শিশু ধর্ষণের বিচার

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

নতুন বছরের শুরুতে যেখানে আশার আলোয় মানুষ বাঁধছে বুক, দেখছে আলোয় উদ্ভাসিত নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন সেখানে ধর্ষণসহ শিশুর প্রতি চরম সহিংসতা আর অমানবিক নিষ্ঠুরতা ধূলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে সব। বছর শুরুর প্রথম ১১ দিনে শুধু রাজধানীতেই ৬ জন শিশু, কিশোরী ও তরুণী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। প্রতিদিনই শিশু ধর্ষণ ও নির্যাতন-নিপীড়নে যোগ হচ্ছে নিত্যনতুন মাত্রা ও ধরন। আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে শিশু অপহরণ ও খুনের ঘটনা। পারিবারিক বিরোধ, প্রতিহিংসা, লোভ-লালসার বলি হচ্ছে অবুঝ শিশুরা। রাস্তাঘাটে, চলন্ত বাসে এমনকি নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুরা ধর্ষিত হচ্ছে। নিজ মা-বাবা, নিকটাত্মীয়ের কাছেও আজ শিশুরা নিরাপদ নয়। কখনো জন্মদাতা পিতার হাতেও শিশুসন্তানকে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার মতো অমানবিক ঘটনা ঘটছে কোথাও। নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে বাদ যাচ্ছে না প্রতিবন্ধী শিশুরাও। ৪-৫ বছরের কিম্বা এর চেয়ে কম বয়সের শিশু থেকে ২২ মাসের শিশুকে ধর্ষণেরও নজির রয়েছে এ দেশে। ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, হত্যার পর লাশ গুমের ঘটনাও বেড়ে চলেছে ক্রমাগত। অন্যদিকে চাইল্ড পার্লামেন্টের এক নিজস্ব জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৯১৮ সালে ৮৭ শতাংশ শিশু কোন না কোনভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর কিছু নমুনা এ বছরের শুরুতেই লক্ষ্য করা গেছে। ১৮ জানুয়ারি রাজধানীর শাহজাহানপুরে ৮ বছর বয়সের এক নিম্নবিত্তের শিশু পাশের বাড়ির দারোয়ান কর্তৃক ধর্ষিত হয়েছে। ১৭ তারিখে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী এলাকায় ১০ বছরের এক শিশু গৃহকর্মীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এর পূর্বেও তাকে নানাভাবে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। ১৩ জানুয়ারি সাভারের আশুলিয়ার ঘোষবাগ এলাকায় এক গার্মেন্ট শ্রমিক তরুণীকে ৩৪ বছরের যুবক ধর্ষণ করেছে। ১০ জানুয়ারি রাজধানীর ভাটারায় ১২ বছরের এক কিশোরীকে গণধর্ষণ করেছে ৪ কিশোর। এছাড়া রামপুরায় ২ তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে ৩৮ বছর বয়সী এক বাবুর্চির বিরুদ্ধে। ৯ তারিখ কামরাঙ্গীরচরে বান্ধবীর সহযোগিতায় ১৩ বছরের এক কিশোরী গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। একই দিনে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ৯ম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীকে দুইদিন আটকে রেখে পালাক্রমে ধর্ষণ করা হয়েছে। ১০ জানুয়ারি বরিশালের বাবুগঞ্জের ক্ষুদ্রকাঠি গ্রামে এক বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষিত হয়েছে এক এসএসসি পরীক্ষার্থী দ্বারা। এছাড়া মৌলভীবাজারে এক তরুণী ও দিনাজপুরে এক শিশু ধর্ষণের শিকার হওয়ার খবর মিলেছে।

ধর্ষণের মতো গর্হিত কাজে শুধু লম্পট, বখাটে কিশোর-যুবকরাই জড়িত নয়, ধর্ষকদের মধ্যে রয়েছে শিক্ষিত যুবসমাজ, রাজনৈতিক কর্মী, সর্বস্তরের শিক্ষকসহ নানা বয়সী ও শ্রেণীপেশার মানুষ। কলেজ, ইউনিভার্সিটিপড়–য়া এক শ্রেণীর বর্বর ছেলেরাও ধর্ষণ করে চলেছে অসহায় শিশুদের। নিকটাত্মীয়, পরিবারের সদস্য, সহকর্মী, যানবাহনের চালক-সহকারী, এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, শিক্ষকের নাম উঠে আসছে ধর্ষকের তালিকায়। বিগত বছরেও দেশে শিশু ধর্ষণের চিত্র ছিল ভয়াবহ। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালে ৩৫৬ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে নিহত হয়েছে ২২ জন শিশু। ৫৩ জন শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ২৬৯ বেসরকারি সংস্থার প্ল্যাটফর্ম ‘বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম’এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৮ সালের প্রথম তিনমাসে ১৭৬ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে যা ১৯১৭ সালের তুলনায় ১৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয় ২০ জন। ধর্ষণের দুঃখে আত্মহত্যা করে ৩ শিশু। এছাড়াও ৮ জন প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। মাত্র তিন মাসে ২১ শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা, ৮ জনকে ইভটিজিং, ২৩ জনকে যৌন হয়রানি এবং ৩ শিশুকে পর্নোগ্রাফির শিকার হতে হয়।

লক্ষ্য করে দেখা যায়, দরিদ্র পরিবারের এবং শ্রমজীবী মা-বাবার শিশুরাই ধর্ষণের শিকার বেশি হচ্ছে। এ ধরনের পরিবারের শিশুরা বাবা-মায়ের অনুপস্থিতিতে এক শ্রেণীর লোকের টার্গেটে পরিণত হয়। শিশুদের ওপর বলপ্রয়োগ করে, ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ করা সহজ। কর্মজীবী শিশু, গৃহকর্মীরা ধর্ষণের বেশি ঝুঁকিতে থাকে। এমনকি ওদের দিয়ে পর্নোগ্রাফি তৈরি করাও সহজ। ধর্ষক হয়ে কেউ জন্মায় না, তবে এত ধর্ষক কী করে তৈরি হয়? এ সমাজে খেয়ে পরে কেমন করে তারা বেড়ে ওঠে! সামাজিক অসহিষ্ণুতাই শিশুর প্রতি এমন অমানবিক আচরণের প্রধান কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন বিশেষজ্ঞরা। যে বয়সে সমাজের প্রতিটি শিশু মানুষের স্নেহ-ভালোবাসা, আদর-যত্ন পেয়ে বেড়ে ওঠার কথা সেই বয়সে তারা হচ্ছে জিঘাংসার বলি। বর্তমান সময়ে নগর জীবনের ব্যস্ততার কারণে মা-বাবা তার সন্তানকে বঞ্চিত করছেন স্নেহ-আদর-ভালোবাসা, উপযুক্ত শাসন থেকে। দাদা-দাদি, চাচা-চাচির মতো নিকটাত্মীয়ের সান্নিধ্যবঞ্চিত শিশু-কিশোর ঘরের মাঝে একাকীত্বে ভোগে। শিশু-কিশোরের মনোজগতে বিশাল শূন্যতা বাসা বাঁধে। তারা খুঁজে নেয় বাইরের এক অচেনা-অজানা জগৎ। সেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিপথগামী বন্ধু-বান্ধবের সংস্পর্শে এসে ধীরে ধীরে ধর্ষণের মতো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। মাদকের অবাধ বিস্তার ধর্ষণের মতো অপরাধ বাড়িয়ে তুলতে সরাসরি প্রভাব ফেলছে। আকাশ সংস্কৃতি ও তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ এবং এর অপব্যবহার শিশু-কিশোরের চরিত্রের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। দেশে কোথাও সুস্থ বিনোদনের সুযোগ নেই বলে অবসরে কখনো ইন্টারনেটে অশ্লীল ছবি, ভিডিও দেখে এবং ফেসবুকে বখে-যাওয়া বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগের অবাধ সুযোগে শিশু-কিশোররা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড দেখে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষাঙ্গনে সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা ও খেলাধুলার ব্যবস্থা না থাকায় ঝুঁকে পড়ছে নানা নেশায় যা তাদের চরিত্র গঠনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ধর্ষণের সামাজিক ব্যাধি আজ মহামারি রূপ ধারণ করলেও বেশিরভাগ ধর্ষণের অপরাধ আড়ালে থেকে যাচ্ছে। সম্প্রতি ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্তদের দণ্ড প্রদান করে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন আদালত। শিশুকে যৌন নিপীড়নের মামলায় সিরাজগঞ্জের সদর উপজেলার এক ব্যক্তিকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে বহিষ্কার করেছে বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে, মীরসরাইয়ে এক প্রতিবন্ধী কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে তার নানা সম্পর্কের ৬০ বছর রয়সী বৃদ্ধকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দণ্ড দেওয়া হলেও কমছে না ধর্ষণের মতো সামাজিক অপরাধ। সাম্প্রতিক সময়ে শিশু ধর্ষণের ভয়াবহ বিস্তার রোধে শিশু ধর্ষণকারীকে কেন মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। রুলে ১৬ বছরের নিচে কেউ ভিকটিম হলে সেক্ষেত্রে ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রণয়ন করায় সরকারের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি হবে না, তা জানতে চেয়েছেন আদালত। ধর্ষণের ঘটনায় কারও মৃত্যু হলে সেক্ষেত্রে আইনে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি যাবজ্জীবন সাজার যে বিধান রয়েছে, সে যাবজ্জীবন সাজা উঠিয়ে দিতে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ হবে না, তা-ও জানতে চাওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, নারীদের স্বয়ংক্রিয় প্রতিরক্ষামূলক যন্ত্র অ্যান্টি রেপ ডিভাইস সরবরাহের বিষয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্টের অপর একটি বেঞ্চ। ধর্ষণ প্রতিরোধ ও ক্ষতিগ্রস্ত নারী ও শিশুদের সহায়তা দিতে এক মাসের মধ্যে কশিন গঠনের যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, উক্ত কমিশনকে আগামী ৬ মাসের মধ্যে আদালতে সুপারিশ দাখিল করতে বলা হয়েছে।

শিশু ধর্ষণ এবং শিশুর প্রতি যেকোনো ধরনের নির্যাতন থেকে পরিত্রাণ পেতে সামাজিক অস্থিরতা দূর করতে হবে। দেশে সুশিক্ষা ব্যবস্থা, সুস্থ সামাজিক পরিস্থিতি ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ধারা ফিরিয়ে আনতে হবে। নিম্নবিত্তের কর্মজীবী নারীদের ঘরে তাদের সন্তানদের সুরক্ষা দিতে হবে। কর্মস্থলে শিশু-কিশোরীরা ধর্ষণের শিকার হয়, তাই শিশুদের কর্মে নিয়োগ বন্ধ করে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা নিতে হবে। রাস্তাঘাটে, যানবাহনে শিশু ও নারীর নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে তৎপর হতে হবে। পর্ন সাইট ও বিদেশি চ্যানেল যেখানে সহিংসতার ঘটনা দেখানো হয় তা বন্ধ করতে হবে। গাড়ি চালকদের ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি প্রতিরোধে বিআরটিএ-র মাধ্যমে বার্তা প্রদান এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সচেতনতামূলক ডকুমেন্টারি গ্রাম পর্যায়ে প্রদর্শনের ব্যবস্থা নিয়ে ধর্ষককে সামাজিকভাবে প্রতিহত করতে হবে। ধর্ষিতা ও তার পরিবারকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আইনী সহায়তা দিতে হবে। বাংলাদেশে ধর্ষণের শাস্তির জন্য যে আইনী বিধান রয়েছে তাতে ধর্ষিতাকে ধর্ষণের প্রমাণ করতে হয়। আলামত সংগ্রহ এবং যেসব পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ধর্ষিতাকে যেতে হয় তাও কঠিন। ধর্ষণের ব্যাপারে ধর্ষিতাকে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদও শিশু ও নারীর জন্য পীড়াদায়ক। ধর্ষণের মামলায় অনেকক্ষেত্রে প্রশাসনের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব ধর্ষণের সুষ্ঠু বিচারে বাধা হয়ে দাঁড়ায় যা পক্ষান্তরে ধর্ষণের বিস্তার ঘটায়। মামলার দীর্ঘসূত্রিতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতিও ধর্ষণকে উৎসাহিত করে। শিশু ধর্ষণের ঘটনার ভয়াবহতাকে জাতীয় সংকট হিসাবে বিবেচনায় করে দ্রুত সম্ভব অপরাধীদের গ্রেফতার ও বিচার সম্পন্ন করতে হবে। ধর্ষককে নিরাপরাধ প্রমাণ করতে হলে ধর্ষিতার ওপর শারীরিক ও মানসিক চাপ কমবে। ধর্ষণের ব্যাপারে রাষ্ট্রের শূন্যসহিষ্ণুতা নীতি গ্রহণ এবং ধর্ষণ প্রতিরোধে জাতীয় কর্মসূচি গ্রহণসহ শিশু ধর্ষণ ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধে আদালত কমিশন গঠনের যে নির্দেশ দিয়েছেন সেটা দ্রুত বাস্তবায়িত করতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে এ ব্যাপারে দ্রুততম সময়ে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। শিশু ও নারী ধর্ষণ প্রতিরোধে আইনের কঠোর প্রয়োগ ও দ্রুত বিচার নিশ্চিতের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক]

শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২০ , ১০ মাঘ ১৪২৬, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

শিশু ধর্ষণের বিচার

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

নতুন বছরের শুরুতে যেখানে আশার আলোয় মানুষ বাঁধছে বুক, দেখছে আলোয় উদ্ভাসিত নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন সেখানে ধর্ষণসহ শিশুর প্রতি চরম সহিংসতা আর অমানবিক নিষ্ঠুরতা ধূলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে সব। বছর শুরুর প্রথম ১১ দিনে শুধু রাজধানীতেই ৬ জন শিশু, কিশোরী ও তরুণী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। প্রতিদিনই শিশু ধর্ষণ ও নির্যাতন-নিপীড়নে যোগ হচ্ছে নিত্যনতুন মাত্রা ও ধরন। আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে শিশু অপহরণ ও খুনের ঘটনা। পারিবারিক বিরোধ, প্রতিহিংসা, লোভ-লালসার বলি হচ্ছে অবুঝ শিশুরা। রাস্তাঘাটে, চলন্ত বাসে এমনকি নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুরা ধর্ষিত হচ্ছে। নিজ মা-বাবা, নিকটাত্মীয়ের কাছেও আজ শিশুরা নিরাপদ নয়। কখনো জন্মদাতা পিতার হাতেও শিশুসন্তানকে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার মতো অমানবিক ঘটনা ঘটছে কোথাও। নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে বাদ যাচ্ছে না প্রতিবন্ধী শিশুরাও। ৪-৫ বছরের কিম্বা এর চেয়ে কম বয়সের শিশু থেকে ২২ মাসের শিশুকে ধর্ষণেরও নজির রয়েছে এ দেশে। ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, হত্যার পর লাশ গুমের ঘটনাও বেড়ে চলেছে ক্রমাগত। অন্যদিকে চাইল্ড পার্লামেন্টের এক নিজস্ব জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৯১৮ সালে ৮৭ শতাংশ শিশু কোন না কোনভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর কিছু নমুনা এ বছরের শুরুতেই লক্ষ্য করা গেছে। ১৮ জানুয়ারি রাজধানীর শাহজাহানপুরে ৮ বছর বয়সের এক নিম্নবিত্তের শিশু পাশের বাড়ির দারোয়ান কর্তৃক ধর্ষিত হয়েছে। ১৭ তারিখে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী এলাকায় ১০ বছরের এক শিশু গৃহকর্মীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এর পূর্বেও তাকে নানাভাবে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। ১৩ জানুয়ারি সাভারের আশুলিয়ার ঘোষবাগ এলাকায় এক গার্মেন্ট শ্রমিক তরুণীকে ৩৪ বছরের যুবক ধর্ষণ করেছে। ১০ জানুয়ারি রাজধানীর ভাটারায় ১২ বছরের এক কিশোরীকে গণধর্ষণ করেছে ৪ কিশোর। এছাড়া রামপুরায় ২ তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে ৩৮ বছর বয়সী এক বাবুর্চির বিরুদ্ধে। ৯ তারিখ কামরাঙ্গীরচরে বান্ধবীর সহযোগিতায় ১৩ বছরের এক কিশোরী গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। একই দিনে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ৯ম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীকে দুইদিন আটকে রেখে পালাক্রমে ধর্ষণ করা হয়েছে। ১০ জানুয়ারি বরিশালের বাবুগঞ্জের ক্ষুদ্রকাঠি গ্রামে এক বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষিত হয়েছে এক এসএসসি পরীক্ষার্থী দ্বারা। এছাড়া মৌলভীবাজারে এক তরুণী ও দিনাজপুরে এক শিশু ধর্ষণের শিকার হওয়ার খবর মিলেছে।

ধর্ষণের মতো গর্হিত কাজে শুধু লম্পট, বখাটে কিশোর-যুবকরাই জড়িত নয়, ধর্ষকদের মধ্যে রয়েছে শিক্ষিত যুবসমাজ, রাজনৈতিক কর্মী, সর্বস্তরের শিক্ষকসহ নানা বয়সী ও শ্রেণীপেশার মানুষ। কলেজ, ইউনিভার্সিটিপড়–য়া এক শ্রেণীর বর্বর ছেলেরাও ধর্ষণ করে চলেছে অসহায় শিশুদের। নিকটাত্মীয়, পরিবারের সদস্য, সহকর্মী, যানবাহনের চালক-সহকারী, এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, শিক্ষকের নাম উঠে আসছে ধর্ষকের তালিকায়। বিগত বছরেও দেশে শিশু ধর্ষণের চিত্র ছিল ভয়াবহ। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালে ৩৫৬ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে নিহত হয়েছে ২২ জন শিশু। ৫৩ জন শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ২৬৯ বেসরকারি সংস্থার প্ল্যাটফর্ম ‘বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম’এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৮ সালের প্রথম তিনমাসে ১৭৬ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে যা ১৯১৭ সালের তুলনায় ১৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয় ২০ জন। ধর্ষণের দুঃখে আত্মহত্যা করে ৩ শিশু। এছাড়াও ৮ জন প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। মাত্র তিন মাসে ২১ শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা, ৮ জনকে ইভটিজিং, ২৩ জনকে যৌন হয়রানি এবং ৩ শিশুকে পর্নোগ্রাফির শিকার হতে হয়।

লক্ষ্য করে দেখা যায়, দরিদ্র পরিবারের এবং শ্রমজীবী মা-বাবার শিশুরাই ধর্ষণের শিকার বেশি হচ্ছে। এ ধরনের পরিবারের শিশুরা বাবা-মায়ের অনুপস্থিতিতে এক শ্রেণীর লোকের টার্গেটে পরিণত হয়। শিশুদের ওপর বলপ্রয়োগ করে, ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ করা সহজ। কর্মজীবী শিশু, গৃহকর্মীরা ধর্ষণের বেশি ঝুঁকিতে থাকে। এমনকি ওদের দিয়ে পর্নোগ্রাফি তৈরি করাও সহজ। ধর্ষক হয়ে কেউ জন্মায় না, তবে এত ধর্ষক কী করে তৈরি হয়? এ সমাজে খেয়ে পরে কেমন করে তারা বেড়ে ওঠে! সামাজিক অসহিষ্ণুতাই শিশুর প্রতি এমন অমানবিক আচরণের প্রধান কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন বিশেষজ্ঞরা। যে বয়সে সমাজের প্রতিটি শিশু মানুষের স্নেহ-ভালোবাসা, আদর-যত্ন পেয়ে বেড়ে ওঠার কথা সেই বয়সে তারা হচ্ছে জিঘাংসার বলি। বর্তমান সময়ে নগর জীবনের ব্যস্ততার কারণে মা-বাবা তার সন্তানকে বঞ্চিত করছেন স্নেহ-আদর-ভালোবাসা, উপযুক্ত শাসন থেকে। দাদা-দাদি, চাচা-চাচির মতো নিকটাত্মীয়ের সান্নিধ্যবঞ্চিত শিশু-কিশোর ঘরের মাঝে একাকীত্বে ভোগে। শিশু-কিশোরের মনোজগতে বিশাল শূন্যতা বাসা বাঁধে। তারা খুঁজে নেয় বাইরের এক অচেনা-অজানা জগৎ। সেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিপথগামী বন্ধু-বান্ধবের সংস্পর্শে এসে ধীরে ধীরে ধর্ষণের মতো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। মাদকের অবাধ বিস্তার ধর্ষণের মতো অপরাধ বাড়িয়ে তুলতে সরাসরি প্রভাব ফেলছে। আকাশ সংস্কৃতি ও তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ এবং এর অপব্যবহার শিশু-কিশোরের চরিত্রের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। দেশে কোথাও সুস্থ বিনোদনের সুযোগ নেই বলে অবসরে কখনো ইন্টারনেটে অশ্লীল ছবি, ভিডিও দেখে এবং ফেসবুকে বখে-যাওয়া বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগের অবাধ সুযোগে শিশু-কিশোররা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড দেখে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষাঙ্গনে সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা ও খেলাধুলার ব্যবস্থা না থাকায় ঝুঁকে পড়ছে নানা নেশায় যা তাদের চরিত্র গঠনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ধর্ষণের সামাজিক ব্যাধি আজ মহামারি রূপ ধারণ করলেও বেশিরভাগ ধর্ষণের অপরাধ আড়ালে থেকে যাচ্ছে। সম্প্রতি ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্তদের দণ্ড প্রদান করে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন আদালত। শিশুকে যৌন নিপীড়নের মামলায় সিরাজগঞ্জের সদর উপজেলার এক ব্যক্তিকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে বহিষ্কার করেছে বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে, মীরসরাইয়ে এক প্রতিবন্ধী কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে তার নানা সম্পর্কের ৬০ বছর রয়সী বৃদ্ধকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দণ্ড দেওয়া হলেও কমছে না ধর্ষণের মতো সামাজিক অপরাধ। সাম্প্রতিক সময়ে শিশু ধর্ষণের ভয়াবহ বিস্তার রোধে শিশু ধর্ষণকারীকে কেন মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। রুলে ১৬ বছরের নিচে কেউ ভিকটিম হলে সেক্ষেত্রে ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রণয়ন করায় সরকারের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি হবে না, তা জানতে চেয়েছেন আদালত। ধর্ষণের ঘটনায় কারও মৃত্যু হলে সেক্ষেত্রে আইনে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি যাবজ্জীবন সাজার যে বিধান রয়েছে, সে যাবজ্জীবন সাজা উঠিয়ে দিতে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ হবে না, তা-ও জানতে চাওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, নারীদের স্বয়ংক্রিয় প্রতিরক্ষামূলক যন্ত্র অ্যান্টি রেপ ডিভাইস সরবরাহের বিষয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্টের অপর একটি বেঞ্চ। ধর্ষণ প্রতিরোধ ও ক্ষতিগ্রস্ত নারী ও শিশুদের সহায়তা দিতে এক মাসের মধ্যে কশিন গঠনের যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, উক্ত কমিশনকে আগামী ৬ মাসের মধ্যে আদালতে সুপারিশ দাখিল করতে বলা হয়েছে।

শিশু ধর্ষণ এবং শিশুর প্রতি যেকোনো ধরনের নির্যাতন থেকে পরিত্রাণ পেতে সামাজিক অস্থিরতা দূর করতে হবে। দেশে সুশিক্ষা ব্যবস্থা, সুস্থ সামাজিক পরিস্থিতি ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ধারা ফিরিয়ে আনতে হবে। নিম্নবিত্তের কর্মজীবী নারীদের ঘরে তাদের সন্তানদের সুরক্ষা দিতে হবে। কর্মস্থলে শিশু-কিশোরীরা ধর্ষণের শিকার হয়, তাই শিশুদের কর্মে নিয়োগ বন্ধ করে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা নিতে হবে। রাস্তাঘাটে, যানবাহনে শিশু ও নারীর নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে তৎপর হতে হবে। পর্ন সাইট ও বিদেশি চ্যানেল যেখানে সহিংসতার ঘটনা দেখানো হয় তা বন্ধ করতে হবে। গাড়ি চালকদের ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি প্রতিরোধে বিআরটিএ-র মাধ্যমে বার্তা প্রদান এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সচেতনতামূলক ডকুমেন্টারি গ্রাম পর্যায়ে প্রদর্শনের ব্যবস্থা নিয়ে ধর্ষককে সামাজিকভাবে প্রতিহত করতে হবে। ধর্ষিতা ও তার পরিবারকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আইনী সহায়তা দিতে হবে। বাংলাদেশে ধর্ষণের শাস্তির জন্য যে আইনী বিধান রয়েছে তাতে ধর্ষিতাকে ধর্ষণের প্রমাণ করতে হয়। আলামত সংগ্রহ এবং যেসব পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ধর্ষিতাকে যেতে হয় তাও কঠিন। ধর্ষণের ব্যাপারে ধর্ষিতাকে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদও শিশু ও নারীর জন্য পীড়াদায়ক। ধর্ষণের মামলায় অনেকক্ষেত্রে প্রশাসনের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব ধর্ষণের সুষ্ঠু বিচারে বাধা হয়ে দাঁড়ায় যা পক্ষান্তরে ধর্ষণের বিস্তার ঘটায়। মামলার দীর্ঘসূত্রিতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতিও ধর্ষণকে উৎসাহিত করে। শিশু ধর্ষণের ঘটনার ভয়াবহতাকে জাতীয় সংকট হিসাবে বিবেচনায় করে দ্রুত সম্ভব অপরাধীদের গ্রেফতার ও বিচার সম্পন্ন করতে হবে। ধর্ষককে নিরাপরাধ প্রমাণ করতে হলে ধর্ষিতার ওপর শারীরিক ও মানসিক চাপ কমবে। ধর্ষণের ব্যাপারে রাষ্ট্রের শূন্যসহিষ্ণুতা নীতি গ্রহণ এবং ধর্ষণ প্রতিরোধে জাতীয় কর্মসূচি গ্রহণসহ শিশু ধর্ষণ ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধে আদালত কমিশন গঠনের যে নির্দেশ দিয়েছেন সেটা দ্রুত বাস্তবায়িত করতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে এ ব্যাপারে দ্রুততম সময়ে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। শিশু ও নারী ধর্ষণ প্রতিরোধে আইনের কঠোর প্রয়োগ ও দ্রুত বিচার নিশ্চিতের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক]