ভাষা আন্দোলন : অর্জন বর্জন

রণেশ মৈত্র

১৯৪৮ ও ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের বহুমাত্রিক অর্জন আমাদের জানা। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যর্থতার সুযোগে যে সব অর্জন কার্যত ফিকে হয় এসেছে, আমাদের সাৎবাৎসরিক কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে সাধ্যমতো সেগুলো তুলে ধরা; বর্তমানে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আবার নতুন উৎসাহে হারানো বিজয়গুলো পুনরায় অর্জন করতে পারে।

১৯৪৭ সালের রাষ্ট্রীয় বিভাজন ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব যে উৎকট সাম্প্রদায়িকতার ফসল (সাম্প্রদায়িক শক্তির সাফল্যও বটে) ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র কয়েক মাস যেতে না যেতেই বাঙালি বুঝতে পারে ১৯৪৮ সালের মার্চে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে।

আমাদের সবারই মনে আছে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টে। ছয় থেকে সাত মাস যেতে না যেতেই ১৯৪৮ সালের মার্চে বাঙালি তরুণেরা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ বলে মাঠে নেমে পড়লেন; আজ তা ভাবলে বিস্মিতই হতে হয়। কারণ ১৯৪৭ সালে অসাম্প্রদায়িক শক্তির পরাজয়ই তো ঘটেছিল ‘মুসলমানের রাষ্ট্র’ হিসেবে, সেখানে ১৯৪৮ সালের শুরুতেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার তাত্ত্বিক ভিত্তিমূলেই তো আঘাত হেনে ফেলল কারণ ওই আন্দোলন ছিল স্পষ্টতই দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরোধী। দ্বিজাতিতত্ত্ব ও সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিমূলে বড় ধরনের আঘাত হেনেছিল ওই আন্দোলন। এত দ্রুততার সঙ্গে আন্দোলনটির সূচনা হলো যে ব্যাপক মানুষের পক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে তা বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি। কারণ যে মানুষ ১৯৪৬ সালে (বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়) ভোটের জোরে ‘মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিল, যে ইসলামী জোশ বাঙালি মুসলিম মানসকে গ্রাস করেছিল তা কি অতি দ্রুতই সমাজদেহ থেকে বিদূরিত হয় কখনও? তাই তার রেশ বেশ ভালোভাবেই ছিল সেই পাকিস্তানি জোশ হারিয়ে যায়নি তখনও মুসলিম সমাজদেহ থেকে। এ কারণেই মূলত ১৯৪৮ সালের আন্দোলন দ্রুত আরও ব্যাপকতা লাভ করতে সক্ষম হয়নি।

তবে একটা আগুন জ্বলেছিল যা তুষের আগুনের মতো ধিকিধিকি করে জ্বলছিল। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এসে তা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। সমাজকে প্রচণ্ড নাড়া দিলো। বাঙালি তীব্রভাবে ঘুরে দাঁড়াল ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। ঝড়ের মতো জানান দিল যে, তারা হিন্দু নয়। মুসলমান না, তারা সবাই বাঙালি যে বাঙালিত্ব রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা সাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ ভয় পেতো এবং সে কারণেই প্রচার করতো যে বাংলাভাষা হিন্দুর ভাষা, মুসলমানের নয়। বাংলাভাষা ভারতের ভাষা, পাকিস্তানের নয়।

সবাই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছেন। শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি ও গাল্পিক এবং ঔপন্যাসিক, সঙ্গীত শিল্পী, নৃত্যশিল্পী, বাদ্যশিল্পী, ছাত্র ও যুব সংগঠন, নারী সমাজসহ সমগ্র বাঙালি জাতি। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে মুখরিত করে তুলেছিল সারা বাংলার মানুষ।

সরকার গুলি দিয়ে জবাব দিল। মানুষ দলে দলে জেলে গেল, আন্দোলন অব্যাহত রাখলো, তীব্রতর করে তুলল দিনে দিনে। বিজয় অর্জন করেই ছাড়ল তারা। বহুমাত্রিক বিজয় আমরা দেখেছি বাঙালি সংস্কৃতির পুনরাবাহন। দেখেছি নানা সাংস্কৃতিক সংগঠনের জন্ম, গণসঙ্গীত, রবীন্দ্র সঙ্গীতের নজরুল সংগীতের ব্যাপক প্রসার, দেখেছি নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আল্পনার পুনঃস্থাপন, দেখেছি নাটকে যে সব স্থানে বাধা দেয়া হতো, সেসব জায়গায় বাধাকে বাধাহীন করে তুলতে, যেসব স্থানে অভিনয়কালে পুরুষকে নারী সাজিয়ে অভিনয় মঞ্চে তুলতে সেসব স্থানে আবার নারীই নারী চরিত্রে অভিনয় শুরু করত। দেখেছি শহরে বন্দরে, হাটে বাজারে সর্বত্র দোকানপাটসহ নানা প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড আরবি, ঊর্দু, ইংরেজির পরিবর্তে বাংলায় নতুন করে লিখতে।

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির স্বীকৃতির পরবর্তীকালে দেখা গেছে বাংলা সাহিত্যের প্রসারে বাঙালি কবি সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিকদের নতুন নতুন বই লিখতে ও প্রকাশ করতে, বই মেলার প্রচলন হতে, ধীরে ধীরে নারী শিক্ষার প্রসার ঘটতে। বস্তুত সমাজে এক বিশাল ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হতে এবং ধীরে ধীরে সমাজদেহ থেকে সাম্প্রদায়িকতা উচ্ছেদ বা হ্রাসের প্রক্রিয়া চালু হতে।

একে একে নানা অসাম্প্রদায়িক ছাত্র, যুব সংগঠন রাজনৈতিক দল গঠিত হতে কুরু করলো এবং এ জাতীয় সংগঠন হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম হলো। দেশব্যাপী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার শাখার বিস্তার ঘটায় তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ধীরে ধীরে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টা পরিষ্কার উপলব্ধিতে এলো। গণতন্ত্রী দল নামে বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠিত হলো।

বিদ্যমান সংগঠনগুলো তাদের নামের সাম্প্রদায়িক অংশ বর্জন করে অসাম্প্রদায়িক সংগঠনে পরিণত হওয়ায় প্রক্রিয়াও শুরু হলো। ১৯৫৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ তার নামের মধ্য থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি তুলে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র লীগ এবং ১৯৫৬ তে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন প্রমুখের উদ্যোগে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি তুলে দিয়ে আওয়ামী লীগে পরিণত হওয়ার মতো তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটতে শুরু করে।

ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে এ কথা আমাদের স্মরণে রাখতে হবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপর ১৯৪৮ সালের গোড়ার দিকে প্রথম সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুব সংগঠন হিসাবে ‘পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। ওই যুবলীগের নেতারাই ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তাৎপর্যপূর্ণ অবস্থান রেখেছিল। ওই যুবলীগ নেতাদের মধ্যে জীবিত আছেন প্রফেসর ইমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান। জেলা পর্যায়েও কেউ কেউ জীবিত আছেন মুষ্টিমেয় সংখ্যায় তবে সংগঠনটি প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আজও অস্তিত্বহীন। এখন যে যুবলীগকে রাজনৈতিক অবস্থানে দেখা যায়, সেটি ১৯৪৮ সালের ওই যুবলীগ নয়।

১৯৪৮ সালের যুবলীগের প্রয়াত নেতাদের অবিস্মৃত নামগুলো হলো ইমাদুল্লাহ, তাজউদ্দীন আহমেদ, কে. জি. মুস্তফা, আবদুল মতিন (ভাষা মতিন), ওলি আহাদ, গাজীউল হক, আতাউর রহমান, আমিনুল ইসলাম বাদশা, মোহাম্মদ তোয়াহা প্রমুখ।

আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক, ছাত্র, যুব প্রতিষ্ঠানের জন্ম বন্ধ যদিও তখন কাউকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় নি রাষ্ট্রীয়ভাবে।

যেসব সংবাদপত্র ভাষা আন্দোলনের পর প্রকাশিত হয় তাদের নাম রাল শুরু হয় বাংলা শব্দ দিয়ে। অবশ্য এমন প্র্যথম পত্রিকা হলো দৈনিক সংবাদ। কিন্তু ‘আজাদ’ ইত্তেফাক, ইত্তহাদ এর মত বিদেশী শব্দে সংবাদপত্রের নামকরণ তখন থেকেই বন্ধ হয়ে যায় এবং মোটামুটি তা আজও অব্যাহত আছে।

পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ব্যাপক প্রসার ঘটে। ১৯৫৪র নির্বাচনে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট অসাধারণ এবং একচ্ছত্র বিজয় অর্জন করে শাসক মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটিয়ে। পরে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, অতঃপর শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বৈরুতে আকস্মিক মৃত্যু ঘটলে শেখ মুজিবের হাতে আওয়ামী লীগের একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পূর্ববাংলা স্বায়ত্তশাসন, ৬ দফা, ছাত্র সমাজের ১১ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর ব্যাপকগণ অভ্যুত্থান এবং সর্বশেষ ১৯৭০ এর ঐতিহাসিক নির্বাচনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের অকল্পনীয় বিজয় ঘটলো। কিন্তু তার হাতে কিছুতেই রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানী সামরিক শাসক গোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ভিন্ন পথে কর্তৃত্ব জোর করে ধীরে রাখতে উদগ্রীব হয়ে পড়ে শুরু করে ব্যাপক গণহত্যা-বাঙালি নিধন। নিরস্ত্র বাঙালিকে তখন ঘুরে দাঁড়াতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত জাতীয় ঐক্য, জাতীয় আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে নয় মাসব্যাপী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর বহু আকাংখিত বাংলাদেশ নামক নতুন ধর্মরিপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। আকাশে রক্তিম সূর্যের উদয় হয়।

অতঃপর বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও ১৯৭২-এর সংবিধান প্রণয়ন ও বাংলাদেশের মৌলিক রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র ওই সংবিধানে গৃহীত হওয়াতে ভাষা আন্দোলনের আদর্শিক বিজয়ের পরিপূর্ণতা আসে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭২ মাত্র ২৪ বছরে কি বিশাল বিজয়ই না অর্জিত হয়েছিল। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি ধর্মীয়, শৈল্পিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে বাঙালি সংস্কৃতির বহুবিধ বিকাশ উন্নয়নের কি অপূর্ব অনুকূল পরিবেশই না সৃষ্টি হয়েছিল। এবার যদি ১৯৭২ থেকে ২০১৮ এই ৪৬ বছরের অর্থাৎ আগের দফায় দ্বিগুণ সময়ের অর্জন হিসেব করি তাহলে কি দাঁড়ায়? অনেক রাস্তাঘাট, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল বিপণি প্রভৃতি স্থাপিত হয়েছে, অনেক সেতু নির্মিত হয়েছে এবং হচ্ছে। চোখ ধাঁধানো বহুতল দালান কোঠা ঢাকাসহ বাংলাদেশে যত ঘটেছে গোটা পশ্চিম বাংলায় তা ঘটেনি। জাতীয় প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, গড় মাথাপিছু আয় বেড়েছে সব দাবি সত্য। বিশাল বিশাল বাজেট পাস করছি তাও সত্য। কিন্তু মূল বিবেচ্য হলো মানুষের অর্থনৈতিক বৈষম্য কি কমেছে? কোটিপতিদ লোকের সংখ্যা কত? মাসিক পাঁচ হাজার বা তা কিছু কম বেশি টাকা উপাপর্জন করে এমন নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীনের সংখ্যা কত? নিশ্চয়ই মানতে হবে জন সংখ্যার ৫ ভাগ বা তার কিছু কম বেশি কোটিপতি দেশের ৯৫ ভাগ অর্থবিত্তের মালিক। তা হলে উন্নয়নটা হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে কাদের? জবাবে বহু পুরনো কথাটাই বলতে হয় তেলা মাথাতেই তেল ঢাকা হয়েছে এবং হচ্ছে। বেকার যুবকের সংখ্যা দুই কোটির মতো হতে পারে। যদি তা এক কোটিরও হয় তা হলে কি করে দাবি করা যাবে আগামী পাঁচ বছরে গ্রামগুলোতে শহরের সব সুবিধা পৌঁছে দেয়া যাবে? হাসপাতালের সংখ্যা, তার হেড সংখ্যা, ডাক্তার নার্সের সংখ্যাও বেড়েছে বটে কিন্তু কিন্তু রোগীর অনুপাতে হেড, নার্স, ডাক্তার কি বেড়েছে? হাসাপাতালে চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহের শক্তি কতজন রোগীর আছে? সরকার এই সব আনুপাতিক তথ্য আগামী বাজেটে অধিবেশনের আগের অধিবেশনে প্রকাশ করলে আগ্রহীরা আগামী বাজেট সম্পর্কে অভিমত প্রস্তাব আকারে জানতে পারবেন। লক্ষ্য মানুষে মানুষ অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানো-বেকারত্ব হ্রাস ও বেকার ভাতা প্রবর্তন।

সাংস্কৃতিক অগ্রগতির প্রশ্নে সাংস্কৃতিক শব্দটির বিশাল ক্যানভাসে না গিয়েও জানতে চাওয়া যেতে পারে মানুষ কেন রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়ল? একথা মাত্র কয়েকদিন আগে একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী বলেছেন। তা হলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আমাদের অগ্রগতি কতটুকু বা আদৌ হয়েছে কি? না হয়ে থাকলে কেন? কেন মানুষ রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়ল যে রাজনীতিকে ধারণ করে মানুষ ভাষা আন্দোলন, অপরাপর গণতান্ত্রিক আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন সার্বভৌম একটি নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠা করল- সেই মানুষ যদি রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়ে- তাকে তবে কিভাবে ব্যাখ্যা করব? এবারে আমি শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়ে। সন্দেহ নেই, আগেই বলেছি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে অনেক বেড়েছে। ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষা-শিক্ষিকার সংখ্যাও বেড়েছে বিপুল পরিমাণে। কিন্তু ছাত্র-ছাত্র ও শিক্ষক শিক্ষিকার আনুপাতিক হার কি ঠিকমত আছে? শিক্ষার মান কি বেড়েছে? না বাড়লে কেন বাড়ে নি? পাঠ্য পুস্তকের বিনা পয়সায় কোটি কোটি সংখ্যায় বিনামূল্যে বিতরণ হয় সত্য কিন্তু পাঠ্যক্রম, পাঠ্যসূচি কি আমাদের চিন্তাধারায় অগ্রগতির স্বাক্ষর বহন করছে। শিক্ষার অসাম্প্রদায়িকী করণ হচ্ছে না কি সাম্প্রদায়িকীকরণ? মানুষের দাবি যে শিক্ষায় পাঠ্যসূচি এবং কবিতা প্রবন্ধ-গল্প-ইতিহাস বলে আসলে সাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ হচ্ছে শিশু-কিশোরদের চেতনায়। সেখানে রবীন্দ্র চেতনা, নজরুল চেতনা নয়, এমন কি বঙ্গবন্ধুর ভাবনা ভাবাদর্শও নয় বরং বিপরীত ভাবাদর্শেই কোমলমতি শিশু-কিশোরদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আজ শিক্ষার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দেখা যায় হেফাজতে ইসলাম ও তার প্রধান তেঁতুল হুজুরকে। এটা কি ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আদর্শের সঙ্গে আদৌ সঙ্গতিপূর্ণ?

শুধু একুশের মাসব্যাপী গ্রন্থমেলার জৌলুস বৃদ্ধি বা সময় ও এলাকাবৃদ্ধির দ্বারা একুশের চেতনা ও আদর্শের প্রচার প্রসার হচ্ছে তা বলা যাবে কি? ধর্মনিরপেক্ষতা কার্যত বিদায় দিয়ে রাষ্ট্রধর্ম লালনের মাধ্যমে ধর্মীয় বৈষম্য বৃদ্ধি, পাঠ্যক্রমের সাম্প্রদায়িকীকরণের মাধ্যমে পশ্চাদপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাভাবনার বিকাশ জোরকদমে ঘটানো হচ্ছে। সরকারি উদ্যোগে মসজিদ নির্মাণ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মূলে শুধু নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী কোটি কোটি মুসলিমও মানসিকভাবে ও নৈতিকভাবে সমর্থনের কোন পথ খুজে পাচ্ছে না। একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রর্বতন ছিল আমাদের জাতীয় অঙ্গীকার। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছেটা কি? কিন্ডারগার্টেনের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার, মাদ্রাসাগুলোর সংখ্যা হু হু করে বাড়িয়ে আরবি এবং ধর্মীয় শিক্ষার বিকাশ এতগুলি বা ত্রিধারা শিক্ষা কি আমাদের জাতীয় ও সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক বিকাশের সহায়ক? নাকি প্রকৃতপক্ষে বাংলা শিক্ষার অবমূল্যায়ন করে আমরা ইংরেজি, আরবি শিক্ষার প্রতি অধিকতর মনোযোগ দিয়েছি। বাংলা ভাষার আন্দোলনের মহিমা কোথায় রক্ষিত হচ্ছে? ইংরেজি শিক্ষা ও তার প্রভাব বৃদ্ধির অনুকূল-আবার বাংলা শিক্ষার অবমূল্যায়ন কোন কল্যাণ বয়ে আনবে না। আইনের বই, দর্শনের বই, বিজ্ঞানের বই, বাংলায় অনুবাদ কতটুকু হয়েছে? কেন বেশি বেশি হচ্ছে না? উচ্চ আদালতে পুরোপুরি বাংলা ভাষার প্রবর্তনের পথে বাধাই বা কোথায়?

স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় স্বীকৃত দুশমন জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলামকে কেন বেআইনি ঘোষণা করা হচ্ছে না সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে। শুধু মুক্তিযোদ্ধা, শুধু দেশবাসীরই দাবি এটা তা তো নয়। উচ্চ আদালতের রায় বারবার তেমনই নির্দেশনা দিয়েছে তবুও সেদিকে কোন অগ্রগতি নেই।

তাই হিসাব-নিকাশ কি পাওয়া যায়? ভাষা আন্দোলনের বিপুল অর্জনের পাশাপাশি আমরা হারালাম কতটুকু? মৌলিক আদর্শিক বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে? বর্জনের পথেই কি হাঁটছি না আমরা শহীদদের আদর্শ বাস্তবায়নের নামে? একটি উৎপাদনশীল অর্থনীতি, আত্মনির্ভরতার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার বদলে আমদানিনির্ভর অর্থনীতি দিয়ে দেশকে উন্নত করা যাবে না। আমরা হতে চাই অধিক থেকে অধিকতর রফতানির ক্ষমতাসম্পন্ন, নতুন নতুন শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে বেকারত্বমুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত এক নবীন বাংলাদেশ। ভাষা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যা থাকবে দীপ্তমান। সেই বাংলাদেশে সবাই নির্ভয়ে তার নিজ নিজ ধর্ম পালন করার স্বাধীনতা ভোগ করবে। রাষ্ট্রের কোন ধর্ম থাকবে না- এ নীতি প্রতিষ্ঠায় দেশ কি আজও অঙ্গীকারবদ্ধ?

[লেখক : সংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত ]

শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ৮ ফল্গুন ১৪২৬, ২৬ জমাদিউল সানি ১৪৪১

ভাষা আন্দোলন : অর্জন বর্জন

রণেশ মৈত্র

১৯৪৮ ও ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের বহুমাত্রিক অর্জন আমাদের জানা। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যর্থতার সুযোগে যে সব অর্জন কার্যত ফিকে হয় এসেছে, আমাদের সাৎবাৎসরিক কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে সাধ্যমতো সেগুলো তুলে ধরা; বর্তমানে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আবার নতুন উৎসাহে হারানো বিজয়গুলো পুনরায় অর্জন করতে পারে।

১৯৪৭ সালের রাষ্ট্রীয় বিভাজন ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব যে উৎকট সাম্প্রদায়িকতার ফসল (সাম্প্রদায়িক শক্তির সাফল্যও বটে) ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র কয়েক মাস যেতে না যেতেই বাঙালি বুঝতে পারে ১৯৪৮ সালের মার্চে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে।

আমাদের সবারই মনে আছে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টে। ছয় থেকে সাত মাস যেতে না যেতেই ১৯৪৮ সালের মার্চে বাঙালি তরুণেরা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ বলে মাঠে নেমে পড়লেন; আজ তা ভাবলে বিস্মিতই হতে হয়। কারণ ১৯৪৭ সালে অসাম্প্রদায়িক শক্তির পরাজয়ই তো ঘটেছিল ‘মুসলমানের রাষ্ট্র’ হিসেবে, সেখানে ১৯৪৮ সালের শুরুতেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার তাত্ত্বিক ভিত্তিমূলেই তো আঘাত হেনে ফেলল কারণ ওই আন্দোলন ছিল স্পষ্টতই দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরোধী। দ্বিজাতিতত্ত্ব ও সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিমূলে বড় ধরনের আঘাত হেনেছিল ওই আন্দোলন। এত দ্রুততার সঙ্গে আন্দোলনটির সূচনা হলো যে ব্যাপক মানুষের পক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে তা বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি। কারণ যে মানুষ ১৯৪৬ সালে (বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়) ভোটের জোরে ‘মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিল, যে ইসলামী জোশ বাঙালি মুসলিম মানসকে গ্রাস করেছিল তা কি অতি দ্রুতই সমাজদেহ থেকে বিদূরিত হয় কখনও? তাই তার রেশ বেশ ভালোভাবেই ছিল সেই পাকিস্তানি জোশ হারিয়ে যায়নি তখনও মুসলিম সমাজদেহ থেকে। এ কারণেই মূলত ১৯৪৮ সালের আন্দোলন দ্রুত আরও ব্যাপকতা লাভ করতে সক্ষম হয়নি।

তবে একটা আগুন জ্বলেছিল যা তুষের আগুনের মতো ধিকিধিকি করে জ্বলছিল। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এসে তা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। সমাজকে প্রচণ্ড নাড়া দিলো। বাঙালি তীব্রভাবে ঘুরে দাঁড়াল ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। ঝড়ের মতো জানান দিল যে, তারা হিন্দু নয়। মুসলমান না, তারা সবাই বাঙালি যে বাঙালিত্ব রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা সাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ ভয় পেতো এবং সে কারণেই প্রচার করতো যে বাংলাভাষা হিন্দুর ভাষা, মুসলমানের নয়। বাংলাভাষা ভারতের ভাষা, পাকিস্তানের নয়।

সবাই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছেন। শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি ও গাল্পিক এবং ঔপন্যাসিক, সঙ্গীত শিল্পী, নৃত্যশিল্পী, বাদ্যশিল্পী, ছাত্র ও যুব সংগঠন, নারী সমাজসহ সমগ্র বাঙালি জাতি। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে মুখরিত করে তুলেছিল সারা বাংলার মানুষ।

সরকার গুলি দিয়ে জবাব দিল। মানুষ দলে দলে জেলে গেল, আন্দোলন অব্যাহত রাখলো, তীব্রতর করে তুলল দিনে দিনে। বিজয় অর্জন করেই ছাড়ল তারা। বহুমাত্রিক বিজয় আমরা দেখেছি বাঙালি সংস্কৃতির পুনরাবাহন। দেখেছি নানা সাংস্কৃতিক সংগঠনের জন্ম, গণসঙ্গীত, রবীন্দ্র সঙ্গীতের নজরুল সংগীতের ব্যাপক প্রসার, দেখেছি নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আল্পনার পুনঃস্থাপন, দেখেছি নাটকে যে সব স্থানে বাধা দেয়া হতো, সেসব জায়গায় বাধাকে বাধাহীন করে তুলতে, যেসব স্থানে অভিনয়কালে পুরুষকে নারী সাজিয়ে অভিনয় মঞ্চে তুলতে সেসব স্থানে আবার নারীই নারী চরিত্রে অভিনয় শুরু করত। দেখেছি শহরে বন্দরে, হাটে বাজারে সর্বত্র দোকানপাটসহ নানা প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড আরবি, ঊর্দু, ইংরেজির পরিবর্তে বাংলায় নতুন করে লিখতে।

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির স্বীকৃতির পরবর্তীকালে দেখা গেছে বাংলা সাহিত্যের প্রসারে বাঙালি কবি সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিকদের নতুন নতুন বই লিখতে ও প্রকাশ করতে, বই মেলার প্রচলন হতে, ধীরে ধীরে নারী শিক্ষার প্রসার ঘটতে। বস্তুত সমাজে এক বিশাল ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হতে এবং ধীরে ধীরে সমাজদেহ থেকে সাম্প্রদায়িকতা উচ্ছেদ বা হ্রাসের প্রক্রিয়া চালু হতে।

একে একে নানা অসাম্প্রদায়িক ছাত্র, যুব সংগঠন রাজনৈতিক দল গঠিত হতে কুরু করলো এবং এ জাতীয় সংগঠন হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম হলো। দেশব্যাপী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার শাখার বিস্তার ঘটায় তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ধীরে ধীরে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টা পরিষ্কার উপলব্ধিতে এলো। গণতন্ত্রী দল নামে বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠিত হলো।

বিদ্যমান সংগঠনগুলো তাদের নামের সাম্প্রদায়িক অংশ বর্জন করে অসাম্প্রদায়িক সংগঠনে পরিণত হওয়ায় প্রক্রিয়াও শুরু হলো। ১৯৫৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ তার নামের মধ্য থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি তুলে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র লীগ এবং ১৯৫৬ তে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন প্রমুখের উদ্যোগে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি তুলে দিয়ে আওয়ামী লীগে পরিণত হওয়ার মতো তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটতে শুরু করে।

ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে এ কথা আমাদের স্মরণে রাখতে হবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপর ১৯৪৮ সালের গোড়ার দিকে প্রথম সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুব সংগঠন হিসাবে ‘পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। ওই যুবলীগের নেতারাই ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তাৎপর্যপূর্ণ অবস্থান রেখেছিল। ওই যুবলীগ নেতাদের মধ্যে জীবিত আছেন প্রফেসর ইমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান। জেলা পর্যায়েও কেউ কেউ জীবিত আছেন মুষ্টিমেয় সংখ্যায় তবে সংগঠনটি প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আজও অস্তিত্বহীন। এখন যে যুবলীগকে রাজনৈতিক অবস্থানে দেখা যায়, সেটি ১৯৪৮ সালের ওই যুবলীগ নয়।

১৯৪৮ সালের যুবলীগের প্রয়াত নেতাদের অবিস্মৃত নামগুলো হলো ইমাদুল্লাহ, তাজউদ্দীন আহমেদ, কে. জি. মুস্তফা, আবদুল মতিন (ভাষা মতিন), ওলি আহাদ, গাজীউল হক, আতাউর রহমান, আমিনুল ইসলাম বাদশা, মোহাম্মদ তোয়াহা প্রমুখ।

আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক, ছাত্র, যুব প্রতিষ্ঠানের জন্ম বন্ধ যদিও তখন কাউকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় নি রাষ্ট্রীয়ভাবে।

যেসব সংবাদপত্র ভাষা আন্দোলনের পর প্রকাশিত হয় তাদের নাম রাল শুরু হয় বাংলা শব্দ দিয়ে। অবশ্য এমন প্র্যথম পত্রিকা হলো দৈনিক সংবাদ। কিন্তু ‘আজাদ’ ইত্তেফাক, ইত্তহাদ এর মত বিদেশী শব্দে সংবাদপত্রের নামকরণ তখন থেকেই বন্ধ হয়ে যায় এবং মোটামুটি তা আজও অব্যাহত আছে।

পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ব্যাপক প্রসার ঘটে। ১৯৫৪র নির্বাচনে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট অসাধারণ এবং একচ্ছত্র বিজয় অর্জন করে শাসক মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটিয়ে। পরে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, অতঃপর শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বৈরুতে আকস্মিক মৃত্যু ঘটলে শেখ মুজিবের হাতে আওয়ামী লীগের একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পূর্ববাংলা স্বায়ত্তশাসন, ৬ দফা, ছাত্র সমাজের ১১ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর ব্যাপকগণ অভ্যুত্থান এবং সর্বশেষ ১৯৭০ এর ঐতিহাসিক নির্বাচনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের অকল্পনীয় বিজয় ঘটলো। কিন্তু তার হাতে কিছুতেই রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানী সামরিক শাসক গোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ভিন্ন পথে কর্তৃত্ব জোর করে ধীরে রাখতে উদগ্রীব হয়ে পড়ে শুরু করে ব্যাপক গণহত্যা-বাঙালি নিধন। নিরস্ত্র বাঙালিকে তখন ঘুরে দাঁড়াতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত জাতীয় ঐক্য, জাতীয় আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে নয় মাসব্যাপী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর বহু আকাংখিত বাংলাদেশ নামক নতুন ধর্মরিপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। আকাশে রক্তিম সূর্যের উদয় হয়।

অতঃপর বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও ১৯৭২-এর সংবিধান প্রণয়ন ও বাংলাদেশের মৌলিক রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র ওই সংবিধানে গৃহীত হওয়াতে ভাষা আন্দোলনের আদর্শিক বিজয়ের পরিপূর্ণতা আসে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭২ মাত্র ২৪ বছরে কি বিশাল বিজয়ই না অর্জিত হয়েছিল। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি ধর্মীয়, শৈল্পিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে বাঙালি সংস্কৃতির বহুবিধ বিকাশ উন্নয়নের কি অপূর্ব অনুকূল পরিবেশই না সৃষ্টি হয়েছিল। এবার যদি ১৯৭২ থেকে ২০১৮ এই ৪৬ বছরের অর্থাৎ আগের দফায় দ্বিগুণ সময়ের অর্জন হিসেব করি তাহলে কি দাঁড়ায়? অনেক রাস্তাঘাট, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল বিপণি প্রভৃতি স্থাপিত হয়েছে, অনেক সেতু নির্মিত হয়েছে এবং হচ্ছে। চোখ ধাঁধানো বহুতল দালান কোঠা ঢাকাসহ বাংলাদেশে যত ঘটেছে গোটা পশ্চিম বাংলায় তা ঘটেনি। জাতীয় প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, গড় মাথাপিছু আয় বেড়েছে সব দাবি সত্য। বিশাল বিশাল বাজেট পাস করছি তাও সত্য। কিন্তু মূল বিবেচ্য হলো মানুষের অর্থনৈতিক বৈষম্য কি কমেছে? কোটিপতিদ লোকের সংখ্যা কত? মাসিক পাঁচ হাজার বা তা কিছু কম বেশি টাকা উপাপর্জন করে এমন নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীনের সংখ্যা কত? নিশ্চয়ই মানতে হবে জন সংখ্যার ৫ ভাগ বা তার কিছু কম বেশি কোটিপতি দেশের ৯৫ ভাগ অর্থবিত্তের মালিক। তা হলে উন্নয়নটা হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে কাদের? জবাবে বহু পুরনো কথাটাই বলতে হয় তেলা মাথাতেই তেল ঢাকা হয়েছে এবং হচ্ছে। বেকার যুবকের সংখ্যা দুই কোটির মতো হতে পারে। যদি তা এক কোটিরও হয় তা হলে কি করে দাবি করা যাবে আগামী পাঁচ বছরে গ্রামগুলোতে শহরের সব সুবিধা পৌঁছে দেয়া যাবে? হাসপাতালের সংখ্যা, তার হেড সংখ্যা, ডাক্তার নার্সের সংখ্যাও বেড়েছে বটে কিন্তু কিন্তু রোগীর অনুপাতে হেড, নার্স, ডাক্তার কি বেড়েছে? হাসাপাতালে চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহের শক্তি কতজন রোগীর আছে? সরকার এই সব আনুপাতিক তথ্য আগামী বাজেটে অধিবেশনের আগের অধিবেশনে প্রকাশ করলে আগ্রহীরা আগামী বাজেট সম্পর্কে অভিমত প্রস্তাব আকারে জানতে পারবেন। লক্ষ্য মানুষে মানুষ অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানো-বেকারত্ব হ্রাস ও বেকার ভাতা প্রবর্তন।

সাংস্কৃতিক অগ্রগতির প্রশ্নে সাংস্কৃতিক শব্দটির বিশাল ক্যানভাসে না গিয়েও জানতে চাওয়া যেতে পারে মানুষ কেন রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়ল? একথা মাত্র কয়েকদিন আগে একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী বলেছেন। তা হলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আমাদের অগ্রগতি কতটুকু বা আদৌ হয়েছে কি? না হয়ে থাকলে কেন? কেন মানুষ রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়ল যে রাজনীতিকে ধারণ করে মানুষ ভাষা আন্দোলন, অপরাপর গণতান্ত্রিক আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন সার্বভৌম একটি নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠা করল- সেই মানুষ যদি রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়ে- তাকে তবে কিভাবে ব্যাখ্যা করব? এবারে আমি শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়ে। সন্দেহ নেই, আগেই বলেছি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে অনেক বেড়েছে। ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষা-শিক্ষিকার সংখ্যাও বেড়েছে বিপুল পরিমাণে। কিন্তু ছাত্র-ছাত্র ও শিক্ষক শিক্ষিকার আনুপাতিক হার কি ঠিকমত আছে? শিক্ষার মান কি বেড়েছে? না বাড়লে কেন বাড়ে নি? পাঠ্য পুস্তকের বিনা পয়সায় কোটি কোটি সংখ্যায় বিনামূল্যে বিতরণ হয় সত্য কিন্তু পাঠ্যক্রম, পাঠ্যসূচি কি আমাদের চিন্তাধারায় অগ্রগতির স্বাক্ষর বহন করছে। শিক্ষার অসাম্প্রদায়িকী করণ হচ্ছে না কি সাম্প্রদায়িকীকরণ? মানুষের দাবি যে শিক্ষায় পাঠ্যসূচি এবং কবিতা প্রবন্ধ-গল্প-ইতিহাস বলে আসলে সাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ হচ্ছে শিশু-কিশোরদের চেতনায়। সেখানে রবীন্দ্র চেতনা, নজরুল চেতনা নয়, এমন কি বঙ্গবন্ধুর ভাবনা ভাবাদর্শও নয় বরং বিপরীত ভাবাদর্শেই কোমলমতি শিশু-কিশোরদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আজ শিক্ষার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দেখা যায় হেফাজতে ইসলাম ও তার প্রধান তেঁতুল হুজুরকে। এটা কি ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আদর্শের সঙ্গে আদৌ সঙ্গতিপূর্ণ?

শুধু একুশের মাসব্যাপী গ্রন্থমেলার জৌলুস বৃদ্ধি বা সময় ও এলাকাবৃদ্ধির দ্বারা একুশের চেতনা ও আদর্শের প্রচার প্রসার হচ্ছে তা বলা যাবে কি? ধর্মনিরপেক্ষতা কার্যত বিদায় দিয়ে রাষ্ট্রধর্ম লালনের মাধ্যমে ধর্মীয় বৈষম্য বৃদ্ধি, পাঠ্যক্রমের সাম্প্রদায়িকীকরণের মাধ্যমে পশ্চাদপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাভাবনার বিকাশ জোরকদমে ঘটানো হচ্ছে। সরকারি উদ্যোগে মসজিদ নির্মাণ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মূলে শুধু নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী কোটি কোটি মুসলিমও মানসিকভাবে ও নৈতিকভাবে সমর্থনের কোন পথ খুজে পাচ্ছে না। একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রর্বতন ছিল আমাদের জাতীয় অঙ্গীকার। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছেটা কি? কিন্ডারগার্টেনের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার, মাদ্রাসাগুলোর সংখ্যা হু হু করে বাড়িয়ে আরবি এবং ধর্মীয় শিক্ষার বিকাশ এতগুলি বা ত্রিধারা শিক্ষা কি আমাদের জাতীয় ও সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক বিকাশের সহায়ক? নাকি প্রকৃতপক্ষে বাংলা শিক্ষার অবমূল্যায়ন করে আমরা ইংরেজি, আরবি শিক্ষার প্রতি অধিকতর মনোযোগ দিয়েছি। বাংলা ভাষার আন্দোলনের মহিমা কোথায় রক্ষিত হচ্ছে? ইংরেজি শিক্ষা ও তার প্রভাব বৃদ্ধির অনুকূল-আবার বাংলা শিক্ষার অবমূল্যায়ন কোন কল্যাণ বয়ে আনবে না। আইনের বই, দর্শনের বই, বিজ্ঞানের বই, বাংলায় অনুবাদ কতটুকু হয়েছে? কেন বেশি বেশি হচ্ছে না? উচ্চ আদালতে পুরোপুরি বাংলা ভাষার প্রবর্তনের পথে বাধাই বা কোথায়?

স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় স্বীকৃত দুশমন জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলামকে কেন বেআইনি ঘোষণা করা হচ্ছে না সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে। শুধু মুক্তিযোদ্ধা, শুধু দেশবাসীরই দাবি এটা তা তো নয়। উচ্চ আদালতের রায় বারবার তেমনই নির্দেশনা দিয়েছে তবুও সেদিকে কোন অগ্রগতি নেই।

তাই হিসাব-নিকাশ কি পাওয়া যায়? ভাষা আন্দোলনের বিপুল অর্জনের পাশাপাশি আমরা হারালাম কতটুকু? মৌলিক আদর্শিক বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে? বর্জনের পথেই কি হাঁটছি না আমরা শহীদদের আদর্শ বাস্তবায়নের নামে? একটি উৎপাদনশীল অর্থনীতি, আত্মনির্ভরতার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার বদলে আমদানিনির্ভর অর্থনীতি দিয়ে দেশকে উন্নত করা যাবে না। আমরা হতে চাই অধিক থেকে অধিকতর রফতানির ক্ষমতাসম্পন্ন, নতুন নতুন শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে বেকারত্বমুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত এক নবীন বাংলাদেশ। ভাষা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যা থাকবে দীপ্তমান। সেই বাংলাদেশে সবাই নির্ভয়ে তার নিজ নিজ ধর্ম পালন করার স্বাধীনতা ভোগ করবে। রাষ্ট্রের কোন ধর্ম থাকবে না- এ নীতি প্রতিষ্ঠায় দেশ কি আজও অঙ্গীকারবদ্ধ?

[লেখক : সংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত ]