গণপরিবহনে ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য

গত শনিবার বিআরটিএ সদর দফতরের ব্যয় বিশ্লেষণসংক্রান্ত কমিটি দেশের চার শতাধিক রুটে বাস-মিনিবাসের ভাড়া এক লাফে ৮০ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। এর ভিত্তিতে মন্ত্রণালয় ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি করে সুপারিশ করেছে। এ সুপারিশ সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। কমিটি সুপারিশ করেছে, একজন যাত্রী দুটি আসনের টিকিট কিনবেন। দুটি টিকিটের দাম যত আসবে তা থেকে ২০ শতাংশ ছাড় দেয়া হবে। বাড়তি ৮০ শতাংশ ভাড়া দিতে হবে। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, দেশের চার শতাধিক রুটে নতুন ভাড়ার তালিকা তৈরির প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছে। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী নতুন ভাড়ায় যানবাহন চালানো হবে।

করোনাকালে বাস ভাড়া এভাবে বাড়ানো হলে সেটা অমানবিক হবে। এ ধরনের সুপারিশ আক্ষরিক অর্থেই অবাস্তব এবং অগ্রহণযোগ্য। এমন পরিস্থিতিতে বাসের ভাড়া বাড়ানো হলে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে কঠিন প্রভাব পড়বে। এটা ঠিক যে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত। তবে এর জন্য ৮০ শতাংশ বাড়তি ভাড়া যাত্রীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া কোনভাবেই সমীচীন নয়। করোনার বিপর্যয়ে জনসাধারণও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেকের আয় কমে গেছে। কারও কারও চাকরির নিশ্চয়তা নেই, মাসের পর মাস বেতন পাচ্ছেন না। কাজেই, বাস মালিকদের ক্ষতির দায় সাধারণ যাত্রীরা কোনভাবেই নিতে পারেন না।

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে। তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশে তেলের দাম কমালে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর দরকার হয় না। বাংলাদেশ রেলওয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে ট্রেনে ৫০ শতাংশ আসন ফাঁকা রাখছে। কিন্তু ভাড়া বাড়ায়নি। একইভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার শর্ত মেনে যাত্রীবাহী নৌযান চলাচলও শুরু হচ্ছে রোববার থেকে। নৌযান মালিকরাও ভাড়া বাড়াচ্ছেন না। অথচ বাস মালিকরা করোনার বিপর্যয়কে কাজে লাগিয়ে এক লাফে ৮০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়ে দিতে চাচ্ছেন। বিষয়টি দুঃখজনক।

সরকার সব সচল করতে চাইছে জীবিকার জন্য। তাই গণপরিবহন সীমিত আকারে চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অথচ যে যুক্তিতে সড়ক পরিবহনের অন্যতম বাহন বাস ও মিনিবাসের ভাড়া বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে, সেটি কি আসলে মানা হবে? স্বাভাবিক সময়ে তো বাসে টেনে যাত্রী তোলা হয়। এ বাস্তবতায় সামাজিক দূরত্ব মানা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। অর্থাৎ যে উদ্দেশ্যে ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত সে উদ্দেশ্যও মালিক-শ্রমিকদের অসহযোগিতার কারণেই ব্যাহত হতে পারে।

বাড়তি ভাড়ার বিষয়টি আপৎকালীন সিদ্ধান্ত হিসেবে বলা হচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর ভাড়া কমবে-এ নিশ্চয়তা দিতে পারছে না কেউ। যে কোন সংকটে বা অজুহাতে দেশে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ালে তা স্বাভাবিক সময়েও কমানোর কোন নজির নেই। ফলে সার্বিক বিবেচনায় সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় পরিবহন মালিকদের দাবির মুখে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই বাড়তি ভাড়ার বোঝা যাত্রীদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। যদি ভাড়া বাড়ানোর এ সুপারিশ অনুমোদন হয় তবে পরিবহন মালিকদের একচেটিয়া সব চাপই মেনে নেয়া হবে।

আমরা আশা করব, যাত্রী সাধারণের ঘাড়ে বাড়তি চাপ যেন না পড়ে সেদিকেই গুরুত্ব দেয়া হবে। সড়ক পরিবহন খাতের প্রভাবশালী নেতারা যা দাবি করেন সরকারকে তাই মেনে নিতে দেখা যায়। এবার যেন তা না হয় সেদিকে বিশেষভাবে নজর দেয়া উচিত।

দেশের বাস মালিক এবং পরিবহন শ্রমিক নেতারা চিরদিনই লুটেরা ছিল, এবং এখনও লুটেরা। তারা শুধু যাত্রীদেরই লুট করে না, তারা তাদের শ্রমিকদেরও লুট করে। গণপরিবহন থেকে দুই হাজার কোটি টাকার চাঁদা তোলার খবর এখন কারও অজানা নয়। অথচ সেই চঁাঁদার টাকাও বিপর্যয়ের সময় শ্রমিকরা পাননি। সেই টাকাও লোপাট হয়ে গেছে। চাঁদাবাজি বন্ধ করা গেলে পরিবহনের ভাড়া নৈরাজ্যসহ সব বন্ধ হয়ে যাবে। সরকার করোনা পরিস্থিতিতে অন্তত এ কাজটি করে দেখাতে পারে।

করোনা পরিস্থিতিতে পৃথিবীর কোন দেশে বাস ভাড়া বাড়েনি। বরং কমেছে। এর কারণ সেসব দেশে সরকার পরিবহন ব্যবস্থাপনায় ভর্তুকি দিয়েছে। যুক্তরাজ্য ও ভারতসহ অনেক দেশে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে করোনাকালে। করোনাকালে লন্ডনে বাস সেবা চালু রয়েছে। কিন্তু বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়নি। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে ভাড়া মওকুফ করা হয়েছে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে কমানো হয়েছে। অথচ বাস চালকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার খরচ বেড়েছে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বেসরকারি সড়ক পরিবহন খাতে ভর্তুকি দেয়া যেতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দর কমেছে। এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তেলের দাম কমানো হলে গণপরিবহনের ভাড়া বাবদ যাত্রীদের কাছ থেকে এত বেশি অর্থ আদায়ের দরকার পড়ে না। বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার দাবি রাখে।

সোমবার, ০১ জুন ২০২০ , ১৮ জৈষ্ঠ ১৪২৭, ৮ শাওয়াল ১৪৪১

গণপরিবহনে ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য

গত শনিবার বিআরটিএ সদর দফতরের ব্যয় বিশ্লেষণসংক্রান্ত কমিটি দেশের চার শতাধিক রুটে বাস-মিনিবাসের ভাড়া এক লাফে ৮০ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। এর ভিত্তিতে মন্ত্রণালয় ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি করে সুপারিশ করেছে। এ সুপারিশ সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। কমিটি সুপারিশ করেছে, একজন যাত্রী দুটি আসনের টিকিট কিনবেন। দুটি টিকিটের দাম যত আসবে তা থেকে ২০ শতাংশ ছাড় দেয়া হবে। বাড়তি ৮০ শতাংশ ভাড়া দিতে হবে। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, দেশের চার শতাধিক রুটে নতুন ভাড়ার তালিকা তৈরির প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছে। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী নতুন ভাড়ায় যানবাহন চালানো হবে।

করোনাকালে বাস ভাড়া এভাবে বাড়ানো হলে সেটা অমানবিক হবে। এ ধরনের সুপারিশ আক্ষরিক অর্থেই অবাস্তব এবং অগ্রহণযোগ্য। এমন পরিস্থিতিতে বাসের ভাড়া বাড়ানো হলে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে কঠিন প্রভাব পড়বে। এটা ঠিক যে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত। তবে এর জন্য ৮০ শতাংশ বাড়তি ভাড়া যাত্রীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া কোনভাবেই সমীচীন নয়। করোনার বিপর্যয়ে জনসাধারণও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেকের আয় কমে গেছে। কারও কারও চাকরির নিশ্চয়তা নেই, মাসের পর মাস বেতন পাচ্ছেন না। কাজেই, বাস মালিকদের ক্ষতির দায় সাধারণ যাত্রীরা কোনভাবেই নিতে পারেন না।

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে। তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশে তেলের দাম কমালে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর দরকার হয় না। বাংলাদেশ রেলওয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে ট্রেনে ৫০ শতাংশ আসন ফাঁকা রাখছে। কিন্তু ভাড়া বাড়ায়নি। একইভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার শর্ত মেনে যাত্রীবাহী নৌযান চলাচলও শুরু হচ্ছে রোববার থেকে। নৌযান মালিকরাও ভাড়া বাড়াচ্ছেন না। অথচ বাস মালিকরা করোনার বিপর্যয়কে কাজে লাগিয়ে এক লাফে ৮০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়ে দিতে চাচ্ছেন। বিষয়টি দুঃখজনক।

সরকার সব সচল করতে চাইছে জীবিকার জন্য। তাই গণপরিবহন সীমিত আকারে চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অথচ যে যুক্তিতে সড়ক পরিবহনের অন্যতম বাহন বাস ও মিনিবাসের ভাড়া বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে, সেটি কি আসলে মানা হবে? স্বাভাবিক সময়ে তো বাসে টেনে যাত্রী তোলা হয়। এ বাস্তবতায় সামাজিক দূরত্ব মানা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। অর্থাৎ যে উদ্দেশ্যে ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত সে উদ্দেশ্যও মালিক-শ্রমিকদের অসহযোগিতার কারণেই ব্যাহত হতে পারে।

বাড়তি ভাড়ার বিষয়টি আপৎকালীন সিদ্ধান্ত হিসেবে বলা হচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর ভাড়া কমবে-এ নিশ্চয়তা দিতে পারছে না কেউ। যে কোন সংকটে বা অজুহাতে দেশে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ালে তা স্বাভাবিক সময়েও কমানোর কোন নজির নেই। ফলে সার্বিক বিবেচনায় সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় পরিবহন মালিকদের দাবির মুখে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই বাড়তি ভাড়ার বোঝা যাত্রীদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। যদি ভাড়া বাড়ানোর এ সুপারিশ অনুমোদন হয় তবে পরিবহন মালিকদের একচেটিয়া সব চাপই মেনে নেয়া হবে।

আমরা আশা করব, যাত্রী সাধারণের ঘাড়ে বাড়তি চাপ যেন না পড়ে সেদিকেই গুরুত্ব দেয়া হবে। সড়ক পরিবহন খাতের প্রভাবশালী নেতারা যা দাবি করেন সরকারকে তাই মেনে নিতে দেখা যায়। এবার যেন তা না হয় সেদিকে বিশেষভাবে নজর দেয়া উচিত।

দেশের বাস মালিক এবং পরিবহন শ্রমিক নেতারা চিরদিনই লুটেরা ছিল, এবং এখনও লুটেরা। তারা শুধু যাত্রীদেরই লুট করে না, তারা তাদের শ্রমিকদেরও লুট করে। গণপরিবহন থেকে দুই হাজার কোটি টাকার চাঁদা তোলার খবর এখন কারও অজানা নয়। অথচ সেই চঁাঁদার টাকাও বিপর্যয়ের সময় শ্রমিকরা পাননি। সেই টাকাও লোপাট হয়ে গেছে। চাঁদাবাজি বন্ধ করা গেলে পরিবহনের ভাড়া নৈরাজ্যসহ সব বন্ধ হয়ে যাবে। সরকার করোনা পরিস্থিতিতে অন্তত এ কাজটি করে দেখাতে পারে।

করোনা পরিস্থিতিতে পৃথিবীর কোন দেশে বাস ভাড়া বাড়েনি। বরং কমেছে। এর কারণ সেসব দেশে সরকার পরিবহন ব্যবস্থাপনায় ভর্তুকি দিয়েছে। যুক্তরাজ্য ও ভারতসহ অনেক দেশে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে করোনাকালে। করোনাকালে লন্ডনে বাস সেবা চালু রয়েছে। কিন্তু বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়নি। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে ভাড়া মওকুফ করা হয়েছে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে কমানো হয়েছে। অথচ বাস চালকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার খরচ বেড়েছে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বেসরকারি সড়ক পরিবহন খাতে ভর্তুকি দেয়া যেতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দর কমেছে। এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তেলের দাম কমানো হলে গণপরিবহনের ভাড়া বাবদ যাত্রীদের কাছ থেকে এত বেশি অর্থ আদায়ের দরকার পড়ে না। বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার দাবি রাখে।