শতবর্ষে মুজিব ॥ ডিজিটাল সোনার বাংলাদেশ

মোস্তাফা জব্বার

আমরা বঙ্গবন্ধুকে শুধু যে ভাষা রাষ্ট্রের পিতা হিসেবে পেয়েছি তাই নয়, তার জন্মের শতবার্ষিকী পালনের সময় জেনে গেছি লাঙল-জোয়ালের দেশটাকে ডিজিটাল করার বীজও তিনিই বপন করেন। তিনিই তার স্বপ্নের সোনার বাংলার সংজ্ঞাও নির্ধারণ করে দেন। তিনি বলে যান- সোনার বাংলা হলো ক্ষুধা-দারিদ্র্য মুক্ত, বৈষম্যহীন উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। এমনকি তিনি মস্কো বা পিকিংপন্থি সমাজতন্ত্রের ছকের বাইরে এসে তার মতো করে সমাজতান্ত্রিক ধারণার বিষয়টিও আমাদের জানিয়ে দিয়ে যান। তার বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠনের মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত বা দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচিতে তার এই ভাবনার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামজিক রূপটিও ফুটে উঠেছে।

বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলন করতে গিয়েই উপলব্ধি করেছিলেন যে বাঙালির নিজস্ব রাষ্ট্র ছাড়া সোনার বাংলা হবে না। ভাষা আন্দোলনের পাশাপাশি তিনি তাই রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলেন। সেই রাজনৈতিক সংগঠন শুধু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকারী মুসলিম লীগকে চ্যালেঞ্জই করেনি ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করার জন্য সার্বিক পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করে। এটিও স্মরণ রাখা দরকার যে, স্বাধীনতার পরও জাতির পিতা দেশটিকে সোনার বাংলায় পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। একদিকে তিনি বাংলা ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, অন্যদিকে একটি সুখী, সমৃদ্ধ, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বৈষম্যহীন সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য সব ভিত্তি তৈরি করেন। তিনি আয়ের বা সম্পদের সুষম বণ্টনের ব্যবস্থাও করেন। সেই সময়ে ২৫ বিঘার খাজনা মওকুফ ও ১০০ বিঘার ওপরে জমি রাখতে না পারার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত একটি বৈষম্যহীন সাম্য-সমাজ প্রতিষ্ঠারই অঙ্গীকার ছিল।

২০০৮ সালে ঘোষণা করার পর আমরা ২০০৯ থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য কাজ করছি। বস্তুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর তার দলের নির্বাচনী ইশতেহারে যে ঘোষণা দিয়েছিলেন তারই বাস্তবায়ন করছি আমরা। ২১ সাল সেই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার একটি মাইলফলক। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এর মাঝে ২০৪১ সালকে পরের মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত করে সরকারি প্রেক্ষিত পরিকল্পনাও প্রস্তুত করছেন। এটির প্রথম খসড়া পেশ হয়েছে। সহসাই এর চূড়ান্ত রূপ অনুমোদিত হবে। সেই প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়নের সময়ও আমাদের বঙ্গবন্ধুর ভাষা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও তার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশের বিষয়টি অনুধাবন করতে হচ্ছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে বস্তুত আমাদের তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হচ্ছে। খুব সংক্ষেপে আমরা প্রেক্ষিতটা একটু আলোচনা করতে পারি।

বঙ্গবন্ধু প্রণীত ’৭২ সালের সংবিধানের মূলমন্ত্র ছিল চারটি- গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরপক্ষেতা ও জাতীয়তাবাদ। বঙ্গবন্ধুর শাসনকালের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনকাল ছাড়া সেই চার নীতির গণতন্ত্র শব্দটি ছাড়া বাকি সবগুলোই মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। সেই সময়টিতে বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র শব্দটি কেউ উচ্চারণ করত না। কিন্তু ঐতিহাসিক বাস্তবতা হচ্ছে সমাজতন্ত্রের আদর্শগত দিকগুলোর বাস্তবায়ন ছাড়া মুক্তির কোন পথ নেই। হয়তো কার্লমার্ক্সের সমাজতন্ত্র ডিজিটাল যুগে প্রতিষ্ঠা করা যাবে না, কিন্তু ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর করতে বা এমনকি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে ডিজিটাল যুগের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া বিকল্প কোন উপায় নেই। এক সময়কার কায়িকশ্রম-যান্ত্রিক শিল্প যুগনির্ভর শ্রেণীনির্ভর মালিক-শ্রমিক কাঠামোটি দিনে দিনে মেধাশ্রমভিত্তিক কাঠামোতে রূপান্তরিত হচ্ছে। ফলে শিল্পের কাঠামো পরিবর্তনসহ শ্রেণীচরিত্র বা শ্রেণী সংগ্রামের সংজ্ঞা বদলাচ্ছে। কোন এক ডিজিটাল বিপ্লবীকে মার্ক্স-লেনিন-এঙ্গেলস এর সমাজতন্ত্রকে নতুন করে বর্ণনা করতে হবে-ব্যাখ্যা করতে হবে। দিতে হবে নতুন তত্ত্ব। তবে সমাজতন্ত্র যে মৌলিক চাহিদা পূরণে রাষ্ট্রের অবশ্য করণীয় দায়িত্ব, সম্পদের সুষম বণ্টন, জাতীয় সম্পদের রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও বৈষম্যহীনতার ধারণাকে জন্ম দিয়েছে সেটি দুনিয়া থেকে বিদায় করা যাবে না। বরং সমাজতন্ত্রের ডিজিটাল ধারাটির জন্য সারা দুনিয়ায় নতুন করে লড়াই চলবে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে এই দেশের মার্ক্সপন্থি (গোপনে) রাজনৈতিক দলগুলো মার্কসের ধারণার ডিজিটাল রূপান্তর অনুধাবন করতে অক্ষম। মার্কস শিল্পযুগের প্রথম স্তরটির বিশ্লেষণ করেছিলেন। ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার বা ডাস ক্যাপিটাল দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব এর আগের প্রকাশনা। ফলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে এসে মার্কসবাদ নিয়ে সামনে যাওয়া কঠিন। আমাদের জাতির পিতা অবশ্য অনেক আগেই বুঝেছিলেন যে মার্কসবাদই শেষ কথা নয়।

মার্কসের সেই ধারাবাহিকতা শিল্প বিপ্লবের দ্বিতীয় স্তরে ও তৃতীয় স্তর পর্যন্ত চলমান ছিলো। তবে অবশ্যই মার্ক্সের চিন্তা ভাবনা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে সমভাবে প্রযোজ্য হবে না। অথচ বঙ্গবন্ধুর কথা ভাবুন। তিনি নিজে কমিউনিস্ট ছিলেন না। তাকে তৎকালীন কোন কোন মার্ক্সবাদী সাম্রাজ্যবাদের দালাল বলতো। তিনি নিজেও প্রচলিত কমিউনিজম ধারণায় বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন ‘সারা দুনিয়ার মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত- শোষক ও শোষিত; আমি শোষিতের পক্ষে।’ যখন তিনি দেশটি স্বাধীন করে দেশের শাসনতন্ত্র রচনা করেন তখন রাষ্ট্রের লক্ষ্য হিসেবে সমাজতন্ত্রকে অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। আমরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর বাকশালকে গালিতে রূপান্তর হতে দেখছি। তিনি বাকশাল করে নাকি একদলীয় শাসন কায়েম করে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছিলেন। বলা হয়, খুনি জিয়াউর রহমান দেশটিতে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু বাকশাল বা বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির দিকে একটু তাকিয়ে দেখুন-একটি সমৃদ্ধ-উন্নত বাংলাদেশ থেকে বৈষম্য দূর করতে হলে ফিরে যেতে হবে সেই দ্বিতীয় বিপ্লবেই।

গণতন্ত্রের কথাও যদি বলেন তবে বাকশালে যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে তার চাইতে উৎকৃষ্ট গণতন্ত্র চর্চা আর কি হতে পারে? বহুদল মানেই প্রকৃত গণতন্ত্র সেটি যারা মনে করেন তারা শুধু পশ্চিমা ধারণার গণতন্ত্রের কথাই চিন্তা করেন। এটি যে একটি মাত্র দলের মাধ্যমেই সম্পূর্ণ ঐক্যমত্যের গণতন্ত্র হতে পারে এবং সেই পদ্ধতিতেও যে নির্বাচন হতে পারে ও জনগণের পছন্দ-অপছন্দ বাছাই করা যেতে পারে সেটি নিন্দুকেরা আলোচনাতেই আনে না।

অন্যদিকে ধর্ম নিরপেক্ষতা যে বাংলাদেশের শক্তি সেটি এখন ভারত-পাকিস্তানসহ সারা দুনিয়া উপলব্ধি করে। ভারত ও পাকিস্তানের চাইতে বাংলাদেশের অগ্রগতির অন্যতম একটি কারণ হিসেবে অসাম্প্রদায়িকতাকে মনে করা হয়। পাকিস্তান মৌলবাদের কাছে জিম্মি হয়ে ও ভারত উগ্রবাদের হাতে জিম্মি হয়ে অগ্রগতির চাকাকে সামনে না নিয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিয়ে জটিলতায় পড়েছে।

আমরা যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কথা বলছি তখনও সেই মহামানবের কথাই ভাবতে হচ্ছে। এই বিষয়টি অনেকের কাছে বহুলাংশে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু তার কর্মকা- দেখলেই বোঝা যাবে তিনি কতোটা দূরদর্শিতার অধিকারী ছিলেন। তিনি সেই ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশকে ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়ন ও ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের সদস্যপদ গ্রহণ করান। একটু ভেবে রাখুন ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন তিনি বেতবুনিয়ায় উপগ্রহ ভূকেন্দ্র উদ্বোধন করেন। সেই পথ ধরেই আমরা ২০১৮ সালের ১২ মে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করি। কতো দূরদর্শী হলে একটি দরিদ্র দেশেও উপগ্রহ নির্মাণের কথা ভাবা যায়।

আজকে আমরা যখন মানবসম্পদের কথা বলি তখন ভাবতে হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার রূপান্তরের কথা। ভেবে দেখুন তিনি যখন তার দেশের নাগরিকদের ভাত জুটাতে পারেন না-কর্মচারীদের বেতন দিতে পারেন না, সড়ক-সেতু বানাতে পারেন না তখন প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করেন। আজকে আমরা উপলব্ধি করতে পারছি যে, প্রাথমিক শিক্ষাকে শক্তিশালী করতে না পারলে ডিজিটাল যুগের মানবসম্পদ গড়ে তোলা যাবে না। বস্তুত তার ধারণাতেই আমাদের ৪১ সালের বাংলাদেশ গড়ে তোলার কথা ভাবতে হবে।

জিয়া-এরশাদ-খালেদা বাংলাদেশকে যেভাবে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার অপচেষ্টা করেছে এবং সারা দুনিয়ার ধমভিত্তিক রাজনৈতির্ক পরিস্থিতি যেমনটা তাতে বাংলাদেশের জন্য ধর্মনিরপেক্ষেতা বজায় রাখাকেই একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল। একই কারণে বাঙালির জাতিসত্তা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ছিলো। নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদের মূল কথাগুলো তুলে ধরা হয়নি বলে এখন তরুণদের একাংশকে ইসলামী জঙ্গিতে রূপান্তরিত করার চেষ্টা হয়। অথচ বঙ্গবন্ধুকে তো বটেই পুরো বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানিরা অমুসলিম বানাতে চেষ্টা করেও সফল হয়নি। একাত্তরে তারা স্পষ্ট করেই বলেছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দারা মুসলমান নয়-হিন্দু। বাঙালি মুসলমানদের হত্যা বা ধর্ষণ করার পেছনে তাদের এ মানসিকতা কাজ করেছে। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় ‘দুষ্কৃতকারী’ ও ‘হিন্দু’ বলেই গালি খেয়েছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে কৌশলের সঙ্গে এই সাম্প্রদায়িকতাকে মোকাবিলা করছেন সেটি ভারত-পাকিস্তানসহ সারা বিশ্বের কাছে প্রশংসিত হয়েছে। পাকিস্তানিরা বরং এটি উপলব্ধি করেছে যে, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার জন্য পাকিস্তানের অগ্রগতি থেমে যাচ্ছে।

বঙ্গবন্ধুর জন্য আমার চোখের পানি আসে আরও একটি বিশাল কারণে। তাকে ছাড়া আমি নিজেকে অসহায় মনে করছি। আমার নিজের মতে বঙ্গবন্ধুর মতো আর কোন রাষ্ট্রনায়ক তার আগে বাঙালির মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রযন্ত্রে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেননি। আমি সেই মুজিবের কথা ভাবি, যে মুজিব ’৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষার দাবি তুলেন, ’৫২ সালে ভাষা আন্দোলন করেন, ’৫২ সালে চীনে ও ’৭৪ সালে জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দেন- তিনিই ’৭২ সালে অপটিমা মুনীর টাইপরাইটার বানিয়েছিলেন। আমি সেই মুজিবের কথা ভাবি, যিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার আগেই বলেছিলেন- ভুল হোক- শুদ্ধ হোক আমরা সরকার গঠন করলে সরকারি কাজে বাংলাই লিখব। কালক্রমে সেই মুজিবের আদর্শ থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সরে গিয়েছিল। এখনও বাংলাদেশের বেসরকারি অফিসে বাংলা বর্ণমালাই নেই। সরকারের কাজে-কর্মে বাংলা ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ডিজিটাল করার নামে প্রায়শই বাংলা হরফকে বিদায় করা হয়। উচ্চ আদালতে ও উচ্চশিক্ষায় বাংলার প্রচলন খুবই কম। উভয় ক্ষেত্রেই বঙ্গসন্তানরা তাদের মায়ের ভাষায় কথা বললেও কার্যক্ষেত্রে ভাষাটিকে প্রয়োগ করে না। কখনও বাংলা-ইংরেজি মিশ্র ভাষাও ব্যবহৃত হয়। অথচ এর কোন যৌক্তিক কারণ নেই। আদালতের বাদী-আসামি-বিচারক ও উকিল বাংলা ভাষাভাষী। তারা কেন বাংলা ব্যবহার করবে না, তার কোন কারণ কেউ বলতে পারবে না। উচ্চশিক্ষায় বাংলায় উপাত্তের অভাব রয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সময়টি পার করতে গিয়ে আমাদের উচিত ছিল এই দুর্বলতাটি দূর করা। কেন বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারকে আমরা বাংলায় রূপান্তর করতে পারলাম না তার কোন জবাব নেই। স্কুলপর্যায়েও শিক্ষার মাধ্যম বাংলাকে পরাভূত করার কুৎসিৎ অপচেষ্টা বিরাজ করে। ইংলিশ মিডিয়াম বা ইংলিশ ভার্সন শিক্ষার নামে বাংলাকে বিদায় করার চেষ্টা বাড়ছে। আবার বাংলা ভাষা লেখা হয় ইংরেজি অক্ষর দিয়ে। যে মানুষটি বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে ও জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিতে পেরেছিলেন সেই মানুষটির দেশে এখন চারপাশে রোমান হরফের রাজত্ব দেখি। ইংরেজি হরফে বাংলা লিখে সেটিকে ভুল বাংলায় রূপান্তর করার ডিজিটাল প্রক্রিয়ার ব্যাপক প্রসারের পাশাপাশি সরাসরি ইংরেজি হরফে বাংলা লেখার প্রবণতা প্রবলভাবে বাড়ছে। ডিজিটাল করার নামে এই ভয়াবহ অপচেষ্টাকে প্রতিরোধ করতে হবে। যে বাঙালি রোমান হরফে বা আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব গ্রহণ করেনি সেই বাঙালি এই অপচেষ্টাকে কখনও বাড়তে দিতে পারে না। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, শেখ মুজিবের বাংলাদেশে যেমনি গণতন্ত্র থাকবে, তেমনি এটি বাঙালি জাতীয়তাবাদকেও সর্বোচ্চ মর্যাদা দেবে। অন্যদিকে শেখ মুজিবের বাংলাদেশ থাকবে অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যহীন।

আসুন না সবাই মিলে বঙ্গবন্ধুর ভাষা রাষ্ট্রটাকেই বিশ্বের সেরা রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করি। আসুন সব ক্ষেত্রে সেই একজন বাঙালিকেই অনুসরণ করি। (সমাপ্ত)

ঢাকা, ২৭ মার্চ ২০২০।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান; সাংবাদিক, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]

mustafajabbar@gmail.com

মঙ্গলবার, ৩১ মার্চ ২০২০ , ১৭ চৈত্র ১৪২৬, ৫ শাবান ১৪৪১

শতবর্ষে মুজিব ॥ ডিজিটাল সোনার বাংলাদেশ

মোস্তাফা জব্বার

আমরা বঙ্গবন্ধুকে শুধু যে ভাষা রাষ্ট্রের পিতা হিসেবে পেয়েছি তাই নয়, তার জন্মের শতবার্ষিকী পালনের সময় জেনে গেছি লাঙল-জোয়ালের দেশটাকে ডিজিটাল করার বীজও তিনিই বপন করেন। তিনিই তার স্বপ্নের সোনার বাংলার সংজ্ঞাও নির্ধারণ করে দেন। তিনি বলে যান- সোনার বাংলা হলো ক্ষুধা-দারিদ্র্য মুক্ত, বৈষম্যহীন উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। এমনকি তিনি মস্কো বা পিকিংপন্থি সমাজতন্ত্রের ছকের বাইরে এসে তার মতো করে সমাজতান্ত্রিক ধারণার বিষয়টিও আমাদের জানিয়ে দিয়ে যান। তার বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠনের মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত বা দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচিতে তার এই ভাবনার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামজিক রূপটিও ফুটে উঠেছে।

বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলন করতে গিয়েই উপলব্ধি করেছিলেন যে বাঙালির নিজস্ব রাষ্ট্র ছাড়া সোনার বাংলা হবে না। ভাষা আন্দোলনের পাশাপাশি তিনি তাই রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলেন। সেই রাজনৈতিক সংগঠন শুধু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকারী মুসলিম লীগকে চ্যালেঞ্জই করেনি ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করার জন্য সার্বিক পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করে। এটিও স্মরণ রাখা দরকার যে, স্বাধীনতার পরও জাতির পিতা দেশটিকে সোনার বাংলায় পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। একদিকে তিনি বাংলা ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, অন্যদিকে একটি সুখী, সমৃদ্ধ, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বৈষম্যহীন সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য সব ভিত্তি তৈরি করেন। তিনি আয়ের বা সম্পদের সুষম বণ্টনের ব্যবস্থাও করেন। সেই সময়ে ২৫ বিঘার খাজনা মওকুফ ও ১০০ বিঘার ওপরে জমি রাখতে না পারার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত একটি বৈষম্যহীন সাম্য-সমাজ প্রতিষ্ঠারই অঙ্গীকার ছিল।

২০০৮ সালে ঘোষণা করার পর আমরা ২০০৯ থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য কাজ করছি। বস্তুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর তার দলের নির্বাচনী ইশতেহারে যে ঘোষণা দিয়েছিলেন তারই বাস্তবায়ন করছি আমরা। ২১ সাল সেই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার একটি মাইলফলক। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এর মাঝে ২০৪১ সালকে পরের মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত করে সরকারি প্রেক্ষিত পরিকল্পনাও প্রস্তুত করছেন। এটির প্রথম খসড়া পেশ হয়েছে। সহসাই এর চূড়ান্ত রূপ অনুমোদিত হবে। সেই প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়নের সময়ও আমাদের বঙ্গবন্ধুর ভাষা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও তার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশের বিষয়টি অনুধাবন করতে হচ্ছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে বস্তুত আমাদের তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হচ্ছে। খুব সংক্ষেপে আমরা প্রেক্ষিতটা একটু আলোচনা করতে পারি।

বঙ্গবন্ধু প্রণীত ’৭২ সালের সংবিধানের মূলমন্ত্র ছিল চারটি- গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরপক্ষেতা ও জাতীয়তাবাদ। বঙ্গবন্ধুর শাসনকালের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনকাল ছাড়া সেই চার নীতির গণতন্ত্র শব্দটি ছাড়া বাকি সবগুলোই মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। সেই সময়টিতে বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র শব্দটি কেউ উচ্চারণ করত না। কিন্তু ঐতিহাসিক বাস্তবতা হচ্ছে সমাজতন্ত্রের আদর্শগত দিকগুলোর বাস্তবায়ন ছাড়া মুক্তির কোন পথ নেই। হয়তো কার্লমার্ক্সের সমাজতন্ত্র ডিজিটাল যুগে প্রতিষ্ঠা করা যাবে না, কিন্তু ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর করতে বা এমনকি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে ডিজিটাল যুগের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া বিকল্প কোন উপায় নেই। এক সময়কার কায়িকশ্রম-যান্ত্রিক শিল্প যুগনির্ভর শ্রেণীনির্ভর মালিক-শ্রমিক কাঠামোটি দিনে দিনে মেধাশ্রমভিত্তিক কাঠামোতে রূপান্তরিত হচ্ছে। ফলে শিল্পের কাঠামো পরিবর্তনসহ শ্রেণীচরিত্র বা শ্রেণী সংগ্রামের সংজ্ঞা বদলাচ্ছে। কোন এক ডিজিটাল বিপ্লবীকে মার্ক্স-লেনিন-এঙ্গেলস এর সমাজতন্ত্রকে নতুন করে বর্ণনা করতে হবে-ব্যাখ্যা করতে হবে। দিতে হবে নতুন তত্ত্ব। তবে সমাজতন্ত্র যে মৌলিক চাহিদা পূরণে রাষ্ট্রের অবশ্য করণীয় দায়িত্ব, সম্পদের সুষম বণ্টন, জাতীয় সম্পদের রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও বৈষম্যহীনতার ধারণাকে জন্ম দিয়েছে সেটি দুনিয়া থেকে বিদায় করা যাবে না। বরং সমাজতন্ত্রের ডিজিটাল ধারাটির জন্য সারা দুনিয়ায় নতুন করে লড়াই চলবে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে এই দেশের মার্ক্সপন্থি (গোপনে) রাজনৈতিক দলগুলো মার্কসের ধারণার ডিজিটাল রূপান্তর অনুধাবন করতে অক্ষম। মার্কস শিল্পযুগের প্রথম স্তরটির বিশ্লেষণ করেছিলেন। ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার বা ডাস ক্যাপিটাল দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব এর আগের প্রকাশনা। ফলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে এসে মার্কসবাদ নিয়ে সামনে যাওয়া কঠিন। আমাদের জাতির পিতা অবশ্য অনেক আগেই বুঝেছিলেন যে মার্কসবাদই শেষ কথা নয়।

মার্কসের সেই ধারাবাহিকতা শিল্প বিপ্লবের দ্বিতীয় স্তরে ও তৃতীয় স্তর পর্যন্ত চলমান ছিলো। তবে অবশ্যই মার্ক্সের চিন্তা ভাবনা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে সমভাবে প্রযোজ্য হবে না। অথচ বঙ্গবন্ধুর কথা ভাবুন। তিনি নিজে কমিউনিস্ট ছিলেন না। তাকে তৎকালীন কোন কোন মার্ক্সবাদী সাম্রাজ্যবাদের দালাল বলতো। তিনি নিজেও প্রচলিত কমিউনিজম ধারণায় বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন ‘সারা দুনিয়ার মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত- শোষক ও শোষিত; আমি শোষিতের পক্ষে।’ যখন তিনি দেশটি স্বাধীন করে দেশের শাসনতন্ত্র রচনা করেন তখন রাষ্ট্রের লক্ষ্য হিসেবে সমাজতন্ত্রকে অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। আমরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর বাকশালকে গালিতে রূপান্তর হতে দেখছি। তিনি বাকশাল করে নাকি একদলীয় শাসন কায়েম করে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছিলেন। বলা হয়, খুনি জিয়াউর রহমান দেশটিতে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু বাকশাল বা বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির দিকে একটু তাকিয়ে দেখুন-একটি সমৃদ্ধ-উন্নত বাংলাদেশ থেকে বৈষম্য দূর করতে হলে ফিরে যেতে হবে সেই দ্বিতীয় বিপ্লবেই।

গণতন্ত্রের কথাও যদি বলেন তবে বাকশালে যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে তার চাইতে উৎকৃষ্ট গণতন্ত্র চর্চা আর কি হতে পারে? বহুদল মানেই প্রকৃত গণতন্ত্র সেটি যারা মনে করেন তারা শুধু পশ্চিমা ধারণার গণতন্ত্রের কথাই চিন্তা করেন। এটি যে একটি মাত্র দলের মাধ্যমেই সম্পূর্ণ ঐক্যমত্যের গণতন্ত্র হতে পারে এবং সেই পদ্ধতিতেও যে নির্বাচন হতে পারে ও জনগণের পছন্দ-অপছন্দ বাছাই করা যেতে পারে সেটি নিন্দুকেরা আলোচনাতেই আনে না।

অন্যদিকে ধর্ম নিরপেক্ষতা যে বাংলাদেশের শক্তি সেটি এখন ভারত-পাকিস্তানসহ সারা দুনিয়া উপলব্ধি করে। ভারত ও পাকিস্তানের চাইতে বাংলাদেশের অগ্রগতির অন্যতম একটি কারণ হিসেবে অসাম্প্রদায়িকতাকে মনে করা হয়। পাকিস্তান মৌলবাদের কাছে জিম্মি হয়ে ও ভারত উগ্রবাদের হাতে জিম্মি হয়ে অগ্রগতির চাকাকে সামনে না নিয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিয়ে জটিলতায় পড়েছে।

আমরা যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কথা বলছি তখনও সেই মহামানবের কথাই ভাবতে হচ্ছে। এই বিষয়টি অনেকের কাছে বহুলাংশে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু তার কর্মকা- দেখলেই বোঝা যাবে তিনি কতোটা দূরদর্শিতার অধিকারী ছিলেন। তিনি সেই ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশকে ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়ন ও ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের সদস্যপদ গ্রহণ করান। একটু ভেবে রাখুন ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন তিনি বেতবুনিয়ায় উপগ্রহ ভূকেন্দ্র উদ্বোধন করেন। সেই পথ ধরেই আমরা ২০১৮ সালের ১২ মে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করি। কতো দূরদর্শী হলে একটি দরিদ্র দেশেও উপগ্রহ নির্মাণের কথা ভাবা যায়।

আজকে আমরা যখন মানবসম্পদের কথা বলি তখন ভাবতে হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার রূপান্তরের কথা। ভেবে দেখুন তিনি যখন তার দেশের নাগরিকদের ভাত জুটাতে পারেন না-কর্মচারীদের বেতন দিতে পারেন না, সড়ক-সেতু বানাতে পারেন না তখন প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করেন। আজকে আমরা উপলব্ধি করতে পারছি যে, প্রাথমিক শিক্ষাকে শক্তিশালী করতে না পারলে ডিজিটাল যুগের মানবসম্পদ গড়ে তোলা যাবে না। বস্তুত তার ধারণাতেই আমাদের ৪১ সালের বাংলাদেশ গড়ে তোলার কথা ভাবতে হবে।

জিয়া-এরশাদ-খালেদা বাংলাদেশকে যেভাবে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার অপচেষ্টা করেছে এবং সারা দুনিয়ার ধমভিত্তিক রাজনৈতির্ক পরিস্থিতি যেমনটা তাতে বাংলাদেশের জন্য ধর্মনিরপেক্ষেতা বজায় রাখাকেই একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল। একই কারণে বাঙালির জাতিসত্তা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ছিলো। নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদের মূল কথাগুলো তুলে ধরা হয়নি বলে এখন তরুণদের একাংশকে ইসলামী জঙ্গিতে রূপান্তরিত করার চেষ্টা হয়। অথচ বঙ্গবন্ধুকে তো বটেই পুরো বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানিরা অমুসলিম বানাতে চেষ্টা করেও সফল হয়নি। একাত্তরে তারা স্পষ্ট করেই বলেছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দারা মুসলমান নয়-হিন্দু। বাঙালি মুসলমানদের হত্যা বা ধর্ষণ করার পেছনে তাদের এ মানসিকতা কাজ করেছে। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় ‘দুষ্কৃতকারী’ ও ‘হিন্দু’ বলেই গালি খেয়েছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে কৌশলের সঙ্গে এই সাম্প্রদায়িকতাকে মোকাবিলা করছেন সেটি ভারত-পাকিস্তানসহ সারা বিশ্বের কাছে প্রশংসিত হয়েছে। পাকিস্তানিরা বরং এটি উপলব্ধি করেছে যে, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার জন্য পাকিস্তানের অগ্রগতি থেমে যাচ্ছে।

বঙ্গবন্ধুর জন্য আমার চোখের পানি আসে আরও একটি বিশাল কারণে। তাকে ছাড়া আমি নিজেকে অসহায় মনে করছি। আমার নিজের মতে বঙ্গবন্ধুর মতো আর কোন রাষ্ট্রনায়ক তার আগে বাঙালির মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রযন্ত্রে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেননি। আমি সেই মুজিবের কথা ভাবি, যে মুজিব ’৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষার দাবি তুলেন, ’৫২ সালে ভাষা আন্দোলন করেন, ’৫২ সালে চীনে ও ’৭৪ সালে জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দেন- তিনিই ’৭২ সালে অপটিমা মুনীর টাইপরাইটার বানিয়েছিলেন। আমি সেই মুজিবের কথা ভাবি, যিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার আগেই বলেছিলেন- ভুল হোক- শুদ্ধ হোক আমরা সরকার গঠন করলে সরকারি কাজে বাংলাই লিখব। কালক্রমে সেই মুজিবের আদর্শ থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সরে গিয়েছিল। এখনও বাংলাদেশের বেসরকারি অফিসে বাংলা বর্ণমালাই নেই। সরকারের কাজে-কর্মে বাংলা ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ডিজিটাল করার নামে প্রায়শই বাংলা হরফকে বিদায় করা হয়। উচ্চ আদালতে ও উচ্চশিক্ষায় বাংলার প্রচলন খুবই কম। উভয় ক্ষেত্রেই বঙ্গসন্তানরা তাদের মায়ের ভাষায় কথা বললেও কার্যক্ষেত্রে ভাষাটিকে প্রয়োগ করে না। কখনও বাংলা-ইংরেজি মিশ্র ভাষাও ব্যবহৃত হয়। অথচ এর কোন যৌক্তিক কারণ নেই। আদালতের বাদী-আসামি-বিচারক ও উকিল বাংলা ভাষাভাষী। তারা কেন বাংলা ব্যবহার করবে না, তার কোন কারণ কেউ বলতে পারবে না। উচ্চশিক্ষায় বাংলায় উপাত্তের অভাব রয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সময়টি পার করতে গিয়ে আমাদের উচিত ছিল এই দুর্বলতাটি দূর করা। কেন বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারকে আমরা বাংলায় রূপান্তর করতে পারলাম না তার কোন জবাব নেই। স্কুলপর্যায়েও শিক্ষার মাধ্যম বাংলাকে পরাভূত করার কুৎসিৎ অপচেষ্টা বিরাজ করে। ইংলিশ মিডিয়াম বা ইংলিশ ভার্সন শিক্ষার নামে বাংলাকে বিদায় করার চেষ্টা বাড়ছে। আবার বাংলা ভাষা লেখা হয় ইংরেজি অক্ষর দিয়ে। যে মানুষটি বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে ও জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিতে পেরেছিলেন সেই মানুষটির দেশে এখন চারপাশে রোমান হরফের রাজত্ব দেখি। ইংরেজি হরফে বাংলা লিখে সেটিকে ভুল বাংলায় রূপান্তর করার ডিজিটাল প্রক্রিয়ার ব্যাপক প্রসারের পাশাপাশি সরাসরি ইংরেজি হরফে বাংলা লেখার প্রবণতা প্রবলভাবে বাড়ছে। ডিজিটাল করার নামে এই ভয়াবহ অপচেষ্টাকে প্রতিরোধ করতে হবে। যে বাঙালি রোমান হরফে বা আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব গ্রহণ করেনি সেই বাঙালি এই অপচেষ্টাকে কখনও বাড়তে দিতে পারে না। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, শেখ মুজিবের বাংলাদেশে যেমনি গণতন্ত্র থাকবে, তেমনি এটি বাঙালি জাতীয়তাবাদকেও সর্বোচ্চ মর্যাদা দেবে। অন্যদিকে শেখ মুজিবের বাংলাদেশ থাকবে অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যহীন।

আসুন না সবাই মিলে বঙ্গবন্ধুর ভাষা রাষ্ট্রটাকেই বিশ্বের সেরা রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করি। আসুন সব ক্ষেত্রে সেই একজন বাঙালিকেই অনুসরণ করি। (সমাপ্ত)

ঢাকা, ২৭ মার্চ ২০২০।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান; সাংবাদিক, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]

mustafajabbar@gmail.com