খেলাপিদের ছাড় সঞ্চয়কারীদের ধর

সামসুল ইসলাম টুকু

আমজনতার গচ্ছিত টাকা এক শ্রেণীর মানুষ ঋণ হিসেবে গ্রহণ করে ব্যবসা-বাণিজ্য করে, গাড়ি-বাড়ি সম্পদ তৈরি করে। তারপরে সে ঋণের টাকা আর ফেরত দেয় না এদেরকেই ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। গত এক দশক ধরে এ ঋণখেলাপিদের সঙ্গে ব্যাংকার ও সরকারের তীব্র স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। পত্রপত্রিকায় বেশ ঝড় উঠেছে। যদিও তারা প্রায় দুই যুগ ধরেই ঋণখেলাপি। একাদশ জাতীয় সংসদের ষষ্ঠ অধিবেশনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের দেয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৬ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা এবং খেলাপি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮ হাজার ২৩৮। গত বছর অবশ্য অর্থমন্ত্রী ৩০০ জন ঋণখেলাপির তালিকা দিয়েছেন। হয়তো তারা শীর্ষ ঋণ খেলাপি এবং তাদের কারও খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ কোটি টাকার কম নয়। দৈনিক সংবাদের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে অন্যায় সুবিধা পেয়ে পেয়ে বেড়েই চলেছে খেলাপি ঋণ। বড় বড় খেলাপিদের সরকার অন্যায় সুযোগ দিয়েছে।

সুযোগগুলো- ব্যাংকিং নিয়ম অনুযায়ী ঋণগ্রহীতা বছর শেষে ঋণের পুরো টাকা ১ দিনের জন্য হলেও জমা দিয়ে বা অ্যাডজাস্ট করে ঋণ নবায়ন করতে পারবেন। এরপর তা কমতে কমতে ২৫ শতাংশ ঋণের টাকা জমা দিয়ে নবায়ন করতে পারবে। সে ক্ষেত্রেও দেখা যায় ২৫ শতাংশ অর্থ জমা না দিয়েই ঋণ নবায়ন করে নিচ্ছে। এ চর্চা চলছে দু’যুগ ধরে। এ অপচর্চার জন্য ব্যাংকাররা না ঋণখেলাপি না উভয়পক্ষই দায়ী এ বিষয়টি চিহ্নিত না করার কারণে। খেলাপি ঋণ গাণিতিক হারে বেড়ে চলেছে। হালে তথা গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংক নিরুপায় হয়ে মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ পুনঃতফশিলিকরণের সুযোগ দিয়েছে। গত বছরই এজন্য ৫ দফা সময় বাড়িয়েছে। শুধু তাই নয় পুনঃতফশিল করা গ্রাহক যেন ব্যাংক থেকে আরও ঋণ পেতে পারে এজন্য সে নীতিমালাও শিথিল করা হয়েছে তাদের প্রথম এক বছর কোন কিস্তি দিতে হবে না। আর চিহ্নিত ঋণ খেলাপিদের সুদ দিতে হবে ৯ শতাংশের কম। ২ লাখ টাকা অবলেপনের জন্য কোন মামলা হবে না। কোন কোন ব্যাংক তাদের পারফরম্যান্স ভালো দেখানোর জন্য খেলাপিকেও খেলাপি হিসাব করেনি, আড়াল করেছে এমন ঘটনাও আছে। যেসব খেলাপি ঋণ মন্দমানের খেলাপি ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু কেউই বাংলাদেশের এসব নীতিমালা বা সুযোগ গ্রহণ করেনি। বরং নামমাত্র ডাউনপেমেন্ট দিয়ে নবায়ন করা হয়েছে। আবার প্রভাবশালী হলে ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই নবায়ন করা হয়েছে। ঋণখেলাপিদের সম্পর্কে এমন মতামতও দেয়া হয়েছে যে ঋণখেলাপিদের জেলে দিলে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়তে পারে। অর্থাৎ সব সুযোগ সুবিধা দেয়া সত্ত্বেও এবং যে সব শর্তে ঋণ গ্রহণ করেছিল তা ভঙ্গ করলেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তথা সরকার কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি।

অন্যদিকে ঠিক এর বিপরীত আচরণ করা হচ্ছে যারা সরকারের বিভিন্ন খাতে কোটি কোটি টাকা গচ্ছিত রাখে তাদের সঙ্গে। যে আমজনতা তাদের ঘামে ভেজা সঞ্চিত টাকা দিয়ে সরকারের কোষাগারকে স্ফীত করছে তাদের সঙ্গেই বিমাতাসুলভ আচরণ করা হচ্ছে। গত বছর থেকেই সঞ্চয়পত্রের ওপর খ—গহস্ত হয়েছে সরকার। প্রথমে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো হয়েছে ২ শতাংশ। এরপর জুলাই থেকে উৎসে কর ৫ শতাংশ এর স্থলে ১০ শতাংশ হারে কাটা হয়েছে। এতেও সঞ্চয়পত্র ক্রেতারা হাল ছাড়েননি। সঞ্চয়পত্র কেনা অব্যাহত রেখেছিলেন। এরপর নতুন শর্ত চাপানো হলো সঞ্চয়পত্র কিনলেই আয়কর অফিস থেকে টিআইএন সংগ্রহ করতে হবে বাধ্যতামূলকভাবে। শুধু তাই নয় সঞ্চয়পত্র কিনতে নগদ টাকা নেয়া হবে না। নিজ অ্যাকাউন্ট থেকে চেক দিতে হবে। এ দুটি শর্ত পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না প্রায় ৭০ ভাগ সঞ্চয়পত্র ক্রয়কারীদের পক্ষে। বিশেষত মহিলাদের পক্ষে। কারণ তাদের না আছে টিআইএন না আছে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। ভবিষ্যতের তহবিল বা প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থ দিয়ে সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে না। যদি কিনতেও হয় তাহলে কর কমিশনারের প্রত্যয়নপত্র বাধ্যতামূল এবং কৃষি খামারের নামে সঞ্চয়পত্র কিনলে উপকর কমিশনারের প্রত্যয়ন লাগবে। এরপর আয়কর বিভাগ থেকে হুমকি দেয়া হলো সারা দেশে নতুন করে ৪৮ লাখ টিআইএনধারী হয়েছে। তাদের প্রত্যেকেই আয়কর অফিসে ডাকা হবে এবং তাদের সম্পদের হিসাব বিবরণী বা রিটার্ন দাখিল করতে বলা হবে। এরপর আরও একটি শর্ত জুড়ে দেয়া হলো সঞ্চয়পত্রে উৎসে কর দিলেও আয়কর আদায়ের ক্ষেত্রে সেটা মাফ করা হবে না। আয়কর বিভাগ বলছে, এসব শর্ত প্রত্যেকের সম্পদের স্বচ্ছতা আনার জন্য জরুরি। অন্যদিকে পত্রিকায় প্রকাশ মাত্র ২০ জন শীর্ষ ঋণখেলাপির হাতে মোট খেলাপি ঋণের ৪৭ ভাগ রয়েছে। এক্ষেত্রে ঋণখেলাপিদের খেলাপি অর্থ আদায়ে সরকারকে কঠোর হতে হবে। তেমনি তাদের কাছ থেকে আয়কর আদায় নিশ্চিত করতে হবে আয়কর বিভাগকে। অন্যথায় তা দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন না হয়ে হবে দুষ্টের পালন শিষ্টের দমন। পরিচিতি এমনই মনে হচ্ছে সরকার প্রকারান্তরে সঞ্চয়কেই নিরুৎসাহিত করছে।

যাইহোক সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের ক্ষেত্রে যেসব শর্ত আরোপ করা হয়েছে তার মারাত্মক প্রভাব পড়েছে সঞ্চয়পত্র বিক্রির ক্ষেত্রে। পত্রিকার খবরে প্রকাশ চলতি অর্থ বছরের প্রথম ৫ মাসে বা জুলাই ১৯ থেকে নভেম্বর ১৯ পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র বিক্রি এসেছে ৫ হাজার ৮৪১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। যা গত বছর একই সময়ে বিক্রির পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে ৭৩ শতাংশ। এক সময় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ চালু হয়েছিল বিশেষ শ্রেণীকে সুবিধা দেয়ার জন্য। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, অবসরভোগী ও নারী বিনিয়োগকারীদের রাষ্ট্র পক্ষে কিছু সুযোগ দিতেই এবং সে ক্ষেত্রে সুদের হারটাও করা হয়েছিল যে কোন ব্যাংকের সুদের হারের চেয়ে বেশি। উল্লেখ করা যেতে পারে বর্তমানে সঞ্চয়পত্র ক্রেতাদের প্রায় ৫০ ভাগই নারী। এজন্য সঞ্চয় প্রকল্পকে মানুষ বলে নারী প্রকল্প। গত ১০-১৫ বছর আগে থেকে প্রবাসী শ্রমিক ও কর্মীরা তাদের অর্জিত টাকা পাঠিয়ে আসছে তাদের স্ত্রী এবং মায়ের কাছে এবং স্ত্রী এবং মায়েরা ওই টাকা দিয়ে সঞ্চয়পত্র কেনে। এটি হচ্ছে একটি দিক। অন্যদিকটি হচ্ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রীত অর্থ সরকার বহুকাল ধরেই রিজার্ভ ফান্ড হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। খুবই জরুরি মুহূর্তে সরকার এই অর্থ রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে ব্যবহার করে। সেই টাকার সুদতো আম-জনতা পেতেই পারে। এ বিশেষ শ্রেণীটি ব্যাংকে যেতে রাজি নয়। কারণ একদিকে ব্যাংকের সুদের হার কম, টাকা নেয়ার সময় সুদের হার বাড়িয়ে বলা হয়। আর দেয়ার সময় সরকারের দোহাই দিয়ে সুদের হার কমিয়ে দেয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের অর্থ কর্তন করে, অ্যাকাউন্ট খুলতে কমপক্ষে এক ডজন সই লাগে এবং সময় লাগে অনেকক্ষণ। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে এ ধরনের জটিলতা নেই। তাছাড়া ব্যাংকতো এখন সরকারের নির্দেশে সুদের হার এক ডিজিটে নিয়ে আসছে। ফলে এ বিশেষ শ্রেণী ব্যাংকের ধারে কাছেও যাবে না। তাহলে এ বিশেষ শ্রেণীটি তাদের সঞ্চিত অর্থ কি করবে। এমনটি একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এখন। তাছাড়া এই আমজনতার অর্থ সরকারে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োজিত ছিল। তা মারাত্মকভাবে হ্রাস পাবে। যা সরকারের জন্য সুখকর হবে বলে মনে হয় না।

তারিখ : ২৫-০১-২০২০

[লেখক : সাংবাদিক ]

মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ২৮ মাঘ ১৪২৬, ১৬ জমাদিউল সানি ১৪৪১

খেলাপিদের ছাড় সঞ্চয়কারীদের ধর

সামসুল ইসলাম টুকু

আমজনতার গচ্ছিত টাকা এক শ্রেণীর মানুষ ঋণ হিসেবে গ্রহণ করে ব্যবসা-বাণিজ্য করে, গাড়ি-বাড়ি সম্পদ তৈরি করে। তারপরে সে ঋণের টাকা আর ফেরত দেয় না এদেরকেই ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। গত এক দশক ধরে এ ঋণখেলাপিদের সঙ্গে ব্যাংকার ও সরকারের তীব্র স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। পত্রপত্রিকায় বেশ ঝড় উঠেছে। যদিও তারা প্রায় দুই যুগ ধরেই ঋণখেলাপি। একাদশ জাতীয় সংসদের ষষ্ঠ অধিবেশনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের দেয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৬ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা এবং খেলাপি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮ হাজার ২৩৮। গত বছর অবশ্য অর্থমন্ত্রী ৩০০ জন ঋণখেলাপির তালিকা দিয়েছেন। হয়তো তারা শীর্ষ ঋণ খেলাপি এবং তাদের কারও খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ কোটি টাকার কম নয়। দৈনিক সংবাদের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে অন্যায় সুবিধা পেয়ে পেয়ে বেড়েই চলেছে খেলাপি ঋণ। বড় বড় খেলাপিদের সরকার অন্যায় সুযোগ দিয়েছে।

সুযোগগুলো- ব্যাংকিং নিয়ম অনুযায়ী ঋণগ্রহীতা বছর শেষে ঋণের পুরো টাকা ১ দিনের জন্য হলেও জমা দিয়ে বা অ্যাডজাস্ট করে ঋণ নবায়ন করতে পারবেন। এরপর তা কমতে কমতে ২৫ শতাংশ ঋণের টাকা জমা দিয়ে নবায়ন করতে পারবে। সে ক্ষেত্রেও দেখা যায় ২৫ শতাংশ অর্থ জমা না দিয়েই ঋণ নবায়ন করে নিচ্ছে। এ চর্চা চলছে দু’যুগ ধরে। এ অপচর্চার জন্য ব্যাংকাররা না ঋণখেলাপি না উভয়পক্ষই দায়ী এ বিষয়টি চিহ্নিত না করার কারণে। খেলাপি ঋণ গাণিতিক হারে বেড়ে চলেছে। হালে তথা গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংক নিরুপায় হয়ে মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ পুনঃতফশিলিকরণের সুযোগ দিয়েছে। গত বছরই এজন্য ৫ দফা সময় বাড়িয়েছে। শুধু তাই নয় পুনঃতফশিল করা গ্রাহক যেন ব্যাংক থেকে আরও ঋণ পেতে পারে এজন্য সে নীতিমালাও শিথিল করা হয়েছে তাদের প্রথম এক বছর কোন কিস্তি দিতে হবে না। আর চিহ্নিত ঋণ খেলাপিদের সুদ দিতে হবে ৯ শতাংশের কম। ২ লাখ টাকা অবলেপনের জন্য কোন মামলা হবে না। কোন কোন ব্যাংক তাদের পারফরম্যান্স ভালো দেখানোর জন্য খেলাপিকেও খেলাপি হিসাব করেনি, আড়াল করেছে এমন ঘটনাও আছে। যেসব খেলাপি ঋণ মন্দমানের খেলাপি ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু কেউই বাংলাদেশের এসব নীতিমালা বা সুযোগ গ্রহণ করেনি। বরং নামমাত্র ডাউনপেমেন্ট দিয়ে নবায়ন করা হয়েছে। আবার প্রভাবশালী হলে ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই নবায়ন করা হয়েছে। ঋণখেলাপিদের সম্পর্কে এমন মতামতও দেয়া হয়েছে যে ঋণখেলাপিদের জেলে দিলে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়তে পারে। অর্থাৎ সব সুযোগ সুবিধা দেয়া সত্ত্বেও এবং যে সব শর্তে ঋণ গ্রহণ করেছিল তা ভঙ্গ করলেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তথা সরকার কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি।

অন্যদিকে ঠিক এর বিপরীত আচরণ করা হচ্ছে যারা সরকারের বিভিন্ন খাতে কোটি কোটি টাকা গচ্ছিত রাখে তাদের সঙ্গে। যে আমজনতা তাদের ঘামে ভেজা সঞ্চিত টাকা দিয়ে সরকারের কোষাগারকে স্ফীত করছে তাদের সঙ্গেই বিমাতাসুলভ আচরণ করা হচ্ছে। গত বছর থেকেই সঞ্চয়পত্রের ওপর খ—গহস্ত হয়েছে সরকার। প্রথমে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো হয়েছে ২ শতাংশ। এরপর জুলাই থেকে উৎসে কর ৫ শতাংশ এর স্থলে ১০ শতাংশ হারে কাটা হয়েছে। এতেও সঞ্চয়পত্র ক্রেতারা হাল ছাড়েননি। সঞ্চয়পত্র কেনা অব্যাহত রেখেছিলেন। এরপর নতুন শর্ত চাপানো হলো সঞ্চয়পত্র কিনলেই আয়কর অফিস থেকে টিআইএন সংগ্রহ করতে হবে বাধ্যতামূলকভাবে। শুধু তাই নয় সঞ্চয়পত্র কিনতে নগদ টাকা নেয়া হবে না। নিজ অ্যাকাউন্ট থেকে চেক দিতে হবে। এ দুটি শর্ত পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না প্রায় ৭০ ভাগ সঞ্চয়পত্র ক্রয়কারীদের পক্ষে। বিশেষত মহিলাদের পক্ষে। কারণ তাদের না আছে টিআইএন না আছে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। ভবিষ্যতের তহবিল বা প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থ দিয়ে সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে না। যদি কিনতেও হয় তাহলে কর কমিশনারের প্রত্যয়নপত্র বাধ্যতামূল এবং কৃষি খামারের নামে সঞ্চয়পত্র কিনলে উপকর কমিশনারের প্রত্যয়ন লাগবে। এরপর আয়কর বিভাগ থেকে হুমকি দেয়া হলো সারা দেশে নতুন করে ৪৮ লাখ টিআইএনধারী হয়েছে। তাদের প্রত্যেকেই আয়কর অফিসে ডাকা হবে এবং তাদের সম্পদের হিসাব বিবরণী বা রিটার্ন দাখিল করতে বলা হবে। এরপর আরও একটি শর্ত জুড়ে দেয়া হলো সঞ্চয়পত্রে উৎসে কর দিলেও আয়কর আদায়ের ক্ষেত্রে সেটা মাফ করা হবে না। আয়কর বিভাগ বলছে, এসব শর্ত প্রত্যেকের সম্পদের স্বচ্ছতা আনার জন্য জরুরি। অন্যদিকে পত্রিকায় প্রকাশ মাত্র ২০ জন শীর্ষ ঋণখেলাপির হাতে মোট খেলাপি ঋণের ৪৭ ভাগ রয়েছে। এক্ষেত্রে ঋণখেলাপিদের খেলাপি অর্থ আদায়ে সরকারকে কঠোর হতে হবে। তেমনি তাদের কাছ থেকে আয়কর আদায় নিশ্চিত করতে হবে আয়কর বিভাগকে। অন্যথায় তা দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন না হয়ে হবে দুষ্টের পালন শিষ্টের দমন। পরিচিতি এমনই মনে হচ্ছে সরকার প্রকারান্তরে সঞ্চয়কেই নিরুৎসাহিত করছে।

যাইহোক সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের ক্ষেত্রে যেসব শর্ত আরোপ করা হয়েছে তার মারাত্মক প্রভাব পড়েছে সঞ্চয়পত্র বিক্রির ক্ষেত্রে। পত্রিকার খবরে প্রকাশ চলতি অর্থ বছরের প্রথম ৫ মাসে বা জুলাই ১৯ থেকে নভেম্বর ১৯ পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র বিক্রি এসেছে ৫ হাজার ৮৪১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। যা গত বছর একই সময়ে বিক্রির পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে ৭৩ শতাংশ। এক সময় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ চালু হয়েছিল বিশেষ শ্রেণীকে সুবিধা দেয়ার জন্য। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, অবসরভোগী ও নারী বিনিয়োগকারীদের রাষ্ট্র পক্ষে কিছু সুযোগ দিতেই এবং সে ক্ষেত্রে সুদের হারটাও করা হয়েছিল যে কোন ব্যাংকের সুদের হারের চেয়ে বেশি। উল্লেখ করা যেতে পারে বর্তমানে সঞ্চয়পত্র ক্রেতাদের প্রায় ৫০ ভাগই নারী। এজন্য সঞ্চয় প্রকল্পকে মানুষ বলে নারী প্রকল্প। গত ১০-১৫ বছর আগে থেকে প্রবাসী শ্রমিক ও কর্মীরা তাদের অর্জিত টাকা পাঠিয়ে আসছে তাদের স্ত্রী এবং মায়ের কাছে এবং স্ত্রী এবং মায়েরা ওই টাকা দিয়ে সঞ্চয়পত্র কেনে। এটি হচ্ছে একটি দিক। অন্যদিকটি হচ্ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রীত অর্থ সরকার বহুকাল ধরেই রিজার্ভ ফান্ড হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। খুবই জরুরি মুহূর্তে সরকার এই অর্থ রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে ব্যবহার করে। সেই টাকার সুদতো আম-জনতা পেতেই পারে। এ বিশেষ শ্রেণীটি ব্যাংকে যেতে রাজি নয়। কারণ একদিকে ব্যাংকের সুদের হার কম, টাকা নেয়ার সময় সুদের হার বাড়িয়ে বলা হয়। আর দেয়ার সময় সরকারের দোহাই দিয়ে সুদের হার কমিয়ে দেয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের অর্থ কর্তন করে, অ্যাকাউন্ট খুলতে কমপক্ষে এক ডজন সই লাগে এবং সময় লাগে অনেকক্ষণ। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে এ ধরনের জটিলতা নেই। তাছাড়া ব্যাংকতো এখন সরকারের নির্দেশে সুদের হার এক ডিজিটে নিয়ে আসছে। ফলে এ বিশেষ শ্রেণী ব্যাংকের ধারে কাছেও যাবে না। তাহলে এ বিশেষ শ্রেণীটি তাদের সঞ্চিত অর্থ কি করবে। এমনটি একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এখন। তাছাড়া এই আমজনতার অর্থ সরকারে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োজিত ছিল। তা মারাত্মকভাবে হ্রাস পাবে। যা সরকারের জন্য সুখকর হবে বলে মনে হয় না।

তারিখ : ২৫-০১-২০২০

[লেখক : সাংবাদিক ]