কৃষক কি এমন প্রণোদনা চেয়েছিল

নুরুল আলম মাসুদ

করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক তাণ্ডবে ধাক্কা বাংলাদেশেও লেগেছে। বাংলাদেশের মতো জনবহুল ক্ষুদ্র অর্থনীতির দেশের জন্য কারোনাভাইরাসের ফলে সৃষ্ট বিপর্যয় কতটা গভীর হতে পারে তা এখনো অনুমেয় নয়। তবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক আশঙ্কা করছে, করোনাভাইরাসের অভিঘাতে বাংলাদেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ১.১ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে। একই সঙ্গে রেমিট্যান্সও তৈরি পোশাকসহ রপ্তানি আয় হ্রাস যে পাবে তা প্রায় নিশ্চিত; সেই সঙ্গে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থানও হ্রাস পেতে পারে। অর্থনীতিকে সচল রাখতে সরকার যদিও ইতোমধ্যে ৭২, ৭৫০ কোটি টাকার একটি প্রণোদনা ঘোষণা করেছে তবে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখতে এই প্রণোদনা প্যাকেজটি কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে তা নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

ফলে আমাদের ভরসা থাকলো কৃষি। বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, বাংলাদেশের এখনো শতকরা প্রায় ৮৭ ভাগ গ্রামীণ মানুষের আয়ের উৎস কৃষি। দুই-তৃতীয়াংশ গ্রামীণ পরিবার কৃষি ও অকৃষিজ উভয় আয়ের ওপর নির্ভরশীল। শহরে বসবাসকারীদের মধ্যেও ১১ শতাংশ মানুষ সরাসরি কৃষিকাজে যুক্ত। বাংলাদেশ শ্রমশক্তি জরিপের (২০১৩) হিসাব মতে, দেশের মোট শ্রমমক্তির ৪৫.৭ শতাংশ কৃষিতে নিয়োজিত রয়েছে। কিন্তু, করোনার আগ্রাসন থেকে রেহাই পায়নি কৃষি খাতও। পরিবহন লকডাউন এবং আঞ্চলিক লকডাউনের কারণে পণ্যবাজার সংকুচিত হয়েছে, কৃষক তার উৎ?পাদিত ফসল বিক্রি করতে পারছেন না আবার উপকরণ সরবরাহে অপ্রতুলতায় আগামীতে উৎপাদন কমে আসারও শঙ্কা রয়েছে। তাতে আসছে দিনগুলোতে দেশে খাদ্য সঙ্কট দেখা দেয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। গত ৭ এপ্রিল জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে এক ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই যে করোনা প্রভাব, এতে ব্যাপকভাবে খাদ্যাভাব দেখা দেবে বিশ্বব্যাপী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল, সে রকম অবস্থা হতে পারে। তাই কৃষিই হতে পারে একমাত্র খাত, যে খাত আসন্ন মন্দায় জনগণের খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চয়তা, কর্মসংস্থান, এবং দারিদ্র্য হ্রাসকরণের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে কৃষি।

চলতি করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে কৃষকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে গত ১২ এপ্রিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার ঘোষণা দেন। এই প্রণোদনা কৃষকদের আদতে কাজে আসবে কিনা সেই বিতর্ক পরে, কিন্তু সরকার যে কৃষকেদর নিয়ে ভেবেছেন তার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।

প্রথমত, এ প্রণোদনা কৃষকদের জন্য রাষ্ট্রীয় কোন অনুদান, প্রণোদনা বা আর্থিক সহায়তা নয়। এটি কৃষি খাতে ৪% সুদে ঋণ (এটি প্রথমে ৫ শতাংশ ছিল, সমালোচনা হওয়ায় তা ৪ শতাংশ করা হয়েছে); কৃষকরা চাইলে এই তহবিল থেকে ঋণ নিতে পারবে। মজার বিষয় হলো, ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী বড় উদ্যোক্তাদের জন্য ঘোষিত চারটি প্যাকেজের সুদের হার ২ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে। অথচ। ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য ৫ শতাংশ সুদের হার কৃষকের জন্য রীতিমতো গলার কাঁটার মতো বিঁধে যাবে। তাই কৃষকেদের জন্য সুদের হার ২ শতাংশ করা উচিত।

প্রধানমন্ত্রী প্রণোদনা ঘোষণাকালে বলেন, আগামি বাজেটে সারের ভর্তুকি বাবদ ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বিগত পাঁচ বছরের বাজেটের দিকে তাকালে দেখা যায়, এটি গত পাঁচ বছর ধরেই রাখা হচ্ছে। কিন্তু, সংশোধিত বাজেটে দেখা যায় বরাদ্দের ৩০ শতাংশ টাকা কম খরচ করা হয়েছে। তাই এবারও ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও আদতেই কত টাকা কৃষকের ভর্তুকির জন্য খরচ করা হবে সেই সংশয় থেকেই যাচ্ছে।

ইতোমধ্যে বোরো ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এই বছর ২ কোটি ৪ লাখ মেট্রিক টন রোরো চাল উৎ?পাদিত হবে। সরকার ইতোমধ্যে ইতোমধ্যে ৬ লাখ টন ধান এবং ১১ লাখ টন চাল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্স আরো দুই লাখ টন বেশি ক্রয়ের ঘোষণা দেন। তাতে সবমিলিয়ে ১৯ লাখ মেট্রিক টন চাল/ধান ক্রয় করবে। এটি মোট উৎ?পাদিত বোরোর ১০ শতাংশেরও কম? তাহলে বাকি ৯০ শতাংশ ধান কোথায় যাবে, তার জন্য কৃষকরা কী ন্যায্যমূল্য পাবে?

দেশে অঘোষিত লকডাউন চলার কারণে বোরো ধান কাটা, ঘরে তোলা, চাতালে আনা এবং সরকারি গুদাম অবধি নিয়ে আসা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। সেই সঙ্গে ধান কাটার জন্য এক এলাকার শ্রমিক যদি অন্য এলাকায় যেতে না পারে তাহলে ব্যাপকভাবে শ্রমিক সংকট দেখা দিবে এবং কোন কোন এলাকায় দৈনিক মজুরি অনেক বেড়ে যেতে পারে। ইতোমধ্যেই সরকারের নানা উদ্যোগে কৃষি শ্রমিকদের বোরো ধান কাটার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। এই দিকে মিল মালিকরা বলতে শুরু করেছেন, ধানকাটা শুরু হলে এবং সরকার ধান ক্রয় শুরু করলে ধানের দাম পড়ে যাবে; তাই খুব জরুরিভাবে সরকারকে ধানের আগাম মূল্য এবং ধান কাটা শ্রমিকদের জন্য দৈনিক ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা উচিত। তাতে ক্ষুদ্র কৃষকরা ধানের ন্যায্যমূল্য পাবে।

এই মুহূর্তে কৃষকের হাতে কোন টাকা নেই। ফলে বোরো ধান কাটার জন্য শ্রমিকদের টাকা পরিবর্তে ধান দিয়ে পারিশ্রমিক শোধ করা হতে পারে। সরকারের ধানক্রয় নীতিমালায় উপযুক্ত প্রমাণসাপেক্ষে সেই শ্রমিকরা যেন তাদের ধান সরকারের কাছে বিক্রি করতে পারে তার নির্দেশনা প্রদান করা যেতে পারে।

বর্তমানে সরকারি গুদামজাতকৃত মোট ১৭৫১ লাখ টন খাদ্যশস্যের মজুত রয়েছে (১৫/০৩/২০২০)। বৈশ্বিক বিভিন্ন পূর্বাভাসই বলছে, করোনা তা-ব আরও দীর্ঘমেয়াদি হবে এবং লকডাউনের সময়ও বৃদ্ধি পাবে। সেই হিসেবে সরকার অতিদরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য যে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেটি আরো দীর্ঘসময় ধরে চালিয়ে গেলে সরকারি সব গুদামই খালি হয়ে যাবে। তাতে করে সরকারের ২৫ লাখ মেট্রিক টন মজুত করার জন্য যে অবকাঠামো রয়েছে তার পুরোটাই ধানচাল ক্রয় করতে পারে। পাশাপাশি ঘোষিত প্রণোদনা বেসরকারি গুদাম ভাড়া করেও এই ক্রয়সীমা আরও বাড়াতে পারে। এর ফলে আগামীতে খাদ্য সংকটের যে আশঙ্কা রয়েছে তা সরকারের পক্ষে মোকাবিলা করা সহজ হবে।

সরকারের এই কৃষি প্রণোদনাটির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ‘কৃষি খাতে বিশেষ প্রণোদনামূলক পুনঃঅর্থায়ন স্কিম’ গঠন করে একটা সার্কুলার জারি করেছে। তাতে বলা হচ্ছে, শস্য ও ফসল খাত ব্যতীত কৃষির অন্যান্য চলতি মূলধন নির্ভরশীল খাতে এই ঋণ দেয়া হবে। কোনো খাতে ৩০ শতাংশের বেশি ঋণ দেওয়া যাবে না। মূলত, কৃষিঋণ নীতিমালা অনুযায়ী কৃষকের উৎপাদিত ফসল বন্ধক রেখে কৃষিঋণ নিতে হয়। এটার সরকারি নাম হলো ‘শস্য বন্ধকি দলিল’। অর্থাৎ কৃষক তার শস্য একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখবেন। ধান বা যেকোনো শস্য বিক্রি করে ঋণের টাকা আবার ফেরত দেবেন। ১৮ মাসের মধ্যে ঋণ ফেরত দিতে হবে। এর প্রথম ছয় মাস গ্রেস পিরিয়ড থাকবে, মানে এ সময় কিস্তি দেয়া লাগবে না। বাকি ১২ মাসে বারো কিস্তির মাধ্যমে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ঘোষিত প্রণোদনাটি মূলত প্রাতিষ্ঠানিক কৃষকদের সহায়তা করতে। কিন্তু প্রচলতি ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই প্রণোদনা থেকে বর্গাচাষি, অপ্রাতিষ্ঠানিক কৃষি কাজ করেন এবং কৃষি সম্পর্কিত কাজ করে- এমন কৃষকরা কোন সহয়তা পাবেন না। সুতরাং, তাদের জন্য কোন ধরণের সুদ ছাড়াই খানাভিত্তিক আয় ধরে নগদ অর্থ সহায়তা দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের খাদ্য চাহিদার ৯০ শতাংশ জোগানদাতার ৯৩ শতাংশ ক্ষুদ্র ও ভূমিহীন কৃষক। সুতরাং, তাদের জন্য কোন ধরনের সুদ ছাড়াই খানাভিত্তিক আয় ধরে শর্তহীন নগদ অর্থ সহায়তা দিতে হবে।

গত মার্চে দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে বৃষ্টিপাত হয়েছে ৬০ শতাংশ কম। এপ্রিলের এক সপ্তাহ চলে গেলেও এখন পর্যন্ত দেশের বেশির ভাগ এলাকায় বৃষ্টি হয়নি। দেশের ফসলের সবচেয়ে বড় এই মৌসুমে মাঠে আলু, সবজি ও শর্ষে রয়েছে, যেগুলোতে সেচ দিতে হচ্ছে। এক্ষেত্র ক্ষুদ্র কৃষকদের যারা নিজেরাই শ্যালো মেশিনে ইরিগেশন করে, তাদেরও ডিজেল ক্রয়ের জন্য জরুরিভাবে নগদ সহায়তা দিতে হবে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, এপ্রিল ও মে মাসে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টন কৃষিপণ্য বাজারে আসে এবং কৃষকদের জন্য এটাই সবচেয়ে বড় মৌসুম। এই দু’মাসে কৃষকের উৎপাদিত সব পণ্যের লাভজনক মূল্য, সহজ বিপণন কৌশল এবং পরবর্তী ফলনের জন্য উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

লকডাউনের কারণে সঙ্কটে পড়েছে দুগ্ধ খামারিরাও। ইতোমধ্যে তারা বিভিন্ন জায়গায় হাড়ি হাড়ি দুধ পুকুরে ঢেলে দিচ্ছেন- প্রতিবাদ করছেন। গরুর দুধের দাম লিটারপ্রতি ৫০ টাকা থেকে ২৫ টাকায়, এমনকি ১২ টাকায়ও নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিদিন ১৫০ লাখ লিটার দুধ অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ৫৭ কোটি টাকা। আগামী এক মাস এভাবে চলতে থাকলে প্রায় ১৭১০ কোটি টাকার ক্ষতির মধ্যে পড়বেন খামারিরা। একইভাবে সঙ্কটে পড়েছেন পোল্টি খামারিরা। ব্রয়লার মুরগির ডিমের দাম যেমন এক দমই পড়ে গেছে। এক্ষেত্রে আপাতত ত্রাণ হিসেবে চালের সঙ্গে আলু, গম, ডিম ইত্যাদি দেয়া যেতে পারে। পাশাপাশি: করোনাকালীন সময়ে দুগ্ধ ও ব্রয়লার খামার পরিচালনার জন্য এককালীন নগদ ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল প্রদান করা যেতে পারে।

আমাদের সবজি বীজের অর্ধেকটাই আসে চীন, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, জাপান থেকে। এসব দেশও যেহেতু করোনায় আক্রান্ত, কাজেই আগেভাগেই বীজ আমদানির বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেই সঙ্গে সরকার আগামী বাজেটে বীজের জন্য বরাদ্দকৃত ১৫০ কোটি শুধুমাত্র আমদানির জন্য বরাদ্দ না করে স্থানীয় পর্যায়ে বীজ গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য কৃষকেদর কর্মরত সংগঠনগুলোতে বিনিয়োগ করতে পারে।

অবশেষে, প্রতিটি সঙ্কটই আমাদের সামনে একটি সুযোগ উপস্থাপন করে। করোনা ভাইরাস শিল্পভিত্তিক বিশ্ব অর্থনীতিকে প্রায় ধসিয়ে দিলেও আমাদের দেখিয়েছে এই অন্তর্বর্তী পরিস্থিতি এবং অদূর ভবিষ্যতেও কৃষিই আমাদের টিকিয়ে রাখার একমাত্র বিকল্প হতে পারে। একই সঙ্গে নাগরিক, সরকার এ অবস্থার মধ্য দিয়ে খাদ্য অধিকার গুরুত্ব, খাদ্য উৎপাদনকারী কৃষকদের অবদান এবং কৃষি খাতে সরকার আরো বেশি স্বাবলম্বী হওয়ার মূল্য উপলব্ধি করবে।

বুধবার, ২৯ এপ্রিল ২০২০ , ১৫ বৈশাখ ১৪২৭, ৫ রমাজান ১৪৪১

কৃষক কি এমন প্রণোদনা চেয়েছিল

নুরুল আলম মাসুদ

করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক তাণ্ডবে ধাক্কা বাংলাদেশেও লেগেছে। বাংলাদেশের মতো জনবহুল ক্ষুদ্র অর্থনীতির দেশের জন্য কারোনাভাইরাসের ফলে সৃষ্ট বিপর্যয় কতটা গভীর হতে পারে তা এখনো অনুমেয় নয়। তবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক আশঙ্কা করছে, করোনাভাইরাসের অভিঘাতে বাংলাদেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ১.১ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে। একই সঙ্গে রেমিট্যান্সও তৈরি পোশাকসহ রপ্তানি আয় হ্রাস যে পাবে তা প্রায় নিশ্চিত; সেই সঙ্গে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থানও হ্রাস পেতে পারে। অর্থনীতিকে সচল রাখতে সরকার যদিও ইতোমধ্যে ৭২, ৭৫০ কোটি টাকার একটি প্রণোদনা ঘোষণা করেছে তবে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখতে এই প্রণোদনা প্যাকেজটি কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে তা নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

ফলে আমাদের ভরসা থাকলো কৃষি। বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, বাংলাদেশের এখনো শতকরা প্রায় ৮৭ ভাগ গ্রামীণ মানুষের আয়ের উৎস কৃষি। দুই-তৃতীয়াংশ গ্রামীণ পরিবার কৃষি ও অকৃষিজ উভয় আয়ের ওপর নির্ভরশীল। শহরে বসবাসকারীদের মধ্যেও ১১ শতাংশ মানুষ সরাসরি কৃষিকাজে যুক্ত। বাংলাদেশ শ্রমশক্তি জরিপের (২০১৩) হিসাব মতে, দেশের মোট শ্রমমক্তির ৪৫.৭ শতাংশ কৃষিতে নিয়োজিত রয়েছে। কিন্তু, করোনার আগ্রাসন থেকে রেহাই পায়নি কৃষি খাতও। পরিবহন লকডাউন এবং আঞ্চলিক লকডাউনের কারণে পণ্যবাজার সংকুচিত হয়েছে, কৃষক তার উৎ?পাদিত ফসল বিক্রি করতে পারছেন না আবার উপকরণ সরবরাহে অপ্রতুলতায় আগামীতে উৎপাদন কমে আসারও শঙ্কা রয়েছে। তাতে আসছে দিনগুলোতে দেশে খাদ্য সঙ্কট দেখা দেয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। গত ৭ এপ্রিল জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে এক ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই যে করোনা প্রভাব, এতে ব্যাপকভাবে খাদ্যাভাব দেখা দেবে বিশ্বব্যাপী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল, সে রকম অবস্থা হতে পারে। তাই কৃষিই হতে পারে একমাত্র খাত, যে খাত আসন্ন মন্দায় জনগণের খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চয়তা, কর্মসংস্থান, এবং দারিদ্র্য হ্রাসকরণের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে কৃষি।

চলতি করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে কৃষকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে গত ১২ এপ্রিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার ঘোষণা দেন। এই প্রণোদনা কৃষকদের আদতে কাজে আসবে কিনা সেই বিতর্ক পরে, কিন্তু সরকার যে কৃষকেদর নিয়ে ভেবেছেন তার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।

প্রথমত, এ প্রণোদনা কৃষকদের জন্য রাষ্ট্রীয় কোন অনুদান, প্রণোদনা বা আর্থিক সহায়তা নয়। এটি কৃষি খাতে ৪% সুদে ঋণ (এটি প্রথমে ৫ শতাংশ ছিল, সমালোচনা হওয়ায় তা ৪ শতাংশ করা হয়েছে); কৃষকরা চাইলে এই তহবিল থেকে ঋণ নিতে পারবে। মজার বিষয় হলো, ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী বড় উদ্যোক্তাদের জন্য ঘোষিত চারটি প্যাকেজের সুদের হার ২ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে। অথচ। ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য ৫ শতাংশ সুদের হার কৃষকের জন্য রীতিমতো গলার কাঁটার মতো বিঁধে যাবে। তাই কৃষকেদের জন্য সুদের হার ২ শতাংশ করা উচিত।

প্রধানমন্ত্রী প্রণোদনা ঘোষণাকালে বলেন, আগামি বাজেটে সারের ভর্তুকি বাবদ ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বিগত পাঁচ বছরের বাজেটের দিকে তাকালে দেখা যায়, এটি গত পাঁচ বছর ধরেই রাখা হচ্ছে। কিন্তু, সংশোধিত বাজেটে দেখা যায় বরাদ্দের ৩০ শতাংশ টাকা কম খরচ করা হয়েছে। তাই এবারও ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও আদতেই কত টাকা কৃষকের ভর্তুকির জন্য খরচ করা হবে সেই সংশয় থেকেই যাচ্ছে।

ইতোমধ্যে বোরো ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এই বছর ২ কোটি ৪ লাখ মেট্রিক টন রোরো চাল উৎ?পাদিত হবে। সরকার ইতোমধ্যে ইতোমধ্যে ৬ লাখ টন ধান এবং ১১ লাখ টন চাল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্স আরো দুই লাখ টন বেশি ক্রয়ের ঘোষণা দেন। তাতে সবমিলিয়ে ১৯ লাখ মেট্রিক টন চাল/ধান ক্রয় করবে। এটি মোট উৎ?পাদিত বোরোর ১০ শতাংশেরও কম? তাহলে বাকি ৯০ শতাংশ ধান কোথায় যাবে, তার জন্য কৃষকরা কী ন্যায্যমূল্য পাবে?

দেশে অঘোষিত লকডাউন চলার কারণে বোরো ধান কাটা, ঘরে তোলা, চাতালে আনা এবং সরকারি গুদাম অবধি নিয়ে আসা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। সেই সঙ্গে ধান কাটার জন্য এক এলাকার শ্রমিক যদি অন্য এলাকায় যেতে না পারে তাহলে ব্যাপকভাবে শ্রমিক সংকট দেখা দিবে এবং কোন কোন এলাকায় দৈনিক মজুরি অনেক বেড়ে যেতে পারে। ইতোমধ্যেই সরকারের নানা উদ্যোগে কৃষি শ্রমিকদের বোরো ধান কাটার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। এই দিকে মিল মালিকরা বলতে শুরু করেছেন, ধানকাটা শুরু হলে এবং সরকার ধান ক্রয় শুরু করলে ধানের দাম পড়ে যাবে; তাই খুব জরুরিভাবে সরকারকে ধানের আগাম মূল্য এবং ধান কাটা শ্রমিকদের জন্য দৈনিক ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা উচিত। তাতে ক্ষুদ্র কৃষকরা ধানের ন্যায্যমূল্য পাবে।

এই মুহূর্তে কৃষকের হাতে কোন টাকা নেই। ফলে বোরো ধান কাটার জন্য শ্রমিকদের টাকা পরিবর্তে ধান দিয়ে পারিশ্রমিক শোধ করা হতে পারে। সরকারের ধানক্রয় নীতিমালায় উপযুক্ত প্রমাণসাপেক্ষে সেই শ্রমিকরা যেন তাদের ধান সরকারের কাছে বিক্রি করতে পারে তার নির্দেশনা প্রদান করা যেতে পারে।

বর্তমানে সরকারি গুদামজাতকৃত মোট ১৭৫১ লাখ টন খাদ্যশস্যের মজুত রয়েছে (১৫/০৩/২০২০)। বৈশ্বিক বিভিন্ন পূর্বাভাসই বলছে, করোনা তা-ব আরও দীর্ঘমেয়াদি হবে এবং লকডাউনের সময়ও বৃদ্ধি পাবে। সেই হিসেবে সরকার অতিদরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য যে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেটি আরো দীর্ঘসময় ধরে চালিয়ে গেলে সরকারি সব গুদামই খালি হয়ে যাবে। তাতে করে সরকারের ২৫ লাখ মেট্রিক টন মজুত করার জন্য যে অবকাঠামো রয়েছে তার পুরোটাই ধানচাল ক্রয় করতে পারে। পাশাপাশি ঘোষিত প্রণোদনা বেসরকারি গুদাম ভাড়া করেও এই ক্রয়সীমা আরও বাড়াতে পারে। এর ফলে আগামীতে খাদ্য সংকটের যে আশঙ্কা রয়েছে তা সরকারের পক্ষে মোকাবিলা করা সহজ হবে।

সরকারের এই কৃষি প্রণোদনাটির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ‘কৃষি খাতে বিশেষ প্রণোদনামূলক পুনঃঅর্থায়ন স্কিম’ গঠন করে একটা সার্কুলার জারি করেছে। তাতে বলা হচ্ছে, শস্য ও ফসল খাত ব্যতীত কৃষির অন্যান্য চলতি মূলধন নির্ভরশীল খাতে এই ঋণ দেয়া হবে। কোনো খাতে ৩০ শতাংশের বেশি ঋণ দেওয়া যাবে না। মূলত, কৃষিঋণ নীতিমালা অনুযায়ী কৃষকের উৎপাদিত ফসল বন্ধক রেখে কৃষিঋণ নিতে হয়। এটার সরকারি নাম হলো ‘শস্য বন্ধকি দলিল’। অর্থাৎ কৃষক তার শস্য একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখবেন। ধান বা যেকোনো শস্য বিক্রি করে ঋণের টাকা আবার ফেরত দেবেন। ১৮ মাসের মধ্যে ঋণ ফেরত দিতে হবে। এর প্রথম ছয় মাস গ্রেস পিরিয়ড থাকবে, মানে এ সময় কিস্তি দেয়া লাগবে না। বাকি ১২ মাসে বারো কিস্তির মাধ্যমে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ঘোষিত প্রণোদনাটি মূলত প্রাতিষ্ঠানিক কৃষকদের সহায়তা করতে। কিন্তু প্রচলতি ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই প্রণোদনা থেকে বর্গাচাষি, অপ্রাতিষ্ঠানিক কৃষি কাজ করেন এবং কৃষি সম্পর্কিত কাজ করে- এমন কৃষকরা কোন সহয়তা পাবেন না। সুতরাং, তাদের জন্য কোন ধরণের সুদ ছাড়াই খানাভিত্তিক আয় ধরে নগদ অর্থ সহায়তা দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের খাদ্য চাহিদার ৯০ শতাংশ জোগানদাতার ৯৩ শতাংশ ক্ষুদ্র ও ভূমিহীন কৃষক। সুতরাং, তাদের জন্য কোন ধরনের সুদ ছাড়াই খানাভিত্তিক আয় ধরে শর্তহীন নগদ অর্থ সহায়তা দিতে হবে।

গত মার্চে দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে বৃষ্টিপাত হয়েছে ৬০ শতাংশ কম। এপ্রিলের এক সপ্তাহ চলে গেলেও এখন পর্যন্ত দেশের বেশির ভাগ এলাকায় বৃষ্টি হয়নি। দেশের ফসলের সবচেয়ে বড় এই মৌসুমে মাঠে আলু, সবজি ও শর্ষে রয়েছে, যেগুলোতে সেচ দিতে হচ্ছে। এক্ষেত্র ক্ষুদ্র কৃষকদের যারা নিজেরাই শ্যালো মেশিনে ইরিগেশন করে, তাদেরও ডিজেল ক্রয়ের জন্য জরুরিভাবে নগদ সহায়তা দিতে হবে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, এপ্রিল ও মে মাসে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টন কৃষিপণ্য বাজারে আসে এবং কৃষকদের জন্য এটাই সবচেয়ে বড় মৌসুম। এই দু’মাসে কৃষকের উৎপাদিত সব পণ্যের লাভজনক মূল্য, সহজ বিপণন কৌশল এবং পরবর্তী ফলনের জন্য উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

লকডাউনের কারণে সঙ্কটে পড়েছে দুগ্ধ খামারিরাও। ইতোমধ্যে তারা বিভিন্ন জায়গায় হাড়ি হাড়ি দুধ পুকুরে ঢেলে দিচ্ছেন- প্রতিবাদ করছেন। গরুর দুধের দাম লিটারপ্রতি ৫০ টাকা থেকে ২৫ টাকায়, এমনকি ১২ টাকায়ও নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিদিন ১৫০ লাখ লিটার দুধ অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ৫৭ কোটি টাকা। আগামী এক মাস এভাবে চলতে থাকলে প্রায় ১৭১০ কোটি টাকার ক্ষতির মধ্যে পড়বেন খামারিরা। একইভাবে সঙ্কটে পড়েছেন পোল্টি খামারিরা। ব্রয়লার মুরগির ডিমের দাম যেমন এক দমই পড়ে গেছে। এক্ষেত্রে আপাতত ত্রাণ হিসেবে চালের সঙ্গে আলু, গম, ডিম ইত্যাদি দেয়া যেতে পারে। পাশাপাশি: করোনাকালীন সময়ে দুগ্ধ ও ব্রয়লার খামার পরিচালনার জন্য এককালীন নগদ ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল প্রদান করা যেতে পারে।

আমাদের সবজি বীজের অর্ধেকটাই আসে চীন, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, জাপান থেকে। এসব দেশও যেহেতু করোনায় আক্রান্ত, কাজেই আগেভাগেই বীজ আমদানির বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেই সঙ্গে সরকার আগামী বাজেটে বীজের জন্য বরাদ্দকৃত ১৫০ কোটি শুধুমাত্র আমদানির জন্য বরাদ্দ না করে স্থানীয় পর্যায়ে বীজ গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য কৃষকেদর কর্মরত সংগঠনগুলোতে বিনিয়োগ করতে পারে।

অবশেষে, প্রতিটি সঙ্কটই আমাদের সামনে একটি সুযোগ উপস্থাপন করে। করোনা ভাইরাস শিল্পভিত্তিক বিশ্ব অর্থনীতিকে প্রায় ধসিয়ে দিলেও আমাদের দেখিয়েছে এই অন্তর্বর্তী পরিস্থিতি এবং অদূর ভবিষ্যতেও কৃষিই আমাদের টিকিয়ে রাখার একমাত্র বিকল্প হতে পারে। একই সঙ্গে নাগরিক, সরকার এ অবস্থার মধ্য দিয়ে খাদ্য অধিকার গুরুত্ব, খাদ্য উৎপাদনকারী কৃষকদের অবদান এবং কৃষি খাতে সরকার আরো বেশি স্বাবলম্বী হওয়ার মূল্য উপলব্ধি করবে।