‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে’

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

চারিদিকে আতঙ্ক, নিজের মধ্যেও। মনে মনে যতই বলি, ‘ভয় কী’ ততই ভয় চেপে ধরে। যতই সচেতন হই ততই অবচেতন মনে নাক, চোখ চুলকাই। আগে কখন হাত নাকে গেছে বলে শত চেষ্টা করেও মনে করতে পারছি না, এখন প্রতি মুহূর্তে যাচ্ছে। আগে কখনও চোখ চুলকাতে হয়নি, এখন নিয়মিত চুলকিয়েও কুলাতে পারছি না। যখন সচেতন থাকি না তখন নাক, চোখ, মুখ কোথাও মশা-মাছি বসে না, যখন সচেতন হই তখন মনে হয় সব মশা-মাছি ভনভন করছে। সকালে বউকে জিজ্ঞেস করি, ‘নাস্তা হয়েছে?’ বউ বলে, ‘দেরি আছে ঘুমিয়ে থাক’। দুপুরেও একই অবস্থা। রাতে টেলিভিশন দেখার ক্ষেত্রে একটু পরিবর্তন হয়েছে, এখন জি-বাংলা দেখার মাঝে মাঝে বাংলাদেশের যে কোন চ্যানেলে ঢুঁ মেরে থাকে- করোনার হালনাগাদ সংবাদ জানার জন্য। মুফতি কাজী ইব্রাহিমের স্বপ্ন দেখারও শেষ নেই; ভারতীয় চ্যানেল দেখলেই করোনাভাইরাস আক্রমণ করবে বলে স্বপ্নে জানিয়ে দিয়েছে। মুফতির বয়ান মতো বাংলাদেশের মহিলা মরে সব সাফ হয়ে যাবে। ইব্রাহিম সাহেব মুফতি, তাই জ্ঞানী, ধর্ম সম্পর্কে অনেক জানেন; জি-বাংলা চ্যানেল দেখা বন্ধ করার জন্য বউকে ইব্রাহিম সাহেবের স্বপ্নের বয়ান শোনাতে হবে। তবে কাজ হবে বলে মনে হয় না।

বউয়ের ধারণা, বাংলাদেশ সরকার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যু সংখ্যা কমিয়ে বলছে। তবে বিরোধী পক্ষের মতো সরকারের এমন কাজের উদ্দেশ্য সে ব্যাখ্যা করতে পারে না। তার ধারণা, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো যেখানে এ ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে দিশেহারা সেখানে বাংলাদেশ সরকারের বেসামাল অবস্থায় এত কম লোক আক্রান্ত হবে কেন? জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, তোমার গ্রাম-ইউনিয়নে কারও করোনাভাইরাসে মৃত্যু সংবাদ শুনেছ?’ বলল, ‘না’। আমারও হাজার হাজার লোকের সঙ্গে পরিচয় আছে, ফেসবুকে পাঁচ হাজার বন্ধু আছে, দুটি বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছি, প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে এখনও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, যাদের সঙ্গে পরিচয় আছে তাদেরও এমন আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আছে- আজ পর্যন্ত কারও আক্তান্ত হওয়ার সংবাদও পাইনি, কথাটি কি সত্য?’ বউ বলে, ‘হ্যাঁ’। তারপরও তার মনে সন্দেহ, লোক আরও বেশি মরছে। হয়তো তাই; কারণ দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় করোনার মতো রোগের উপসর্গ নিয়ে যারা মরছে তাদের মৃত্যুর কারণ পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই, নিশ্চিত না হয়ে সরকারও মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করতে পারছে না। বেশি বা কম- এতে আমার বউয়ের কোন লাভ-ক্ষতি নেই। যারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে সংখ্যা বাড়ানোর মতলবে আছে তাদের সঙ্গে তার কোন যোগসাজশও নেই। দুর্ভিক্ষ, মহামারী, আন্দোলনে মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি ব্রিটিশ আমল থেকেই অব্যাহত আছে। ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের শাপলা চত্বরের অবস্থান হটাতে পুলিশের অভিযানে তিন হাজার হেফাজতি মারা গেছেন বলে হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফি দাবি করেছিলেন। মৃত্যুর এ সংখ্যা বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামও সমর্থন করেছিল। হেফাজতে ইসলামকে মৃত ব্যক্তিদের তালিকা দিতে বলা হলেও সেই তালিকা আজও তৈরি হয়নি।

সৌদি আরবের হজ ও ওমরা বিষয়ক মন্ত্রী এ বছর হজ করার পরিকল্পনা নিতে নিষেধ করেছেন, ইতোমধ্যে ওমরা হজ পালন স্থগিত করা হয়েছে, মক্কা-মদিনায় মসজিদ চত্বরে নামাজ আদায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ধর্মীয় সমাবেশ থেকে মালয়েশিয়ায় করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে; মালয়েশিয়ায় করোনাভাইরাসে যতজন মারা গেছেন তাদের অধিকাংশ ওই ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ছিলেন। ভারতে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত তাবলিগের দশজন ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়া তাবলিগিদের ৪০৩ জন আক্রান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। ওমরা থেকে ফেরত আসা লোকজন তুরস্কে প্রথম করোনাভাইরাস ছড়ায়; দশ হাজার ওমরাকারীকে কোয়ারেন্টিনে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। যারা তাবলিগ করেন তাদের প্রায় সবাই একটি কথা বলেন, ‘এ দুনিয়া ক্ষণকালের, এ দুনিয়ার মোহে কাজ না করে অন্তহীন পরকালের জন্য সঞ্চয় করুন, আপনার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, ধন-সম্পদ পরকালে কোন কাজে লাগবে না, শুধু ইবাদত ও দ্বীনি কর্ম আপনাকে বেহেস্তে নেবে’। তবুও মানুষ ইহকালে ঘুষখায়, দুর্নীতি করে, মিথ্যে কথা বলে, গৃহকর্মীদের গরম খুন্তি দিয়ে মারে, অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করে, খুন করে, মাস্তানি করে, চুরি করে, ডাকাতি করে। এত অপরাধ করেও করুণাময় আল্লাহর মেহেরবানিতে মানুষ বেহেস্তে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে; কারণ হাজার অপরাধ করার পরও মহামারীতে মরলে শহীদের মর্যাদা পাওয়ার কথা হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। করোনার মহামারী থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রত্যাশা করে আমরা বেশি বেশি ধর্মকর্ম করছি, বারবার বিগত অপকর্মের জন্য তওবা করছি। করোনার এ আতঙ্কের মধ্যেও কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে মাদ্রাসা শিক্ষক মাওলানা বদিউল আলম মুন্সীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কম বয়সে বলেছেন, ‘মরণরে, তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান’। মৃত্যুকে বরণ করার ব্যাপারে রাধার এই আকুতি প্রকৃত অর্থে কৃষ্ণকে পাওয়ার আকুতি; ইহকালে না পেয়ে পরকালে পাবে এই প্রত্যাশায় রাধা তাড়াতাড়ি মরতে চেয়েছে এবং রাধা মরণকে শ্যামের সমান মনে করেছে। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে এসে রবি ঠাকুর বলেন, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’ ইহকাল আর পরকালে জীবনের যে অখ- মহাস্রোত তার মধ্যে মৃত্যু কিছুটা যতি বা থেমে যাওয়া বলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করতেন। আমরা যারা পরকালে বিশ্বাসী তারাও তাই মনে করি। মরণ অবশ্যম্ভাবী। বিজ্ঞান এখনও মরণকে পরাজিত করতে পারেনি। মানুষ প্রতিদিন মরছে- কেউ রোগে মরছে, কেউ আত্মহত্যা করছে, কেউ খুন হচ্ছে, কেউ বিচারে মৃত্যুদ- পাচ্ছে, কেউ মারণাস্ত্রের আঘাতে মরছে। মানুষের কল্যাণে কিছুর আবিষ্কার করে ধর্মান্ধদের আক্রোশেও অনেকে মরেছেন। ধর্মের জন্য এক ধার্মিক আরেক ধার্মিককে কতল করছে, গুলি করছে, ছুরিকাঘাত করছে, গায়ের ওপর গাড়ি তুলে দিচ্ছে। নিউজিল্যান্ডের দুটি মসজিদে হামলা চালিয়ে একান্ন মুসল্লিকে হত্যা করার কথা কয়েকদিন আগে স্বীকার করেছে অভিযুক্ত আসামি ব্রেটন ট্যারান্ট। ফ্রান্সের নিস শহরে মুসলিম জেহাদির ট্রাক হামলায় ৮৪ জন মানুষ মরেছিল, ব্রিটেনে বারবার জঙ্গিদের ছুরি হামলায় মরেছে সাধারণ কিছু মানুষ। হামলা করছে ধার্মিকেরা অন্য ধর্মের উপসনালয়ে, ধার্মিকেরা মরছে ধার্মিকদের হাতে।

কোন মরণই মানুষের জানা সময় তারিখে আসে না, তাই মরণে সাসপেন্স থাকে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর শতকরা দুই বা তিন শতাংশের বেশি সাধারণত মারা যাচ্ছে না, তবুও মৃত্যুর ভয়ে সবাই আতঙ্কিত। করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে মারা গেছে প্রায় তেষট্টি হাজার লোক, হয়তো আরও মরবে। এমন মৃত্যু তো নতুন নয়। অতীতে বিভিন্ন ভাইরাসে এর চেয়েও বেশি লোক মারা গেছে। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও বহু লোক মরেছে। সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের লিবিয়া, সিরিয়া ও ইরাকে সিভিল ওয়ারে এবং ইয়েমেনে সৌদি জোটের বিমান হামলায় যেভাবে নির্বিচারে লোক মরল, এখনও মরছে তার তাৎপর্য ও গুরুত্ব নিশ্চয়ই কম নয়। সিরিয়ায় বিগত আট, নয় বছর ধরে গৃহযুদ্ধে সাত/আট লাখ লোক মরেছে, লাখ লাখ লোক আহত হয়েছে, মোট জনসংখ্যার অর্ধেক লোককে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে, অথচ সিরিয়ায় করোনায় মরেছে মাত্র একজন। ইরাকে এখনও গাড়িবোমায় শত শত লোকের প্রাণহানি হচ্ছে। লিবিয়ায় আধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত দুটি গ্রুপ ক্ষমতার জন্য মুখামুখি যুদ্ধ করছে। প্রতিদিন লোক মরছে- ক্ষমতার জন্য, স্বার্থের জন্য, সম্প্রদায়গত আদর্শের খাতিরে। ইসরায়েলের জঙ্গি বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত বোমায় মরছে ফিলিস্তিনের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। সৌদি বোমায় মরেছে ইয়েমেনের শিয়া গ্রুপ। এসব মরণে তো বিশ্বের সব মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা যায়নি। কারণ যারা মরেছে, মরছে তারা একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের লোক। এসব মরণ ছোবল থেকে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ মুক্ত বলে দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মৃত্যুর ব্যাপারে নির্লিপ্ত। কিন্তু করোনা কোন সীমান্ত মানেনি, সীমান্ত রক্ষীদের পাহারা ফাঁকি দিয়ে সারা বিশ্বের মানুষকে আক্রমণ করে বসেছে। এ আক্রমণ থেকে রেহাই পাননি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, ব্রিটিশ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী প্রিন্স চার্লস, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর স্ত্রী, স্পেনের প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী, স্পেনের উপপ্রধানমন্ত্রী। করোনাভাইরাসের ভয়ে ৯৪ বছর বয়সী রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ও তার স্বামী ফিলিপকে বাকিংহাম প্যালেস থেকে পঁচিশ মাইল দূরবর্তী উইন্ডসর ক্যাসেলে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ভাগ্যবান ডোনাল্ড ট্রাম্প- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বলে ধারণা করা হয়েছিল; করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কয়েকজনের সংস্পর্শে আসার পরও করোনা তাকে স্পর্শ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

আমার ধার্মিক স্ত্রীর মরতে কোন আপত্তি নেই; তার দুঃখ হচ্ছে, চিকিৎসা ছাড়াই মরতে হবে, মরার পর কেউ দেখতে আসবে না, তার জন্য স্বামীও কাঁদার সুযোগ পাবে না, জানাজা হবে না। কয়েক দিন পূর্বে তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী বার্ধক্যজনিত কারণে কোন রোগ ছাড়াই হঠাৎ ইন্তেকাল করেছেন, আমরা কেউ যাইনি, কারণ সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী কোয়ারেন্টিনে আছি। সরকারের সব নির্দেশনা মেনে বিপদে আছি; সরকার বলেছে, প্রয়োজনাতিরিক্ত কোন পণ্য যেন কেনা না হয়- কিনিনি। মনে করেছিলাম, প্রয়োজনানুযায়ী পরবর্তীতে কিছু কিছু কিনব। গত মঙ্গলবার রাত ১২টায় দেখলাম পার্শ্ববর্তী বস্তি থেকে এক লোককে সর্দি, কাশি, জ্বরের কারণে হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। তাই বাজারে যেতে ভয় করছে। কিন্তু কুকুরের জন্য আমার কিছু পাউরুটির দরকার ছিল। আমাদের দুই বাসার মধ্যখানের প্যাসেজে চারটি কুকুর থাকে, তারা রাস্তায় গেলেই মানুষ মারে। শিশু-কিশোর মনের আনন্দে কুকুরগুলোকে ঢিল মারে, কুকুরের কান্না শুনে আমি দৌড়ে বারান্দায় যাই, কিশোরেরা আমাকে দেখে দৌড়ে পালায়। আমি প্রতিদিন রাতে বারান্দা থেকে ওদের জন্য কিছু পাউরুটি ও পলিথিনে করে ভাত ফেলে দেই। দু’দিন দেইনি- দু’দিন খাবার না দেয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, কুকুরগুলোর ওপর আমার ক্ষোভ। কয়েকদিন পূর্বে হঠাৎ একটি বিড়ালের আর্তচিৎকার শুনে বারান্দায় গিয়ে দেখলাম, ওই চারটি কুকুর বিড়ালটিকে ধরার জন্য দৌড়াদৌড়ি করছে। তিনতলা থেকে চিৎকার করতে করতে দৌডে বাসার নিচে গিয়ে দেখি, ততক্ষণে বিড়ালটিকে মেরে ফেলা হয়েছে। নিঃশ্বাস নিচ্ছে কী না অনেকক্ষণ বিড়ালটির পাশে বসে দেখার চেষ্টা করেছি, দেখলাম কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিড়ালটির গায়ে মাছি-মশা বসতে শুরু করেছে। শুধু করোনা নয়, মৃত্যু যে কতভাবে আসে তার হিসাব রাখা কঠিন।

পৃথিবীর ৯০-৯৯ শতাংশ মানুষ, পশু-পাখি, গাছপালা কমপক্ষে ছয় বার নাকি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল; এমন কেয়ামতের ধ্বংসস্তূপ থেকে আবার পৃথিবী জেগে উঠেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ, দুর্ঘটনা প্রভৃতিতে মানুষ সর্বস্ব হারিয়েও আবার শক্ত-সামর্থ্য হয়ে বেঁচে উঠে। অনেক রোগেরই ওষুধ নেই, চিকিৎসা নেই- কিন্তু ওই সব রোগে আক্রান্ত মানুষগুলোও বেঁচে যায়। হতাশায় নিমজ্জিত হলে কোন ওষুধই কাজ করে না। বাংলাদেশে নেতিবাচক কিছু মানুষের হতাশা ব্যঞ্জক কথাবার্তায় করোনার আতঙ্কের চেয়েও ভয়ংকর ঘোর অনামিশা নেমে এসেছে। মহামারীতে মৃত্যু শহীদের সমতুল্য- ধর্মের এমন আশ্বাস থাকা সত্বেও করোনায় আক্রান্ত সন্দেহে কোন স্বজনকেও কেউ সহ্য করতে পারছে না। প্রতিটি লোক ইতালি ফেরতপ্রবাসীদের মু-পাত করছে। একটু সর্দি-কাশি হলে সুস্থ মানুষগুলো তাকে ঘৃণা করছে, হাসপাতালে অন্য রোগের অসুস্থ লোকগুলোও হাসপাতালে সর্দি-কাশি দ্বারা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা প্রতিহত করে দিচ্ছে। মানুষ কত নিষ্ঠুর। সিটি করপোরেশনের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে খিলগাঁও-তালতলা কবরস্থানে এলাকার বাইরের লোকদের কবর দেয়া যাবে না বলে এলাকাবাসী ব্যানার টাঙিয়ে রেখেছে। মুসলমান হলেই নাকি ভাই-ভাই, কিন্তু মরার পরও ধর্মের ভ্রাতৃত্ববোধ কোন কাজে লাগছে না। বেঁচে থাকার আগ্রহ অনেককে হিংস্র করে তুলছে। এ অবস্থায় রবি ঠাকুরের আশ্বাসের বাণী আমাদের বাঁচার আশা জাগায়-

‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে।/ তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।/ তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,/ বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।’

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ]

ahmedzeauddin0@gmail.com

সোমবার, ০৬ এপ্রিল ২০২০ , ২৩ চৈত্র ১৪২৬, ১১ শাবান ১৪৪১

‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে’

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

চারিদিকে আতঙ্ক, নিজের মধ্যেও। মনে মনে যতই বলি, ‘ভয় কী’ ততই ভয় চেপে ধরে। যতই সচেতন হই ততই অবচেতন মনে নাক, চোখ চুলকাই। আগে কখন হাত নাকে গেছে বলে শত চেষ্টা করেও মনে করতে পারছি না, এখন প্রতি মুহূর্তে যাচ্ছে। আগে কখনও চোখ চুলকাতে হয়নি, এখন নিয়মিত চুলকিয়েও কুলাতে পারছি না। যখন সচেতন থাকি না তখন নাক, চোখ, মুখ কোথাও মশা-মাছি বসে না, যখন সচেতন হই তখন মনে হয় সব মশা-মাছি ভনভন করছে। সকালে বউকে জিজ্ঞেস করি, ‘নাস্তা হয়েছে?’ বউ বলে, ‘দেরি আছে ঘুমিয়ে থাক’। দুপুরেও একই অবস্থা। রাতে টেলিভিশন দেখার ক্ষেত্রে একটু পরিবর্তন হয়েছে, এখন জি-বাংলা দেখার মাঝে মাঝে বাংলাদেশের যে কোন চ্যানেলে ঢুঁ মেরে থাকে- করোনার হালনাগাদ সংবাদ জানার জন্য। মুফতি কাজী ইব্রাহিমের স্বপ্ন দেখারও শেষ নেই; ভারতীয় চ্যানেল দেখলেই করোনাভাইরাস আক্রমণ করবে বলে স্বপ্নে জানিয়ে দিয়েছে। মুফতির বয়ান মতো বাংলাদেশের মহিলা মরে সব সাফ হয়ে যাবে। ইব্রাহিম সাহেব মুফতি, তাই জ্ঞানী, ধর্ম সম্পর্কে অনেক জানেন; জি-বাংলা চ্যানেল দেখা বন্ধ করার জন্য বউকে ইব্রাহিম সাহেবের স্বপ্নের বয়ান শোনাতে হবে। তবে কাজ হবে বলে মনে হয় না।

বউয়ের ধারণা, বাংলাদেশ সরকার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যু সংখ্যা কমিয়ে বলছে। তবে বিরোধী পক্ষের মতো সরকারের এমন কাজের উদ্দেশ্য সে ব্যাখ্যা করতে পারে না। তার ধারণা, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো যেখানে এ ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে দিশেহারা সেখানে বাংলাদেশ সরকারের বেসামাল অবস্থায় এত কম লোক আক্রান্ত হবে কেন? জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, তোমার গ্রাম-ইউনিয়নে কারও করোনাভাইরাসে মৃত্যু সংবাদ শুনেছ?’ বলল, ‘না’। আমারও হাজার হাজার লোকের সঙ্গে পরিচয় আছে, ফেসবুকে পাঁচ হাজার বন্ধু আছে, দুটি বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছি, প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে এখনও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, যাদের সঙ্গে পরিচয় আছে তাদেরও এমন আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আছে- আজ পর্যন্ত কারও আক্তান্ত হওয়ার সংবাদও পাইনি, কথাটি কি সত্য?’ বউ বলে, ‘হ্যাঁ’। তারপরও তার মনে সন্দেহ, লোক আরও বেশি মরছে। হয়তো তাই; কারণ দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় করোনার মতো রোগের উপসর্গ নিয়ে যারা মরছে তাদের মৃত্যুর কারণ পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই, নিশ্চিত না হয়ে সরকারও মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করতে পারছে না। বেশি বা কম- এতে আমার বউয়ের কোন লাভ-ক্ষতি নেই। যারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে সংখ্যা বাড়ানোর মতলবে আছে তাদের সঙ্গে তার কোন যোগসাজশও নেই। দুর্ভিক্ষ, মহামারী, আন্দোলনে মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি ব্রিটিশ আমল থেকেই অব্যাহত আছে। ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের শাপলা চত্বরের অবস্থান হটাতে পুলিশের অভিযানে তিন হাজার হেফাজতি মারা গেছেন বলে হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফি দাবি করেছিলেন। মৃত্যুর এ সংখ্যা বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামও সমর্থন করেছিল। হেফাজতে ইসলামকে মৃত ব্যক্তিদের তালিকা দিতে বলা হলেও সেই তালিকা আজও তৈরি হয়নি।

সৌদি আরবের হজ ও ওমরা বিষয়ক মন্ত্রী এ বছর হজ করার পরিকল্পনা নিতে নিষেধ করেছেন, ইতোমধ্যে ওমরা হজ পালন স্থগিত করা হয়েছে, মক্কা-মদিনায় মসজিদ চত্বরে নামাজ আদায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ধর্মীয় সমাবেশ থেকে মালয়েশিয়ায় করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে; মালয়েশিয়ায় করোনাভাইরাসে যতজন মারা গেছেন তাদের অধিকাংশ ওই ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ছিলেন। ভারতে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত তাবলিগের দশজন ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়া তাবলিগিদের ৪০৩ জন আক্রান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। ওমরা থেকে ফেরত আসা লোকজন তুরস্কে প্রথম করোনাভাইরাস ছড়ায়; দশ হাজার ওমরাকারীকে কোয়ারেন্টিনে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। যারা তাবলিগ করেন তাদের প্রায় সবাই একটি কথা বলেন, ‘এ দুনিয়া ক্ষণকালের, এ দুনিয়ার মোহে কাজ না করে অন্তহীন পরকালের জন্য সঞ্চয় করুন, আপনার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, ধন-সম্পদ পরকালে কোন কাজে লাগবে না, শুধু ইবাদত ও দ্বীনি কর্ম আপনাকে বেহেস্তে নেবে’। তবুও মানুষ ইহকালে ঘুষখায়, দুর্নীতি করে, মিথ্যে কথা বলে, গৃহকর্মীদের গরম খুন্তি দিয়ে মারে, অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করে, খুন করে, মাস্তানি করে, চুরি করে, ডাকাতি করে। এত অপরাধ করেও করুণাময় আল্লাহর মেহেরবানিতে মানুষ বেহেস্তে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে; কারণ হাজার অপরাধ করার পরও মহামারীতে মরলে শহীদের মর্যাদা পাওয়ার কথা হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। করোনার মহামারী থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রত্যাশা করে আমরা বেশি বেশি ধর্মকর্ম করছি, বারবার বিগত অপকর্মের জন্য তওবা করছি। করোনার এ আতঙ্কের মধ্যেও কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে মাদ্রাসা শিক্ষক মাওলানা বদিউল আলম মুন্সীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কম বয়সে বলেছেন, ‘মরণরে, তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান’। মৃত্যুকে বরণ করার ব্যাপারে রাধার এই আকুতি প্রকৃত অর্থে কৃষ্ণকে পাওয়ার আকুতি; ইহকালে না পেয়ে পরকালে পাবে এই প্রত্যাশায় রাধা তাড়াতাড়ি মরতে চেয়েছে এবং রাধা মরণকে শ্যামের সমান মনে করেছে। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে এসে রবি ঠাকুর বলেন, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’ ইহকাল আর পরকালে জীবনের যে অখ- মহাস্রোত তার মধ্যে মৃত্যু কিছুটা যতি বা থেমে যাওয়া বলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করতেন। আমরা যারা পরকালে বিশ্বাসী তারাও তাই মনে করি। মরণ অবশ্যম্ভাবী। বিজ্ঞান এখনও মরণকে পরাজিত করতে পারেনি। মানুষ প্রতিদিন মরছে- কেউ রোগে মরছে, কেউ আত্মহত্যা করছে, কেউ খুন হচ্ছে, কেউ বিচারে মৃত্যুদ- পাচ্ছে, কেউ মারণাস্ত্রের আঘাতে মরছে। মানুষের কল্যাণে কিছুর আবিষ্কার করে ধর্মান্ধদের আক্রোশেও অনেকে মরেছেন। ধর্মের জন্য এক ধার্মিক আরেক ধার্মিককে কতল করছে, গুলি করছে, ছুরিকাঘাত করছে, গায়ের ওপর গাড়ি তুলে দিচ্ছে। নিউজিল্যান্ডের দুটি মসজিদে হামলা চালিয়ে একান্ন মুসল্লিকে হত্যা করার কথা কয়েকদিন আগে স্বীকার করেছে অভিযুক্ত আসামি ব্রেটন ট্যারান্ট। ফ্রান্সের নিস শহরে মুসলিম জেহাদির ট্রাক হামলায় ৮৪ জন মানুষ মরেছিল, ব্রিটেনে বারবার জঙ্গিদের ছুরি হামলায় মরেছে সাধারণ কিছু মানুষ। হামলা করছে ধার্মিকেরা অন্য ধর্মের উপসনালয়ে, ধার্মিকেরা মরছে ধার্মিকদের হাতে।

কোন মরণই মানুষের জানা সময় তারিখে আসে না, তাই মরণে সাসপেন্স থাকে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর শতকরা দুই বা তিন শতাংশের বেশি সাধারণত মারা যাচ্ছে না, তবুও মৃত্যুর ভয়ে সবাই আতঙ্কিত। করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে মারা গেছে প্রায় তেষট্টি হাজার লোক, হয়তো আরও মরবে। এমন মৃত্যু তো নতুন নয়। অতীতে বিভিন্ন ভাইরাসে এর চেয়েও বেশি লোক মারা গেছে। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও বহু লোক মরেছে। সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের লিবিয়া, সিরিয়া ও ইরাকে সিভিল ওয়ারে এবং ইয়েমেনে সৌদি জোটের বিমান হামলায় যেভাবে নির্বিচারে লোক মরল, এখনও মরছে তার তাৎপর্য ও গুরুত্ব নিশ্চয়ই কম নয়। সিরিয়ায় বিগত আট, নয় বছর ধরে গৃহযুদ্ধে সাত/আট লাখ লোক মরেছে, লাখ লাখ লোক আহত হয়েছে, মোট জনসংখ্যার অর্ধেক লোককে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে, অথচ সিরিয়ায় করোনায় মরেছে মাত্র একজন। ইরাকে এখনও গাড়িবোমায় শত শত লোকের প্রাণহানি হচ্ছে। লিবিয়ায় আধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত দুটি গ্রুপ ক্ষমতার জন্য মুখামুখি যুদ্ধ করছে। প্রতিদিন লোক মরছে- ক্ষমতার জন্য, স্বার্থের জন্য, সম্প্রদায়গত আদর্শের খাতিরে। ইসরায়েলের জঙ্গি বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত বোমায় মরছে ফিলিস্তিনের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। সৌদি বোমায় মরেছে ইয়েমেনের শিয়া গ্রুপ। এসব মরণে তো বিশ্বের সব মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা যায়নি। কারণ যারা মরেছে, মরছে তারা একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের লোক। এসব মরণ ছোবল থেকে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ মুক্ত বলে দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মৃত্যুর ব্যাপারে নির্লিপ্ত। কিন্তু করোনা কোন সীমান্ত মানেনি, সীমান্ত রক্ষীদের পাহারা ফাঁকি দিয়ে সারা বিশ্বের মানুষকে আক্রমণ করে বসেছে। এ আক্রমণ থেকে রেহাই পাননি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, ব্রিটিশ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী প্রিন্স চার্লস, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর স্ত্রী, স্পেনের প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী, স্পেনের উপপ্রধানমন্ত্রী। করোনাভাইরাসের ভয়ে ৯৪ বছর বয়সী রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ও তার স্বামী ফিলিপকে বাকিংহাম প্যালেস থেকে পঁচিশ মাইল দূরবর্তী উইন্ডসর ক্যাসেলে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ভাগ্যবান ডোনাল্ড ট্রাম্প- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বলে ধারণা করা হয়েছিল; করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কয়েকজনের সংস্পর্শে আসার পরও করোনা তাকে স্পর্শ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

আমার ধার্মিক স্ত্রীর মরতে কোন আপত্তি নেই; তার দুঃখ হচ্ছে, চিকিৎসা ছাড়াই মরতে হবে, মরার পর কেউ দেখতে আসবে না, তার জন্য স্বামীও কাঁদার সুযোগ পাবে না, জানাজা হবে না। কয়েক দিন পূর্বে তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী বার্ধক্যজনিত কারণে কোন রোগ ছাড়াই হঠাৎ ইন্তেকাল করেছেন, আমরা কেউ যাইনি, কারণ সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী কোয়ারেন্টিনে আছি। সরকারের সব নির্দেশনা মেনে বিপদে আছি; সরকার বলেছে, প্রয়োজনাতিরিক্ত কোন পণ্য যেন কেনা না হয়- কিনিনি। মনে করেছিলাম, প্রয়োজনানুযায়ী পরবর্তীতে কিছু কিছু কিনব। গত মঙ্গলবার রাত ১২টায় দেখলাম পার্শ্ববর্তী বস্তি থেকে এক লোককে সর্দি, কাশি, জ্বরের কারণে হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। তাই বাজারে যেতে ভয় করছে। কিন্তু কুকুরের জন্য আমার কিছু পাউরুটির দরকার ছিল। আমাদের দুই বাসার মধ্যখানের প্যাসেজে চারটি কুকুর থাকে, তারা রাস্তায় গেলেই মানুষ মারে। শিশু-কিশোর মনের আনন্দে কুকুরগুলোকে ঢিল মারে, কুকুরের কান্না শুনে আমি দৌড়ে বারান্দায় যাই, কিশোরেরা আমাকে দেখে দৌড়ে পালায়। আমি প্রতিদিন রাতে বারান্দা থেকে ওদের জন্য কিছু পাউরুটি ও পলিথিনে করে ভাত ফেলে দেই। দু’দিন দেইনি- দু’দিন খাবার না দেয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, কুকুরগুলোর ওপর আমার ক্ষোভ। কয়েকদিন পূর্বে হঠাৎ একটি বিড়ালের আর্তচিৎকার শুনে বারান্দায় গিয়ে দেখলাম, ওই চারটি কুকুর বিড়ালটিকে ধরার জন্য দৌড়াদৌড়ি করছে। তিনতলা থেকে চিৎকার করতে করতে দৌডে বাসার নিচে গিয়ে দেখি, ততক্ষণে বিড়ালটিকে মেরে ফেলা হয়েছে। নিঃশ্বাস নিচ্ছে কী না অনেকক্ষণ বিড়ালটির পাশে বসে দেখার চেষ্টা করেছি, দেখলাম কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিড়ালটির গায়ে মাছি-মশা বসতে শুরু করেছে। শুধু করোনা নয়, মৃত্যু যে কতভাবে আসে তার হিসাব রাখা কঠিন।

পৃথিবীর ৯০-৯৯ শতাংশ মানুষ, পশু-পাখি, গাছপালা কমপক্ষে ছয় বার নাকি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল; এমন কেয়ামতের ধ্বংসস্তূপ থেকে আবার পৃথিবী জেগে উঠেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ, দুর্ঘটনা প্রভৃতিতে মানুষ সর্বস্ব হারিয়েও আবার শক্ত-সামর্থ্য হয়ে বেঁচে উঠে। অনেক রোগেরই ওষুধ নেই, চিকিৎসা নেই- কিন্তু ওই সব রোগে আক্রান্ত মানুষগুলোও বেঁচে যায়। হতাশায় নিমজ্জিত হলে কোন ওষুধই কাজ করে না। বাংলাদেশে নেতিবাচক কিছু মানুষের হতাশা ব্যঞ্জক কথাবার্তায় করোনার আতঙ্কের চেয়েও ভয়ংকর ঘোর অনামিশা নেমে এসেছে। মহামারীতে মৃত্যু শহীদের সমতুল্য- ধর্মের এমন আশ্বাস থাকা সত্বেও করোনায় আক্রান্ত সন্দেহে কোন স্বজনকেও কেউ সহ্য করতে পারছে না। প্রতিটি লোক ইতালি ফেরতপ্রবাসীদের মু-পাত করছে। একটু সর্দি-কাশি হলে সুস্থ মানুষগুলো তাকে ঘৃণা করছে, হাসপাতালে অন্য রোগের অসুস্থ লোকগুলোও হাসপাতালে সর্দি-কাশি দ্বারা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা প্রতিহত করে দিচ্ছে। মানুষ কত নিষ্ঠুর। সিটি করপোরেশনের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে খিলগাঁও-তালতলা কবরস্থানে এলাকার বাইরের লোকদের কবর দেয়া যাবে না বলে এলাকাবাসী ব্যানার টাঙিয়ে রেখেছে। মুসলমান হলেই নাকি ভাই-ভাই, কিন্তু মরার পরও ধর্মের ভ্রাতৃত্ববোধ কোন কাজে লাগছে না। বেঁচে থাকার আগ্রহ অনেককে হিংস্র করে তুলছে। এ অবস্থায় রবি ঠাকুরের আশ্বাসের বাণী আমাদের বাঁচার আশা জাগায়-

‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে।/ তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।/ তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,/ বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।’

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ]

ahmedzeauddin0@gmail.com