করোনা ও ডিজিটাল জীবনধারা

মোস্তাফা জব্বার

সারা বিশ্বে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয়ের নাম করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯। ব্রিটিশ রাজকুমার, প্রধানমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং সৌদি রাজপরিবারের ১৫০ সদস্যসহ ১১ লাখের মতো আক্রান্ত মানুষ এবং লাখের কাছাকাছি জীবনহানির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব এখন বস্তুত গৃহবন্দী। অতি শক্তিশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে আমাদের মতো দেশ পর্যন্ত সকলেই প্রাথমিকভাবে এই মহামারী থেকে বেঁচে থাকার জন্য সঙ্গনিরোধ, লকডাউন, জনতার সান্ধ্য আইন, সান্ধ্য আইন, ১৪৪ ধারা ইত্যাদি নানা পদ্ধতি গ্রহণ করে যাচ্ছেন। এর শেষ কবে সেই সব নিয়ে বিভিন্ন সময়সীমা বা আলোচনা থাকলেও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না এর সমাপ্তি রেখাটি কোথায় গিয়ে থামবে। চীনের উহান প্রদেশ অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে কোভিড ১৯ মোকাবেলা করে একটি সুস্থির অবস্থায় রয়েছে। সুস্থির থাকার বিষয়ে কোরিয়ার অবস্থাও অনেক ভালো। জাপানও ভালো অবস্থায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন ও ইতালি বস্তুত ভয়ংকর বিপদের শীর্ষে রয়েছে। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাবার কোন পথ তাদের জানা আছে বলে মনে হয় না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এসব বিষয়ে গুজব ছড়ানোর সবচেয়ে বড় মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের দিকেও যদি আমরা তাকাই তবে আমরা মুজিব শতবর্ষের অনুষ্ঠান বাতিল করে ২৬ মার্চ থেকে গৃহবন্দী জীবনযাপন করছি আমরা। এখন পর্যন্ত এই সময়সীমা ২৫ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত নির্দিষ্ট করা রয়েছে। বাংলা নববর্ষ সংক্রান্ত সকল অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে। একদম ন্যূনতম সেবাও আমরা চালু রাখতে হিমসিম খাচ্ছি। সারা বিশ্বের সঙ্গে পুরো দেশের মানুষ একসঙ্গে এরকম অবস্থার মোকাবেলা করেছে বলে আমি আমার একাত্তর বছরের জীবনে স্মরণ করতে পারছি না।

এর প্রভাব কি হবে সেটি এখনই ধারণা করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে সর্ববৃহৎ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী খাত পোশাক শিল্পের ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিতের অবস্থা হিসেব করলে এটি বিশাল আকারের ধস। শিল্প-বাণিজ্য ও আর্থিক খাতসহ সব কিছুতেই স্থবিরতার আশঙ্কা কাজ করছে। কেউ কেউ বলছেন করোনার প্রভাবে বিশ্বে বেকার হতে পারে কোটি কোটি লোক। হতদরিদ্র হয়ে যেতে পারেন ৫০ কোটি লোক। আমেরিকার পুঁজিবাজার ও বিশ্বজুড়ে অন্যান্য পুঁজিবাজারের ধস বিবেচনায় নিলে বিশ্ব অর্থনীতি এখন স্থবিরতার পথে। ডিসেম্বরে শুরু হওয়া বিপদের মাত্র শতাধিক দিনের হিসাব নিলেই মাথার চুল খাঁড়া হয়ে যায়। সামনে কি আছে সেটি ধারণা করাও হয়তো এখন সম্ভব নয়।

তবে একটি বিষয় সম্ভবত আমাদের সবার ধারণাতেই এসেছে যে, বিশ্বটা সত্যি সত্যি ডিজিটাল হয়ে গেছে। এমনকি আমাদের দেশের অতি সাধারণ মানুষও যখন তার গৃহবন্দী জীবন কাটাচ্ছে তখন ডিজিটাল প্রযুক্তিই তার একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহুজনকেই এখন বাড়িতে বসে কাজকর্ম করতে হচ্ছে। কেবলমাত্র সরাসরি কায়িক শ্রমের কাজ ছাড়া বাকি কাজ যে ডিজিটাল পদ্ধতিতে করা যায় তার অফুরন্ত দৃষ্টান্তও স্থাপিত হচ্ছে।

একেবারে ন্যূনতম তথ্যটাও যদি ধরি তবে মোবাইলে কল করা বা ইন্টারনেট ব্রাউজ করা ছাড়া এমনকি দৈনন্দিন জীবনও কাটছে না। এটি কেবল যোগাযোগের মাধ্যম হয়নি এটি কাজের বাহন এবং বিনোদনের প্রধান উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে বর্তমানে ১৫.৯৪ কোটি মোবাইল সংযোগ আছে এবং অন্তত ১০ কোটি লোক মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। এখন প্রায় ১০ কোটি ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে। এখন ৫ মিনিট যদি ইন্টারনেট বন্ধ থাকে তবে আমাদের জীবনের ওপর যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে তা চিন্তাও করা যায় না। অথচ আজ থেকে ১০ বছর আগে ইন্টারনেটের কোন প্রভাবই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ছিলো না। ফেসবুক ব্যবহার করে হাজার হাজার তরুণ নিজের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। অনুমান করা হয় যে দেশের তিন কোটি ৪০ লাখ ব্যবহারকারীর মাঝে প্রায় ১০ লাখ ফেসবুক ব্যবহারকারী এতে ব্যবসা করে। বিপণন ও সামাজিক যোগাযোগের কথা না হয় উল্লেখই করা হলো না। ফেসবুক ছাড়াও অন্যান্য ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সরাসরি জিনিসপত্র বেচাকেনা হচ্ছে। এখন আর ভোক্তাকে বাজারে গিয়ে পছন্দের জিনিস কিনতে হচ্ছে না। ইন্টারনেটে জিনিস পছন্দ করে অর্ডার দিলেই তা বাসায় পৌঁছে যাচ্ছে। মূল্য পরিশোধ করে ভোক্তা তা গ্রহণ করতেও পারছে। মানুষ যতোটুকু সুযোগ-সুবিধা রাষ্ট্রীয়ভাবে পেয়েছে তা সুন্দরভাবে কাজে লাগাতে পেরেছে। যেটা বর্তমানে ডিজিটাল অর্থনীতি হিসেবে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। মানুষ কিন্তু বসে নেই। তার নিজের প্রয়োজনে এগিয়ে যাচ্ছে। যার সুফলটা পাচ্ছে রাষ্ট্র এবং সরকার। এখানে আরো অনেক বেশি কাজ করার সুযোগ আছে। করোনার আত্মপ্রকাশের পর আমরা যখন গৃহবন্দী হয়ে পড়লাম তখন অবস্থা একটি নতুন মাত্রা পেলো।

আমরা যখন ঘর থেকে ঘরে যাতায়াত করতে পারছি না তখন বিশ্বজুড়ে যোগাযোগ কেবলমাত্র এই প্রযুক্তিই প্রদান করছে। আমাদের ব্যান্ডউইদথ ব্যবহারের চিত্রটা দেখলেই আন্দাজ করা যাবে যে জীবনটা কতোটা বদলে গেছে। জানুয়ারি মাসে আমাদের ব্যান্ডউইদথ ব্যবহৃত হতো ১২৭৮ জিবিপিএস। ২৫ মার্চ ব্যবহৃত হতো ১৪০০ জিবিপিএস আর ৯ এপ্রিল ব্যবহৃত হয়েছে ১৫৫৮ জিবিপিএস। মাত্র সঙ্গত কারণেই ভয়েস কল ও ইন্টারনেটের ব্যবহারও বেড়েছে। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে আমেরিকার মোবাইল অপারেটরদের ভয়েস কল শতকরা ৪৪ ভাগ ও ডাটা কল বেড়েছে ৮৮ ভাগ। বস্তুত এই চিত্রটি সারা বিশ্বের। ঘরে বসে অফিস করার কাজটা আমরা অনেকেই এখন করছি। সেদিন আমি টেলিকম বিভাগের বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি বিষয়ক একটি সভা করেছি ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে। এখন করোনা সংক্রান্ত সংবাদ সম্মেলন হয় ডিজিটাল পদ্ধতিতে। টিভিগুলো অংশগ্রহণকারীকে বাড়িতে রেখেই অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী সার্ক দেশের সরকার প্রধানদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সিং করেছেন। এরপর তিনি জেলা প্রশাসক বা বিভাগীয় কমিশনারদের সঙ্গেও ভিডিও কনফারেন্সিং করে যাচ্ছেন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী বা মন্ত্রীগণ নিজের বাড়িতে বসেই তাদের কর্ম সম্পাদন করছেন। বস্তুত অফিসও ডিজিটাল পদ্ধতিতে চলতে পারে। আমাদের ই-নথি সরকারি কাজ করার সকল সক্ষমতা নিয়েই তৈরি করা। ফলে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ডিজিটাল পদ্ধতিতে সকল স্তরেই ব্যবহৃত হতে পারে। এরই মাঝে অনেক হুয়াটসঅ্যাপ-ম্যাসেঞ্জারে গ্রুপ করে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। কোন কোন বেসরকারি সংস্থাও সভা-আলোচনা-সিদ্ধান্তগ্রহণসহ অনেক ধরনের কাজ করছে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কেনাকাটাও ডিজিটাল পদ্ধতিতেই হতে পারে। ডিজিটাল কমার্স ব্যবস্থা সক্রিয় করে সকলেই তাদের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে পারেন। আর্থিক লেনদেনের জন্য কেবল মোবাইল অর্থ সেবা নয় ব্যাঙ্কগুলোর অ্যাপ ও ওয়ালেট আছে। সরকারের সেবা দেবার মতো নেটওয়ার্ক এরই মাঝে গড়ে ওঠেছে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার ছাড়াও ডাক বিভাগ তার ডিজিটাল রূপান্তরের মধ্য দিয়ে সরকারের সেবার পাশাপাশি ডিজিটাল কমার্সে ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে। সামগ্রিকভাবে বলা যেতে পারে যে করোনার মতো পরিস্থিতি হোক বা না হোক আমাদের জনগণ ডিজিটাল জীবনধারায় অভ্যস্ত। কোন কোন ক্ষেত্রে দুনিয়ার মানুষদের চাইতেও কিছুটা এগিয়ে। বিশেষ করে আমাদের নতুন প্রজন্মের সন্তানেরা কোন কিছুকেই অসাধ্য মনে করে না।

আজই আমি ফেসবুকে এক ভদ্রমহিলা ও তার মায়ের আলাপের স্ক্রিন শট দেখছিলাম। মেয়ে ৬/৭ বছরের। সে পাশের ঘরে বসে হুয়াটসঅ্যাপে মাকে লিখছে আমি একটা কচ্ছপ কিনবো। মা লিখেছে কচ্ছপের ইংরেজি বলতে পারলে কিনে দেব। মেয়েটি যথারীতি সঠিক ইংরেজি লিখেছে। মাকে সে জিজ্ঞেস করছে, ঠিক হয়েছে? মা বললো হঁযা। মেয়ে লিখছে তাহলে কিনে দাও। মা বললো এখনতো সবই বন্ধ। মেয়ে বলছে অনলাইনে অর্ডার দাও। মা বলছে-সব বন্ধতো। মেয়ে বলছে অনলাইনতো বন্ধ নয়।

আমি নিশ্চিত লাইবা ও তার মায়ের গল্প ঘরে ঘরে আছে। এমন একটি দেশের জনগণকে নিয়ে শঙ্কার কিছু নাই। তবে এবারের করোনাভাইরাস কিছু হুশিয়ারি দিয়ে গেছে।

আমি প্রথম হুশিয়ারিটাকে কর্মসংস্থানের দিকে দেখাতে চাই। আমাদের পোশাক শিল্পের যে অবস্থাটি মাত্র ৩ মাসে তৈরি হয়ে গেলো সেটির কোন প্রতিকার আমরা আদৌ পাবো কিনা জানি না। খুব সঙ্গতকারণেই আমাদেরকে বিবেচনা করতে হবে যে পোশাক কারখানায় ভবিষ্যতে আমাদের সস্তা শ্রমিকের বিকল্প হবে রোবট। বিশ্বের যে প্রান্তেই আমাদের সোয়া কোটি প্রবাসী বসবাস করছে তারাও রোবটের কাছে তাদের চাকরিটা খুইয়ে নিজের দেশে ফিরে আসতে পারে। বিশ্ব রোবোটিক্সের সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডাটা-আইওটি ইত্যাদি ব্যবহার করে অদক্ষ ও অর্ধশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনীয়তা পূরণ করবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা এরকম পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সামান্য সচেতনতা দেখাচ্ছি না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি কোনভাবেই এই নতুন পরিস্থিতির উপযোগী নয়। এক বাক্যে বললে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে যদি ডিজিটাল যুগের উপযোগী না করা যায় তবে আমরা দুনিয়ার নতুন বিপ্লবে শরিকতো হতেই পারবোনা বরং করোনার মতো মহামারীতে যখন মনুষ্যহীন উৎপাদন ব্যবস্থার দিকে মানুষ মনযোগী হবে তখন আমাদের অস্তিত্ত্ব বিপন্ন হবে। এখনই আমরা অনুভব করছি যে আমাদের দিনমজুর, কায়িক শ্রমের মানুষ, বস্তিবাসী এইসব জনগোষ্ঠী বস্তুত এক অসহায় অস্থার মাঝে পৌঁছে গেছে। ব্যবসা বাণিজ্য কোন পথে যাবে-দোকান পাট-কল কারখানা কেমন করে চলবে সেইসব ভাবনার পাশাপাশি এমনকি বেতন ভাতা দেবের মতো বিষয়গুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠেছে। সরকার এরই মাঝে রপ্তানিমুখী খাতের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার সহায়তা ও সাধারণ মানুষের জন্য সহায়তার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। তবে আমাদের জন্য সংকটের বিষয় হচ্ছে আমরা কেউই এখনও নিশ্চিত নয় যে এর শেষ সীমারেখাটি কোথায়।

করোনার প্রভাবে দ্বিতীয় বিষয়টি দৃশ্যমান হলো যে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই ভাইরাসকে যতোটা মোকাবেলা করা সম্ভব হয়েছে আর কোনভাবে সেটি সম্ভব নয়। চীন, কোরিয়া ও জাপান রোবোটিক্স ও বিগডাটাকে এক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের সুফলও পেয়েছে। যে চীনে করোনার উদ্ভব সেই চীন এখন সারা দুনিয়াকে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছে।

করোনার মাঝে বসবাস করে আমি আমাদের সামনের পথচলাকে দু’দিকে প্রবাহমান দেখতে চাই।

১) আমাদের জ্ঞানকর্মী গড়ে তুলতে হবে। এজন্য বিদ্যমান বা প্রচলিত শিক্ষায় যারা শিক্ষিত হয়েছে বা যারা কায়িক শ্রমের দক্ষতা নিয়ে কাজ করছে তাদের ডিজিটাল যুগের উপযোগী জ্ঞানকর্মী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ডিজিটাল দক্ষতা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত কর্মক্ষেত্রগুলো থেকে বাছাই করে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হলে আমাদের মানবসম্পদ রপ্তানি বিপন্ন না হয়ে আরও বেশি গতি পাবে। যদি তা করতে না পারি তবে মানবসম্পদ রপ্তানি স্থবির হবে ও এক সময়ে উল্টো স্রোতে প্রবাহিত হবে। একই সঙ্গে দেশের ডিজিটাল রূপান্তরে নিজের দেশে যেসব পেশাগত পরিবর্তন হবে এবং জ্ঞানকর্মীদের যে চাহিদা তৈরি হবে তার জন্য ডিজিটাল দক্ষতার প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

বড় কাজটি করতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায়। এ শিক্ষার প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চস্তরে বিষয়বস্তু, পাঠ্য উপকরণ, পাঠদান, মূল্যায়ন এবং শিক্ষাদান পদ্ধতিকে সমন্বিতরূপে ডিজিটাল করতে হবে। গত এক দশকে এই খাতে সমন্বয়ের অভাব প্রকট ছিলো। পরিকল্পনার সংকট এবং ডিজিটাল রূপান্তরে গুণগত মান অর্জনে ঘাটতি ছিলো। ডিজিটাল ক্লাসরুম গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু তাতে অপ্রয়োজনীয় উপকরণ ব্যবহার করার পাশাপাশি পেশাগত ডিজিটাল কনটেন্টও প্রদান করা হয়নি। তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা প্রচলন করার পাশাপাশি ডিজিটাল ল্যাব গড়ে তোলা হয়েছে-কিন্তু ল্যাব পরিচালনা ও ব্যবহার সমন্বিত বা পর্যাপ্ত ছিলো না।

সবচেয়ে বড় প্রয়োজনটি হচ্ছে প্রাথমিক স্তর থেকেই প্রোগামিং-রোবোটিক্সের মতো বিষয় যুক্ত করা এবং ডিজিটাল যুগের বিষয়গুলো সকল স্তরে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অংশ হিসেবে চালু করা।

২) আমাদের সকল গুরুত্ব ডিজিটাল প্রযুক্তি গবেষণায় দিতে হবে। আমাদের এখন রোবোটিক্স-কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, আইওটি, বিগডাটা, ব্লক চেইনসহ ডিজিটাল শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ব্যবহারের জন্য সকল শক্তি নিয়োগ করতে হবে।

আমার নিজের ধারণা করোনা পরবর্তীকালে আমাদের আরও কিছু জরুরি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে।

ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০২০।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান; সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-বিজয় ডিজিটাল শিক্ষার প্রণেতা]

mustafajabbar@gmail.com

মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল ২০২০ , ১ বৈশাখ ১৪২৭, ১৯ শাবান ১৪৪১

করোনা ও ডিজিটাল জীবনধারা

মোস্তাফা জব্বার

image

সারা বিশ্বে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয়ের নাম করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯। ব্রিটিশ রাজকুমার, প্রধানমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং সৌদি রাজপরিবারের ১৫০ সদস্যসহ ১১ লাখের মতো আক্রান্ত মানুষ এবং লাখের কাছাকাছি জীবনহানির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব এখন বস্তুত গৃহবন্দী। অতি শক্তিশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে আমাদের মতো দেশ পর্যন্ত সকলেই প্রাথমিকভাবে এই মহামারী থেকে বেঁচে থাকার জন্য সঙ্গনিরোধ, লকডাউন, জনতার সান্ধ্য আইন, সান্ধ্য আইন, ১৪৪ ধারা ইত্যাদি নানা পদ্ধতি গ্রহণ করে যাচ্ছেন। এর শেষ কবে সেই সব নিয়ে বিভিন্ন সময়সীমা বা আলোচনা থাকলেও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না এর সমাপ্তি রেখাটি কোথায় গিয়ে থামবে। চীনের উহান প্রদেশ অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে কোভিড ১৯ মোকাবেলা করে একটি সুস্থির অবস্থায় রয়েছে। সুস্থির থাকার বিষয়ে কোরিয়ার অবস্থাও অনেক ভালো। জাপানও ভালো অবস্থায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন ও ইতালি বস্তুত ভয়ংকর বিপদের শীর্ষে রয়েছে। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাবার কোন পথ তাদের জানা আছে বলে মনে হয় না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এসব বিষয়ে গুজব ছড়ানোর সবচেয়ে বড় মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের দিকেও যদি আমরা তাকাই তবে আমরা মুজিব শতবর্ষের অনুষ্ঠান বাতিল করে ২৬ মার্চ থেকে গৃহবন্দী জীবনযাপন করছি আমরা। এখন পর্যন্ত এই সময়সীমা ২৫ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত নির্দিষ্ট করা রয়েছে। বাংলা নববর্ষ সংক্রান্ত সকল অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে। একদম ন্যূনতম সেবাও আমরা চালু রাখতে হিমসিম খাচ্ছি। সারা বিশ্বের সঙ্গে পুরো দেশের মানুষ একসঙ্গে এরকম অবস্থার মোকাবেলা করেছে বলে আমি আমার একাত্তর বছরের জীবনে স্মরণ করতে পারছি না।

এর প্রভাব কি হবে সেটি এখনই ধারণা করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে সর্ববৃহৎ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী খাত পোশাক শিল্পের ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিতের অবস্থা হিসেব করলে এটি বিশাল আকারের ধস। শিল্প-বাণিজ্য ও আর্থিক খাতসহ সব কিছুতেই স্থবিরতার আশঙ্কা কাজ করছে। কেউ কেউ বলছেন করোনার প্রভাবে বিশ্বে বেকার হতে পারে কোটি কোটি লোক। হতদরিদ্র হয়ে যেতে পারেন ৫০ কোটি লোক। আমেরিকার পুঁজিবাজার ও বিশ্বজুড়ে অন্যান্য পুঁজিবাজারের ধস বিবেচনায় নিলে বিশ্ব অর্থনীতি এখন স্থবিরতার পথে। ডিসেম্বরে শুরু হওয়া বিপদের মাত্র শতাধিক দিনের হিসাব নিলেই মাথার চুল খাঁড়া হয়ে যায়। সামনে কি আছে সেটি ধারণা করাও হয়তো এখন সম্ভব নয়।

তবে একটি বিষয় সম্ভবত আমাদের সবার ধারণাতেই এসেছে যে, বিশ্বটা সত্যি সত্যি ডিজিটাল হয়ে গেছে। এমনকি আমাদের দেশের অতি সাধারণ মানুষও যখন তার গৃহবন্দী জীবন কাটাচ্ছে তখন ডিজিটাল প্রযুক্তিই তার একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহুজনকেই এখন বাড়িতে বসে কাজকর্ম করতে হচ্ছে। কেবলমাত্র সরাসরি কায়িক শ্রমের কাজ ছাড়া বাকি কাজ যে ডিজিটাল পদ্ধতিতে করা যায় তার অফুরন্ত দৃষ্টান্তও স্থাপিত হচ্ছে।

একেবারে ন্যূনতম তথ্যটাও যদি ধরি তবে মোবাইলে কল করা বা ইন্টারনেট ব্রাউজ করা ছাড়া এমনকি দৈনন্দিন জীবনও কাটছে না। এটি কেবল যোগাযোগের মাধ্যম হয়নি এটি কাজের বাহন এবং বিনোদনের প্রধান উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে বর্তমানে ১৫.৯৪ কোটি মোবাইল সংযোগ আছে এবং অন্তত ১০ কোটি লোক মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। এখন প্রায় ১০ কোটি ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে। এখন ৫ মিনিট যদি ইন্টারনেট বন্ধ থাকে তবে আমাদের জীবনের ওপর যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে তা চিন্তাও করা যায় না। অথচ আজ থেকে ১০ বছর আগে ইন্টারনেটের কোন প্রভাবই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ছিলো না। ফেসবুক ব্যবহার করে হাজার হাজার তরুণ নিজের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। অনুমান করা হয় যে দেশের তিন কোটি ৪০ লাখ ব্যবহারকারীর মাঝে প্রায় ১০ লাখ ফেসবুক ব্যবহারকারী এতে ব্যবসা করে। বিপণন ও সামাজিক যোগাযোগের কথা না হয় উল্লেখই করা হলো না। ফেসবুক ছাড়াও অন্যান্য ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সরাসরি জিনিসপত্র বেচাকেনা হচ্ছে। এখন আর ভোক্তাকে বাজারে গিয়ে পছন্দের জিনিস কিনতে হচ্ছে না। ইন্টারনেটে জিনিস পছন্দ করে অর্ডার দিলেই তা বাসায় পৌঁছে যাচ্ছে। মূল্য পরিশোধ করে ভোক্তা তা গ্রহণ করতেও পারছে। মানুষ যতোটুকু সুযোগ-সুবিধা রাষ্ট্রীয়ভাবে পেয়েছে তা সুন্দরভাবে কাজে লাগাতে পেরেছে। যেটা বর্তমানে ডিজিটাল অর্থনীতি হিসেবে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। মানুষ কিন্তু বসে নেই। তার নিজের প্রয়োজনে এগিয়ে যাচ্ছে। যার সুফলটা পাচ্ছে রাষ্ট্র এবং সরকার। এখানে আরো অনেক বেশি কাজ করার সুযোগ আছে। করোনার আত্মপ্রকাশের পর আমরা যখন গৃহবন্দী হয়ে পড়লাম তখন অবস্থা একটি নতুন মাত্রা পেলো।

আমরা যখন ঘর থেকে ঘরে যাতায়াত করতে পারছি না তখন বিশ্বজুড়ে যোগাযোগ কেবলমাত্র এই প্রযুক্তিই প্রদান করছে। আমাদের ব্যান্ডউইদথ ব্যবহারের চিত্রটা দেখলেই আন্দাজ করা যাবে যে জীবনটা কতোটা বদলে গেছে। জানুয়ারি মাসে আমাদের ব্যান্ডউইদথ ব্যবহৃত হতো ১২৭৮ জিবিপিএস। ২৫ মার্চ ব্যবহৃত হতো ১৪০০ জিবিপিএস আর ৯ এপ্রিল ব্যবহৃত হয়েছে ১৫৫৮ জিবিপিএস। মাত্র সঙ্গত কারণেই ভয়েস কল ও ইন্টারনেটের ব্যবহারও বেড়েছে। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে আমেরিকার মোবাইল অপারেটরদের ভয়েস কল শতকরা ৪৪ ভাগ ও ডাটা কল বেড়েছে ৮৮ ভাগ। বস্তুত এই চিত্রটি সারা বিশ্বের। ঘরে বসে অফিস করার কাজটা আমরা অনেকেই এখন করছি। সেদিন আমি টেলিকম বিভাগের বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি বিষয়ক একটি সভা করেছি ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে। এখন করোনা সংক্রান্ত সংবাদ সম্মেলন হয় ডিজিটাল পদ্ধতিতে। টিভিগুলো অংশগ্রহণকারীকে বাড়িতে রেখেই অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী সার্ক দেশের সরকার প্রধানদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সিং করেছেন। এরপর তিনি জেলা প্রশাসক বা বিভাগীয় কমিশনারদের সঙ্গেও ভিডিও কনফারেন্সিং করে যাচ্ছেন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী বা মন্ত্রীগণ নিজের বাড়িতে বসেই তাদের কর্ম সম্পাদন করছেন। বস্তুত অফিসও ডিজিটাল পদ্ধতিতে চলতে পারে। আমাদের ই-নথি সরকারি কাজ করার সকল সক্ষমতা নিয়েই তৈরি করা। ফলে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ডিজিটাল পদ্ধতিতে সকল স্তরেই ব্যবহৃত হতে পারে। এরই মাঝে অনেক হুয়াটসঅ্যাপ-ম্যাসেঞ্জারে গ্রুপ করে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। কোন কোন বেসরকারি সংস্থাও সভা-আলোচনা-সিদ্ধান্তগ্রহণসহ অনেক ধরনের কাজ করছে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কেনাকাটাও ডিজিটাল পদ্ধতিতেই হতে পারে। ডিজিটাল কমার্স ব্যবস্থা সক্রিয় করে সকলেই তাদের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে পারেন। আর্থিক লেনদেনের জন্য কেবল মোবাইল অর্থ সেবা নয় ব্যাঙ্কগুলোর অ্যাপ ও ওয়ালেট আছে। সরকারের সেবা দেবার মতো নেটওয়ার্ক এরই মাঝে গড়ে ওঠেছে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার ছাড়াও ডাক বিভাগ তার ডিজিটাল রূপান্তরের মধ্য দিয়ে সরকারের সেবার পাশাপাশি ডিজিটাল কমার্সে ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে। সামগ্রিকভাবে বলা যেতে পারে যে করোনার মতো পরিস্থিতি হোক বা না হোক আমাদের জনগণ ডিজিটাল জীবনধারায় অভ্যস্ত। কোন কোন ক্ষেত্রে দুনিয়ার মানুষদের চাইতেও কিছুটা এগিয়ে। বিশেষ করে আমাদের নতুন প্রজন্মের সন্তানেরা কোন কিছুকেই অসাধ্য মনে করে না।

আজই আমি ফেসবুকে এক ভদ্রমহিলা ও তার মায়ের আলাপের স্ক্রিন শট দেখছিলাম। মেয়ে ৬/৭ বছরের। সে পাশের ঘরে বসে হুয়াটসঅ্যাপে মাকে লিখছে আমি একটা কচ্ছপ কিনবো। মা লিখেছে কচ্ছপের ইংরেজি বলতে পারলে কিনে দেব। মেয়েটি যথারীতি সঠিক ইংরেজি লিখেছে। মাকে সে জিজ্ঞেস করছে, ঠিক হয়েছে? মা বললো হঁযা। মেয়ে লিখছে তাহলে কিনে দাও। মা বললো এখনতো সবই বন্ধ। মেয়ে বলছে অনলাইনে অর্ডার দাও। মা বলছে-সব বন্ধতো। মেয়ে বলছে অনলাইনতো বন্ধ নয়।

আমি নিশ্চিত লাইবা ও তার মায়ের গল্প ঘরে ঘরে আছে। এমন একটি দেশের জনগণকে নিয়ে শঙ্কার কিছু নাই। তবে এবারের করোনাভাইরাস কিছু হুশিয়ারি দিয়ে গেছে।

আমি প্রথম হুশিয়ারিটাকে কর্মসংস্থানের দিকে দেখাতে চাই। আমাদের পোশাক শিল্পের যে অবস্থাটি মাত্র ৩ মাসে তৈরি হয়ে গেলো সেটির কোন প্রতিকার আমরা আদৌ পাবো কিনা জানি না। খুব সঙ্গতকারণেই আমাদেরকে বিবেচনা করতে হবে যে পোশাক কারখানায় ভবিষ্যতে আমাদের সস্তা শ্রমিকের বিকল্প হবে রোবট। বিশ্বের যে প্রান্তেই আমাদের সোয়া কোটি প্রবাসী বসবাস করছে তারাও রোবটের কাছে তাদের চাকরিটা খুইয়ে নিজের দেশে ফিরে আসতে পারে। বিশ্ব রোবোটিক্সের সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডাটা-আইওটি ইত্যাদি ব্যবহার করে অদক্ষ ও অর্ধশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনীয়তা পূরণ করবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা এরকম পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সামান্য সচেতনতা দেখাচ্ছি না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি কোনভাবেই এই নতুন পরিস্থিতির উপযোগী নয়। এক বাক্যে বললে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে যদি ডিজিটাল যুগের উপযোগী না করা যায় তবে আমরা দুনিয়ার নতুন বিপ্লবে শরিকতো হতেই পারবোনা বরং করোনার মতো মহামারীতে যখন মনুষ্যহীন উৎপাদন ব্যবস্থার দিকে মানুষ মনযোগী হবে তখন আমাদের অস্তিত্ত্ব বিপন্ন হবে। এখনই আমরা অনুভব করছি যে আমাদের দিনমজুর, কায়িক শ্রমের মানুষ, বস্তিবাসী এইসব জনগোষ্ঠী বস্তুত এক অসহায় অস্থার মাঝে পৌঁছে গেছে। ব্যবসা বাণিজ্য কোন পথে যাবে-দোকান পাট-কল কারখানা কেমন করে চলবে সেইসব ভাবনার পাশাপাশি এমনকি বেতন ভাতা দেবের মতো বিষয়গুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠেছে। সরকার এরই মাঝে রপ্তানিমুখী খাতের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার সহায়তা ও সাধারণ মানুষের জন্য সহায়তার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। তবে আমাদের জন্য সংকটের বিষয় হচ্ছে আমরা কেউই এখনও নিশ্চিত নয় যে এর শেষ সীমারেখাটি কোথায়।

করোনার প্রভাবে দ্বিতীয় বিষয়টি দৃশ্যমান হলো যে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই ভাইরাসকে যতোটা মোকাবেলা করা সম্ভব হয়েছে আর কোনভাবে সেটি সম্ভব নয়। চীন, কোরিয়া ও জাপান রোবোটিক্স ও বিগডাটাকে এক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের সুফলও পেয়েছে। যে চীনে করোনার উদ্ভব সেই চীন এখন সারা দুনিয়াকে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছে।

করোনার মাঝে বসবাস করে আমি আমাদের সামনের পথচলাকে দু’দিকে প্রবাহমান দেখতে চাই।

১) আমাদের জ্ঞানকর্মী গড়ে তুলতে হবে। এজন্য বিদ্যমান বা প্রচলিত শিক্ষায় যারা শিক্ষিত হয়েছে বা যারা কায়িক শ্রমের দক্ষতা নিয়ে কাজ করছে তাদের ডিজিটাল যুগের উপযোগী জ্ঞানকর্মী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ডিজিটাল দক্ষতা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত কর্মক্ষেত্রগুলো থেকে বাছাই করে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হলে আমাদের মানবসম্পদ রপ্তানি বিপন্ন না হয়ে আরও বেশি গতি পাবে। যদি তা করতে না পারি তবে মানবসম্পদ রপ্তানি স্থবির হবে ও এক সময়ে উল্টো স্রোতে প্রবাহিত হবে। একই সঙ্গে দেশের ডিজিটাল রূপান্তরে নিজের দেশে যেসব পেশাগত পরিবর্তন হবে এবং জ্ঞানকর্মীদের যে চাহিদা তৈরি হবে তার জন্য ডিজিটাল দক্ষতার প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

বড় কাজটি করতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায়। এ শিক্ষার প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চস্তরে বিষয়বস্তু, পাঠ্য উপকরণ, পাঠদান, মূল্যায়ন এবং শিক্ষাদান পদ্ধতিকে সমন্বিতরূপে ডিজিটাল করতে হবে। গত এক দশকে এই খাতে সমন্বয়ের অভাব প্রকট ছিলো। পরিকল্পনার সংকট এবং ডিজিটাল রূপান্তরে গুণগত মান অর্জনে ঘাটতি ছিলো। ডিজিটাল ক্লাসরুম গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু তাতে অপ্রয়োজনীয় উপকরণ ব্যবহার করার পাশাপাশি পেশাগত ডিজিটাল কনটেন্টও প্রদান করা হয়নি। তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা প্রচলন করার পাশাপাশি ডিজিটাল ল্যাব গড়ে তোলা হয়েছে-কিন্তু ল্যাব পরিচালনা ও ব্যবহার সমন্বিত বা পর্যাপ্ত ছিলো না।

সবচেয়ে বড় প্রয়োজনটি হচ্ছে প্রাথমিক স্তর থেকেই প্রোগামিং-রোবোটিক্সের মতো বিষয় যুক্ত করা এবং ডিজিটাল যুগের বিষয়গুলো সকল স্তরে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অংশ হিসেবে চালু করা।

২) আমাদের সকল গুরুত্ব ডিজিটাল প্রযুক্তি গবেষণায় দিতে হবে। আমাদের এখন রোবোটিক্স-কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, আইওটি, বিগডাটা, ব্লক চেইনসহ ডিজিটাল শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ব্যবহারের জন্য সকল শক্তি নিয়োগ করতে হবে।

আমার নিজের ধারণা করোনা পরবর্তীকালে আমাদের আরও কিছু জরুরি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে।

ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০২০।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান; সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-বিজয় ডিজিটাল শিক্ষার প্রণেতা]

mustafajabbar@gmail.com