পিকে হালদারসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে

আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস এবং রিলায়েন্স ফাইন্যান্স কোম্পানির শীর্ষ পদে থেকে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লুট করার ঘটনায় এরআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদারসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। এ বিষয়ে অনুসন্ধান শেষ পর্যায়ে রয়েছে। মামলার বিষয়ে দুদক প্রস্তুতি নিচ্ছে। অর্থ লোপাট সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনও দুদকের হাতে পৌঁছেছে। প্রশাস্ত ছাড়া অন্য যারা সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লোপাটের সঙ্গে জড়িত তাদের বিষয়ে যাচাই-বাচাই করা হচ্ছে। মামলায় পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইনান্সিয়াল লিমিটেড রিলায়েন্স ফাইনেন্সিয়াল এবং ইন্টারন্যাশাল ফাইনেন্সিয়ালসহ প্রশাস্ত কুমার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা এবং তার স্বজনরা এসব মামলায় আসামি হচ্ছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে অনুসন্ধান টিমের প্রধান দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ারের স্বাক্ষরিত চিঠিতে আগামী ২৭ এবং ২৮ জানুয়ারি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়েছে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সের ৩ পরিচালককে। তাদের কাছে রিলায়েন্স ফাইনান্সিয়ালের গ্রাহকের সংখ্যা, একাউন্টে গচ্ছিত অর্থসহ বিভিন্ন বিষয়ের তথ্য চাওয়া হয়েছে।

এদিকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার আত্মসাত ও বিদেশে পাচারের ঘটনায় বিদেশ পলাতক এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক এমপি প্রশান্ত কুমার হালদারসহ ২০ জনেরব্যাংক একাউন্ট, যাবতীয় সম্পদ এবং পাসপোর্টসহ জব্দ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। গতকাল হাইকোর্টের এক ব্যাঞ্চ এ আদেশ দেন। এ আদেশ বাস্তবায়নে কাজ করবে দুদক টিম।

দুদক সূত্র জানায়, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদার রিলায়েন্স ফাইন্যান্স নামের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডি থাকা অবস্থায় তার আত্মীয়-স্বজনকে দিয়ে আরও বেশ কয়েকটি লিজিং কোম্পানির ইনডিপেন্ডেন পরিচালক বানান এবং একক কর্তৃত্বে অদৃশ্য শক্তির মাধ্যমে পিপলস লিজিংসহ বেশ কয়েকটি লিজিং কোম্পানির টাকা বিভিন্ন কৌশলে বের করে আত্মসাত করেন। পিপলস লিজিং এ আমানতকারীদের ৩ হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন কৌশলে আত্মসাত করেন এব ওই কোম্পানিকে পথে বসিয়েছেন। এ সমস্ত কোম্পানির স্থাবর সম্পদ বিক্রি করে দেন এবং আমানতকারীদের শেয়ার পোর্টফোলিও থেকে শেয়ার বিক্রি করে সমুদয় টাকা আত্মসাত করেন। এ বিষয়ে পিপলস লিজিং এর বোর্ড অব ডিরেক্টরের নাম ও বিস্তারিত তথ্যাদি, ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১ কোটি বা তদূর্র্ধ্ব ঋণ দেয়া হয়েছে, এমন প্রতিষ্ঠা-ব্যক্তিদের তথ্যাদি ও ঋণের বর্তমান পোর্টফোলিও, একাউন্ট স্ট্যাটম্যান্ট, ২০১০ সাল থেকে ওই প্রতিষ্ঠানের ওপর ইন্টারনাল বা এক্ট্রারনাল অডিট প্রতিবেদন সংগ্রহ করা হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট রিপোর্ট সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়া রিলায়েন্স ফাইন্যান্স নামীয় প্রতিষ্ঠান থেকে ২০০৯ সাল এ পর্যন্ত কত টাকা আমানতকারীদের কাছ থেকে উত্তোলন করা হয়েছে এবং কত টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানে কাছে কত টাকা রক্ষিত রয়েছে, ওই প্রতিষ্ঠানের নামে কোন কোন ব্যাংকে একাউন্ট রয়েছে এবং একাউন্টে কত টাকা জমা রয়েছে, তার তথ্যাদি প্রতিবেদন আকারে দিতে হবে এবং এতদসংক্রান্ত একাউন্ট স্ট্যাটম্যান্টসহ প্রয়োজনীয় তথ্যাদি চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়েছে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসেসের পরিচাল ও ভাইস চেয়ারম্যান মো. নিজামুল আহসান, পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম মোল্লা এবং মো. ইউসুফ ইসমাইলকে। গতকাল দুদকের পরিচালক এবং তদন্ত সংশ্লিষ্ট টিমের প্রধান গুলশান আনোয়ার প্রধানের স্বাক্ষরিত চিঠিতে তলব করে এ ৩ জনকে আগামী ২৭ এবং ২৮ জানুয়ারি দুদকে হাজির থাকতে বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট দুদকের এক পদস্ত কর্মকর্তা জানান, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইনেন্সিয়াল লিমিটেডকে পুরোপুরি দেওলিয়া করে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাত এবং তা বিদেশে পাচারের তথ্য প্রমাণ পেয়েছে দুদক। আগ থেকে বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এ অর্থ লুটের মূল হোতা প্রশাস্ত কুমার হালদার কৌশলে বিদেশে পালিয়ে যায়। তার অবস্থায় বর্তমানে কানাডায় বলে তথ্য রয়েছে দুদকের কাছে। তবু প্রশান্তের সঠিক অবস্থান কোথায় রয়েছে এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে দুদক বিভিন্নভাবে তথ্য সংগ্রহ করছে। পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইনেন্সিয়াল লিমিটেডকে দেওলিয়া করে প্রশাস্ত কুমারের প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা শাখার যে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে তা হাতে পেয়েছে দুদক। অনুসন্ধান টিম ওই প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করছে। এ বিষয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে। তদন্ত শেষ পর্যায়ে। ৩ জনকে তলব করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাকিদের তলব করা হবে। জিজ্ঞাসাবাদের তালিকায় প্রশাস্ত কুমারের আত্মীয় স্বজন, পিপলস, রিলায়েন্স এবং ইন্টারন্যাশাল ফাইনেন্সিয়াল লিমিটেডসহ প্রশাস্ত কুমার যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, দায়িত্ব পালন করেছেন সেসব প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকের তালিকা দুদকের কাছে রয়েছে।

দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, তদন্তের সিংহভাগ তদন্ত শেষ হয়েছে। এ অর্থ লুটের ঘটনায় পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইনেন্সিয়াল লিমিটেডসহ কমপক্ষে বিভিন্ন পর্যায়ের ২২ থেকে ২৫ জন আসামি হবেন। শুধু প্রশান্ত কুমার একাই নয় অর্থ লুট এবং বিদেশে পাচারের সঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইনেন্সিয়াল লিমিটেড, রিলায়েন্স ফাইনেন্সিয়াল লিমিটেডসহ বিভিন্ন পর্যায়ের অনেকেই জড়িত। গতকাল হাইকোর্ট সুয়োমুটো রুল জারি করেছে। প্রশাস্ত কুমার হালদারের যাবতীয় ব্যাংক একাউন্ট জব্দের পাশাপাশি মোট ২০ জনের পাসপোর্টসহ যাবতীয় নতিপত্র জব্দের নির্দেশ দিয়েছে। হাইকোর্ট যে ২০ জনের নতিপত্র জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছে অনুসন্ধানের স্বার্থে তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদকের ডাকা হবে। অপর একটি সূত্র জানায়, মামলায় প্রশাস্ত কুমার হালদারকে প্রধান আসামি করা হবে। এরপর এ অর্থ লুট ও তা বিদেশে পাচারের সঙ্গে যার যতখানি ভূমিকা রয়েছে সে অনুযায়ী প্রত্যেককে আসামি করা হবে। কমপক্ষে ৪ থেকে ৫টি মামলা করার মতো তথ্য প্রমাণ দুদকের কাছে রয়েছে। হাইকোর্ট থেকে প্রশান্ত কুমার হালদারসহ যে ২০ জনের ব্যাংক হিসাব, যাবতীয় সম্পদ এবং পাসপোর্ট জব্দের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তারা এসব মামলায় আসামি হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।

পিকে হালদারসহ ২০ জনের ব্যাংক একাউন্ট, সম্পদ এবং পাসপোর্ট জব্দের নির্দেশ

এদিকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মাসাত এবং তা বিদেশে পাচারের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে এনআরবি গ্লোবাল বাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে থাকা ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডের পরিচালক প্রশাস্ত কুমার হালদারসহ (পিকে হালদার) ২০ জনের সব সম্পদ, ব্যাংক হিসাব জব্দ ও পাসপোর্ট আটকানোর নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। গতকাল বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন। আদালতে আবেদনকারীর পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট শাহরিয়ার কবির। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডে বিনিয়োগকারী দুই জনের আবেদনের প্রেক্ষিতে এ আদেশ দেয়া হয়। অন্য যাদের বিষয়ে এ আদেশ দেয়া হয়েছে তারা হলেন, কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম নুরুল আলম, পরিচালক জহিরুল আলম, নাসিম আনোয়ার, বাসুদেব ব্যানার্জি, পাপিয়া ব্যানার্জি, মোমতাজ বেগম, নওশেরুল ইসলাম, আনোয়ারুল কবির, প্রকৌশলী নুরুজ্জামান, আবুল হাসেম, এমএ হাসেম, মো. রাশেদুল হক, পিকে হালদারের মা লীলাবতী হালদার, স্ত্রী সুষ্মিতা সাহা, ভাই প্রিতুষ কুমার হালদার, চাচাতো ভাই অমিতাব অধিকারী, অভিজিৎ অধিকারী, ব্যাংক এশিয়ার সাবেক পরিচালক ইরফান উদ্দিন আহমেদ ও পিকে হালদারের বন্ধু উজ্জ্বল কুমার নন্দী। আদেশে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক খাতের কোম্পানি ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডের স্বাধীন পরিচালক ও চেয়ারম্যান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ইব্রাহিম খালেদকে নিয়োগ দিয়েছেন আদালত।

দুদক সূত্র জানায়, যেহেতু প্রশান্ত কুমার হালাদারের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাত এবং তা বিদেশে পাচারের বিষয়ে দুদক অনুসন্ধান করছে তাই এ বিষয়ে দুদকের কাছে আদেশের কপি আসলে দুদক ব্যবস্থা নিবে। যে ২০ জনের ব্যাংক একাউন্ট, যাবতীয় সম্পদ এবং পাসপোর্ট জব্দের আদেশ দেয়া হয়েছে তারা সবাই সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাত এবং বিদেশে পাচারের সঙ্গে নানাভাবে জড়িত। এরা প্রত্যেকেই প্রশাস্ত কুমার হালদারের যাবতীয় কুকর্মের অন্যতন সহযোগী। দুদক সূত্র জানায়, প্রশান্ত কুমার হালদার যে শুধু পিপলস লিজিং এবং রিলায়েন্সের অর্থ লুট করেছে তা নয়, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) এবং এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের শীর্ষ পদে থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন। এসব সব প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন ও নতুন আরও কিছু কাগুজে প্রতিষ্ঠান তৈরির মাধ্যমে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করে তা বিদেশে পাচার করেছেন প্রশান্ত কুমার হালদার। দুদকের অনুসন্ধান চলাকালে কৌশলে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। ক্যাসিনো অভিযানের মধ্যে দুদক কর্তৃক দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের পর্যায়ে প্রশান্ত কুমার হালদারের বিরুদ্ধে ২৭৫ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেন দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ। ওই মামলার আগেই তিনি দেশ ছেড়ে লাপাত্তা হন।

উল্লেখ আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস এবং রিলায়েন্স ফাইন্যান্স কোম্পানির আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে অনুসন্ধানে দুদকের উপ-পরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধানকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হলে পিপলস লিজিং কোম্পানি ও রিলায়েন্স ফ্যাইন্স্যান্স এর গত ৪ বছরে (২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত) দায়িত্বে থাকা বোর্ড অব ডিরেক্টটরদের নামসহ যাবতীয় নথিপত্র তলব করে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

বুধবার, ২২ জানুয়ারী ২০২০ , ৮ মাঘ ১৪২৬, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লুট

পিকে হালদারসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে

সাইফ বাবলু

আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস এবং রিলায়েন্স ফাইন্যান্স কোম্পানির শীর্ষ পদে থেকে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লুট করার ঘটনায় এরআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদারসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। এ বিষয়ে অনুসন্ধান শেষ পর্যায়ে রয়েছে। মামলার বিষয়ে দুদক প্রস্তুতি নিচ্ছে। অর্থ লোপাট সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনও দুদকের হাতে পৌঁছেছে। প্রশাস্ত ছাড়া অন্য যারা সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লোপাটের সঙ্গে জড়িত তাদের বিষয়ে যাচাই-বাচাই করা হচ্ছে। মামলায় পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইনান্সিয়াল লিমিটেড রিলায়েন্স ফাইনেন্সিয়াল এবং ইন্টারন্যাশাল ফাইনেন্সিয়ালসহ প্রশাস্ত কুমার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা এবং তার স্বজনরা এসব মামলায় আসামি হচ্ছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে অনুসন্ধান টিমের প্রধান দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ারের স্বাক্ষরিত চিঠিতে আগামী ২৭ এবং ২৮ জানুয়ারি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়েছে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সের ৩ পরিচালককে। তাদের কাছে রিলায়েন্স ফাইনান্সিয়ালের গ্রাহকের সংখ্যা, একাউন্টে গচ্ছিত অর্থসহ বিভিন্ন বিষয়ের তথ্য চাওয়া হয়েছে।

এদিকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার আত্মসাত ও বিদেশে পাচারের ঘটনায় বিদেশ পলাতক এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক এমপি প্রশান্ত কুমার হালদারসহ ২০ জনেরব্যাংক একাউন্ট, যাবতীয় সম্পদ এবং পাসপোর্টসহ জব্দ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। গতকাল হাইকোর্টের এক ব্যাঞ্চ এ আদেশ দেন। এ আদেশ বাস্তবায়নে কাজ করবে দুদক টিম।

দুদক সূত্র জানায়, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদার রিলায়েন্স ফাইন্যান্স নামের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডি থাকা অবস্থায় তার আত্মীয়-স্বজনকে দিয়ে আরও বেশ কয়েকটি লিজিং কোম্পানির ইনডিপেন্ডেন পরিচালক বানান এবং একক কর্তৃত্বে অদৃশ্য শক্তির মাধ্যমে পিপলস লিজিংসহ বেশ কয়েকটি লিজিং কোম্পানির টাকা বিভিন্ন কৌশলে বের করে আত্মসাত করেন। পিপলস লিজিং এ আমানতকারীদের ৩ হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন কৌশলে আত্মসাত করেন এব ওই কোম্পানিকে পথে বসিয়েছেন। এ সমস্ত কোম্পানির স্থাবর সম্পদ বিক্রি করে দেন এবং আমানতকারীদের শেয়ার পোর্টফোলিও থেকে শেয়ার বিক্রি করে সমুদয় টাকা আত্মসাত করেন। এ বিষয়ে পিপলস লিজিং এর বোর্ড অব ডিরেক্টরের নাম ও বিস্তারিত তথ্যাদি, ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১ কোটি বা তদূর্র্ধ্ব ঋণ দেয়া হয়েছে, এমন প্রতিষ্ঠা-ব্যক্তিদের তথ্যাদি ও ঋণের বর্তমান পোর্টফোলিও, একাউন্ট স্ট্যাটম্যান্ট, ২০১০ সাল থেকে ওই প্রতিষ্ঠানের ওপর ইন্টারনাল বা এক্ট্রারনাল অডিট প্রতিবেদন সংগ্রহ করা হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট রিপোর্ট সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়া রিলায়েন্স ফাইন্যান্স নামীয় প্রতিষ্ঠান থেকে ২০০৯ সাল এ পর্যন্ত কত টাকা আমানতকারীদের কাছ থেকে উত্তোলন করা হয়েছে এবং কত টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানে কাছে কত টাকা রক্ষিত রয়েছে, ওই প্রতিষ্ঠানের নামে কোন কোন ব্যাংকে একাউন্ট রয়েছে এবং একাউন্টে কত টাকা জমা রয়েছে, তার তথ্যাদি প্রতিবেদন আকারে দিতে হবে এবং এতদসংক্রান্ত একাউন্ট স্ট্যাটম্যান্টসহ প্রয়োজনীয় তথ্যাদি চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়েছে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসেসের পরিচাল ও ভাইস চেয়ারম্যান মো. নিজামুল আহসান, পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম মোল্লা এবং মো. ইউসুফ ইসমাইলকে। গতকাল দুদকের পরিচালক এবং তদন্ত সংশ্লিষ্ট টিমের প্রধান গুলশান আনোয়ার প্রধানের স্বাক্ষরিত চিঠিতে তলব করে এ ৩ জনকে আগামী ২৭ এবং ২৮ জানুয়ারি দুদকে হাজির থাকতে বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট দুদকের এক পদস্ত কর্মকর্তা জানান, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইনেন্সিয়াল লিমিটেডকে পুরোপুরি দেওলিয়া করে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাত এবং তা বিদেশে পাচারের তথ্য প্রমাণ পেয়েছে দুদক। আগ থেকে বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এ অর্থ লুটের মূল হোতা প্রশাস্ত কুমার হালদার কৌশলে বিদেশে পালিয়ে যায়। তার অবস্থায় বর্তমানে কানাডায় বলে তথ্য রয়েছে দুদকের কাছে। তবু প্রশান্তের সঠিক অবস্থান কোথায় রয়েছে এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে দুদক বিভিন্নভাবে তথ্য সংগ্রহ করছে। পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইনেন্সিয়াল লিমিটেডকে দেওলিয়া করে প্রশাস্ত কুমারের প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা শাখার যে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে তা হাতে পেয়েছে দুদক। অনুসন্ধান টিম ওই প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করছে। এ বিষয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে। তদন্ত শেষ পর্যায়ে। ৩ জনকে তলব করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাকিদের তলব করা হবে। জিজ্ঞাসাবাদের তালিকায় প্রশাস্ত কুমারের আত্মীয় স্বজন, পিপলস, রিলায়েন্স এবং ইন্টারন্যাশাল ফাইনেন্সিয়াল লিমিটেডসহ প্রশাস্ত কুমার যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, দায়িত্ব পালন করেছেন সেসব প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকের তালিকা দুদকের কাছে রয়েছে।

দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, তদন্তের সিংহভাগ তদন্ত শেষ হয়েছে। এ অর্থ লুটের ঘটনায় পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইনেন্সিয়াল লিমিটেডসহ কমপক্ষে বিভিন্ন পর্যায়ের ২২ থেকে ২৫ জন আসামি হবেন। শুধু প্রশান্ত কুমার একাই নয় অর্থ লুট এবং বিদেশে পাচারের সঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইনেন্সিয়াল লিমিটেড, রিলায়েন্স ফাইনেন্সিয়াল লিমিটেডসহ বিভিন্ন পর্যায়ের অনেকেই জড়িত। গতকাল হাইকোর্ট সুয়োমুটো রুল জারি করেছে। প্রশাস্ত কুমার হালদারের যাবতীয় ব্যাংক একাউন্ট জব্দের পাশাপাশি মোট ২০ জনের পাসপোর্টসহ যাবতীয় নতিপত্র জব্দের নির্দেশ দিয়েছে। হাইকোর্ট যে ২০ জনের নতিপত্র জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছে অনুসন্ধানের স্বার্থে তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদকের ডাকা হবে। অপর একটি সূত্র জানায়, মামলায় প্রশাস্ত কুমার হালদারকে প্রধান আসামি করা হবে। এরপর এ অর্থ লুট ও তা বিদেশে পাচারের সঙ্গে যার যতখানি ভূমিকা রয়েছে সে অনুযায়ী প্রত্যেককে আসামি করা হবে। কমপক্ষে ৪ থেকে ৫টি মামলা করার মতো তথ্য প্রমাণ দুদকের কাছে রয়েছে। হাইকোর্ট থেকে প্রশান্ত কুমার হালদারসহ যে ২০ জনের ব্যাংক হিসাব, যাবতীয় সম্পদ এবং পাসপোর্ট জব্দের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তারা এসব মামলায় আসামি হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।

পিকে হালদারসহ ২০ জনের ব্যাংক একাউন্ট, সম্পদ এবং পাসপোর্ট জব্দের নির্দেশ

এদিকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মাসাত এবং তা বিদেশে পাচারের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে এনআরবি গ্লোবাল বাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে থাকা ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডের পরিচালক প্রশাস্ত কুমার হালদারসহ (পিকে হালদার) ২০ জনের সব সম্পদ, ব্যাংক হিসাব জব্দ ও পাসপোর্ট আটকানোর নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। গতকাল বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন। আদালতে আবেদনকারীর পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট শাহরিয়ার কবির। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডে বিনিয়োগকারী দুই জনের আবেদনের প্রেক্ষিতে এ আদেশ দেয়া হয়। অন্য যাদের বিষয়ে এ আদেশ দেয়া হয়েছে তারা হলেন, কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম নুরুল আলম, পরিচালক জহিরুল আলম, নাসিম আনোয়ার, বাসুদেব ব্যানার্জি, পাপিয়া ব্যানার্জি, মোমতাজ বেগম, নওশেরুল ইসলাম, আনোয়ারুল কবির, প্রকৌশলী নুরুজ্জামান, আবুল হাসেম, এমএ হাসেম, মো. রাশেদুল হক, পিকে হালদারের মা লীলাবতী হালদার, স্ত্রী সুষ্মিতা সাহা, ভাই প্রিতুষ কুমার হালদার, চাচাতো ভাই অমিতাব অধিকারী, অভিজিৎ অধিকারী, ব্যাংক এশিয়ার সাবেক পরিচালক ইরফান উদ্দিন আহমেদ ও পিকে হালদারের বন্ধু উজ্জ্বল কুমার নন্দী। আদেশে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক খাতের কোম্পানি ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডের স্বাধীন পরিচালক ও চেয়ারম্যান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ইব্রাহিম খালেদকে নিয়োগ দিয়েছেন আদালত।

দুদক সূত্র জানায়, যেহেতু প্রশান্ত কুমার হালাদারের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাত এবং তা বিদেশে পাচারের বিষয়ে দুদক অনুসন্ধান করছে তাই এ বিষয়ে দুদকের কাছে আদেশের কপি আসলে দুদক ব্যবস্থা নিবে। যে ২০ জনের ব্যাংক একাউন্ট, যাবতীয় সম্পদ এবং পাসপোর্ট জব্দের আদেশ দেয়া হয়েছে তারা সবাই সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাত এবং বিদেশে পাচারের সঙ্গে নানাভাবে জড়িত। এরা প্রত্যেকেই প্রশাস্ত কুমার হালদারের যাবতীয় কুকর্মের অন্যতন সহযোগী। দুদক সূত্র জানায়, প্রশান্ত কুমার হালদার যে শুধু পিপলস লিজিং এবং রিলায়েন্সের অর্থ লুট করেছে তা নয়, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) এবং এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের শীর্ষ পদে থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন। এসব সব প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন ও নতুন আরও কিছু কাগুজে প্রতিষ্ঠান তৈরির মাধ্যমে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করে তা বিদেশে পাচার করেছেন প্রশান্ত কুমার হালদার। দুদকের অনুসন্ধান চলাকালে কৌশলে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। ক্যাসিনো অভিযানের মধ্যে দুদক কর্তৃক দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের পর্যায়ে প্রশান্ত কুমার হালদারের বিরুদ্ধে ২৭৫ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেন দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ। ওই মামলার আগেই তিনি দেশ ছেড়ে লাপাত্তা হন।

উল্লেখ আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস এবং রিলায়েন্স ফাইন্যান্স কোম্পানির আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে অনুসন্ধানে দুদকের উপ-পরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধানকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হলে পিপলস লিজিং কোম্পানি ও রিলায়েন্স ফ্যাইন্স্যান্স এর গত ৪ বছরে (২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত) দায়িত্বে থাকা বোর্ড অব ডিরেক্টটরদের নামসহ যাবতীয় নথিপত্র তলব করে চিঠি পাঠানো হয়েছে।