মুজিব শাসন আমল : ১৯৭২

১৪ ফেব্রুয়ারি

একচেটিয়া পুঁজিবাদের নাম বদলানো

সম্পর্কে ডাঙ্গের হুঁশিয়ারি

নতুন নামে পুরনো একচেটিয়া পুঁজিব্যবস্থা যাতে এদেশে পুনরায় মাথাচাড়া না দেয় সে দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখার জন্য ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান ও নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক কমরেড এস, এ, এম, ডাঙ্গে বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সোমবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বক্তৃতা করছিলেন। কমরেড ডাঙ্গে বলেন, বাংলাদেশে যে বিপ্লব ঘটে গেছে তার সঙ্গেই এখানে একচেটিয়া পুঁজিবাদ ও কার্টেল ব্যবস্থা ভেঙে গেছে। কিন্তু ভারতে এই অভিশাপের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে। মি, ডাঙ্গে বর্তমানে বাংলাদেশে সফররত ৮-সদস্য শ্রমিক প্রতিনিধি। দলের নেতৃত্ব করছেন। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর তার এই বিশ্বাসই জন্মেছে যে, অর্থনীতির কয়েকটি ক্ষেত্র যেমন ব্যাংক, বীমা ও ভারী শিল্প তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত করবেন। মি, ডাঙ্গে বলেন যে, এটা না করা হলে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ভিত্তিই প্রতিষ্ঠিত হবে না। মি. ডাঙ্গে বাংলাদেশের শ্রমিকের সঙ্গে ভারতীয় শ্রমিক সমাজের একাত্মতা ঘোষণা করে বলেন যে, তারা বাংলাদেশের পুনর্গঠনে অংশ নেবেন। তিনি বাংলাদেশের গণহত্যা ও এখানকার অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করাকে পাকিস্তানি বর্বরবাহিনীর সুপরিকল্পিত কাজ বলে অভিহিত করেন। তিনি একে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জার্মান নাৎসীবাহিনীর গণহত্যার সাথে তুলনা করেন।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি : কমরেড ডাঙ্গে বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য দায়ী পাকিস্তানি সামরিক অফিসারদের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচার দাবি করেন। তিনি বলেন, অপরাধী পাকিস্তানজেনারেলদের কোনো অবস্থাতেই জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী প্রশ্রয় দেয়া উচিত হবে না। তিনি শাসনতন্ত্র রচযিতাদের ওপর নির্ভর না করে জনসাধারণকে শাসনতন্ত্র রচনায় অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে তিনি বুদ্ধিজীবীর অংশ হিসেবে ছাত্র সমাজকে সজাগ হতে বলেন।

শ্রমিকদের প্রতি আহ্বান : মি. ডাঙ্গে বাংলাদেশের শ্রমিক সমাজকে উৎপাদনের কাজে নিজেদের । ব্যাপৃত রাখার আহ্বান জানান। এতে করে নতুন একচেটিয়া পুঁজিপতির আবির্ভাব প্রতিহত হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে ডাঙ্গের বক্তৃতা : ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান মি, এস, এ, ডাঙ্গে শ্রমিক স্বার্থ সামনে রেখে দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনের কাজে অংশ নেয়ার জন্যে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ও কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে দলের সদস্য ও কর্মীদের উদ্দেশ্যে মি, ডাঙ্গে বক্তৃতা করছিলেন। তিনি এখানকার অবস্থার সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য স্থানের অবস্থার মধ্যে কোনো প্রকার বিভ্রান্তি সৃষ্টি না করার জন্য দলের সদস্য ও কর্মীদের আহ্বান জানান। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা উল্লেখ করে মি. ডাঙ্গে বলেন যে, এখানে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সুফলকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের জন্যে সময় এসে গেছে।

বিমান দুর্ঘটনাটি কি স্বাভাবিক না কোন চক্রান্তের শিকার

“আমি আর পারছি নে। আমাকে আর কিছু জিজ্ঞাস করবেন না দয়া করে।” কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় প্রায় লুটিয়ে পড়ছিলেন ক্যাপ্টেন খালেকের বিধবা স্ত্রী মিসেস রমিজা খালেক। তবুও সমস্ত মানসিকতা ভুলে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম তার স্বামীর সম্পর্কে। তিনি কান্না জড়িত কণ্ঠে বললেন, “আমার স্বামীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি এর পেছনে নিশ্চয়ই কোন চক্রান্ত ছিল। তিনি আবার বললেন, “জানেন, আমার স্বামী স্বাধীনতার পরে আমাকে প্রায়ই বলতেন যে, তার পেছনে নাকি শত্রু লেগেছে। তাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু আমি সেকথা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইনি। এখন তার সেকথাগুলিই আমার বার বার মনে পড়ছে।” বিমান দুর্ঘটনার পেছনেও হয়তো কোনো অদৃশ্য ষড়যন্ত্র ছিল বলে তার স্ত্রী বিশ্বাস করছেন। ক্যাপ্টেন খালেক তার স্ত্রীকে বলতেন, একটি নতুন দেশের পুনর্গঠনের কাজে আমার দায়িত্ব রয়েছে অনেক। তাই পদমর্যাদা আশা করিনা-শুরু থেকেই কাজ করতে চাই। কিন্তু তিনি যখন প্রায়ই অত্যন্ত পরিশ্রান্ত হয়ে বাসায় ফিরতেন- তার স্ত্রী স্বামীর সে চেহারার প্রতি করুণা দেখিয়ে বেশি পরিশ্রম না করার জন্যে অনুরোধ করতেন। স্ত্রীর এ অনুরোধে তিনি হেসে সেদিন জবাব দিয়েছিলেন, “আজই আমার ট্রেনিং দেয়ার শেষদিন। আমি যে তিন জন ক্যাডেটকে এতদিন ট্রেনিং দিচ্ছিলাম তারা যদি আজ সাফল্য লাভ করে, তবে আমার বিশ্রাম নেয়ার সময় আসবে।” কিন্তু কে জানতো তার এ বিশ্রাম চিরদিনের মতো হবে। এতোক্ষণ কথা বলতে বলতে আবেগে আবার তিনি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। দুর্ঘটনার দিন ক্যাপ্টেন খালেকের এক বছরের ছেলে ডালিম বার বার কোলে চড়ে ছিল। সে কিছুতেই সেদিন বাবার কোল থেকে নামতে চায়নি। কিন্তু দায়িত্ব পালনে বিলম্ব হওয়ায় তিনি ছেলেকে কোল হতে নামিয়ে দিয়েছিলেন। এ সময় ডালিম জোরে জোরে কাঁদতে থাকে। তিনি সে সময়ে স্ত্রীকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ওকে থামাও। নইলে আমি আজ ফ্লাই করতে পারবো না। বার বার ওর কান্নামাখা মুখ ভেসে উঠবে। সেই ডালিম তার বাবাকে আর দেখতে না পেয়ে আধো আধো কথায় শুধু ‘আব্দু’ ‘আব্দু’ বলে কেঁদে উঠে। বিমান দুর্ঘটনায় নিহত ক্যাপ্টেন খালেক তার এ ছেলের প্রতি অতি উচ্চ আশা পোষণ করতেন। তার এ ছেলেকে তিনি বিশ্বের একজন খ্যাতিমান ব্যক্তি করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি প্রায়ই এ সম্পর্কে তাঁর স্ত্রীকে বলতেন, ‘আমার এ ছেলে খুব বুদ্ধিমান হবে।’ আমি বিমান চালিয়েছি। কিন্তু সে রকেট চালাবে। সেদিন কবে আসবে যেদিন সে সত্যিকার রকেট চালক হবে। তার জননী এখন হয়তো এ প্রতীক্ষাই করবেন। আর সত্যিই একদিন সম্ভবত: প্রতীক্ষার অবসান ঘটবে।

১৫ ফেব্রুয়ারি

বাঙালি এমন এক জাতি যারা রক্ত দিতে জানে -বঙ্গবন্ধু

ভাষা আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের মানুষের স্বাধিকারের আন্দোলন, স্বাধীনতার আন্দোলন। সেদিন থেকে শুরু হয়েছিল চরম সংগ্রামের প্রস্তুতি। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোমবার তার ভাষণে উপরোক্ত মন্তব্য করেন। স্বাধীনতা-উত্তরকালে এবছরও অমর একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালিত হবে। এ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছেন, ‘১৯৪৮ সাল থেকে আস্তে আস্তে এ সংগ্রাম শুরু হয়, ৫২ সালে এই সংগ্রাম চরম পর্যায়ে উপনীত হয়।’ মহান একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু ভাষণের পূর্ণ বিবরণ এখানে দেয়া হলো : দেশবাসী ভাই ও বোনেরা আমার, আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি আমরা স্বাধীন দেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো শহীদ দিবস উদযাপন করতে যাচ্ছি। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকেই এ সংগ্রাম শুরু হয়। সেদিন আমরা গ্রেফতার হয়ে ছিলাম রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে। সেটা শুধু ভাষা আন্দোলনই ছিল না এবং কেবলমাত্র ভাষা আন্দোলনই সেদিন শুধু হয় নাই এ আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের মানুষের স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন। ১৯৪৮ সাল থেকে আস্তে আস্তে এ সংগ্রাম শুরু হয়। ’৫২ সালে এই সংগ্রাম চরম পর্যায়ে উপনীত হয়। সেদিন আমাদের দেশের ছেলেরা রক্ত দিয়েছিল, শহীদ হয়েছিল বাংলাভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। কিন্তু সেটা কি শুধু ভাষা আন্দোলনই ছিল? সেটা বেলমাত্র ভাষা আন্দোলনই ছিল না। ছেলেরা রক্ত দিয়েছিল কেবলমাত্র ভাষার জন্য নয়। এর সঙ্গে ছিল সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আর মানুষের মতো বাঁচবার অধিকারের সগ্রাম। সেদিন অনেকেই বুঝতে চেষ্টা করেননি যে, বাংলার মানুষ জেগে ওঠেছে, বাংলার মানুষকে আর দাবিয়ে রাখা যাবে না। সেদিন থেকে শুরু হয়েছিল চরম সংগ্রামের প্রস্তুতি। বছরের পর বছর এ দিনটি আমার দেশের ভাইবোনেরা পালন করছে শহীদ দিবস হিসেবে। কিন্তু শহীদ দিবস পালন করলেও বারবার এর ওপর আঘাত এসেছে। এদিনটি সত্যিকার অর্থে আমরা উদযাপন করতে পারিনি। কারণ শোষকগোষ্ঠী এই দিনটিকে হিংসার চোখে দেখতো এবং তারা এটাকে ধ্বংস করতে বারবার চেষ্টা করেছে। এমনকি যে সীমানায়। শহীদ মিনারটি গড়ে উঠেছিল তার ওপর বারবার এই ষড়যন্ত্রকারীরা এবং শোষকশ্রেণী আঘাত করেছে।

তারপর থেকে বছরের পর বছর অনেক ভাই বোন, দেশের জনসাধারণ জীবন দিয়েছেন। জীবন দিয়েছেন স্বাধীনতা আন্দোলনে। তারা বাঁচতে চেয়েছে মানুষের মতো। তারা চেয়েছে তাদের অধিকার, তারা চেয়েছে স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে তারা বাস করবে। কিন্তু পৈচাশিক শক্তি সেটা কিছুতেই মানতে চায়নি। হত্যা করেছে আমার ভাই বোনদের। আঘাত করেছে আমাদের সাংস্কৃতির ওপর, আঘাত করেছে আমাদের অর্থনীতির ওপর। নির্যাতন করেছেন আমার মা-বোনদের। ভিখারি করেছে। বাংলার জনসাধারণকে। কিন্তু বাঙালি এমন এক জাতি যারা রক্ত দিতে জানে। যে জাতি মরতে শিখে, সে জাতিকে কেউ রুখতে পারে না- শাসকগোষ্ঠী বুঝে নাই। তাই তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে তারা আক্রমণ করেছিল। আজ আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি সত্যি কিন্তু তা অনেক রক্তের বিনিময়ে। এতে রক্ত কেনো দেশ কোনো জাতি স্বাধীনতার জন্য দেয়নি। কিন্তু এ রক্ত আমাদের বৃথা যাবে, এ স্বাধীনতা আমাদের বৃথা যাবে যদি আমরা হাসি ফোটাতে না পারি, যদি এদেশের মানুষকে শোষণমুক্ত করতে না পরি, শোষণমুক্ত সমাজ গঠন করতে না পারি। এবং তা যদি করতে হয়, তাহলে এদেশের মানুষকে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হবে। আমি আশা করি, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ এবার এ শপথই নেবে।

আমরা স্বাধীন হয়েছি। কিন্তু স্বাধীন হলেও আমরা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবো না-যদি শোষণমুক্ত সমাজ গঠন না করতে পারি। সেজন্য জাতি-ধর্ম-দলমত-নির্বিশেষে ছাত্র যুবক কৃষক-শ্রমিক সকলকে অগ্রসর হতে হবে- এটাই আমরা আশা করি। এদিনে আমাদের শপথ হবে যে স্বাধীনতা আমরা এনেছি, যদি প্রয়োজন হয় রক্ত দিয়ে এ স্বাধীনতা রক্ষা করবো। যদি প্রয়োজন হয় দেশ গড়ে তোলার জন্য আরও রক্ত দেবো। আজ প্রতিজ্ঞা করতে হবে, শহীদের রক্তের কথা মনে। করে, যারা মারা গেছে, যারা শহীদ হয়েছে, যাদের মায়ের বুক খালি হয়েছে, যে বোন বিধবা হয়েছে, যে কোটি কোটি মানুষ আজ গৃহহারা হয়েছে তাদের কথা স্মরণ করে শপথ নিতে হবে, বাংলার মাটিতে শোষণহীন সমাজ গড়তে হবে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েম করতে হবে। মানুষ যাতে আর দুঃখ-কষ্ট না পায়, আর কোনোদিন অত্যাচারিত নিপীড়িত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমাদের কাজে অগ্রসর হতে হবে। তাই আমি অনুরোধ করছি, বিশেষভাবে যুব সমাজ, ছাত্র সমাজ, কৃষক-শ্রমিক ভাইদের সংঘবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে। আমরা মহাবিপদের মধ্যে আছি। আমাদের কিছুই নাই। নতুন করে সবকিছু গড়তে হবে। আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে দেশকে গড়ে তুলি, একটি শোষণহীন সমাজ তৈরি করি। শহীদ স্মৃতি অমর হোক। জয় বাংলা।

মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ৫ ফল্গুন ১৪২৬, ২৩ জমাদিউল সানি ১৪৪১

মুজিব শতবর্ষ

মুজিব শাসন আমল : ১৯৭২

১৪ ফেব্রুয়ারি

একচেটিয়া পুঁজিবাদের নাম বদলানো

সম্পর্কে ডাঙ্গের হুঁশিয়ারি

নতুন নামে পুরনো একচেটিয়া পুঁজিব্যবস্থা যাতে এদেশে পুনরায় মাথাচাড়া না দেয় সে দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখার জন্য ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান ও নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক কমরেড এস, এ, এম, ডাঙ্গে বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সোমবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বক্তৃতা করছিলেন। কমরেড ডাঙ্গে বলেন, বাংলাদেশে যে বিপ্লব ঘটে গেছে তার সঙ্গেই এখানে একচেটিয়া পুঁজিবাদ ও কার্টেল ব্যবস্থা ভেঙে গেছে। কিন্তু ভারতে এই অভিশাপের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে। মি, ডাঙ্গে বর্তমানে বাংলাদেশে সফররত ৮-সদস্য শ্রমিক প্রতিনিধি। দলের নেতৃত্ব করছেন। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর তার এই বিশ্বাসই জন্মেছে যে, অর্থনীতির কয়েকটি ক্ষেত্র যেমন ব্যাংক, বীমা ও ভারী শিল্প তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত করবেন। মি, ডাঙ্গে বলেন যে, এটা না করা হলে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ভিত্তিই প্রতিষ্ঠিত হবে না। মি. ডাঙ্গে বাংলাদেশের শ্রমিকের সঙ্গে ভারতীয় শ্রমিক সমাজের একাত্মতা ঘোষণা করে বলেন যে, তারা বাংলাদেশের পুনর্গঠনে অংশ নেবেন। তিনি বাংলাদেশের গণহত্যা ও এখানকার অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করাকে পাকিস্তানি বর্বরবাহিনীর সুপরিকল্পিত কাজ বলে অভিহিত করেন। তিনি একে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জার্মান নাৎসীবাহিনীর গণহত্যার সাথে তুলনা করেন।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি : কমরেড ডাঙ্গে বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য দায়ী পাকিস্তানি সামরিক অফিসারদের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচার দাবি করেন। তিনি বলেন, অপরাধী পাকিস্তানজেনারেলদের কোনো অবস্থাতেই জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী প্রশ্রয় দেয়া উচিত হবে না। তিনি শাসনতন্ত্র রচযিতাদের ওপর নির্ভর না করে জনসাধারণকে শাসনতন্ত্র রচনায় অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে তিনি বুদ্ধিজীবীর অংশ হিসেবে ছাত্র সমাজকে সজাগ হতে বলেন।

শ্রমিকদের প্রতি আহ্বান : মি. ডাঙ্গে বাংলাদেশের শ্রমিক সমাজকে উৎপাদনের কাজে নিজেদের । ব্যাপৃত রাখার আহ্বান জানান। এতে করে নতুন একচেটিয়া পুঁজিপতির আবির্ভাব প্রতিহত হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে ডাঙ্গের বক্তৃতা : ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান মি, এস, এ, ডাঙ্গে শ্রমিক স্বার্থ সামনে রেখে দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনের কাজে অংশ নেয়ার জন্যে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ও কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে দলের সদস্য ও কর্মীদের উদ্দেশ্যে মি, ডাঙ্গে বক্তৃতা করছিলেন। তিনি এখানকার অবস্থার সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য স্থানের অবস্থার মধ্যে কোনো প্রকার বিভ্রান্তি সৃষ্টি না করার জন্য দলের সদস্য ও কর্মীদের আহ্বান জানান। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা উল্লেখ করে মি. ডাঙ্গে বলেন যে, এখানে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সুফলকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের জন্যে সময় এসে গেছে।

বিমান দুর্ঘটনাটি কি স্বাভাবিক না কোন চক্রান্তের শিকার

“আমি আর পারছি নে। আমাকে আর কিছু জিজ্ঞাস করবেন না দয়া করে।” কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় প্রায় লুটিয়ে পড়ছিলেন ক্যাপ্টেন খালেকের বিধবা স্ত্রী মিসেস রমিজা খালেক। তবুও সমস্ত মানসিকতা ভুলে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম তার স্বামীর সম্পর্কে। তিনি কান্না জড়িত কণ্ঠে বললেন, “আমার স্বামীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি এর পেছনে নিশ্চয়ই কোন চক্রান্ত ছিল। তিনি আবার বললেন, “জানেন, আমার স্বামী স্বাধীনতার পরে আমাকে প্রায়ই বলতেন যে, তার পেছনে নাকি শত্রু লেগেছে। তাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু আমি সেকথা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইনি। এখন তার সেকথাগুলিই আমার বার বার মনে পড়ছে।” বিমান দুর্ঘটনার পেছনেও হয়তো কোনো অদৃশ্য ষড়যন্ত্র ছিল বলে তার স্ত্রী বিশ্বাস করছেন। ক্যাপ্টেন খালেক তার স্ত্রীকে বলতেন, একটি নতুন দেশের পুনর্গঠনের কাজে আমার দায়িত্ব রয়েছে অনেক। তাই পদমর্যাদা আশা করিনা-শুরু থেকেই কাজ করতে চাই। কিন্তু তিনি যখন প্রায়ই অত্যন্ত পরিশ্রান্ত হয়ে বাসায় ফিরতেন- তার স্ত্রী স্বামীর সে চেহারার প্রতি করুণা দেখিয়ে বেশি পরিশ্রম না করার জন্যে অনুরোধ করতেন। স্ত্রীর এ অনুরোধে তিনি হেসে সেদিন জবাব দিয়েছিলেন, “আজই আমার ট্রেনিং দেয়ার শেষদিন। আমি যে তিন জন ক্যাডেটকে এতদিন ট্রেনিং দিচ্ছিলাম তারা যদি আজ সাফল্য লাভ করে, তবে আমার বিশ্রাম নেয়ার সময় আসবে।” কিন্তু কে জানতো তার এ বিশ্রাম চিরদিনের মতো হবে। এতোক্ষণ কথা বলতে বলতে আবেগে আবার তিনি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। দুর্ঘটনার দিন ক্যাপ্টেন খালেকের এক বছরের ছেলে ডালিম বার বার কোলে চড়ে ছিল। সে কিছুতেই সেদিন বাবার কোল থেকে নামতে চায়নি। কিন্তু দায়িত্ব পালনে বিলম্ব হওয়ায় তিনি ছেলেকে কোল হতে নামিয়ে দিয়েছিলেন। এ সময় ডালিম জোরে জোরে কাঁদতে থাকে। তিনি সে সময়ে স্ত্রীকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ওকে থামাও। নইলে আমি আজ ফ্লাই করতে পারবো না। বার বার ওর কান্নামাখা মুখ ভেসে উঠবে। সেই ডালিম তার বাবাকে আর দেখতে না পেয়ে আধো আধো কথায় শুধু ‘আব্দু’ ‘আব্দু’ বলে কেঁদে উঠে। বিমান দুর্ঘটনায় নিহত ক্যাপ্টেন খালেক তার এ ছেলের প্রতি অতি উচ্চ আশা পোষণ করতেন। তার এ ছেলেকে তিনি বিশ্বের একজন খ্যাতিমান ব্যক্তি করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি প্রায়ই এ সম্পর্কে তাঁর স্ত্রীকে বলতেন, ‘আমার এ ছেলে খুব বুদ্ধিমান হবে।’ আমি বিমান চালিয়েছি। কিন্তু সে রকেট চালাবে। সেদিন কবে আসবে যেদিন সে সত্যিকার রকেট চালক হবে। তার জননী এখন হয়তো এ প্রতীক্ষাই করবেন। আর সত্যিই একদিন সম্ভবত: প্রতীক্ষার অবসান ঘটবে।

১৫ ফেব্রুয়ারি

বাঙালি এমন এক জাতি যারা রক্ত দিতে জানে -বঙ্গবন্ধু

ভাষা আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের মানুষের স্বাধিকারের আন্দোলন, স্বাধীনতার আন্দোলন। সেদিন থেকে শুরু হয়েছিল চরম সংগ্রামের প্রস্তুতি। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোমবার তার ভাষণে উপরোক্ত মন্তব্য করেন। স্বাধীনতা-উত্তরকালে এবছরও অমর একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালিত হবে। এ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছেন, ‘১৯৪৮ সাল থেকে আস্তে আস্তে এ সংগ্রাম শুরু হয়, ৫২ সালে এই সংগ্রাম চরম পর্যায়ে উপনীত হয়।’ মহান একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু ভাষণের পূর্ণ বিবরণ এখানে দেয়া হলো : দেশবাসী ভাই ও বোনেরা আমার, আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি আমরা স্বাধীন দেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো শহীদ দিবস উদযাপন করতে যাচ্ছি। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকেই এ সংগ্রাম শুরু হয়। সেদিন আমরা গ্রেফতার হয়ে ছিলাম রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে। সেটা শুধু ভাষা আন্দোলনই ছিল না এবং কেবলমাত্র ভাষা আন্দোলনই সেদিন শুধু হয় নাই এ আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের মানুষের স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন। ১৯৪৮ সাল থেকে আস্তে আস্তে এ সংগ্রাম শুরু হয়। ’৫২ সালে এই সংগ্রাম চরম পর্যায়ে উপনীত হয়। সেদিন আমাদের দেশের ছেলেরা রক্ত দিয়েছিল, শহীদ হয়েছিল বাংলাভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। কিন্তু সেটা কি শুধু ভাষা আন্দোলনই ছিল? সেটা বেলমাত্র ভাষা আন্দোলনই ছিল না। ছেলেরা রক্ত দিয়েছিল কেবলমাত্র ভাষার জন্য নয়। এর সঙ্গে ছিল সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আর মানুষের মতো বাঁচবার অধিকারের সগ্রাম। সেদিন অনেকেই বুঝতে চেষ্টা করেননি যে, বাংলার মানুষ জেগে ওঠেছে, বাংলার মানুষকে আর দাবিয়ে রাখা যাবে না। সেদিন থেকে শুরু হয়েছিল চরম সংগ্রামের প্রস্তুতি। বছরের পর বছর এ দিনটি আমার দেশের ভাইবোনেরা পালন করছে শহীদ দিবস হিসেবে। কিন্তু শহীদ দিবস পালন করলেও বারবার এর ওপর আঘাত এসেছে। এদিনটি সত্যিকার অর্থে আমরা উদযাপন করতে পারিনি। কারণ শোষকগোষ্ঠী এই দিনটিকে হিংসার চোখে দেখতো এবং তারা এটাকে ধ্বংস করতে বারবার চেষ্টা করেছে। এমনকি যে সীমানায়। শহীদ মিনারটি গড়ে উঠেছিল তার ওপর বারবার এই ষড়যন্ত্রকারীরা এবং শোষকশ্রেণী আঘাত করেছে।

তারপর থেকে বছরের পর বছর অনেক ভাই বোন, দেশের জনসাধারণ জীবন দিয়েছেন। জীবন দিয়েছেন স্বাধীনতা আন্দোলনে। তারা বাঁচতে চেয়েছে মানুষের মতো। তারা চেয়েছে তাদের অধিকার, তারা চেয়েছে স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে তারা বাস করবে। কিন্তু পৈচাশিক শক্তি সেটা কিছুতেই মানতে চায়নি। হত্যা করেছে আমার ভাই বোনদের। আঘাত করেছে আমাদের সাংস্কৃতির ওপর, আঘাত করেছে আমাদের অর্থনীতির ওপর। নির্যাতন করেছেন আমার মা-বোনদের। ভিখারি করেছে। বাংলার জনসাধারণকে। কিন্তু বাঙালি এমন এক জাতি যারা রক্ত দিতে জানে। যে জাতি মরতে শিখে, সে জাতিকে কেউ রুখতে পারে না- শাসকগোষ্ঠী বুঝে নাই। তাই তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে তারা আক্রমণ করেছিল। আজ আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি সত্যি কিন্তু তা অনেক রক্তের বিনিময়ে। এতে রক্ত কেনো দেশ কোনো জাতি স্বাধীনতার জন্য দেয়নি। কিন্তু এ রক্ত আমাদের বৃথা যাবে, এ স্বাধীনতা আমাদের বৃথা যাবে যদি আমরা হাসি ফোটাতে না পারি, যদি এদেশের মানুষকে শোষণমুক্ত করতে না পরি, শোষণমুক্ত সমাজ গঠন করতে না পারি। এবং তা যদি করতে হয়, তাহলে এদেশের মানুষকে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হবে। আমি আশা করি, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ এবার এ শপথই নেবে।

আমরা স্বাধীন হয়েছি। কিন্তু স্বাধীন হলেও আমরা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবো না-যদি শোষণমুক্ত সমাজ গঠন না করতে পারি। সেজন্য জাতি-ধর্ম-দলমত-নির্বিশেষে ছাত্র যুবক কৃষক-শ্রমিক সকলকে অগ্রসর হতে হবে- এটাই আমরা আশা করি। এদিনে আমাদের শপথ হবে যে স্বাধীনতা আমরা এনেছি, যদি প্রয়োজন হয় রক্ত দিয়ে এ স্বাধীনতা রক্ষা করবো। যদি প্রয়োজন হয় দেশ গড়ে তোলার জন্য আরও রক্ত দেবো। আজ প্রতিজ্ঞা করতে হবে, শহীদের রক্তের কথা মনে। করে, যারা মারা গেছে, যারা শহীদ হয়েছে, যাদের মায়ের বুক খালি হয়েছে, যে বোন বিধবা হয়েছে, যে কোটি কোটি মানুষ আজ গৃহহারা হয়েছে তাদের কথা স্মরণ করে শপথ নিতে হবে, বাংলার মাটিতে শোষণহীন সমাজ গড়তে হবে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েম করতে হবে। মানুষ যাতে আর দুঃখ-কষ্ট না পায়, আর কোনোদিন অত্যাচারিত নিপীড়িত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমাদের কাজে অগ্রসর হতে হবে। তাই আমি অনুরোধ করছি, বিশেষভাবে যুব সমাজ, ছাত্র সমাজ, কৃষক-শ্রমিক ভাইদের সংঘবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে। আমরা মহাবিপদের মধ্যে আছি। আমাদের কিছুই নাই। নতুন করে সবকিছু গড়তে হবে। আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে দেশকে গড়ে তুলি, একটি শোষণহীন সমাজ তৈরি করি। শহীদ স্মৃতি অমর হোক। জয় বাংলা।