করোনায় কী করা দরকার, কী করছি

সালাম জুবায়ের

পৃথিবী নামের আমাদের এই গ্রহ এখন সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। আমরা যারা এখন বেঁচে আছি তাদের জীবনে এ ধরনের মহাদুর্যোগ আর কখনও আসেনি। সর্বগ্রাসী এই মহাদুর্যোগ কোন বিশেষ দেশ, জাতি বা গোষ্ঠী নয়, পুরো মানব জাতিকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। মানব বিনাশী এই মহাদুর্যোগের নাটের গুরু করোনা নামের এই দানব তার ধ্বংসযজ্ঞ আর কত দিন চালাবে, কোথায় গিয়ে থামবে তা কেউ বলতে পারছে না। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের হাজার হাজার বছরের বিবর্তনের ধারায় এবং বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে নানা আবিষ্কার ও ক্রম বিকাশের নিরন্তর প্রচেষ্টার ফলে যে ক্ষমতা মানুষ জয় করতে পেরেছে সেই প্রজ্ঞা ও কৌশল ব্যবহার করে কীভাবে এই দানবকে পরাস্ত করা যায়- তা নিয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে চলছে নির্ঘুম গবেষণা। প্রবল ইচ্ছাশক্তি, এতকালের অর্জিত অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও মেধা দিয়ে অচিরেই হয়তো এই দানবকে পরাস্ত করার ‘অস্ত্র’ আবিষ্কার করতে সক্ষম হবে মানুষ। কিন্তু শত চেষ্টা সত্ত্বেও যতক্ষণ না করোনা বধের পরম আকাক্সিক্ষত সেই ‘অস্ত্র’ মানুষের করায়ত্ব হচ্ছে ততদিন করোনাকে রুখতে আপতকালীন কিন্তু ব্যবস্থার প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। করোনার ভাবগতি বিশ্লেষণ করে বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে স্বল্পমেয়াদি প্রাথমিক কিছু ব্যবস্থার দিক নির্দেশনা দিয়েছে। এ মুহূর্তে করোনা রুখতে সবার পরামর্শ একটাই, তা হলো; বাড়ি থেকে বের না হওয়া, করোনার উপসর্গ দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসা দেয়া এবং সঙ্গহীন থাকা। সে সঙ্গে সাবান-পানি দিয়ে ঘনঘন হাত ধোয়া। এ গুলো করতে পারলে করোনা সংক্রমণ রোধ করার সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যে এসব ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করে করোনা বধের ক্ষেত্রে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য ফল পেয়েছে।

আমাদের দেশের সব মানুষের পক্ষে এসব বিষয় বাস্তবায়ন এবং মেনে চলা মোটেই কঠিন কাজ নয়। কিন্তু করোনা প্রাদুর্ভাব প্রবল প্রতাপে ছড়িয়ে পড়ার এক মাস পরও আমরা বাংলাদেশে এসব নিয়ম-নীতির কতটুকু বাস্তবায়ন এবং মেনে চলতে পারছি? এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে আরেকটি প্রশ্নের উত্তর সবচেয়ে জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। তা হলো; আমরা কি করোনা থেকে বাঁচতে বাড়ি থেকে না বের হওয়া, জনসমাবেশ এড়িয়ে চলা, সঙ্গনিরোধ, ব্যাপকভিত্তিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করা- এসব বাস্তবায়ন করতে বা মেনে চলতে চেষ্টা করেছি? এর উত্তর ইতিবাচক নয়। আমরা হয়তো চেষ্টা করেছি কিন্তু সে চেষ্টা ফল পাওয়ার মতো চেষ্টা নয় কিছুতেই। সংবাদপত্রের পাতা আর টিভি পর্দায় চোখ রাখলে আমাদের রাস্তা-ঘাটের অবস্থা আমরা পরিষ্কার দেখতে পাই। ঘর থেকে বের হওয়ার নির্দেশ যদি আমরা মানতাম তবে টিভিতে লকডাউনের মধ্যেও হাট-বাজার-সড়কে এমন জনসমাবেশ হওয়ার চিত্র দেখতে পারার কথা নয়।

সবাই বলছেন, বিশেষ করে সরকার এবং এ সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞরা, করোনাভাইরাসের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সরকার এবং জনগণকে সমানভাবে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে হবে। এখানে কোন এক পক্ষের কাজে প্রত্যাশানুযায়ী সাফল্য আসবে না। চিকিৎসাকর্মীদের কর্মকা- এই কার্যক্রমের মধ্যেই পড়ে। সরকারকে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং জনসাধারণসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সে নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে হবে। এটাই এই মুহূর্তে আমাদের সবার- সরকার ও জনগণ- দায়িত্ব। কিন্তু তার কতটা আমরা করতে পারছি। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রকৃত অবস্থা আশা জাগানিয়া নয়।

এবার প্রথম সরকারের কার্যক্রমের কথায় আসি। সরকার করোনা থেকে রক্ষা পেতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছে- এটা সত্য। সরকারের চেষ্টায় কোন কমতি নেই। কিন্তু সে প্রচেষ্টা কতটা ‘আপটু দা মার্ক’? তা নিয়েই প্রশ্ন। সবারই কথা, প্রথম দিকে সরকারের করোনা মোকাবিলার পরিকল্পনা কিছুটা অগোছালো হয়ে পড়েছিল। চাহিদা অনুযায়ী পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ঘাটতি দেখা গেছে। সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ প্রথম দিকে পুরো পরিস্থিতি সামাল দিতে অনেকটা খেই হারিয়ে ফেলেছিল বলা যায়। তাদের খেই হারিয়ে ফেলার ব্যাপারটি তাদের কার্যক্রম দেখে সবাই অনুধাবন করতে পেরেছেন। সংবাদপত্র ও টিভি এ নিয়ে কম-বেশি খবরও পরিবেশন করা হয়েছে। কোন পরিকল্পনা বা কোন কাজটা আগে করা উচিত সেটা তো সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগই ভালো জানার কথা এবং কোন কাজ এ মুহূর্তে করতে হবে সেটা নির্ধারণ করার দায়িত্বও তো তাদের। কিন্তু তারা তা করতে পেরেছেন বলে মনে হয়নি অনেকেরই। শুধু গত ৭/৮ দিনে বিভিন্ন সংবাদপত্রে যেসব খবর-প্রতিবেদন-ছবি ছাপা হয়েছে এবং টিভি পর্দায় দেখানো হয়েছে তা থেকে স্পষ্ট বলা যায় স্বাস্থ্য বিভাগ তার কাছে সরকারের প্রত্যাশিত কাজে উল্লেখ করার মতো সাফল্য দেখাতে পারেনি। স্বাস্থ্য বিভাগের ব্যর্থতার ব্যাপারে বেশি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে না গিয়ে বলা যায় স্বাস্থ্য বিভাগের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে দেশের সরকারি-বেসরকারি সব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান। স্বাস্থ্য বিভাগের অনুমোদন ছাড়া হাসপাতাল এবং চিকিৎসা পেশার একটি পাতাও নড়ে না। সেই স্বাস্থ্য বিভাগ করোনাভাইরাসের সর্বগ্রাসী হামলার সময় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোকেই বাগে আনতে পারেনি বা বাগে আনতে চেষ্টা করেনি। অন্য অর্থে বলা অনুচিত নয় যে, সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই করোনা যুদ্ধে সরকারকে যথাযথভাবে এবং প্রয়োজনানুযায়ী সহযোগিতা করেনি। বরং অনেক ক্ষেত্রে অসহযোগিতা করেছে বললে ভুল বলা হবে না। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগ সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে পারেনি। সংবাদপত্রে এমনও লেখা হয়েছে যে, করোনা চিকিৎসা দিতে হবে সে কারণে অনেক হাসপাতাল বন্ধ করে দিয়ে মালিক- ডাক্তাররা বাড়িতে লুকিয়ে থেকেছে, এসব দেখভাল করার কথা তো স্বাস্থ্য বিভাগের। কি কারণে কে হাসপাতাল বন্ধ করে দিল, কোন চিকিৎসক কেন চাকরিতে অনুপস্থিত থাকলো তা নিয়ে কাজ করার কথা তো স্বাস্থ্য বিভাগেরই। এই কাজটিই তারা বছরের পর ধরে করে আসছেন। অন্য অর্থে এটাই তাদের অন্যতম মূল কাজ।

করোনার হামলার ক্ষেত্রে একটি কথা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো; স্বাস্থ্য বিভাগের প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত ছিল করোনা শনাক্তের পরীক্ষার ব্যবস্থা তৈরি করা। কিন্তু এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিভাগ প্রথম দিকে পুরোপরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তারা যতটা সক্রিয় ছিলেন প্রতিদিন করোনা ব্রিফিং দিতে, করোনা পরীক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করার দিকে তাদের ততটা নজর ছিল না। নজর থাকলে করোনা ছড়ানো অনেকটা কমানো যেত বলে অনেকে মনে করেন। প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর করোনা পরীক্ষার কেন্দ্র ছিল মাত্র একটি। সেখানে দিনে কতটা পরীক্ষা করা সম্ভব ছিল? নমুনা সংগ্রহ করারও কোন ব্যবস্থা বা সংগ্রহ কর্মী ছিল খুবই কম। নারায়ণগঞ্জে করোনা প্রাদুর্ভাব যখন চরম আকার ধারণ করে, তখনও সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে যে, নারায়ণগঞ্জে নমুনা সংগ্রহের কমী ছিল মাত্র দুজন। ঢাকার সবচেয়ে কাছের শহরের যদি এ অবস্থা হয় তবে অন্য জেলার অবস্থা কেমন তা সহজেই অনুমান করা যায়। পরে অবশ্য ঢাকার একাধিক এবং ঢাকার বাইরেও কয়েকটি স্থানে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে করোনা প্রাদুর্ভাব শুরুর পর প্রথম পদক্ষেপেই কেন এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। তা করা হলেতো মানুষকে এত ভয় আর আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হতো না। সাধারণ সচেতন মানুষতো আতঙ্কের মধ্যে ছিল এই ভেবে যে, করোনা হয়েছে কিনা তার পরীক্ষারই কোন ব্যবস্থা নেই, তা হলে করোনা হলেতো মরে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই।

সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রথম কাজ কি হওয়া উচিত ছিল তা নিয়ে আমাদের মতো আম-জনতার বলার বা মন্তব্য করার কিছু নেই। চিকিৎসক আর বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে মন্তব্য করার অধিকার রাখেন। সেই বিশেষজ্ঞরাই দিন-রাত সংবাদপত্র ও টিভির টকশোতে অনবরত বলেছেন; স্বাস্থ্য বিভাগকে প্রথমেই চিকিৎসক এবং চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট সব কর্মীদের দিকে সবচেয়ে বেশি নজর দেয়া উচিত ছিল। কারণ, হোক করোনা বা অন্য কোন রোগব্যাধি- তাদের সঠিক চিকিৎসা দেয়ার সবক্ষেত্রেই চিকিৎসকই, অন্য অর্থে পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা, তার ‘লাইফ লাইন’। সেই ‘লাইফ লাইন’ পুরোটাই ছিল স্বাস্থ্য বিভাগের অবহেলার শিকার- সেটা অনেকেরই অভিযোগ। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা অন্য গ্রহ থেকে আসেননি, তারা এদেশের আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা, এই সমাজের বিদ্যমান চিকিৎসা শিক্ষা এবং সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনারই সৃষ্টি। তারা শুরুতেই জানবেন না, এখন, এই করোনা মহামারির সময়, কোন কাজ প্রথম করা দরকার বা কাকে তাদের প্রথম দরকার, তা কি করে হয়। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখেছি উল্টো চিত্র, চিকিৎসকদের সংগঠিত করে, উদ্বুদ্ধ করে, আস্থায় এনে সংকটকাল উত্তরণের কোন পরিকল্পনা তো দূরের কথা তাদের জন্য ন্যূনতম কোন পেশাদারি দরদ স্বাস্থ্য বিভাগের কারো মধ্যে ছিল না। থাকলে চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সামনে চরম দুঃসময়ে কাজের কোন গাইড লাইন বা সমন্বয় ছিল না কেন? সরকারের উচিত স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে এ প্রশ্নের উত্তর চাওয়া। তবে স্বাস্থ্য বিভাগ উল্টো একটি কাজ ঠিকই করেছেন। তা হলো, ৬ চিকিৎসককে বরখাস্ত করা। অনেকেরই অভিমত, এভাবে চিকিৎসক বরখাস্ত করে ‘জরুরি সেবা কার্যক্রম’ শক্তভিত্তির ওপর দাঁড় করানো প্রায় অসম্ভব। এটা অদক্ষতা এবং অপকর্ম ছাড়া আর কিছু নয়। চিকিৎসকদের বরখাস্ত না করে তাদের আপতকালে কাজে ফিরিয়ে আনাটাই ছিল প্রথম প্রয়োজন। অবস্থা স্বাভাবিক হলে তাদের কাছে কৈফিয়ত চাওয়া যেত। তা না করে ছয়জনকে বাদ দিয়ে চিকিৎসা টিমের শক্তি কমিয়ে ফেলা হলো। এই সাধারণ যুক্তিটা আমজনতা বুঝলেও চিকিৎসা পেশার অভিজ্ঞরা কেন বুঝলেন না তা আমরা বুঝতে পারছি না। ধারণা করা যায় স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের সামগ্রিক ব্যর্থতার দায় এড়াতে কর্তৃপক্ষ তাদের সাসপেন্ড করেছে অন্যায়ভাবে।

অনেক চিকিৎসক করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে অস্বীকার করেছেন বলে সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে, স্বাস্থ্য বিভাগও জানিয়েছে, যাদের বরখাস্ত করা হয়েছে তাদের কেউ কেউ করোনার চিকিৎসা করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। এটা অবশ্যই অপেশাদারসুলভ এবং পেশাদারি অসদাচরণও। বাংলাদেশের চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। সেসব সত্ত্বেও চিকিৎসকদের সুনাম এবং আন্তরিকভাবে সামাজিক দায়িত্ব পালনে উদাহরণ সৃষ্টির ঘটনাও অনেক আছে। তবে নিজের সুরক্ষার চিন্তা করার অধিকার তার যেমন আছে তেমনি আপতকালে কষ্ট স্বীকার করে পেশাদারি দায়িত্ব পালনও তার পেশাদারি শপথের অংশ। একজন পেশাদার লোক কখনোই ঝুঁকির মুখে পড়বেন না তা হলফ করে বলতে পারবেন না। স্বাভাবিক সময়ে আমাদের অনেকের জীবন বিপন্ন হওয়ার মতো অনেক ঘটনা ঘটে।

তবে চিকিৎসকদের দায়িত্ব পালন করা না করা নিয়ে যত কথাই বলি না কেন- তা কখনোই গ্রহণযোগ্য হবে না যদি না কোন ধরনের চিকিৎসার জন্য তার নিজের সুরক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়। আর এটা অবশ্যই করতে হবে পুরো ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের। অন্যজনকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে নিজের জীবনই বিপন্ন হতে পারে এমন অবস্থা বিরাজ করলে অনেক চিকিৎসকই ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’ এ প্রবাদ বাক্য আওড়াতে আওড়াতে চাকরি ছেড়ে চলে যাবেন। এটা সব দেশে সবকালে ইতিহাসেরই শিক্ষা। আমরা তার ব্যতিক্রম হবো- এমনটা আশা করা সমীচীন নয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে করোনা শুরুর প্রথম দিকেই করোনা চিকিৎসার ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের জন্য অতি প্রয়োজনীয় পিপিই সংগ্রহ করতে পারেনি স্বাস্থ্য বিভাগ- এ ব্যর্থতার জবাব কি দেবেন তারা। এভাবে চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিভাগ যে চরম অবহেলা করেছে তার প্রমাণ সময়মতো সব চিকিৎসকের কাছে পিপিই না পৌঁছানো। এর পরিণতি কতটা নির্মম এবং দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকর, মানহানিকর তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি প্রায় অর্ধশতাধিক চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হওয়া এবং সিলেটের চিকিৎসক মইনুদ্দিনের করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। এখন এই অভিযোগ অযৌক্তিক মনে হবে না যে, এভাবে দেশের দুঃসময়ে যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেই চিকিৎসকদের সময়মতো পিপিই সরবরাহ না করে স্রেফ মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এর সম্পূর্ণ দায় স্বাস্থ্য বিভাগ ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেয়া উচিত। এক্ষেত্রে কোন অজুহাত দেখিয়ে তাদের দায় এড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ, ইনিয়ে-বিনিয়ে দেয়া কোন জবাবই গ্রহণযোগ্য হবে না। তাদের করণীয় তারা সময় মতো করতে পারেননি। এ ব্যাপারে কোন কোন কর্মকর্তা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি, যথা সময়ে উদ্যোগ নেননি, তাদের খুঁজে বের করা দরকার এবং তাদের বদলে যোগ্য লোকদের সেখানে বসানো প্রয়োজন। তা না হলে জরুরি প্রয়োজনের কাজের গতি বাড়বে না। সরকার যা সিদ্ধান্ত নেন তা দ্রুত বাস্তবায়ন এবং প্রয়োজনের সময় সরকারকে যথাযথ পরামর্শ দিতে না পারেন কোন কর্মকর্তা, তা হলে তাদের শুধু নামের পাশে বড় বড় ডিগ্রির বহর দেখে বড় বড় পদে বসিয়ে রাখার কোন অর্থ নেই। সরকারের বেতন ভাতা খেয়ে শুরু রুটিন ওয়ার্ক ছাড়া সৃজনশীল, উদ্ভাবনমূলক এবং অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কাজ করার মানসিকতা যাদের নেই তাদের সরকারের বড় পদে আমলা হিসেবে তাদের রাখার কোন প্রয়োজন নেই।

আগেই বলেছি, বিশেজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে করোনা যুদ্ধে একা সরকার কিছু করতে পারবে না যদি শ্রেণী-পেশা নির্বিশেষে দেশের সব মানুষের সম্মিলিত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা এক বিন্দুতে না মেলানো যায়। সরকার সিদ্ধান্ত নিলে তা যদি সাধারণ মানুষ, আমরা যাদের আমজনতা বলে অভিহিত করি, তারা যতক্ষণ না তা পালন বা বাস্তবায়ন করবেন, ততক্ষণ তা সাফল্যের মুখ দেখবে না- এটা সবারই জানা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে দুনিয়ার তাবৎ বিশেষজ্ঞরা বলছেন ‘বাঁচতে হলে ঘরে থাকুন, একে অন্যের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন’। সে অনুযায়ী সরকারও সারা দেশে লকডাউন ঘোষণা করে পথে বের হতে মানুষজনকে বারণ করছেন। এ নিয়ে সংবাদপত্র-টিভিতে অনবরত প্রচারণা চলেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পথে পথে ঘুরে ঘুরে মাইক দিয়ে অনুরোধ করছেন, ‘করোনা থেকে নিজে বাঁচতে, অন্যকে বাঁচাতে, সবাই ঘরে থাকুন’। কিন্তু কে শোনে কার কথা। অপ্রিয় সত্য যে, আমরা আমজনতা সরকারের কোন কথাই এখন কানে তুলছি না। শোনার দরকার শুনছি, আবার নিজে নিজেই ঠিক করছি- দূর, আমার করোনা হবে না, সরকারের এত কথা শুনে লাভ নেই। এমন দম্ভোক্তি করার স্বভাব অনেক সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। ইতিহাসের বীর বাঙালি এখন মৃত্যুকেও ভয় পায় না। ভাবটা এমন যে, মরতে হলে মরব, তবু করোনাকে ভয় পেয়ে ঘরে বসে থাকব না। সংবাদপত্রের পাতা এবং টিভি পর্দায় চোখ রাখলেই দেখা যাচ্ছে অপ্রিয় দৃশ্য, খবর। সংবাদপত্রের পাতায় এবং টিভি পর্দায় দেখানো হচ্ছে- হাটে, ঘাটে, মাঠে, সড়কে মানুষের যেন ঢল নেমেছে। করোনার ভয়ে কেউ ঘরে বসে থাকতে চায় না। দৈনিক সংবাদের করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউন কতটা বাস্তবায়ন হচ্ছে সে সম্পর্কে একটি সরজমিন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে; লকডাউন কি জিনিস তাই অনেক সাধারণ মানুষ জানে না। লকডাউন মানতে তারা বাধ্য সে সম্পর্কে তারা একেবারেই সচেতন নয়। সে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে; অনেকেই বলেন সারাদিন ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগে না তাই পথে বেরিয়ে একটু আড্ডা দিচ্ছি। এই কথাই হচ্ছে আমাদের আমজনতার অধিকাংশের ‘সত্যভাষণ’ এবং সচেতনকার প্রকৃত চিত্র।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সব মানুষই নাকি নিজের জীবনকেই সবচেয়ে বেশি মূল্যবান জিনিস মনে করে। কিন্তু করোনাকবলিত এখনকার বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এবং সড়ক-মহাসড়ক, অলিগলির দিকে তাকালে তা মনে হয় না। চিকিৎসকরা বারবার বলছেন, করোনার কোন অষুধ নেই, এ ভাইরাসে ধরলে মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে। কিন্তু এসব কথা শুনেও মানছেন না বাংলাদেশের মানুষ। এমন ‘অন্ধ’, এমন অপরিণামদর্শী, অবিবেচক, অসচেতন মানুষকে কে রক্ষা করবে? এমন প্রশ্নের উত্তর দেয়ার কেউ নেই।

শনিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২০ , ৫ বৈশাখ ১৪২৭, ২৩ শাবান ১৪৪১

রিপোর্টারের সাতকাহন

করোনায় কী করা দরকার, কী করছি

সালাম জুবায়ের

পৃথিবী নামের আমাদের এই গ্রহ এখন সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। আমরা যারা এখন বেঁচে আছি তাদের জীবনে এ ধরনের মহাদুর্যোগ আর কখনও আসেনি। সর্বগ্রাসী এই মহাদুর্যোগ কোন বিশেষ দেশ, জাতি বা গোষ্ঠী নয়, পুরো মানব জাতিকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। মানব বিনাশী এই মহাদুর্যোগের নাটের গুরু করোনা নামের এই দানব তার ধ্বংসযজ্ঞ আর কত দিন চালাবে, কোথায় গিয়ে থামবে তা কেউ বলতে পারছে না। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের হাজার হাজার বছরের বিবর্তনের ধারায় এবং বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে নানা আবিষ্কার ও ক্রম বিকাশের নিরন্তর প্রচেষ্টার ফলে যে ক্ষমতা মানুষ জয় করতে পেরেছে সেই প্রজ্ঞা ও কৌশল ব্যবহার করে কীভাবে এই দানবকে পরাস্ত করা যায়- তা নিয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে চলছে নির্ঘুম গবেষণা। প্রবল ইচ্ছাশক্তি, এতকালের অর্জিত অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও মেধা দিয়ে অচিরেই হয়তো এই দানবকে পরাস্ত করার ‘অস্ত্র’ আবিষ্কার করতে সক্ষম হবে মানুষ। কিন্তু শত চেষ্টা সত্ত্বেও যতক্ষণ না করোনা বধের পরম আকাক্সিক্ষত সেই ‘অস্ত্র’ মানুষের করায়ত্ব হচ্ছে ততদিন করোনাকে রুখতে আপতকালীন কিন্তু ব্যবস্থার প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। করোনার ভাবগতি বিশ্লেষণ করে বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে স্বল্পমেয়াদি প্রাথমিক কিছু ব্যবস্থার দিক নির্দেশনা দিয়েছে। এ মুহূর্তে করোনা রুখতে সবার পরামর্শ একটাই, তা হলো; বাড়ি থেকে বের না হওয়া, করোনার উপসর্গ দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসা দেয়া এবং সঙ্গহীন থাকা। সে সঙ্গে সাবান-পানি দিয়ে ঘনঘন হাত ধোয়া। এ গুলো করতে পারলে করোনা সংক্রমণ রোধ করার সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যে এসব ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করে করোনা বধের ক্ষেত্রে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য ফল পেয়েছে।

আমাদের দেশের সব মানুষের পক্ষে এসব বিষয় বাস্তবায়ন এবং মেনে চলা মোটেই কঠিন কাজ নয়। কিন্তু করোনা প্রাদুর্ভাব প্রবল প্রতাপে ছড়িয়ে পড়ার এক মাস পরও আমরা বাংলাদেশে এসব নিয়ম-নীতির কতটুকু বাস্তবায়ন এবং মেনে চলতে পারছি? এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে আরেকটি প্রশ্নের উত্তর সবচেয়ে জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। তা হলো; আমরা কি করোনা থেকে বাঁচতে বাড়ি থেকে না বের হওয়া, জনসমাবেশ এড়িয়ে চলা, সঙ্গনিরোধ, ব্যাপকভিত্তিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করা- এসব বাস্তবায়ন করতে বা মেনে চলতে চেষ্টা করেছি? এর উত্তর ইতিবাচক নয়। আমরা হয়তো চেষ্টা করেছি কিন্তু সে চেষ্টা ফল পাওয়ার মতো চেষ্টা নয় কিছুতেই। সংবাদপত্রের পাতা আর টিভি পর্দায় চোখ রাখলে আমাদের রাস্তা-ঘাটের অবস্থা আমরা পরিষ্কার দেখতে পাই। ঘর থেকে বের হওয়ার নির্দেশ যদি আমরা মানতাম তবে টিভিতে লকডাউনের মধ্যেও হাট-বাজার-সড়কে এমন জনসমাবেশ হওয়ার চিত্র দেখতে পারার কথা নয়।

সবাই বলছেন, বিশেষ করে সরকার এবং এ সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞরা, করোনাভাইরাসের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সরকার এবং জনগণকে সমানভাবে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে হবে। এখানে কোন এক পক্ষের কাজে প্রত্যাশানুযায়ী সাফল্য আসবে না। চিকিৎসাকর্মীদের কর্মকা- এই কার্যক্রমের মধ্যেই পড়ে। সরকারকে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং জনসাধারণসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সে নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে হবে। এটাই এই মুহূর্তে আমাদের সবার- সরকার ও জনগণ- দায়িত্ব। কিন্তু তার কতটা আমরা করতে পারছি। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রকৃত অবস্থা আশা জাগানিয়া নয়।

এবার প্রথম সরকারের কার্যক্রমের কথায় আসি। সরকার করোনা থেকে রক্ষা পেতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছে- এটা সত্য। সরকারের চেষ্টায় কোন কমতি নেই। কিন্তু সে প্রচেষ্টা কতটা ‘আপটু দা মার্ক’? তা নিয়েই প্রশ্ন। সবারই কথা, প্রথম দিকে সরকারের করোনা মোকাবিলার পরিকল্পনা কিছুটা অগোছালো হয়ে পড়েছিল। চাহিদা অনুযায়ী পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ঘাটতি দেখা গেছে। সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ প্রথম দিকে পুরো পরিস্থিতি সামাল দিতে অনেকটা খেই হারিয়ে ফেলেছিল বলা যায়। তাদের খেই হারিয়ে ফেলার ব্যাপারটি তাদের কার্যক্রম দেখে সবাই অনুধাবন করতে পেরেছেন। সংবাদপত্র ও টিভি এ নিয়ে কম-বেশি খবরও পরিবেশন করা হয়েছে। কোন পরিকল্পনা বা কোন কাজটা আগে করা উচিত সেটা তো সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগই ভালো জানার কথা এবং কোন কাজ এ মুহূর্তে করতে হবে সেটা নির্ধারণ করার দায়িত্বও তো তাদের। কিন্তু তারা তা করতে পেরেছেন বলে মনে হয়নি অনেকেরই। শুধু গত ৭/৮ দিনে বিভিন্ন সংবাদপত্রে যেসব খবর-প্রতিবেদন-ছবি ছাপা হয়েছে এবং টিভি পর্দায় দেখানো হয়েছে তা থেকে স্পষ্ট বলা যায় স্বাস্থ্য বিভাগ তার কাছে সরকারের প্রত্যাশিত কাজে উল্লেখ করার মতো সাফল্য দেখাতে পারেনি। স্বাস্থ্য বিভাগের ব্যর্থতার ব্যাপারে বেশি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে না গিয়ে বলা যায় স্বাস্থ্য বিভাগের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে দেশের সরকারি-বেসরকারি সব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান। স্বাস্থ্য বিভাগের অনুমোদন ছাড়া হাসপাতাল এবং চিকিৎসা পেশার একটি পাতাও নড়ে না। সেই স্বাস্থ্য বিভাগ করোনাভাইরাসের সর্বগ্রাসী হামলার সময় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোকেই বাগে আনতে পারেনি বা বাগে আনতে চেষ্টা করেনি। অন্য অর্থে বলা অনুচিত নয় যে, সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই করোনা যুদ্ধে সরকারকে যথাযথভাবে এবং প্রয়োজনানুযায়ী সহযোগিতা করেনি। বরং অনেক ক্ষেত্রে অসহযোগিতা করেছে বললে ভুল বলা হবে না। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগ সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে পারেনি। সংবাদপত্রে এমনও লেখা হয়েছে যে, করোনা চিকিৎসা দিতে হবে সে কারণে অনেক হাসপাতাল বন্ধ করে দিয়ে মালিক- ডাক্তাররা বাড়িতে লুকিয়ে থেকেছে, এসব দেখভাল করার কথা তো স্বাস্থ্য বিভাগের। কি কারণে কে হাসপাতাল বন্ধ করে দিল, কোন চিকিৎসক কেন চাকরিতে অনুপস্থিত থাকলো তা নিয়ে কাজ করার কথা তো স্বাস্থ্য বিভাগেরই। এই কাজটিই তারা বছরের পর ধরে করে আসছেন। অন্য অর্থে এটাই তাদের অন্যতম মূল কাজ।

করোনার হামলার ক্ষেত্রে একটি কথা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো; স্বাস্থ্য বিভাগের প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত ছিল করোনা শনাক্তের পরীক্ষার ব্যবস্থা তৈরি করা। কিন্তু এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিভাগ প্রথম দিকে পুরোপরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তারা যতটা সক্রিয় ছিলেন প্রতিদিন করোনা ব্রিফিং দিতে, করোনা পরীক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করার দিকে তাদের ততটা নজর ছিল না। নজর থাকলে করোনা ছড়ানো অনেকটা কমানো যেত বলে অনেকে মনে করেন। প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর করোনা পরীক্ষার কেন্দ্র ছিল মাত্র একটি। সেখানে দিনে কতটা পরীক্ষা করা সম্ভব ছিল? নমুনা সংগ্রহ করারও কোন ব্যবস্থা বা সংগ্রহ কর্মী ছিল খুবই কম। নারায়ণগঞ্জে করোনা প্রাদুর্ভাব যখন চরম আকার ধারণ করে, তখনও সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে যে, নারায়ণগঞ্জে নমুনা সংগ্রহের কমী ছিল মাত্র দুজন। ঢাকার সবচেয়ে কাছের শহরের যদি এ অবস্থা হয় তবে অন্য জেলার অবস্থা কেমন তা সহজেই অনুমান করা যায়। পরে অবশ্য ঢাকার একাধিক এবং ঢাকার বাইরেও কয়েকটি স্থানে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে করোনা প্রাদুর্ভাব শুরুর পর প্রথম পদক্ষেপেই কেন এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। তা করা হলেতো মানুষকে এত ভয় আর আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হতো না। সাধারণ সচেতন মানুষতো আতঙ্কের মধ্যে ছিল এই ভেবে যে, করোনা হয়েছে কিনা তার পরীক্ষারই কোন ব্যবস্থা নেই, তা হলে করোনা হলেতো মরে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই।

সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রথম কাজ কি হওয়া উচিত ছিল তা নিয়ে আমাদের মতো আম-জনতার বলার বা মন্তব্য করার কিছু নেই। চিকিৎসক আর বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে মন্তব্য করার অধিকার রাখেন। সেই বিশেষজ্ঞরাই দিন-রাত সংবাদপত্র ও টিভির টকশোতে অনবরত বলেছেন; স্বাস্থ্য বিভাগকে প্রথমেই চিকিৎসক এবং চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট সব কর্মীদের দিকে সবচেয়ে বেশি নজর দেয়া উচিত ছিল। কারণ, হোক করোনা বা অন্য কোন রোগব্যাধি- তাদের সঠিক চিকিৎসা দেয়ার সবক্ষেত্রেই চিকিৎসকই, অন্য অর্থে পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা, তার ‘লাইফ লাইন’। সেই ‘লাইফ লাইন’ পুরোটাই ছিল স্বাস্থ্য বিভাগের অবহেলার শিকার- সেটা অনেকেরই অভিযোগ। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা অন্য গ্রহ থেকে আসেননি, তারা এদেশের আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা, এই সমাজের বিদ্যমান চিকিৎসা শিক্ষা এবং সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনারই সৃষ্টি। তারা শুরুতেই জানবেন না, এখন, এই করোনা মহামারির সময়, কোন কাজ প্রথম করা দরকার বা কাকে তাদের প্রথম দরকার, তা কি করে হয়। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখেছি উল্টো চিত্র, চিকিৎসকদের সংগঠিত করে, উদ্বুদ্ধ করে, আস্থায় এনে সংকটকাল উত্তরণের কোন পরিকল্পনা তো দূরের কথা তাদের জন্য ন্যূনতম কোন পেশাদারি দরদ স্বাস্থ্য বিভাগের কারো মধ্যে ছিল না। থাকলে চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সামনে চরম দুঃসময়ে কাজের কোন গাইড লাইন বা সমন্বয় ছিল না কেন? সরকারের উচিত স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে এ প্রশ্নের উত্তর চাওয়া। তবে স্বাস্থ্য বিভাগ উল্টো একটি কাজ ঠিকই করেছেন। তা হলো, ৬ চিকিৎসককে বরখাস্ত করা। অনেকেরই অভিমত, এভাবে চিকিৎসক বরখাস্ত করে ‘জরুরি সেবা কার্যক্রম’ শক্তভিত্তির ওপর দাঁড় করানো প্রায় অসম্ভব। এটা অদক্ষতা এবং অপকর্ম ছাড়া আর কিছু নয়। চিকিৎসকদের বরখাস্ত না করে তাদের আপতকালে কাজে ফিরিয়ে আনাটাই ছিল প্রথম প্রয়োজন। অবস্থা স্বাভাবিক হলে তাদের কাছে কৈফিয়ত চাওয়া যেত। তা না করে ছয়জনকে বাদ দিয়ে চিকিৎসা টিমের শক্তি কমিয়ে ফেলা হলো। এই সাধারণ যুক্তিটা আমজনতা বুঝলেও চিকিৎসা পেশার অভিজ্ঞরা কেন বুঝলেন না তা আমরা বুঝতে পারছি না। ধারণা করা যায় স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের সামগ্রিক ব্যর্থতার দায় এড়াতে কর্তৃপক্ষ তাদের সাসপেন্ড করেছে অন্যায়ভাবে।

অনেক চিকিৎসক করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে অস্বীকার করেছেন বলে সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে, স্বাস্থ্য বিভাগও জানিয়েছে, যাদের বরখাস্ত করা হয়েছে তাদের কেউ কেউ করোনার চিকিৎসা করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। এটা অবশ্যই অপেশাদারসুলভ এবং পেশাদারি অসদাচরণও। বাংলাদেশের চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। সেসব সত্ত্বেও চিকিৎসকদের সুনাম এবং আন্তরিকভাবে সামাজিক দায়িত্ব পালনে উদাহরণ সৃষ্টির ঘটনাও অনেক আছে। তবে নিজের সুরক্ষার চিন্তা করার অধিকার তার যেমন আছে তেমনি আপতকালে কষ্ট স্বীকার করে পেশাদারি দায়িত্ব পালনও তার পেশাদারি শপথের অংশ। একজন পেশাদার লোক কখনোই ঝুঁকির মুখে পড়বেন না তা হলফ করে বলতে পারবেন না। স্বাভাবিক সময়ে আমাদের অনেকের জীবন বিপন্ন হওয়ার মতো অনেক ঘটনা ঘটে।

তবে চিকিৎসকদের দায়িত্ব পালন করা না করা নিয়ে যত কথাই বলি না কেন- তা কখনোই গ্রহণযোগ্য হবে না যদি না কোন ধরনের চিকিৎসার জন্য তার নিজের সুরক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়। আর এটা অবশ্যই করতে হবে পুরো ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের। অন্যজনকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে নিজের জীবনই বিপন্ন হতে পারে এমন অবস্থা বিরাজ করলে অনেক চিকিৎসকই ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’ এ প্রবাদ বাক্য আওড়াতে আওড়াতে চাকরি ছেড়ে চলে যাবেন। এটা সব দেশে সবকালে ইতিহাসেরই শিক্ষা। আমরা তার ব্যতিক্রম হবো- এমনটা আশা করা সমীচীন নয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে করোনা শুরুর প্রথম দিকেই করোনা চিকিৎসার ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের জন্য অতি প্রয়োজনীয় পিপিই সংগ্রহ করতে পারেনি স্বাস্থ্য বিভাগ- এ ব্যর্থতার জবাব কি দেবেন তারা। এভাবে চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিভাগ যে চরম অবহেলা করেছে তার প্রমাণ সময়মতো সব চিকিৎসকের কাছে পিপিই না পৌঁছানো। এর পরিণতি কতটা নির্মম এবং দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকর, মানহানিকর তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি প্রায় অর্ধশতাধিক চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হওয়া এবং সিলেটের চিকিৎসক মইনুদ্দিনের করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। এখন এই অভিযোগ অযৌক্তিক মনে হবে না যে, এভাবে দেশের দুঃসময়ে যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেই চিকিৎসকদের সময়মতো পিপিই সরবরাহ না করে স্রেফ মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এর সম্পূর্ণ দায় স্বাস্থ্য বিভাগ ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেয়া উচিত। এক্ষেত্রে কোন অজুহাত দেখিয়ে তাদের দায় এড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ, ইনিয়ে-বিনিয়ে দেয়া কোন জবাবই গ্রহণযোগ্য হবে না। তাদের করণীয় তারা সময় মতো করতে পারেননি। এ ব্যাপারে কোন কোন কর্মকর্তা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি, যথা সময়ে উদ্যোগ নেননি, তাদের খুঁজে বের করা দরকার এবং তাদের বদলে যোগ্য লোকদের সেখানে বসানো প্রয়োজন। তা না হলে জরুরি প্রয়োজনের কাজের গতি বাড়বে না। সরকার যা সিদ্ধান্ত নেন তা দ্রুত বাস্তবায়ন এবং প্রয়োজনের সময় সরকারকে যথাযথ পরামর্শ দিতে না পারেন কোন কর্মকর্তা, তা হলে তাদের শুধু নামের পাশে বড় বড় ডিগ্রির বহর দেখে বড় বড় পদে বসিয়ে রাখার কোন অর্থ নেই। সরকারের বেতন ভাতা খেয়ে শুরু রুটিন ওয়ার্ক ছাড়া সৃজনশীল, উদ্ভাবনমূলক এবং অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কাজ করার মানসিকতা যাদের নেই তাদের সরকারের বড় পদে আমলা হিসেবে তাদের রাখার কোন প্রয়োজন নেই।

আগেই বলেছি, বিশেজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে করোনা যুদ্ধে একা সরকার কিছু করতে পারবে না যদি শ্রেণী-পেশা নির্বিশেষে দেশের সব মানুষের সম্মিলিত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা এক বিন্দুতে না মেলানো যায়। সরকার সিদ্ধান্ত নিলে তা যদি সাধারণ মানুষ, আমরা যাদের আমজনতা বলে অভিহিত করি, তারা যতক্ষণ না তা পালন বা বাস্তবায়ন করবেন, ততক্ষণ তা সাফল্যের মুখ দেখবে না- এটা সবারই জানা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে দুনিয়ার তাবৎ বিশেষজ্ঞরা বলছেন ‘বাঁচতে হলে ঘরে থাকুন, একে অন্যের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন’। সে অনুযায়ী সরকারও সারা দেশে লকডাউন ঘোষণা করে পথে বের হতে মানুষজনকে বারণ করছেন। এ নিয়ে সংবাদপত্র-টিভিতে অনবরত প্রচারণা চলেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পথে পথে ঘুরে ঘুরে মাইক দিয়ে অনুরোধ করছেন, ‘করোনা থেকে নিজে বাঁচতে, অন্যকে বাঁচাতে, সবাই ঘরে থাকুন’। কিন্তু কে শোনে কার কথা। অপ্রিয় সত্য যে, আমরা আমজনতা সরকারের কোন কথাই এখন কানে তুলছি না। শোনার দরকার শুনছি, আবার নিজে নিজেই ঠিক করছি- দূর, আমার করোনা হবে না, সরকারের এত কথা শুনে লাভ নেই। এমন দম্ভোক্তি করার স্বভাব অনেক সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। ইতিহাসের বীর বাঙালি এখন মৃত্যুকেও ভয় পায় না। ভাবটা এমন যে, মরতে হলে মরব, তবু করোনাকে ভয় পেয়ে ঘরে বসে থাকব না। সংবাদপত্রের পাতা এবং টিভি পর্দায় চোখ রাখলেই দেখা যাচ্ছে অপ্রিয় দৃশ্য, খবর। সংবাদপত্রের পাতায় এবং টিভি পর্দায় দেখানো হচ্ছে- হাটে, ঘাটে, মাঠে, সড়কে মানুষের যেন ঢল নেমেছে। করোনার ভয়ে কেউ ঘরে বসে থাকতে চায় না। দৈনিক সংবাদের করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউন কতটা বাস্তবায়ন হচ্ছে সে সম্পর্কে একটি সরজমিন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে; লকডাউন কি জিনিস তাই অনেক সাধারণ মানুষ জানে না। লকডাউন মানতে তারা বাধ্য সে সম্পর্কে তারা একেবারেই সচেতন নয়। সে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে; অনেকেই বলেন সারাদিন ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগে না তাই পথে বেরিয়ে একটু আড্ডা দিচ্ছি। এই কথাই হচ্ছে আমাদের আমজনতার অধিকাংশের ‘সত্যভাষণ’ এবং সচেতনকার প্রকৃত চিত্র।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সব মানুষই নাকি নিজের জীবনকেই সবচেয়ে বেশি মূল্যবান জিনিস মনে করে। কিন্তু করোনাকবলিত এখনকার বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এবং সড়ক-মহাসড়ক, অলিগলির দিকে তাকালে তা মনে হয় না। চিকিৎসকরা বারবার বলছেন, করোনার কোন অষুধ নেই, এ ভাইরাসে ধরলে মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে। কিন্তু এসব কথা শুনেও মানছেন না বাংলাদেশের মানুষ। এমন ‘অন্ধ’, এমন অপরিণামদর্শী, অবিবেচক, অসচেতন মানুষকে কে রক্ষা করবে? এমন প্রশ্নের উত্তর দেয়ার কেউ নেই।