাহসিকতা নিয়ে আমরা অনেকে বাহবা দিলেও পরিবার ও সমাজে একজন ধর্ষিতার দুর্বিষহ অবস্থা দূরীভূত করার কোন হাতিয়ার জানা নেই- কোন ধর্ষিতা মেয়ের আত্মহত্যা ঠেকানোর স্বার্থে ওই পরিবারকে বাধ্য হয়ে নিজের এলাকা ত্যাগ করে অপরিচিত জায়গায় গিয়ে বসতি গড়ে তুলতে হয়। আমরা কুমারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন না করেই বিধবা বিয়ে করি, পরকীয়ায় বিবাহিতা রমনীর সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হই, কিন্ত ধর্ষিতা মেয়েদের বিয়ে করাকে ঘৃণা করি- এমন দ্বিচারী মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

zeauddinahmed@gmail.com