মুক্তিযোদ্ধা বাবলুর শরীরে যুদ্ধকালীন বোমার ১১টি স্পিøন্টার

সৌম্যকান্তি দেহের একজন মানুষ অবলিলায় বলে চলেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা। দেখে বোঝার উপায় নেই শরীরে এখনও তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন কৈশরের যুদ্ধদিনের বোমার ১১টি স্পি্লন্টার। পাকিস্তানি হানাদারদের নির্যাতন অত্যাচারে বিভিন্ন অঙ্গপ্রতঙ্গের হাড় ভেঙে চুরমার হয়েছে। ভেঙে দেয়া হয়েছে মুখের সামনের ছয়টি দাঁত। এখনও যুদ্ধদিনের গৌরবের স্মৃতি টাটকা ও জীবন্ত তার মানসপটে। তিনি যশোরের বীর সন্তান মুক্তিযোদ্ধা খুরশীদ আনোয়ার বাবলু। প্রবাস যাপন করলেও যার মননে প্রিয় মাতৃভূমি আর লাল সুবজের গৌরবের পতাকা সদা জাগ্রত।

গতকাল সকাল ১০টায় যশোর মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগার চত্বরে যান এ বীরসেনা। যশোর মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগার এবং আইইডি যুব ফোরামের সহযোগিতায় ‘মুক্তিযোদ্ধা দেখো মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনো’ শীর্ষক আয়োজনে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের তিনি একাত্তরের ভয়ানক দিনগুলোর বর্ণনা শুনান। দেশের বীর সন্তানদের বীরত্ব লাখো শহীদের আত্মত্যাগের রোমহর্ষক সেই বর্ণনা শুনে গর্ব শ্রদ্ধা আর দায়িত্ববোধের আত্মবিবেচনায় শিউরে উঠেছেন অনেক শ্রোতা। যশোর মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগারের এটি ধারাবাহিক কর্মসূচি। অনুষ্ঠানে স্কুল-কলেজের ৪০ জন শিক্ষার্থী পিনপতন নীরবতার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনে।

অনুষ্ঠানের শুরুতে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এক মিনিট নীরবতা পালন শেষে জাতীয় সংগীতে কণ্ঠমেলান সবাই। জাতীয় সংগীতের পর আইইডি যশোরের পরিচালক বিথীকা সরকার সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়ার্ক স্টেট মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার খুরশিদ আনোয়ার বাবলুর সঙ্গে। কিশোর এ মুক্তিযোদ্ধার সম্পর্কে আয়োজনের শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে তার সম্পর্কে ধারণা দেন আরেক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা প্রবীণ সাংবাদিক রুকুনউদ্দৌলাহ।

যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণ করে বাবলু বলেন, যশোরের মানুষের কাছে ১৯৭১ সালের তিন মার্চ ঐতিহাসিক দিন। স্বাধীনতা সংগ্রামে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছিল এদিন। ৩ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টা। স্বতঃস্ফূর্ত জনতার বিশাল মিছিল বের হয় ঈদগাহ ময়দান থেকে। দড়াটানা মোড় ঘুরে কাপুড়িয়াপট্টি-চৌরাস্তা হয়ে মিছিলটি ঢোকে রেল রোডে। সরকারি খাদ্য গুদামের সামনে পাক হানাদার বাহিনীর অবস্থান দেখে তাদের দিকে ইট ও জুতা নিক্ষেপ করে বিক্ষুব্ধ জনতা। সার্কিট হাউসের ভেতরে পাক সেনাদের দেখে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে জনতা। তারা সার্কিট হাউস আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। দুপুর ১২টার দিকে হানাদার বাহিনীর গাড়ি ঈদগাহের পাশের রাস্তা অতিক্রম করার সময় জনতা আবারও উত্তেজিত হয়ে ওঠে। ওই সময় খবর আসে টেলিফোন ভবন দখল করে নিয়েছে হানাদার বাহিনী।

চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে উপস্থিত ছাত্র-জনতার মধ্যে, উত্তেজিত ছাত্র-জনতার একটি অংশ ঈদগাহ ময়দান থেকে বেরিয়ে টেলিফোন ভবনের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এ সময় কোন সতর্কীকরণ ছাড়াই টেলিফোন ভবনের ছাদ থেকে জনতার দিকে মেশিনগান দিয়ে গুলিবর্ষণ শুরু করে হানাদার বাহিনী। হানাদার বাহিনীর বুলেটে শহীন হন চারুবালা কর। পরে বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণে যুদ্ধের সবুজ সংকেত তাদের অনুপ্রেরণা দেয়।

তিনি আরও বলেন, ১৯৭১ সালের চার এপ্রিল তার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় দিন। এদিন তিনি মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করেন। ভাগ্যগুণে বেঁচে গিয়ে দেশ মাত্রিকাকে মুক্ত করার প্রত্যয় তার আরও দৃঢ় হয়। এ দিন পাকবাহিনী ট্যাংক, কামানসহ শহরে হামলা চালায় উল্লেখ করে তিনি আরও জানান, এদিনে শুরু হয় পাকআর্মিদের ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা। তারা শহরের নিরস্ত্র মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে। পাকবাহিনীর গণহত্যায় পুরো শহর সে সময় বধ্যভূমিতে পরিণত হয়। অবশেষে সব বাধাকে অতিক্রম করে নানাভাবে নানা বেশে বীর যোদ্ধারা ছয় ডিসেম্বর যশোরের আর ১৬ ডিসেম্বর সমগ্র দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে।

তার আশা দেশের হাল ধরবে সচেতন মানুষ। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মন থেকে লালন করবে মুখে নয়। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। করতালি আর শ্রদ্ধায় আয়োজনের শ্রোতারা সে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে। শেষ হয় আয়োজন। রয়ে যায় গল্পে কথায় ত্যাগের অপার মহিমা।

মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী ২০২০ , ৭ মাঘ ১৪২৬, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

মুক্তিযোদ্ধা বাবলুর শরীরে যুদ্ধকালীন বোমার ১১টি স্পিøন্টার

যশোর অফিস

image

গতকাল যশোর মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগারে যুদ্ধকালীন স্মৃতিচারণ করেন মুক্তিযোদ্ধা বাবলু -সংবাদ

সৌম্যকান্তি দেহের একজন মানুষ অবলিলায় বলে চলেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা। দেখে বোঝার উপায় নেই শরীরে এখনও তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন কৈশরের যুদ্ধদিনের বোমার ১১টি স্পি্লন্টার। পাকিস্তানি হানাদারদের নির্যাতন অত্যাচারে বিভিন্ন অঙ্গপ্রতঙ্গের হাড় ভেঙে চুরমার হয়েছে। ভেঙে দেয়া হয়েছে মুখের সামনের ছয়টি দাঁত। এখনও যুদ্ধদিনের গৌরবের স্মৃতি টাটকা ও জীবন্ত তার মানসপটে। তিনি যশোরের বীর সন্তান মুক্তিযোদ্ধা খুরশীদ আনোয়ার বাবলু। প্রবাস যাপন করলেও যার মননে প্রিয় মাতৃভূমি আর লাল সুবজের গৌরবের পতাকা সদা জাগ্রত।

গতকাল সকাল ১০টায় যশোর মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগার চত্বরে যান এ বীরসেনা। যশোর মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগার এবং আইইডি যুব ফোরামের সহযোগিতায় ‘মুক্তিযোদ্ধা দেখো মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনো’ শীর্ষক আয়োজনে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের তিনি একাত্তরের ভয়ানক দিনগুলোর বর্ণনা শুনান। দেশের বীর সন্তানদের বীরত্ব লাখো শহীদের আত্মত্যাগের রোমহর্ষক সেই বর্ণনা শুনে গর্ব শ্রদ্ধা আর দায়িত্ববোধের আত্মবিবেচনায় শিউরে উঠেছেন অনেক শ্রোতা। যশোর মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগারের এটি ধারাবাহিক কর্মসূচি। অনুষ্ঠানে স্কুল-কলেজের ৪০ জন শিক্ষার্থী পিনপতন নীরবতার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনে।

অনুষ্ঠানের শুরুতে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এক মিনিট নীরবতা পালন শেষে জাতীয় সংগীতে কণ্ঠমেলান সবাই। জাতীয় সংগীতের পর আইইডি যশোরের পরিচালক বিথীকা সরকার সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়ার্ক স্টেট মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার খুরশিদ আনোয়ার বাবলুর সঙ্গে। কিশোর এ মুক্তিযোদ্ধার সম্পর্কে আয়োজনের শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে তার সম্পর্কে ধারণা দেন আরেক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা প্রবীণ সাংবাদিক রুকুনউদ্দৌলাহ।

যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণ করে বাবলু বলেন, যশোরের মানুষের কাছে ১৯৭১ সালের তিন মার্চ ঐতিহাসিক দিন। স্বাধীনতা সংগ্রামে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছিল এদিন। ৩ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টা। স্বতঃস্ফূর্ত জনতার বিশাল মিছিল বের হয় ঈদগাহ ময়দান থেকে। দড়াটানা মোড় ঘুরে কাপুড়িয়াপট্টি-চৌরাস্তা হয়ে মিছিলটি ঢোকে রেল রোডে। সরকারি খাদ্য গুদামের সামনে পাক হানাদার বাহিনীর অবস্থান দেখে তাদের দিকে ইট ও জুতা নিক্ষেপ করে বিক্ষুব্ধ জনতা। সার্কিট হাউসের ভেতরে পাক সেনাদের দেখে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে জনতা। তারা সার্কিট হাউস আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। দুপুর ১২টার দিকে হানাদার বাহিনীর গাড়ি ঈদগাহের পাশের রাস্তা অতিক্রম করার সময় জনতা আবারও উত্তেজিত হয়ে ওঠে। ওই সময় খবর আসে টেলিফোন ভবন দখল করে নিয়েছে হানাদার বাহিনী।

চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে উপস্থিত ছাত্র-জনতার মধ্যে, উত্তেজিত ছাত্র-জনতার একটি অংশ ঈদগাহ ময়দান থেকে বেরিয়ে টেলিফোন ভবনের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এ সময় কোন সতর্কীকরণ ছাড়াই টেলিফোন ভবনের ছাদ থেকে জনতার দিকে মেশিনগান দিয়ে গুলিবর্ষণ শুরু করে হানাদার বাহিনী। হানাদার বাহিনীর বুলেটে শহীন হন চারুবালা কর। পরে বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণে যুদ্ধের সবুজ সংকেত তাদের অনুপ্রেরণা দেয়।

তিনি আরও বলেন, ১৯৭১ সালের চার এপ্রিল তার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় দিন। এদিন তিনি মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করেন। ভাগ্যগুণে বেঁচে গিয়ে দেশ মাত্রিকাকে মুক্ত করার প্রত্যয় তার আরও দৃঢ় হয়। এ দিন পাকবাহিনী ট্যাংক, কামানসহ শহরে হামলা চালায় উল্লেখ করে তিনি আরও জানান, এদিনে শুরু হয় পাকআর্মিদের ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা। তারা শহরের নিরস্ত্র মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে। পাকবাহিনীর গণহত্যায় পুরো শহর সে সময় বধ্যভূমিতে পরিণত হয়। অবশেষে সব বাধাকে অতিক্রম করে নানাভাবে নানা বেশে বীর যোদ্ধারা ছয় ডিসেম্বর যশোরের আর ১৬ ডিসেম্বর সমগ্র দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে।

তার আশা দেশের হাল ধরবে সচেতন মানুষ। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মন থেকে লালন করবে মুখে নয়। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। করতালি আর শ্রদ্ধায় আয়োজনের শ্রোতারা সে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে। শেষ হয় আয়োজন। রয়ে যায় গল্পে কথায় ত্যাগের অপার মহিমা।