কোলকাতার ইনফোকম : অনন্য অভিজ্ঞতা

মোস্তাফা জব্বার

ইনফোকম নামটির সঙ্গে আমার পরিচিতি ছিল অনেক আগে থেকেই। আমাদের সাফকাত হায়দার ভাইয়ের আয়োজনে যুক্ত থাকেন। কোলকাতার আনন্দবাজার গোষ্ঠী এর আয়োজক। ১৮ সালের শেষ দিকে ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে সাফকাত ভাই কোলকাতার ইনফোকম আয়োজনে অংশ নেবার জন্য অনুরোধ করার প্রেক্ষিতে আমি আমন্ত্রণটি গ্রহণ করি। প্রথমত আমার দেখার আগ্রহ ছিল যে, বৃহত্তর বঙ্গের অপর পাড়ে ডিজিটাল শব্দটির প্রভাব কেমন। অন্য কারণটি ছিল যে তখন কোলকাতায় অবস্থানরত অসুস্থ স্ত্রীকেও দেখে আসতে পারব। বকুল তখন দুটি নষ্ট কিডনি নিয়ে অন্তত একটি কিডনির প্রতিস্থাপনের জন্য কোলকাতার হাসপাতালে পরীক্ষা-চিকিৎসাধীন ছিল। বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ মানুষ ভারতে চিকিৎসা নেয়। এর মাঝে একটি বড় অংশ আছে যারা কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য যায়।

ভারত ও কলিকাতা পরিচিতি : অবস্থান: ভারত দক্ষিণ এশিয়ার একটি রাষ্ট্র। দেশটির সরকারি নাম ভারতীয় প্রজাতন্ত্র। ভৌগোলিক আয়তনের বিচারে এটি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম এবং বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম রাষ্ট্র। অন্যদিকে জনসংখ্যার বিচারে এই দেশ বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক জনবহুল এবং পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ভারতের পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তান উত্তর-পূর্বে চীন, নেপাল ও ভুটান এবং পূর্বে বাংলাদেশ ও মায়ানমার অবস্থিত। এছাড়া ভারত মহাসাগরে অবস্থিত শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও ইন্দোনেশিয়া ভারতের নিকটবর্তী কয়েকটি দ্বীপরাষ্ট্র। দক্ষিণে ভারত মহাসাগর, পশ্চিমে আরব সাগর ও পূর্বে বঙ্গোপসাগর দ্বারা বেষ্টিত ভারতের উপকূলরেখার সম্মিলিত দৈর্ঘ্য ৭,৫১৭ কিলোমিটার (৪,৬৭১ মাইল)।

বর্তমানে ভারত ২৯টি রাজ্য ও সাতটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বিশিষ্ট একটি সংসদীয় সাধারণতন্ত্র। ভারতীয় অর্থব্যবস্থা বাজারি বিনিময় হারের বিচারে বিশ্বে দ্বাদশ ও ক্রয়ক্ষমতা সমতার বিচারে বিশ্বে চতুর্থ বৃহত্তম। ১৯৯১ সালে ভারত সরকার গৃহীত আর্থিক সংস্কার নীতির ফলশ্রুতিতে আজ আর্থিক বৃদ্ধিহারের বিচারে ভারত বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে দ্বিতীয়। তবে অতিমাত্রায় দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা ও অপুষ্টি এখনও ভারতের অন্যতম প্রধান সমস্যা। আয়তন : ৩২ লাখ ৮৭ হাজার ২৬৩ বর্গকিলোমিটার। মাথাপিছু আয় : ১৫৯২ ডলার। (১৪০তম)। শিক্ষার হার : ৭৪.০৪%। জনসংখ্যা : ১২১ কোটির বেশি

কলকাতা : কলকাতা হল ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর এবং ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী। কলকাতা শহরটি হুগলি নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থিত। এ শহর পূর্ব ভারতের শিক্ষা, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্র। কলকাতা বন্দর ভারতের প্রাচীনতম সচল বন্দর তথা দেশের প্রধান নদীবন্দর।

জনসংখ্যা : কলকাতার জনসংখ্যা ৪,৪৯৬,৬৯৪। (২০১১ সালো জনগণনা অনুসারে।) জনসংখ্যার হিসেবে এটি ভারতের ৭ম সর্বাধিক জনবহুল পৌর-এলাকা। অন্যদিকে বৃহত্তর কলকাতার জনসংখ্যা ১৪,১১২,৫৩৬। জনসংখ্যার হিসেবে বৃহত্তর কলকাতা ভারতের ৩য় সর্বাধিক জনবহুল মহানগরীয় অঞ্চল। জনসংখ্যার ঘনত্বে কলকাতায় প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ২৪,২৫০ জন বা প্রতি বর্গ মাইলে ৬৩,২০০ জন মানুষ বাস করে। শিক্ষার হার : ৮৭.১৪%। আয়তন : কলকাতার আয়তন ১৮৫ বর্গ কিমি.। বৃহত্তর কলকাতার আয়তন ১,৮৮৬.৬৭ বর্গ কিমি.।

বলা যেতে পারে এক ধরনের আত্মার টানে ইনফোকমে যোগ দিই। বাংলারই আরেক অংশে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে পারার সুযোগটাও হাতছাড়া করতে চাইনি। এখন অনুভভ করি সেই যাত্রাটি কতটা সফল ছিল। অনুষ্ঠানটি সম্পর্কে কোলকাতার দৈনিক দি টেলিগ্রাফ ৭ জানুয়ারি ১৮ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর বাংলা অনুবাদটি ইনফোকমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের একটি চিত্র তুলে ধরবে।

অনুষ্ঠানের শ্রোতারা অন্য আরও একটি গতানুগতিক বক্তব্যের জন্য প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু কুর্তা-পাজামা পরিহিত লোকটি তার ২০ মিনিটের মাতৃভাষায় বক্তৃতা করে শ্রোতাদের অভিভূত করলেন। সবাইকে চমকে দিয়ে বাংলাদেশের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী বাংলায় বক্তৃতা করলেন। পুরো অনুষ্ঠানটিতে তিনিই একমাত্র মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করলেন। অনুষ্ঠানে যারা বাংলা ভাষায় বক্তৃতা শুনতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেননি তাদের উদ্দেশ্যে দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেছেন, কয়েক বছর পর ভাষা কোন সমস্যা হবে না, বিশেষ করে ইনফোকম শ্রোতাদের কাছে। কারণ প্রযুক্তি এই অসুবিধাটি দূর করে দেবে। বাংলাকে আপনি যে কোন ভাষায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনুদিত পাবেন।

মন্ত্রী কলকাতায় গত ৬ ডিসেম্বর ১৮ এবিপি গ্রুপের উদ্যোগে আয়োজিত ‘ইনফরমেশন, কমিউনিকেশন্স অ্যান্ড টেকনোলজি এক্সপজিশন ইন দি ইস্ট’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে তার বক্তৃতার জন্য হলভর্তি দর্শকদের কাছে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছেন।

বাংলাদেশের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী বলেন, আজ ৬ ডিসেম্বর। এ মাসেই বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের অবদান (সাপোর্ট) আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। মন্ত্রী আইটিবিষয়ক এ সম্মেলনের তাৎপর্য তুলে ধরেন।

বাংলা বিজয় কীবোর্ডের জনক, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মি. মোস্তাফা জব্বার বাংলাদেশের অগ্রগতির অগ্রযাত্রার চিত্র তুলে ধরে বলেন, ১৯৭১ সালে ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট দিয়ে বাংলাদশের অর্থনীতির যাত্রা শুরু হয়। এই বাংলাদেশ আজ এশিয়ার অর্থনীতির পাওয়ার হাউস হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪.৫ লাখ কোটি টাকার (রুপি)র বাজেটে প্রণীত হয়েছে।

অনুষ্ঠানে মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বের ১৬ কোটিরও বেশি জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশ প্রযুক্তিকে আলিঙ্গন করেছে বলে তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেন।

পশ্চিম বঙ্গের আইটি মন্ত্রী অমিত মিত্র উদ্বোধনী ল্যাম্প প্রজ্বলন করেন। এবিপি প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও ডি.ডি পুরকায়স্থ অনুষ্ঠান উপস্থিত ছিলেন।

মোস্তাফা জব্বার বাংলাদেশে ৫৩টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে তিন শতাধিক ডিজিটাল সেবা প্রদান করা হচ্ছে উল্লেখ করে বলেন, শতকরা ৪০ ভাগ আর্থিক লেনদেন ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পন্ন হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতিদিন ১০২৪ কোটি টাকা মোবাইল ফোনে লেনদেন হচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগমন্ত্রী।

সাংবাদিকতা থেকে রাজনীতিতে আসা মি. মোস্তাফা জব্বার জোর দিয়ে বলেন যে, বাংলাদেশ বা ভারতের আইটি খাত উন্নত দেশের আউটসোর্সিংয়ের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি করে নিজস্ব পণ্যেরও বিকাশ ঘটাতে হবে। ‘আমরা আর কতদিন কামলাগিরি করব’ বললেন মোস্তাফা জব্বার।

তিনি বাংলাভাষী শ্রোতাদের একটি অংশকে এ বিষয়টি বোঝাতে চেয়েছেন তা দেখার জন্য অনলাইন অভিধান দেখতে পরামর্শ ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, কামলাগিরিকে দিনমজুরি হিসেবে সংক্ষিপ্ত অনুবাদ করা যেতে পারে। বাংলাদেশে এটি বহুল ব্যবহৃত বাক্য।

মোস্তাফা জব্বার বর্তমান বিশ্বে শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের জন্য চাকরি একটি বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে বলেন, প্রযুক্তি কল্যাণের জন্য, মানুষের জন্য, মানুষকে বাদ দিয়ে নয়। তিনি বলেন, চালকবিহীন গাড়ির জন্য যদি চালক চাকরি হারায়, রোবটিক্স প্রযুক্তির কারণে আমার দেশের গার্মেন্ট কর্মী যদি চাকরি হারায়, তবে তা আমাদের জন্য মোটেও সুখের নয়। তিনি এ অঞ্চলে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ব্রিটিশ প্রবর্তিত প্রচলিত শিক্ষাকে ডিজিটাল যুগের শিক্ষায় রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।’

কোলকাতার পত্রিকার এ প্রতিবেদনটি আমার হাতে আসে অনুষ্ঠানের কদিন পরে। তবে সেদিনের বক্তৃতা যে উপস্থিত দর্শকদের মাঝে আলোড়ন তুলে সেটি টের পাই অনুষ্ঠানের শেষে মঞ্চ থেকে নামার পরপরই।

বেসিস বোর্ডের সাবেক পরিচালক ও আমার প্রিয়জন মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল গত ৬ ডিসেম্বর ১৮ ফেসবুকে এক অনুচ্ছেদের একটি স্ট্যাটাস দিয়েছে। সোহেলের মতো আমার শুভাকাক্সক্ষীদের অনেকেই আমাকে একটু আলাদা সম্মান দেয়। এই স্ট্যাটাসটা তার প্রমাণ। জীবনে ওদের ঋণ কখনও পরিশোধ করতে পারব না। ওর স্ট্যাটাসটা এরকম, ‘ইনফোকমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও দুপুরের আহারের পর আমাদের বেশ তাড়া ছিল আইসিটি হাইটেক পার্ক পরিদর্শনে যাবার। তাই অনেকটা দ্রুত পায়ে হোটেলের লিফটের দিকে পা চালালাম, প্রায় দরজায় পৌঁছে গেছি, এমন সময় এক ভদ্রলোক এসে মোস্তাফা জব্বার ভাইকে বললেন, ‘স্যার আজ আপনার বক্তব্য শুনে প্রাণ ভরে গেছে, তাই আপনার পা দুটো ধরে প্রণাম করতে চাই’। উনি প্রণাম করলেন এবং সবাই অবাক হয়ে একজন অপরিচিত মানুষের জব্বার ভাইয়ের প্রতি এই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অবাক নয়নে মুগ্ধ হয়ে দেখলো, সাক্ষী হলাম বিরল এক অভিজ্ঞতার।’

সোহেলের সঙ্গে একটি বিষয়ে আমি একমত-এটি এক বিরল অভিজ্ঞতা। বলা যেতে পারে, এক ধরনের অপ্রস্তুত অভিজ্ঞতাও। সোহেল যে দৃশ্যটির বিবরণ দিয়েছে, তেমন ডজন খানেক ঘটনা ঘটেছে সেই সময়ে, মাত্র দুদিনে। দল বেধে এসে পা ছুয়ে প্রণাম করে আশীর্বাদ চেয়েছে ইনফোকমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দর্শকরা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের এই বিষয়টি আমাকে ব্যাপকভাবে আলোড়িত করেছে। আমি এই অভাবনীয় ঘটনার কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছি। দুয়েকজনকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম-একদম পা ছুয়ে প্রণাম কেন? একজন আমাকে বলেছেন, আপনি যে হলে আজ ভাষণ দিলেন এ হলে প্রতিদিন নানা রকমের অনুষ্ঠান হয়-কিন্তু আজ অবধি কেউ সম্ভবত এখানে বাংলায় ভাষণ দেননি। কোন সেমিনার, সামিট বা সাধারণ অনুষ্ঠানেও কোলকাতার ভাষা থাকে ইংরেজি। আপনি প্রমাণ করলেন, বাংলা ভাষা আপনারাই ধারণ করে রেখেছেন। এ জন্যই ভাষার জন্য রাষ্ট্র গঠন করা আপনাদের দ্বারা সম্ভব হয়েছে। সালাম বাংলা ও বাংলাদেশকে। আরেকজন মাঝ বয়সী মহিলা আমার রুমে ওঠার লিফটের পাশে একা বসে ছিলেন। আমাকে দেখেই হাসি দিয়ে ওঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমার ৪০ বছর বয়সে এমন একটি ভাষণ আমি শুনিনি। আমাকে আশীর্বাদ করে দিন। এরপর সেই মেয়েটি আমার পা ছুয়ে প্রণাম করলেন। ‘ভালো থেকো মা’ বলে ওর চোখের দিকে তাকাতেই দেখলাম চোখের কোনে পানি। বললেন, স্যার, আমাদের রাজ্যে এমন একটি অনুষ্ঠানে বাংলায় কথা বলার মানুষ আপনি পাবেন না। কেউ সাহস করে না। আমি দেখিনাই। দু-চারটি কথা বলে জানলাম-একটু শেকড়ের টানও রয়েছে। মেয়েটির পূর্ব পুরুষেরা বাংলাদেশ থেকে গেছে। চোখের পানিটা বোধহয় সেই কারণে। মেয়েটি আরও বললো, স্যার বাংলাদেশের যে অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরলেন সেটিও আমরা কল্পনা করিনি এপার থেকে।

একটি মন্ত্রণালয়ের দুটি বিভাগের প্রচুর কাজের চাপের মাঝেও আমি আমার প্রিয় বন্ধু সাফকাত হায়দারের অনুরোধে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলিকাতায় আয়োজিত ইনফোকম ১৮-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার সম্মতি প্রদান করি। তখন মন্ত্রী ছিলাম। সম্মেলনটি ৬-৭-৮ ডিসেম্বরে কোলকাতার আইটিসি সোনার হোটেলে অনুষ্ঠিত হয়। আমি পাঁচ ডিসেম্বর বিকালের বিমান ফ্লাইটে কোলকাতা পৌছাই। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বিমানবন্দরে আমাদের কলকাতার ডেপুটি হাই কমিশনার নিজে উপস্থিত থেকে আমাকে স্বাগত জানান। এর আগে স্পেন, জাপান ও থাইল্যান্ডে আমাদের দূতাবাসের কর্মকর্তাদের আন্তরিকতা পেয়ে আমি মুগ্ধ। বিমানবন্দরের বাইরে বাংলাদেশের পতাকাসম্বলিত গাড়ি আমাকে অনেকটাই আবেগাপ্লুত করে। মনে পড়ে বাংলা বিহার উড়িষ্যার কথা। মনে পড়ে কোলকাতা একদিন ভারতবর্ষের রাজধানী ছিল। পূর্ববাংলা ছিল বাঙালদের বসবাসের জায়গা-লাঙল-জোয়ালের দেশ। সেই কোলকাতা এখন তার নিজের ভাষাও টিকিয়ে রাখতে পারছেনা। বাঙালিরা এমনকি নিজেরাও হিন্দিতে কথা বলে। কেবল হয়তো বাড়িতে বাংলা চলে। বাঙালদের দেশ থেকে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়িয়ে কোলকাতার রাস্তায় চলতে পারা এবং কোলকাতা পুলিশের প্রটোকল পাওয়া ভিন্ন আমেজের তো বটেই।

ভারতের সঙ্গে আমার স্মৃতি আবেগময়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল নিয়ে প্রথম ভারতের মেঘালয়ে প্রবেশ করি। সেই দলটির প্রশিক্ষণ নিতে তিন মাস সময় লাগবে জেনে আরও একটি দল নিয়ে আবার মেঘালয়ে যাই। সেখান থেকে ৭১ এর ডিসেম্বর মাসের ৬ তারিখে হাতে একটি মাত্র গ্রেনেড নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি। সেদিন থেকেই আমার উপজেলা খালিয়াজুরি আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তাঞ্চল ঘোষিত হয়। যদিও খালিয়াজুরী পুরো নয়মাসই মুক্ত ছিল তথাপি সেদিন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি ও মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সর্বাত্মক জড়িয়ে পড়া আমাদের জন্য এক অসাধারণ স্মৃতি হয়ে ওঠে। সেদিনই আমাদের লিপসা বাজারের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড অফিস প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই ভারত যেখানে এক সময়ে জয় বাংলার লোক বলে পরিচিত ছিলাম, সেই ভারতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী গাড়িতে চড়ব, সামনে কোলকাতা পুলিশের গাড়ি থাকবে এটি নষ্টালজিয়াতো বটেই।

সাফকাত ভাইর প্রস্তাবে রাজি হবার আরও একটি কারণ ছিল যে ওখানে গেলে কোলকাতার হাসপাতালে কিডনি রোগী স্ত্রী বকুল মোস্তাফা ও ছেলে বিজয় জব্বারের সঙ্গে দেখা করা যাবে। ওরা বস্তুত সময়ের সঙ্গে লড়াই করছে। বকুলের সঙ্গে দেখা হয় না এক মাস হবে। ডায়ালাইসিস আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতে আরও কতদিন লাগবে সেটাও জানছিলাম না।

ইনফোকমের আয়োজন আমার পরিচিত। এর আগেও বেশ কয়েকবার আমাকে ইনফোকমে দাওয়াত দেয়া হয়েছে। কিন্তু থাকতে পারিনি। এবার এসে আইটিসি সোনার হোটেলেই ওঠলাম। আয়োজকরা সেই আয়োজনই করেছে। হোটেলটিতে আরও একবার ছিলাম। সংসদ সদস্য মাইনুদ্দিন আহমদ বাদল কোলকাতার একটি টিভিতে এক সময়ে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন। তারই উপস্থাপনার একটি পর্বে ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলেছিলাম। হোটেলে আসার পথে কলকাতা বিমানবন্দর সড়ক, সল্ট লেক ও আশেপাশের এলাকা দেখে চমকে ওঠছিলাম। মেট্রো রেল-ফ্লাইওভারসহ ব্যাপক উন্নয়ন দৃশ্যমান চারপাশে। ইনফোকমের সম্মেলনও আগের চাইতে অনেক বিস্তৃত হয়েছে।

কোলকাতা ভ্রমণে যাবার সময়েই আমার সিদ্ধান্ত ছিল রাজারহাটে হাইটেক পার্কগুলো দেখবো। আমি তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের দায়িত্ব গ্রহণ করে প্রথমে যে সচিব মহোদয়কে পাই সেই সুবীর কিশোর চৌধুরী রাজারহাটের ব্যাপক প্রশংসা করেন। যদিও তখন তিনি ছিলেন না তথাপি তার উৎসাহব্যঞ্জক কথাগুলো আমাকে রাজারহাট নিয়ে যায়। আমি রাজারহাটের হাইটেক পার্কগুলো দেখে ব্যতিক্রম ও ভিন্নতা উপলব্ধি করি। আমরাতো দেশজুড়েই হাইটেক নামক নির্মাণ কাজের বিস্তৃতি দেখছি-কিন্তু রাজারহাটে দেখলাম বিশাল বিশাল তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপকতম কর্মকা-। তথ্যপ্রযুক্তি কাজ করার জন্য এতো বড় স্থাপনা থাকতে পারে এবং এত মানুষ এক সঙ্গে ডিজিটাল প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে পারে সেটিতো চমকে দেবেই।

কোলকাতা সফরকালেই বিজয় তার মাকে নিয়ে বাসা ভাড়া করে যে বাসায় থেকে চিকিৎসা করাচ্ছিল সেখানে যাই। একই প্রয়োজনে যাই কলকাতার এ্যাপোলো হাসপাতালে। পুরো সময়ে বাংলাদেশের উপ হাই কমিশন ও কোলকাতা পুলিশ ব্যাপকভাবে সহায়তা করে। স্মরণ করতে পারি কেবলমাত্র কোলকাতাতেই আমার বাহনটিকে কোলকাতা পুলিশ সার্বক্ষণিক পাহারা দিয়েছে। একাত্তর সালে যে ভারতে প্রায় অসহায়ের মতো সময় কাটিয়েছি সেই ভারতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে পুলিশ প্রটেকসনে চলতে পারা অবশ্যই একটু ভিন্ন উপলব্দি অনুভূত করিয়েছে।

কোলকাতা হলো সেই শহর যে শহরে আমি প্রথম দেশের বাইরে পা ফেলি। প্রায় অর্ধ শতক আগের দেখা কোলকাতা বদলেতো গেছেই বদলে গেছে এর মানুষগুলোও। এক সময়ে কোলকাতার নিউ মার্কেটের কুলিরাও হিন্দি ছাড়া কথা বলতো না। পুরা নিউ মার্কেটে একটাও বাঙালি দোকান পেয়েছিলাম বলে মনে পড়ে না। এখন সেই শহরটি কান পেতে বাংলা শুনে-বাংলাকে সম্মান দেয় এবং বাংলাদেশকে গৌরবের অর্জন বলে মনে করে-এটা আমাদের বিশাল পাওনা।

ঢাকা, ১৯ জানুয়ারি ২০২০

মতামত লেখকের নিজস্ব

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]

mustafajabbar@gmail.com, ওয়েবপেজ: www.bijoyekushe.net, www.bijoydigital.com

মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী ২০২০ , ৭ মাঘ ১৪২৬, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

কোলকাতার ইনফোকম : অনন্য অভিজ্ঞতা

মোস্তাফা জব্বার

ইনফোকম নামটির সঙ্গে আমার পরিচিতি ছিল অনেক আগে থেকেই। আমাদের সাফকাত হায়দার ভাইয়ের আয়োজনে যুক্ত থাকেন। কোলকাতার আনন্দবাজার গোষ্ঠী এর আয়োজক। ১৮ সালের শেষ দিকে ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে সাফকাত ভাই কোলকাতার ইনফোকম আয়োজনে অংশ নেবার জন্য অনুরোধ করার প্রেক্ষিতে আমি আমন্ত্রণটি গ্রহণ করি। প্রথমত আমার দেখার আগ্রহ ছিল যে, বৃহত্তর বঙ্গের অপর পাড়ে ডিজিটাল শব্দটির প্রভাব কেমন। অন্য কারণটি ছিল যে তখন কোলকাতায় অবস্থানরত অসুস্থ স্ত্রীকেও দেখে আসতে পারব। বকুল তখন দুটি নষ্ট কিডনি নিয়ে অন্তত একটি কিডনির প্রতিস্থাপনের জন্য কোলকাতার হাসপাতালে পরীক্ষা-চিকিৎসাধীন ছিল। বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ মানুষ ভারতে চিকিৎসা নেয়। এর মাঝে একটি বড় অংশ আছে যারা কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য যায়।

ভারত ও কলিকাতা পরিচিতি : অবস্থান: ভারত দক্ষিণ এশিয়ার একটি রাষ্ট্র। দেশটির সরকারি নাম ভারতীয় প্রজাতন্ত্র। ভৌগোলিক আয়তনের বিচারে এটি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম এবং বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম রাষ্ট্র। অন্যদিকে জনসংখ্যার বিচারে এই দেশ বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক জনবহুল এবং পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ভারতের পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তান উত্তর-পূর্বে চীন, নেপাল ও ভুটান এবং পূর্বে বাংলাদেশ ও মায়ানমার অবস্থিত। এছাড়া ভারত মহাসাগরে অবস্থিত শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও ইন্দোনেশিয়া ভারতের নিকটবর্তী কয়েকটি দ্বীপরাষ্ট্র। দক্ষিণে ভারত মহাসাগর, পশ্চিমে আরব সাগর ও পূর্বে বঙ্গোপসাগর দ্বারা বেষ্টিত ভারতের উপকূলরেখার সম্মিলিত দৈর্ঘ্য ৭,৫১৭ কিলোমিটার (৪,৬৭১ মাইল)।

বর্তমানে ভারত ২৯টি রাজ্য ও সাতটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বিশিষ্ট একটি সংসদীয় সাধারণতন্ত্র। ভারতীয় অর্থব্যবস্থা বাজারি বিনিময় হারের বিচারে বিশ্বে দ্বাদশ ও ক্রয়ক্ষমতা সমতার বিচারে বিশ্বে চতুর্থ বৃহত্তম। ১৯৯১ সালে ভারত সরকার গৃহীত আর্থিক সংস্কার নীতির ফলশ্রুতিতে আজ আর্থিক বৃদ্ধিহারের বিচারে ভারত বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে দ্বিতীয়। তবে অতিমাত্রায় দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা ও অপুষ্টি এখনও ভারতের অন্যতম প্রধান সমস্যা। আয়তন : ৩২ লাখ ৮৭ হাজার ২৬৩ বর্গকিলোমিটার। মাথাপিছু আয় : ১৫৯২ ডলার। (১৪০তম)। শিক্ষার হার : ৭৪.০৪%। জনসংখ্যা : ১২১ কোটির বেশি

কলকাতা : কলকাতা হল ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর এবং ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী। কলকাতা শহরটি হুগলি নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থিত। এ শহর পূর্ব ভারতের শিক্ষা, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্র। কলকাতা বন্দর ভারতের প্রাচীনতম সচল বন্দর তথা দেশের প্রধান নদীবন্দর।

জনসংখ্যা : কলকাতার জনসংখ্যা ৪,৪৯৬,৬৯৪। (২০১১ সালো জনগণনা অনুসারে।) জনসংখ্যার হিসেবে এটি ভারতের ৭ম সর্বাধিক জনবহুল পৌর-এলাকা। অন্যদিকে বৃহত্তর কলকাতার জনসংখ্যা ১৪,১১২,৫৩৬। জনসংখ্যার হিসেবে বৃহত্তর কলকাতা ভারতের ৩য় সর্বাধিক জনবহুল মহানগরীয় অঞ্চল। জনসংখ্যার ঘনত্বে কলকাতায় প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ২৪,২৫০ জন বা প্রতি বর্গ মাইলে ৬৩,২০০ জন মানুষ বাস করে। শিক্ষার হার : ৮৭.১৪%। আয়তন : কলকাতার আয়তন ১৮৫ বর্গ কিমি.। বৃহত্তর কলকাতার আয়তন ১,৮৮৬.৬৭ বর্গ কিমি.।

বলা যেতে পারে এক ধরনের আত্মার টানে ইনফোকমে যোগ দিই। বাংলারই আরেক অংশে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে পারার সুযোগটাও হাতছাড়া করতে চাইনি। এখন অনুভভ করি সেই যাত্রাটি কতটা সফল ছিল। অনুষ্ঠানটি সম্পর্কে কোলকাতার দৈনিক দি টেলিগ্রাফ ৭ জানুয়ারি ১৮ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর বাংলা অনুবাদটি ইনফোকমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের একটি চিত্র তুলে ধরবে।

অনুষ্ঠানের শ্রোতারা অন্য আরও একটি গতানুগতিক বক্তব্যের জন্য প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু কুর্তা-পাজামা পরিহিত লোকটি তার ২০ মিনিটের মাতৃভাষায় বক্তৃতা করে শ্রোতাদের অভিভূত করলেন। সবাইকে চমকে দিয়ে বাংলাদেশের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী বাংলায় বক্তৃতা করলেন। পুরো অনুষ্ঠানটিতে তিনিই একমাত্র মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করলেন। অনুষ্ঠানে যারা বাংলা ভাষায় বক্তৃতা শুনতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেননি তাদের উদ্দেশ্যে দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেছেন, কয়েক বছর পর ভাষা কোন সমস্যা হবে না, বিশেষ করে ইনফোকম শ্রোতাদের কাছে। কারণ প্রযুক্তি এই অসুবিধাটি দূর করে দেবে। বাংলাকে আপনি যে কোন ভাষায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনুদিত পাবেন।

মন্ত্রী কলকাতায় গত ৬ ডিসেম্বর ১৮ এবিপি গ্রুপের উদ্যোগে আয়োজিত ‘ইনফরমেশন, কমিউনিকেশন্স অ্যান্ড টেকনোলজি এক্সপজিশন ইন দি ইস্ট’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে তার বক্তৃতার জন্য হলভর্তি দর্শকদের কাছে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছেন।

বাংলাদেশের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী বলেন, আজ ৬ ডিসেম্বর। এ মাসেই বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের অবদান (সাপোর্ট) আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। মন্ত্রী আইটিবিষয়ক এ সম্মেলনের তাৎপর্য তুলে ধরেন।

বাংলা বিজয় কীবোর্ডের জনক, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মি. মোস্তাফা জব্বার বাংলাদেশের অগ্রগতির অগ্রযাত্রার চিত্র তুলে ধরে বলেন, ১৯৭১ সালে ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট দিয়ে বাংলাদশের অর্থনীতির যাত্রা শুরু হয়। এই বাংলাদেশ আজ এশিয়ার অর্থনীতির পাওয়ার হাউস হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪.৫ লাখ কোটি টাকার (রুপি)র বাজেটে প্রণীত হয়েছে।

অনুষ্ঠানে মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বের ১৬ কোটিরও বেশি জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশ প্রযুক্তিকে আলিঙ্গন করেছে বলে তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেন।

পশ্চিম বঙ্গের আইটি মন্ত্রী অমিত মিত্র উদ্বোধনী ল্যাম্প প্রজ্বলন করেন। এবিপি প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও ডি.ডি পুরকায়স্থ অনুষ্ঠান উপস্থিত ছিলেন।

মোস্তাফা জব্বার বাংলাদেশে ৫৩টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে তিন শতাধিক ডিজিটাল সেবা প্রদান করা হচ্ছে উল্লেখ করে বলেন, শতকরা ৪০ ভাগ আর্থিক লেনদেন ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পন্ন হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতিদিন ১০২৪ কোটি টাকা মোবাইল ফোনে লেনদেন হচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগমন্ত্রী।

সাংবাদিকতা থেকে রাজনীতিতে আসা মি. মোস্তাফা জব্বার জোর দিয়ে বলেন যে, বাংলাদেশ বা ভারতের আইটি খাত উন্নত দেশের আউটসোর্সিংয়ের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি করে নিজস্ব পণ্যেরও বিকাশ ঘটাতে হবে। ‘আমরা আর কতদিন কামলাগিরি করব’ বললেন মোস্তাফা জব্বার।

তিনি বাংলাভাষী শ্রোতাদের একটি অংশকে এ বিষয়টি বোঝাতে চেয়েছেন তা দেখার জন্য অনলাইন অভিধান দেখতে পরামর্শ ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, কামলাগিরিকে দিনমজুরি হিসেবে সংক্ষিপ্ত অনুবাদ করা যেতে পারে। বাংলাদেশে এটি বহুল ব্যবহৃত বাক্য।

মোস্তাফা জব্বার বর্তমান বিশ্বে শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের জন্য চাকরি একটি বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে বলেন, প্রযুক্তি কল্যাণের জন্য, মানুষের জন্য, মানুষকে বাদ দিয়ে নয়। তিনি বলেন, চালকবিহীন গাড়ির জন্য যদি চালক চাকরি হারায়, রোবটিক্স প্রযুক্তির কারণে আমার দেশের গার্মেন্ট কর্মী যদি চাকরি হারায়, তবে তা আমাদের জন্য মোটেও সুখের নয়। তিনি এ অঞ্চলে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ব্রিটিশ প্রবর্তিত প্রচলিত শিক্ষাকে ডিজিটাল যুগের শিক্ষায় রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।’

কোলকাতার পত্রিকার এ প্রতিবেদনটি আমার হাতে আসে অনুষ্ঠানের কদিন পরে। তবে সেদিনের বক্তৃতা যে উপস্থিত দর্শকদের মাঝে আলোড়ন তুলে সেটি টের পাই অনুষ্ঠানের শেষে মঞ্চ থেকে নামার পরপরই।

বেসিস বোর্ডের সাবেক পরিচালক ও আমার প্রিয়জন মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল গত ৬ ডিসেম্বর ১৮ ফেসবুকে এক অনুচ্ছেদের একটি স্ট্যাটাস দিয়েছে। সোহেলের মতো আমার শুভাকাক্সক্ষীদের অনেকেই আমাকে একটু আলাদা সম্মান দেয়। এই স্ট্যাটাসটা তার প্রমাণ। জীবনে ওদের ঋণ কখনও পরিশোধ করতে পারব না। ওর স্ট্যাটাসটা এরকম, ‘ইনফোকমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও দুপুরের আহারের পর আমাদের বেশ তাড়া ছিল আইসিটি হাইটেক পার্ক পরিদর্শনে যাবার। তাই অনেকটা দ্রুত পায়ে হোটেলের লিফটের দিকে পা চালালাম, প্রায় দরজায় পৌঁছে গেছি, এমন সময় এক ভদ্রলোক এসে মোস্তাফা জব্বার ভাইকে বললেন, ‘স্যার আজ আপনার বক্তব্য শুনে প্রাণ ভরে গেছে, তাই আপনার পা দুটো ধরে প্রণাম করতে চাই’। উনি প্রণাম করলেন এবং সবাই অবাক হয়ে একজন অপরিচিত মানুষের জব্বার ভাইয়ের প্রতি এই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অবাক নয়নে মুগ্ধ হয়ে দেখলো, সাক্ষী হলাম বিরল এক অভিজ্ঞতার।’

সোহেলের সঙ্গে একটি বিষয়ে আমি একমত-এটি এক বিরল অভিজ্ঞতা। বলা যেতে পারে, এক ধরনের অপ্রস্তুত অভিজ্ঞতাও। সোহেল যে দৃশ্যটির বিবরণ দিয়েছে, তেমন ডজন খানেক ঘটনা ঘটেছে সেই সময়ে, মাত্র দুদিনে। দল বেধে এসে পা ছুয়ে প্রণাম করে আশীর্বাদ চেয়েছে ইনফোকমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দর্শকরা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের এই বিষয়টি আমাকে ব্যাপকভাবে আলোড়িত করেছে। আমি এই অভাবনীয় ঘটনার কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছি। দুয়েকজনকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম-একদম পা ছুয়ে প্রণাম কেন? একজন আমাকে বলেছেন, আপনি যে হলে আজ ভাষণ দিলেন এ হলে প্রতিদিন নানা রকমের অনুষ্ঠান হয়-কিন্তু আজ অবধি কেউ সম্ভবত এখানে বাংলায় ভাষণ দেননি। কোন সেমিনার, সামিট বা সাধারণ অনুষ্ঠানেও কোলকাতার ভাষা থাকে ইংরেজি। আপনি প্রমাণ করলেন, বাংলা ভাষা আপনারাই ধারণ করে রেখেছেন। এ জন্যই ভাষার জন্য রাষ্ট্র গঠন করা আপনাদের দ্বারা সম্ভব হয়েছে। সালাম বাংলা ও বাংলাদেশকে। আরেকজন মাঝ বয়সী মহিলা আমার রুমে ওঠার লিফটের পাশে একা বসে ছিলেন। আমাকে দেখেই হাসি দিয়ে ওঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমার ৪০ বছর বয়সে এমন একটি ভাষণ আমি শুনিনি। আমাকে আশীর্বাদ করে দিন। এরপর সেই মেয়েটি আমার পা ছুয়ে প্রণাম করলেন। ‘ভালো থেকো মা’ বলে ওর চোখের দিকে তাকাতেই দেখলাম চোখের কোনে পানি। বললেন, স্যার, আমাদের রাজ্যে এমন একটি অনুষ্ঠানে বাংলায় কথা বলার মানুষ আপনি পাবেন না। কেউ সাহস করে না। আমি দেখিনাই। দু-চারটি কথা বলে জানলাম-একটু শেকড়ের টানও রয়েছে। মেয়েটির পূর্ব পুরুষেরা বাংলাদেশ থেকে গেছে। চোখের পানিটা বোধহয় সেই কারণে। মেয়েটি আরও বললো, স্যার বাংলাদেশের যে অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরলেন সেটিও আমরা কল্পনা করিনি এপার থেকে।

একটি মন্ত্রণালয়ের দুটি বিভাগের প্রচুর কাজের চাপের মাঝেও আমি আমার প্রিয় বন্ধু সাফকাত হায়দারের অনুরোধে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলিকাতায় আয়োজিত ইনফোকম ১৮-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার সম্মতি প্রদান করি। তখন মন্ত্রী ছিলাম। সম্মেলনটি ৬-৭-৮ ডিসেম্বরে কোলকাতার আইটিসি সোনার হোটেলে অনুষ্ঠিত হয়। আমি পাঁচ ডিসেম্বর বিকালের বিমান ফ্লাইটে কোলকাতা পৌছাই। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বিমানবন্দরে আমাদের কলকাতার ডেপুটি হাই কমিশনার নিজে উপস্থিত থেকে আমাকে স্বাগত জানান। এর আগে স্পেন, জাপান ও থাইল্যান্ডে আমাদের দূতাবাসের কর্মকর্তাদের আন্তরিকতা পেয়ে আমি মুগ্ধ। বিমানবন্দরের বাইরে বাংলাদেশের পতাকাসম্বলিত গাড়ি আমাকে অনেকটাই আবেগাপ্লুত করে। মনে পড়ে বাংলা বিহার উড়িষ্যার কথা। মনে পড়ে কোলকাতা একদিন ভারতবর্ষের রাজধানী ছিল। পূর্ববাংলা ছিল বাঙালদের বসবাসের জায়গা-লাঙল-জোয়ালের দেশ। সেই কোলকাতা এখন তার নিজের ভাষাও টিকিয়ে রাখতে পারছেনা। বাঙালিরা এমনকি নিজেরাও হিন্দিতে কথা বলে। কেবল হয়তো বাড়িতে বাংলা চলে। বাঙালদের দেশ থেকে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়িয়ে কোলকাতার রাস্তায় চলতে পারা এবং কোলকাতা পুলিশের প্রটোকল পাওয়া ভিন্ন আমেজের তো বটেই।

ভারতের সঙ্গে আমার স্মৃতি আবেগময়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল নিয়ে প্রথম ভারতের মেঘালয়ে প্রবেশ করি। সেই দলটির প্রশিক্ষণ নিতে তিন মাস সময় লাগবে জেনে আরও একটি দল নিয়ে আবার মেঘালয়ে যাই। সেখান থেকে ৭১ এর ডিসেম্বর মাসের ৬ তারিখে হাতে একটি মাত্র গ্রেনেড নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি। সেদিন থেকেই আমার উপজেলা খালিয়াজুরি আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তাঞ্চল ঘোষিত হয়। যদিও খালিয়াজুরী পুরো নয়মাসই মুক্ত ছিল তথাপি সেদিন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি ও মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সর্বাত্মক জড়িয়ে পড়া আমাদের জন্য এক অসাধারণ স্মৃতি হয়ে ওঠে। সেদিনই আমাদের লিপসা বাজারের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড অফিস প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই ভারত যেখানে এক সময়ে জয় বাংলার লোক বলে পরিচিত ছিলাম, সেই ভারতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী গাড়িতে চড়ব, সামনে কোলকাতা পুলিশের গাড়ি থাকবে এটি নষ্টালজিয়াতো বটেই।

সাফকাত ভাইর প্রস্তাবে রাজি হবার আরও একটি কারণ ছিল যে ওখানে গেলে কোলকাতার হাসপাতালে কিডনি রোগী স্ত্রী বকুল মোস্তাফা ও ছেলে বিজয় জব্বারের সঙ্গে দেখা করা যাবে। ওরা বস্তুত সময়ের সঙ্গে লড়াই করছে। বকুলের সঙ্গে দেখা হয় না এক মাস হবে। ডায়ালাইসিস আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতে আরও কতদিন লাগবে সেটাও জানছিলাম না।

ইনফোকমের আয়োজন আমার পরিচিত। এর আগেও বেশ কয়েকবার আমাকে ইনফোকমে দাওয়াত দেয়া হয়েছে। কিন্তু থাকতে পারিনি। এবার এসে আইটিসি সোনার হোটেলেই ওঠলাম। আয়োজকরা সেই আয়োজনই করেছে। হোটেলটিতে আরও একবার ছিলাম। সংসদ সদস্য মাইনুদ্দিন আহমদ বাদল কোলকাতার একটি টিভিতে এক সময়ে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন। তারই উপস্থাপনার একটি পর্বে ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলেছিলাম। হোটেলে আসার পথে কলকাতা বিমানবন্দর সড়ক, সল্ট লেক ও আশেপাশের এলাকা দেখে চমকে ওঠছিলাম। মেট্রো রেল-ফ্লাইওভারসহ ব্যাপক উন্নয়ন দৃশ্যমান চারপাশে। ইনফোকমের সম্মেলনও আগের চাইতে অনেক বিস্তৃত হয়েছে।

কোলকাতা ভ্রমণে যাবার সময়েই আমার সিদ্ধান্ত ছিল রাজারহাটে হাইটেক পার্কগুলো দেখবো। আমি তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের দায়িত্ব গ্রহণ করে প্রথমে যে সচিব মহোদয়কে পাই সেই সুবীর কিশোর চৌধুরী রাজারহাটের ব্যাপক প্রশংসা করেন। যদিও তখন তিনি ছিলেন না তথাপি তার উৎসাহব্যঞ্জক কথাগুলো আমাকে রাজারহাট নিয়ে যায়। আমি রাজারহাটের হাইটেক পার্কগুলো দেখে ব্যতিক্রম ও ভিন্নতা উপলব্ধি করি। আমরাতো দেশজুড়েই হাইটেক নামক নির্মাণ কাজের বিস্তৃতি দেখছি-কিন্তু রাজারহাটে দেখলাম বিশাল বিশাল তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপকতম কর্মকা-। তথ্যপ্রযুক্তি কাজ করার জন্য এতো বড় স্থাপনা থাকতে পারে এবং এত মানুষ এক সঙ্গে ডিজিটাল প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে পারে সেটিতো চমকে দেবেই।

কোলকাতা সফরকালেই বিজয় তার মাকে নিয়ে বাসা ভাড়া করে যে বাসায় থেকে চিকিৎসা করাচ্ছিল সেখানে যাই। একই প্রয়োজনে যাই কলকাতার এ্যাপোলো হাসপাতালে। পুরো সময়ে বাংলাদেশের উপ হাই কমিশন ও কোলকাতা পুলিশ ব্যাপকভাবে সহায়তা করে। স্মরণ করতে পারি কেবলমাত্র কোলকাতাতেই আমার বাহনটিকে কোলকাতা পুলিশ সার্বক্ষণিক পাহারা দিয়েছে। একাত্তর সালে যে ভারতে প্রায় অসহায়ের মতো সময় কাটিয়েছি সেই ভারতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে পুলিশ প্রটেকসনে চলতে পারা অবশ্যই একটু ভিন্ন উপলব্দি অনুভূত করিয়েছে।

কোলকাতা হলো সেই শহর যে শহরে আমি প্রথম দেশের বাইরে পা ফেলি। প্রায় অর্ধ শতক আগের দেখা কোলকাতা বদলেতো গেছেই বদলে গেছে এর মানুষগুলোও। এক সময়ে কোলকাতার নিউ মার্কেটের কুলিরাও হিন্দি ছাড়া কথা বলতো না। পুরা নিউ মার্কেটে একটাও বাঙালি দোকান পেয়েছিলাম বলে মনে পড়ে না। এখন সেই শহরটি কান পেতে বাংলা শুনে-বাংলাকে সম্মান দেয় এবং বাংলাদেশকে গৌরবের অর্জন বলে মনে করে-এটা আমাদের বিশাল পাওনা।

ঢাকা, ১৯ জানুয়ারি ২০২০

মতামত লেখকের নিজস্ব

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]

mustafajabbar@gmail.com, ওয়েবপেজ: www.bijoyekushe.net, www.bijoydigital.com