কমিটেড ও দক্ষ শিক্ষকরাই পারেন

গোলাম রহমান চৌধুরী

‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’ কথাটি ছোট বেলা থেকেই শুনে আসছি। মনীষীরা তাই বলেন “যে জাতি শিক্ষা দীক্ষায় যত উন্নত সে জাতি ততটাই এগিয়ে”। এ শিক্ষার মূল ভিত্তিই হলো প্রাথমিক শিক্ষা। বর্তমান সরকার শিক্ষাবান্ধব সরকার এ কথা অনস্বীকার্য। বর্তমান সরকারের আন্তরিকতায় প্রতিটি বিদ্যালয়ের নান্দনিকতার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি বিদ্যালয়ে চালু হয়েছে মিড ডে মিল। এখন প্রতিটি শিশুই তার মায়ের দেয়া খাবার নিয়ে বিদ্যালয়ে যায়। এ শিশুদের দক্ষ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে চাই দক্ষ শিক্ষক। একমাত্র মেধাবীরাই পারে এ কোমলমতি শিশুদের দক্ষ জাতি গঠনের স্বপ্ন দেখাতে। শিক্ষার মূল ভিত্তি হলো প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষা মজবুত না হলে মাধ্যমিক, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা সফল হবে না। তাই শিক্ষার মূল ভিত্তি প্রাথমিক শিক্ষাকে মজবুত করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন মেধাবি, যোগ্যতা সম্পন্ন ও দক্ষ শিক্ষক। শিক্ষকের যথাযথ বেতন ও মর্যাদা দেয়ার মাধ্যমেই শুধু এসব মেধাবী যোগ্যতাসম্পন্ন ও দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ করা সম্ভব। তা হলেই সবার জন্য মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষার স্বপ্নপূরণ হবে। সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিতকরণে সাংবিধানিক ও আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ বাধ্যবাধকতা মানতেও প্রাথমিক শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো উচিত। বলা হয়ে থাকে- যে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বেশি সে দেশ তত উন্নত। প্রাথমিক স্তরের প্রতিটি শিশুই দেশের সম্পদ। এ সব শিশুকে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে মানসম্মত শিক্ষার বিকল্প হিসেবে বিদ্যালয়কে আকর্ষণীয় ও উন্নত হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদানকে আধুনিক পদ্ধতি, কৌশল ও আকর্ষণীয় শিক্ষা উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে আরও কার্যকর করা দরকার। প্রতিটি শিশুকে দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানানো প্রায়োজন। ধর্মীয়, নৈতিক ও উন্নত চারিত্রিক গুণাবলি অর্জনে সহায়তা করা। এক্ষেত্রে শিক্ষক, বাব-মা, অভিভাবক, শিক্ষা ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা ও জনপ্রতিনিধিগণ উদ্যোমী হওয়া প্রয়োজন। বর্তমান যুগে একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো জাতির অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য ও প্রত্যাশা পূরণের উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা।

বাংলাদেশ ২০২০-২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার যে লক্ষ্য স্থির করেছে মানসম্মত শিক্ষা ছাড়া সেটি অর্জন সম্ভব নয়। বিশ্ব ব্যাংক কর্তৃক ২০১৩ সালে প্রকাশিত একটি নীতি পর্যালোচনাপত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হাজির করেছে। এতে বলা হয়েছে, শ্রমশক্তির ৯৬ শতাংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিকের চেয়ে কম, দুই তৃতীয়াংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিকের চেয়ে কম; দুই তৃতীয়াংশের প্রাথমিকের চেয়ে কম। প্রাথমিক পাশ শ্রমশক্তির মাত্র এক তৃতীয়াংশের গণনা ও স্বাক্ষরতায় প্রত্যাশিত জ্ঞান রয়েছে। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে জোরালো সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধে বলীয়ান শিক্ষাও নিশ্চিত করতে হবে, যাতে শিশুর সার্বিক কল্যাণ বলতে জাতি ধর্ম-বর্ণ লিঙ্গ নির্বিশেষে সবার জন্য সমতাভিত্তিক অধিকার ও কল্যাণের ধারণাটি আত্মস্থ করতে সক্ষম হয়। গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের বৈচিত্র্যময় আর্থসামাজিক অবস্থা বিশেষ বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন এবং আদর্শ অনুপাতে শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষকের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও বাড়তি সহায়তা প্রয়োজন কি না- তা ভেবে দেখা জরুরি। ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমল তো বটেই, এমনকি দুই আড়াই দশক আগের তুলনায় এ বৈচিত্র্য এখন অনেক বেশি। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্রছাত্রীদের একটি অংশের অভিভাবকের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। আরেকটি অংশের বাবা-মায়েরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গেছেন। বাকি একটি অংশ আসছে এমন পরিবার থেকে যাদের বাবা মা প্রাথমিক পরবর্তী শিক্ষায় শিক্ষিত। বিভিন্ন আর্থসামাজিক পরিস্থিতি থেকে আসা ছাত্রছাত্রী যাতে শ্রেণীকক্ষে একটি সমধারা/ অভিন্ন ধারার পরিবেশে জ্ঞানার্জন করতে পারে তা শিক্ষককে নিশ্চিত করতে হয়। শিক্ষক যাতে সেই ভূমিকা পালন করতে পারেন সেজন্য তার উপযুক্ত প্রশিক্ষণ থাকা প্রয়োজন। অন্যদিকে, এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের প্রতি যে বাড়তি মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন তা সহায়ক শিক্ষকের মাধ্যমে নিশ্চিত করা যেতে পারে। মানসম্মত শিক্ষাদানে শিক্ষক প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। সরকারের প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (পিটিআই) সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শিক্ষক প্রশিক্ষণে ভূমিকা পালন করছে সত্য, তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও উদ্ভাবন চলছে তা পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ আমাদের শিক্ষকদের কতটুকু? আমাদের দেশে চিকিৎসা, প্রকৌশল, স্থাপত্য, গবেষণা ইত্যাদি পেশায় জড়িতদের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের যে সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে শিক্ষকদের জন্য তা তৈরি হয়েছে কি? আবার পেশাগত উৎকর্ষ সাধনের সঙ্গে ব্যক্তির মর্যাদা বৃদ্ধির বিষয়টি অঙ্গাঙ্গি জড়িত যার সুযোগ শিক্ষকদের জন্য অত্যন্ত সীমিত। এর ফলে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী এ পেশায় আসতে আগ্রহ বোধ করছেন না। কাজের স্বীকৃতি যে কোন পেশার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ব্যক্তির পেশাগত উৎকর্ষ সাধনে তা অনুপ্রেরণা জোগায়। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে বছরের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের স্কীকৃতির বিদ্যমান সরকারি ব্যবস্থাটিকে এজন্য আরও উদ্ভাবনমূলক ও প্রসারিত করা প্রয়োজন। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা আজ অনেকখানি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। প্রাইভেট টিউশনির দাপট, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ার ঝোঁক, শূন্য শিক্ষকপদ, শিক্ষকমণ্ডলীরও আন্তরিকতার অভাব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিকাঠামো, শিক্ষক-শিক্ষিকার শিক্ষণ পরিবেশের অভাব এবং এ কারণে গুণমানের অভাব থাকলে শিক্ষিত হবার ক্ষেত্রটি থেকে যায় সঙ্কুচিত।

শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয়, তবে শিক্ষকবৃন্দ সে মেরুদণ্ডের স্রষ্টা। গোটা মানুষ্য সমাজের মধ্যে নৈতিক বিচারে শিক্ষকদের চেয়ে সম্মানিত ও শিক্ষকতার চেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পেশা আর একটিও নেই। শিক্ষকরা সমাজের প্রাণ। দেশ-জাতি-সমাজ-রাষ্ট্রের দুঃসময়ে সবার চেতনার উন্মেষ ঘটিয়ে জাতিমুক্তির কাণ্ডারি হিসেবে শিক্ষক সমাজ গুরুদায়িত্ব পালন করে আসছে। তাই পৃথিবীর যত সম্মানজনক পেশা আছে, তার মধ্যে শিক্ষকতা সর্বোচ্চ সম্মানিত পেশা।

সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও শিক্ষকতা একটি মহান পেশা হিসেবে স্বীকৃত। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মানসম্মত শিক্ষা। বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফল, পাসের আধিক্য থাকলেও গুণগত মান নিয়ে সংশয় রয়েছে। তাই মানসম্মত শিক্ষাদানের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও ক্ষমতাসম্পন্ন শিক্ষক দ্বারা সব শিক্ষা দান নিশ্চিত করা জরুরি। মানসম্মত শিক্ষার মূল উপাদান হচ্ছে- মানসম্মত শিক্ষক, মানসম্মত শিক্ষার উপকরণ ও মানসম্মত পরিবেশ। শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দই শিক্ষার্থীদের রোল মডেল। তাই শিক্ষকদের আউট ফিট হওয়া উচিত সে রকমই। কিন্তু আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকলে সেদিকে শিক্ষকদের নজর দেয়া সম্ভব হয় না। সরকার ইতোমধ্যে কিছুটা পদক্ষেপ নিয়েছে, এতে শিক্ষকদের জীবনযাত্রার মান কিছুটা বাড়লেও তা যথেষ্ট নয়। শিক্ষকরা জাতি গঠনে ভূমিকা রাখেন। আর এ কারণে এ পেশায় আরও মেধাবীদের আসা উচিত। কিন্তু মেধাবীরা তো সচ্ছল জীবনযাপন করতে চায়। পেশায় এসে যদি সেটা না পায়, তাহলে আসবে কেন? শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের অন্তর্ভুক্তি অত্যন্ত জরুরি। যোগ্যতা ও অবদান অনুযায়ী শিক্ষকদের মূল্যায়ন হওয়া উচিত। তা না হলে যতই বেতন বৃদ্ধি বা কারিকুলাম বদল করা হোক, কোন লাভ হবে না। প্রতি বছর বই বদল হচ্ছে, ভুল বই বের হচ্ছে। এর ফলে শিক্ষার লক্ষ্যটা প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। শিক্ষকদের প্রয়োজন উপযুক্ত প্রশিক্ষণ। কিন্তু প্রশিক্ষণের নামে উপহাস প্রশিক্ষণই হচ্ছে, তাতে যোগ্য শিক্ষক তৈরি হয় না। অথচ শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে যোগ্য শিক্ষক দরকার। সর্বাগ্রে প্রয়োজন শিক্ষকদের আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলা। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভবিষ্যৎ বিশ্বে ১১টি উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তির একটি বাংলাদেশ। কিন্তু তাদের শঙ্কা শুধু শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার কারণে অনেক প্রতিশ্রুতির সেই ভবিষ্যৎ মিথ্যা হয়ে যেতে পারে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাই আমাদের উদ্যোগী হতে হবে এবং তা এখনই।

সুতরাং দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে মানসম্মত শিক্ষা আর মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে উপযুক্ত শিক্ষা আবশ্যক। আর শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে যথার্থ সম্মান এবং সম্মানীর সু-ব্যবস্থা করতে রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

khabarica@gmail.com

সোমবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ২৭ মাঘ ১৪২৬, ১৫ জমাদিউল সানি ১৪৪১

কমিটেড ও দক্ষ শিক্ষকরাই পারেন

গোলাম রহমান চৌধুরী

‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’ কথাটি ছোট বেলা থেকেই শুনে আসছি। মনীষীরা তাই বলেন “যে জাতি শিক্ষা দীক্ষায় যত উন্নত সে জাতি ততটাই এগিয়ে”। এ শিক্ষার মূল ভিত্তিই হলো প্রাথমিক শিক্ষা। বর্তমান সরকার শিক্ষাবান্ধব সরকার এ কথা অনস্বীকার্য। বর্তমান সরকারের আন্তরিকতায় প্রতিটি বিদ্যালয়ের নান্দনিকতার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি বিদ্যালয়ে চালু হয়েছে মিড ডে মিল। এখন প্রতিটি শিশুই তার মায়ের দেয়া খাবার নিয়ে বিদ্যালয়ে যায়। এ শিশুদের দক্ষ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে চাই দক্ষ শিক্ষক। একমাত্র মেধাবীরাই পারে এ কোমলমতি শিশুদের দক্ষ জাতি গঠনের স্বপ্ন দেখাতে। শিক্ষার মূল ভিত্তি হলো প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষা মজবুত না হলে মাধ্যমিক, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা সফল হবে না। তাই শিক্ষার মূল ভিত্তি প্রাথমিক শিক্ষাকে মজবুত করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন মেধাবি, যোগ্যতা সম্পন্ন ও দক্ষ শিক্ষক। শিক্ষকের যথাযথ বেতন ও মর্যাদা দেয়ার মাধ্যমেই শুধু এসব মেধাবী যোগ্যতাসম্পন্ন ও দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ করা সম্ভব। তা হলেই সবার জন্য মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষার স্বপ্নপূরণ হবে। সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিতকরণে সাংবিধানিক ও আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ বাধ্যবাধকতা মানতেও প্রাথমিক শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো উচিত। বলা হয়ে থাকে- যে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বেশি সে দেশ তত উন্নত। প্রাথমিক স্তরের প্রতিটি শিশুই দেশের সম্পদ। এ সব শিশুকে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে মানসম্মত শিক্ষার বিকল্প হিসেবে বিদ্যালয়কে আকর্ষণীয় ও উন্নত হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদানকে আধুনিক পদ্ধতি, কৌশল ও আকর্ষণীয় শিক্ষা উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে আরও কার্যকর করা দরকার। প্রতিটি শিশুকে দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানানো প্রায়োজন। ধর্মীয়, নৈতিক ও উন্নত চারিত্রিক গুণাবলি অর্জনে সহায়তা করা। এক্ষেত্রে শিক্ষক, বাব-মা, অভিভাবক, শিক্ষা ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা ও জনপ্রতিনিধিগণ উদ্যোমী হওয়া প্রয়োজন। বর্তমান যুগে একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো জাতির অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য ও প্রত্যাশা পূরণের উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা।

বাংলাদেশ ২০২০-২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার যে লক্ষ্য স্থির করেছে মানসম্মত শিক্ষা ছাড়া সেটি অর্জন সম্ভব নয়। বিশ্ব ব্যাংক কর্তৃক ২০১৩ সালে প্রকাশিত একটি নীতি পর্যালোচনাপত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হাজির করেছে। এতে বলা হয়েছে, শ্রমশক্তির ৯৬ শতাংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিকের চেয়ে কম, দুই তৃতীয়াংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিকের চেয়ে কম; দুই তৃতীয়াংশের প্রাথমিকের চেয়ে কম। প্রাথমিক পাশ শ্রমশক্তির মাত্র এক তৃতীয়াংশের গণনা ও স্বাক্ষরতায় প্রত্যাশিত জ্ঞান রয়েছে। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে জোরালো সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধে বলীয়ান শিক্ষাও নিশ্চিত করতে হবে, যাতে শিশুর সার্বিক কল্যাণ বলতে জাতি ধর্ম-বর্ণ লিঙ্গ নির্বিশেষে সবার জন্য সমতাভিত্তিক অধিকার ও কল্যাণের ধারণাটি আত্মস্থ করতে সক্ষম হয়। গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের বৈচিত্র্যময় আর্থসামাজিক অবস্থা বিশেষ বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন এবং আদর্শ অনুপাতে শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষকের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও বাড়তি সহায়তা প্রয়োজন কি না- তা ভেবে দেখা জরুরি। ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমল তো বটেই, এমনকি দুই আড়াই দশক আগের তুলনায় এ বৈচিত্র্য এখন অনেক বেশি। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্রছাত্রীদের একটি অংশের অভিভাবকের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। আরেকটি অংশের বাবা-মায়েরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গেছেন। বাকি একটি অংশ আসছে এমন পরিবার থেকে যাদের বাবা মা প্রাথমিক পরবর্তী শিক্ষায় শিক্ষিত। বিভিন্ন আর্থসামাজিক পরিস্থিতি থেকে আসা ছাত্রছাত্রী যাতে শ্রেণীকক্ষে একটি সমধারা/ অভিন্ন ধারার পরিবেশে জ্ঞানার্জন করতে পারে তা শিক্ষককে নিশ্চিত করতে হয়। শিক্ষক যাতে সেই ভূমিকা পালন করতে পারেন সেজন্য তার উপযুক্ত প্রশিক্ষণ থাকা প্রয়োজন। অন্যদিকে, এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের প্রতি যে বাড়তি মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন তা সহায়ক শিক্ষকের মাধ্যমে নিশ্চিত করা যেতে পারে। মানসম্মত শিক্ষাদানে শিক্ষক প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। সরকারের প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (পিটিআই) সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শিক্ষক প্রশিক্ষণে ভূমিকা পালন করছে সত্য, তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও উদ্ভাবন চলছে তা পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ আমাদের শিক্ষকদের কতটুকু? আমাদের দেশে চিকিৎসা, প্রকৌশল, স্থাপত্য, গবেষণা ইত্যাদি পেশায় জড়িতদের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের যে সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে শিক্ষকদের জন্য তা তৈরি হয়েছে কি? আবার পেশাগত উৎকর্ষ সাধনের সঙ্গে ব্যক্তির মর্যাদা বৃদ্ধির বিষয়টি অঙ্গাঙ্গি জড়িত যার সুযোগ শিক্ষকদের জন্য অত্যন্ত সীমিত। এর ফলে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী এ পেশায় আসতে আগ্রহ বোধ করছেন না। কাজের স্বীকৃতি যে কোন পেশার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ব্যক্তির পেশাগত উৎকর্ষ সাধনে তা অনুপ্রেরণা জোগায়। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে বছরের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের স্কীকৃতির বিদ্যমান সরকারি ব্যবস্থাটিকে এজন্য আরও উদ্ভাবনমূলক ও প্রসারিত করা প্রয়োজন। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা আজ অনেকখানি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। প্রাইভেট টিউশনির দাপট, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ার ঝোঁক, শূন্য শিক্ষকপদ, শিক্ষকমণ্ডলীরও আন্তরিকতার অভাব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিকাঠামো, শিক্ষক-শিক্ষিকার শিক্ষণ পরিবেশের অভাব এবং এ কারণে গুণমানের অভাব থাকলে শিক্ষিত হবার ক্ষেত্রটি থেকে যায় সঙ্কুচিত।

শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয়, তবে শিক্ষকবৃন্দ সে মেরুদণ্ডের স্রষ্টা। গোটা মানুষ্য সমাজের মধ্যে নৈতিক বিচারে শিক্ষকদের চেয়ে সম্মানিত ও শিক্ষকতার চেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পেশা আর একটিও নেই। শিক্ষকরা সমাজের প্রাণ। দেশ-জাতি-সমাজ-রাষ্ট্রের দুঃসময়ে সবার চেতনার উন্মেষ ঘটিয়ে জাতিমুক্তির কাণ্ডারি হিসেবে শিক্ষক সমাজ গুরুদায়িত্ব পালন করে আসছে। তাই পৃথিবীর যত সম্মানজনক পেশা আছে, তার মধ্যে শিক্ষকতা সর্বোচ্চ সম্মানিত পেশা।

সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও শিক্ষকতা একটি মহান পেশা হিসেবে স্বীকৃত। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মানসম্মত শিক্ষা। বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফল, পাসের আধিক্য থাকলেও গুণগত মান নিয়ে সংশয় রয়েছে। তাই মানসম্মত শিক্ষাদানের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও ক্ষমতাসম্পন্ন শিক্ষক দ্বারা সব শিক্ষা দান নিশ্চিত করা জরুরি। মানসম্মত শিক্ষার মূল উপাদান হচ্ছে- মানসম্মত শিক্ষক, মানসম্মত শিক্ষার উপকরণ ও মানসম্মত পরিবেশ। শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দই শিক্ষার্থীদের রোল মডেল। তাই শিক্ষকদের আউট ফিট হওয়া উচিত সে রকমই। কিন্তু আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকলে সেদিকে শিক্ষকদের নজর দেয়া সম্ভব হয় না। সরকার ইতোমধ্যে কিছুটা পদক্ষেপ নিয়েছে, এতে শিক্ষকদের জীবনযাত্রার মান কিছুটা বাড়লেও তা যথেষ্ট নয়। শিক্ষকরা জাতি গঠনে ভূমিকা রাখেন। আর এ কারণে এ পেশায় আরও মেধাবীদের আসা উচিত। কিন্তু মেধাবীরা তো সচ্ছল জীবনযাপন করতে চায়। পেশায় এসে যদি সেটা না পায়, তাহলে আসবে কেন? শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের অন্তর্ভুক্তি অত্যন্ত জরুরি। যোগ্যতা ও অবদান অনুযায়ী শিক্ষকদের মূল্যায়ন হওয়া উচিত। তা না হলে যতই বেতন বৃদ্ধি বা কারিকুলাম বদল করা হোক, কোন লাভ হবে না। প্রতি বছর বই বদল হচ্ছে, ভুল বই বের হচ্ছে। এর ফলে শিক্ষার লক্ষ্যটা প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। শিক্ষকদের প্রয়োজন উপযুক্ত প্রশিক্ষণ। কিন্তু প্রশিক্ষণের নামে উপহাস প্রশিক্ষণই হচ্ছে, তাতে যোগ্য শিক্ষক তৈরি হয় না। অথচ শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে যোগ্য শিক্ষক দরকার। সর্বাগ্রে প্রয়োজন শিক্ষকদের আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলা। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভবিষ্যৎ বিশ্বে ১১টি উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তির একটি বাংলাদেশ। কিন্তু তাদের শঙ্কা শুধু শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার কারণে অনেক প্রতিশ্রুতির সেই ভবিষ্যৎ মিথ্যা হয়ে যেতে পারে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাই আমাদের উদ্যোগী হতে হবে এবং তা এখনই।

সুতরাং দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে মানসম্মত শিক্ষা আর মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে উপযুক্ত শিক্ষা আবশ্যক। আর শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে যথার্থ সম্মান এবং সম্মানীর সু-ব্যবস্থা করতে রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

khabarica@gmail.com