হাজার কোটি টাকার ইউরিয়া সার লোপাট

সংশ্লিষ্ট রাঘব বোয়ালরা অধরা

বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) বাফার গোডাউনে ট্রানজিটের নামে লাখ লাখ মেট্রিক টন ইউরিয়া সার ঘাটতির রহস্য অবশেষে ফাঁস হতে চলেছে। বিসিআইসি বাফার গোডাউনের ইউরিয়ার ঘাটতি কাগজ-কলমে ট্রানজিট দেখালেও প্রকৃত অর্থে তা লোপাট করা হয়েছে।

ট্রানজিটের নামে কাফকো উৎপাদিত ও বিদেশ থেকে আমদানিকৃত সার চট্টগ্রাম এবং মোংলা পোর্ট থেকে ছাড় করে বাফার গোডাউনে না নিয়ে একটি সিন্ডিকেট রাস্তা থেকেই তা বিক্রি করে ভাগ-বণ্টন করে নিয়েছে। বিসিআইসির এ সার লোপাটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ কয়েকটি পরিবহন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জড়িত বলে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। শিল্পসংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বাফার গোডাউনের সার ঘাটতির ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করলেও ৩ বছরেও বিসিআইসি কোন পদক্ষেপ নেয়নি। অবশেষে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্তে নেমে সার লোপাটের রহস্য উন্মোচনসহ রাঘব বোয়ালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। দেশের খাদ্য উৎপাদনে প্রতিবছর বিসিআইসি কাফকোর উৎপাদিত সারসহ বিদেশ থেকে ইউরিয়া সার আমদানি করে কৃষকের চাহিদা পূরণ করে থাকে। কাফকো কারখানাসহ আমদানিকৃত ইউরিয়া চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর থেকে বিভিন্ন পরিবহনের মাধ্যমে সারা দেশের বাফার গোডাউনে সংরক্ষণের পর তালিকাভুক্ত ডিলারদের মাধ্যমে কৃষকদের সরবরাহ করা হয়।

বিসিআইসির নির্ধারিত কয়েকটি বেসরকারি পরিবহন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান (মেসার্স বাল্ক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, মালিক : আমিনুর রশিদ খান; ইউসুফ চেম্বার ৪র্থ তলা ২০ দিলখুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা), মেসার্স নবাব অ্যান্ড কোং (মালিক : নবাব খান ১০১/৫০ আগ্রাবাদ; চট্টগ্রাম), মেসার্স সাউথ ডেল্টা সিস্টেম অ্যান্ড ট্রেডিং লি. (মালিক : মশিউর রহমান খান, গ্লোব চেম্বার ১০৪ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা; ঢাকা) এবং মেসার্স পোটন ট্রেডার্স (মালিক : কামরুল খান, ৩০/৩১ বিসিআইসি ভবন, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা; ঢাকা); উক্ত সার বগুড়া, সান্তাহার, গাইবান্ধা, রংপুর, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, পার্বতীপুর, চরকাই, জয়পুরহাট, রাজশাহী, নাটোর, ঠাকুরগাঁও, বাঘাবাড়ী, যশোর, বরিশাল, ভোলা, টেকেররহাট, পটুয়াখালীসহ সারা দেশের বাফার গোডাউনে পৌঁছে দেয়। অভিযোগ উঠেছে বিসিআইসি’র কাফকো কারখানা ও বন্দর থেকে আমদানিকৃত এ ইউরিয়া সার বাফার গুদামে না নিয়ে রাস্তা থেকেই লোপাট করা হয়েছে। ২০০৭ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত হাজার কোটি টাকার ইউরিয়া লোপাটের ঘটনা ঘটেছে। আর এ লোপাটের সঙ্গে বিসিআইসির কতিপয় কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট পরিবহন ঠিকাদার সিন্ডিকেট জড়িত রয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ট্রানজিটের নামে লাখ লাখ মে. টন সার ঘাটতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে তদন্তসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিলেও বিসিআইসি ৩ বছর ধরে নীরব ভূমিকা পালন করে আসছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র অভিযোগ তুলেছেন। খোদ বিসিআইসির এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ইউরিয়া সার ঘাটতির উদ্বেগজনক তথ্য পাওয়া গেছে, ২০০৭ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত কাফকো ও বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ১ হাজার ৫১৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা মূল্যের ৩ লাখ ২৫ হাজার ৩২১ মেট্রিক টন ইউরিয়া সার স্টোর ইন ট্রানজিট দেখানো হলেও তার কোন হিসাব নেই। অডিট তথ্যে দেখা যায়, বিসিআইসি ৩০ জুলাই ২০০৭ সালে ৮৫১ মেট্রিক টন, ৩১ জুলাই ২০০৮ সালে ২৩ হাজার ৮৪২ মেট্রিক টন, ৩১ জুলাই ২০০৯ সালে ১২ হাজার ৩৮০ মেট্রিক টন, ৩০ জুলাই ২০১০ সালে ৩২ হাজার ৬০৯ মেট্রিক টন, ৩১ জুলাই ২২০১১ সালে ৭৬ হাজার ৬৮৯ মেট্রিক টন, ৩১ জুলাই ২০১২ সালে ৪১ হাজার ৭৩ মেট্রিক টন, ৩১ জুলাই ২০১৩ সালে ১ লাখ ৬ হাজার ৩২২ মেট্রিক টন, ৩১ জুলাই ২০১৪ সালে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৬৪৪ মেট্রিক টন, ৩০ জুন ২০১৫ সালে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন, ২৭ জানুয়ারি ২০১৬ সালে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৩২১ মেট্রিক টন ইউরিয়া সার ঘাটতি দেখা যায় যা ট্রানজিট হিসেবে দেখানো হয়েছে। সার ঘাটতির ঘটনায় সংসদীয় কমিটি তদন্তসহ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করলেও তা বিসিআইসি কর্তৃৃপক্ষ বছরের পর বছর শুধু সময়ক্ষেপণ করছে। গত ১ নভেম্বর ২০১৬ সালে ১০ম জাতীয় সংসদের শিল্প মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ১৪তম বৈঠকে দেশের বাফার গোডাউনের ইউরিয়া ঘাটতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়।

সংসদীয় কমিটির সভাপতি সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী ৭নং আলোচ্য সূচিতে জানান, বিসিআইসির হিসাবে যে সার ঘাটতি রয়েছে যা কাগজ-কলমে ট্রানজিট হিসেবে দেখানো হয়েছে তা প্রকৃতপক্ষে উক্ত সার নেই। বৈঠকে আলোচনা শেষে এ বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা ও দোষিদের আইনের আওতায় এনে ব্যবস্থা করার জন্য সুপারিশ করা হয়। বৈঠকে টাঙ্গাইল-১ এর সংসদ সদস্য মো. আবদুর রাজ্জাক (বর্তমান কৃষিমন্ত্রী), ঢাকা ৫ আসনের সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান মোল্লা, রংপুর ২ আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম মো. আহ্সানুল হক চৌধুরী, ফেনী-৩ আসনের সংসদ সদস্য রহিম উল্লাহ, মহিলা আসন ২১ সংসদ সদস্য বেগম ফাতেমা তুজ্জহুরাসহ শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব, বিসিআইসি চেয়ারম্যান, বিসিক চেয়ারম্যানসহ কমিটির সদস্যরা অংশ নেন। অন্যদিকে গত ১৭ ফেব্রয়ারি ২০১৬ সালে বিসিআইসির সহ-প্রধান নিরীক্ষক এএসএম আনওয়ার আল সাদাত বিসিআইসি/ বিপণন/ ২০০১- ২০১৫/০১স্মারক নং অডিট রিপোর্টে আরও উল্লেখ করেন-কোন পরিবহন ঠিকাদারের কাছে কি পরিমাণ সার স্টোর ইন ট্রানজিট হিসেবে মজুত আছে তার কোন সঠিক হিসাব সংরক্ষণ করা হয়নি। তা ছাড়া কোন বাফারের অধীন কি পরিমাণ সার স্টোর ইন ট্রানজিট আছে তারও কোন হিসাব নেই।

অডিটে ইউরিয়া সারের গড় আমদানি মূল্য প্রতি টন ৫৮২ ডলার (ইউ এস) হিসাবে ট্রানজিট প্রদর্শিত ৩ লাখ ২৫ হাজার ৩২১ মেট্রিক টনের মূল্য ১ হাজার ৫১৫ কোটি ৮৩ লাখ ৩১ হাজার ৯৯৫ টাকা বলে উল্লেখ করা হয়। কি অবস্থায় প্রদর্শিত সারের বিস্তারিত হিসাব রাখা হয়নি এবং এ বিষয়ে কোন কার্যকর ব্যবস্থা কেন নেয়া হয়নি তার যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যাসহ জরুরি ভিত্তিতে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে নিরীক্ষাকে জানানোর অনুরোধ জানানো হয়।

অডিট রিপোর্টে ট্রানজিট প্রদর্শিত সারের সঠিক হিসাব সংরক্ষণ না করা গুরুতর অনিয়ম বিধায় জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ অডিট রিপোর্টের পরে ও বিসিআইসি কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। বরং হাজার কোটি টাকার সার লোপাটের এ অপকর্ম ধামাচাপা দিতে সংশ্লিষ্ট রাঘব বোয়ালদের বাঁচাতে বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিতে সহায়তা করছে বিসিআইসির কতিপয় কর্মকর্তা। এদিকে বিপুল পরিমাণ ইউরিয়া সার লোপাটের এ ঘটনা দুর্নীতি দমন কমিশনের নজরে এলে তারা তদন্তে নেমে হাজার কোটি টাকার ইউরিয়া সার লোপাটের প্রাথমিক সত্যতা প্রায় নিশ্চিত হয়েছেন। তারা দেখতে পান কাফকোর কারখানা এবং চিটাগাং ও মোংলা বন্দর থেকে আমদানিকৃত যে সার ট্রানজিট হিসেবে দেখানো হয়েছে তা বছরের পর বছর কাগজ-কলমে ট্রানজিটই দেখানো হয়েছে।

এ ইউরিয়া সার বছরের পর বছর যেন রাস্তাতে গাড়িতেই রয়ে গেছে। এ সার কোথায় কোন বাফার গোডাউনে আছে তার কোন হিসাব নেই বিসিআইসির কাছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে কোন তথ্যও দিতে পারছেন না। যার অর্থই হচ্ছে এ ইউরিয়া সার বাফার গোডাউনে না এনে রাস্তা থেকেই বিক্রি করে ভাগ-বণ্টন করে নেয়া হয়েছে। তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, বিসিআইসি সারের এ ব্যাপক ঘাটতি পূরণে ১ বছরের সার আগের বছরের দেখিয়ে পূরণের চেষ্টা করা হচ্ছে যা প্রকৃত অর্থে ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’র শামিল বলে তারা মনে করছেন। তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা বিসিআইসির সার পরিবহনের সঙ্গে জড়িত ঠিকাদারদের মধ্যে অধিকাংশই হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক বলে তদন্তে নেমে জানতে পেরেছেন যা তাদের অবাক করেছে। এ পরিবহন ঠিকাদারদের আয়ের সঙ্গে অর্জিত সম্পদের সামঞ্জস্য আছে কিনা তা অনুসন্ধান করে দেখা হচ্ছে। শুধু তাই নয় বিসিআইসির কয়েক কর্মকর্তা কর্মচারীর সম্পদের অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। তবে প্রকৃত অর্থে কত মেট্রিক টন সার ঘাটতি হয়েছে তা বিসিআইসি যেন মুখে কুলুপ এঁটে আছে।

এ ব্যাপারে বিসিআইসি মহাব্যবস্থাপক মো. সফিকুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঘাটতির পরিমাণ বলতে অপারগতা প্রকাশ করে জানান, ‘জিএম মার্কেটিংকে জিজ্ঞাসা করুন আমাকে নয়। আর আমার কাছ থেকে তথ্য নিতে হলে তথ্য অধিকার আইনে আসতে হবে।’ জিএম মার্কেটিং মো. মঞ্জুর রেজার অফিশিয়াল টেলিটক নাম্বারে বার বার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন না ধরায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

আরও খবর
সংসদে ৮২৩৮ জন ঋণখেলাপির তালিকা
ই-পাসপোর্ট জাতির জন্য ‘মুজিববর্ষের’ উপহার : প্রধানমন্ত্রী
দায়িত্বে অবহেলায় কঠোর শাস্তি সিইসি
পলাতক সিনহাসহ ১১ জনের নামে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ
ঢাকার অলিগলিতে প্রার্থীরা জমজমাট নির্বাচনী আমেজ
ঢাকাকে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন ঘোষণা দেয়া দরকার হাইকোর্ট
ই-পাসপোর্ট সংক্রান্ত তথ্যাবলি
পলিথিন মোড়ানো পোস্টার বন্ধের নির্দেশ
মায়ানমারে গণহত্যার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে
গণতন্ত্র সূচকে ৮ ধাপ অগ্রগতি বাংলাদেশের
হলফনামায় তথ্য গোপনের অভিযোগ তাবিথের বিরুদ্ধে
ক্ষণগণনা
‘পিতা তুমি বাংলাদেশ’ মুজিববর্ষে চট্টগ্রামে ম্যুরাল নির্মাণ

বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২০ , ৯ মাঘ ১৪২৬, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

বাফার গোডাউনগুলোয়

হাজার কোটি টাকার ইউরিয়া সার লোপাট

সংশ্লিষ্ট রাঘব বোয়ালরা অধরা

হাবিবুর রহমান স্বপন, পাবনা

বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) বাফার গোডাউনে ট্রানজিটের নামে লাখ লাখ মেট্রিক টন ইউরিয়া সার ঘাটতির রহস্য অবশেষে ফাঁস হতে চলেছে। বিসিআইসি বাফার গোডাউনের ইউরিয়ার ঘাটতি কাগজ-কলমে ট্রানজিট দেখালেও প্রকৃত অর্থে তা লোপাট করা হয়েছে।

ট্রানজিটের নামে কাফকো উৎপাদিত ও বিদেশ থেকে আমদানিকৃত সার চট্টগ্রাম এবং মোংলা পোর্ট থেকে ছাড় করে বাফার গোডাউনে না নিয়ে একটি সিন্ডিকেট রাস্তা থেকেই তা বিক্রি করে ভাগ-বণ্টন করে নিয়েছে। বিসিআইসির এ সার লোপাটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ কয়েকটি পরিবহন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জড়িত বলে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। শিল্পসংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বাফার গোডাউনের সার ঘাটতির ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করলেও ৩ বছরেও বিসিআইসি কোন পদক্ষেপ নেয়নি। অবশেষে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্তে নেমে সার লোপাটের রহস্য উন্মোচনসহ রাঘব বোয়ালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। দেশের খাদ্য উৎপাদনে প্রতিবছর বিসিআইসি কাফকোর উৎপাদিত সারসহ বিদেশ থেকে ইউরিয়া সার আমদানি করে কৃষকের চাহিদা পূরণ করে থাকে। কাফকো কারখানাসহ আমদানিকৃত ইউরিয়া চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর থেকে বিভিন্ন পরিবহনের মাধ্যমে সারা দেশের বাফার গোডাউনে সংরক্ষণের পর তালিকাভুক্ত ডিলারদের মাধ্যমে কৃষকদের সরবরাহ করা হয়।

বিসিআইসির নির্ধারিত কয়েকটি বেসরকারি পরিবহন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান (মেসার্স বাল্ক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, মালিক : আমিনুর রশিদ খান; ইউসুফ চেম্বার ৪র্থ তলা ২০ দিলখুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা), মেসার্স নবাব অ্যান্ড কোং (মালিক : নবাব খান ১০১/৫০ আগ্রাবাদ; চট্টগ্রাম), মেসার্স সাউথ ডেল্টা সিস্টেম অ্যান্ড ট্রেডিং লি. (মালিক : মশিউর রহমান খান, গ্লোব চেম্বার ১০৪ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা; ঢাকা) এবং মেসার্স পোটন ট্রেডার্স (মালিক : কামরুল খান, ৩০/৩১ বিসিআইসি ভবন, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা; ঢাকা); উক্ত সার বগুড়া, সান্তাহার, গাইবান্ধা, রংপুর, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, পার্বতীপুর, চরকাই, জয়পুরহাট, রাজশাহী, নাটোর, ঠাকুরগাঁও, বাঘাবাড়ী, যশোর, বরিশাল, ভোলা, টেকেররহাট, পটুয়াখালীসহ সারা দেশের বাফার গোডাউনে পৌঁছে দেয়। অভিযোগ উঠেছে বিসিআইসি’র কাফকো কারখানা ও বন্দর থেকে আমদানিকৃত এ ইউরিয়া সার বাফার গুদামে না নিয়ে রাস্তা থেকেই লোপাট করা হয়েছে। ২০০৭ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত হাজার কোটি টাকার ইউরিয়া লোপাটের ঘটনা ঘটেছে। আর এ লোপাটের সঙ্গে বিসিআইসির কতিপয় কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট পরিবহন ঠিকাদার সিন্ডিকেট জড়িত রয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ট্রানজিটের নামে লাখ লাখ মে. টন সার ঘাটতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে তদন্তসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিলেও বিসিআইসি ৩ বছর ধরে নীরব ভূমিকা পালন করে আসছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র অভিযোগ তুলেছেন। খোদ বিসিআইসির এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ইউরিয়া সার ঘাটতির উদ্বেগজনক তথ্য পাওয়া গেছে, ২০০৭ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত কাফকো ও বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ১ হাজার ৫১৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা মূল্যের ৩ লাখ ২৫ হাজার ৩২১ মেট্রিক টন ইউরিয়া সার স্টোর ইন ট্রানজিট দেখানো হলেও তার কোন হিসাব নেই। অডিট তথ্যে দেখা যায়, বিসিআইসি ৩০ জুলাই ২০০৭ সালে ৮৫১ মেট্রিক টন, ৩১ জুলাই ২০০৮ সালে ২৩ হাজার ৮৪২ মেট্রিক টন, ৩১ জুলাই ২০০৯ সালে ১২ হাজার ৩৮০ মেট্রিক টন, ৩০ জুলাই ২০১০ সালে ৩২ হাজার ৬০৯ মেট্রিক টন, ৩১ জুলাই ২২০১১ সালে ৭৬ হাজার ৬৮৯ মেট্রিক টন, ৩১ জুলাই ২০১২ সালে ৪১ হাজার ৭৩ মেট্রিক টন, ৩১ জুলাই ২০১৩ সালে ১ লাখ ৬ হাজার ৩২২ মেট্রিক টন, ৩১ জুলাই ২০১৪ সালে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৬৪৪ মেট্রিক টন, ৩০ জুন ২০১৫ সালে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন, ২৭ জানুয়ারি ২০১৬ সালে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৩২১ মেট্রিক টন ইউরিয়া সার ঘাটতি দেখা যায় যা ট্রানজিট হিসেবে দেখানো হয়েছে। সার ঘাটতির ঘটনায় সংসদীয় কমিটি তদন্তসহ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করলেও তা বিসিআইসি কর্তৃৃপক্ষ বছরের পর বছর শুধু সময়ক্ষেপণ করছে। গত ১ নভেম্বর ২০১৬ সালে ১০ম জাতীয় সংসদের শিল্প মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ১৪তম বৈঠকে দেশের বাফার গোডাউনের ইউরিয়া ঘাটতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়।

সংসদীয় কমিটির সভাপতি সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী ৭নং আলোচ্য সূচিতে জানান, বিসিআইসির হিসাবে যে সার ঘাটতি রয়েছে যা কাগজ-কলমে ট্রানজিট হিসেবে দেখানো হয়েছে তা প্রকৃতপক্ষে উক্ত সার নেই। বৈঠকে আলোচনা শেষে এ বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা ও দোষিদের আইনের আওতায় এনে ব্যবস্থা করার জন্য সুপারিশ করা হয়। বৈঠকে টাঙ্গাইল-১ এর সংসদ সদস্য মো. আবদুর রাজ্জাক (বর্তমান কৃষিমন্ত্রী), ঢাকা ৫ আসনের সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান মোল্লা, রংপুর ২ আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম মো. আহ্সানুল হক চৌধুরী, ফেনী-৩ আসনের সংসদ সদস্য রহিম উল্লাহ, মহিলা আসন ২১ সংসদ সদস্য বেগম ফাতেমা তুজ্জহুরাসহ শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব, বিসিআইসি চেয়ারম্যান, বিসিক চেয়ারম্যানসহ কমিটির সদস্যরা অংশ নেন। অন্যদিকে গত ১৭ ফেব্রয়ারি ২০১৬ সালে বিসিআইসির সহ-প্রধান নিরীক্ষক এএসএম আনওয়ার আল সাদাত বিসিআইসি/ বিপণন/ ২০০১- ২০১৫/০১স্মারক নং অডিট রিপোর্টে আরও উল্লেখ করেন-কোন পরিবহন ঠিকাদারের কাছে কি পরিমাণ সার স্টোর ইন ট্রানজিট হিসেবে মজুত আছে তার কোন সঠিক হিসাব সংরক্ষণ করা হয়নি। তা ছাড়া কোন বাফারের অধীন কি পরিমাণ সার স্টোর ইন ট্রানজিট আছে তারও কোন হিসাব নেই।

অডিটে ইউরিয়া সারের গড় আমদানি মূল্য প্রতি টন ৫৮২ ডলার (ইউ এস) হিসাবে ট্রানজিট প্রদর্শিত ৩ লাখ ২৫ হাজার ৩২১ মেট্রিক টনের মূল্য ১ হাজার ৫১৫ কোটি ৮৩ লাখ ৩১ হাজার ৯৯৫ টাকা বলে উল্লেখ করা হয়। কি অবস্থায় প্রদর্শিত সারের বিস্তারিত হিসাব রাখা হয়নি এবং এ বিষয়ে কোন কার্যকর ব্যবস্থা কেন নেয়া হয়নি তার যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যাসহ জরুরি ভিত্তিতে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে নিরীক্ষাকে জানানোর অনুরোধ জানানো হয়।

অডিট রিপোর্টে ট্রানজিট প্রদর্শিত সারের সঠিক হিসাব সংরক্ষণ না করা গুরুতর অনিয়ম বিধায় জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ অডিট রিপোর্টের পরে ও বিসিআইসি কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। বরং হাজার কোটি টাকার সার লোপাটের এ অপকর্ম ধামাচাপা দিতে সংশ্লিষ্ট রাঘব বোয়ালদের বাঁচাতে বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিতে সহায়তা করছে বিসিআইসির কতিপয় কর্মকর্তা। এদিকে বিপুল পরিমাণ ইউরিয়া সার লোপাটের এ ঘটনা দুর্নীতি দমন কমিশনের নজরে এলে তারা তদন্তে নেমে হাজার কোটি টাকার ইউরিয়া সার লোপাটের প্রাথমিক সত্যতা প্রায় নিশ্চিত হয়েছেন। তারা দেখতে পান কাফকোর কারখানা এবং চিটাগাং ও মোংলা বন্দর থেকে আমদানিকৃত যে সার ট্রানজিট হিসেবে দেখানো হয়েছে তা বছরের পর বছর কাগজ-কলমে ট্রানজিটই দেখানো হয়েছে।

এ ইউরিয়া সার বছরের পর বছর যেন রাস্তাতে গাড়িতেই রয়ে গেছে। এ সার কোথায় কোন বাফার গোডাউনে আছে তার কোন হিসাব নেই বিসিআইসির কাছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে কোন তথ্যও দিতে পারছেন না। যার অর্থই হচ্ছে এ ইউরিয়া সার বাফার গোডাউনে না এনে রাস্তা থেকেই বিক্রি করে ভাগ-বণ্টন করে নেয়া হয়েছে। তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, বিসিআইসি সারের এ ব্যাপক ঘাটতি পূরণে ১ বছরের সার আগের বছরের দেখিয়ে পূরণের চেষ্টা করা হচ্ছে যা প্রকৃত অর্থে ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’র শামিল বলে তারা মনে করছেন। তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা বিসিআইসির সার পরিবহনের সঙ্গে জড়িত ঠিকাদারদের মধ্যে অধিকাংশই হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক বলে তদন্তে নেমে জানতে পেরেছেন যা তাদের অবাক করেছে। এ পরিবহন ঠিকাদারদের আয়ের সঙ্গে অর্জিত সম্পদের সামঞ্জস্য আছে কিনা তা অনুসন্ধান করে দেখা হচ্ছে। শুধু তাই নয় বিসিআইসির কয়েক কর্মকর্তা কর্মচারীর সম্পদের অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। তবে প্রকৃত অর্থে কত মেট্রিক টন সার ঘাটতি হয়েছে তা বিসিআইসি যেন মুখে কুলুপ এঁটে আছে।

এ ব্যাপারে বিসিআইসি মহাব্যবস্থাপক মো. সফিকুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঘাটতির পরিমাণ বলতে অপারগতা প্রকাশ করে জানান, ‘জিএম মার্কেটিংকে জিজ্ঞাসা করুন আমাকে নয়। আর আমার কাছ থেকে তথ্য নিতে হলে তথ্য অধিকার আইনে আসতে হবে।’ জিএম মার্কেটিং মো. মঞ্জুর রেজার অফিশিয়াল টেলিটক নাম্বারে বার বার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন না ধরায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।