মুনীরুজ্জামান
জাতীয় সংসদ ক্রসফায়ারের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেনি। কিন্তু অন্তত চারজন জাতীয় সংসদ সদস্য ধর্ষণকারীদের ক্রসফায়ারে হত্যা করার পক্ষে মত দিয়েছেন। এদের মধ্যে দু’জন সরাসরি ক্রসফায়ারে হত্যা করার দাবি জানিয়েছেন, অন্য দু’জন, এদের মধ্যে একজন সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতাও রয়েছেন, ওই দু’জন সংসদ সদস্যকে সমর্থন করেছেন। এর অর্থ হলো জাতীয় সংসদের অন্তত চারজন সদস্যের আইন, বিচারিক প্রক্রিয়া এবং বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা নেই। থাকলে তারা ক্রসফায়ার অর্থৎ বিচার না করে সরাসরি হত্যা করার দাবি জানাতেন না এবং সমর্থন করতেন না। প্রশাসন আইনশৃংখলা তথা ধর্ষণ, সন্ত্রাস, রাজনৈতিক সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণে কতখানি ব্যর্থ হলে খোদ আইন প্রণেতারা আইন ভাঙার দাবি জানাতে পারেন সেটা আমাদের সবাইকে ভাবতে হবে। আইনপ্রণেতাদের যখন আইনের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে যায় তখন রাষ্ট্রের আইনি ব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা থাকে কি করে? গণতন্ত্র এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য এর চেয়ে বিপর্যয়কর আর কী হতে পারে! আইনপ্রণেতারা যখন সরাসরি আইন ভাঙার কথা বলেন তখন জাতি হিসেবে আমাদের ব্যর্থতা আর লজ্জার কোন শেষ থাকে না। আমাদের জাতীয় ইমেজ যেখানে গিয়ে দাঁড়ায় সেটার নাম বর্বরতা। আমাদের দেশকে বর্বর দেশ, আমাদের জাতিগতভাবে বর্বর হিসেবে পরিচিতি দেয়ার জন্য এ সংসদ সদস্যদের কি অভিযুক্ত করা যায় না। অথচ এ দেশে ক্রসফায়ার-এনকাউন্টার-বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলছে অবিরাম এবং সরকার যথারীতি সেটা অস্বীকার করে চলেছে অবিরাম, দেশি ফোরামে- আন্তর্জাতিক ফোরামেও। প্রয়োজনে ধর্ষণকারীদের ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যা করার দাবি জানিয়েছেন জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির দু’জন সদস্য। গতকাল মঙ্গলবার সংসদে পয়েন্ট অফ অর্ডারে অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিয়ে এ দাবি জানান কাজী ফিরোজ রশীদ ও মুজিবুল হক চুন্নু। সরকারি দলের একজন জ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্য ও অন্য একজন সংসদ সদস্য তাদের দাবিকে সমর্থন করেন। (কালের কণ্ঠ, ১৫ জানুয়ারি ২০২০)
১৮ জানুয়ারির সংবাদ-এর প্রথম পাতায় কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ প্রাঙ্গণে ধর্ষণবিরোধী মানববন্ধনের পোস্টারের ভাষা ছিল ‘ধর্ষকের বিচার চাই, ক্রসফায়ার নয়’। সংবাদ-এর ‘শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন। ক্রসফায়ার নয়, ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ডের আইন চাই’ শীর্ষক সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণসহ বিভিন্ন জায়গায় ধর্ষণের প্রতিবাদে কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করেছেন। এ সময় তারা ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের আইন করা, ক্রসফায়ারের পরিবর্তে ধর্ষকদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা, ইন্টারনেটে ধর্ষিতাকে ভাইরাল না করে ধর্ষকদের ভাইরাল করা, যে সমাজ ধর্ষক জন্ম দেয় সেই সমাজ পরিবর্তনসহ বিভিন্ন দাবি ও স্লোগান সংবলিত পোস্টার বহন করে। মানববন্ধনের ছবিতে ইনসেট করা একজন ছাত্রীকে ‘ধর্ষকের বিচার চাই, ক্রসফায়ার নয়’ সংবলিত পোস্টার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
ধর্ষণকারীর বিচার করা সম্পর্কে কয়েকজন সংসদ সদস্যের যে অবস্থান পাওয়া গেল সেটা হচ্ছে, ধর্ষণকারীকে ক্রসফায়ারে অর্থাৎ বিচার না করে হত্যা করতে হবে। বাংলাদেশে ক্রসফায়ারের ঘটনা শুরু হয় ১৯৯৪ সালে বিএনপি-জামায়াতের চার দলীয় সরকারের সময়। আইনি প্রক্রিয়ায় সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ অন্যান্য অপরাধ দমনে ব্যর্থ হয়েই বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় সরকার ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যা শুরু করে। এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে, এর আগে ২০০২ সালে আইনশৃংখলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হলে, বিএনপি-জামায়াত সরকার অপরাধ দমনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে কুখ্যাত ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ শুরু করে অন্তত ৫২ জন নিরপরাধ মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা করে। এর বিরুদ্ধে দেশে প্রবল প্রতিক্রিয়া হলে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্ব অপারেশন ক্লিনহার্টে অংশগ্রহণকারী বাহিনীকে ‘দায়মুক্তি’ দিয়ে এ অমানবিক হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে বাধ্য হয়।
২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় সরকারের পতনের পর দুই বছরের জন্য অর্থাৎ ২০০৭-০৮ মেয়াদের জন্য ক্ষমতায় ছিল সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও বন্ধ হয়নি ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড।
এর ২ বছর পর, কুখ্যাত শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নানকে উত্তরায় ক্রসফায়ারে হত্যা করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় ক্রসফায়ারে মানুষ হত্যা। সেই শুরু। তারপর থেকে এ ৩৬ বছরে কয়েক হাজার মানুষকে ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার এবং বন্দুকযুদ্ধ নামক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে চিহ্নিত সন্ত্রাসী যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, ছিনতাইকারী, মাদক বহনকারী, চুনোপুঁটি মাদক ব্যবসায়ী এবং নিরপরাধ মানুষকেও হত্যা করা হয়েছে ক্রসফায়ারে।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে সংগৃহীত তথ্য থেকে জানা যায়- ২০০৪ সালে শুরু হওয়ার পর থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ২৬৮৮ জনকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৪, ২০০৫ এবং ২০০৬-এ ৩ বছরে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে যথাক্রমে ১৩৪, ৩৫৪ এবং ২৫৮ জনকে। সর্বমোট ৭৪৬ জনকে, গড়ে বছরে ২৪৮.৩ জনকে ক্রসফায়ারে বিচারবহির্ভূত ভাবে হত্যা করা হয়। এছাড়াও ২০০২ সালে অপারেশন ক্লিনহার্ট-এ ৫২ জনকে হত্যা করা হয় অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয় মোট ৭৯৮ জনকে।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ২ বছরে অর্থাৎ ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয় যথাক্রমে ১১৫ এবং ১৪১ জনকে। মোট ২৫৬ জন গড়ে বছরে ১২৮ জনকে।
২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং কঠোরভাবে মানবাধিকার বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছিল। উল্লিখিত মেনিফেস্টোর ৫টি অগ্রাধিকার প্রাপ্ত বিষয়ের ৫ম ধারাটি ছিল সুশাসন প্রতিষ্ঠা বিষয়ক এ ধারায় বলা হয়েছে-
5. Establishment of Good Governance :
i. Terrorism and religious extremism will be controlled with iron hand. Trial of war criminals will be arranged.
ii. Genuine independence and impartiality of the judiciary will be ensured. Extrajudicial killings will be stopped. The judgment of the Bangabandhu murder case will be made effective and the retrial of jail killings will be held. Trial of real criminals responsible for the grenade attack of the 21st August, 2004 through proper investigation will be arranged. Rule of law will be established, The Human Rights Commission will be strengthened and made effective, and an Ombudsman will be appointed. Human rights will be strictly enforced. (সূত্র : আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইট)
২০০৮ সালের এ নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে আওয়ামী লীগ অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে অঙ্গীকার করেছিল : সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হবে। স্বাধীন পক্ষপাতমুক্ত বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। .... আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে। মানবাধিকার কঠোরভাবে কার্যকর করা হবে।
দেশবাসী আশা করেছিল এবার বোধহয় ক্রসফায়ার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে। হারিয়ে যাওয়া খোঁজ না পাওয়া আত্মীয়দের খোঁজ পাওয়া যাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি। ২০০৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ১১ বছরে ক্রসফায়ার-এনকাউন্টার-বন্দুকযুদ্ধ নামক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে ১৬৮৯ জন মারা গেছে। গড়ে প্রতি বছর ১৫৩.৩ জনকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে।
মিডিয়ার তথ্যে আরও জানা যায়- ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শাসনামলে প্রথম ৫ বছরে ক্রসফায়ারে মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পেলেও ২০১৪ সাল থেকে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। তথ্যে দেখা যায় আওয়ামী লীগ আমলে ২০০৯, ২০১০, ২০১১, ২০১২ এবং ২০১৩ পর্যন্ত ৫ বছরে বিচারবহির্ভূত হত্যায় নিহত হয়েছে যথাক্রমে ১২৫, ৯৩, ৬২, ৫৮, ৪২ জন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ক্রমেই কমে আসছিল বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। ২০১৪, ২০১৫, ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮ এবং ২০১৯ এ ৬ বছরে বিচাবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে নিহত হয়েছে যথাক্রমে ১২৮, ১৪৬, ১৫৯, ১২৬, ৪১২ এবং ৩৩৮ জন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ক্রম ঊর্ধ্বগতি। সন্দেহ নেই, সন্ত্রাসসহ অন্যান্য অপরাধ বৃদ্ধির কারণেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও বেড়েছে।
অর্থাৎ ২০০৪ সাল থেকে প্রতিবছর ধারাবাহিক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা ক্রসফায়ার সন্ত্রাস কমাতে পারেনি। জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, ‘এত ঘটনা ঘটছে, মাদকের জন্য এত ক্রসফায়ার হচ্ছে। সমানে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। কিন্তু এ ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ, এখন পর্যন্ত কেন একজন ধর্ষক বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়নি? জাতীয় পার্টির আরেকজন সংসদ সদস্য বলেছেন, ‘ধর্ষকদের একমাত্র শাস্তি হওয়া উচিত এনকাউন্টারে দিয়ে মেরে ফেলা, যাতে আর কোন ধর্ষক সাহস না পায়। ধর্ষক গ্রেফতার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিয়ে ওইখানে গুলি করে মেরে ফেলা হোক।’
‘এত ঘটনা ঘটছে, মাদকের জন্য এত ক্রসফায়ার হচ্ছে। সমানে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। কিন্তু এ ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ, এখন পর্যন্ত কেন একজন ধর্ষক বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়নি? বিষয়টা গুরুত্ব দিয়ে যদি ব্যবস্থা না নেয়া যায়, তবে কোন ক্রমেই এটা কনট্রোল করা যাবে না। এ জন্য প্রয়োজনে আইন সংশোধন করতে হবে।’
ধর্ষকদের একমাত্র শাস্তি হওয়া উচিত এনকাউন্টারে দিয়ে মেরে ফেলা, যাতে আর কোন ধর্ষক সাহস না পায়। ধর্ষক গ্রেফতার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিয়ে ওইখানে গুলি করে মেরে ফেলা হোক।’
(কালের কণ্ঠ, ১৫ ফেব্রুয়ারি)
ক্রসফায়ারের ইতিহাস নিঃসন্দেহে প্রমাণ করেছে ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড দিয়ে আর যাই হোক সন্ত্রাস, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা, কোন অপরাধই কমানো সম্ভব নয়। সংসদ সদস্য দু’জন বলেছেন মাদক কারবারিদের মতো ধর্ষণকারীদের ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারে হত্যা করলে ধর্ষণ বন্ধ হবে। তাদের দু’জনকে বিনীতভাবে প্রশ্ন করতে চাই ক্রসফায়ারে দেয়ার পর মাদক ব্যবসায়ীদের তৎপরতা কি কমেছে? মাদকের দৌরাত্ম্য কি কমেছে? কমেনি। কক্সবাজারের একজন পুলিশ কর্মকর্তার কথা হচ্ছে, একসময় কক্সবাজারে যারা মাদক গডফাদারদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করত তারাই এখন (গডফাদারদের তথাকথিত সারেন্ডার এবং কয়েকজনের ক্রসফায়ারে হত্যার পর) সংখ্যায় যারা প্রায় ৫০০ তারাই ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পুরোদমে ব্যবসা চালাচ্ছে। এদের মধ্যে ৩০ জন হচ্ছে বড় ব্যবসায়ী। তাহলে এত ক্রসফায়ার আর তোড়জোড় করে সারেন্ডার করে কী হলো। ফলাফল শূন্য। ইয়াবা এখন প্লেনে করে উড়ে আসছে, রিপোর্ট করেছে ইত্তেফাক।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কোন সমাধাই নয়। অনেক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে ক্রসফায়ারে। তার মধ্যে কথিত অপরাধী যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে নিরপরাধ মানুষ; কিন্তু এ হত্যা এ মৃত্যু দেশ সমাজ ও রাষ্ট্রকে কিছুই দিতে পারেনি। কিন্তু ক্ষতি হয়েছে অনেক। বিচার ব্যবস্থাকে দুর্বল করা হয়েছে। আইনশৃংখলা বাহিনীকে জবাবদিহিতার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ধ্বংস করা হয়েছে সুশাসন, আইনের শাসন এবং মানবাধিকার। আধুনিক সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে আমরা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি। একদিকে অপরাধ দমনের স্বাভাবিক, সুস্থ, মানবিক এবং আইনসম্মত সব ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে, অন্যদিকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও ব্যর্থ। এ বাস্তবতায় কয়েকজন সংসদ সদস্য আবার বিচার না করে ক্রসফায়ারে হত্যা করার দাবি জানাচ্ছেন। কোথায় যাচ্ছি আমরা?
এ বিষচক্র থেকে বের হওয়ার রাষ্ট্র ও সমাজ এবং মানুষকে বের করার কঠিন পথটি হচ্ছে দেশের কঠোরভাবে আইনের শাসন এবং সুশাসন নিশ্চিত করা। মানবাধিকার নিশ্চিত করা। বিচার ব্যবস্থা, বিচারিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী করা। সব আইনশৃংখলা বাহিনীকে কঠোর জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতার মধ্যে নিয়ে আসা। অপরাধ, তা সে সন্ত্রাসই হোক আর ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিই হোক, অপরাধ সম্পর্কে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা। কারণ কি ব্যক্তি পর্যায়ে, কি পরিবার বা সামাজিক পর্যায়ে এখন অপরাধকে অপরাধ বলেই মনে করা হয় না। এ মানসিকতা বদলানো কঠিন, কাজগুলো করা আরও কঠিন। সেই কারণেই কী দু’জন সংসদ সদস্য ক্রসফায়ারের পক্ষে ওকালতি করেছেন? তাদের মনে রাখা সমীচীন হবে পিচ্চি হান্নান থেকে ক্রসফায়ারের জাতীয় সংসদ পর্যন্ত যাত্রা দেশের জন্য মোটেই ভালো হবে না।
সোমবার, ২০ জানুয়ারী ২০২০ , ৬ মাঘ ১৪২৬, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১
মুনীরুজ্জামান
জাতীয় সংসদ ক্রসফায়ারের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেনি। কিন্তু অন্তত চারজন জাতীয় সংসদ সদস্য ধর্ষণকারীদের ক্রসফায়ারে হত্যা করার পক্ষে মত দিয়েছেন। এদের মধ্যে দু’জন সরাসরি ক্রসফায়ারে হত্যা করার দাবি জানিয়েছেন, অন্য দু’জন, এদের মধ্যে একজন সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতাও রয়েছেন, ওই দু’জন সংসদ সদস্যকে সমর্থন করেছেন। এর অর্থ হলো জাতীয় সংসদের অন্তত চারজন সদস্যের আইন, বিচারিক প্রক্রিয়া এবং বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা নেই। থাকলে তারা ক্রসফায়ার অর্থৎ বিচার না করে সরাসরি হত্যা করার দাবি জানাতেন না এবং সমর্থন করতেন না। প্রশাসন আইনশৃংখলা তথা ধর্ষণ, সন্ত্রাস, রাজনৈতিক সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণে কতখানি ব্যর্থ হলে খোদ আইন প্রণেতারা আইন ভাঙার দাবি জানাতে পারেন সেটা আমাদের সবাইকে ভাবতে হবে। আইনপ্রণেতাদের যখন আইনের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে যায় তখন রাষ্ট্রের আইনি ব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা থাকে কি করে? গণতন্ত্র এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য এর চেয়ে বিপর্যয়কর আর কী হতে পারে! আইনপ্রণেতারা যখন সরাসরি আইন ভাঙার কথা বলেন তখন জাতি হিসেবে আমাদের ব্যর্থতা আর লজ্জার কোন শেষ থাকে না। আমাদের জাতীয় ইমেজ যেখানে গিয়ে দাঁড়ায় সেটার নাম বর্বরতা। আমাদের দেশকে বর্বর দেশ, আমাদের জাতিগতভাবে বর্বর হিসেবে পরিচিতি দেয়ার জন্য এ সংসদ সদস্যদের কি অভিযুক্ত করা যায় না। অথচ এ দেশে ক্রসফায়ার-এনকাউন্টার-বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলছে অবিরাম এবং সরকার যথারীতি সেটা অস্বীকার করে চলেছে অবিরাম, দেশি ফোরামে- আন্তর্জাতিক ফোরামেও। প্রয়োজনে ধর্ষণকারীদের ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যা করার দাবি জানিয়েছেন জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির দু’জন সদস্য। গতকাল মঙ্গলবার সংসদে পয়েন্ট অফ অর্ডারে অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিয়ে এ দাবি জানান কাজী ফিরোজ রশীদ ও মুজিবুল হক চুন্নু। সরকারি দলের একজন জ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্য ও অন্য একজন সংসদ সদস্য তাদের দাবিকে সমর্থন করেন। (কালের কণ্ঠ, ১৫ জানুয়ারি ২০২০)
১৮ জানুয়ারির সংবাদ-এর প্রথম পাতায় কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ প্রাঙ্গণে ধর্ষণবিরোধী মানববন্ধনের পোস্টারের ভাষা ছিল ‘ধর্ষকের বিচার চাই, ক্রসফায়ার নয়’। সংবাদ-এর ‘শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন। ক্রসফায়ার নয়, ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ডের আইন চাই’ শীর্ষক সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণসহ বিভিন্ন জায়গায় ধর্ষণের প্রতিবাদে কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করেছেন। এ সময় তারা ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের আইন করা, ক্রসফায়ারের পরিবর্তে ধর্ষকদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা, ইন্টারনেটে ধর্ষিতাকে ভাইরাল না করে ধর্ষকদের ভাইরাল করা, যে সমাজ ধর্ষক জন্ম দেয় সেই সমাজ পরিবর্তনসহ বিভিন্ন দাবি ও স্লোগান সংবলিত পোস্টার বহন করে। মানববন্ধনের ছবিতে ইনসেট করা একজন ছাত্রীকে ‘ধর্ষকের বিচার চাই, ক্রসফায়ার নয়’ সংবলিত পোস্টার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
ধর্ষণকারীর বিচার করা সম্পর্কে কয়েকজন সংসদ সদস্যের যে অবস্থান পাওয়া গেল সেটা হচ্ছে, ধর্ষণকারীকে ক্রসফায়ারে অর্থাৎ বিচার না করে হত্যা করতে হবে। বাংলাদেশে ক্রসফায়ারের ঘটনা শুরু হয় ১৯৯৪ সালে বিএনপি-জামায়াতের চার দলীয় সরকারের সময়। আইনি প্রক্রিয়ায় সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ অন্যান্য অপরাধ দমনে ব্যর্থ হয়েই বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় সরকার ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যা শুরু করে। এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে, এর আগে ২০০২ সালে আইনশৃংখলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হলে, বিএনপি-জামায়াত সরকার অপরাধ দমনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে কুখ্যাত ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ শুরু করে অন্তত ৫২ জন নিরপরাধ মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা করে। এর বিরুদ্ধে দেশে প্রবল প্রতিক্রিয়া হলে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্ব অপারেশন ক্লিনহার্টে অংশগ্রহণকারী বাহিনীকে ‘দায়মুক্তি’ দিয়ে এ অমানবিক হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে বাধ্য হয়।
২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় সরকারের পতনের পর দুই বছরের জন্য অর্থাৎ ২০০৭-০৮ মেয়াদের জন্য ক্ষমতায় ছিল সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও বন্ধ হয়নি ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড।
এর ২ বছর পর, কুখ্যাত শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নানকে উত্তরায় ক্রসফায়ারে হত্যা করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় ক্রসফায়ারে মানুষ হত্যা। সেই শুরু। তারপর থেকে এ ৩৬ বছরে কয়েক হাজার মানুষকে ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার এবং বন্দুকযুদ্ধ নামক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে চিহ্নিত সন্ত্রাসী যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, ছিনতাইকারী, মাদক বহনকারী, চুনোপুঁটি মাদক ব্যবসায়ী এবং নিরপরাধ মানুষকেও হত্যা করা হয়েছে ক্রসফায়ারে।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে সংগৃহীত তথ্য থেকে জানা যায়- ২০০৪ সালে শুরু হওয়ার পর থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ২৬৮৮ জনকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৪, ২০০৫ এবং ২০০৬-এ ৩ বছরে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে যথাক্রমে ১৩৪, ৩৫৪ এবং ২৫৮ জনকে। সর্বমোট ৭৪৬ জনকে, গড়ে বছরে ২৪৮.৩ জনকে ক্রসফায়ারে বিচারবহির্ভূত ভাবে হত্যা করা হয়। এছাড়াও ২০০২ সালে অপারেশন ক্লিনহার্ট-এ ৫২ জনকে হত্যা করা হয় অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয় মোট ৭৯৮ জনকে।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ২ বছরে অর্থাৎ ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয় যথাক্রমে ১১৫ এবং ১৪১ জনকে। মোট ২৫৬ জন গড়ে বছরে ১২৮ জনকে।
২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং কঠোরভাবে মানবাধিকার বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছিল। উল্লিখিত মেনিফেস্টোর ৫টি অগ্রাধিকার প্রাপ্ত বিষয়ের ৫ম ধারাটি ছিল সুশাসন প্রতিষ্ঠা বিষয়ক এ ধারায় বলা হয়েছে-
5. Establishment of Good Governance :
i. Terrorism and religious extremism will be controlled with iron hand. Trial of war criminals will be arranged.
ii. Genuine independence and impartiality of the judiciary will be ensured. Extrajudicial killings will be stopped. The judgment of the Bangabandhu murder case will be made effective and the retrial of jail killings will be held. Trial of real criminals responsible for the grenade attack of the 21st August, 2004 through proper investigation will be arranged. Rule of law will be established, The Human Rights Commission will be strengthened and made effective, and an Ombudsman will be appointed. Human rights will be strictly enforced. (সূত্র : আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইট)
২০০৮ সালের এ নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে আওয়ামী লীগ অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে অঙ্গীকার করেছিল : সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হবে। স্বাধীন পক্ষপাতমুক্ত বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। .... আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে। মানবাধিকার কঠোরভাবে কার্যকর করা হবে।
দেশবাসী আশা করেছিল এবার বোধহয় ক্রসফায়ার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে। হারিয়ে যাওয়া খোঁজ না পাওয়া আত্মীয়দের খোঁজ পাওয়া যাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি। ২০০৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ১১ বছরে ক্রসফায়ার-এনকাউন্টার-বন্দুকযুদ্ধ নামক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে ১৬৮৯ জন মারা গেছে। গড়ে প্রতি বছর ১৫৩.৩ জনকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে।
মিডিয়ার তথ্যে আরও জানা যায়- ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শাসনামলে প্রথম ৫ বছরে ক্রসফায়ারে মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পেলেও ২০১৪ সাল থেকে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। তথ্যে দেখা যায় আওয়ামী লীগ আমলে ২০০৯, ২০১০, ২০১১, ২০১২ এবং ২০১৩ পর্যন্ত ৫ বছরে বিচারবহির্ভূত হত্যায় নিহত হয়েছে যথাক্রমে ১২৫, ৯৩, ৬২, ৫৮, ৪২ জন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ক্রমেই কমে আসছিল বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। ২০১৪, ২০১৫, ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮ এবং ২০১৯ এ ৬ বছরে বিচাবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে নিহত হয়েছে যথাক্রমে ১২৮, ১৪৬, ১৫৯, ১২৬, ৪১২ এবং ৩৩৮ জন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ক্রম ঊর্ধ্বগতি। সন্দেহ নেই, সন্ত্রাসসহ অন্যান্য অপরাধ বৃদ্ধির কারণেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও বেড়েছে।
অর্থাৎ ২০০৪ সাল থেকে প্রতিবছর ধারাবাহিক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা ক্রসফায়ার সন্ত্রাস কমাতে পারেনি। জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, ‘এত ঘটনা ঘটছে, মাদকের জন্য এত ক্রসফায়ার হচ্ছে। সমানে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। কিন্তু এ ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ, এখন পর্যন্ত কেন একজন ধর্ষক বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়নি? জাতীয় পার্টির আরেকজন সংসদ সদস্য বলেছেন, ‘ধর্ষকদের একমাত্র শাস্তি হওয়া উচিত এনকাউন্টারে দিয়ে মেরে ফেলা, যাতে আর কোন ধর্ষক সাহস না পায়। ধর্ষক গ্রেফতার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিয়ে ওইখানে গুলি করে মেরে ফেলা হোক।’
‘এত ঘটনা ঘটছে, মাদকের জন্য এত ক্রসফায়ার হচ্ছে। সমানে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। কিন্তু এ ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ, এখন পর্যন্ত কেন একজন ধর্ষক বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়নি? বিষয়টা গুরুত্ব দিয়ে যদি ব্যবস্থা না নেয়া যায়, তবে কোন ক্রমেই এটা কনট্রোল করা যাবে না। এ জন্য প্রয়োজনে আইন সংশোধন করতে হবে।’
ধর্ষকদের একমাত্র শাস্তি হওয়া উচিত এনকাউন্টারে দিয়ে মেরে ফেলা, যাতে আর কোন ধর্ষক সাহস না পায়। ধর্ষক গ্রেফতার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিয়ে ওইখানে গুলি করে মেরে ফেলা হোক।’
(কালের কণ্ঠ, ১৫ ফেব্রুয়ারি)
ক্রসফায়ারের ইতিহাস নিঃসন্দেহে প্রমাণ করেছে ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড দিয়ে আর যাই হোক সন্ত্রাস, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা, কোন অপরাধই কমানো সম্ভব নয়। সংসদ সদস্য দু’জন বলেছেন মাদক কারবারিদের মতো ধর্ষণকারীদের ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারে হত্যা করলে ধর্ষণ বন্ধ হবে। তাদের দু’জনকে বিনীতভাবে প্রশ্ন করতে চাই ক্রসফায়ারে দেয়ার পর মাদক ব্যবসায়ীদের তৎপরতা কি কমেছে? মাদকের দৌরাত্ম্য কি কমেছে? কমেনি। কক্সবাজারের একজন পুলিশ কর্মকর্তার কথা হচ্ছে, একসময় কক্সবাজারে যারা মাদক গডফাদারদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করত তারাই এখন (গডফাদারদের তথাকথিত সারেন্ডার এবং কয়েকজনের ক্রসফায়ারে হত্যার পর) সংখ্যায় যারা প্রায় ৫০০ তারাই ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পুরোদমে ব্যবসা চালাচ্ছে। এদের মধ্যে ৩০ জন হচ্ছে বড় ব্যবসায়ী। তাহলে এত ক্রসফায়ার আর তোড়জোড় করে সারেন্ডার করে কী হলো। ফলাফল শূন্য। ইয়াবা এখন প্লেনে করে উড়ে আসছে, রিপোর্ট করেছে ইত্তেফাক।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কোন সমাধাই নয়। অনেক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে ক্রসফায়ারে। তার মধ্যে কথিত অপরাধী যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে নিরপরাধ মানুষ; কিন্তু এ হত্যা এ মৃত্যু দেশ সমাজ ও রাষ্ট্রকে কিছুই দিতে পারেনি। কিন্তু ক্ষতি হয়েছে অনেক। বিচার ব্যবস্থাকে দুর্বল করা হয়েছে। আইনশৃংখলা বাহিনীকে জবাবদিহিতার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ধ্বংস করা হয়েছে সুশাসন, আইনের শাসন এবং মানবাধিকার। আধুনিক সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে আমরা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি। একদিকে অপরাধ দমনের স্বাভাবিক, সুস্থ, মানবিক এবং আইনসম্মত সব ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে, অন্যদিকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও ব্যর্থ। এ বাস্তবতায় কয়েকজন সংসদ সদস্য আবার বিচার না করে ক্রসফায়ারে হত্যা করার দাবি জানাচ্ছেন। কোথায় যাচ্ছি আমরা?
এ বিষচক্র থেকে বের হওয়ার রাষ্ট্র ও সমাজ এবং মানুষকে বের করার কঠিন পথটি হচ্ছে দেশের কঠোরভাবে আইনের শাসন এবং সুশাসন নিশ্চিত করা। মানবাধিকার নিশ্চিত করা। বিচার ব্যবস্থা, বিচারিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী করা। সব আইনশৃংখলা বাহিনীকে কঠোর জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতার মধ্যে নিয়ে আসা। অপরাধ, তা সে সন্ত্রাসই হোক আর ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিই হোক, অপরাধ সম্পর্কে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা। কারণ কি ব্যক্তি পর্যায়ে, কি পরিবার বা সামাজিক পর্যায়ে এখন অপরাধকে অপরাধ বলেই মনে করা হয় না। এ মানসিকতা বদলানো কঠিন, কাজগুলো করা আরও কঠিন। সেই কারণেই কী দু’জন সংসদ সদস্য ক্রসফায়ারের পক্ষে ওকালতি করেছেন? তাদের মনে রাখা সমীচীন হবে পিচ্চি হান্নান থেকে ক্রসফায়ারের জাতীয় সংসদ পর্যন্ত যাত্রা দেশের জন্য মোটেই ভালো হবে না।