নারায়ণগঞ্জে করোনা এপিসেন্টারে পরিণত

পরিস্থিতি ক্রমাগত অবনতির দিকে লকডাউন মানছে না মানুষ

নারায়ণগঞ্জে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে। এক দিনে সর্বোচ্চ ২৪ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে জেলা সিভিল সার্জনসহ সরকারি-বেসরকারি নয়জন চিকিৎসকও রয়েছেন। কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না সংক্রমণ। সারাদেশে নারায়ণগঞ্জ এখন আতঙ্কের নাম। শুরুর দিকে দেশে কেউ করোনা আক্রান্ত হলে প্রবাসী কিনা জানাটাই ছিল মূল প্রসঙ্গ। সে প্রসঙ্গ এখন ঘুরে গেছে নারায়ণগঞ্জের দিকে। আক্রান্ত ব্যক্তি নারায়ণগঞ্জ ফেরত কিনা জানতে চাওয়া হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জকে এখন করোনা সংক্রমণের কেন্দ্রস্থল (এপিসেন্টার) বলছে দেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। তবে শুরুর দিকে সঠিক কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগোলে এই পরিস্থিতি ঠেকানো যেতো বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের। নারায়ণগঞ্জ করোনার এপিসেন্টার হওয়ার পেছনে প্রশাসন ও সরকারের উদাসীনতাকেই দায়ী করছেন তারা।

সারাদেশের মধ্যে অনেক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ নারায়ণগঞ্জ। রাজধানীর লাগোয়া এই জেলাটির পাশেই মুন্সিগঞ্জ জেলা। প্রবাসীদের বড় একটি অংশ মুন্সিগঞ্জের বাসিন্দা। ঢাকা-মুন্সিগঞ্জের সংযোগ দেয় নারায়ণগঞ্জ। জেলাটির ওপর দিয়ে গিয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। শহরের মধ্যেই বিসিক শিল্পনগরী ও ইপিজেড। দেশের সবচেয়ে বড় হোসিয়ারি শিল্প এই নারায়ণগঞ্জে। বিদেশি ক্রেতাদের আনাগোনা প্রচুর। শ্রমিক অধ্যুষিত এই জেলাটির আয়তন ছোট হলেও ৯০ লাখেরও বেশি মানুষের বসবাস এখানে। আর এই জেলাতেই সবচেয়ে বেশি আঘাত হেনেছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। রাজধানী ঢাকার পর সবচেয়ে বেশি করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে নারায়ণগঞ্জে। মৃত্যুর হারও তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।

সরকার ও প্রশাসনের উদাসীনতা

শুরুতেই করোনা আক্রান্ত দুই রোগী শনাক্ত হয় নারায়ণগঞ্জে। ইতালি ফেরত এক ব্যক্তি ও তার স্ত্রী। দু’জনই চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ফিরে গেলেন নিজ গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ শহরের যে বাড়িতে তারা থাকতেন সেই বাড়িটিকে লকডাউন করা হয়নি। শুরু থেকেই বিদেশ থেকে ফেরা প্রবাসীদের হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা নিয়ে উদাসীন ছিল জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ ও প্রশাসন। প্রথম আক্রান্ত পাওয়ার পরের এক সপ্তাহে মাত্র ৩০ জন প্রবাসীর হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে পেরেছিল স্বাস্থ্য বিভাগ। যদিও ওই সময়ে বিদেশ থেকে ফেরা প্রবাসীর সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজারেরও বেশি। ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি করেও বিদেশ ফেরতদের অবস্থান নিশ্চিত করতে পারেনি প্রশাসন।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, মার্চ মাসজুড়ে নারায়ণগঞ্জে বিদেশ ফেরতদের সংখ্যা ছিল ৬০০৮ জন। তবে হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা গেছে মাত্র ১১৮৮ জনের। বাকিদের খুঁজেই পায়নি। এমনকি হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা প্রবাসীদের প্রতিও ছিল না তেমন নজরদারি। অনেক প্রবাসীকেই দেখা গেছে, তারা দিব্যি বাইরে ঘুরে বেরিয়েছেন, দোকানদারি করছেন কিংবা বাজার করতে চলে গেছেন। এমন অপরাধে বেশ কয়েকজন প্রবাসীকে জরিমানাও করা হয়। হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তিদের প্রশাসনিকভাবে যে সহযোগিতা করার কথা ছিল তেমনটাও করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও জনসমাগমপূর্ণ অনুষ্ঠান বাদ যায়নি। প্রথম সংক্রমণ পাওয়ার এক সপ্তাহ পরেও শহরের বিভিন্ন স্থানে বিয়ে, ওয়াজ-মাহফিলের মতো জনসমাগম হয় এমন কার্যক্রম চলেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করলেও বন্ধ করা যায়নি কোচিং সেন্টারগুলো। চলেছে অপ্রয়োজনীয় ঘোরাঘুরি। জনসমাগম রোধে তখনও সরাসরি অ্যাকশনে যায়নি প্রশাসন। আর এসব কারণেই নারায়ণগঞ্জে করোনার সংক্রমণ দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে বলে মত অনেকের। এরই মধ্যে ২৩ মার্চ তৃতীয় রোগী শনাক্ত হয় নারায়ণগঞ্জে। গণপরিবহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আসেনি তখনও। নিয়মমাফিক চলেছে গার্মেন্টসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। গার্মেন্টস খুলে দেয়ার পর আবার এক দিনের নোটিশে বন্ধের ঘোষণায় গ্রাম থেকে শহরে ফেরা মানুষ আবার গ্রামে ফিরে যায়।

নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, প্রথম যখন করোনা রোগী নারায়ণগঞ্জে শনাক্ত হলো তখনই প্রশাসনের কড়াকড়ি ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল। যথাযথ কর্মসূচি এখনও গ্রহণ করতে পারেনি সরকার। শুরুটা হয়তো নারায়ণগঞ্জ দিয়ে কিন্তু এটা জাতীয় একটি সমস্যা। সুতরাং সব রাজনৈতিক দল, সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয়ভাবে এই সমস্যার মোকাবিলা করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

জেলায় সর্বপ্রথম মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় গত ২ এপ্রিল। করোনায় ৪ এপ্রিল মারা যান দ্বিতীয় ব্যক্তি। পরিস্থিতি বিবেচনায় এর পরদিনই নারায়ণগঞ্জে কারফিউ জারি কিংবা লকডাউনের দাবি জানান নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। লকডাউনের প্রস্তাব আরও আগেই দিয়েছিলেন বলে সংবাদকে জানান মেয়র আইভী। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন তা আমলে নেয়নি। দেরিতে হলেও তা আমলে নেয় সরকার। গত ৭ এপ্রিল রাতে সরকারিভাবে নারায়ণগঞ্জকে লকডাউন করার ঘোষণা আসে। কিন্তু ততদিনে করোনা নারায়ণগঞ্জের কমিউনিটি লেভেলে ছড়িয়ে পড়েছে। সর্বশেষ পাওয়া তথ্যমতে, নারায়ণগঞ্জে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৩২মারা গেছেন ১২জন।

নারায়ণগঞ্জ সিটি এলাকা এবং সদর উপজেলায় করোনার প্রকোপ বেশি। শহরের থানা পুকুরপাড়, নন্দীপাড়া, দেওভোগ আখড়া এবং সদর উপজেলার কাশিপুরের আমবাগান ও পূর্ব লামাপাড়া; বন্দর উপজেলার রসূলবাগ; রূপগঞ্জ উপজেলার গোলাকান্দাইল, ভুলতা ও নোয়াপাড়া; আড়াইহাজার উপজেলার বিশনন্দী ইউনিয়নে; সোনারগাঁ উপজেলায় করোনা রোগী শনাক্ত আছেন।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, ‘লকডাউন আগেই করা উচিত ছিল। এখন করা হয়েছে সেটাও কেউ মানছে না। এদিকে নারায়ণগঞ্জকে এপিসেন্টার বলা হচ্ছে। লকডাউন আরও কড়াকড়ি করতে হবে। প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। তবে নিজেরা সচেতন না হলে কিছুই হবে না। মানুষকে সচেতন হতে হবে।’

নমুনা সংগ্রহ কম, পরীক্ষাগারের দাবি

শুরু থেকেই নমুনা সংগ্রহ ছিল কম। প্রথমে সরাসরি আইইডিসিআর থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় গত ৩১ মার্চ থেকে জেলা পর্যায়ে নমুনা সংগ্রহ করা শুরু হয়। প্রথম দিনে সংগৃহীত ১১ জনের মধ্যে ৩ জনের নমুনায় করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়। নমুনা সংগ্রহের জন্য যথেষ্ট যানবাহনও নেই বলে জানায় জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। দুইবার জেলা স্বাস্থ্য বিভাগে নমুনা দিয়েও কোন রিপোর্ট না পেয়ে চারদিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উপস্থিত হয়ে নমুনা দেন নারায়ণগঞ্জ ৩শ’ শয্যা হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের এক চিকিৎসক। পরে করোনা পজিটিভ বলে শনাক্ত হন তিনি। নারায়ণগঞ্জে প্রথম যে নারী মারা যান তারও করোনা শনাক্ত হয় মারা যাওয়ার তিন দিন পর। দুই দিন আইইডিসিআরের হটলাইনে যোগাযোগ করেও নমুনা দিতে পারেনি শহরের জনপ্রিয় গিটারিস্ট খাইরুল আলম হিরু। উপসর্গ নিয়েই মারা যান তিনি। মৃত্যুর ৮-৯ ঘণ্টা পর তার নমুনা সংগ্রহ করা হয় বলে জানান হিরুর বড় ভাই আবু নাঈম। তিন দিন পর করোনা পরীক্ষায় পজিটিভ রিপোর্ট আসে তার। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন হিরুর স্বজনরা। গত কয়েকদিনে জেলায় দশেরও অধিক ব্যক্তি করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন কিন্তু তাদের নমুনা সংগ্রহ করা হয়নি।

তাছাড়া জেলা শহরে ৫০ শয্যার একটি কোয়ারেন্টিন সেল স্থাপন করা হলেও সেখানে মাত্র একজন ছাড়া এ পর্যন্ত কাউকেই রাখা হয়নি। জোরালো দাবি থাকলেও নারায়ণগঞ্জে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের কোন পরীক্ষাগার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়নি সরকার। তবে শহরের দুটি স্থানে ১৬টি নমুনা সংগ্রহ বুথ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ।

করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুতে পর্যাপ্ত পিপিই সরবরাহ না থাকায় চিকিৎসকদের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা ছিল। শঙ্কা এখন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। নারায়ণগঞ্জের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের বেশ কয়েকজন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্ত অবস্থায় আইসোলেশনে আছেন জেলা সিভিল সার্জন ও জেলা করোনা বিষয়ক ফোকাল পারসনসহ আরও কয়েকজন স্বাস্থ্যকর্মী। সন্দেহভাজন অবস্থায় কোয়ারেন্টিনে আছেন জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিন, জেলা পুলিশ সুপারসহ আরও কয়েকজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা।

করোনা মোকাবিলায় সঠিক পরিকল্পনা ছিল না বলেই এমনটা হয়েছে বলে মন্তব্য চিকিৎসকদের। করোনা প্রতিরোধ কমিটির প্রধান স্বাস্থ্য বিভাগের কাউকে করলে সিদ্ধান্ত নেয়াটা সহজ হতো বলেও অভিমত তাদের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারি হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, ‘চিকিৎসকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করাই ছিল সর্বপ্রথম কাজ। কিন্তু তা করা হয়নি। বেশ কয়েকজন চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন। আরও অনেকেই কোয়ারেন্টিনে আছে। চিকিৎসকরাই আক্রান্ত হয়ে পড়লে রোগীরা চিকিৎসা নেবে কার কাছে?’

জেলা সিভিল সার্জন করোনা আক্রান্ত হওয়ায় কথা হয় ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ঢাকা স্বাস্থ্য বিভাগের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. চৌধুরী মো. ইকবাল বাহারের সাথে। সরাসরি না বললেও প্রায় একই সুরে কথা বললেন ভারপ্রাপ্ত এই সিভিল সার্জন। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘এয়ারপোর্ট থেকেই প্রবাসীদের আটকাতে পারলে কাজ হতো। বন্যার পানি ছেড়ে দেয়া হয়েছে এখন আমরা সেচছি। তখন এয়ারপোর্ট থেকে প্রবাসীদের এভাবে ছেড়ে না দিলে হয়তো ট্রান্সমিশনটা কম হতো। তাছাড়া অনেকেই গ্রামে ফিরে গিয়েছিল আবার এসেছে। এতে ট্রান্সমিশন বেড়েছে। কমিউনিটি পর্যায়ে সারাদেশে এভাবেই ছড়িয়েছে।’

লকডাউন মানছে না কেউ

সরকারিভাবে লকডাউনের ঘোষণা আসলেও তা মানছেন না কেউ। সেনাবাহিনী, র‌্যাব, পুলিশ কেউই মানুষের ঘর থেকে বের হওয়া আটকাতে পারছে না। নানা অজুহাতে বের হচ্ছেন তারা। তাছাড়া এখনও কিছু কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে। শহরের চিত্র এক ধরনের হলেও পাড়া-মহল্লার চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। সন্ধ্যা ৬টার পর ঘর থেকে বের হওয়ার বিষয়ে কড়াকড়ি থাকলেও তা খাটছে না নারায়ণগঞ্জের বেলায়। পাড়া-মহল্লার আড্ডা কোনমতেই থামানো যাচ্ছে না। এদিকে এলাকাগুলোতে স্বেচ্ছা লকডাউনের নামে ব্যারিকেড দেয়ায় জরুরি সেবা ব্যাহত হচ্ছে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসহ জরুরি সেবা চালু থাকায় সেসব অজুহাতে বের হচ্ছে মানুষ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাইলেও কঠোর অবস্থানে যেতে পারছে না জানালেন জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘নিয়মিত টহল তো আছেই তাছাড়া স্পেশাল গোয়েন্দা টিম নামিয়ে দিয়েছি। তারপরও গলিগুলোতে লোক বের হয়, আমরা গেলেই তারা সরে যায়। এটা অ্যালার্মিং একটি বিষয়। জনপ্রতিনিধিদেরও সম্পৃক্ত করেছি। জনসচেতনতা না বাড়লে এই কাজ কঠিন। একেবারে কারফিউ থাকলে কঠোর থেকে কঠোরতর হতে পারতাম। কিন্তু ভোগ্যপণ্য, কাঁচাবাজারের সঙ্গে সম্পৃক্তরা বের হচ্ছে। তাদের তো আটকাতে পারছি না। সর্বোচ্চ আইনের প্রয়োগ করতে পারছি না। তারপরও কীভাবে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া যায় সেটা আমরা দেখছি।’

এদিকে কর্মহীন মানুষদের ক্ষোভ বাড়ছে। ত্রাণের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসছেন তারা। প্রতিদিনই জেলার কোথাও না কোথায়ও বিক্ষোভ করছেন কর্মহীন মেহনতি মানুষ। বিগত কয়েকদিনে স্থানীয় কাউন্সিলর থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘেরাও করার মতো ঘটনাও ঘটেছে।

করোনার এই সংকটে প্রশ্ন উঠেছে নারায়ণগঞ্জের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়েও। দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ জেলাটিতে নেই কোন মেডিকেল কলেজ। সরকারি হাসপাতাল দুটিরও দৈন্যতা লক্ষ করা গেছে। দুই হাসপাতালেরই চিকিৎসক ও নার্সসহ কয়েকজন কর্মী করোনা আক্রান্ত হওয়ায় স্থবির হয়ে পড়ে চিকিৎসাসেবা। চার দিন বন্ধ ছিল নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের সার্বিক কার্যক্রম। সংকটের এই সময়ে বেসরকারি হাসপাতালের অধিকাংশই বন্ধ। চিকিৎসকরা চেম্বারে বসা বন্ধ করে দিয়েছেন। চিকিৎসক সংকট দেখা দিয়েছে নারায়ণগঞ্জে।

এদিকে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য নারায়ণগঞ্জ ৩শ’ শয্যা হাসপাতালকে নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি। এই হাসপাতালেরই দু’জন চিকিৎসকসহ তিনজন করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. চৌধুরী মো. ইকবাল বাহার সংবাদকে বলেন, ‘সিভিল সার্জন, সদরের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, ৩শ’ শয্যার দুই চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মেডিসিন ডিপার্টমেন্টের অনেকেই কোয়ারেন্টিনে চলে গেছেন। সর্বোচ্চ সতর্কতা নিয়ে আগাতে হচ্ছে। আমাদের সীমাবদ্ধতার চাইতেও বেশি আন্তরিকতা। জনসাধারণের সহযোগিতা ছাড়া করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাবে না।’

মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল ২০২০ , ১ বৈশাখ ১৪২৭, ১৯ শাবান ১৪৪১

প্রশাসনের উদাসীনতা

নারায়ণগঞ্জে করোনা এপিসেন্টারে পরিণত

পরিস্থিতি ক্রমাগত অবনতির দিকে লকডাউন মানছে না মানুষ

সৌরভ হোসেন সিয়াম, নারায়ণগঞ্জ

নারায়ণগঞ্জে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে। এক দিনে সর্বোচ্চ ২৪ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে জেলা সিভিল সার্জনসহ সরকারি-বেসরকারি নয়জন চিকিৎসকও রয়েছেন। কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না সংক্রমণ। সারাদেশে নারায়ণগঞ্জ এখন আতঙ্কের নাম। শুরুর দিকে দেশে কেউ করোনা আক্রান্ত হলে প্রবাসী কিনা জানাটাই ছিল মূল প্রসঙ্গ। সে প্রসঙ্গ এখন ঘুরে গেছে নারায়ণগঞ্জের দিকে। আক্রান্ত ব্যক্তি নারায়ণগঞ্জ ফেরত কিনা জানতে চাওয়া হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জকে এখন করোনা সংক্রমণের কেন্দ্রস্থল (এপিসেন্টার) বলছে দেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। তবে শুরুর দিকে সঠিক কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগোলে এই পরিস্থিতি ঠেকানো যেতো বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের। নারায়ণগঞ্জ করোনার এপিসেন্টার হওয়ার পেছনে প্রশাসন ও সরকারের উদাসীনতাকেই দায়ী করছেন তারা।

সারাদেশের মধ্যে অনেক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ নারায়ণগঞ্জ। রাজধানীর লাগোয়া এই জেলাটির পাশেই মুন্সিগঞ্জ জেলা। প্রবাসীদের বড় একটি অংশ মুন্সিগঞ্জের বাসিন্দা। ঢাকা-মুন্সিগঞ্জের সংযোগ দেয় নারায়ণগঞ্জ। জেলাটির ওপর দিয়ে গিয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। শহরের মধ্যেই বিসিক শিল্পনগরী ও ইপিজেড। দেশের সবচেয়ে বড় হোসিয়ারি শিল্প এই নারায়ণগঞ্জে। বিদেশি ক্রেতাদের আনাগোনা প্রচুর। শ্রমিক অধ্যুষিত এই জেলাটির আয়তন ছোট হলেও ৯০ লাখেরও বেশি মানুষের বসবাস এখানে। আর এই জেলাতেই সবচেয়ে বেশি আঘাত হেনেছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। রাজধানী ঢাকার পর সবচেয়ে বেশি করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে নারায়ণগঞ্জে। মৃত্যুর হারও তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।

সরকার ও প্রশাসনের উদাসীনতা

শুরুতেই করোনা আক্রান্ত দুই রোগী শনাক্ত হয় নারায়ণগঞ্জে। ইতালি ফেরত এক ব্যক্তি ও তার স্ত্রী। দু’জনই চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ফিরে গেলেন নিজ গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ শহরের যে বাড়িতে তারা থাকতেন সেই বাড়িটিকে লকডাউন করা হয়নি। শুরু থেকেই বিদেশ থেকে ফেরা প্রবাসীদের হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা নিয়ে উদাসীন ছিল জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ ও প্রশাসন। প্রথম আক্রান্ত পাওয়ার পরের এক সপ্তাহে মাত্র ৩০ জন প্রবাসীর হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে পেরেছিল স্বাস্থ্য বিভাগ। যদিও ওই সময়ে বিদেশ থেকে ফেরা প্রবাসীর সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজারেরও বেশি। ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি করেও বিদেশ ফেরতদের অবস্থান নিশ্চিত করতে পারেনি প্রশাসন।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, মার্চ মাসজুড়ে নারায়ণগঞ্জে বিদেশ ফেরতদের সংখ্যা ছিল ৬০০৮ জন। তবে হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা গেছে মাত্র ১১৮৮ জনের। বাকিদের খুঁজেই পায়নি। এমনকি হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা প্রবাসীদের প্রতিও ছিল না তেমন নজরদারি। অনেক প্রবাসীকেই দেখা গেছে, তারা দিব্যি বাইরে ঘুরে বেরিয়েছেন, দোকানদারি করছেন কিংবা বাজার করতে চলে গেছেন। এমন অপরাধে বেশ কয়েকজন প্রবাসীকে জরিমানাও করা হয়। হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তিদের প্রশাসনিকভাবে যে সহযোগিতা করার কথা ছিল তেমনটাও করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও জনসমাগমপূর্ণ অনুষ্ঠান বাদ যায়নি। প্রথম সংক্রমণ পাওয়ার এক সপ্তাহ পরেও শহরের বিভিন্ন স্থানে বিয়ে, ওয়াজ-মাহফিলের মতো জনসমাগম হয় এমন কার্যক্রম চলেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করলেও বন্ধ করা যায়নি কোচিং সেন্টারগুলো। চলেছে অপ্রয়োজনীয় ঘোরাঘুরি। জনসমাগম রোধে তখনও সরাসরি অ্যাকশনে যায়নি প্রশাসন। আর এসব কারণেই নারায়ণগঞ্জে করোনার সংক্রমণ দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে বলে মত অনেকের। এরই মধ্যে ২৩ মার্চ তৃতীয় রোগী শনাক্ত হয় নারায়ণগঞ্জে। গণপরিবহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আসেনি তখনও। নিয়মমাফিক চলেছে গার্মেন্টসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। গার্মেন্টস খুলে দেয়ার পর আবার এক দিনের নোটিশে বন্ধের ঘোষণায় গ্রাম থেকে শহরে ফেরা মানুষ আবার গ্রামে ফিরে যায়।

নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, প্রথম যখন করোনা রোগী নারায়ণগঞ্জে শনাক্ত হলো তখনই প্রশাসনের কড়াকড়ি ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল। যথাযথ কর্মসূচি এখনও গ্রহণ করতে পারেনি সরকার। শুরুটা হয়তো নারায়ণগঞ্জ দিয়ে কিন্তু এটা জাতীয় একটি সমস্যা। সুতরাং সব রাজনৈতিক দল, সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয়ভাবে এই সমস্যার মোকাবিলা করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

জেলায় সর্বপ্রথম মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় গত ২ এপ্রিল। করোনায় ৪ এপ্রিল মারা যান দ্বিতীয় ব্যক্তি। পরিস্থিতি বিবেচনায় এর পরদিনই নারায়ণগঞ্জে কারফিউ জারি কিংবা লকডাউনের দাবি জানান নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। লকডাউনের প্রস্তাব আরও আগেই দিয়েছিলেন বলে সংবাদকে জানান মেয়র আইভী। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন তা আমলে নেয়নি। দেরিতে হলেও তা আমলে নেয় সরকার। গত ৭ এপ্রিল রাতে সরকারিভাবে নারায়ণগঞ্জকে লকডাউন করার ঘোষণা আসে। কিন্তু ততদিনে করোনা নারায়ণগঞ্জের কমিউনিটি লেভেলে ছড়িয়ে পড়েছে। সর্বশেষ পাওয়া তথ্যমতে, নারায়ণগঞ্জে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৩২মারা গেছেন ১২জন।

নারায়ণগঞ্জ সিটি এলাকা এবং সদর উপজেলায় করোনার প্রকোপ বেশি। শহরের থানা পুকুরপাড়, নন্দীপাড়া, দেওভোগ আখড়া এবং সদর উপজেলার কাশিপুরের আমবাগান ও পূর্ব লামাপাড়া; বন্দর উপজেলার রসূলবাগ; রূপগঞ্জ উপজেলার গোলাকান্দাইল, ভুলতা ও নোয়াপাড়া; আড়াইহাজার উপজেলার বিশনন্দী ইউনিয়নে; সোনারগাঁ উপজেলায় করোনা রোগী শনাক্ত আছেন।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, ‘লকডাউন আগেই করা উচিত ছিল। এখন করা হয়েছে সেটাও কেউ মানছে না। এদিকে নারায়ণগঞ্জকে এপিসেন্টার বলা হচ্ছে। লকডাউন আরও কড়াকড়ি করতে হবে। প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। তবে নিজেরা সচেতন না হলে কিছুই হবে না। মানুষকে সচেতন হতে হবে।’

নমুনা সংগ্রহ কম, পরীক্ষাগারের দাবি

শুরু থেকেই নমুনা সংগ্রহ ছিল কম। প্রথমে সরাসরি আইইডিসিআর থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় গত ৩১ মার্চ থেকে জেলা পর্যায়ে নমুনা সংগ্রহ করা শুরু হয়। প্রথম দিনে সংগৃহীত ১১ জনের মধ্যে ৩ জনের নমুনায় করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়। নমুনা সংগ্রহের জন্য যথেষ্ট যানবাহনও নেই বলে জানায় জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। দুইবার জেলা স্বাস্থ্য বিভাগে নমুনা দিয়েও কোন রিপোর্ট না পেয়ে চারদিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উপস্থিত হয়ে নমুনা দেন নারায়ণগঞ্জ ৩শ’ শয্যা হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের এক চিকিৎসক। পরে করোনা পজিটিভ বলে শনাক্ত হন তিনি। নারায়ণগঞ্জে প্রথম যে নারী মারা যান তারও করোনা শনাক্ত হয় মারা যাওয়ার তিন দিন পর। দুই দিন আইইডিসিআরের হটলাইনে যোগাযোগ করেও নমুনা দিতে পারেনি শহরের জনপ্রিয় গিটারিস্ট খাইরুল আলম হিরু। উপসর্গ নিয়েই মারা যান তিনি। মৃত্যুর ৮-৯ ঘণ্টা পর তার নমুনা সংগ্রহ করা হয় বলে জানান হিরুর বড় ভাই আবু নাঈম। তিন দিন পর করোনা পরীক্ষায় পজিটিভ রিপোর্ট আসে তার। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন হিরুর স্বজনরা। গত কয়েকদিনে জেলায় দশেরও অধিক ব্যক্তি করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন কিন্তু তাদের নমুনা সংগ্রহ করা হয়নি।

তাছাড়া জেলা শহরে ৫০ শয্যার একটি কোয়ারেন্টিন সেল স্থাপন করা হলেও সেখানে মাত্র একজন ছাড়া এ পর্যন্ত কাউকেই রাখা হয়নি। জোরালো দাবি থাকলেও নারায়ণগঞ্জে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের কোন পরীক্ষাগার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়নি সরকার। তবে শহরের দুটি স্থানে ১৬টি নমুনা সংগ্রহ বুথ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ।

করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুতে পর্যাপ্ত পিপিই সরবরাহ না থাকায় চিকিৎসকদের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা ছিল। শঙ্কা এখন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। নারায়ণগঞ্জের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের বেশ কয়েকজন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্ত অবস্থায় আইসোলেশনে আছেন জেলা সিভিল সার্জন ও জেলা করোনা বিষয়ক ফোকাল পারসনসহ আরও কয়েকজন স্বাস্থ্যকর্মী। সন্দেহভাজন অবস্থায় কোয়ারেন্টিনে আছেন জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিন, জেলা পুলিশ সুপারসহ আরও কয়েকজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা।

করোনা মোকাবিলায় সঠিক পরিকল্পনা ছিল না বলেই এমনটা হয়েছে বলে মন্তব্য চিকিৎসকদের। করোনা প্রতিরোধ কমিটির প্রধান স্বাস্থ্য বিভাগের কাউকে করলে সিদ্ধান্ত নেয়াটা সহজ হতো বলেও অভিমত তাদের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারি হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, ‘চিকিৎসকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করাই ছিল সর্বপ্রথম কাজ। কিন্তু তা করা হয়নি। বেশ কয়েকজন চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন। আরও অনেকেই কোয়ারেন্টিনে আছে। চিকিৎসকরাই আক্রান্ত হয়ে পড়লে রোগীরা চিকিৎসা নেবে কার কাছে?’

জেলা সিভিল সার্জন করোনা আক্রান্ত হওয়ায় কথা হয় ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ঢাকা স্বাস্থ্য বিভাগের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. চৌধুরী মো. ইকবাল বাহারের সাথে। সরাসরি না বললেও প্রায় একই সুরে কথা বললেন ভারপ্রাপ্ত এই সিভিল সার্জন। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘এয়ারপোর্ট থেকেই প্রবাসীদের আটকাতে পারলে কাজ হতো। বন্যার পানি ছেড়ে দেয়া হয়েছে এখন আমরা সেচছি। তখন এয়ারপোর্ট থেকে প্রবাসীদের এভাবে ছেড়ে না দিলে হয়তো ট্রান্সমিশনটা কম হতো। তাছাড়া অনেকেই গ্রামে ফিরে গিয়েছিল আবার এসেছে। এতে ট্রান্সমিশন বেড়েছে। কমিউনিটি পর্যায়ে সারাদেশে এভাবেই ছড়িয়েছে।’

লকডাউন মানছে না কেউ

সরকারিভাবে লকডাউনের ঘোষণা আসলেও তা মানছেন না কেউ। সেনাবাহিনী, র‌্যাব, পুলিশ কেউই মানুষের ঘর থেকে বের হওয়া আটকাতে পারছে না। নানা অজুহাতে বের হচ্ছেন তারা। তাছাড়া এখনও কিছু কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে। শহরের চিত্র এক ধরনের হলেও পাড়া-মহল্লার চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। সন্ধ্যা ৬টার পর ঘর থেকে বের হওয়ার বিষয়ে কড়াকড়ি থাকলেও তা খাটছে না নারায়ণগঞ্জের বেলায়। পাড়া-মহল্লার আড্ডা কোনমতেই থামানো যাচ্ছে না। এদিকে এলাকাগুলোতে স্বেচ্ছা লকডাউনের নামে ব্যারিকেড দেয়ায় জরুরি সেবা ব্যাহত হচ্ছে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসহ জরুরি সেবা চালু থাকায় সেসব অজুহাতে বের হচ্ছে মানুষ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাইলেও কঠোর অবস্থানে যেতে পারছে না জানালেন জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘নিয়মিত টহল তো আছেই তাছাড়া স্পেশাল গোয়েন্দা টিম নামিয়ে দিয়েছি। তারপরও গলিগুলোতে লোক বের হয়, আমরা গেলেই তারা সরে যায়। এটা অ্যালার্মিং একটি বিষয়। জনপ্রতিনিধিদেরও সম্পৃক্ত করেছি। জনসচেতনতা না বাড়লে এই কাজ কঠিন। একেবারে কারফিউ থাকলে কঠোর থেকে কঠোরতর হতে পারতাম। কিন্তু ভোগ্যপণ্য, কাঁচাবাজারের সঙ্গে সম্পৃক্তরা বের হচ্ছে। তাদের তো আটকাতে পারছি না। সর্বোচ্চ আইনের প্রয়োগ করতে পারছি না। তারপরও কীভাবে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া যায় সেটা আমরা দেখছি।’

এদিকে কর্মহীন মানুষদের ক্ষোভ বাড়ছে। ত্রাণের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসছেন তারা। প্রতিদিনই জেলার কোথাও না কোথায়ও বিক্ষোভ করছেন কর্মহীন মেহনতি মানুষ। বিগত কয়েকদিনে স্থানীয় কাউন্সিলর থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘেরাও করার মতো ঘটনাও ঘটেছে।

করোনার এই সংকটে প্রশ্ন উঠেছে নারায়ণগঞ্জের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়েও। দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ জেলাটিতে নেই কোন মেডিকেল কলেজ। সরকারি হাসপাতাল দুটিরও দৈন্যতা লক্ষ করা গেছে। দুই হাসপাতালেরই চিকিৎসক ও নার্সসহ কয়েকজন কর্মী করোনা আক্রান্ত হওয়ায় স্থবির হয়ে পড়ে চিকিৎসাসেবা। চার দিন বন্ধ ছিল নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের সার্বিক কার্যক্রম। সংকটের এই সময়ে বেসরকারি হাসপাতালের অধিকাংশই বন্ধ। চিকিৎসকরা চেম্বারে বসা বন্ধ করে দিয়েছেন। চিকিৎসক সংকট দেখা দিয়েছে নারায়ণগঞ্জে।

এদিকে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য নারায়ণগঞ্জ ৩শ’ শয্যা হাসপাতালকে নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি। এই হাসপাতালেরই দু’জন চিকিৎসকসহ তিনজন করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. চৌধুরী মো. ইকবাল বাহার সংবাদকে বলেন, ‘সিভিল সার্জন, সদরের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, ৩শ’ শয্যার দুই চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মেডিসিন ডিপার্টমেন্টের অনেকেই কোয়ারেন্টিনে চলে গেছেন। সর্বোচ্চ সতর্কতা নিয়ে আগাতে হচ্ছে। আমাদের সীমাবদ্ধতার চাইতেও বেশি আন্তরিকতা। জনসাধারণের সহযোগিতা ছাড়া করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাবে না।’