সোনালি আঁশ পাটের জিনোম সিকোয়েন্সিং বাংলাদেশে নতুন সম্ভাবনার হাতছানি

কৃষিবিদ ড. মো. মাহবুবুল ইসলাম

সূচনা

পাট ও ছত্রাকের জিনোম বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. মাকসুদুল আলমের স্বপ্ন

জিন-নকশা/জিনম-সিকোয়েন্সিং এবং পাট

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

সূচনা

স্বাধীন বাংলার স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাটের অমিত সম্পদ-সম্ভাবনার বিষয়টি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি জানতেন অতীতের ডান্ডি-লন্ডন-কলকাতা, করাচি-পিন্ডির সম্পদ বিকাশে পাটের অবদান অনস্বীকার্য। তাই লক্ষ্য করা যায় সুদীর্ঘকালব্যাপী আর্থ-রাজনৈতিক চিন্তার ভিত্তিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পশ্চাদপট নির্মাণে তিনি পাটকে সর্বদাই অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছেন। বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনৈতিক ভিত্তি নির্মাণের জন্য তিনি পাট খাতকে সুপরিকল্পিত উপায়ে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। পাট প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা এবং প্রত্যক্ষ কর্মোদ্যোগকে দুটি পৃথক ভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমত বঙ্গবন্ধুর আর্থ-রাজনৈতিক চিন্তায় পাট প্রসঙ্গ আর দ্বিতীয়ত স্বাধীন বাংলাদেশে পাট খাতের পুনর্গঠনে তার সূচিত ব্যবস্থাদির সংক্ষিপ্ত বিবরণ। তার অর্থ হচ্ছে পাট প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর চিন্তার দূরদর্শিতা আর অপরটি চিন্তা ও কর্মের গভীর সমন্বয় সাধন। বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ও পাট। এ তিনটি শব্দ আমার জানামতে একাত্মা। কারণ বঙ্গবন্ধুকে ভাবতে হলে বাংলাদেশকে ভাবতে হয় আর বাংলাদেশকে ভাবতে হলে পাটকে ভাবতে হবে। বঙ্গবন্ধু যথার্থই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, এক দীর্ঘ, জটিল এবং বহুমুখী কৃষি-শিল্প-বাণিজ্যিক স্তর অতিক্রম করেই পাট চূড়ান্ত পর্যায়ে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ বলে প্রতিপন্ন হতে পারে। এক্ষেত্রে নিবিড় এবং কার্যকর সমন্বয়ের কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশের পাট খাত নিয়ে তার গঠনমূলক উদ্যোগের ফলে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই পাট মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু গভীর দূরদৃষ্টি দিয়ে ঠিকই বুঝেছিলেন, কৃষকের মাঠের পাট ক্রয় থেকে শুরু করে বিদেশের বাজারে পাটজাত পণ্য বিক্রয় পর্যন্ত জটিল ব্যবসায়ে সাফল্যের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে কার্যকর সমন্বয়ের খুবই দরকার।

গত বছর আমি এর ওপর একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। আমার জানামতে, পাটের সোনালি আঁশের জন্যই বাংলার নাম হয়েছে সোনার বাংলা। বঙ্গবন্ধু যখন বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানি শোষকেরা সোনার বাংলার পাটের টাকা নিয়ে ইসলামাবাদ তৈরি করছে। তখনই শুরু হয় দ্বন্দ্ব। আর সেই দ্বন্দ্বের সমাপ্তি ঘটে স্বাধীনতা দিয়ে। কিন্তু বর্তমান সরকারের নির্বাহী প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা, জননেত্রী, গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনা, তিনিও বুঝতে পেরেছেন এ ফসল সোনার ফসল। পৃথিবীর একমাত্র বাংলাদেশেই ভালো মানের পাট উৎপন্ন হয়। এর ভবিষ্যৎ এখনও খুবই উজ্জ্বল। গত ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে যুগান্তকারী বিজয়ের পটভূমিতে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। জননেত্রী শেখ হাসিনার দিনবদলের সনদের প্রতি দেশবাসী বিশেষত তরুণ সমাজের অভূতপূর্ব সমর্থন এবং বিপুল প্রত্যাশা দেশের সামনে একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে। সবাই ভেতরে ভেতরে বেশ আবেগাপ্লুত ও উত্তেজনা অনুভব করে, আর তারই ফলশ্রুতিতে প্রবল একটা আশাবাদ জেগে উঠে সবার মনে, এবার একটা কিছু হবে। আর তাই হলো। সেই দিনবদলের ডাক দেয়া সরকারের অর্থায়নেই সাফল্য লাভ করল পাটের জিন-নকশা উন্মোচন কার্যক্রম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উৎসাহ ও প্রেরণা এবং শ্রদ্ধেয় বেগম মতিয়া চৌধুরী, মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর দৃঢ়চিত্ত ও একনিষ্ঠ উদ্যোগ এ স্বপ্নযাত্রার স্বপ্নকে বাস্তবায়নে রূপ দিতে একক ভাবে আশা জুগিয়েছেন। আজ প্রমাণিত হয়েছে বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদরা সম্পদের হাজারও সীমাবদ্ধতার মাঝেও যুগোপযোগী গবেষণার সাফল্যের ধারা ধরে রাখতে সক্ষম।

পাট মূলত একটি অত্যন্ত উৎকৃষ্ট অর্থনৈতিক উদ্ভিদ। এর আঁশ বা তন্তু দিয়ে নানা নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র তৈরি করা যায়। গবেষকদের মতে, জিন সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে এ উদ্ভিদের দৈর্ঘ্য, গুনাগুণ, রং, প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার ক্ষমতা ইত্যাদি বৃদ্ধি করা যায়। পাটের জিন নকশা উন্মোচনের মাধ্যমে এর ডিএনএ সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা পাওয়া যায়। এর ফলে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে আরও উন্নত জাতের পাট প্রস্তুত করা সম্ভব। অত্যন্ত সফলভাবে পাটের জিনোম সিকোয়েন্সিং নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ মালয়েশিয়ার পর দ্বিতীয় রাষ্ট্র হিসেবে সংকর জাতের পাট উৎপাদন শুরু করে। জিনোম সিকোয়েন্সিং নিয়ে একটু সংক্ষিপ্তভাবে ধারণা দেয়া যাক। জিন হলো প্রত্যেক জীবের বংশগতির ধারক ও বাহক। জেনেটিক কোড একটি জীবের সব বৈশিষ্ট্য বহন করে। এক প্রজাতির জীবের কোড অন্য প্রজাতি থেকে বেশ আলাদা। জিনোম সিকোয়েন্সিং বলতে এই জেনেটিক কোডের বিশ্লেষণ করা বোঝায়। কোন জিনটি উদ্ভিদের কোন বৈশিষ্ট্য বহন করে তা নির্ণয় করার পদ্ধতিকেই জিনোম সিকোয়েন্সিং বলে। এর মাধ্যমে যেকোনো জীবের জিন পরিবর্তন করে আরও উন্নত করা সম্ভব।

{একনজরে পাটের জিনোম সিকোয়েন্সিং গবেষণার চিত্র

(ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত) নিজের কর্মস্থলের সামনে ড. মাকসুদুল আলম

(ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

পাট ও পাটের ছত্রাকের জিনোম বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. মাকসুদুল আলমের স্বপ্ন

পাটের জিন-নকশা উন্মোচনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন ড. মাকসুদ। তার দরকার ছিল শুধু লোকবল ও গবেষণার ন্যূনতম আর্থিক সহায়তা। পাট তো নিছক একটি উদ্ভিদ নয়, পাটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। পরে ২০০৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আহমেদ শামসুল ইসলাম, প্রাণরসায়ন ও অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হাসিনা খান ও বেসরকারি তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক সংস্থা ডেটাসফটের মাহবুব জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াই ও ইউনিভার্সিটি সেইনস মালয়েশিয়ার সঙ্গেও কথা হয় তার। প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতাও দরকার ছিল। পুরো কাজটি করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী এবং ডেটাসফটের কর্মীদের নিয়ে ‘স্বপ্নযাত্রা’ নামে একটি উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদ ও ডেটাসফট। যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ে অবস্থিত উনার সাবেক কর্মস্থল জেনোম রিসার্চ সেন্টার ও মালয়েশিয়ার ইউএসএম প্রাথমিকভাবে কিছু কারিগরি সহায়তা দেয়। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে পাটের জিনবিষয়ক গবেষণাতথ্য জোগাড় করা শুরু হয়। বিপুল পরিমাণে তথ্য উনাদের হাতে চলে আসার পর সেসব সুবিন্যস্ত ও ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন দেখা দেয়। প্রয়োজন হয় সুপার কম্পিউটারের।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে (ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

ড. মাকসুদুল আলম তার গবেষক দল নিয়ে ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে আনুষ্ঠানিকভাবে পাট নিয়ে কাজ শুরু করেন। তার নেতৃত্ব দেয়া এ দলটির নাম ছিল ‘স্বপ্নযাত্রা’। বাংলাদেশ সরকার তার এ গবেষণা অব্যাহত রাখার জন্য দশ কোটি টাকার ফান্ডিংয়ের ব্যবস্থা করে। টানা দুই বছর নিরলস পরিশ্রম করার পর অবশেষে ২০১০ সালে গবেষক দল ‘স্বপ্নযাত্রা’ তাদের গবেষণায় সফল হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে এ সফলতার ঘোষণা দেন।

ড. মাকসুদুল আলম ২০০৯ সালের নভেম্বরে মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন। সেখান থেকে শুনতে পান বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো তাদের গবেষণা নিয়ে একটি প্রতিবেদন বের করেছে। সেই প্রতিবেদনটিই পুরো পরিস্থিতি পাল্টে দেয়। ঠিক পরের মাসের প্রথম সপ্তাহে তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ড. মাকসুদুল আলমকে মালয়েশিয়ায় ফোন করেন এবং বলেন, ‘আপনার ওপরে লেখাটি পড়েছি। আপনি দেশে আসেন। আমরা আপনাদের সব সহযোগিতা দেব।’ তিনি ড. মাকসুদুল আলম স্যারকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীকে পুরো বিষয়টি সংক্ষেপে বোঝানো হয়েছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও গবেষণাটি চালিয়ে যেতে বলেন। এর জন্য সম্পূর্ণ সহযোগিতা সরকার করবে। আবারও পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু হয়। পাটের জিন-নকশা তারা এ দেশে বসে উন্মোচন করলেন। এই আনন্দের কোনো শেষ ছিল না। এরপর তারা শুরু করলেন ছত্রাকের জীবন রহস্য উন্মোচনের কাজ। ড. মাকসুদ শুরুতে ভেবেছিলেন, এ গবেষণায় ৫ বছর সময় লাগবে। কিন্তু আমাদের বিজ্ঞানীরা দিন-রাত পরিশ্রমের বিনিময়ে এক বছরের মধ্যে ছত্রাকের রহস্য ভেদ করেন। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পাট ও ছত্রাকের জীবন রহস্য উন্মোচনে গবেষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পুনরায় এক নতুন যুগে প্রবেশ করে। এ গবেষণার মাধ্যমে জৈব তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি খাতের তরুণ বিজ্ঞানীদের যে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা হয়, তার গুরুত্ব অপরিসীম।

জিন-নকশা/জিনম-সিকোয়েন্সিং এবং পাট

আমি একজন পাটের কৃষিবিজ্ঞানী, কৃষিতত্ত্ববিদ। তারই সূত্র ধরে গত প্রায় ২২ বছর ধরে পাটের কৃষি ক্ষেত্রে গবেষণার কাজ পরিচালনা করে আসছি। জিন বিজ্ঞান বা বায়োটেকনোলজি আমার বিষয় নয় তবে কাজের সঙ্গে জানা আর জানার সূত্র ধরেই কিছু কথা লেখার চেষ্টা করা।

পাদ্রী গ্রেগর জোহান মেন্ডেলের কথা আমরা প্রায় সবাই শুনেছি। তিনিই প্রথম জীবনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে চিন্তা করেছিলেন। যেমন লম্বা আর খাটো মটরশুটির বৈশিষ্ট কিভাবে বংশানুক্রমে প্রবাহিত হয়, সেটি জানতে গিয়ে তিনি খুঁজে পান এক নতুন বিজ্ঞানের। তার ধারণা থেকেই মানুষ জানতে পারে যে, দেখতে যেমনই হোক আর বহিরাবরণে যাই থাক, জীবনের বৈশিষ্ট্যেরও একক আছে এবং সেই এককের ভিন্নতার জন্য জীবনের নানা প্রকাশ। তবে তখনও মেন্ডেলের এ ধ্যান-ধারণা গুরুত্বের সঙ্গে কারও নজর কাড়তে পারেনি। তার প্রায় ১০০ বছর পর মানুষ তার এ ধারণার কথা জানে এবং বিশ্বাস করতে শুরু করে। আস্তে আস্তে শুরু হয় বংশগতি বিজ্ঞানের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। মানুষ জানতে পারে জীবনের বৈশিষ্ট্যের একক হলো জিন, আর সেই বিজ্ঞান হলো জেনেটিক্স। তারপর আবার ধীমেধরা গতিতে কেটে যায় প্রায় ৫০ বছর। এক সময় ধরা দেয় এক জোড়া বিজ্ঞানী, নাম ওয়াটসন ও ক্রিক, যাদের দেয়া ধারণা থেকেই মানুষ জানতে পারে জিন মাত্রই এক ধরনের এসিডের চাঞ্চল্য। নিউক্লিক এসিড (ডিঅক্সিরাইবো বা রাইবো)। সবটার নাম ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক এসিড) বা আরএনএ (রাইবো নিউক্লিক এসিড)। ডিএনএর কাজ হলো জীবনের জন্য কি ধরনের প্রোটিন বানাতে হবে, সেটির নির্দেশনা নিয়ে কাজ করা। আর আরএনএর কাজ হলো সেই বার্তা প্রয়োজনীয় স্থানে বয়ে নিয়ে যাওয়া। তার অর্থ হলো জীবন মানেই ডিএনএ ও আরএনএর দৌড়ঝাঁপ ছাড়া কিছু নয়। একজন মানুষের চোখের রং নীল হবে না কালো হবে, তার তথ্য প্রথম মাতৃকোষেই লেখা থাকে, লিখা থাকে ডিএনএর দ্বিসূত্রকের বিন্যাসে। মাতৃকোষের বিভাজন থেকে শরীর গঠনের একপর্যায়ে চোখ গঠিত হয়। আর তখন আদি কোষের ডিএনএ থেকে আরএনএ নীল চোখের বার্তা পৌঁছে দেয় সেখানে। তৈরি হয় নীল চোখ, আর আমরা দেখি নীল নয়নাকে। এ ভাবেই আসলে সব জীব কোষের সব বৈশিষ্ট্য সঞ্চিত আছে ডিএনএর জিনে। মোট কথা কোন জীবের জীবনকে বুঝতে হলে, তার জিনের অনুক্রম বা বিন্যাসটা জানতে হবে। আর এটাই হলো জিনবিজ্ঞানের মূল বিষয়। অর্থাৎ জীবন রহস্যের আসল বিষয় জিন-নকশা বা জিন সিকোয়েন্স।

ড. মাকসুদুল আলমের (মাঝে) নেতৃত্বে কাজ করা দল ‘স্বপ্নযাত্রা’র সব সদস্য (ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

পৃথিবীর সবচেয়ে সরলতম ভাইরাস থেকে সবচেয়ে জটিলতম মানব সন্তানের মাঝে একটা গভীর মিল আছে। তাদের সবার গঠনের একটা নীল নকশা আছে। আর সেই নীল নকশা অনুযায়ীই কেউ পিঁপড়া আর কেউবা বিশাল আকারের হাতি, কেউ লজ্জাবতী আর কেউ বটগাছ, কেউ সাপ আর কেউবা জলহস্তী হয়ে গড়ে উঠে। এটুকু তথ্য যদি বিশ্বাস করা যায় তা হলে পরের অংশটুকু আরও চমৎকার ও চমকপ্রদ। সেটা হলো পৃথিবীর সব প্রাণীরই একটি জীবন নকশা আছে এবং সেই নকশার ভাষা একটি। সেই ভাষাটি লিখা হয়েছে ইংরেজির মাত্র চারটি অক্ষরে। আর সেই চারটি অক্ষর হচ্ছে এ টি জি এবং সি। যা জীবনের মৌলিক উপাদানগুলোর আধ্যক্ষর। সম্প্রতিকালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, মানুষ ইচ্ছা করলে যে কোন প্রাণের উৎসের চার অক্ষরে লেখা জীবনের সেই নীলনকশাটি পড়ে ফেলতে পারে। মানুষের জীবনের সেই নীল নকশাটির নাম ‘মানবজিনম’। সবমিলিয়ে সেই জিনম বা নীলনকশায় আছে ৩০০ কোটি অক্ষর যা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘বেসপেয়ার’।

এই জিনোম রহস্য উন্মোচন বা জিনোম সিকোয়েন্সিং সম্বন্ধে অনেকেরই হয়তো ধারণা আছে। একটু সহজ করে বলার চেষ্টা করি। যে কোন জীবের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব কার্যক্রমই নিয়ন্ত্রিত হয় তার জিনোম বা কিছু ক্রোমোজোম বা অনেক অনেক অনেক জিনের দ্বারা। জিনগুলো তৈরি ডিএনএ দ্বারা, আর ডিএনএ তৈরি নিউক্লিওটাইড দ্বারা। এ নিউক্লিওটাইডের বেস আবার চার ধরনের। এডেনিন (এ), থাইমিন (টি), গুয়ানিন (জি) ও সাইটোসিন (সি)। আসলে জীবের ক্রোমোজোমে এ চারটি বেসই ঘুরে ফিরে নানা কম্বিনেশনে আছে, এবং এদের কম্বিনেশন ও বিন্যাসের ওপরেই নির্ভর করছে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ। তাই কোনো জীবের এই জিনোম ডিকোড বা এটিজিসির পারস্পরিক বিন্যাসটা আবিষ্কার করা মানেই সেই জীবের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী জিনগুলোর অবস্থান ও ফাংশন সম্বন্ধে বিস্তারিত ধারণা পাওয়া। যেমন মানুষের জিনোম ডিকোডিং করে ইতোমধ্যে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী বিভিন্ন জিনের অবস্থান জানা গেছে, এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানেও তার ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। সুতরাং পাটের জিনোম ডিকোডিং বা জিন সিকোয়েন্সিং হওয়া মানে আমরা এখন পাট সম্বন্ধে অনেক কিছু জানি বা এর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী জিনগুলোর সম্বন্ধেও জানি। এটা অবশ্যই একটা বড় অর্জন। অর্থাৎ, সিকোয়েন্সিং করা হয়েছে মানে পাটের জিনগুলোর বিন্যাস ও অবস্থানের ব্যাপারে জানা গেছে। এদের কার্যকলাপ বা দায়িত্ব-কর্তব্য জানা গেছে। যারা এই বিষয়ে পড়াশোনা করছেন, তারা বেশ ভালোভাবে বুঝবেন এ কাজের গুরুত্ব কতটুকু। আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের জৈবিক কার্যক্রমের অন্তর্নিহিত নিয়ন্ত্রকগুলো বের করার সুযোগ দিয়েছে, কিন্তু সেই নিয়ন্ত্রকগুলো বের করা এখনো শেষ হয়নি, সেটাও করতে আরও অনেক সময় লাগবে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

পাট একটি অর্থকরী মাঠ ফসল। এটি গাছ। এরও জীবন আছে। আমাদের দেশে শীতকালে পাট হয় না। আর যে কারণে হয় না, সে তথ্যটি জিনোম সিকোয়েন্সের কোথাও না কোথাও আছে। যা বিজ্ঞানীরা বের করে একটা নতুন জাতের পাট উদ্ভাবন করতে পারবেন, তখন কনকনে শীতেও পাট ফসলে মাঠ ভরে যাবে। আর বিজ্ঞানীরা চাইলে ঠাণ্ডা পানির পাট, লোনা পানির পাট, কম পানির পাট, চিকন সুতার পাট, শক্ত/নরম আঁশ উৎপাদনকারী পাট, পোকা/রোগ-নিরোধক পাট, ঔষধী পাট এমনকি রঙিন পাটের জাত পর্যন্ত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হবেন ভবিষ্যতে।

যেহেতু সময়ের অনেক পরিবর্তন হয়েছে এবং পরিবেশের চাহিদার রূপ পাল্টিয়েছে তাই পুরনো ধ্যান-ধারণা বাদ দিয়ে নতুন ভাবে শুরু করা প্রয়োজন। আর তার জন্য প্রয়োজন ধবধবে পাট। যাতে ব্লিচ করার প্রয়োজন না হয় এবং লিগনিন কম থাকে, যার আঁশ হবে মানসম্পন্ন ও মিহি। তবে সমস্যা হলো পাট খুবই স্পর্শকাতর। পোকার আক্রমণ ও রোগবালাই সহ্য করতে পারে না। আবার এমন পাট আছে যে পোকার আক্রমণ সহ্য করতে পারে কিন্তু লিগনিন বেশি। পচাতে অনেক সময় লাগে। তাই শুরু হলো কম লিগনিনওয়ালা পাটের খোঁজ করা। কিন্তু সেটা কোথায় পাওয়া যাবে? ধানের অভিজ্ঞতা থেকে সহজেই চিন্তা করা যায়, নিশ্চয়ই এমন পাট প্রকৃতিতে আছে যার দেহে লিগনিনের পরিমাণ কম। অতএব বিজ্ঞানীদের কাজ হবে একটির বৈশিষ্ট্য অন্যটিতে ঢুকিয়ে দেয়া। তবে তা করতে গিয়ে দেখা গেল ধানের মতো হাজার হাজার জাত পাটের নেই। পাটের আছে হাতেগোনা কয়েকটি জাত।

আর তা জানলেই জানা যাবে কোন জিন কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্যটিকে ধারণ করছে বা লিগনিনের আধিক্যের জন্য দায়ী কে অথবা কোন জিন বৈশিষ্ট্যের জন্য ধবধবে পাটে পোকার আক্রমণ হয় ইত্যাদি। এটা যে শুধু বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদেরই চিন্তার বিষয় ছিল তা নয় বিশ্বের সবক’টি পাট উৎপাদনকারী দেশের বিজ্ঞানীদের মধ্যে এক অদৃশ্য যুদ্ধ চলছিল পাটের জিন-নকশা সবার আগে উন্মোচন করার জন্য। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, পাটের জিন-নকশা উন্মোচনের ফলে বাংলাদেশের আবহাওয়া ও প্রয়োজন অনুযায়ী পাটের নতুন জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি পাটের গুণগত মান ও উৎপাদন বিপুল পরিমাণে বাড়ানো সম্ভব। আর নতুন জাত উদ্ভাবন করা হলে পাট পচাতে কম সময় লাগবে, আঁশ দিয়ে জৈব জ্বালানি ও ওষুধ তৈরি করা সম্ভব হবে।

পাটের জিন-নকশার সুবাদে পাট চাষকে বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ুর উপযোগী করে আঁশের সেরা মান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সম্ভব হবে উন্নত মানের পাটের জাত উদ্ভাবন করে পাটের ফলন ও আঁশের মান বাড়িয়ে বিশ্বে পাটের বাজারে বাংলাদেশকে আবারও সুপ্রতিষ্ঠিত করা। উন্নত জাতের সুতা ও ঔষধ তৈরিতেও এ আবিষ্কার অবদান রাখবে বলে আমাদের বিশেষ ধারণা। এত সব সম্ভাবনাকে জোড়া লাগালে একদিকে কৃষি ও কৃষকের বিকাশ, অন্যদিকে জাতীয় অর্থনীতির সমৃদ্ধির উজ্জ্বল ছবি অনুমান করা অসম্ভব কিছুই নয়। এখন তথ্যপ্রযুক্তি আর বায়োটেকনোলজির সহযোগিতায় বাংলাদেশের দিনবদলের নতুন অধ্যায় শুরু হবে।

বিশ্বজুড়ে জৈব তথ্যপ্রযুক্তি খাত দ্রুত বড় ও শক্তিশালী হচ্ছে। জৈব তথ্যপ্রযুক্তি সেবা দিয়ে শুধু ভারতই প্রতিবছর দুই বিলিয়ন ডলার অর্থ আয় করছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই খাতে আয় আরও বেশি। বাংলাদেশেরও এই খাতে প্রবেশ করার সুযোগ এখন অপার। ড. মাকসুদুল আলমের এই আবিস্কার পাটের রোগ বালাই দমন করে বৈরী আবহাওয়ায় পাটকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হবে। একই সঙ্গে অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে ফলে লাখ লাখ কৃষকের মুখে হাসি ফুটবে। পাট সত্যিকার অর্থে আবারও সোনালী আঁশে পরিণত হবে। তবে এখন প্রয়োজন মাঠ পর্যায়ে প্রায়োগিক সাফল্য অর্জনের সব ব্যবস্থা গ্রহন ও নিশ্চিত করা। আর তার জন্য প্রয়োজন বিজ্ঞানীদের নিরলস গবেষণা ও সরকারের একান্ত পৃষ্ঠপোষকতা। প্রকৃতির জন্য ভয়াবহ সিনথেটিক প্লাস্টিকের তুলনায় পাট হলো সম্পূর্ণ সবুজ তন্তু। পাটের ৭৫ শতাংশ সেলুলোজ, ১১-১৪ শতাংশ লিগনিন ও ১২ শতাংশ জাইলিন। একরপ্রতি সেলুলোজ তন্তুজ উৎপাদন পাটের বেলায় সবচেয়ে বেশি, যা কাগজ ও জৈব জ্বালানি উৎপাদনে ব্যবহৃত হতে পারে। পাটের পাতা আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয় (আমাশয়, কোষ্ঠকাঠিন্য ও কৃমির সংক্রমণ রোধে খুবই কার্যকর)। এ ছাড়া পাটের পাতা ভিটামিনসমৃদ্ধও বটে। চীন ও ভারতের দ্রুত বিকাশের কারণে প্যাকেজিং, কাগজ ও নির্মাণ শিল্পে কাঁচামালের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক। আবার বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় এক কোটি ২০ লাখ লোকের জীবন-জীবিকা পাটের ওপর নির্ভরশীল। এদিকে পলিথিন ও প্লাস্টিকের কারণে পরিবেশের ক্ষতি ঠেকাতে বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক তন্তুর ব্যবহার বাড়ছে। জাতিসংঘের উদ্যোগে ২০০৯ সালকে প্রাকৃতিক তন্তু বছর হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। কাজেই আমাদেরও এখন দরকার পাটের দিকে ফিরে তাকানো।

অতি সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ কৃষি জিনোমিক্স ইনস্টিটিউট’ নামে একটি স্বতন্ত্র জিনোম গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এটা সরকারের একটি মহতি উদ্যোগ যার ফলে বাংলাদেশে কৃষি ক্ষেত্রে উচ্চ স্তরের গবেষণার সুযোগ তৈরি হবে। শুরু হবে সব ধরনের ফসল, মাছ ও প্রাণীর নানাবিধ বিষয়ে জিনোম আবিষ্কারের গবেষণা। পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশও কৃষি গবেষণায় অবদান রাখতে পারবে।

[ লেখক : পরিচালক, বিজেআরআই]

মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী ২০২০ , ৭ মাঘ ১৪২৬, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

সোনালি আঁশ পাটের জিনোম সিকোয়েন্সিং বাংলাদেশে নতুন সম্ভাবনার হাতছানি

কৃষিবিদ ড. মো. মাহবুবুল ইসলাম

সূচনা

পাট ও ছত্রাকের জিনোম বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. মাকসুদুল আলমের স্বপ্ন

জিন-নকশা/জিনম-সিকোয়েন্সিং এবং পাট

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

সূচনা

স্বাধীন বাংলার স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাটের অমিত সম্পদ-সম্ভাবনার বিষয়টি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি জানতেন অতীতের ডান্ডি-লন্ডন-কলকাতা, করাচি-পিন্ডির সম্পদ বিকাশে পাটের অবদান অনস্বীকার্য। তাই লক্ষ্য করা যায় সুদীর্ঘকালব্যাপী আর্থ-রাজনৈতিক চিন্তার ভিত্তিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পশ্চাদপট নির্মাণে তিনি পাটকে সর্বদাই অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছেন। বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনৈতিক ভিত্তি নির্মাণের জন্য তিনি পাট খাতকে সুপরিকল্পিত উপায়ে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। পাট প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা এবং প্রত্যক্ষ কর্মোদ্যোগকে দুটি পৃথক ভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমত বঙ্গবন্ধুর আর্থ-রাজনৈতিক চিন্তায় পাট প্রসঙ্গ আর দ্বিতীয়ত স্বাধীন বাংলাদেশে পাট খাতের পুনর্গঠনে তার সূচিত ব্যবস্থাদির সংক্ষিপ্ত বিবরণ। তার অর্থ হচ্ছে পাট প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর চিন্তার দূরদর্শিতা আর অপরটি চিন্তা ও কর্মের গভীর সমন্বয় সাধন। বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ও পাট। এ তিনটি শব্দ আমার জানামতে একাত্মা। কারণ বঙ্গবন্ধুকে ভাবতে হলে বাংলাদেশকে ভাবতে হয় আর বাংলাদেশকে ভাবতে হলে পাটকে ভাবতে হবে। বঙ্গবন্ধু যথার্থই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, এক দীর্ঘ, জটিল এবং বহুমুখী কৃষি-শিল্প-বাণিজ্যিক স্তর অতিক্রম করেই পাট চূড়ান্ত পর্যায়ে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ বলে প্রতিপন্ন হতে পারে। এক্ষেত্রে নিবিড় এবং কার্যকর সমন্বয়ের কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশের পাট খাত নিয়ে তার গঠনমূলক উদ্যোগের ফলে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই পাট মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু গভীর দূরদৃষ্টি দিয়ে ঠিকই বুঝেছিলেন, কৃষকের মাঠের পাট ক্রয় থেকে শুরু করে বিদেশের বাজারে পাটজাত পণ্য বিক্রয় পর্যন্ত জটিল ব্যবসায়ে সাফল্যের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে কার্যকর সমন্বয়ের খুবই দরকার।

গত বছর আমি এর ওপর একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। আমার জানামতে, পাটের সোনালি আঁশের জন্যই বাংলার নাম হয়েছে সোনার বাংলা। বঙ্গবন্ধু যখন বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানি শোষকেরা সোনার বাংলার পাটের টাকা নিয়ে ইসলামাবাদ তৈরি করছে। তখনই শুরু হয় দ্বন্দ্ব। আর সেই দ্বন্দ্বের সমাপ্তি ঘটে স্বাধীনতা দিয়ে। কিন্তু বর্তমান সরকারের নির্বাহী প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা, জননেত্রী, গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনা, তিনিও বুঝতে পেরেছেন এ ফসল সোনার ফসল। পৃথিবীর একমাত্র বাংলাদেশেই ভালো মানের পাট উৎপন্ন হয়। এর ভবিষ্যৎ এখনও খুবই উজ্জ্বল। গত ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে যুগান্তকারী বিজয়ের পটভূমিতে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। জননেত্রী শেখ হাসিনার দিনবদলের সনদের প্রতি দেশবাসী বিশেষত তরুণ সমাজের অভূতপূর্ব সমর্থন এবং বিপুল প্রত্যাশা দেশের সামনে একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে। সবাই ভেতরে ভেতরে বেশ আবেগাপ্লুত ও উত্তেজনা অনুভব করে, আর তারই ফলশ্রুতিতে প্রবল একটা আশাবাদ জেগে উঠে সবার মনে, এবার একটা কিছু হবে। আর তাই হলো। সেই দিনবদলের ডাক দেয়া সরকারের অর্থায়নেই সাফল্য লাভ করল পাটের জিন-নকশা উন্মোচন কার্যক্রম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উৎসাহ ও প্রেরণা এবং শ্রদ্ধেয় বেগম মতিয়া চৌধুরী, মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর দৃঢ়চিত্ত ও একনিষ্ঠ উদ্যোগ এ স্বপ্নযাত্রার স্বপ্নকে বাস্তবায়নে রূপ দিতে একক ভাবে আশা জুগিয়েছেন। আজ প্রমাণিত হয়েছে বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদরা সম্পদের হাজারও সীমাবদ্ধতার মাঝেও যুগোপযোগী গবেষণার সাফল্যের ধারা ধরে রাখতে সক্ষম।

পাট মূলত একটি অত্যন্ত উৎকৃষ্ট অর্থনৈতিক উদ্ভিদ। এর আঁশ বা তন্তু দিয়ে নানা নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র তৈরি করা যায়। গবেষকদের মতে, জিন সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে এ উদ্ভিদের দৈর্ঘ্য, গুনাগুণ, রং, প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার ক্ষমতা ইত্যাদি বৃদ্ধি করা যায়। পাটের জিন নকশা উন্মোচনের মাধ্যমে এর ডিএনএ সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা পাওয়া যায়। এর ফলে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে আরও উন্নত জাতের পাট প্রস্তুত করা সম্ভব। অত্যন্ত সফলভাবে পাটের জিনোম সিকোয়েন্সিং নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ মালয়েশিয়ার পর দ্বিতীয় রাষ্ট্র হিসেবে সংকর জাতের পাট উৎপাদন শুরু করে। জিনোম সিকোয়েন্সিং নিয়ে একটু সংক্ষিপ্তভাবে ধারণা দেয়া যাক। জিন হলো প্রত্যেক জীবের বংশগতির ধারক ও বাহক। জেনেটিক কোড একটি জীবের সব বৈশিষ্ট্য বহন করে। এক প্রজাতির জীবের কোড অন্য প্রজাতি থেকে বেশ আলাদা। জিনোম সিকোয়েন্সিং বলতে এই জেনেটিক কোডের বিশ্লেষণ করা বোঝায়। কোন জিনটি উদ্ভিদের কোন বৈশিষ্ট্য বহন করে তা নির্ণয় করার পদ্ধতিকেই জিনোম সিকোয়েন্সিং বলে। এর মাধ্যমে যেকোনো জীবের জিন পরিবর্তন করে আরও উন্নত করা সম্ভব।

{একনজরে পাটের জিনোম সিকোয়েন্সিং গবেষণার চিত্র

(ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত) নিজের কর্মস্থলের সামনে ড. মাকসুদুল আলম

(ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

পাট ও পাটের ছত্রাকের জিনোম বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. মাকসুদুল আলমের স্বপ্ন

পাটের জিন-নকশা উন্মোচনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন ড. মাকসুদ। তার দরকার ছিল শুধু লোকবল ও গবেষণার ন্যূনতম আর্থিক সহায়তা। পাট তো নিছক একটি উদ্ভিদ নয়, পাটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। পরে ২০০৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আহমেদ শামসুল ইসলাম, প্রাণরসায়ন ও অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হাসিনা খান ও বেসরকারি তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক সংস্থা ডেটাসফটের মাহবুব জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াই ও ইউনিভার্সিটি সেইনস মালয়েশিয়ার সঙ্গেও কথা হয় তার। প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতাও দরকার ছিল। পুরো কাজটি করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী এবং ডেটাসফটের কর্মীদের নিয়ে ‘স্বপ্নযাত্রা’ নামে একটি উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদ ও ডেটাসফট। যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ে অবস্থিত উনার সাবেক কর্মস্থল জেনোম রিসার্চ সেন্টার ও মালয়েশিয়ার ইউএসএম প্রাথমিকভাবে কিছু কারিগরি সহায়তা দেয়। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে পাটের জিনবিষয়ক গবেষণাতথ্য জোগাড় করা শুরু হয়। বিপুল পরিমাণে তথ্য উনাদের হাতে চলে আসার পর সেসব সুবিন্যস্ত ও ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন দেখা দেয়। প্রয়োজন হয় সুপার কম্পিউটারের।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে (ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

ড. মাকসুদুল আলম তার গবেষক দল নিয়ে ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে আনুষ্ঠানিকভাবে পাট নিয়ে কাজ শুরু করেন। তার নেতৃত্ব দেয়া এ দলটির নাম ছিল ‘স্বপ্নযাত্রা’। বাংলাদেশ সরকার তার এ গবেষণা অব্যাহত রাখার জন্য দশ কোটি টাকার ফান্ডিংয়ের ব্যবস্থা করে। টানা দুই বছর নিরলস পরিশ্রম করার পর অবশেষে ২০১০ সালে গবেষক দল ‘স্বপ্নযাত্রা’ তাদের গবেষণায় সফল হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে এ সফলতার ঘোষণা দেন।

ড. মাকসুদুল আলম ২০০৯ সালের নভেম্বরে মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন। সেখান থেকে শুনতে পান বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো তাদের গবেষণা নিয়ে একটি প্রতিবেদন বের করেছে। সেই প্রতিবেদনটিই পুরো পরিস্থিতি পাল্টে দেয়। ঠিক পরের মাসের প্রথম সপ্তাহে তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ড. মাকসুদুল আলমকে মালয়েশিয়ায় ফোন করেন এবং বলেন, ‘আপনার ওপরে লেখাটি পড়েছি। আপনি দেশে আসেন। আমরা আপনাদের সব সহযোগিতা দেব।’ তিনি ড. মাকসুদুল আলম স্যারকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীকে পুরো বিষয়টি সংক্ষেপে বোঝানো হয়েছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও গবেষণাটি চালিয়ে যেতে বলেন। এর জন্য সম্পূর্ণ সহযোগিতা সরকার করবে। আবারও পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু হয়। পাটের জিন-নকশা তারা এ দেশে বসে উন্মোচন করলেন। এই আনন্দের কোনো শেষ ছিল না। এরপর তারা শুরু করলেন ছত্রাকের জীবন রহস্য উন্মোচনের কাজ। ড. মাকসুদ শুরুতে ভেবেছিলেন, এ গবেষণায় ৫ বছর সময় লাগবে। কিন্তু আমাদের বিজ্ঞানীরা দিন-রাত পরিশ্রমের বিনিময়ে এক বছরের মধ্যে ছত্রাকের রহস্য ভেদ করেন। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পাট ও ছত্রাকের জীবন রহস্য উন্মোচনে গবেষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পুনরায় এক নতুন যুগে প্রবেশ করে। এ গবেষণার মাধ্যমে জৈব তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি খাতের তরুণ বিজ্ঞানীদের যে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা হয়, তার গুরুত্ব অপরিসীম।

জিন-নকশা/জিনম-সিকোয়েন্সিং এবং পাট

আমি একজন পাটের কৃষিবিজ্ঞানী, কৃষিতত্ত্ববিদ। তারই সূত্র ধরে গত প্রায় ২২ বছর ধরে পাটের কৃষি ক্ষেত্রে গবেষণার কাজ পরিচালনা করে আসছি। জিন বিজ্ঞান বা বায়োটেকনোলজি আমার বিষয় নয় তবে কাজের সঙ্গে জানা আর জানার সূত্র ধরেই কিছু কথা লেখার চেষ্টা করা।

পাদ্রী গ্রেগর জোহান মেন্ডেলের কথা আমরা প্রায় সবাই শুনেছি। তিনিই প্রথম জীবনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে চিন্তা করেছিলেন। যেমন লম্বা আর খাটো মটরশুটির বৈশিষ্ট কিভাবে বংশানুক্রমে প্রবাহিত হয়, সেটি জানতে গিয়ে তিনি খুঁজে পান এক নতুন বিজ্ঞানের। তার ধারণা থেকেই মানুষ জানতে পারে যে, দেখতে যেমনই হোক আর বহিরাবরণে যাই থাক, জীবনের বৈশিষ্ট্যেরও একক আছে এবং সেই এককের ভিন্নতার জন্য জীবনের নানা প্রকাশ। তবে তখনও মেন্ডেলের এ ধ্যান-ধারণা গুরুত্বের সঙ্গে কারও নজর কাড়তে পারেনি। তার প্রায় ১০০ বছর পর মানুষ তার এ ধারণার কথা জানে এবং বিশ্বাস করতে শুরু করে। আস্তে আস্তে শুরু হয় বংশগতি বিজ্ঞানের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। মানুষ জানতে পারে জীবনের বৈশিষ্ট্যের একক হলো জিন, আর সেই বিজ্ঞান হলো জেনেটিক্স। তারপর আবার ধীমেধরা গতিতে কেটে যায় প্রায় ৫০ বছর। এক সময় ধরা দেয় এক জোড়া বিজ্ঞানী, নাম ওয়াটসন ও ক্রিক, যাদের দেয়া ধারণা থেকেই মানুষ জানতে পারে জিন মাত্রই এক ধরনের এসিডের চাঞ্চল্য। নিউক্লিক এসিড (ডিঅক্সিরাইবো বা রাইবো)। সবটার নাম ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক এসিড) বা আরএনএ (রাইবো নিউক্লিক এসিড)। ডিএনএর কাজ হলো জীবনের জন্য কি ধরনের প্রোটিন বানাতে হবে, সেটির নির্দেশনা নিয়ে কাজ করা। আর আরএনএর কাজ হলো সেই বার্তা প্রয়োজনীয় স্থানে বয়ে নিয়ে যাওয়া। তার অর্থ হলো জীবন মানেই ডিএনএ ও আরএনএর দৌড়ঝাঁপ ছাড়া কিছু নয়। একজন মানুষের চোখের রং নীল হবে না কালো হবে, তার তথ্য প্রথম মাতৃকোষেই লেখা থাকে, লিখা থাকে ডিএনএর দ্বিসূত্রকের বিন্যাসে। মাতৃকোষের বিভাজন থেকে শরীর গঠনের একপর্যায়ে চোখ গঠিত হয়। আর তখন আদি কোষের ডিএনএ থেকে আরএনএ নীল চোখের বার্তা পৌঁছে দেয় সেখানে। তৈরি হয় নীল চোখ, আর আমরা দেখি নীল নয়নাকে। এ ভাবেই আসলে সব জীব কোষের সব বৈশিষ্ট্য সঞ্চিত আছে ডিএনএর জিনে। মোট কথা কোন জীবের জীবনকে বুঝতে হলে, তার জিনের অনুক্রম বা বিন্যাসটা জানতে হবে। আর এটাই হলো জিনবিজ্ঞানের মূল বিষয়। অর্থাৎ জীবন রহস্যের আসল বিষয় জিন-নকশা বা জিন সিকোয়েন্স।

ড. মাকসুদুল আলমের (মাঝে) নেতৃত্বে কাজ করা দল ‘স্বপ্নযাত্রা’র সব সদস্য (ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

পৃথিবীর সবচেয়ে সরলতম ভাইরাস থেকে সবচেয়ে জটিলতম মানব সন্তানের মাঝে একটা গভীর মিল আছে। তাদের সবার গঠনের একটা নীল নকশা আছে। আর সেই নীল নকশা অনুযায়ীই কেউ পিঁপড়া আর কেউবা বিশাল আকারের হাতি, কেউ লজ্জাবতী আর কেউ বটগাছ, কেউ সাপ আর কেউবা জলহস্তী হয়ে গড়ে উঠে। এটুকু তথ্য যদি বিশ্বাস করা যায় তা হলে পরের অংশটুকু আরও চমৎকার ও চমকপ্রদ। সেটা হলো পৃথিবীর সব প্রাণীরই একটি জীবন নকশা আছে এবং সেই নকশার ভাষা একটি। সেই ভাষাটি লিখা হয়েছে ইংরেজির মাত্র চারটি অক্ষরে। আর সেই চারটি অক্ষর হচ্ছে এ টি জি এবং সি। যা জীবনের মৌলিক উপাদানগুলোর আধ্যক্ষর। সম্প্রতিকালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, মানুষ ইচ্ছা করলে যে কোন প্রাণের উৎসের চার অক্ষরে লেখা জীবনের সেই নীলনকশাটি পড়ে ফেলতে পারে। মানুষের জীবনের সেই নীল নকশাটির নাম ‘মানবজিনম’। সবমিলিয়ে সেই জিনম বা নীলনকশায় আছে ৩০০ কোটি অক্ষর যা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘বেসপেয়ার’।

এই জিনোম রহস্য উন্মোচন বা জিনোম সিকোয়েন্সিং সম্বন্ধে অনেকেরই হয়তো ধারণা আছে। একটু সহজ করে বলার চেষ্টা করি। যে কোন জীবের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব কার্যক্রমই নিয়ন্ত্রিত হয় তার জিনোম বা কিছু ক্রোমোজোম বা অনেক অনেক অনেক জিনের দ্বারা। জিনগুলো তৈরি ডিএনএ দ্বারা, আর ডিএনএ তৈরি নিউক্লিওটাইড দ্বারা। এ নিউক্লিওটাইডের বেস আবার চার ধরনের। এডেনিন (এ), থাইমিন (টি), গুয়ানিন (জি) ও সাইটোসিন (সি)। আসলে জীবের ক্রোমোজোমে এ চারটি বেসই ঘুরে ফিরে নানা কম্বিনেশনে আছে, এবং এদের কম্বিনেশন ও বিন্যাসের ওপরেই নির্ভর করছে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ। তাই কোনো জীবের এই জিনোম ডিকোড বা এটিজিসির পারস্পরিক বিন্যাসটা আবিষ্কার করা মানেই সেই জীবের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী জিনগুলোর অবস্থান ও ফাংশন সম্বন্ধে বিস্তারিত ধারণা পাওয়া। যেমন মানুষের জিনোম ডিকোডিং করে ইতোমধ্যে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী বিভিন্ন জিনের অবস্থান জানা গেছে, এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানেও তার ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। সুতরাং পাটের জিনোম ডিকোডিং বা জিন সিকোয়েন্সিং হওয়া মানে আমরা এখন পাট সম্বন্ধে অনেক কিছু জানি বা এর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী জিনগুলোর সম্বন্ধেও জানি। এটা অবশ্যই একটা বড় অর্জন। অর্থাৎ, সিকোয়েন্সিং করা হয়েছে মানে পাটের জিনগুলোর বিন্যাস ও অবস্থানের ব্যাপারে জানা গেছে। এদের কার্যকলাপ বা দায়িত্ব-কর্তব্য জানা গেছে। যারা এই বিষয়ে পড়াশোনা করছেন, তারা বেশ ভালোভাবে বুঝবেন এ কাজের গুরুত্ব কতটুকু। আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের জৈবিক কার্যক্রমের অন্তর্নিহিত নিয়ন্ত্রকগুলো বের করার সুযোগ দিয়েছে, কিন্তু সেই নিয়ন্ত্রকগুলো বের করা এখনো শেষ হয়নি, সেটাও করতে আরও অনেক সময় লাগবে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

পাট একটি অর্থকরী মাঠ ফসল। এটি গাছ। এরও জীবন আছে। আমাদের দেশে শীতকালে পাট হয় না। আর যে কারণে হয় না, সে তথ্যটি জিনোম সিকোয়েন্সের কোথাও না কোথাও আছে। যা বিজ্ঞানীরা বের করে একটা নতুন জাতের পাট উদ্ভাবন করতে পারবেন, তখন কনকনে শীতেও পাট ফসলে মাঠ ভরে যাবে। আর বিজ্ঞানীরা চাইলে ঠাণ্ডা পানির পাট, লোনা পানির পাট, কম পানির পাট, চিকন সুতার পাট, শক্ত/নরম আঁশ উৎপাদনকারী পাট, পোকা/রোগ-নিরোধক পাট, ঔষধী পাট এমনকি রঙিন পাটের জাত পর্যন্ত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হবেন ভবিষ্যতে।

যেহেতু সময়ের অনেক পরিবর্তন হয়েছে এবং পরিবেশের চাহিদার রূপ পাল্টিয়েছে তাই পুরনো ধ্যান-ধারণা বাদ দিয়ে নতুন ভাবে শুরু করা প্রয়োজন। আর তার জন্য প্রয়োজন ধবধবে পাট। যাতে ব্লিচ করার প্রয়োজন না হয় এবং লিগনিন কম থাকে, যার আঁশ হবে মানসম্পন্ন ও মিহি। তবে সমস্যা হলো পাট খুবই স্পর্শকাতর। পোকার আক্রমণ ও রোগবালাই সহ্য করতে পারে না। আবার এমন পাট আছে যে পোকার আক্রমণ সহ্য করতে পারে কিন্তু লিগনিন বেশি। পচাতে অনেক সময় লাগে। তাই শুরু হলো কম লিগনিনওয়ালা পাটের খোঁজ করা। কিন্তু সেটা কোথায় পাওয়া যাবে? ধানের অভিজ্ঞতা থেকে সহজেই চিন্তা করা যায়, নিশ্চয়ই এমন পাট প্রকৃতিতে আছে যার দেহে লিগনিনের পরিমাণ কম। অতএব বিজ্ঞানীদের কাজ হবে একটির বৈশিষ্ট্য অন্যটিতে ঢুকিয়ে দেয়া। তবে তা করতে গিয়ে দেখা গেল ধানের মতো হাজার হাজার জাত পাটের নেই। পাটের আছে হাতেগোনা কয়েকটি জাত।

আর তা জানলেই জানা যাবে কোন জিন কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্যটিকে ধারণ করছে বা লিগনিনের আধিক্যের জন্য দায়ী কে অথবা কোন জিন বৈশিষ্ট্যের জন্য ধবধবে পাটে পোকার আক্রমণ হয় ইত্যাদি। এটা যে শুধু বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদেরই চিন্তার বিষয় ছিল তা নয় বিশ্বের সবক’টি পাট উৎপাদনকারী দেশের বিজ্ঞানীদের মধ্যে এক অদৃশ্য যুদ্ধ চলছিল পাটের জিন-নকশা সবার আগে উন্মোচন করার জন্য। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, পাটের জিন-নকশা উন্মোচনের ফলে বাংলাদেশের আবহাওয়া ও প্রয়োজন অনুযায়ী পাটের নতুন জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি পাটের গুণগত মান ও উৎপাদন বিপুল পরিমাণে বাড়ানো সম্ভব। আর নতুন জাত উদ্ভাবন করা হলে পাট পচাতে কম সময় লাগবে, আঁশ দিয়ে জৈব জ্বালানি ও ওষুধ তৈরি করা সম্ভব হবে।

পাটের জিন-নকশার সুবাদে পাট চাষকে বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ুর উপযোগী করে আঁশের সেরা মান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সম্ভব হবে উন্নত মানের পাটের জাত উদ্ভাবন করে পাটের ফলন ও আঁশের মান বাড়িয়ে বিশ্বে পাটের বাজারে বাংলাদেশকে আবারও সুপ্রতিষ্ঠিত করা। উন্নত জাতের সুতা ও ঔষধ তৈরিতেও এ আবিষ্কার অবদান রাখবে বলে আমাদের বিশেষ ধারণা। এত সব সম্ভাবনাকে জোড়া লাগালে একদিকে কৃষি ও কৃষকের বিকাশ, অন্যদিকে জাতীয় অর্থনীতির সমৃদ্ধির উজ্জ্বল ছবি অনুমান করা অসম্ভব কিছুই নয়। এখন তথ্যপ্রযুক্তি আর বায়োটেকনোলজির সহযোগিতায় বাংলাদেশের দিনবদলের নতুন অধ্যায় শুরু হবে।

বিশ্বজুড়ে জৈব তথ্যপ্রযুক্তি খাত দ্রুত বড় ও শক্তিশালী হচ্ছে। জৈব তথ্যপ্রযুক্তি সেবা দিয়ে শুধু ভারতই প্রতিবছর দুই বিলিয়ন ডলার অর্থ আয় করছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই খাতে আয় আরও বেশি। বাংলাদেশেরও এই খাতে প্রবেশ করার সুযোগ এখন অপার। ড. মাকসুদুল আলমের এই আবিস্কার পাটের রোগ বালাই দমন করে বৈরী আবহাওয়ায় পাটকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হবে। একই সঙ্গে অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে ফলে লাখ লাখ কৃষকের মুখে হাসি ফুটবে। পাট সত্যিকার অর্থে আবারও সোনালী আঁশে পরিণত হবে। তবে এখন প্রয়োজন মাঠ পর্যায়ে প্রায়োগিক সাফল্য অর্জনের সব ব্যবস্থা গ্রহন ও নিশ্চিত করা। আর তার জন্য প্রয়োজন বিজ্ঞানীদের নিরলস গবেষণা ও সরকারের একান্ত পৃষ্ঠপোষকতা। প্রকৃতির জন্য ভয়াবহ সিনথেটিক প্লাস্টিকের তুলনায় পাট হলো সম্পূর্ণ সবুজ তন্তু। পাটের ৭৫ শতাংশ সেলুলোজ, ১১-১৪ শতাংশ লিগনিন ও ১২ শতাংশ জাইলিন। একরপ্রতি সেলুলোজ তন্তুজ উৎপাদন পাটের বেলায় সবচেয়ে বেশি, যা কাগজ ও জৈব জ্বালানি উৎপাদনে ব্যবহৃত হতে পারে। পাটের পাতা আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয় (আমাশয়, কোষ্ঠকাঠিন্য ও কৃমির সংক্রমণ রোধে খুবই কার্যকর)। এ ছাড়া পাটের পাতা ভিটামিনসমৃদ্ধও বটে। চীন ও ভারতের দ্রুত বিকাশের কারণে প্যাকেজিং, কাগজ ও নির্মাণ শিল্পে কাঁচামালের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক। আবার বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় এক কোটি ২০ লাখ লোকের জীবন-জীবিকা পাটের ওপর নির্ভরশীল। এদিকে পলিথিন ও প্লাস্টিকের কারণে পরিবেশের ক্ষতি ঠেকাতে বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক তন্তুর ব্যবহার বাড়ছে। জাতিসংঘের উদ্যোগে ২০০৯ সালকে প্রাকৃতিক তন্তু বছর হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। কাজেই আমাদেরও এখন দরকার পাটের দিকে ফিরে তাকানো।

অতি সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ কৃষি জিনোমিক্স ইনস্টিটিউট’ নামে একটি স্বতন্ত্র জিনোম গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এটা সরকারের একটি মহতি উদ্যোগ যার ফলে বাংলাদেশে কৃষি ক্ষেত্রে উচ্চ স্তরের গবেষণার সুযোগ তৈরি হবে। শুরু হবে সব ধরনের ফসল, মাছ ও প্রাণীর নানাবিধ বিষয়ে জিনোম আবিষ্কারের গবেষণা। পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশও কৃষি গবেষণায় অবদান রাখতে পারবে।

[ লেখক : পরিচালক, বিজেআরআই]