রাজশাহীতে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধ

আফজাল হোসেন ছবি

একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরুর পরপরই বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপরই বাংলাদেশের চেহারা পুরো পাল্টে যায়। ২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যা করে পুরো শহর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাওয়ার পর সারা দেশে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। বিভিন্ন স্থানে একদিকে সংগ্রামী ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক-জনতা, অন্যদিকে বাঙালি সেনা সদস্য, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনী পাকিস্তান বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে তাদের ওপর সশস্ত্র হামলা শুরু করে। একই সময়ে বাঙালি যুবকদের যুদ্ধ যাত্রা শুরু হয়। একাত্তরের ২৮ মার্চ রাজশাহীতে পুলিশ লাইনে পাকিস্তান হানারদার বাহিনীর সঙ্গে ছাত্র-জনতা-পুলিশের প্রচ- যুদ্ধ হয়। আমরা যারা তখন রাজশাহীতে ছাত্র রাজনীতি করি এবং আওয়ামী লীগ, ন্যাপসহ বিভিন্ন দলের রাজনীতিবিদ তারা সবাই একাত্তরে সেই দিনে (২৮ মার্চ) বাঙালি পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। সেটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর রাজশাহীতে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধ। সেই যুদ্ধের স্মৃতি আমাদের মনে এখনও উজ্জ্বল-অম্লান।

একাত্তরের উত্তাল মার্চে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ঢাকার মতোই রাজশাহীতে শুরু হয় স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত প্রস্তুতি। আমি তখন ছিলাম রাজশাহী সরকারি নিউ ডিগ্রি কলেজের ছাত্র। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী এবং রাজশাহী কোর্ট আঞ্চলিক ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে আন্দোলন সংগ্রামে সারাক্ষণই সম্পৃক্ত ছিলাম। ১ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ৩ মার্চ আহুত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজশাহীতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানবিরোধী স্লোগান দিতে দিতে সব শ্রেণী পেশার মানুষ মিছিল নিয়ে পথে নেমে আসে।

তখন রাজশাহীর আন্দোলন সংগ্রামে যেসব ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতারা নেতৃত্ব দিতেন তাদের মধ্যে ছিলেন সিকান্দর আবু জাফর, সাইদুল ইসলাম, মোখলেছুর রহমান, শফিকুর রহমান বাদশা, মোর্শেদ কোরাইশী স্বপন, আবদুল কুদ্দুস, আবদুল মান্নান, এম আতাউর রহমান, গোলাম আরিফ টিপু, মিয়া মোহাম্মদ মোহসিন, জামিলুর রহমান মাস্টারদা, রুহল আমিন প্রামানিক, মাহতাব উদ্দিন, মহসিন প্রামানিক, আবদুল হাদী, সাইদুল ইসলাম, বদিউজ্জামান, হাবিবুর রহমান টুকু, আলমগীর মোহাম্মদ কামাল, আবদুল লতিফ চঞ্চল, ফরহাদ আলী মিয়া, হারুনর রশিদ, বদরে আলম বরদী, আসম শফিউদ্দিন সাদি, গোলাম ইজদানি, নুরে আফতাব, আহমদ শফিউদ্দিন, জুলফিকার আহমেদ গোলাপ, একে এম আবদুর রউফ, সুখেন মুখার্জী, আতাউর শান্তু, অংকুর সেন, অসিত সেন, লুৎফর রহমান লুথু, হাবিবুর রহমান জার্মান, শহীদ নূরুল ইসলাম. একেএম জাহাঙ্গীর, ইমরুল কায়েস, মাহবুবুল আলম, শাহজাহান আলী বূরজান, সরোয়ারুল ইসলাম বুলেট, জাকাউল ইসলাম, আলী আসগর স্বপন, গোলাম ফারুক ফটু, আবদুল মালেক চৌধুরী, মোস্তাফিজুর রহমান খান আলম, সাইদুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান টুকু, মোসতাকুল মোরশেদ বুজি প্রমুখ।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষনের ২/১ দিনের মধ্যেই নেতারা রাজশাহীর বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় ডামি রাইফেল নিয়ে ছাত্র-যুবকদের গেরিলা ট্রেনিং দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রশিক্ষণ দেয়ার দায়িত্ব দেন ইপিআরের দুই সৈনিককে। তারা আমাদের প্রশিক্ষণ দেন কীভাবে রাইফেল শত্রুর দিকে তাক করে গুলি ছুড়তে হয়। আমরা ছাত্র নেতারা বিভিন্ন করাত কল থেকে ডামি রাইফেল তৈরি করে আনি। তখন প্রশিক্ষণ নেয়া রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতাদের অনেকেই পরে প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে রাজশাহীতে সবচেয়ে স্মরণীয় এবং বীরত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ২৩ মার্চ রাজশাহীতে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন। সেদিন নেতাদের নির্দেশে আমি আদালত ভবনের ছাদে উঠে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা তুলি। পতাকা উত্তোলনের পর হাজার হাজার মানুষ হাততালি আর সে্লাগানে ফেটে পড়েন।

তারপরই বাঙালি জাতির জীবনে সেই কালো রাত ২৫ মার্চ এলো। ঢাকায় নির্বিচারে গুলি করে মারা শুরু করে পাকিস্তানিরা। রাজশাহী ইপিআরের দুই সিপাই অলি ও কামরুল এ খবর পুলিশ লাইনে এসে সবাইকে জানায়। সঙ্গে সঙ্গেই নেতারা পাকিস্তান বাহিনীকে প্রতিরোধ এবং প্রয়োজনে তাদের ওপর হামলা করার সিদ্ধান্ত নেন। এরপরই সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা যাতে শহরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য বিভিন্ন সড়কে ব্যরিকেড দেয়া হয়। বিভিন্ন স্থানে বিক্ষুব্ধ মানুষ লাঠিসোটা এবং দেশীয় অস্ত্র নিয়ে অবস্থায় নেয়। পুলিশ সদস্যরা অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হয়ে যায়। রাজশাহী সেনানিবাসে তখন খুব বেশি পাকিস্তানি সেনা সদস্য ছিল না। ঢাকায় গণহত্যা শুরুর পর ২৫ মার্চেই পুলিশলাইনে হামলার জন্য সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে আসে পাকিস্তান বাহিনী। তার আগে বিভিন্ন সড়কের বেরিকেড অপসারণ করতে গিয়ে ব্যাপক বাধার মুখে পড়ে তারা। তবে শেষ পর্যন্ত পুলিশ লাইনের কাছাকাছি আসতে সক্ষম হয়। এ সময় পুলিশলাইনে পুলিশ অস্ত্রাগারের দায়িত্বে ছিলেন এক অবাঙালি পুলিশ সদস্য। বিদ্রোহী পুলিশরা পুলিশের অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র নিতে গেলে সে বাধা দেয়। তখন আতিক নামে পুলিশের এক হাবিলদার জোর করে অস্ত্রাগারের চাবি ছিনিয়ে নেন। সে অস্ত্র পুলিশ ও চাত্র জনতার মধ্যে বিতরণ করা হয়। এরপর ছাত্র জনতা ও পুলিশের আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে যায় এবং আরও উদ্যমে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। ২৭ মার্চ সকাল থেকেই কারফিউ জারী করা হয়। ওই দিনই দুপুর আড়াইটার দিকে পাকিস্তান বাহিনী আবার হামলা করে। আবারও প্রতিরোধ করে ছাত্র জনতা ও পুলিশ সদস্যরা। এরপরও পাকিস্তান সৈন্যরা পুলিশ লাইন দখল করতে পারেনি। এরপর ২৮ মার্চ আরও সৈন্য, অস্ত্র নিয়ে নতুন শক্তি সঞ্চয় করে পাকিস্তান বাহিনী চূড়ান্ত হামলা চালায়। সেদিন প্রচ- যুদ্ধ হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে। কিন্তু পুলিশ-জনতাকে হঠাতে পারেনি পাকিস্তানিরা। বরং পাকিস্তানিরা পিছু হঠে আবার সেনানিবাসে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। সেটাই ছিল রাজশাহীতে বড় যুদ্ধ। এসময় ইপিআর-এ কর্মরত মেজর গিয়াসের নেতৃত্বে মেজর নাজমুল, ক্যাপ্টেন রশিদ প্রমুখ পুলিশ ও ছাত্র জনতাকে সংগঠিত করে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। সে যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা মেজর আসলাম ও ক্যাপ্টেন রেজা নিহত হয়। তখন পুলিশলাইনের পাশে ছিল সরকারি স্টাফ কোয়ার্টার। সেখান থেকে পুলিশলাইনে খাবার ও পানি সরবরাহ করা হয়। তখনকার ছাত্র খাইরুল আনাম নোমান ও মহসিন, ম্যাজিস্ট্রেট জালাল, খাদেমুল, রতন, মজনু, ভুলু, মালেক চৌধুরী প্রমুখ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তারা বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী দিয়ে সড়কে ব্যরিকেড দেন পাকিস্তান বাহিনীকে আটকে দিতে। ডা. মাহবুবুল আলম, ডা, টুকু প্রমুখ যুদ্ধে আহতদের চিকিৎসা করেন।

এভাবে আরও কয়েকদিন কেটে যায়। এরপর পাকিস্তান বাহিনী বগুড়া সেনানিবাসসহ আশেপাশের বিভিন্ন সেনা ছাউনি থেকে আরও সৈন্য এবং ভারি অস্ত্র নিয়ে আসে রাজশাহী সেনানিবাসে। এরপর ৩/৪ এপ্রিলে পূর্ণ শক্তি নিয়ে পাকিস্তান বাহিনী হামলা চালায়। এ সময় তারা মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করে এগিয়ে আসে। এ অবস্থায় কয়েকদিন গোলাগুলি চলে। কিন্তু পাকিস্তান বাহিনীর তীব্র আক্রমণে পুলিশ সদস্য ও ছাত্রজনতার টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। অনেক পুলিশ সদস্য এবং সাধারণ মানুষ পাকিস্তান বাহিনীর আক্রমণে গুলিতে শহীদ হন। পরে পুলিশলাইন ছেড়ে সবাই যার যার নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। ১৩ এপ্রিল পাকিস্তান বাহিনী রাজশাহী শহর পুরোপুরি দখল করতে সক্ষম হয়।

[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরের ভারতের বিহারে চাকুলিয়া সেনানিবাসে প্রশিক্ষণ নিয়ে রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন]

শনিবার, ২৮ মার্চ ২০২০ , ১৪ চৈত্র ১৪২৬, ২৮ রজব সানি ১৪৪১

ডেটলাইন ২৮ মার্চ ১৯৭১

রাজশাহীতে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধ

আফজাল হোসেন ছবি

একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরুর পরপরই বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপরই বাংলাদেশের চেহারা পুরো পাল্টে যায়। ২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যা করে পুরো শহর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাওয়ার পর সারা দেশে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। বিভিন্ন স্থানে একদিকে সংগ্রামী ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক-জনতা, অন্যদিকে বাঙালি সেনা সদস্য, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনী পাকিস্তান বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে তাদের ওপর সশস্ত্র হামলা শুরু করে। একই সময়ে বাঙালি যুবকদের যুদ্ধ যাত্রা শুরু হয়। একাত্তরের ২৮ মার্চ রাজশাহীতে পুলিশ লাইনে পাকিস্তান হানারদার বাহিনীর সঙ্গে ছাত্র-জনতা-পুলিশের প্রচ- যুদ্ধ হয়। আমরা যারা তখন রাজশাহীতে ছাত্র রাজনীতি করি এবং আওয়ামী লীগ, ন্যাপসহ বিভিন্ন দলের রাজনীতিবিদ তারা সবাই একাত্তরে সেই দিনে (২৮ মার্চ) বাঙালি পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। সেটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর রাজশাহীতে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধ। সেই যুদ্ধের স্মৃতি আমাদের মনে এখনও উজ্জ্বল-অম্লান।

একাত্তরের উত্তাল মার্চে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ঢাকার মতোই রাজশাহীতে শুরু হয় স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত প্রস্তুতি। আমি তখন ছিলাম রাজশাহী সরকারি নিউ ডিগ্রি কলেজের ছাত্র। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী এবং রাজশাহী কোর্ট আঞ্চলিক ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে আন্দোলন সংগ্রামে সারাক্ষণই সম্পৃক্ত ছিলাম। ১ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ৩ মার্চ আহুত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজশাহীতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানবিরোধী স্লোগান দিতে দিতে সব শ্রেণী পেশার মানুষ মিছিল নিয়ে পথে নেমে আসে।

তখন রাজশাহীর আন্দোলন সংগ্রামে যেসব ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতারা নেতৃত্ব দিতেন তাদের মধ্যে ছিলেন সিকান্দর আবু জাফর, সাইদুল ইসলাম, মোখলেছুর রহমান, শফিকুর রহমান বাদশা, মোর্শেদ কোরাইশী স্বপন, আবদুল কুদ্দুস, আবদুল মান্নান, এম আতাউর রহমান, গোলাম আরিফ টিপু, মিয়া মোহাম্মদ মোহসিন, জামিলুর রহমান মাস্টারদা, রুহল আমিন প্রামানিক, মাহতাব উদ্দিন, মহসিন প্রামানিক, আবদুল হাদী, সাইদুল ইসলাম, বদিউজ্জামান, হাবিবুর রহমান টুকু, আলমগীর মোহাম্মদ কামাল, আবদুল লতিফ চঞ্চল, ফরহাদ আলী মিয়া, হারুনর রশিদ, বদরে আলম বরদী, আসম শফিউদ্দিন সাদি, গোলাম ইজদানি, নুরে আফতাব, আহমদ শফিউদ্দিন, জুলফিকার আহমেদ গোলাপ, একে এম আবদুর রউফ, সুখেন মুখার্জী, আতাউর শান্তু, অংকুর সেন, অসিত সেন, লুৎফর রহমান লুথু, হাবিবুর রহমান জার্মান, শহীদ নূরুল ইসলাম. একেএম জাহাঙ্গীর, ইমরুল কায়েস, মাহবুবুল আলম, শাহজাহান আলী বূরজান, সরোয়ারুল ইসলাম বুলেট, জাকাউল ইসলাম, আলী আসগর স্বপন, গোলাম ফারুক ফটু, আবদুল মালেক চৌধুরী, মোস্তাফিজুর রহমান খান আলম, সাইদুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান টুকু, মোসতাকুল মোরশেদ বুজি প্রমুখ।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষনের ২/১ দিনের মধ্যেই নেতারা রাজশাহীর বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় ডামি রাইফেল নিয়ে ছাত্র-যুবকদের গেরিলা ট্রেনিং দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রশিক্ষণ দেয়ার দায়িত্ব দেন ইপিআরের দুই সৈনিককে। তারা আমাদের প্রশিক্ষণ দেন কীভাবে রাইফেল শত্রুর দিকে তাক করে গুলি ছুড়তে হয়। আমরা ছাত্র নেতারা বিভিন্ন করাত কল থেকে ডামি রাইফেল তৈরি করে আনি। তখন প্রশিক্ষণ নেয়া রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতাদের অনেকেই পরে প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে রাজশাহীতে সবচেয়ে স্মরণীয় এবং বীরত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ২৩ মার্চ রাজশাহীতে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন। সেদিন নেতাদের নির্দেশে আমি আদালত ভবনের ছাদে উঠে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা তুলি। পতাকা উত্তোলনের পর হাজার হাজার মানুষ হাততালি আর সে্লাগানে ফেটে পড়েন।

তারপরই বাঙালি জাতির জীবনে সেই কালো রাত ২৫ মার্চ এলো। ঢাকায় নির্বিচারে গুলি করে মারা শুরু করে পাকিস্তানিরা। রাজশাহী ইপিআরের দুই সিপাই অলি ও কামরুল এ খবর পুলিশ লাইনে এসে সবাইকে জানায়। সঙ্গে সঙ্গেই নেতারা পাকিস্তান বাহিনীকে প্রতিরোধ এবং প্রয়োজনে তাদের ওপর হামলা করার সিদ্ধান্ত নেন। এরপরই সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা যাতে শহরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য বিভিন্ন সড়কে ব্যরিকেড দেয়া হয়। বিভিন্ন স্থানে বিক্ষুব্ধ মানুষ লাঠিসোটা এবং দেশীয় অস্ত্র নিয়ে অবস্থায় নেয়। পুলিশ সদস্যরা অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হয়ে যায়। রাজশাহী সেনানিবাসে তখন খুব বেশি পাকিস্তানি সেনা সদস্য ছিল না। ঢাকায় গণহত্যা শুরুর পর ২৫ মার্চেই পুলিশলাইনে হামলার জন্য সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে আসে পাকিস্তান বাহিনী। তার আগে বিভিন্ন সড়কের বেরিকেড অপসারণ করতে গিয়ে ব্যাপক বাধার মুখে পড়ে তারা। তবে শেষ পর্যন্ত পুলিশ লাইনের কাছাকাছি আসতে সক্ষম হয়। এ সময় পুলিশলাইনে পুলিশ অস্ত্রাগারের দায়িত্বে ছিলেন এক অবাঙালি পুলিশ সদস্য। বিদ্রোহী পুলিশরা পুলিশের অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র নিতে গেলে সে বাধা দেয়। তখন আতিক নামে পুলিশের এক হাবিলদার জোর করে অস্ত্রাগারের চাবি ছিনিয়ে নেন। সে অস্ত্র পুলিশ ও চাত্র জনতার মধ্যে বিতরণ করা হয়। এরপর ছাত্র জনতা ও পুলিশের আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে যায় এবং আরও উদ্যমে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। ২৭ মার্চ সকাল থেকেই কারফিউ জারী করা হয়। ওই দিনই দুপুর আড়াইটার দিকে পাকিস্তান বাহিনী আবার হামলা করে। আবারও প্রতিরোধ করে ছাত্র জনতা ও পুলিশ সদস্যরা। এরপরও পাকিস্তান সৈন্যরা পুলিশ লাইন দখল করতে পারেনি। এরপর ২৮ মার্চ আরও সৈন্য, অস্ত্র নিয়ে নতুন শক্তি সঞ্চয় করে পাকিস্তান বাহিনী চূড়ান্ত হামলা চালায়। সেদিন প্রচ- যুদ্ধ হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে। কিন্তু পুলিশ-জনতাকে হঠাতে পারেনি পাকিস্তানিরা। বরং পাকিস্তানিরা পিছু হঠে আবার সেনানিবাসে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। সেটাই ছিল রাজশাহীতে বড় যুদ্ধ। এসময় ইপিআর-এ কর্মরত মেজর গিয়াসের নেতৃত্বে মেজর নাজমুল, ক্যাপ্টেন রশিদ প্রমুখ পুলিশ ও ছাত্র জনতাকে সংগঠিত করে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। সে যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা মেজর আসলাম ও ক্যাপ্টেন রেজা নিহত হয়। তখন পুলিশলাইনের পাশে ছিল সরকারি স্টাফ কোয়ার্টার। সেখান থেকে পুলিশলাইনে খাবার ও পানি সরবরাহ করা হয়। তখনকার ছাত্র খাইরুল আনাম নোমান ও মহসিন, ম্যাজিস্ট্রেট জালাল, খাদেমুল, রতন, মজনু, ভুলু, মালেক চৌধুরী প্রমুখ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তারা বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী দিয়ে সড়কে ব্যরিকেড দেন পাকিস্তান বাহিনীকে আটকে দিতে। ডা. মাহবুবুল আলম, ডা, টুকু প্রমুখ যুদ্ধে আহতদের চিকিৎসা করেন।

এভাবে আরও কয়েকদিন কেটে যায়। এরপর পাকিস্তান বাহিনী বগুড়া সেনানিবাসসহ আশেপাশের বিভিন্ন সেনা ছাউনি থেকে আরও সৈন্য এবং ভারি অস্ত্র নিয়ে আসে রাজশাহী সেনানিবাসে। এরপর ৩/৪ এপ্রিলে পূর্ণ শক্তি নিয়ে পাকিস্তান বাহিনী হামলা চালায়। এ সময় তারা মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করে এগিয়ে আসে। এ অবস্থায় কয়েকদিন গোলাগুলি চলে। কিন্তু পাকিস্তান বাহিনীর তীব্র আক্রমণে পুলিশ সদস্য ও ছাত্রজনতার টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। অনেক পুলিশ সদস্য এবং সাধারণ মানুষ পাকিস্তান বাহিনীর আক্রমণে গুলিতে শহীদ হন। পরে পুলিশলাইন ছেড়ে সবাই যার যার নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। ১৩ এপ্রিল পাকিস্তান বাহিনী রাজশাহী শহর পুরোপুরি দখল করতে সক্ষম হয়।

[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরের ভারতের বিহারে চাকুলিয়া সেনানিবাসে প্রশিক্ষণ নিয়ে রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন]