শত প্রদীপে আলোক উজ্জ্বল হোক বাংলাদেশ

রণেশ মৈত্র

১০ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর জন্মের শতবর্ষের শুরুতে এই ক্ষণজন্মা দেশনেতার শুভ জন্মলগ্নের ক্ষণগণনা শুরু হলো। ১৭ মার্চ তার জন্মদিন, শত প্রদীপে সমগ্র বাংলাদেশ আলোকিত হোক- এই কামনা নিয়েই সমগ্র বাঙালি জাতি, দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ, নারী সমাজ, ছাত্র সমাজ, শ্রমিক শ্রেণী, কৃষককুল ধর্ম-বর্ণ সম্প্রদায় নির্বিশেষে বছরটি নানা আয়োজনে উদযাপন করবে। দেশ-বিদেশের বিশিষ্টজনরা আসবেন বাঙালির প্রাণের নেতাকে, বঙ্গবন্ধু তথা বিশ্ববন্ধুকে তাদের সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানাতে।

বাঙালি জাতির জন্য বঙ্গবন্ধুর ত্যাগের সীমা-পরিসীমা নেই। ১৯২০ সালে অজপাড়াগাঁয়ে তৎকালীন ফরিদপুর জেলায় ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। একটি আজান পড়েছিল সেদিনকার সেই শত সম্ভাবনাপূর্ণ শিশুটিকে দেশের মাটিতে স্বাগত জানিয়ে।

সেই ১৯২০ সালে জন্ম আর তার করুণ বিদায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে। মাত্র ৫৫ বছর জীবিত থাকতে পেরেছিলেন হাজারও সম্ভাবনাপূর্ণ শিশুটি, বিশ্বকে চোখের জলে ভাসিয়ে চলে যেতে হয়েছিল ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে। বাঙালি বেদনার সাথে অনুভব করে- বঙ্গবন্ধু আক্রান্ত হলে দেশবাসী এমনকি তার ঘনিষ্ঠজনরাও ওই নির্মম আক্রমণ প্রতিরোধে এগিয়ে যেতে পারেননি স্রেফ পরবর্তী নেতৃত্বের ভীতির কারণে।

অথচ আজ মনে পড়ে ওই একটি মানুষ দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে তাদের ঐক্যবদ্ধ করে কী অসীম সাহসের সাথেই না জীবনভর লড়াই-সংগ্রাম-আন্দোলন করেছিলেন অসীম বিচক্ষণতার সাথে তার প্রিয় বাঙালি জাতিকে মুক্ত করতে; বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে। আজও মানুষ সে কথা ভেবে শ্রদ্ধায় তার ছবিতে ফুল দেয়, কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করে দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে।

এক নজরে পেছন ফিরে দেখা যাক শেখ মুজিব নামক ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ ভূমিষ্ঠ হওয়া সেই শিশুটি তার স্বল্পায়ু জীবনে দেশের মানুষকে কী কী দিয়ে গেছেন। মাত্র ৫৫ বছরের মধ্যে প্রথম ২০ বছর যদি তার চেতনা বিকাশে লেগেছে বলে ধরে নেয়া যায়, তবে তো তার হাতে সচেতনভাবে দেশের কাজ করার জন্য সময় ছিল মাত্র ৩৫ বছর। অংকের হিসাব আমাদের আরও জানায় যে, তার দীর্ঘ বারো বছরের কারাজীবনকে হিসেবে নিলে প্রকৃতপক্ষে সক্রিয়ভাবে জনগণকে নিয়ে জনগণের সাথে মিলে পৃথিবীর আলো-বাতাসে সমৃদ্ধ হয়ে কাজ করার সময় পেয়েছিলেন মাত্র ২৩ বছর। মাত্রই ২৩ বছর! তবে জেলখানায় বসেও দিনগুলো তিনি ঘুমিয়ে কাটাননি; ভেবেছেন দেশের কথা-মানুষের কথা, বাঙালি জাতির কথা, আন্দোলনের কথা, সংগ্রামের কথা, লড়াইয়ের কথা।

বঙ্গবন্ধু যেমন ছিলেন বিশালদেহী মানুষ, তেমনই বিশাল ছিল তার হৃদয়; তেমনই দৃঢ় ছিল তার প্রত্যয়, তেমনই নিষ্ঠা ছিল তার দেশ, জনগণ ও আদর্শের প্রতি।

এগুলো অতিকথন নয়- স্তাবকতাও নয়। যদিও কি বঙ্গবন্ধু কি তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা- উভয়ের কপালেই বিপুলসংখ্যক স্তাবক জুটেছে। স্তাবকেরা প্রায় সকলেই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ, তার বিশ্বস্তও। আর সর্বোচ্চ বিশ্বস্ত হিসেবে যিনি দলে ও সরকারে ছিলেন তার নিকটতম ঘনিষ্ঠতম সেই খোন্দকার মোশতাকই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মতো নির্মম ঘটনা ঘটাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি।

আজও রাষ্ট্রক্ষমতাকে ঘিরে যে হারে স্তাবকের দল জুটেছে তাতেও শঙ্কিত বোধ করার যথেষ্ট কারণ আছে। দুধ-কলা দিয়ে যে সাপগুলোকে পুষতে দেখা যাচ্ছে, তাদের চেনা দুরূহ বটে কিন্তু তবু না চিনলে, তাদের বিরুদ্ধে সময়োচিত, দৃঢ় পদক্ষেপ না নিলে সর্বনাশের পুনরাবৃত্তি অসম্ভব কিছু নয়।

যা হোক, বঙ্গবন্ধুর লালিত আদর্শ, এ দেশের মহান ভাষা আন্দোলনের আদর্শ, গণতান্ত্রিক আন্দোলনসমূহের আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ যা তিনি ধারণ করতেন, লালন করতেন সেগুলোকে সইতে বা মানতে রাজি না থাকার ফলেই দলের ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থেকে খুনিরা অতবড় একটি বিপর্যয় ঘটিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র পরোয়া করেনি, ঘাতকের লোমশ হাত কাঁপেনি একটুও।

পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল ইসলামী সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে। ওই রাষ্ট্র গঠনেও শেখ মুজিবের বাল্যকালে খানিকটা অবদান ছিল মুসলিম লীগের কর্মী স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। কিন্তু পাকিস্তান যখন বাস্তবে রূপ পেল, চাঁদ-তারা পতাকা যখন ঘরে ঘরে উড়ানো হলো, ‘পাক সরেজমিন’ নামক গানটি (অবাঙালির গানকে) যখন তার জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গাওয়ানো শুরু হলো, পোস্টাল-স্ট্যাম্প, মানি অর্ডার ফরম, সরকারি দফতরসমূহের যাবতীয় নথিপত্র যখন উর্দু ও ইংরেজিতে ছাপানো হলো- শেখ মুজিব তখনই পাকিস্তান গড়ার নেতাদের মতলব বুঝে ফেললেন। দেশের বামপন্থী তরুণ সমাজের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ভূমিকা রাখলেন।

ইতিমধ্যে যৌবনে উত্তীর্ণ শেখ মুজিব সংগঠন গড়া, দল গড়া (মুসলিম ছাত্রলীগ, আওয়ামী মুসলিম লীগ) শেষে তাবৎ আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মূলত পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে গড়ে তোলা ওই আন্দোলনসমূহে দেশের বামপন্থী তরুণ-তরুণীরাই ছিলেন সাহসী সহযোদ্ধা। জাতীয়তাবাদী ও বামশক্তির সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছিল অপ্রতিরোধ্য অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক একটি বাঙালি রাষ্ট্র গঠনের লৌহদৃঢ় প্রত্যয়।

সেই অবিনাশী প্রত্যয় নিয়ে আন্দোলনের মাঠ প্রকম্পিত করে তুলেছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী শক্তি এবং ভাসানী মনি সিংহের নেতৃত্বে বামপন্থী তরুণ শক্তি হাতে হাত ধরে। উভয় শক্তির মধ্যে সংহতিও গড়ে উঠেছিল বিপুলভাবে।

যেদিন বিদেশের মাটিতে অন্যতম আওয়ামী লীগ নেতা পাশ্চাত্যে ঘেঁষা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পরলোক গমন করেন সেদিন শেখ মুজিবের একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের ওপর। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ ‘মুসলিম’ শব্দ দলের নাম থেকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত করা, ১৯৭২ সালের সংবিধানে চারটি ঐতিহাসিক মৌলনীতি ঘোষণা (গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ) বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চেতনার সর্বোচ্চ প্রতিফলন হিসেবে সর্বত্র স্বীকৃত সর্বত্র নন্দিত।

তাই শেষ বিবেচনায়, আজ বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মদিনের প্রাক্কালে স্মৃতিতে ভেসে উঠছে তার ঐতিহাসিক অবদান ও আদর্শের অবিনশ্বর চেতনাগুলোকে এবং তার জীবনের অমূল্য শিক্ষাগুলোকে।

সেগুলোকে সংক্ষেপে এভাবে চিত্রিত করা যায়-

এক. সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে যোগ দিয়ে অবশেষে তাকে ঘৃণার সাথে পরিত্যাগ করে অসাম্প্রদায়িক চরিত্রে সংগঠনকে রূপান্তরিত করা; দুই. ভিক্ষা নয়, আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমেই জনতার ন্যায্য দাবি-দাওয়া আদায় করতে হয়; তিন. শত্রুকে কদাপি বন্ধু বলে গ্রহণ না করা এবং বন্ধুর সাথে মিত্রতা ক্রমান্বয়ে দৃঢ় করা এবং চার. জাতিকে কখনো বিভক্ত নয় বরং সর্বদা সকল কাজে ব্যাপকভাবে ঐক্যবদ্ধ করা।

এই শিক্ষাগুলোকে পুরোপুরি গ্রহণ করে অগ্রসর হতে পারলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতির সব বাস্তবায়নই হতে পারে বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী উদযাপনের প্রধানতম প্রত্যয়।

তাই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ যত জৌলুসের সাথেই পালন করা হোক- তার সাথে অবশ্যই পরিপূর্ণ সংযোগ ঘটানো প্রয়োজন তার আজীবন লালিত আদর্শসমূহকে; যে আদর্শ নিয়ে তিনি সংগ্রাম করেছেন, সারাটি জীবনভর যে মহান আদর্শগুলো তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন তার রচিত বাহাত্তরের সংবিধানে সেগুলোর অবিকল পুনঃস্থাপন।

সুতরাং আমরা যদি এ বর্ষটি যথার্থই উদযাপন করতে চাই তাহলে তার প্রতিটি মুহূর্তকে যেমন আনন্দঘন করে তুলতে হবে, তেমনই তার সুমহান আদর্শগুলোকে সংবিধানে পুনঃস্থাপন করে বাহাত্তরের মূল সংবিধানের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে হবে।

এ লক্ষে আগামী ১৬ মার্চ (১৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর জন্মের পূর্ব দিনে) সংবিধানের বিশেষ অধিবেশন ডেকে বাহাত্তরের সংবিধান অবিকল পুনরুজ্জীবিত করা হোক।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লক্ষ্য সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক;

১৯৭৫ পরবর্তীকালে সংঘটিত তাবৎ সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিচার ও অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হোক;

ধর্মীয় ও জাতীয় সংখ্যালঘু আদিবাসীদের সকল ক্ষেত্রে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করা হোক এবং

শান্তিপূর্ণভাবে সকলের মতপ্রকাশের এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্বকারী সকল আইন প্রতিষ্ঠা করা হোক।

এগুলোই হোক শতবর্ষের আলোক উজ্জ্বল শত প্রদীপ; যা থেকে দীপ্ত ও উজ্জ্বল হোক আমাদের বাংলাদেশ।

[লেখক : সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, পাবনা; সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত]

mail:raneshmaitra@gmail.com

বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২০ , ৯ মাঘ ১৪২৬, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

শত প্রদীপে আলোক উজ্জ্বল হোক বাংলাদেশ

রণেশ মৈত্র

image

১০ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর জন্মের শতবর্ষের শুরুতে এই ক্ষণজন্মা দেশনেতার শুভ জন্মলগ্নের ক্ষণগণনা শুরু হলো। ১৭ মার্চ তার জন্মদিন, শত প্রদীপে সমগ্র বাংলাদেশ আলোকিত হোক- এই কামনা নিয়েই সমগ্র বাঙালি জাতি, দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ, নারী সমাজ, ছাত্র সমাজ, শ্রমিক শ্রেণী, কৃষককুল ধর্ম-বর্ণ সম্প্রদায় নির্বিশেষে বছরটি নানা আয়োজনে উদযাপন করবে। দেশ-বিদেশের বিশিষ্টজনরা আসবেন বাঙালির প্রাণের নেতাকে, বঙ্গবন্ধু তথা বিশ্ববন্ধুকে তাদের সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানাতে।

বাঙালি জাতির জন্য বঙ্গবন্ধুর ত্যাগের সীমা-পরিসীমা নেই। ১৯২০ সালে অজপাড়াগাঁয়ে তৎকালীন ফরিদপুর জেলায় ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। একটি আজান পড়েছিল সেদিনকার সেই শত সম্ভাবনাপূর্ণ শিশুটিকে দেশের মাটিতে স্বাগত জানিয়ে।

সেই ১৯২০ সালে জন্ম আর তার করুণ বিদায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে। মাত্র ৫৫ বছর জীবিত থাকতে পেরেছিলেন হাজারও সম্ভাবনাপূর্ণ শিশুটি, বিশ্বকে চোখের জলে ভাসিয়ে চলে যেতে হয়েছিল ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে। বাঙালি বেদনার সাথে অনুভব করে- বঙ্গবন্ধু আক্রান্ত হলে দেশবাসী এমনকি তার ঘনিষ্ঠজনরাও ওই নির্মম আক্রমণ প্রতিরোধে এগিয়ে যেতে পারেননি স্রেফ পরবর্তী নেতৃত্বের ভীতির কারণে।

অথচ আজ মনে পড়ে ওই একটি মানুষ দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে তাদের ঐক্যবদ্ধ করে কী অসীম সাহসের সাথেই না জীবনভর লড়াই-সংগ্রাম-আন্দোলন করেছিলেন অসীম বিচক্ষণতার সাথে তার প্রিয় বাঙালি জাতিকে মুক্ত করতে; বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে। আজও মানুষ সে কথা ভেবে শ্রদ্ধায় তার ছবিতে ফুল দেয়, কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করে দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে।

এক নজরে পেছন ফিরে দেখা যাক শেখ মুজিব নামক ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ ভূমিষ্ঠ হওয়া সেই শিশুটি তার স্বল্পায়ু জীবনে দেশের মানুষকে কী কী দিয়ে গেছেন। মাত্র ৫৫ বছরের মধ্যে প্রথম ২০ বছর যদি তার চেতনা বিকাশে লেগেছে বলে ধরে নেয়া যায়, তবে তো তার হাতে সচেতনভাবে দেশের কাজ করার জন্য সময় ছিল মাত্র ৩৫ বছর। অংকের হিসাব আমাদের আরও জানায় যে, তার দীর্ঘ বারো বছরের কারাজীবনকে হিসেবে নিলে প্রকৃতপক্ষে সক্রিয়ভাবে জনগণকে নিয়ে জনগণের সাথে মিলে পৃথিবীর আলো-বাতাসে সমৃদ্ধ হয়ে কাজ করার সময় পেয়েছিলেন মাত্র ২৩ বছর। মাত্রই ২৩ বছর! তবে জেলখানায় বসেও দিনগুলো তিনি ঘুমিয়ে কাটাননি; ভেবেছেন দেশের কথা-মানুষের কথা, বাঙালি জাতির কথা, আন্দোলনের কথা, সংগ্রামের কথা, লড়াইয়ের কথা।

বঙ্গবন্ধু যেমন ছিলেন বিশালদেহী মানুষ, তেমনই বিশাল ছিল তার হৃদয়; তেমনই দৃঢ় ছিল তার প্রত্যয়, তেমনই নিষ্ঠা ছিল তার দেশ, জনগণ ও আদর্শের প্রতি।

এগুলো অতিকথন নয়- স্তাবকতাও নয়। যদিও কি বঙ্গবন্ধু কি তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা- উভয়ের কপালেই বিপুলসংখ্যক স্তাবক জুটেছে। স্তাবকেরা প্রায় সকলেই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ, তার বিশ্বস্তও। আর সর্বোচ্চ বিশ্বস্ত হিসেবে যিনি দলে ও সরকারে ছিলেন তার নিকটতম ঘনিষ্ঠতম সেই খোন্দকার মোশতাকই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মতো নির্মম ঘটনা ঘটাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি।

আজও রাষ্ট্রক্ষমতাকে ঘিরে যে হারে স্তাবকের দল জুটেছে তাতেও শঙ্কিত বোধ করার যথেষ্ট কারণ আছে। দুধ-কলা দিয়ে যে সাপগুলোকে পুষতে দেখা যাচ্ছে, তাদের চেনা দুরূহ বটে কিন্তু তবু না চিনলে, তাদের বিরুদ্ধে সময়োচিত, দৃঢ় পদক্ষেপ না নিলে সর্বনাশের পুনরাবৃত্তি অসম্ভব কিছু নয়।

যা হোক, বঙ্গবন্ধুর লালিত আদর্শ, এ দেশের মহান ভাষা আন্দোলনের আদর্শ, গণতান্ত্রিক আন্দোলনসমূহের আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ যা তিনি ধারণ করতেন, লালন করতেন সেগুলোকে সইতে বা মানতে রাজি না থাকার ফলেই দলের ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থেকে খুনিরা অতবড় একটি বিপর্যয় ঘটিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র পরোয়া করেনি, ঘাতকের লোমশ হাত কাঁপেনি একটুও।

পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল ইসলামী সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে। ওই রাষ্ট্র গঠনেও শেখ মুজিবের বাল্যকালে খানিকটা অবদান ছিল মুসলিম লীগের কর্মী স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। কিন্তু পাকিস্তান যখন বাস্তবে রূপ পেল, চাঁদ-তারা পতাকা যখন ঘরে ঘরে উড়ানো হলো, ‘পাক সরেজমিন’ নামক গানটি (অবাঙালির গানকে) যখন তার জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গাওয়ানো শুরু হলো, পোস্টাল-স্ট্যাম্প, মানি অর্ডার ফরম, সরকারি দফতরসমূহের যাবতীয় নথিপত্র যখন উর্দু ও ইংরেজিতে ছাপানো হলো- শেখ মুজিব তখনই পাকিস্তান গড়ার নেতাদের মতলব বুঝে ফেললেন। দেশের বামপন্থী তরুণ সমাজের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ভূমিকা রাখলেন।

ইতিমধ্যে যৌবনে উত্তীর্ণ শেখ মুজিব সংগঠন গড়া, দল গড়া (মুসলিম ছাত্রলীগ, আওয়ামী মুসলিম লীগ) শেষে তাবৎ আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মূলত পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে গড়ে তোলা ওই আন্দোলনসমূহে দেশের বামপন্থী তরুণ-তরুণীরাই ছিলেন সাহসী সহযোদ্ধা। জাতীয়তাবাদী ও বামশক্তির সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছিল অপ্রতিরোধ্য অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক একটি বাঙালি রাষ্ট্র গঠনের লৌহদৃঢ় প্রত্যয়।

সেই অবিনাশী প্রত্যয় নিয়ে আন্দোলনের মাঠ প্রকম্পিত করে তুলেছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী শক্তি এবং ভাসানী মনি সিংহের নেতৃত্বে বামপন্থী তরুণ শক্তি হাতে হাত ধরে। উভয় শক্তির মধ্যে সংহতিও গড়ে উঠেছিল বিপুলভাবে।

যেদিন বিদেশের মাটিতে অন্যতম আওয়ামী লীগ নেতা পাশ্চাত্যে ঘেঁষা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পরলোক গমন করেন সেদিন শেখ মুজিবের একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের ওপর। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ ‘মুসলিম’ শব্দ দলের নাম থেকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত করা, ১৯৭২ সালের সংবিধানে চারটি ঐতিহাসিক মৌলনীতি ঘোষণা (গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ) বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চেতনার সর্বোচ্চ প্রতিফলন হিসেবে সর্বত্র স্বীকৃত সর্বত্র নন্দিত।

তাই শেষ বিবেচনায়, আজ বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মদিনের প্রাক্কালে স্মৃতিতে ভেসে উঠছে তার ঐতিহাসিক অবদান ও আদর্শের অবিনশ্বর চেতনাগুলোকে এবং তার জীবনের অমূল্য শিক্ষাগুলোকে।

সেগুলোকে সংক্ষেপে এভাবে চিত্রিত করা যায়-

এক. সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে যোগ দিয়ে অবশেষে তাকে ঘৃণার সাথে পরিত্যাগ করে অসাম্প্রদায়িক চরিত্রে সংগঠনকে রূপান্তরিত করা; দুই. ভিক্ষা নয়, আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমেই জনতার ন্যায্য দাবি-দাওয়া আদায় করতে হয়; তিন. শত্রুকে কদাপি বন্ধু বলে গ্রহণ না করা এবং বন্ধুর সাথে মিত্রতা ক্রমান্বয়ে দৃঢ় করা এবং চার. জাতিকে কখনো বিভক্ত নয় বরং সর্বদা সকল কাজে ব্যাপকভাবে ঐক্যবদ্ধ করা।

এই শিক্ষাগুলোকে পুরোপুরি গ্রহণ করে অগ্রসর হতে পারলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতির সব বাস্তবায়নই হতে পারে বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী উদযাপনের প্রধানতম প্রত্যয়।

তাই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ যত জৌলুসের সাথেই পালন করা হোক- তার সাথে অবশ্যই পরিপূর্ণ সংযোগ ঘটানো প্রয়োজন তার আজীবন লালিত আদর্শসমূহকে; যে আদর্শ নিয়ে তিনি সংগ্রাম করেছেন, সারাটি জীবনভর যে মহান আদর্শগুলো তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন তার রচিত বাহাত্তরের সংবিধানে সেগুলোর অবিকল পুনঃস্থাপন।

সুতরাং আমরা যদি এ বর্ষটি যথার্থই উদযাপন করতে চাই তাহলে তার প্রতিটি মুহূর্তকে যেমন আনন্দঘন করে তুলতে হবে, তেমনই তার সুমহান আদর্শগুলোকে সংবিধানে পুনঃস্থাপন করে বাহাত্তরের মূল সংবিধানের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে হবে।

এ লক্ষে আগামী ১৬ মার্চ (১৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর জন্মের পূর্ব দিনে) সংবিধানের বিশেষ অধিবেশন ডেকে বাহাত্তরের সংবিধান অবিকল পুনরুজ্জীবিত করা হোক।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লক্ষ্য সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক;

১৯৭৫ পরবর্তীকালে সংঘটিত তাবৎ সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিচার ও অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হোক;

ধর্মীয় ও জাতীয় সংখ্যালঘু আদিবাসীদের সকল ক্ষেত্রে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করা হোক এবং

শান্তিপূর্ণভাবে সকলের মতপ্রকাশের এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্বকারী সকল আইন প্রতিষ্ঠা করা হোক।

এগুলোই হোক শতবর্ষের আলোক উজ্জ্বল শত প্রদীপ; যা থেকে দীপ্ত ও উজ্জ্বল হোক আমাদের বাংলাদেশ।

[লেখক : সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, পাবনা; সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত]

mail:raneshmaitra@gmail.com