ক্রসফায়ারে নাশ : বাকিতে চাঙ্গা মাদক!

মীর আব্দুল আলীম

মাদক নিয়ে সরকার বেশ সোচ্চার। ধরপাকড় হচ্ছে; ক্রশফায়ার হচ্ছে। ক্রসফায়ারে মাদককারবারি নাশ (শেষ) হলেও, বাকির মাদকে দেশ এখন চাঙ্গা বেশ। বছরখানেক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ অভিযানের কারণে বিপাকে পড়েন দেশি এবং আন্তর্জাতিক মাদককারবারিরা। কিছুটা হলেও ‘ব্যবসায়’ ধস নামে। ফলে বাজার চাঙা রাখতে বাকিতে ইয়াবা আর ফেনসিডিল বিক্রি শুরু করেছেন মায়ানমার আর ভারতের মাদক কারবারিরা। দেশের খুচরা বাজারেও এখন ‘মাল বেচে দাম দাও’ এই নীতিতে ব্যবসা চলছে বেশ জোরেসোরে। আগে নগদে; এমনকি অগ্রিম অর্থে মায়ানমারে উৎপাদিত ইয়াবা আর ভারতের ফেনসিডিল আনতো আমাদের মাদক কারবারি চক্র। খুচরা বাজারে বিক্রিও হতো নগদেই। বাংলাদেশে মাদক ব্যবসার ঝুঁকি বাড়ায় ব্যবসায়ীদের লোভ দেখিয়ে আন্তর্জাতিক ইয়াবা আর ফেনসিডিল চক্র দেশে বাকিতে ঠিকই মাদক পাচার করে চলেছে। এমন সংবাদ আমাদের জাতীয় দৈনিকগুলো কয়েকদিন ধরে ফলাও করে প্রচার করছে।

আমরা জানি যে, মায়ানমার ইয়াবা তৈরি করে আর ভারত ফেন্সিডিল। তাদের উৎপাদিত ইয়াবা আর ফেনসিডিল সেবন করছে বাংলাদেশের মানুষ। এসব মাদক বেঁচে প্রতি দিন আমাদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ভারত, মিয়ানমার। আর তাতে আমাদের যুবসমাজ ইয়াবা আসক্ত হয়ে ধ্বংসে নিপাতিত হচ্ছে। কি করছি আমরা? আমাদের সরকারও কি করতে পারছে? শত শত মাদক বিক্রেতাকে ইতোমধ্যে ক্রসফায়ার দেয়া হয়েছে। তাতেও কি মাদক কেনাবেঁচা বন্ধ হয়েছে? না; পুরোদমেই চলছে মাদক ব্যবসা। সেবনকারীর কমেনি, কমেনি বিক্রেতাও। একজন ক্রসফায়ারে মরলে গডফাদাররা সঙ্গে সঙ্গে ২-৪ জন চুনোপুঁটি বিক্রেতাওয়ালার জন্ম দেয়। তাই মাদক ব্যবসা না কমে বাড়ে বৈকি! এাদক নিয়ন্ত্রণে দরকার আইনের সঠিক প্রয়োগ। সরকার কিন্তু মাদক নিয়ন্ত্রণ ঠিকই করতে চায়। মাদকের ব্যাপারে সরকারের সম্মতি নেই মোটেও, তবে সরকার সংশ্লিষ্ট কর্তাবাবুদের ম্যানেজ হয়ে যাবার কারনেই মাদকের প্রসারতা প্রতিদিন বাড়ছে। এদের কারণেই মাদক ব্যবসায়ীরা দেশে মাদকে সয়লাব করে দিতে পারছে।

বাংলাদেশে ইয়াবা আর ফেনসিডিলের বাজার তৈরি হওয়ায় মায়ানমার এবং ভারত সীমান্তে অসংখ্য ইয়াবা আর ফেনসিডিলেরর কারখানা গড়ে উঠছে। এসব কারখানায় বাংলাদেশের যুবসমাজের জন্য মায়ানমার মরণ নেশা ইয়াবা এবং ভারত থেকে ফেনসিডিল উৎপাদন করে তা নির্বিঘ্নে সর্বরাহ করা হচ্ছে। বলতে দ্বিধা নেই যে, এসব দেশে মাদক তৈরি হচ্ছে আমাদের জন্যই। সম্প্রতি মায়ানমার সফরের অভিজ্ঞতা আমাকে বেশ ব্যথিত করেছে। বাংলাদেশ ঘেঁষা সীমান্তে মায়ানমারে অসংখ্য ইয়াবা কারখানা গড়ে উঠেছে। সেসব কারখানা কোটি কোটি পিস ইয়াবা তৈরি হচ্ছে। অবাক করা কথা, মায়ানমারের মানুষ, সেখানকার যুবসমাজ খুব একটা ইয়াবা আশক্ত নয়। কোন কোন এলাকায় তো ইয়াবা কি তা সেখানকার অধিবাসীরা জানেনই না। মূলত বাংলাদেশিদের জন্যই সেখানে ইয়াবা কারখানা গড়ে উঠেছে। যতদুর জানতে পারি, তাতে নাকি এ ব্যাপারে সে দেশের সরকারের মৌন সম্মতিও আছে। মিয়ানমার সীমান্তে ইয়াবা কারখানার কথা আমরা জানি, আমাদের সরকারও জানে, কিন্তু ইয়াবা চোরাচালান রোধ হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না?

মাদক তথা ইয়াবা ব্যবসা নির্বিঘ্নে হচ্ছে তা বলছি না। মাদক কারবারিরা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হচ্ছে, ধরাও পরছে মাঝেসাজে। যেদিন এ লিখাটি লিখছি সেদিনও সারা দেশে ১ লাখ পিস ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে এসময় কাউকে আটক করতে পারেনি। ১ লাখ পিস ইয়াবা সে কি সহজ কথা? ১ দেড় লাখ লোক আসক্ত হতে পারবে এ ইয়াবায়। দামওতো কম নয়। বাজার মূল্যে কম করে ৫ কোটি টাকা। এত টাকার মাদক ধরা পরলো আর কাউকে গ্রেওফতার করা গেলো না এটা প্রশ্ন সমানে আসে বৈকি! এইতো হচ্ছে বেশিরভাগ সময়। যারা মাঝেমধ্যে ধরা পরে তারা কেবল চুনোপুঁটি। আবার ওদের গডফাদারদের বদান্নতায় ওরা সহসাই ছাড়া পেয়ে যায়। দেশের প্রতিটি সীমান্তেই এমন হচ্ছে। ভারতের সীমান্তও অসংখ্য ফেনসিডিলের কারখানা আছে। সেখানেও এই একই অবস্থা। পাশ্ববর্তী দেশ গুলো আমাদেরও দেশে মাদকের বাজার তৈরি করে নিয়েছে। এজন্যই হয়তো দেশ মাদকে সয়লাব হচ্ছে। মাদক ব্যবসার সাথে দেশের অনেক রাঘববোয়াল জড়িত। তাই ওদের টিকিটিও ছোঁয় না কেউ। তাই যা হবার তাই হচ্ছে দেশে। আমরা দেশবাসী দুরভাগা বলেই আমাদের যুবসমাজ সহজে মাদক হাতের নাগালে পাচ্ছে। এ সংক্রান্ত আইনের তেমন শাসন সক্রিয় নয় বলে আমাদের সন্তানরা দিনদিন অধপতনে নিপাতিত হচ্ছে।

দেশ থেকে কেন মাদক নিয়ন্ত্রণ হয় না? যারা মাদক নিয়ন্ত্রণ করবেন কি করছেন তারা? মাদক পাচার, ব্যবসা ও ব্যবহারকারীর ক্রমপ্রসার রোধকল্পে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে নানারকম কার্যক্রম দেখা গেলেও তেমন কোনো ইতিবাচক ফল মিলছে না। মাদক শুধু একজন ব্যক্তি কিংবা একটি পরিবারের জন্যই অভিশাপ বয়ে আনে না, দেশ-জাতির জন্যও ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনছে। নানারকম প্রাণঘাতী রোগব্যাধি বিস্তারের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও খারাপ করে তুলছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় দেশের অভ্যন্তরে মাদকের বিকিকিনি এবং বিভিন্ন সীমান্তপথে দেশের অভ্যন্তরে মাদকের অনুপ্রবেশ নিয়ে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও দীর্ঘদিনের। এবার প্রত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে মাদক ব্যবসার অত্যন্ত নিরাপদ স্থানগুলোর একটি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। কারারক্ষীদের সতর্ক পাহারা থাকতেও যদি কারাগারে মাদক ঢুকতে পারে তাহলে সারাদেশের অবস্থা যে কী তা সহজেই অনুমান করা যায়। দেশের প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় মাদকদ্রব্য বিকিকিনির বিষয়টি এ দেশে বলতে গেলে ওপেন সিক্রেট। বিভিন্ন সময়ে পুলিশি অভিযানে মাদকদ্রব্য আটক ও এর সঙ্গে জড়িতদের আটকের কথা শোনা গেলেও মাদক ব্যবসার নেপথ্যে থাকা গডফাদারদের আটক করা হয়েছে কিংবা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে এমন কথা শোনা যায় না। ফলে মাদকবিরোধী নানা অভিযানের কিছুদিন যেতে না যেতেই আবারো নতুন করে মাদক ব্যবসার প্রসার ঘটে। মাদক ব্যবসায়ীদের প্রধান টার্গেট হচ্ছে তরুণ সমাজ। দেশের তরুণ সমাজ মাদকের ভয়াবহ প্রভাবে বিপথগামী হচ্ছে। মাদকের নীল ছোবলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আমাদের আগামী প্রজন্ম। যা একটি দেশের ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ দুঃসংবাদ বই নয়। সত্য যে, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার প্রকট রূপের পেছনে মাদক অন্যতম বড় একটি উপসর্গ হয়ে দেখা দিয়েছে। এর মতো উদ্বেগজনক ঘটনা আর কী হতে পারে?

মাদক সেবনের ফুফল সম্পর্কে মহাসমারোহে আলোচনা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়। বিভিন্ন এনজিও মাদক সেবন নিরুৎসাহিত করতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। মাদক পাচার, বহন ও ব্যবহারের বিভিন্ন শাস্তি রয়েছে। তবু মাদক ব্যবহার কমেনি। ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইন, ইয়াবা, প্যাথেডিনের ব্যবসা রমরমা। নারী, পুরুষ উভয় শ্রেণীর মধ্যে মাদক সেবন প্রবণতা বাড়ছে। ডিশ এন্টেনার যুগে বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন এদেশের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীকে সমকামী, নেশাগ্রস্ত ও পশুপাখি সহযোগে বাস করার মানসিকতা তৈরি করছে। ঘুমের ওষুধ, হেরোইন, গাঁজা, এমনকি কুকুর মারার ইনজেকশন সেবন করছে মাদকসেবীরা। বিষ শরীরে ঢুকিয়ে নেশা করার মতো অভ্যাস গড়ে উঠছে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। এ ব্যাপারে প্রশাসন নির্বিকার। কাজের কাজ কিছুই করে না। আর করবেই বা কেন? মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন জানে এসব। জানে কোথায় মাদকদ্রব্য বিক্রি হয়, কোথা থেকে আসে এসব আর কারাই বা বিক্রি করে এর সবই তাদের নখদর্পণে। যদিও এসব ধরার দায়িত্ব তাদের। সময়মতো মাসোহারা পেলেই তারা তুষ্ট। নিজেদের উদর পূর্তি হলেই হলো। এ ব্যাপারে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের বক্তব্য- কোথায় মদ? কোথায় ফেনসিডিল? কোথায় অস্ত্র? কোথায় হেরোইন? যেন কিছুই জানেন না তারা। আর জানবেনই বা কেন? নগদ পেলেতো সবার মুখেই কুলুপ এঁটে থাকে; তখন চোখ হয় অন্ধ। আর এ সুযোগে নেশার রাজ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে গোটা উপজেলার যুবসমাজ। এগুলোকে ঘিরে পারিবারিক ও সামাজিক শান্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঘটছে সহিংস ঘটনা। বেড়েছে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি। তবে মাদক বিক্রেতাদের যে পুলিশ একেবারেই ধরছে না তা নয়। মাঝে মধ্যে মাদকসহ ২-৪ জনকে গ্রেফতার করা হলেও মাদক বিক্রেতারা আইনের ফাঁকফোকরে আবারও জেল থেকে বেরিয়ে এসে পুনরায় ব্যবসা পরিচালনা করছে।

আমাদের বর্তমান সমাজ জীবনে মাদকের ব্যবহার সবাইকেই উদ্বিগ্ন করেছে। এর বিষাক্ত ছোবল অকালে কেড়ে নিচ্ছে অনেক প্রাণ। অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণী হচ্ছে বিপথগামী। এ থেকে পরিত্রাণের আশায় ১৯৯০ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন (১৯৯০ সালের ২০নং আইন) প্রণীত হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনকল্পে ওই আইন ১৯৯০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি প্রণয়ন করা হয়। ওই আইনের ২(ঠ) ধারায় মাদকের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। সে মতে মূলত অপিয়াম পপি বা তৎনিঃসৃত আঠালো পদার্থ; আফিম; আফিম থেকে উদ্ভূত মরফিন, কোডিন, হেরোইন ইত্যাদি এবং এদের ক্ষারগুলো; শতকরা ০.২% এর অধিক মরফিনযুক্ত যে কোনো পদার্থ, কৃত্রিম উপায়ে তৈরি আফিমের সমধর্মী দ্রব্য যথাথ পেথিডিন, হাইড্রোমরফিন, ডিমেরাল, বেটাপ্রোডাইন ইত্যাদি, কোকা পাতা এবং তা থেকে উদ্ভূত সব দ্রব্য, কোকেন এবং ০.১% এর অধিক কোকেনযুক্ত যে কোনো পদার্থ অথবা কোকেনের যে কোনো ক্ষার, চরস, হাশিশ, গাঁজাগাছ, গাঁজা, ভাংগাছ, ভাং, গাঁজা বা ভাং সহযোগে প্রস্তুত যে কোনো পদার্থ, এলকোহল এবং ০.৫%-এর অধিক এলকোহলযুক্ত যেকোনো পদার্থ, রেক্টিফাইড স্পিরিট এবং তৎসহযোগে যে কোনো ওষুধ বা তরল পদার্থ, বিয়ার, বারবিচুয়েটস, তাড়ি, পচুই, মেথিলেটেড স্পিরিট ইত্যাদি দ্রব্য মাদক হিসেবে পরিচিত। ভারতে তৈরি ফেনসিডিল সিরাপ আমাদের দেশে মাদক হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এ সিরাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আফিম থেকে উদ্ভূত কোডিন, এই কারণেই ফেনসিডিল সিরাপ সেবন করলে মাদকতা আসে। তাই ফেনসিডিল সিরাপ মাদক হিসেবে পরিচিত। এলকোহল ব্যতীত অন্য কোনো মাদকদ্রব্যের চাষাবাদ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বহন, পরিবহন, আমদানি-রফতানি, সরবরাহ, ক্রয়, বিক্রয়, ধারণ, সংরক্ষণ, গুদামজাতকরণ, প্রদর্শন, প্রয়োগ ও ব্যবহার ওই আইনের ৯ ধারায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর নবম দশকে (১৯৮১ থেকে ১৯৯০ সাল) বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে মাদকের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় বিদেশ থেকে আসা মাদক সম্পর্কিত অপরাধের বিচার করা হতো ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন অনুসারে। সেখানে শুধু শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চোরাপথে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য দেশে নিয়ে আসা বা নিজ হেফাজতে রাখার অপরাধেই আসামির বিচার হতো। জনজীবনে ব্যাপক ক্ষতি সাধনকারী এই মাদকসংক্রান্ত অপরাধ দমনের জন্য ওই আইন পর্যাপ্ত ছিল না। তাই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনকল্পে ১৯৯০ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা হয়। ১৩৯৬ বঙ্গাব্দের ১৯ পৌষ মোতাবেক ১৯৯০ সালের ২ জানুয়ারি তারিখ থেকে এ আইন কার্যকর হয়। কিন্তু কুড়ি বছরেরও অধিককাল পথপরিক্রমায় মাদকদ্রব্য ব্যাপকভাবে নিযন্ত্রিত হয়নি। এর ব্যবহার এবং প্রসার বেড়েই চলেছে। অভিভাবকরা আজ চিন্তিত তাদের সন্তানদের মাদকাসক্তি নিয়ে। মাদকের হিংস্র ছোবল থেকে সারা জাতি চায় আত্মরক্ষা করতে। আইনের কার্যকর প্রয়োগ হয়নি বলেই আজ মাদক নিয়ে এতো সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। বেড়েছে উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ।

দেশে মাদক যেন মুড়ি-মুড়কির মতো বিকিকিনি হচ্ছে। পত্রিকার সূত্রমতে, দেশে বছরে ২৫ হাজার কোটি টাকার মাদক কেনাবেচা হয়। মাদক গ্রহণকারীর সংখ্যা কত তার সঠিক পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই। সরকার বলছে, ৫০ লাখ, কিন্তু বেসরকারি সূত্রমতে, ৭০ লাখেরও বেশি। এদের অধিকাংশই যুবক-যুবতী ও তরুণ-তরুণী। মাদক গ্রহণকারীর ৮০ ভাগের বয়স ১৫ থেকে ৩৫ বছর। বিশ্বের নেশাগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭ম। এর ভয়াল থাবা বিস্তৃত হয়েছে শহর হতে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত। বিভিন্ন মাদকের মরণ নেশায় প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে ৮-১০ বছরের শিশু হতে শুরু করে নারী এমনকি বৃদ্ধরাও। ২০০২ সালে দেশে মাদক অপরাধীর সংখ্যা ছিল ৬ শতাংশ। বর্তমানে তা ৪০ শতাংশের বেশি। এর ব্যবসা জমে ওঠেছে দেশে। মায়ানমার, থাইল্যান্ড ও লাওস নিয়ে গঠিত গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল, ভারত, নেপাল ও তিব্বতের সীমান্তবর্তী অঞ্চল নিয়ে গোল্ডেন ওয়েজ এবং পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরানের সীমান্তবর্তী অঞ্চল নিয়ে গোল্ডেন ক্রিসেন্ট বাংলাদেশকে ঘিরে ফেলেছে। ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম মাদক উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের থাবার মধ্যে অবস্থান করছে। বাংলাদেশকে ঘিরে প্রতিবেশী দেশের সীমান্তে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার ফেনসিডিলের কারখানা। সংঘবদ্ধ চক্র মায়ানমার হতে কক্সবাজার দিয়ে সারাদেশে সুকৌশলে ছড়িয়ে দিচ্ছে ইয়াবা। নতুন নেশা ইয়াবার ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছে তরুণ সমাজ। বিশেষ করে স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়গামী ছেলেমেয়েরা। ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবার কোনটি দেশে উৎপাদিত না হলেও তা পাওয়া যাচ্ছে যত্রতত্র। সামাজিক সমস্যা ছাপিয়ে এটি যেন গত দু’দশকে পারিবারিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। প্রায়ই চোখে পড়ে মাদকের করাল গ্রাস থেকে ফেরাতে না পেরে পরিবারের শান্তি রক্ষায় বাবা-মা তার সন্তানকে, সন্তান বাবাকে পুলিশে সোপর্দ করছেন। মাদকাসক্ত সন্তানের হাতে পিতা-মাতা খুন-জখমের ঘটনা অহরহ ঘটতে শুরু করেছে। সন্তানের নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত বাবা-মা ও সমাজের দৃষ্টি রাখা দরকার।

আশির দশকে বাংলাদেশে মাদকের বিস্তার শুরু হয় মর্মে বিভিন্ন তথ্য মেলে। এ সময় লুকিয়ে-চুরিয়ে, প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে মাদক বিক্রি করা হতো। মাদক বিক্রি এখন আর অতটা গোপনে নেই বলেই প্রতীয়মান হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে জানা যায়, রাজধানীতে ডিজে পার্টির নামে বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় মাদকের রমরমা আসর বসে। এখানে সাধারণত ধনী পরিবারের তরুণ-তরুণীদের যাতায়াত। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গামী তরুণ-তরুণীরাই মূলত মাদকের নেশায় বুঁদ। মাদক এখন আর অলিতে-গলিতে নয়, এর বিস্তার ঘটেছে ভদ্র সমাজে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও মাদকের ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে বলে এর আগে উল্লেখ করেছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব। আর এবার খোদ কারাবেষ্টনীতে মাদকের নিরাপদ বিস্তারের কথা জানা গেল। এ ঘটনাকে শর্ষের মধ্যে ভূত বলেই অভিহিত করা যায়। মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসন শুধু নগর-মহানগরেই সীমাবদ্ধ নেই, গ্রামবাংলা পর্যন্ত মাদক এখন সহজলভ্য। হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় মাদক। তবে মাঝেমধ্যে মাদকদ্রব্য বহনের দায়ে কেউ কেউ ধরা পড়লেও মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকে। দৃশ্যের আড়ালে এই যে অদৃশ্য মহাশক্তিধর চক্রটির জন্যই মাদকের ক্রমবিস্তার রোধ হয়ে উঠেছে অসম্ভব।

সুতরাং আমরা মনে করি মাদক সংশ্লিষ্ট চুনোপুঁটি থেকে রাঘববোয়াল পর্যন্ত প্রত্যেকের ব্যাপারেই আইন প্রয়োগে কঠোরতা দেখাতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগই মাদকের ভয়াবহ বিস্তার রোধে সহায়ক হতে পারে। মাদক আমাদের সমাজকে কিভাবে কুরে কুরে খাচ্ছে তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এ সমস্যা সমাজ ও রাষ্ট্রের। দেশের উদীয়মান শ্রেণী যদি সমাজ বৈশিষ্ট্যের বিরূপতার শিকার হয় তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। দেশকে রক্ষা করতে হলে সংশ্লিষ্টদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। পরিস্থিতি উত্তরণে মাদকাসক্তি, যৌনাচার এবং পর্নোগ্রাফি প্রতিরোধে সুচিন্তিত ও সমন্বিত কর্মপন্থা গ্রহণ করা দরকার। একটি প্রজন্ম ধ্বংস হওয়ার আগে আমাদের সবার দায়িত্ব হবে দেশ থেকে মাদক নির্মূল করা। এজন্য দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি সবাই যে যার জায়গা থেকে মাদকের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। হুঙ্কার দিতে হবে দেশ থেকে মাদক নির্মূল করার। আমরা বিশ্বাস করি রাষ্ট্রের কাছে মাদক সিন্ডিকেট মোটেও শক্তিশালী নয়। রাষ্ট্র চাইলে দেশের মাদক প্রসারতা কমবে। আর রাষ্ট্র তা সহসাই করবে- এ প্রত্যাশা রইল।

[লেখক : কলামিস্ট]

বুধবার, ২২ জানুয়ারী ২০২০ , ৮ মাঘ ১৪২৬, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

ক্রসফায়ারে নাশ : বাকিতে চাঙ্গা মাদক!

মীর আব্দুল আলীম

মাদক নিয়ে সরকার বেশ সোচ্চার। ধরপাকড় হচ্ছে; ক্রশফায়ার হচ্ছে। ক্রসফায়ারে মাদককারবারি নাশ (শেষ) হলেও, বাকির মাদকে দেশ এখন চাঙ্গা বেশ। বছরখানেক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ অভিযানের কারণে বিপাকে পড়েন দেশি এবং আন্তর্জাতিক মাদককারবারিরা। কিছুটা হলেও ‘ব্যবসায়’ ধস নামে। ফলে বাজার চাঙা রাখতে বাকিতে ইয়াবা আর ফেনসিডিল বিক্রি শুরু করেছেন মায়ানমার আর ভারতের মাদক কারবারিরা। দেশের খুচরা বাজারেও এখন ‘মাল বেচে দাম দাও’ এই নীতিতে ব্যবসা চলছে বেশ জোরেসোরে। আগে নগদে; এমনকি অগ্রিম অর্থে মায়ানমারে উৎপাদিত ইয়াবা আর ভারতের ফেনসিডিল আনতো আমাদের মাদক কারবারি চক্র। খুচরা বাজারে বিক্রিও হতো নগদেই। বাংলাদেশে মাদক ব্যবসার ঝুঁকি বাড়ায় ব্যবসায়ীদের লোভ দেখিয়ে আন্তর্জাতিক ইয়াবা আর ফেনসিডিল চক্র দেশে বাকিতে ঠিকই মাদক পাচার করে চলেছে। এমন সংবাদ আমাদের জাতীয় দৈনিকগুলো কয়েকদিন ধরে ফলাও করে প্রচার করছে।

আমরা জানি যে, মায়ানমার ইয়াবা তৈরি করে আর ভারত ফেন্সিডিল। তাদের উৎপাদিত ইয়াবা আর ফেনসিডিল সেবন করছে বাংলাদেশের মানুষ। এসব মাদক বেঁচে প্রতি দিন আমাদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ভারত, মিয়ানমার। আর তাতে আমাদের যুবসমাজ ইয়াবা আসক্ত হয়ে ধ্বংসে নিপাতিত হচ্ছে। কি করছি আমরা? আমাদের সরকারও কি করতে পারছে? শত শত মাদক বিক্রেতাকে ইতোমধ্যে ক্রসফায়ার দেয়া হয়েছে। তাতেও কি মাদক কেনাবেঁচা বন্ধ হয়েছে? না; পুরোদমেই চলছে মাদক ব্যবসা। সেবনকারীর কমেনি, কমেনি বিক্রেতাও। একজন ক্রসফায়ারে মরলে গডফাদাররা সঙ্গে সঙ্গে ২-৪ জন চুনোপুঁটি বিক্রেতাওয়ালার জন্ম দেয়। তাই মাদক ব্যবসা না কমে বাড়ে বৈকি! এাদক নিয়ন্ত্রণে দরকার আইনের সঠিক প্রয়োগ। সরকার কিন্তু মাদক নিয়ন্ত্রণ ঠিকই করতে চায়। মাদকের ব্যাপারে সরকারের সম্মতি নেই মোটেও, তবে সরকার সংশ্লিষ্ট কর্তাবাবুদের ম্যানেজ হয়ে যাবার কারনেই মাদকের প্রসারতা প্রতিদিন বাড়ছে। এদের কারণেই মাদক ব্যবসায়ীরা দেশে মাদকে সয়লাব করে দিতে পারছে।

বাংলাদেশে ইয়াবা আর ফেনসিডিলের বাজার তৈরি হওয়ায় মায়ানমার এবং ভারত সীমান্তে অসংখ্য ইয়াবা আর ফেনসিডিলেরর কারখানা গড়ে উঠছে। এসব কারখানায় বাংলাদেশের যুবসমাজের জন্য মায়ানমার মরণ নেশা ইয়াবা এবং ভারত থেকে ফেনসিডিল উৎপাদন করে তা নির্বিঘ্নে সর্বরাহ করা হচ্ছে। বলতে দ্বিধা নেই যে, এসব দেশে মাদক তৈরি হচ্ছে আমাদের জন্যই। সম্প্রতি মায়ানমার সফরের অভিজ্ঞতা আমাকে বেশ ব্যথিত করেছে। বাংলাদেশ ঘেঁষা সীমান্তে মায়ানমারে অসংখ্য ইয়াবা কারখানা গড়ে উঠেছে। সেসব কারখানা কোটি কোটি পিস ইয়াবা তৈরি হচ্ছে। অবাক করা কথা, মায়ানমারের মানুষ, সেখানকার যুবসমাজ খুব একটা ইয়াবা আশক্ত নয়। কোন কোন এলাকায় তো ইয়াবা কি তা সেখানকার অধিবাসীরা জানেনই না। মূলত বাংলাদেশিদের জন্যই সেখানে ইয়াবা কারখানা গড়ে উঠেছে। যতদুর জানতে পারি, তাতে নাকি এ ব্যাপারে সে দেশের সরকারের মৌন সম্মতিও আছে। মিয়ানমার সীমান্তে ইয়াবা কারখানার কথা আমরা জানি, আমাদের সরকারও জানে, কিন্তু ইয়াবা চোরাচালান রোধ হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না?

মাদক তথা ইয়াবা ব্যবসা নির্বিঘ্নে হচ্ছে তা বলছি না। মাদক কারবারিরা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হচ্ছে, ধরাও পরছে মাঝেসাজে। যেদিন এ লিখাটি লিখছি সেদিনও সারা দেশে ১ লাখ পিস ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে এসময় কাউকে আটক করতে পারেনি। ১ লাখ পিস ইয়াবা সে কি সহজ কথা? ১ দেড় লাখ লোক আসক্ত হতে পারবে এ ইয়াবায়। দামওতো কম নয়। বাজার মূল্যে কম করে ৫ কোটি টাকা। এত টাকার মাদক ধরা পরলো আর কাউকে গ্রেওফতার করা গেলো না এটা প্রশ্ন সমানে আসে বৈকি! এইতো হচ্ছে বেশিরভাগ সময়। যারা মাঝেমধ্যে ধরা পরে তারা কেবল চুনোপুঁটি। আবার ওদের গডফাদারদের বদান্নতায় ওরা সহসাই ছাড়া পেয়ে যায়। দেশের প্রতিটি সীমান্তেই এমন হচ্ছে। ভারতের সীমান্তও অসংখ্য ফেনসিডিলের কারখানা আছে। সেখানেও এই একই অবস্থা। পাশ্ববর্তী দেশ গুলো আমাদেরও দেশে মাদকের বাজার তৈরি করে নিয়েছে। এজন্যই হয়তো দেশ মাদকে সয়লাব হচ্ছে। মাদক ব্যবসার সাথে দেশের অনেক রাঘববোয়াল জড়িত। তাই ওদের টিকিটিও ছোঁয় না কেউ। তাই যা হবার তাই হচ্ছে দেশে। আমরা দেশবাসী দুরভাগা বলেই আমাদের যুবসমাজ সহজে মাদক হাতের নাগালে পাচ্ছে। এ সংক্রান্ত আইনের তেমন শাসন সক্রিয় নয় বলে আমাদের সন্তানরা দিনদিন অধপতনে নিপাতিত হচ্ছে।

দেশ থেকে কেন মাদক নিয়ন্ত্রণ হয় না? যারা মাদক নিয়ন্ত্রণ করবেন কি করছেন তারা? মাদক পাচার, ব্যবসা ও ব্যবহারকারীর ক্রমপ্রসার রোধকল্পে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে নানারকম কার্যক্রম দেখা গেলেও তেমন কোনো ইতিবাচক ফল মিলছে না। মাদক শুধু একজন ব্যক্তি কিংবা একটি পরিবারের জন্যই অভিশাপ বয়ে আনে না, দেশ-জাতির জন্যও ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনছে। নানারকম প্রাণঘাতী রোগব্যাধি বিস্তারের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও খারাপ করে তুলছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় দেশের অভ্যন্তরে মাদকের বিকিকিনি এবং বিভিন্ন সীমান্তপথে দেশের অভ্যন্তরে মাদকের অনুপ্রবেশ নিয়ে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও দীর্ঘদিনের। এবার প্রত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে মাদক ব্যবসার অত্যন্ত নিরাপদ স্থানগুলোর একটি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। কারারক্ষীদের সতর্ক পাহারা থাকতেও যদি কারাগারে মাদক ঢুকতে পারে তাহলে সারাদেশের অবস্থা যে কী তা সহজেই অনুমান করা যায়। দেশের প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় মাদকদ্রব্য বিকিকিনির বিষয়টি এ দেশে বলতে গেলে ওপেন সিক্রেট। বিভিন্ন সময়ে পুলিশি অভিযানে মাদকদ্রব্য আটক ও এর সঙ্গে জড়িতদের আটকের কথা শোনা গেলেও মাদক ব্যবসার নেপথ্যে থাকা গডফাদারদের আটক করা হয়েছে কিংবা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে এমন কথা শোনা যায় না। ফলে মাদকবিরোধী নানা অভিযানের কিছুদিন যেতে না যেতেই আবারো নতুন করে মাদক ব্যবসার প্রসার ঘটে। মাদক ব্যবসায়ীদের প্রধান টার্গেট হচ্ছে তরুণ সমাজ। দেশের তরুণ সমাজ মাদকের ভয়াবহ প্রভাবে বিপথগামী হচ্ছে। মাদকের নীল ছোবলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আমাদের আগামী প্রজন্ম। যা একটি দেশের ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ দুঃসংবাদ বই নয়। সত্য যে, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার প্রকট রূপের পেছনে মাদক অন্যতম বড় একটি উপসর্গ হয়ে দেখা দিয়েছে। এর মতো উদ্বেগজনক ঘটনা আর কী হতে পারে?

মাদক সেবনের ফুফল সম্পর্কে মহাসমারোহে আলোচনা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়। বিভিন্ন এনজিও মাদক সেবন নিরুৎসাহিত করতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। মাদক পাচার, বহন ও ব্যবহারের বিভিন্ন শাস্তি রয়েছে। তবু মাদক ব্যবহার কমেনি। ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইন, ইয়াবা, প্যাথেডিনের ব্যবসা রমরমা। নারী, পুরুষ উভয় শ্রেণীর মধ্যে মাদক সেবন প্রবণতা বাড়ছে। ডিশ এন্টেনার যুগে বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন এদেশের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীকে সমকামী, নেশাগ্রস্ত ও পশুপাখি সহযোগে বাস করার মানসিকতা তৈরি করছে। ঘুমের ওষুধ, হেরোইন, গাঁজা, এমনকি কুকুর মারার ইনজেকশন সেবন করছে মাদকসেবীরা। বিষ শরীরে ঢুকিয়ে নেশা করার মতো অভ্যাস গড়ে উঠছে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। এ ব্যাপারে প্রশাসন নির্বিকার। কাজের কাজ কিছুই করে না। আর করবেই বা কেন? মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন জানে এসব। জানে কোথায় মাদকদ্রব্য বিক্রি হয়, কোথা থেকে আসে এসব আর কারাই বা বিক্রি করে এর সবই তাদের নখদর্পণে। যদিও এসব ধরার দায়িত্ব তাদের। সময়মতো মাসোহারা পেলেই তারা তুষ্ট। নিজেদের উদর পূর্তি হলেই হলো। এ ব্যাপারে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের বক্তব্য- কোথায় মদ? কোথায় ফেনসিডিল? কোথায় অস্ত্র? কোথায় হেরোইন? যেন কিছুই জানেন না তারা। আর জানবেনই বা কেন? নগদ পেলেতো সবার মুখেই কুলুপ এঁটে থাকে; তখন চোখ হয় অন্ধ। আর এ সুযোগে নেশার রাজ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে গোটা উপজেলার যুবসমাজ। এগুলোকে ঘিরে পারিবারিক ও সামাজিক শান্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঘটছে সহিংস ঘটনা। বেড়েছে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি। তবে মাদক বিক্রেতাদের যে পুলিশ একেবারেই ধরছে না তা নয়। মাঝে মধ্যে মাদকসহ ২-৪ জনকে গ্রেফতার করা হলেও মাদক বিক্রেতারা আইনের ফাঁকফোকরে আবারও জেল থেকে বেরিয়ে এসে পুনরায় ব্যবসা পরিচালনা করছে।

আমাদের বর্তমান সমাজ জীবনে মাদকের ব্যবহার সবাইকেই উদ্বিগ্ন করেছে। এর বিষাক্ত ছোবল অকালে কেড়ে নিচ্ছে অনেক প্রাণ। অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণী হচ্ছে বিপথগামী। এ থেকে পরিত্রাণের আশায় ১৯৯০ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন (১৯৯০ সালের ২০নং আইন) প্রণীত হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনকল্পে ওই আইন ১৯৯০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি প্রণয়ন করা হয়। ওই আইনের ২(ঠ) ধারায় মাদকের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। সে মতে মূলত অপিয়াম পপি বা তৎনিঃসৃত আঠালো পদার্থ; আফিম; আফিম থেকে উদ্ভূত মরফিন, কোডিন, হেরোইন ইত্যাদি এবং এদের ক্ষারগুলো; শতকরা ০.২% এর অধিক মরফিনযুক্ত যে কোনো পদার্থ, কৃত্রিম উপায়ে তৈরি আফিমের সমধর্মী দ্রব্য যথাথ পেথিডিন, হাইড্রোমরফিন, ডিমেরাল, বেটাপ্রোডাইন ইত্যাদি, কোকা পাতা এবং তা থেকে উদ্ভূত সব দ্রব্য, কোকেন এবং ০.১% এর অধিক কোকেনযুক্ত যে কোনো পদার্থ অথবা কোকেনের যে কোনো ক্ষার, চরস, হাশিশ, গাঁজাগাছ, গাঁজা, ভাংগাছ, ভাং, গাঁজা বা ভাং সহযোগে প্রস্তুত যে কোনো পদার্থ, এলকোহল এবং ০.৫%-এর অধিক এলকোহলযুক্ত যেকোনো পদার্থ, রেক্টিফাইড স্পিরিট এবং তৎসহযোগে যে কোনো ওষুধ বা তরল পদার্থ, বিয়ার, বারবিচুয়েটস, তাড়ি, পচুই, মেথিলেটেড স্পিরিট ইত্যাদি দ্রব্য মাদক হিসেবে পরিচিত। ভারতে তৈরি ফেনসিডিল সিরাপ আমাদের দেশে মাদক হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এ সিরাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আফিম থেকে উদ্ভূত কোডিন, এই কারণেই ফেনসিডিল সিরাপ সেবন করলে মাদকতা আসে। তাই ফেনসিডিল সিরাপ মাদক হিসেবে পরিচিত। এলকোহল ব্যতীত অন্য কোনো মাদকদ্রব্যের চাষাবাদ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বহন, পরিবহন, আমদানি-রফতানি, সরবরাহ, ক্রয়, বিক্রয়, ধারণ, সংরক্ষণ, গুদামজাতকরণ, প্রদর্শন, প্রয়োগ ও ব্যবহার ওই আইনের ৯ ধারায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর নবম দশকে (১৯৮১ থেকে ১৯৯০ সাল) বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে মাদকের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় বিদেশ থেকে আসা মাদক সম্পর্কিত অপরাধের বিচার করা হতো ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন অনুসারে। সেখানে শুধু শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চোরাপথে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য দেশে নিয়ে আসা বা নিজ হেফাজতে রাখার অপরাধেই আসামির বিচার হতো। জনজীবনে ব্যাপক ক্ষতি সাধনকারী এই মাদকসংক্রান্ত অপরাধ দমনের জন্য ওই আইন পর্যাপ্ত ছিল না। তাই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনকল্পে ১৯৯০ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা হয়। ১৩৯৬ বঙ্গাব্দের ১৯ পৌষ মোতাবেক ১৯৯০ সালের ২ জানুয়ারি তারিখ থেকে এ আইন কার্যকর হয়। কিন্তু কুড়ি বছরেরও অধিককাল পথপরিক্রমায় মাদকদ্রব্য ব্যাপকভাবে নিযন্ত্রিত হয়নি। এর ব্যবহার এবং প্রসার বেড়েই চলেছে। অভিভাবকরা আজ চিন্তিত তাদের সন্তানদের মাদকাসক্তি নিয়ে। মাদকের হিংস্র ছোবল থেকে সারা জাতি চায় আত্মরক্ষা করতে। আইনের কার্যকর প্রয়োগ হয়নি বলেই আজ মাদক নিয়ে এতো সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। বেড়েছে উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ।

দেশে মাদক যেন মুড়ি-মুড়কির মতো বিকিকিনি হচ্ছে। পত্রিকার সূত্রমতে, দেশে বছরে ২৫ হাজার কোটি টাকার মাদক কেনাবেচা হয়। মাদক গ্রহণকারীর সংখ্যা কত তার সঠিক পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই। সরকার বলছে, ৫০ লাখ, কিন্তু বেসরকারি সূত্রমতে, ৭০ লাখেরও বেশি। এদের অধিকাংশই যুবক-যুবতী ও তরুণ-তরুণী। মাদক গ্রহণকারীর ৮০ ভাগের বয়স ১৫ থেকে ৩৫ বছর। বিশ্বের নেশাগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭ম। এর ভয়াল থাবা বিস্তৃত হয়েছে শহর হতে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত। বিভিন্ন মাদকের মরণ নেশায় প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে ৮-১০ বছরের শিশু হতে শুরু করে নারী এমনকি বৃদ্ধরাও। ২০০২ সালে দেশে মাদক অপরাধীর সংখ্যা ছিল ৬ শতাংশ। বর্তমানে তা ৪০ শতাংশের বেশি। এর ব্যবসা জমে ওঠেছে দেশে। মায়ানমার, থাইল্যান্ড ও লাওস নিয়ে গঠিত গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল, ভারত, নেপাল ও তিব্বতের সীমান্তবর্তী অঞ্চল নিয়ে গোল্ডেন ওয়েজ এবং পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরানের সীমান্তবর্তী অঞ্চল নিয়ে গোল্ডেন ক্রিসেন্ট বাংলাদেশকে ঘিরে ফেলেছে। ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম মাদক উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের থাবার মধ্যে অবস্থান করছে। বাংলাদেশকে ঘিরে প্রতিবেশী দেশের সীমান্তে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার ফেনসিডিলের কারখানা। সংঘবদ্ধ চক্র মায়ানমার হতে কক্সবাজার দিয়ে সারাদেশে সুকৌশলে ছড়িয়ে দিচ্ছে ইয়াবা। নতুন নেশা ইয়াবার ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছে তরুণ সমাজ। বিশেষ করে স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়গামী ছেলেমেয়েরা। ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবার কোনটি দেশে উৎপাদিত না হলেও তা পাওয়া যাচ্ছে যত্রতত্র। সামাজিক সমস্যা ছাপিয়ে এটি যেন গত দু’দশকে পারিবারিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। প্রায়ই চোখে পড়ে মাদকের করাল গ্রাস থেকে ফেরাতে না পেরে পরিবারের শান্তি রক্ষায় বাবা-মা তার সন্তানকে, সন্তান বাবাকে পুলিশে সোপর্দ করছেন। মাদকাসক্ত সন্তানের হাতে পিতা-মাতা খুন-জখমের ঘটনা অহরহ ঘটতে শুরু করেছে। সন্তানের নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত বাবা-মা ও সমাজের দৃষ্টি রাখা দরকার।

আশির দশকে বাংলাদেশে মাদকের বিস্তার শুরু হয় মর্মে বিভিন্ন তথ্য মেলে। এ সময় লুকিয়ে-চুরিয়ে, প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে মাদক বিক্রি করা হতো। মাদক বিক্রি এখন আর অতটা গোপনে নেই বলেই প্রতীয়মান হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে জানা যায়, রাজধানীতে ডিজে পার্টির নামে বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় মাদকের রমরমা আসর বসে। এখানে সাধারণত ধনী পরিবারের তরুণ-তরুণীদের যাতায়াত। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গামী তরুণ-তরুণীরাই মূলত মাদকের নেশায় বুঁদ। মাদক এখন আর অলিতে-গলিতে নয়, এর বিস্তার ঘটেছে ভদ্র সমাজে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও মাদকের ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে বলে এর আগে উল্লেখ করেছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব। আর এবার খোদ কারাবেষ্টনীতে মাদকের নিরাপদ বিস্তারের কথা জানা গেল। এ ঘটনাকে শর্ষের মধ্যে ভূত বলেই অভিহিত করা যায়। মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসন শুধু নগর-মহানগরেই সীমাবদ্ধ নেই, গ্রামবাংলা পর্যন্ত মাদক এখন সহজলভ্য। হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় মাদক। তবে মাঝেমধ্যে মাদকদ্রব্য বহনের দায়ে কেউ কেউ ধরা পড়লেও মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকে। দৃশ্যের আড়ালে এই যে অদৃশ্য মহাশক্তিধর চক্রটির জন্যই মাদকের ক্রমবিস্তার রোধ হয়ে উঠেছে অসম্ভব।

সুতরাং আমরা মনে করি মাদক সংশ্লিষ্ট চুনোপুঁটি থেকে রাঘববোয়াল পর্যন্ত প্রত্যেকের ব্যাপারেই আইন প্রয়োগে কঠোরতা দেখাতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগই মাদকের ভয়াবহ বিস্তার রোধে সহায়ক হতে পারে। মাদক আমাদের সমাজকে কিভাবে কুরে কুরে খাচ্ছে তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এ সমস্যা সমাজ ও রাষ্ট্রের। দেশের উদীয়মান শ্রেণী যদি সমাজ বৈশিষ্ট্যের বিরূপতার শিকার হয় তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। দেশকে রক্ষা করতে হলে সংশ্লিষ্টদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। পরিস্থিতি উত্তরণে মাদকাসক্তি, যৌনাচার এবং পর্নোগ্রাফি প্রতিরোধে সুচিন্তিত ও সমন্বিত কর্মপন্থা গ্রহণ করা দরকার। একটি প্রজন্ম ধ্বংস হওয়ার আগে আমাদের সবার দায়িত্ব হবে দেশ থেকে মাদক নির্মূল করা। এজন্য দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি সবাই যে যার জায়গা থেকে মাদকের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। হুঙ্কার দিতে হবে দেশ থেকে মাদক নির্মূল করার। আমরা বিশ্বাস করি রাষ্ট্রের কাছে মাদক সিন্ডিকেট মোটেও শক্তিশালী নয়। রাষ্ট্র চাইলে দেশের মাদক প্রসারতা কমবে। আর রাষ্ট্র তা সহসাই করবে- এ প্রত্যাশা রইল।

[লেখক : কলামিস্ট]