ঘরে থাকুন, ঘরে থাকুন, ঘরে থাকুন সংক্রমণ রোধ করুন

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

হঠাৎ ঢাকা শহরের চিত্র পাল্টে যেতে শুরু করেছে। নীরব নিস্তব্ধ জনশূন্য সড়কে আবার মানুষের চলাচল বেড়ে চলেছে। বেশকিছু রিকশায় ঘুরে ফিরছে মানুষ। ৩১ মার্চের ঢাকার এ দৃশ্য দেখে বিস্ময়ের সঙ্গে ভয়ও কাজ করতে শুরু করেছে। খবর নিয়ে জানলাম মফস্বল শহরগুলোর একই অবস্থা। মানুষ এখন আর লকডাউন তেমন মানছে না। হাট-বাজারে বেড়েছে মানুষের আনাগোনা। চায়ের দোকানেও আবার শুরু হয়েছে অড্ডা। সবাই মুখোশ বেঁধে নির্বিঘে্ব পথ চলছে। সরকার লকডাউনের মেয়াদ ৯ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়িয়েছে। পরের দুদিন সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় ১১ এগ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশের সব সরকারি, বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে। ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে লকডাউন। স্কুল, কলেজসহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কোচিং সেন্টার বন্ধ হয়ে গেছে ১৭ মার্চ থেকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের মেয়াদ হয়তো প্রয়োজনে ১১ এপ্রিলের পরেও বাড়ানো হতে পারে। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া অব্যাহত রাখার জন্য টেলিভিশনকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারেরও প্রচেষ্টা চলছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া চারদিকে দোকানপাট সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা হয়েছে। ১ এপ্রিল থেকে টিসিবি নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্য বিক্রি শুরু করবে। সামনে রমজানের খাদ্যসংকট যাতে না হয় সেই ব্যাপারেও প্রশাসন সচেষ্ট রয়েছে। খেটে খাওয়া মানুষের আহার জোগান দিতে সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি সংস্থা বাড়িয়েছে সাহায্যের হাত।

এই মুহূর্তে বিশ্ব করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। ‘ওয়ার্ল্ডোমিটার’-এর সর্বশেষ খবর- বিশে্বর ২০২টি দেশে ও দুটি আন্তর্জাতিক প্রমোদতরীতে অদ্যাবধি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৮৫৮,৬৬৯ জন। এর মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন ৪২,১৫১ জন। একের পর এক নতুন দেশের মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। চীন ছাড়িয়ে পৃথিবীজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই ছোট্ট এক মারণকিট। কেউ তাকে দমিয়ে রাখতে পারছে না। কোন মারণাস্ত্রই লাগছে না কাজে। এই মুহূর্তে শক্তিধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। এখানে মৃতের সংখ্যা চীনকেও ছাড়য়ে গেছে। ৩১ মার্চ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে মারা গেছেন ৩,৮৮৯ জন সেখানে চীনে মৃত্যু হয়ে ৩,৩০৫ জনের। করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ইতালিতে, ১২,৪২৮ জন। এর পরেই রয়েছে স্পেনের স্থান ৮,৪৬৮ জন। এই প্রাণঘাতী মারণকিট কবে নিঃশেষ হবে কেউ তা আজও জানে না।

গেল শেষ ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু। কথিত আছে, উহানের কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি মাছ-মাংস বিক্রির বাজার থেকে নাকি করোনাভাইরাস ছড়াতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে করোনাভাইরাসের অপ্রতিরোধ্য সংক্রমণ বাড়তে থাকে। উহান শহরের বাইরে হুবেই প্রদেশ ছাড়িয়ে অন্য প্রদেশগুলোতে চলে করোনা বিস্তার। একসময় বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টায় ৩১২ জন বাংলাদেশিকে উহান থেকে ঢাকায় এনে কোয়ারান্টিনে রাখার কারণে কেউ কোরানাভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি। এমনকি তারা কাউকে সংক্রমিত করেনি। কিন্তু বিপত্তিটা বাঁধে পরবর্তীতে ইতালি থেকে প্রত্যাগত বিপুল-সংখ্যক বাংলাদেশিকে প্রশাসনের প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও নির্দিষ্ট জায়গায় কোয়ারেন্টিনের রাখতে না পারায়। এরপর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে বিপুল-সংখ্যক বাংলাদেশি হযরত শাজজালাল বিমানবন্দরে এসে নির্বিঘেœ যে যার বাড়িতে চলে যান। সীমিত সংখ্যক বিদেশ প্রত্যাগতদের শরীরের তাপমাত্রা বেশি থাকায় তাদের ভাইরাস পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে নেয়া হয়। তবে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে শুধু থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে প্রত্যাগতদের শরীরের তাপমাত্রা মেপে তাদের শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি সন্দেহাতীতভাবে নিরূপণ সম্ভব হয়নি। এসব মানুষ ঘরে ফিরে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা ফলপ্রসূভাবে কাজ করেনি। এদের বেশিরভাগই স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করেছেন। কেউ পরিবারের সঙ্গে থেকে কেউ নিজের পিতা, কেউ নিজের স্ত্রী বা সন্তানকে সংক্রমিত করেছেন। তাদের কেউ কেউ মারাও গেছেন। এভাবেই করোনাভাইরাস বাংলাদেশে বিস্তার লাভ করতে শুরু করেছে।

বাংলাদেশে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত সব ধরনের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ রয়েছে। এর পূর্বে গণপরিবহনসহ সব রকম যানবাহন চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রয়েছে। করোনাভাইরাসের আক্রমণ প্রতিরোধে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় যথেষ্ট প্রচারাভিযান চলছে। রাস্তায় জনগণের এবং যানবাহনের চলাচল এবং অন্যান্য নির্দেশ পালন নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আইইডিসিআরের হেল্পলাইন থেকে মানুষের যথাযথ সেবা প্রদান ও রোগ শনাক্তকরণের পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। দেশের কিছু হাসপাতালে ভাইরাস আক্রান্তদের জন্য কিছু বেড প্রস্তুত করা হলেও সুচিকিৎসার জন্য ভেন্টিলেশনসহ জীবন রক্ষাকারী সব উপাদান সরকারি ও বেসরকারি সব হাসপাতালে মজুত রাখতে হবে। গরিব রোগীদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা ও খাদ্য সংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ রবাদ্দ রাখতে হবে। ঢাকার বাইরের হাসপাতালে রোগীর স্বাস্থ্যসেবার পরিধি ও মান বাড়াতে হবে। চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয় থেকে হাসপাতালে দায়িত্বরত প্রতিটি কর্মীর জন্য পিপিই দিতে হবে। চীন থেকে আনা পিপিই কিটস এবং অন্যান্য চিকিৎসাসামগ্রী হাসপাতালগুলোতে যথাযথভাবে দ্রুত বণ্টন করতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকাশিত সংবাদে বোঝা যায় বাংলাদেশে ভাইরাস সংক্রমণ এখনও হতাশাব্যাঞ্জক পর্যায়ে পৌঁছেনি। মার্চের ৩১ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশে ভাইরাস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৫১ জন, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২৫ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন ৫ জন। তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে জ্বর, সর্দি-কাশির উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করা লোকজন কী রোগে আক্রান্ত হয়েছেন তা বোঝা যাচ্ছে না। কেননা তাদের কাউকে করোনাভাইরাস পরীক্ষার আওতায় আনা হয়নি। করোনাভাইরাসের উপসর্গ থাকা মানুষগুলোকে পরীক্ষায় আওতায় এনে করোয়ারেন্টিনে রাখা এবং উপযুক্ত চিকিৎসা প্রদানের ব্যবস্থা না নিলে সংক্রমণ প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে পড়বে। প্রথম থেকে দেশের বাহির থেকে লোকজন দেশে আসার পথগুলো বন্ধ করে দিয়ে শহরে শহরে লকডাউন ঘোষিত হলে হয়তো করোনাভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেকটা হ্রাস পেতো। লকডাউন ঘোষণার আগেই যথেষ্ট সময় পেয়ে বিদেশ প্রত্যাগতরা শহরময়, গ্রাম-গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ে সংক্রমণে সহায়তা করেছে। দেশব্যাপী লকডাইন ঘোষণার পর থেকে ঢাকা থেকে মানুষ ছুটে গেছেন মফস্বল শহরে বা গ্রামে। যে যেখানেই থাকুন, বাড়িতে থাকতে হবে। করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা। সাবান-পানি দিয়ে ২০ মিনিট ধরে হাত না ধুয়ে চোখ, নাক, মুখ স্পর্শ করা যাবে না। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেই ওষুধের মতো জরুরি জিনিস কিনতে হবে। কেউ আক্রান্ত বলে মনে হলে পরিবারের সদস্যদের কাছে থেকে আলাদা ঘরে থেকে রোগের উপসর্গ বুঝে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ তেমন বাড়ছে না ভেবে মানুষের মাঝে ঢিলেঢালা ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মানুষের চলাচল সে কারণেই বাড়ছে। এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাই লকডাউনের পুরো সময়টা সবাইকে গৃহবন্দি হয়েই থাকতে হবে। বিশেষ প্রয়োজন ঘরের বাইরে যাওয়া যাবে না। ঘরের একজন সমর্থ ব্যক্তিকে অতি প্রয়োজনীয় কাজে বেরুনোর দায়িত্ব দিতে হবে। অতি প্রয়োজনে কাউকে বেরোতে হলে ব্যক্তিগত সুরক্ষার নিয়মাবলি মেনে কাজ সেরেই দ্রুত ঘরে ফিরে আসতে হবে। বিয়ে, জন্মদিন পালনের মতো উৎসব আয়োজন বন্ধ করতে হবে। ঘরে ঢোকার আগেই হাত, সমস্ত মুখম-ল, পা ভালো করে সাবান-পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। এর আগে ঘরের দরজার হাতল বা অন্য কোনো আসবাবপত্রই ছোঁয়া যাবে না। একটি দিনের লকডাউন মানে দেশের অর্থনৈতিক বিশাল ক্ষতি। তারপরও বিশেষ সংকট সময়ে এটা সরকারকে করতে হচ্ছে। এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে সবাইকে সহযোগিতা করতে। করতে হবে নিজের প্রয়োজনে, পরিবার, দেশ ও দশের স্বার্থে। সুযোগ পেলেই আবার ছোবল মারবে করোনাভাইরাস। মহাবিপদের সম্মুখীন আজ দেশ। তাই একে মোকাবিলা করতে হবে নির্ভয়ে, সুকৌশলে। স্বচ্ছল মানুষের জনস্বার্থে বাড়িয়ে দিতে হবে সাহায্যের হাত। করোনাভাইরাসের জন্য কোন আতঙ্ক নয়, চাই সতর্কতা আর সাবধানতা। সাহসের সঙ্গে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সবার সমন্বিত প্রয়াসই এই প্রাণঘাতী রোগ থেকে দিতে পারে মুক্তি। করোনাভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক নেই। নেই কোন নিরাময়ের ওষুধও। কাজেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাই একমাত্র পথ করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার। ঘরে সেলফ আইসোলেশনে থাকা কোন শাস্তি নয়। এর মাঝেই বিনোদন বা শান্তির পথ খুঁজে নিতে হবে। এটাকে যদি ত্যাগ হিসাবেও ধরে নেয়া হয়, কিছুদিনের জন্য সেটুকু স্বীকার করে নিতে হবে সবার বৃহত্তর স্বার্থে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট]

বৃহস্পতিবার, ০২ এপ্রিল ২০২০ , ১৯ চৈত্র ১৪২৬, ৭ শাবান ১৪৪১

ঘরে থাকুন, ঘরে থাকুন, ঘরে থাকুন সংক্রমণ রোধ করুন

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

হঠাৎ ঢাকা শহরের চিত্র পাল্টে যেতে শুরু করেছে। নীরব নিস্তব্ধ জনশূন্য সড়কে আবার মানুষের চলাচল বেড়ে চলেছে। বেশকিছু রিকশায় ঘুরে ফিরছে মানুষ। ৩১ মার্চের ঢাকার এ দৃশ্য দেখে বিস্ময়ের সঙ্গে ভয়ও কাজ করতে শুরু করেছে। খবর নিয়ে জানলাম মফস্বল শহরগুলোর একই অবস্থা। মানুষ এখন আর লকডাউন তেমন মানছে না। হাট-বাজারে বেড়েছে মানুষের আনাগোনা। চায়ের দোকানেও আবার শুরু হয়েছে অড্ডা। সবাই মুখোশ বেঁধে নির্বিঘে্ব পথ চলছে। সরকার লকডাউনের মেয়াদ ৯ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়িয়েছে। পরের দুদিন সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় ১১ এগ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশের সব সরকারি, বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে। ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে লকডাউন। স্কুল, কলেজসহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কোচিং সেন্টার বন্ধ হয়ে গেছে ১৭ মার্চ থেকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের মেয়াদ হয়তো প্রয়োজনে ১১ এপ্রিলের পরেও বাড়ানো হতে পারে। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া অব্যাহত রাখার জন্য টেলিভিশনকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারেরও প্রচেষ্টা চলছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া চারদিকে দোকানপাট সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা হয়েছে। ১ এপ্রিল থেকে টিসিবি নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্য বিক্রি শুরু করবে। সামনে রমজানের খাদ্যসংকট যাতে না হয় সেই ব্যাপারেও প্রশাসন সচেষ্ট রয়েছে। খেটে খাওয়া মানুষের আহার জোগান দিতে সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি সংস্থা বাড়িয়েছে সাহায্যের হাত।

এই মুহূর্তে বিশ্ব করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। ‘ওয়ার্ল্ডোমিটার’-এর সর্বশেষ খবর- বিশে্বর ২০২টি দেশে ও দুটি আন্তর্জাতিক প্রমোদতরীতে অদ্যাবধি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৮৫৮,৬৬৯ জন। এর মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন ৪২,১৫১ জন। একের পর এক নতুন দেশের মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। চীন ছাড়িয়ে পৃথিবীজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই ছোট্ট এক মারণকিট। কেউ তাকে দমিয়ে রাখতে পারছে না। কোন মারণাস্ত্রই লাগছে না কাজে। এই মুহূর্তে শক্তিধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। এখানে মৃতের সংখ্যা চীনকেও ছাড়য়ে গেছে। ৩১ মার্চ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে মারা গেছেন ৩,৮৮৯ জন সেখানে চীনে মৃত্যু হয়ে ৩,৩০৫ জনের। করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ইতালিতে, ১২,৪২৮ জন। এর পরেই রয়েছে স্পেনের স্থান ৮,৪৬৮ জন। এই প্রাণঘাতী মারণকিট কবে নিঃশেষ হবে কেউ তা আজও জানে না।

গেল শেষ ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু। কথিত আছে, উহানের কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি মাছ-মাংস বিক্রির বাজার থেকে নাকি করোনাভাইরাস ছড়াতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে করোনাভাইরাসের অপ্রতিরোধ্য সংক্রমণ বাড়তে থাকে। উহান শহরের বাইরে হুবেই প্রদেশ ছাড়িয়ে অন্য প্রদেশগুলোতে চলে করোনা বিস্তার। একসময় বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টায় ৩১২ জন বাংলাদেশিকে উহান থেকে ঢাকায় এনে কোয়ারান্টিনে রাখার কারণে কেউ কোরানাভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি। এমনকি তারা কাউকে সংক্রমিত করেনি। কিন্তু বিপত্তিটা বাঁধে পরবর্তীতে ইতালি থেকে প্রত্যাগত বিপুল-সংখ্যক বাংলাদেশিকে প্রশাসনের প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও নির্দিষ্ট জায়গায় কোয়ারেন্টিনের রাখতে না পারায়। এরপর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে বিপুল-সংখ্যক বাংলাদেশি হযরত শাজজালাল বিমানবন্দরে এসে নির্বিঘেœ যে যার বাড়িতে চলে যান। সীমিত সংখ্যক বিদেশ প্রত্যাগতদের শরীরের তাপমাত্রা বেশি থাকায় তাদের ভাইরাস পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে নেয়া হয়। তবে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে শুধু থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে প্রত্যাগতদের শরীরের তাপমাত্রা মেপে তাদের শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি সন্দেহাতীতভাবে নিরূপণ সম্ভব হয়নি। এসব মানুষ ঘরে ফিরে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা ফলপ্রসূভাবে কাজ করেনি। এদের বেশিরভাগই স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করেছেন। কেউ পরিবারের সঙ্গে থেকে কেউ নিজের পিতা, কেউ নিজের স্ত্রী বা সন্তানকে সংক্রমিত করেছেন। তাদের কেউ কেউ মারাও গেছেন। এভাবেই করোনাভাইরাস বাংলাদেশে বিস্তার লাভ করতে শুরু করেছে।

বাংলাদেশে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত সব ধরনের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ রয়েছে। এর পূর্বে গণপরিবহনসহ সব রকম যানবাহন চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রয়েছে। করোনাভাইরাসের আক্রমণ প্রতিরোধে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় যথেষ্ট প্রচারাভিযান চলছে। রাস্তায় জনগণের এবং যানবাহনের চলাচল এবং অন্যান্য নির্দেশ পালন নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আইইডিসিআরের হেল্পলাইন থেকে মানুষের যথাযথ সেবা প্রদান ও রোগ শনাক্তকরণের পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। দেশের কিছু হাসপাতালে ভাইরাস আক্রান্তদের জন্য কিছু বেড প্রস্তুত করা হলেও সুচিকিৎসার জন্য ভেন্টিলেশনসহ জীবন রক্ষাকারী সব উপাদান সরকারি ও বেসরকারি সব হাসপাতালে মজুত রাখতে হবে। গরিব রোগীদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা ও খাদ্য সংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ রবাদ্দ রাখতে হবে। ঢাকার বাইরের হাসপাতালে রোগীর স্বাস্থ্যসেবার পরিধি ও মান বাড়াতে হবে। চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয় থেকে হাসপাতালে দায়িত্বরত প্রতিটি কর্মীর জন্য পিপিই দিতে হবে। চীন থেকে আনা পিপিই কিটস এবং অন্যান্য চিকিৎসাসামগ্রী হাসপাতালগুলোতে যথাযথভাবে দ্রুত বণ্টন করতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকাশিত সংবাদে বোঝা যায় বাংলাদেশে ভাইরাস সংক্রমণ এখনও হতাশাব্যাঞ্জক পর্যায়ে পৌঁছেনি। মার্চের ৩১ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশে ভাইরাস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৫১ জন, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২৫ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন ৫ জন। তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে জ্বর, সর্দি-কাশির উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করা লোকজন কী রোগে আক্রান্ত হয়েছেন তা বোঝা যাচ্ছে না। কেননা তাদের কাউকে করোনাভাইরাস পরীক্ষার আওতায় আনা হয়নি। করোনাভাইরাসের উপসর্গ থাকা মানুষগুলোকে পরীক্ষায় আওতায় এনে করোয়ারেন্টিনে রাখা এবং উপযুক্ত চিকিৎসা প্রদানের ব্যবস্থা না নিলে সংক্রমণ প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে পড়বে। প্রথম থেকে দেশের বাহির থেকে লোকজন দেশে আসার পথগুলো বন্ধ করে দিয়ে শহরে শহরে লকডাউন ঘোষিত হলে হয়তো করোনাভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেকটা হ্রাস পেতো। লকডাউন ঘোষণার আগেই যথেষ্ট সময় পেয়ে বিদেশ প্রত্যাগতরা শহরময়, গ্রাম-গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ে সংক্রমণে সহায়তা করেছে। দেশব্যাপী লকডাইন ঘোষণার পর থেকে ঢাকা থেকে মানুষ ছুটে গেছেন মফস্বল শহরে বা গ্রামে। যে যেখানেই থাকুন, বাড়িতে থাকতে হবে। করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা। সাবান-পানি দিয়ে ২০ মিনিট ধরে হাত না ধুয়ে চোখ, নাক, মুখ স্পর্শ করা যাবে না। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেই ওষুধের মতো জরুরি জিনিস কিনতে হবে। কেউ আক্রান্ত বলে মনে হলে পরিবারের সদস্যদের কাছে থেকে আলাদা ঘরে থেকে রোগের উপসর্গ বুঝে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ তেমন বাড়ছে না ভেবে মানুষের মাঝে ঢিলেঢালা ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মানুষের চলাচল সে কারণেই বাড়ছে। এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাই লকডাউনের পুরো সময়টা সবাইকে গৃহবন্দি হয়েই থাকতে হবে। বিশেষ প্রয়োজন ঘরের বাইরে যাওয়া যাবে না। ঘরের একজন সমর্থ ব্যক্তিকে অতি প্রয়োজনীয় কাজে বেরুনোর দায়িত্ব দিতে হবে। অতি প্রয়োজনে কাউকে বেরোতে হলে ব্যক্তিগত সুরক্ষার নিয়মাবলি মেনে কাজ সেরেই দ্রুত ঘরে ফিরে আসতে হবে। বিয়ে, জন্মদিন পালনের মতো উৎসব আয়োজন বন্ধ করতে হবে। ঘরে ঢোকার আগেই হাত, সমস্ত মুখম-ল, পা ভালো করে সাবান-পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। এর আগে ঘরের দরজার হাতল বা অন্য কোনো আসবাবপত্রই ছোঁয়া যাবে না। একটি দিনের লকডাউন মানে দেশের অর্থনৈতিক বিশাল ক্ষতি। তারপরও বিশেষ সংকট সময়ে এটা সরকারকে করতে হচ্ছে। এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে সবাইকে সহযোগিতা করতে। করতে হবে নিজের প্রয়োজনে, পরিবার, দেশ ও দশের স্বার্থে। সুযোগ পেলেই আবার ছোবল মারবে করোনাভাইরাস। মহাবিপদের সম্মুখীন আজ দেশ। তাই একে মোকাবিলা করতে হবে নির্ভয়ে, সুকৌশলে। স্বচ্ছল মানুষের জনস্বার্থে বাড়িয়ে দিতে হবে সাহায্যের হাত। করোনাভাইরাসের জন্য কোন আতঙ্ক নয়, চাই সতর্কতা আর সাবধানতা। সাহসের সঙ্গে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সবার সমন্বিত প্রয়াসই এই প্রাণঘাতী রোগ থেকে দিতে পারে মুক্তি। করোনাভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক নেই। নেই কোন নিরাময়ের ওষুধও। কাজেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাই একমাত্র পথ করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার। ঘরে সেলফ আইসোলেশনে থাকা কোন শাস্তি নয়। এর মাঝেই বিনোদন বা শান্তির পথ খুঁজে নিতে হবে। এটাকে যদি ত্যাগ হিসাবেও ধরে নেয়া হয়, কিছুদিনের জন্য সেটুকু স্বীকার করে নিতে হবে সবার বৃহত্তর স্বার্থে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট]